#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-০৯]
~আফিয়া আফরিন
অন্বেষা একদফা হেসে নিল। হাসি থামলে নাবিলাকে আবার ডাকল,
— “আরে উঠো উঠো। দেখ সামির, কি বর তুই? তোর বউ তোকে চিনতেই পারছে না।”
— “এটা তো ওর ব্যর্থতা।” সামির ব্যাঙ্গাত্মক চাহনি নিক্ষেপ করল। নাবিলা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। চোখের সামনে সামির ইয়াসিরকে দেখে চোখ কচলে তাকাল। সত্যি নাকি স্বপ্ন? এরইমধ্যে অন্বেষা বলল,
— “শোনো কাহিনী। সামির কিন্তু আমাদের সাথে আসতে চাচ্ছিল না। হয়ত একা একা কোয়ান্টিটি টাইম স্পেন্ড করতে চাইছিল। কিন্তু বউ ছাড়া থাকতে না পেরে ঠিকই চলে এসেছে।”
সামির বিরক্ত হয়ে বলল,
— “চুপ কর। আজাইরা কথা।”
নাবিলা কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
— “এ কোথা থেকে এলো? কেনো এলো?”
সামির বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে বেশ ভাব নিয়ে এগিয়ে এলো,
— “তোমার সমস্যা? আমাকে আমার শশুরমশাই বিশেষভাবে ডাক পাঠিয়েছেন। তাই এসেছি।”
নাবিলা অবাক হলো। বাবার কি দরকার ছিল খাল কেটে কুমির ডেকে নিয়ে আসার? নাবিলা যে ওকে একদম সহ্য করতে পারে না। ভেবেছিল, অন্তত কিছুদিন সামিরের চেহারাটা দেখতে হবে না। কিন্তু না, স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। নাবিলা গম্ভীরভাবে বলল,
— “আমার ঘরে কি করছেন?”
সামির আশপাশে তাকিয়ে কটাক্ষ করল,
— “নাম তো কোথাও লেখা নাই।”
— “নাম লেখা থাকা লাগবে না। এই ঘরে আমি থাকি মানেই আমার ঘর।”
অন্বেষা মুচকি হেসে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ওদের দুটোকে স্পেস দিয়ে ঘর থেকে বের হলো। নাবিলা তেড়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি এখানে থাকতে আসছেন? আমার ঘরে আমার সাথে?”
— “কেনো? তোমার ঘরে থাকতে ভিসা লাগবে নাকি?” সামির ভুরু কুঁচকাল।
— “ভিসা লাগবেই তো, যেহেতু গোপনে এসে আমার জীবন বিপর্যস্ত করেছেন।”
— “এখন পর্যন্ত গোপনে কিছুই করিনি। যা করেছি সামনাসামনি, সবাইকে সাক্ষী রেখে করেছি। গোপনে কিছু করতে হলে দরজা বন্ধ করতে হয়, করব?”
নাবিলা এতদিন ভেবেছিল সামির ত্যাড়া টাইপের, কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে ও অসভ্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বলল কী কথাটা? ছিঃ ছিঃ। বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে মনে সে হতাশায় ডুবে গেল, সামির ইয়াসিরের আর কত রূপ দেখতে হবে তাকে? নাবিলা নিঃশ্বাস আটকে ওর কথা হজম করার চেষ্টা করল।
সামির একধাপ এগিয়ে এসে নাবিলাকে এক হাতে সাইডে সরিয়ে দিলো, আর নিজেই বিছানায় বসে বালিশে আড়াআড়ি হেলান দিলো। চোখ বন্ধ করে খোশমেজাজে বলল,
— “এক কাপ চা করে নিয়ে আসো তো। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, অনেকক্ষণ জার্নি করেছি। যাও, আমাকে বিরক্ত করো না। চা দিয়ে চলে যাও।”
নাবিলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
— “আপনি কি আমাকে অর্ডার দিচ্ছেন?”
— “তোমাকে অর্ডার দিচ্ছি মানে? তোমাকে কেন অর্ডার দিব? তোমাকে অর্ডার করে আমি কি করবো? আমি তোমাকে চা আনতে বলেছি।”
নাবিলা মাথায় হাত চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই একজীবন যে তার কপাল আর মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে শেষ হবে সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে। বড্ড আফসোস হলো নিজের জন্য। আহারে, শেষে কীনা এই লেখা ছিল!
নাবিলা চা নিয়ে এসে সামিরের সামনে রাখতেই, সামির চোখ বন্ধ করে এক হাত কপালে রেখে আলগা স্বরে বলল,
— “পা টিপে দাও তো।”
নাবিলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। সামিরকে পাশ কাটিয়ে একটা বালিশ তুলে নিয়ে সোজা ওর মুখে চেপে ধরল। সামির লাফ দিয়ে উঠে বসল। বালিশটা সরিয়ে বলল,
— “এটা কি ধরনের বেয়াদবি? তুমি কি আমায় মেরে জেলে যেতে চাচ্ছো?”
— “হুমম।”
সামির ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল,
— “আমাকে মারা এত সোজা না। কই মাছের প্রাণ। তোমার মত হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে আমাকে মারার সাহস করো না প্লিজ। তাহলে একসময় নিজের সাহসে নিজেই দ্বিধায় পড়ে যাবে, লজ্জা পাবে।”
— “আমি না আপনাকে দেখে নিব।” বলেই নাবিলা দরজার দিকে পা বাড়াল।
সামির খানিকটা গলা উঁচিয়ে বলল,
— “দেখে নিবে? আচ্ছা, আমি কি পরীক্ষার খাতা নাকি যে আমাকে দেখে নম্বর কেটে দিবে?”
— “উঁহু। আপনি যা তাই। আপনাকে আমি আপনার মত করেই দেখে নিব।” নাবিলা হিসহিসিয়ে উত্তর দিল।
— “ঠিক আছে। তবে আগে নিজের চোখের পাওয়ার বাড়িয়ে নিও… নইলে আমার এই সুদর্শন চেহারা মিস করবা। আর হ্যাঁ, সামির ইয়াসির ফ্রি শো না… টিকিট কেটে আসতে হবে।”
নাবিলা শুধু পারল না সামিরকে চোখের আগুনে ভস্ম করে দিতে। ও বিরক্ত মুখে হুঁ হুঁ শব্দ করে দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল আর সামির বালিশে হেলান দিয়ে নিজের হাসিটা চেপে রাখার চেষ্টা করল।
বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই সাবিহা আর জারা হাজির। ওরা নাবিলার বান্ধবী। বাড়ির ভেতর তখনো অতিথির ভিড়। ওরা ভেবেছে, এরা নিশ্চয় নাবিলার আত্মীয়। নাবিলা মুখে কিছু না বলে ওদের ইশারায় ছাদের সিঁড়ির দিকে ডাকল। ছাদে ওঠার পথে মাঝের ল্যান্ডিংয়ে সামির দাঁড়িয়ে ছিল। এক হাতে ফোন, অন্য হাতে চায়ের কাপ। চোখ উঠিয়ে নাবিলার দিকে তাকাল, ঠোঁটের কোণে একধরনের অর্থপূর্ণ হাসি। নাবিলা বিন্দুমাত্র ধার ধারল না, সরাসরি পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সাবিহা একবার সামিরের দিকে তাকিয়ে নাবিলার কানে খুব আস্তে করে বলল,
— “কে রে এটা?”
নাবিলা মুখ শক্ত করে বলল,
— “কে আবার? দেখতে পাচ্ছিস না একটা ছেলে মানুষ।”
— “পরিচয়টা কি?”
— “জানিনা। তবে আমার কাছে মানুষের পর্যায়ে পড়ে না।”
সাবিহা আরও কিছু বলতে নিলেই নাবিলা ওকে থামিয়ে দিল। কিন্তু ছাদে উঠে বাতাসে দাঁড়াতেই জারা বলল,
— “এই, ওটা তোর কেমন কাজিন রে? আগে তো দেখি নাই।”
নাবিলা হালকা হাই তুলে বলল,
— “দূরসম্পর্কের।”
— “থাকে কোথায়?”
— “ও ভিনগ্রহের প্রাণী। গুগল ম্যাপ খুললেও লোকেশন বের করতে পারবি না।”
সাবিহা বলল,
— “তাহলে এত গম্ভীরভাবে তাকাচ্ছিল কেন তোর দিকে?”
নাবিলা ভ্রু তুলে বলল,
— “গম্ভীরভাবে? আরে ও চশমা পরে না, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল আমরা মানুষ নাকি পরী। ওর কথা বাদ দে। ওকে নিয়ে এত কৌতুহল কেন?”
— “ছেলেটা সুন্দর।” জারা বলল, ওর সাথেও সাবিহাও মাথা নাড়ল।
নাবিলা ঠোঁট কামড়ে গম্ভীর মুখে বলল,
— “সুন্দর না বান্দর সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?” তারপর ও খুব সন্তর্পণে সামিরের বিষয়টা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেল। ওদের এত কৌতুহল নাবিলার ভালো লাগল না। কেনো লাগল না, সেটা ও খেয়ালও করল না। হয়ত একটু হিংসে হলো, ওর বান্ধবী ওরই সামনে দাঁড়িয়ে আরেকজনের প্রশংসা করছে, তাকে নিয়ে কথা বলছে, উতলা হচ্ছে। কিন্তু কেনো হবে?
