প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৮+১৯+২০

0
18

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৮]
~আফিয়া আফরিন

নাবিলা জানালার আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে, সামিরকে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। ভেতরে ভেতরে অস্থির হচ্ছে, সামির এখানে কেন? কেবল কি দেখা করার জন্য, নাকি কোনো জরুরি কাজ আছে? হঠাৎ মনে হলো, যদি কেউ দেখে ফেলে? বাবা-মা, ভাই বা আশেপাশের মানুষ! ওহ, মাথাটা একেবারেই গেছে। সামিরকে দেখলেই বা কী? ওরা কি প্রেম করছে যে ধরা পড়ার ভয় আছে? নাবিলা মাথা উঁচু করে নরম স্বরে জানালার থেকেই বলল,
— “শুধু দু’মিনিট দাঁড়ান আপনি। আসছি আমি।”

সামির দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ম্লান আলোয়। নিজের মনেই হাসল একবার। মনে মনে বলল, “আসলেই আমি পাগল। এই রাত-বিরেতে আসা কি ঠিক হলো?”
ওর মাথায় কোনো প্ল্যান ছিল না। নাবিলার জানালার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর অজানা টান টের পাচ্ছে। সারাদিন একরাশ অস্থিরতায় কাটানোর পর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলো, আসতেই হবে এখানে। হয়তো দু’টা কথা বলবে, হয়তো একঝলক দেখেই ফিরে যাবে। এত দেরিতে আসার পরিকল্পনা ছিল না। বের হয়েছিল অনেক আগেই তবে সড়ক পথে এত জ্যাম ছিল যে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। তবু মনে হচ্ছে, সময় তো ফুরোয়নি… অনেকটা সময় বাকি আছে।

নাবিলা বাইরে বের হয়ে এলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সামিরের সামনে এসে থামল। দু’জনের চোখে চোখ পড়তেই একমুহূর্তের জন্য চারপাশের অন্ধকার, রাতের নিস্তব্ধতা সব মিলিয়ে গেল। নাবিলা নরম গলায় বলল,
— “আসুন।”

সামির হকচকিয়ে গেল। ইতস্তত করে বলল,
— “ইয়ে মানে… সবাই কি জেগে আছে?”

নাবিলা মৃদু হেসে উত্তর দিল,
— “বাবা ঘুম। মা-ও ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত।”

সামির এক ধাপ পিছিয়ে গেল,
— “আমি বরং যাই, আচ্ছা? এইভাবে হুট করে চলে আসা ঠিক হয়নি।”
কথা শেষ করেই ঘুরে দাঁড়াল। বোধহয় রাতের অন্ধকারে মিশে গিয়ে সমস্ত সংকোচ, সমস্ত দুর্বলতা গোপন করে ফেলতে চায়। কিন্তু ঠিক তখনই নাবিলার হাত এগিয়ে গেল। দৃঢ়ভাবে টেনে ধরল সামিরের হাত।
— “আজব মানুষ তো আপনি!” চোখ রাঙিয়ে বলল ও। কিন্তু সেই চোখরাঙানির ভেতরেই কী অদ্ভুত টান, কী অজানা আবেগ ঝিলিক দিচ্ছিল। সামির কি টের পেল? মনে হয়… তাইতো হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। বরং অনুভব করল, নাবিলার আঙুলগুলো তার হাতের চারপাশে কেমন উষ্ণ আর আশ্বস্ত করে রাখা।
.
রাতটা ছিল ভীষণ অস্বস্তির। নাবিলা চুপ করে ছিল, কারণ সেও বুঝতে পারছিল সামির অস্বস্তিতে আছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওর হাসি থামছিল না। মাঝে মাঝে পাশ ফিরে তাকালেই সামিরকে লজ্জিত কিশোরের মতো গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে ওর মনটা খিলখিল করে উঠছিল। ভোরের আলো ফুটতেই বাবা-মা জামাইয়ের আসার খবর শুনে চমকে উঠলেন।
— “আরে? সামির কখন এলো? আমাদের একবার ডেকে দিলে কি হতো? ঘুম তো কাঁচা-ই ছিল।”