গল্পগুজব করে ছাদ থেকে নামছিল ওরা। সিঁড়ির মুখে এসে হঠাৎ অন্বেষার সাথে ধাক্কা খেল। অন্বেষা কৌতূহলী চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
— “সামির আর ভাইয়াকে দেখেছো কোথাও? আমি অনেকক্ষন পর্যন্ত খুঁজছি। ছাদে আছে নাকি?”
নাবিলা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “আমরা তো ছাদে ছিলাম, সেখানে ওদের টিকিও পাইনি। মনে হয়, বাইরে গেছে।”
অন্বেষা দু’জনে দিকে তাকিয়ে বলল,
— “ওরা কি তোমার ফ্রেন্ড? পরিচয় করিয়ে দাও।”
নাবিলা ঢোঁক গিলল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয় টাইপ অবস্থা হয়েছে। এখন ওরা নাবিলার বিয়ের কথা নির্ঘাত জেনে যাবে। আর হলোও তাই। অন্বেষা ওদেরকে নাবিলার ননাস হিসেবে পরিচয় দিল। জারা, সাবিহা দুজনেই অবাক। বলল,
— “আরে এটা তো ব্রেকিং নিউজ।”
নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “ব্রেকিং না, শকিং নিউজ।” তারপর ওরা একে একে আরও প্রশ্ন শুরু করে দিল। যার আগাও নাই, মাথাও নাই। হঠাৎ করে বিয়ে করল? তাও প্রায় একসপ্তাহ হতে চলল, অথচ ওদের কিছু জানাল না। কারণ কি? এটা কি প্রেমের বিয়ে? প্রেমটা কার দিক থেকে ছিল? নাবিলার দিক থেকে তো মোটেও না, তাহলে সেটা তারা জানতে পারত। জারা জিজ্ঞেস করল,
— “ভাইয়া কি তোকে পছন্দ করেছিল রে?”
এত এত প্রশ্নে নাবিলা বিরক্ত। সেই বিরক্ত ভাব ওর চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল। নিজেকে সামলে জবাব দিল,
— “ওর পছন্দ করার টাইম নাই, ও সবসময় ব্যস্ত থাকে অন্যদের জীবন ঝালিয়ে খেতে।”
— “তাহলে তুই পছন্দ করেছিলি?”
নাবিলা আর ওদের কথার উত্তর দিল না। ওদের নিয়ে বাইরে বের হলো। বিকেলের আকাশে রোদটা নরম, হালকা বাতাসে চারদিক অলস ভঙ্গিতে হেলে পড়েছিল। গাছের পাতাগুলোও শিস বাজাচ্ছিল। অনেকদিন হলো বাইরে এসে ভালো করে নিঃশ্বাস নেওয়া হয় না। মনে হয়, চারপাশের বাতাসও ভারি হয়ে গেছে। নাহ, এভাবে থাকলে নিজেকে ভুলে যেতে হবে। সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। নিজেকে ভোলা মানেই ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ফাঁপা হয়ে যাওয়া। বাহ্যিক সমস্যার কারণে কোনোভাবেই নিজের অস্তিত্বকে তুচ্ছ করা যাবে না। সমস্যাগুলো যতই বড় বা চাপদায়ক হোক, নিজের মূলকে হারালে সবই বৃথা। তবুও মাঝে মাঝে মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে, একটা অদ্ভুত ব্যাকুলতা আসে, যা ঠেকানো যায় না। আচ্ছা যাইহোক, কিন্তু সে জানে, এই অশান্তি ঠেকানোর জন্যও কোনো না কোনো উপায় আছে। হয়তো নিজের ভিতরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, হয়তো ছোট ছোট আনন্দের ছোঁয়ায়, ধীরে ধীরে মনকে শান্ত করার রীতিতে; কোনও না কোনও পথে সে আবার নিজের স্বাভাবিক, স্থির অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে। এছাড়া বাবা তো সবসময় বলেই,
— “নিজেকে যদি নিজে ভালো রাখতে পারো, তাহলে পৃথিবীর কেউই তোমার খারাপ লাগানোর ক্ষমতা রাখে না।” এই কথাগুলো অদৃশ্য ঢাল। বাবা যেমন বলতেন, নিজের মনকে শক্ত রাখা মানেই পৃথিবীর অশান্তির কাছে আপোশ না করা; এটাই নাবিলাকে সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবে।
বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকতেই সামিরকে চোখে পড়ল, কিছুটা দূরেই। তাকে দেখলেই মেজাজটা অস্থিরতায় ঢেকে যায়। তবুও নাবিলা নিজের মনে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করল, শ্বাস গ্রহণে শান্তি খুঁজে নিল যেন অন্তত সাময়িকভাবে অস্থির মনটাকে দমন করতে পারে।
.
সেদিন রাতের আড্ডায় ঘরের পরিবেশটা অন্যরকম ছিল। হাসি, গল্প আর ব্যস্ততার মধ্যে সবাই মেতে উঠেছে। তবুও নাবিলার মন অন্যত্র, একটা চিন্তার ছায়া মাথায় ঘুরছে। আজ কি তাকে সামিরের সাথে একঘরে থাকতে হবে? অতিথির কারণে অন্য ঘরগুলো ফাঁকা নেই, আর সামিরের সাথে একঘরে থাকার ইচ্ছাও নেই। সে চেষ্টা করল, কোনো সমাধান মিলল না। মনে মনে ভাবছে, সামিরও নিশ্চয় সতর্ক। তার কোনো ফাঁদে সহজে পা দেবেনা। নাবিলা উদ্বিগ্ন কিন্তু কৌশল খুঁজে বের করার চেষ্টায় মনোযোগী।
রাতের খাওয়াদাওয়ার সময় নাবিলার দেখা মিলল না। সামির কৌতূহল নিয়ে নাদিমকে জিজ্ঞেস করল,
— “তোমার আপু কোথায়?”
নাদিম বলল,
— “বাগানে গেছে দেখলাম।”
সামির বাগানের দিকে পা বাড়াল। মেয়েটার সাহস সত্যিই প্রশংসনীয়, এই ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে একলা সাপখোপের আড্ডাখানায় এসে বসে আছে। সামির চারপাশে চোখ বুলিয়ে নাবিলাকে সামনেই দেখতে পেল। সে ওইদিকে এগোতে শুরু করল, মুহূর্তেই মশার ভনভন কানে তালা লাগিয়ে দিল। নাবিলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “এখানে কি করছ?”
— “বসে আছি।” নাবিলা নির্বিকার।
— “কেনো?”
নাবিলা চট করেই প্রতিউত্তর করল,
— “আপনাকে বলব কেন?”
— “আমাকেই বলতে হবে।”
নাবিলা ঠোঁট কুঁচকে বলল,
— “বাধ্য নই।”
সামির পাশের দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়াল,
— “আলবৎ বাধ্য।”
নাবিলা ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “অধিকার খাটাচ্ছেন?”
— “হ্যাঁ।” সামিরের কন্ঠে নিশ্চয়তা ছিল।
নাবিলা চট করে বলল,
— “পারবেন না। যান।”
সামির নাবিলার হাত টেনে ধরে বলল,
— “চলো।”
নাবিলা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
— “আশ্চর্য। জোর কাকে দেখাচ্ছেন?”
— “তোমাকে।”
— “আমি যাব না। সারারাত এখানেই বসে থাকব।” নাবিলার কণ্ঠে জেদ ছিল।
সামির ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “মশা বসছে গালে, কামড়াচ্ছে। এরপর সারারাত এখানে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলে সবাই আবার উল্টাপাল্টা কিছু ভাববে। চরিত্রের দিকে আঙ্গুল উঠবে।”
নাবিলা চোখ বড় করে বিস্ময়ে হতবাক হলো। ওইদিকে সামির নির্বিকার চেহারায় দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিলা বসা থেকে উঠে সামনের দিকে পা বাড়াল। পেছন থেকে সামিরের কণ্ঠ শোনা গেল,
— “এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছো?”
নাবিলা থমথমে গলায় বলল,
— “আপনার ফালতু কথা শোনার থেকে ঘরে গিয়ে বসে থাকা ভালো।”
সামির কুটিল হাসি দিয়ে নাবিলার পেছন পেছন এগিয়ে গেল। নাবিলা নিজের মনে গুনগুন করে বলল, “বাবারে বাবা, কই দিলা বিয়া?”
সেই রাতে নাবিলা বিছানার একপাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। মাঝখানে কোলবালিশ রেখে নিজের নিরাপত্তার রেখা টানল। একদম চুপচাপ, কোনো কথা বলল না। সামির অপেক্ষায় ছিল, এই আশায় যে নাবিলা হয়তো কিছু পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু প্রথমবারের মত হতাশ হতে হলো তাকে। নাবিলা কোনো আন্দোলন করল না, একদম শান্ত।
—
সামিররা এসেছে তিনদিন কেটে গেছে। আগামীকাল ফেরার দিন ঠিক করা হয়েছে। এই তিনদিনে নাবিলা বেশ মজা করেছে অন্বেষা আর আয়ানের সঙ্গে, যদিও সামিরও ছিল পাশে। তবে নাবিলা ওকে বিশেষভাবে মনে রাখে না, গোনায়ও ধরে না। চাচাতো ভাইবোন তো একই রক্তের; কিন্তু সামির ইয়াসির এরকম বজ্জাত কিভাবে হলো? সত্যিই কি ও আন্টি-আংকেলের নিজের ছেলে, নাকি দত্তক হিসেবে আনা হয়েছে? চেহারাটা আবার আন্টির সঙ্গে মিলে। হয়তো কালের বিবর্তনে একসাথে থাকতে থাকতে আন্টির চেহারাটা ভুলবশত ওর মধ্যে এসে বসেছে। নাহয় ওমন ভালোমানুষদের এমন বদমাইশ ছেলে হতেই পারে না… কোনোভাবেই না। আজ হঠাৎ অন্বেষা আপু একটা গুরুতর কথা বলে উঠল,
— “তুমি সামিরকে নিজের মনের কথা বলেছো?”
নাবিলা মাথা কাত করে ভাবল, “মনের কথা? আমি কি বলব? সামির যে এমন বজ্জাত, এটা সরাসরি বললে খারাপ দেখাবে তো।” উত্তরে সে হালকা গলায় বলল,
— “উঁহু।”
অন্বেষা লাফ দিয়ে উঠল,
— “এখনও না?”
নাবিলা কিছুটা লাজুকভাবে কাঁধ উঁচু করে বলল,
— “না তো… বলার প্রয়োজন মনে হয়নি।”
অন্বেষা একটু বিরক্তি মিশিয়ে হাসল,
— “তুমি যে বোকা! এগুলো তো বলতে হয়। তুমি ওকে নিয়ে কী ভাবো, কী ফিল করো, সেটা জানাবে না? না জানালে কীভাবে বুঝবে সামির?”
নাবিলা চিন্তিত হলো। অন্বেষা ফের বলল,
— “তবে যাও। আজকেই বলো। কিন্তু বলার জন্য একটা সুন্দর মুহূর্তের দরকার তাই না? এক কাজ করি? তোমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিই। তুমি মাথায় একহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে গিয়ে বলো, ‘হে পতি পরমেশ্বর, আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’ আসো, আসো…”
নাবিলা মাথার মধ্যে ঘুমন্ত সাহসকে চেপে ধরে বলল,
— “অসম্ভব। কোনো মানেই হয় না শাড়ি পড়ে, ঘোমটা দিয়ে…”
অন্বেষা মুখ ভরে হাসল,
— “আজকের দিনটা ঠিক মতো ব্যবহার কর, পরে আর সুযোগ পাবে না। মুহূর্তটা সুন্দর হওয়া দরকার।”
নাবিলা কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই অন্বেষা ওকে টেনে নিয়ে গেল। অন্বেষা দেখেছে, মাঝেমধ্যে সামির আর নাবিলা বেশ ঝগড়া করে। এত ঝগড়া তো বিয়ের শুরুতেই অস্বাভাবিক, তাই অন্বেষা এই পরিকল্পনা করেছে। ওর পরিকল্পনায় বাড়ির অন্যরা কেউ কিছু মনে করল না; বরং উৎসাহ দিল। সবকিছু থেকে সামিরকে দূরে রাখা হলো কারণ ওকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে।
অন্বেষা নাবিলাকে একটা টুকটুকে লাল শাড়ি পড়িয়ে দিল, সাজিয়ে দিল। তারপর মাথায় ঘোমটাও সেট করে দিল। চোখে খুশির ঝিলিক। পরিশেষে বলল,
— “আজকে বোধহয় সামির ফিট খাবে। যাও, ওকে ফিট খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত হও।”
নাবিলা কপাল চাপড়াল, ওরমধ্যে এক ধরনের লাজ-চিন্তার মিশ্রণ। কারণ অন্বেষা ওর হাতে একটি মোমবাতি ধরিয়ে দিয়েছে। ফিসফিস করে বলল,
— “তোমার ঘরের বাতি আমি নিভিয়ে দিয়ে এসেছি। সামিরকে বলেছি ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে। ও বাতি জ্বালানোর আগে এন্ট্রি নাও।”
নাবিলা নার্ভাস হয়ে গুটিগুটি পায়ে ওর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মোমবাতি হাতে ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই আশপাশটা আলোকিত হয়ে উঠল। নরম আলো নাবিলার লাল শাড়ি, সাজসজ্জা আর ঘোমটা উজ্জ্বল করে তুলল তার মুখমন্ডল। সামিরের চোখ সত্যি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না; দৃষ্টিটা সরাসরি নাবিলার দিকে আটকে গেল। সে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিল, কিন্তু এই রহস্যময়ী নারীর রূপের মাধুর্য দেখে উঠে বসল। মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে গিয়েছিল। কেবল চলমান ছিল নাবিলার উপস্থিতি আর সামিরের বিস্ময়। সামির হঠাৎ মুখ খুলল,
— “তুমি…?”
নাবিলা ফাঁকা ঢোঁক গিলল,
— “মনের কথা জানাতে এসেছি আপনাকে।”
সামির খানিক চমকালো,
— “মানে?”
নাবিলা কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে, চোখে চোখ রেখে ওর কাঙ্খিত কথাগুলো বলতে শুরু করল,
— “শোনো, মিস্টার সামির ইয়াসির… তুমি হচ্ছো পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে, বজ্জাত, বদমাশ, নিষ্ঠুর, পাষাণ, হৃদয়হীন, গোঁয়ার, অসভ্য, বর্বর একটা ছেলে। তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমার উচিত নিজেকে সারাজীবনের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা অথবা নিজের গর্দান নিজেই নেয়া। আমার মাঝেসাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে তোমার গলাটা টিপে ধরে বলি, আমাকে কেনো বিয়ে করেছো? দেখো, আজ তোমার জন্য আমি মিষ্টি একটা মুহূর্ত নিয়ে এসেছি। জানো কেনো মিষ্টি? কারণ আমি যে তোমায় আমার মনের কথাগুলো বলতে পারছি। আমি এটা বলতে এসেছি যে, তুমি কতটা বিরক্তিকর। এই যে আজ আমি তোমায় আমার মনের কথা বলে দিলাম, সেটা এতদিন আমার নিয়ন্ত্রণের অংশ ছিল মাত্র। আমার চোখের দিকে তাকাও মিস্টার… দেখো, এইবার আমি বলছি সত্যি বলছি।”
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১০]
~আফিয়া আফরিন
সকাল হতে না হতেই বাড়িটা বিদায়ের ব্যস্ততায় গমগম করছে। আজ সামিরদের রওনা হওয়ার কথা ছিল ভোরবেলায় কিন্তু স্বভাবসিদ্ধভাবে দেরিই হয়ে গেল। অবশেষে সকাল দশটার দিকে গাড়ি গেট পেরোনোর প্রস্তুতি নিল। এতক্ষণে সামির আর নাবিলার দেখা তো দূরের কথা, চোখাচোখিও হয়নি। দু’জন নীরব প্রতিজ্ঞা করেছে, কেউ কারো অস্তিত্ব স্বীকার করবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে, দরজার কাছে হঠাৎই মুখোমুখি…
সামিরের চোখে সেই তীক্ষ্ণ, ঠান্ডা, গো টু হেল টাইপ দৃষ্টি। ভেতরে জমে থাকা বিরক্তি আর রাগ সরাসরি নাবিলার দিকে ছুঁড়ে দিল। গতরাতের ঘটনাটা এখনো তার মাথায় ঘুরছে। যা-ই করুক, ভুলতে পারছে না।
নাবিলা চোখের পলক ফেলল না। তার ভেতরে মৃদু হাসির ঢেউ উঠল। অবশ্যই, সফল অপারেশনের এমন রেজাল্টই তো হওয়া উচিত। গতকাল রাতের দৃশ্যটা মনে পড়তেই নাবিলার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি খেলে গেল। আহারে বেচারা! সামিরের অবস্থা হয়েছিল শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মত, একেবারে ধপাস করে পড়ে গিয়েছিল। না, শরীরে নয়… একেবারে আত্মসম্মানের মাটিতে। নাবিলার ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু হাসি ফুটতেই সামিরের ভ্রূ কুঁচকে গেল। চোখে-মুখে একধরনের “তুমি হাসছো কেন?” ধরনের জিজ্ঞাসা। ব্যাগের স্ট্র্যাপ কাঁধে ঠিক করতে করতে এমনভাবে তাকাল, যে নাবিলা আচমকা হাসি থামাতে বাধ্য হলো। সামির এগিয়ে এসে ঠান্ডা গলায় বলল,
— “এত খুশি লাগছে কেন? গতকাল রাতের কীর্তিতে গর্ব হচ্ছে নাকি?”