সামির অপ্রস্তুতবোধ করল। গলায় যতটা সম্ভব দৃঢ়তা আনার চেষ্টা করল। মুখস্ত করে রাখা কথাটা বলে দিল,
— “মানে… মা নাবিলাকে নিতে পাঠিয়েছে।” সারারাত ধরে সামির ভাবছিল, সকালে যদি কারও মুখোমুখি হতে হয়, কেউ যদি হঠাৎ এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করে; তাহলে কী বলবে? মাথায় এই উত্তরটাই রপ্ত করে নিচ্ছিল বারবার।
নেওয়াজ আহসান কিছুতেই জামাইকে ছাড়বেন না। নাবিলাকে নিয়ে যতটা ভালোবাসা, সামিরের জন্যও তার সমান কর্তৃত্বপূর্ণ ভালবাসা। কিন্তু সামিরের চোখেমুখে অস্বস্তি ফুটে উঠছিল স্পষ্ট। অবশেষে বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলতে হলো,
— “আসলে… আমার ক্লাস প্রেজেন্টেশন আছে। নাবিলা বরং থাকুক।”

নাবিলাও তড়িঘড়ি করে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
— “না বাবা, আমারও তো ক্লাস আছে। আমি-ও চলে যাব।”
একই সাথে দু’জনের একই কথা শুনে নেওয়াজ আহসান কিছুটা থমকালেন। তাঁর কড়া ভুরু খানিকটা কুঁচকে গেল। কিন্তু আর কোনো অজুহাত দাঁড় করানোরও জায়গা রইল না। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেনে নিলেন। মেয়ে-জামাইকে বিদায় দিলেন বিকাল নাগাদ। নীতুও সাথে ছিল। সে ফিরে এসে সরাসরি ফোন করল রেশমাকে। কথায় কথায় বলল,
— “নাবিলাকে এত মিস করছিলি যে একেবারে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলি, ওকে নিয়ে যেতে।”

অন্যপ্রান্তে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল রেশমা। একটু বিস্মিত হলো। তিনি নাবিলাকে মিস করছিলেন ঠিকই কিন্তু সামিরকে একবারও যেতে বলেননি। ভেবেছিলাম মেয়ে বাবা-মায়ের কাছে এতদিন পর গেছে… আর কিছুদিন থাকুক। সামির তাহলে কেন গেল? বউয়ের টানে… বাহ, তাহলে তো বেশ হয়। তিনি হাসিমুখে বান্ধবীর সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন।

গাড়ি চলছে। সামিরের মুখটা শক্ত, ভ্রূ কুঁচকানো। তার দৃষ্টি রাস্তায় আটকে আছে। নাবিলা আবোলতাবোল প্রশ্ন করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। আর সে “শাট আপ, শাট আপ” করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে নাবিলা আহ্লাদী সুরে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি সত্যি আমাকে মামণির কথায় নিতে আসছেন?”

সামির কোনো দিকে না তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
— “শাট আপ।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার ফিসফিস করল নাবিলা,
— “মামণি বোধহয় আমাকে অনেক মিস করছিল… তাই না?”

সামিরের আবারও একরকম রাগঢাকা কর্কশ স্বর,
— “শাট আপ।”

এবার নাবিলা চোখের কোণে দুষ্টুমি মেশানো আভা নিয়ে সরাসরি তাকাল তার দিকে,
— “আচ্ছা… আপনি মিস করছিলেন না?”
সামির এইবার কিছু বলল না, শুধু দাঁত চেপে নাবিলার দিকে তাকাল। মুখে বলছে এক কথা আর মনে আরেক কথা। নিজেকে কেমন গিরগিটি মনে হচ্ছে। অথচ তার এই স্বভাব কোনোদিন ছিল না। মনে যা, মুখেও তা। নাবিলার বেলায় সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে কেন? মনের ভেতরটা চিৎকার করে বলছে, “হ্যাঁ, আমি তোমাকেই মিস করছিলাম।” মনের এইরকম অবনতি হবে তা ভেবেছিল কোনোদিন? কামিনীর বেলায় তো সব ঠিকঠাক ছিল। কেনো ছিল? ভালোবাসা ছিল না বলে?
সামির বাসায় ঢুকতেই রেশমা আগ্রহভরে তাকালেন। নাবিলাকে পাশে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন। রেশমা বললেন,
— “কিরে বাবু, তুই নাবিলাকে…”