নাবিলা হালকা কাঁধ ঝাঁকাল,
— “গর্ব না, শান্তি লাগছে।”
সামির চোখ ছোট করে তাকাল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে বলল,
— “ঠিক আছে, এবার কিন্তু হিসাব মেলাবো। তুমি শুধু অপেক্ষা করো।”
নাবিলা ভ্রূ তুলে বলল,
— “ওপেন চ্যালেঞ্জ করছেন? কিন্তু আমি তো ভয় পাই না।”
— “সে দেখবোনি।”
বলেই সামির দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। তাকে দেখে নাবিলার মনে হলো, সিনেমার ভিলেন শেষ সংলাপ দিয়ে মঞ্চ ছাড়ছে। হুহ… যাওয়ার আগে রেশমা নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অন্বেষা গলা জড়িয়ে ধরল। বলল, খুব তাড়াতাড়ি আবার তাদের দেখা হবে। হয় অন্বেষা আসবে নয়তো নাবিলা যাবে। আয়ানও ভদ্রভাবে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। শুধু ওই অসুরটা চুপচাপ গাড়ির ভেতর বসেছিল। মাথা নিচু করে ফোন স্ক্রল করছিল। নাবিলাকে বিদায় দেওয়া যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তা মনেই করছে না। নাবিলাই এগিয়ে গেল। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল,
— “আবার আসবে তো, সামির? তোমাকে কিন্তু খুব মিস করব… বিশেষ করে তোমার সেই তাকিয়ে থাকাটা। কথা বলার স্টাইল আর, থাক সবার সামনে বেশি কিছু না বলি।”
সামিরও হেসে জবাব দিল,
— “আমি তো এসে গেলাম, এইবার বরং তুমি এসে ঘাটতিটা পূর্ণ করে দিও।”
চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা একচোট হেসে ফেলল। সামির মাথা তুলে কেবল এক সেকেন্ডের জন্য তাকাল, তারপর আবার ফোনে চোখ গুঁজে দিল।
ওরা বিদায় নেওয়ার পর পুরো বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। নাবিলার একটু মন খারাপ হলো, অন্বেষার সাথে ওর বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আর আয়ান ভাইয়াও। বয়সে যথেষ্ট বড় হলেও এ ক’দিনে ওদের সঙ্গে এক অদৃশ্য বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। হাসিঠাট্টা, গল্প, আড্ডা, সব বোধহয় নিয়ে চলে গেল ওরা। তারপর নাবিলা একটু হেসে নিজেকে গুছিয়ে নিল। মনে মনে বলল,
— “ঠিক আছে, আপু আর ভাইয়া চলে গেলেও, ওই অসুরটা তো আপাতত নাই… অন্তত শান্তি পেলাম।”
গেট বন্ধ করে ভেতরে ফিরতে ফিরতে ঠোঁটের কোণে একরকম কুটিল হাসি ফুটে উঠল। ওর মাথায় বুঝি আবার নতুন কোনো পরিকল্পনা জন্ম নিচ্ছে সামির ইয়াসিরকে ফাঁদে ফেলার জন্য।
.
নাবিলা ঠিক করল, কোনোকিছু নিয়ে সে আর মাথা ঘামাবে না। ভর্তি পরীক্ষাটা এখন তার কাছে অনেক বড় কিছু। এতে তো নিজের স্বপ্ন আছেই, সাথে বাবা-মায়েরও স্বপ্ন। এখানে হেরে যাওয়া চলবে না। দিনগুলো তাই নিজের মতো করে সাজিয়ে নিল। টিউশনি শুরু করল, সকালে চা হাতে পড়ার টেবিলে বসছে, বিকালে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা, সন্ধ্যায় নাদিমের সাথে রিমোটের দখল নিয়ে যুদ্ধে নামা; হেরে গেলে চুল টেনে দেওয়া আর জিতলে বিজয়ীর হাসি হেসে গর্বে বুক ফুলানো। বাবা-মায়ের আদর, আহ্লাদ থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ির খোঁজখবর, সবমিলিয়ে নাবিলার রোজকার জীবনটা আবার নতুন ছন্দে ফিরে এলো। হাসি, খুনসুটি আর পড়াশোনার মিশেলে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।
সবকিছুর ভিড়ে সামির একেবারেই রঙ হারানো একটা ছবি; না আছে উজ্জ্বলতা, না আছে টান। নাবিলা ওকে মনেও রাখতে চায় না; বিয়েটা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা, নামমাত্র একটা ঘটনা, যার প্রতি কোনও আবেগ নেই। নিজের কাছে সে এমন ভান করেই থাকে যে ওর বিয়ে হয়ইনি। কিন্তু চারপাশের মানুষ বোধহয় এ ভান ভাঙাতে বদ্ধপরিকর।
প্রতিদিন সকালে, দুপুরে, রাতে, মা এসে নিয়ম করে একই প্রশ্ন,
— “সামিরের সাথে কথা হলো?”
রেশমা আন্টির সাথে কথা হলেও তার স্নেহভরা গলায় অনিবার্য প্রশ্ন,
— “সামির ফোন করেছিল মা?”
নাবিলাকে তখন ভেতরে বিরক্তির আগুন লুকিয়ে রেখে মুখে একটা প্লাষ্টিক হাসি ঝোলাতে হয়। উফফফ সামির, সামির, সামির… এ নামটা শুনতে শুনতে তার কানটা সত্যিই ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। নামটার উচ্চারণই এখন নতুন এক ধরনের মাথাব্যথা, আতঙ্ক। কিছু শব্দ আছে যেগুলো শুনলেই মানুষের বুক ধকধক করে, সামির শব্দটা নাবিলার কাছে ঠিক সেইরকম। উঁহু এই ধকধকের জম্ম ভালোবাসা কিংবা প্রেম থেকে উদঘটিত হচ্ছে না, অস্থিরতা থেকে হচ্ছে। যেমন ঝড়ের আগে প্রকৃতি লন্ডভন্ড হয়ে যায়, ঠিক সেরকম।
ওইদিকে সামিরেরও অবস্থাও একইরকম। ইদানীং বাড়িতে ওকে পাওয়াই মুশকিল। বন্ধুদের সাথে লম্বা আড্ডা, হুটহাট কোথাও চলে যাওয়া। এখন তো তার কাছে বাড়ি মানেই এড়িয়ে চলার জায়গা। কারণ বাড়িতে থাকলেই মা শুরু করে অদ্ভুত রকম জেরা, সাবজেক্ট সবসময় নাবিলা।
সামির জানে, যতই চেষ্টা করুক নাবিলার নামটা মাথা থেকে সরানো যাবে না। ও জীবনে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, সাইড করার চেষ্টাই বৃথা। একসময় মনে হতো, ওরা শুধু দুই আলাদা দুনিয়ার মানুষ, আলাদা পথে চলবে। কিন্তু মন তো বোঝে, বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে; পথ আলাদা হলেও, গন্তব্যে আলাদা নয়, কোথাও না কোথাও দেখা হবেই… হতেই হবে। তারমধ্যে মা একেবারে আদাজল খেয়ে পড়েছে, এই বিষয়টা নিয়েই প্রতিদিন অন্তত একবার গরম তেল ঢালবেই।
সামির শুধু মনে মনে বলে, —“মা প্লিজ, আজ না…” কিন্তু মা যে কী শুরু করেছে, তা মা নিজেও জানে না।
বাড়ির গেট পেরিয়ে সামির বাইকের দিকে এগোলো। বাইকের পাশে গিয়ে হেলমেটটা হাতে নিল। এক ঝটকায় কপালের উপরের চুলগুলো পেছনে সরিয়ে নিল হাতের পাতায়। তারপর বাইকের সিটে বসে এক পা দিয়ে স্ট্যান্ড তুলে দিল। চোখে সানগ্লাস, ডান হাতে হ্যান্ডেল ধরা, বাম হাতে হেলমেট ঠিক করতে করতে স্টার্ট দিল। তার গন্তব্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কিছু জরুরি কাজ আছে, সেগুলো সেরে ফিরতে হবে।
রাস্তায় কিছুদূর গিয়েই চোখের কোণায় ভেসে উঠল লালরঙা দোতলা বাড়িটা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কামিনী, চোখে কৌতূহল মেশানো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সামির স্বভাবমতোই সম্মুখে দৃষ্টি রেখে সোজা চলে গেল, ওখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে তা দেখার প্রয়োজনবোধ করল না। তবুও বোঝা যায়, ও জানে, প্রায় প্রতিদিনই কামিনী এই পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার যাতায়াত নজরে রাখে।
কেন রাখে? সে প্রশ্নের উত্তর সামির জানে না বা জানতে চায় না। তবে এই নজরদারির পেছনে আজকাল একটা নতুন কারণ যুক্ত হয়েছে, সেটা হচ্ছে নাবিলা।
নাটোর থেকে ফিরেই অন্বেষা কামিনীকে নাবিলার ছবি দেখিয়েছিল, ওরা কী কী করেছে, তা গল্প করেছে। মুখে বারবার উচ্চারণ করেছে,
—“সামিরের বউ, সামিরের বউ…” ঠিকই বলেছে, কিন্তু এই অতিরিক্ত মিষ্টি ভাব আর চোখের ঝিলিক কামিনীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এখন কামিনীর চোখে শুধু কৌতূহল নেই, আছে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার ঝলক। কামিনী নিজেও জানে, সামিরের প্রতি তার আর কিছুই নেই। আর সামির? সে তো ফিরেও তাকায় না। কিন্তু দূরের সেই মেয়েটিকে সরাসরি না দেখেও, তাকে হারাতে চায় কামিনী। কিন্তু কোনদিক দিয়ে হারাতে চায়, তা নিজেও জানেনা। মনে মনে ওর জন্য এক অপ্রতিরোধ্য হিংসার বীজ বপন করে রেখেছে।
সেদিন অন্বেষাকে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল। তখন কামিনীর গলায় ছিল শীতল সুর, কথাটা সাধারণভাবেই জিজ্ঞেস করছে কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে ছিল অসহ্য আর বিরক্তির মিশ্রণ। অন্বেষার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। ওর ঠোঁটের কোণে একরকম অনিচ্ছুক টান পড়ল,
— “ওই মেয়েটা কবে আসবে এখানে?” শব্দগুলো বেরোল ধীরস্বরে, কিন্তু তাতে কেমন হিসেবি মাপঝোক ছিল। নাবিলার নাম উচ্চারণে এড়িয়ে গেল সে। আর সামিরের বউ বলবে? অসম্ভব। অন্বেষা প্রথমে কিছুই বুঝল না। ভুরু কুঁচকে বলল,
— “কোন মেয়েটার কথা বলছো গো?”
কামিনী কফির কাপে চুমুক দিল। চোখ সরাল না রাস্তা থেকে,
— “ওই যে ওই মেয়েটা…”
অন্বেষা এবার বুঝে হেসে ফেলল,
— “কে? নাবিলা? সামিরের বউ?” কামিনীর গলার ভেতরে চেপে থাকা কথাটা অন্বেষাই উচ্চারণ করে দিল।
কামিনী মুখ শক্ত করে শুধু বলল,
— “হুঁ।”
— “কাকি যে কবে নিয়ে আসে? বাচ্চা মেয়ে না? আসবেই, হয়ত একটু দেরিতে। এত তাড়া কীসের? বিয়েটা তো হয়েই আছে।”
— “ওহ।”
শেষের “ওহ” শব্দটা মুখে থাকলেও, চোখে-মুখে স্পষ্ট, ওর ভেতরে কিছু একটা খচখচ করছে। একটা অজানা অস্বস্তি সবসময় খোঁচা মারছে। অন্বেষা হয়ত কিছু বুঝতে পেরে ভাবির মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু তার অভিব্যক্তি বুঝতে পারল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। কামিনীকে সহজে বোঝা যায় না… তার ভাইও বোঝে না। ভাইয়ের সাথে বিয়ের সময় ওকে বেশ অন্যরকম মনে হয়েছিল। তখন জানত না সামিরের সাথে রিলেশনের ব্যপারটা। পরে অবশ্য সামির’ই বলেছিল। অন্বেষা রায়হান ভাইয়ার বোন হলেও সামিরের ছোলেবেলার বন্ধু, ওকে বলাই যায়।
.
সামির ভার্সিটি পোঁছেই গেটে ইশরাককে দেখল সিগারেট টানতে। সামির সামান্য হেসে মাথা ঝাঁকাল, বাইকের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে হাত গুটিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
— “আবার শুরু করেছিস?”
গেটের বাইরে তখন ভ্যাপসা রোদ, বাতাসে সিগারেটের তীব্র গন্ধ মিশে আছে। ইশরাক ধোঁয়া ছেড়ে কাঁধ উঁচু করল,
— “শুরু করি নাই আবার শেষও করি নাই। অনেকদিনের অভ্যাস, সহজে ছাড়া যায় না মামা। টান দিবি নাকি একটা?”
সামির সরাসরি তাকিয়ে বলল,
— “উঁহু।”
ইশরাকের ঠোঁটে হালকা কৌতুকের ছাপ,
— “বাহ। অভ্যাস গেছে গা?”
— “অভ্যাস ছিলোই না আমার। মাঝেমধ্যে টুকটাক… ওটাকে অভ্যাস বা নেশা কিছুই বলে না।”
ইশরাক আবার ধোঁয়া ছাড়ল। কবি কবি একটা ভাব নিয়ে বলল,
— “এখন তো বিয়ে করে ফেলছোস। কোনো প্যারা নাই, কোনো চিন্তা নাই, ছ্যাঁকা খাইয়া ব্যাকা হওয়ার ভয় নাই। তাই তোর নেশা ছাড়াই ভালো। কিন্তু ভাই, আমার গার্লফ্রেন্ড? দু’দিন পরপর প্যারা দেয়। মাইয়া মানুষ এত জটিল! সকালে ভালো মনে হয়, বিকেলে জাঁদরেল মনে হয়।”
সামির এই কথাটা মনে মনে স্বীকার করল। জীবনটা যতই অগোছালো হোক, যতই ব্যস্ত হোক কিন্তু যখন কামিনীর অস্তিত্ব ছিল তার চারপাশে তখনও এই প্রবৃত্তি কাজ করত। নিজের ব্যক্তিগত জিনিস; কোনো অনুভূতি, কোনো সম্পর্ক, কোনো মুহূর্ত তাতে সে কখনো অন্যকারো কতৃত্ব পছন্দ করে না। যেটা তার, সেটা একান্ত তারই থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে নিজেকে একরোখা, স্বার্থপর, সংবেদনশীল, অবাধ্য প্রিয়তাভাজন, কঠিন মনে হলেও এটাই সামির ইয়াসিরের প্রকৃতি। অন্যকারো কাছে প্রিয় কিছু ভাগাভাগি করা মানে সেটা একধরনের অচেনা হুমকি। মনে মনে বোঝে, এই প্রবৃত্তিই তাকে কখনো কোনো পরিস্থিতিতে কমপ্লায়েন্ট বা নম্র হতে দেয় না। নিজের দখলকে সামির এতটা গুরুত্ব দেয় যে, মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয় নিজের স্বভাবের তীব্রতায়। ইশরাকের কথায় সামির চুপচাপ নিজের ভেতরের এই সীমাবদ্ধতা, স্বার্থপরতা আর আবেগের মিশ্রণকে টের পাচ্ছিল; হুট করে মনে হলো, নাবিলার বেলায়ও কি এমন সীমাবদ্ধতা কাজ করবে কখনো?
—
বাবা-মা নাবিলাকে নিয়ে খানিক চিন্তায় আছে। নেওয়াজ আহসান কাগজপত্রে প্রায় চোখ বোলাতে বোলাতে স্ত্রীর সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। কোথায় কোথায় পরীক্ষা দেবে নাবিলা? চান্স পেলে তারপর কী করবে? এখন তো তারাই শুধু অভিভাবক নন… মাথার উপর সামির আছে। নীতু প্রস্তাব রাখল,
— “অন্য কোথাও পরীক্ষা না দিয়ে ঢাকাতে দিলেই হয়। ওখানে কোথাও হলে হবে, না হলে ন্যাশনাল তো আছেই। আর যদি জগন্নাথে কোনোভাবে হয়ে যায়, তাহলে তো পুরো লটারি।”
নাবিলা নিজেই ভাবছিল চান্স পেলে কি করবে, কীসের প্রস্তুতি নিবে? আগে তো ইচ্ছে ছিল, ঢাকাতেই কোথায় ভর্তি হবে। কিন্তু বর্তমানে সেই ইচ্ছেটা মিইয়ে গেছে। কারণ ঢাকায় পড়তে গেলে ওকে হলে, হোস্টেলে কিংবা মেসে রাখবে না। সোজা শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিবে। আর শ্বশুরবাড়ি মানেই সামিরের মুখ দর্শন করতে হবে। এই ইচ্ছে, শখ কোনোটাই নেই। কিন্তু বাবা-মাকে সেটা বোঝাবে কি করে? নাবিলা সিদ্ধান্ত নিল, ও ঢাকা যাবে পরীক্ষা দিতে। কিন্তু একটা পরীক্ষায়ও প্রশ্নের উত্তর লিখবে না। দরকার হলে সামির ইয়াসিরের মাথামুণ্ডু এঁকে দিয়ে আসবে।
নাবিলার পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালোই। সারাবছর উড়ে বেড়ালেও পরীক্ষার আগে মনটাকে টেনেটুনে সিরিয়াস অবস্থানে নিয়ে আসে। কিন্তু এইবার মনটা অস্থির, শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। ভেতরটা খাম খাম করছে। পড়াশোনার বিষয়গুলো মাথার মধ্যে তালগোল পাকাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে আসে, হুট করে বিয়ে হয়ে গেল। এখন কি পড়াশোনা ঠিকমতো করা যাবে? ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে এক বান্ধবীরও যখন বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তার পড়াশোনাও আর হলো না। শশুরবাড়ি থেকে নাকি অনুমতি দিবে না।
নাবিলা জানে রেশমা আন্টি কিংবা আংকেল কেউ এমন নয়। তারা ঠিকই সাহায্য করবে, আদর করবে। তবু মনে ভয় লাগে। এই ভয়ে সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, পড়াশোনায় মন বসছে না, আবার উটকো সব চিন্তা একসাথে দাপট দেখাচ্ছে। নাবিলার মনে দ্বন্দ্ব দুই ধারার নদী হয়ে একসাথে বয়ে চলেছে। একদিকে রয়েছে পড়াশোনা, পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু অন্যদিকের অন্য একটা আওয়াজ ভেতরটা বারবার কাঁপাচ্ছে। মনের এক কোণে লুকিয়ে আছে ফার্স্ট ইয়ারের বান্ধবীর উদাহরণ। বিয়ে হলো, পড়াশোনা থেমে গেল। সে কথা ভাবতেই শরীর চট করে অস্থির হয়ে যায়। নতুন সংসারের দায়, শ্বশুরবাড়ির প্রত্যাশা, আর নিজের স্বপ্নের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে; এসব চিন্তায় তার মন হঠাৎ হঠাৎ থেমে যায়।
নাবিলার ভয়টা অন্যরকম। মানে, এই ভয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। সে জানে নিজের আত্মবিশ্বাসের সীমানা পরীক্ষিত হবে। মনে মনে বারবার চেষ্টা করে নিজের অবস্থান দৃঢ় রাখতে কিন্তু হৃদয় ছোট ছোট আতঙ্ক নিয়ে দোলা খায়। সবমিলিয়ে নাবিলার ভিতর একটা সংকীর্ণ দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যা তাকে একপলকও শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। এরইমধ্যে নীতু ঘরে এলো ফোনে কথা বলতে বলতে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে কথা বলতে বলতে নাবিলার দিকে এগিয়ে দিল।
— “ধর।”
নাবিলা দেখল ভিডিও কল, ওপাশে রেশমা আন্টি। মাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,
— “কী?”