পুরো কথাটা শেষ করার আগেই সামির বলে উঠল,
— “মা, নাবিলার জরুরি ক্লাস আছে। সামনে আবার পরীক্ষা। এসব ফেলে এতদিন ওখানে থাকা ঠিক না। তাই ওকে নিয়ে এলাম। পরীক্ষা শেষ হলে গিয়ে অনেকদিন থাকবে।”

রেশমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। নাবিলাও কিছুটা সংশয় নিয়ে তাকাল। সামির নিজেকে যতটা সরল দেখাচ্ছে, ভেতরে ততটা সহজ নয়। কিন্তু এমনভাবে নির্লিপ্ত গলায় বলল যে, মনে হলো সবই শুধু দায়িত্ববোধ থেকে করা। নাবিলার মনের ভিতর এতক্ষণ যাবত যে ভালোলাগার প্রজাপ্রতিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছিল তারা ডানা ঝাপটানি থামিয়ে দিল। ও সামিরকে ঠিক বুঝতে পারছে না। অদ্ভুত চরিত্র… এই ভালো, এই খারাপ!
রেশমা মৃদু হেসে বললেন,
— “আচ্ছা, ঠিক আছে। পড়াশোনার চাপ আগে সামলাক। পরীক্ষা শেষ হলে আবার পাঠিয়ে দেব।”
সামির আর কোনো জবাব দিল না। নাবিলার দিকে একপলক তাকিয়ে ঘরে গেল। ওর দৃষ্টিতে যে নাবিলাকে ঘরে আসার নির্দেশ ছিল, যা নাবিলা বুঝল না।
.
নাবিলা আবারও নিয়মিত ক্লাস শুরু করল। যাওয়া-আসা সামিরের সাথেই হচ্ছে। ভাবের রাজা আগের মতই ভাব দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে এতটাই উদাসীন হয়ে যায় যে নাবিলার রাগ হয়, আবার সেই উদাসীনতার ফাঁকেই হঠাৎ একটুখানি দৃষ্টি বা একটা শব্দে বুক ধড়ফড় করে ওঠে। কী জানি, আসলে কী হয় এর? নাবিলা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নাবিলা ওর চিন্তা বাদ দিয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিল। সামনে প্রজেক্টর অন, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। পাশ থেকে হঠাৎ টুস করে পেটে খোঁচা খেয়ে আঁতকে উঠল। তাকিয়ে দেখল তাসনিম মুখ চেপে হাসছে।
— “কি করছিস?” নাবিলা বিরক্ত মুখে ফিসফিস করে বলল।

তাসনিম ইশারা করল সামনের দিকে।
— “ওই দেখ, একটা ছেলে তোর দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকায় আছে।”

নাবিলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “কেন?”