নীতু হেসে বলল,
— “কথা বল। রেশমা ফোন করেছে। তোর সাথে কথা বলবে।”
নাবিলা কুঁচকে গেল। একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে বসেছে ঠিকই, কিন্তু চুলগুলো উস্কখুষ্ক, আউলা-ঝাউলা। মায়ের চোখ রাঙানির প্রভাবে ফোনটা হাতে নিল। সালাম দিয়ে কথা বলতেই ওপাশ থেকে রেশমার গরম, মাতৃত্বপূর্ণ কণ্ঠ ভেসে এলো।
— “কেমন আছো, মা?”
নাবিলার মনে পড়েনা, শেষ কবে উনার মুখ থেকে সে নিজের নাম শুনেছে। বেশিরভাগ সময়ই মা বলেই সম্বোধন করে, আংকেলও তাই। নাবিলার অবশ্য ভালোই লাগে। নিজের ছেলেকে বাবু ডাকে আর ওকে মা… হিহি।
নাবিলা হেসে বলল,
— “ভালো আছি আন্টি, আপনি কেমন আছেন?”
— “আমিও ভালো আছি। একমিনিট দাঁড়াও।”
নাবিলা দেখল উনি উঠে অন্যরুমে গেলেন। নাবিলা অবশ্য অবচেতন মনে অপেক্ষা করছিল। তিনি হুট করে ফোনটা সামিরের দিকে এগিয়ে দিলেন।
— “নে, নাবিলার সাথে কথা বল।” বলেই তিনি নিরাবধি হেঁটে ঘর থেকে চলে গেলেন।
নাবিলা হঠাৎ হকচকিয়ে গেল। সে সামিরের সাথে কি কথা বলবে? কীভাবে শুরু করবে? সামিরও কিছুটা অপ্রস্তুতবোধ করল বোধহয়। নাবিলা ফোনটা কেটে দিতে উদ্যত হয়। সামির তৎক্ষণাৎ গলায় হালকা গাম্ভীর্য এবং নিয়ন্ত্রিত স্বরে বলে উঠল,
—“এই না না, ফোন কাটবে না।”
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১১]
~আফিয়া আফরিন
সামিরের বলা কথাটা আদেশের মত ছিল না, একটু অন্যরকম। শুনে নাবিলা অচেতনভাবে থমকে গেল, কারণ স্বরটা কঠিন না হলেও ভিতরে অদৃশ্য প্রভাব ফেলছিল। নাবিলা কিছু বলল না। সামিরই বলল,
— “আমার মুখের উপর ফোন কেটে দেওয়ার সাহস দেখাচ্ছো নাকি?”
— “মুখের উপর কীভাবে ফোন কাটব? আপনি তো সামনাসামনি নাই।”
সামির গলা একটু কড়া করে বলল,
— “বড়দের সাথে অভদ্রতামি করে কথা বলবে না, বুচ্ছো?”
— “কেনো? তাতে বড় মানুষের কি জবাব খুঁজতে কষ্ট হয়?”
— “তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছা নাই।”
নাবিলা একটা ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
— “আমারও আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নাই।”
নাহ, এই মেয়েটা সামিরের মুখের উপর টপাটপ কথা বলছে, তাকে অগ্রাহ্য করছে, তা হবে না। সামির গলা চড়িয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
— “তুমিও কথা বলবে আর তোমার চৌদ্দগুষ্টিও।”
নাবিলা একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— “ছিঃ, কথাবার্তার কী ছিরি। আমি তো ভাবছিলাম আপনাকে ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।”
সামির গম্ভীর স্বরে বলল,
— “ভদ্রলোক হওয়ার দরকার নেই তোমার সামনে।”
নাবিলা বেশ শব্দ করেই হেসে উঠল,
— “আপনি ভদ্রলোক সাজার চেষ্টা করলেও আমার কাছে পাস করতে পারবেন না। কারণ ইতোমধ্যে আমি আপনার নারী-নক্ষত্র জেনে গেছি।”
সামির একটু হেসে ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলল,
— “তাই নাকি? তাহলে তো তুমি জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর আছো। আমার চেহারা দেখে বলো, কবে আমি ভাগ্যবান হবো?”
নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “আপনার ভাগ্য তো বিয়ের দিনেই ফুরিয়ে গেছে।”
ওপাশ থেকে সামিরের মুখটা দপ করে নিভে গেল। নাবিলা আসলে ভুল কিছু বলে নাই। সত্যি বিয়ের পর ভাগ্য স্থির হয়ে গেছে। তা না হলে যেখানে সবার ওপর স্বর্গ থেকে আনন্দের ঝর্ণা ধারা বয় সেখানে তার জীবনে শ্বশুরালয় থেকে বজ্রপাত নেমে আসে?
কথাবার্তা শেষ পর্যায়ে। ফোন রাখার আগে হঠাৎ নাবিলার মনে হলো একটা প্রশ্ন করা উচিত। সে ধীরকণ্ঠে বলল,
— “আচ্ছা, আপনি কি সবসময়ই এমন?”
সামির ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— “কেমন?”
— “রূঢ়।”
মুহূর্তের জন্য সামির ধাক্কা খেল,
— “আমি রূঢ়?”
— “হুম, তাই মনে হয়। নাকি ইচ্ছে করেই আমার সাথে এমন ব্যবহার করেন?”
নাবিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামির চুপ রইল। কোনো ব্যাখ্যা বা প্রতিবাদ করল না। শুধু ফোনটা রেখে দিল।
ফোন রাখার পর সামির থমকে বসে রইল কিছুক্ষণ। সে কি আসলেই রূঢ়? নিজের সম্পর্কে তার ধারণা একেবারেই তা নয়। অন্তত নিজেকে তো সে মোটেও অমন ভাবে না। নাবিলা এমন বলল কেন? ওর সাথে কি সত্যিই সে এতটা বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে?
সামির এভাবে হঠাৎ ফোন কেটে দেওয়ায় নাবিলার বুকের ভেতর কেমন যেন কী একটা বিঁধে গেল। কী এমন বলেছে সে? স্রেফ একটা প্রশ্নই তো করেছিল! তাও সত্যি কথা, যা সে মন থেকে অনুভব করেছে। এতটুকু কথায় গায়ে লাগার কী আছে? মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। এই সুন্দর, স্নিগ্ধ সকালবেলাও এখন তার কাছে বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। নাবিলা মনে মনে ভাবল— হুহ, কিছুই বলা যায় না একেবারে। উনার চারপাশে অদৃশ্য একটা দেয়াল, যার ভেতর ঢোকা অসম্ভব আর বাইরে থেকে কথা বললেই গায়ে আগুন লাগে তার।
.
নাবিলার কথাটা সামিরের মনে সারাদিন ঘুরেফিরে ঘুরছে। ছোট্ট সেই কথাই তাকে সারাদিন অস্বস্তি আর অশান্তির ভিড়ে আটকে রেখেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
— “ভাই, আমি কি রূঢ় আচরণ করি?”
সবাই তাকিয়ে রইল, কেউ হেসে ফেলল, কেউ চুপ রইল। সামির ইদানীং অন্যরকম আচরণ করছে তবে সেটা রূঢ় মোটেও নয়। ইশরাক বলল,
— “নির্ঘাত ভাবি তোকে বলেছে কিছু, তাইনা? তুই রূঢ় না কিন্তু একদম সাদাসিধাও না। মানে বলতে চাচ্ছি, তুই কঠিন ধাঁচের মানুষ। বিয়ে হতে না হতেই ভাবির সাথে কী এমন ব্যবহার করলি যে সে তোকে রূঢ় উপাধিতে ভূষিত করল?”
সামির খানিকটা মাথা নাড়ল, সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। বরং ওদের মাঝ থেকে বেরিয়ে এলো। ওর আসলে নিজেকে চেনা দরকার। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? কাকে জিজ্ঞেস করলে একটা ঠিকঠাক উত্তর মিলবে? মাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, “আমার ছেলে খারাপ হতেই পারে না।” বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, “তোকে ছোটবেলা থেকে যেমন শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি, ঠিক সেরকম তুই।” কাজিনদের জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দিবে, “ভাই তুই বদমেজাজি। তোর মিষ্টি কথায় তো আবার মানুষের ডায়াবেটিস ধরবে।” আর বাকি রইল, কামিনী। ওর কথাও জানা আছে। ও বলবে, “মনে আছে আমাদের সময়টা? ওই সময়ে তো একেবারেই প্রফেশনাল রূঢ়তা দেখিয়েছ।”
নাহ, আর কাউকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। না হয় নাবিলাকে জবাবদিহি করতে হবে, ঠিক কি কারণে সে সামির ইয়াসিরকে এই কথাটা বলল?
—
নাবিলার ঢাকা আগমনের পরপরই মনে পড়ল, এখন সবকিছু পরীক্ষার দিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে উঠেছে ছোটো খালামনির বাসায়। দিনগুলো কেটে যাচ্ছে চিন্তায়। মনে বারবার প্রশ্ন জাগে, কী করবে? ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাওয়া মানে কুমির ভর্তি খালে ঝাঁপ দেওয়া। একমুহূর্তের সিদ্ধান্ত জীবনের পথে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু যদি পরীক্ষা ব্যর্থ হয়, সেটাও মোটেই কাম্য নয়। তাই মনে একরকম দ্বিধা, একধরনের অস্থিরতা। সেদিনের পর সামিরের সাথে আর কথা হয় নাই। যে মানুষ মুখের উপর ফোন কেটে দিতে পারে, তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও তা সাজে না।
এখান থেকে নাকি লালবাগ খুব কাছে। ওর পরিবার ইতিমধ্যেই ঘুরে এসেছে ওই বাড়ি থেকে। তবে নাবিলা যায় নাই। ওর জন্য এখনই যাওয়ার সময় নয়। রেশমা আন্টি একথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, একমাত্র বৌমাকে তিনি এইভাবে ঘরে তুলবেন না।
আজ নাবিলার পরীক্ষা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যতটা খারাপ হবে ভেবেছিল ততটা খারাপ হলো না। সত্যি বলতে, পুরোপুরি খারাপ করার ইচ্ছে হলো না। যেসব প্রশ্ন ওর কমন ছিল, সেগুলো ঠিকঠাক লিখে ফেলেছে। পরীক্ষা শেষে রেশমা আন্টি আর সাখাওয়াত আংকেল নাবিলার সাথে দেখা করতে এসেছেন। ও আশেপাশে তাকিয়েও অসুরটাকে কোথাও দেখতে পেল না। তবে মা-বাবা, আন্টি-আংকেলের সাথে দারুণ সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ঢাকা থাকাকালীন সময়টায় রেশমা আন্টি প্রায় দেখা করতে চলে আসে। ইদানীং নাকি নাবিলাকে ছাড়া তার মন টিকছে না। নিজের তো মেয়ে নেই, ওকেই বড্ড আপন মনে হয়।
তারপর পরীক্ষা ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটাও দিয়েছে একরকম। আজ পরীক্ষা শেষে অন্বেষা, আয়ান, রায়হান আর কামিনী উপস্থিত ছিল। রায়হানের সাথে পরিচয় ছিল না, তবে পরিচয় হলো। কিছুমুহুর্তের মধ্যে নাবিলার মনে হলো, বাকি দুই ভাই-বোনের থেকে রায়হান ভাইয়া বেশি ভালো। কিন্তু তার বউটা একটু কেমন জানি। কোনোকিছুতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। একটা কথা জিজ্ঞেস করলেও কাটাকাটাভাবে উত্তর দিচ্ছে। আড়ালে অন্বেষা ওকে বলেই ফেলল,
— “ভাবির সাথে সাবধানে কথাবার্তা বলো। একসময় তোমার সোয়ামীর পিরিতের গার্লফ্রেন্ড ছিল।”
নাবিলা সত্যিই অবাক হলো। ওখানে সবাই উপস্থিত থাকায় তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। সামিরের গার্লফ্রেন্ড এই বদমেজাজি মহিলা? বিশ্বাসই হয় না… ব্রেকআপ নিশ্চয়ই দুজনের অতিরিক্ত পাকনামি আর চুল ছেঁড়াছেঁড়ির জন্যই হয়েছিল। নাবিলার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, ব্রেকআপ কেনো করেছিল ওরা? অন্বেষা জিজ্ঞেস করল, সে অবশ্য সঠিকভাবে জানে না। শুধু বলল,
— “মতের মিল হচ্ছিল না বোধহয়।”
নাবিলার এইমুহূর্তে ওই মেয়েটার জন্য কষ্ট হলো। কেন গিয়েছিল সামিরের সাথে রিলেশন করতে? ওর সাথে আবার কারো মতের মিল হয় নাকি? নিজে যা বোঝে তাই, কাউকে গুরুত্ব দেয় না। অন্তত এই কয়েকমাসে, নাবিলা সামিরের কাজকর্মে অনেকটা পরিচিত হয়ে গেছে।
আজকের পরীক্ষা ছিল জগন্নাথে। নাবিলা ভেবেছিল, এখানে সে কিছুই লিখবে না। কিন্তু প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল।এতো সহজ প্রশ্ন, পানির মতো স্বচ্ছ। কীভাবে না লিখে থাকা সম্ভব? সামিরের কথা কেনো বারবার মনে আসছে, নিজেও বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওর সিদ্ধান্ত স্থির, সামিরের জন্য নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার মানে হয় না। তাই সে সমস্ত ভাবনা, জীবন, মন সবকিছু থেকে সামির ইয়াসিরকে একপাশে সরিয়ে শুধু পরীক্ষার দিকে মন দিল। পরীক্ষা শেষে মনে হলো, কিছুই ভুল হয়নি; ঠিক পথেই এগিয়েছে সে।
পরীক্ষা শেষে নাবিলা সামিরকে দেখে হঠাৎ চোখ-মুখ কুঁচকে অন্য দিকে তাকাল। ও আবার এখানে এসেছে কেনো? সামির তখন উপস্থিত সবার সামনে বলল,
— “নাবিলার সাথে আমার একটু আলাদা কথা আছে।”
নাবিলা ফট করে ঘুরে তাকাল। সামির বাবার সঙ্গে কথা বলছিল। বাবাও হেসে বললেন,
— “হ্যাঁ, যাও। কোথায় যাবে, ঘুরে এসো।” নাবিলা কিছু বোঝার আগেই সামির অনুমতি পেয়ে গেল। সে নাবিলার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
— “চলো।”
নাবিলা বিক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
— “কোথায় যাবো? আপনার সাথে আমি কোথাও যাব না।”
সামির শান্ত স্বরে বলল,
— “কথা আছে তোমার সাথে।”
— “আমার নেই।”
— “কিন্তু আমার আছে।”
নাবিলা থমথমে গলায় বলল,
— “তাহলে বলেন।”
— “এখানে না।”
নাবিলা প্রশ্ন করল,
— “কেনো? কি কথা বলবেন?”
সামির নির্বিকার স্বরে বলল,
— “পার্সোনাল।”
— “মানে?” নাবিলার কণ্ঠে বিস্ময়।
সামির কাঁধে হালকা ঝাঁকি দিয়ে বলল,
— “বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অনেক পার্সোনাল কথা থাকে। সবার সামনে বলা যায় না। চলো…”
নির্বিকার ভাব নিয়ে সে নাবিলার হাত ধরল। নাবিলা একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে থমকে গেল। কিন্তু সামিরের সাথে গেল। বাইরে সে বাইক পার্ক করে রেখেছিল। বাইক স্টার্ট দিয়ে নাবিলাকে উঠে বসতে বলল। নাবিলা ইতস্তত করে বসল, খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখেই। সামিরকে ধরলও না, শক্ত হয়ে বসে রইল। তার বসার ভঙ্গি এমন যে, সামান্য ঝুঁকলেও পিছলে যেতে পারে। সামির তা লক্ষ্য করতেই বলল,
— “ধরে বসো। আমি মানুষ, জন্তু-জানোয়ার না।”
নাবিলা বলল,
— “সমস্যা নেই।”
— “ঠিক আছে।”
সমস্যা আছে কিনা বোঝনোর জন্যই সামির একটু এগিয়ে গিয়ে এমনভাবে ব্রেক কষলো যে নাবিলা পড়েই যাচ্ছিল। তবে হাত বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল সামির। তারপর সাবধানী স্বরে বলল,
— “বড়দের কথা না শুনলে এমনি হবে।”
নাবিলা তার পিঠে ঘুষি মেরে বলল,
— “আপনি আসলে বাইক চালাতেই পারেন না।”
— “এখন ভালোভাবে বসো।”
শেষ পর্যন্ত নাবিলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামিরের কাঁধে হাত রাখল। বাইক চলতে আরম্ভ করল এবং নাবিলা সামিরের কাছাকাছি বসে তার গায়ের ঘ্রাণ অনুভব করছিল। সেই ঘ্রাণ, সেই গতি, আর সামিরের উপস্থিতি; সবটাই ওর কাছে অন্যরকম মনে হলো। এতটা কাছাকাছি, এতটা সংস্পর্শ; হৃদয়টা অল্প একটু দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে আর মনে হচ্ছে এই অনুভূতি কিছুটা লুকোনো, কিছুটা নতুন, কিছুটা নিজের জন্যই। নাবিলা নিজের মনোনিবেশ অন্যদিকে সরানোর জন্য কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
— “গেলেই দেখতে পাবে।”
নাবিলা একটু চটে গিয়ে ঠোঁট কুঁচকে বলল,
— “এইজন্যই, এইরকম একরোখা স্বভাবের জন্যই মিসেস কামিনী আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন।”
নাবিলার বলতে দেরি সামিরের ব্রেক কষাতে একমুহুর্ত দেরি হলো না। থামার সঙ্গে সঙ্গে সে এমনভাবে নাবিলার দিকে তাকাল, যে ওর চোখের দৃষ্টিই নাবিলার সমস্ত মনোবৃত্তি পরীক্ষা করছে। নাবিলা অজান্তেই ভড়কে গেল, দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। সামির কিছু বলল না, শুধু মৌনভাবে তাকিয়ে রইল। কিছু মুহূর্ত থেমে থাকার পর বাইক আবার স্টার্ট হলো। কিন্তু রাস্তায় চলতে চলতে নাবিলা আর কিছু বলার সাহস পায়নি। সামিরের উপস্থিতি, গভীর দৃষ্টির চাপ এবং হঠাৎ থামার অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত; সবমিলিয়ে তার মনকে চুপচাপভাবে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু সেটা কেমন দখল, তা বুঝতে পারছে না। নাবিলা অনুভব করল, সামিরের কাছাকাছি থাকলেই একটা ভয় আর আতঙ্কের মিশ্র অনুভূতি তাকে ঘিরে থাকে।
সদরঘাটের কোল ঘেঁষা নির্জন চড়ে এসে দাঁড়াল দু’জন। চারদিকে নদীর কালচে পানি, মাঝে মাঝে ঢেউ ভেঙে নৌকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাতাসে পানির গন্ধ আর চড়ের ভেজা মাটির গন্ধ মিশে আছে।
সামির প্রথমেই কোনো কথা বলল না। বাইক থেকে নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, চারপাশটা গভীরভাবে দেখছে। অথচ ওর পাশে থাকা নাবিলার মনে হচ্ছিল, এই নীরবতা আসলে কেবল বাহানা। কিছু একটা বলার আছে তার।
নাবিলা একটু দূরে গিয়ে বসে পড়ল একটা পাথরের ওপর। দু’হাত জড়িয়ে হাঁটুর ওপর মুখ ঠেকিয়ে রাখল। চোখে বিরক্তি, অথচ মনে কৌতূহল। সামির আসলে কি বলতে চায়? নাকি চুপচাপ বসিয়ে রাখার জন্যই এখানে টেনে এনেছে? ওর ভেতরে আরও একটা দ্বিধা ঘুরপাক খাচ্ছে, সামিরের মতলব সম্পর্কে এখনও স্পষ্ট হতে পারছে না। মাঝে মাঝে সামিরকে স্বাভাবিক মনে হয়, আবার হঠাৎ আচরণ পাল্টে যায়। ভালো থাকতে থাকতে কেন জানি রূঢ়তায় ভরে ওঠে। ঠিক বোঝা যায় না, কোনটা আসল সামির; নাকি দুটোই?
কিছুক্ষণ নদীর শব্দ ছাড়া চারপাশে আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। হঠাৎ সামির ধীরপায়ে নাবিলার দিকে এগিয়ে এলো। তার চোখে একটা গম্ভীর ছায়া, ঠোঁট শক্তভাবে চেপে আছে।
—“কামিনীর কথা তুমি কিভাবে জানলে?” স্বর নীচু, তবে ভারি। ভেতরে ভেতরে দমিয়ে রাখা রাগ হঠাৎ বেরিয়ে আসছে।
নাবিলা ভড়কে গেলেও মুখের অভিব্যক্তিতে সেটা প্রকাশ করল না। সামলে বলল,
—“জানলে কি সমস্যা?”
সামির মুখের রেখা আরও শক্ত হলো। চোখ দুটো সরু হয়ে এলো,
—“প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন না করে উত্তর দাও।”
একটু থেমে নাবিলা ফিসফিস স্বরে বলল,
—“শুনেছিলাম আমি।”
সামির এক পা এগিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। কণ্ঠস্বর এবার ঠাণ্ডা হলেও থম ধরা,
—“কার কাছ থেকে শুনেছো এবং ঠিক কি কি শুনেছো?”
সামিরের কথার তোরে অথবা অনেকক্ষণ পানি না খাওয়ার কারণে নাবিলার গলা শুকিয়ে এসেছে। কোনমতে বলল,
—“বেশি কিছু না।”
সামির ভুরু কুঁচকালো,
—“তো তখন ওই কথাটা তুমি কিসের উপর ভিত্তি করে বললে?”
নাবিলা এইবার সরাসরি সামিরের দিকে তাকাল। ওর চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। চোয়াল শক্ত, ঠোঁট শক্ত করে চেপে আছে। কপালের শিরাও দপদপ করছে বোধহয়। এই ছোট্ট কথায় এত রেগে যাওয়ার কি আছে? তবে কি বিষয়টা সামিরের জন্য স্পর্শকাতর ছিল? অবশেষে নীরবতা ভেঙে নাবিলা বলল,
— “কথাটা আমার মনে হয়েছে তাই বলেছি। কারণ আপনার রাগ, জেদ, ইগো, সম্পর্কে আপনার বিন্দু পরিমাণ ধারণাও বোধহয় নেই।”
সামির একমুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
— “তোমাকে আমি দুটো ভালো কথা বলার জন্য এখানে ডেকে এনেছিলাম।”
— “তবে বলুন।” নাবিলা নির্বিকার গলায় জবাব দিল।
সামির গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল,
— “প্রয়োজনবোধ করছি না। তুমি ভালো কথা শোনার মানুষ নও। তবে যতটুকু বলা দরকার ততটুকু বলছি… খুব শীঘ্রই হয়ত তোমাকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে। কথার কথা হচ্ছে, আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করা যাবে না।”
নাবিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— “কারো পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার মতো সময় আমার হাতে নেই।”
— “তাহলে ঠিক আছে।” সামির সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
নাবিলা কণ্ঠস্বর দৃঢ় রেখে বলল,
— “তবে আপনিও শুনে রাখুন… আপনি আমার স্বাধীনতা, আমার ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে পারবেন না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিতে হবে। আমি আমার জীবনে কারো স্বেচ্ছাচারিতা একটুও পছন্দ করি না।”
সামির বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল,
— “আমি তোমার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসিনি। তবে ভুলে যেও না, স্বাধীনতা সীমার মধ্যে সুন্দর থাকে। আমার চোখের সামনে সীমা অতিক্রম করলে সেটা আমি মেনে নিব না, নিশ্চয়ই।”
নাবিলা উত্তর দিল না। ঠোঁট কামড়ে একপাশে তাকিয়ে রইল। এই গোয়ারের সাথে তর্ক করাই বৃথা।
ওরা নদীর ধারে নীরব বসে রইল অনেকক্ষণ। কেবল জলের ধাক্কা আর নৌকার ভেঁপু বাজা শব্দ ভেসে আসছিল। ফেরার আগে হঠাৎ সামির হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,
— “কোথায় যাবে? নিজের বাড়ি, খালামনির বাড়ি, নাকি শ্বশুরবাড়ি?”
নাবিলা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল,
— “শ্বশুরবাড়ি যাওয়া বারণ আছে।”
— “কে বারণ করেছে?”
নাবিলা একচিলতে দুষ্টু হাসি দিয়ে উত্তর দিল,
— “বাবুর মা বাবুর বউকে যেতে বারণ করে দিয়েছে।”
নাবিলার উত্তর শুনে সামির একদম নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রইল। এই ফাজিল মেয়েকে কিছুই বলবে না বলে ঠিক করল। সামির চুপচাপ গিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। নাবিলা পেছনে বসে স্বভাবতই সামিরের কাঁধে হাত রাখল, সামান্য সমর্থন বটে। মুহূর্তেই সামির চট করে বলল,
— “হাত সরাও, হাত সরাও।”
নাবিলা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল,
— “কেনো?”
সামির শুধু মাথা নাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
— “কেন মানে? আমাকে টাচ করবে কেন? ইউ নো, সামির ইয়াসিরের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র!”
.
.
.
চলবে….