তাসনিম কাঁধ ঝাঁকাল,
— “আমি কেমনে বলব?”
— “গিয়া জিজ্ঞেস কর।” নাবিলা বিরক্ত হয়ে বইয়ের দিকে মুখ ফেরাল। কিন্তু কৌতূহলটা ঠিকই খোঁচা মারল। অবচেতনেই একসময় মাথা একটু কাত করে পাশের দিকে তাকাল। আর ঠিক তখনই চোখ আটকে গেল, একজোড়া দৃষ্টি সত্যিই তার দিকে নিবদ্ধ। একই ডিপার্টমেন্টের হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটাকে নাবিলা চেনে না, নামও জানে না।
ক্লাস শেষে তন্ময়ের সঙ্গে নাবিলার টুকটাক আলাপ জমে উঠল। ওই ছেলেটার নাম তন্ময়। সহজ-সরল ভঙ্গিতে কথা বলে, তাতে নাবিলারও অস্বস্তি লাগল না। ঠিক তখনই মাধুর্য এগিয়ে এসে মুখ বাঁকা করে বলল,
— “আরে, আমাকে কিছু বলবি না? আমি তো চিনি ওরে। কলেজে একসাথে ছিলাম।”
যাইহোক, তন্ময়ের সঙ্গে তাদের একপ্রকার বন্ধুত্ব তৈরি হলো। ক্লাস শেষে চারজন মিলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল, গল্প করতে করতে। মূল ফটকে এসে নাবিলা ওদের বিদায় দিল হাত নেড়ে। তারপর পা বাড়াল সামির যেখানে সবসময় অপেক্ষা করে সেইদিকে। সামিরের কপাল কুঁচকানো, চোখজোড়া তীক্ষ্ণ। ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— “ওই ছেলেটা কে?”

নাবিলা হকচকিয়ে গেল। এই বান্দা দেখল কেমনে? চোখ অতদূর গেল কীভাবে? নাবিলা সহজ গলায় বলল,
— “বন্ধু।”
— “বন্ধু, হুম। বন্ধু…”
— “ইয়েস।”
নাবিলা বাইকে উঠে সামিরের কাঁধে হাত রাখল। নাবিলার হাতের স্পর্শ সামির খেয়াল করল। সে কিছুটা অচঞ্চল হয়ে সেই স্পর্শ অনুভব করল। “হাত সরাও” বলতে চেয়েও বলল না।
বাড়ি ফেরার পর অন্বেষা এলো কথা বলতে। এসেই সামিরের সাথে একচোট লাগল। মুখে মুখেই শুরু হলো কাঁটাছেঁড়া, সামিরও কম যায় না।
— “তোমার স্বামী নিজে বিয়ে করছে তাই চায় না দুনিয়ার আর কারো বিয়ে হোক। কাল আমাকে রীতিমতো অভিশাপ দিছে, আমার নাকি বিয়ে হবে না।” নাবিলার দিকে তাকিয়ে অভিযোগ জানাল অন্বেষা।

সামির খোঁচা মারল,
— “হবে নাই তো।”

অন্বেষা চোখ বড় বড় করে বলল,
— “ক্যান? তুই একলা বউ নিয়ে ফুর্তি করবি? আমরা দেখব?”
— “হুম দেখবি।”
— “তোর বউ আমি কিডন্যাপ করব।”

সামির হেসে বলল,
— “এহহ, শখ কত! মানুষের বউ নিয়ে টানাটানি করে? বেহায়া কোথাকার। যা ভাগ।”
মিনিট দশেকের ঝগড়ায় ঘর ভাসিয়ে ফেলল দু’জন। নাবিলা বিরক্ত হয়ে গেল। দু’জনের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে চুপ করিয়ে দিল। সামিরকে ধমকে আপাতত ঘরের বাইরে যেতে বলল। তারপর অন্বেষাকে নিয়ে বসল। অন্বেষা যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, রায়হান ভাইয়াকে কোনোভাবেই ম্যানেজ করা যাবে না। অসম্ভব। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, কাজ হবে না। তাই এবার আর ম্যানেজ করার চেষ্টা নয়… সরাসরি পালাতে হবে।
সব শুনে নাবিলা আকাশ থেকে পড়ল। বিস্মিত চোখে অন্বেষার দিকে তাকিয়ে রইল। ওরাও দু’জন এককালে পালিয়েছিল তবে সেখানে রোমান্টিক ব্যপার-স্যপার ছিল না। ফালতু একটা কাহিনী হয়েছিল। যতই ভাবছে ততই মাথার ভেতর সিনেমার দৃশ্য ভেসে উঠছে। দু’জন মানুষ রাতের আঁধারে গোপনে বেরিয়ে যাচ্ছে, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অথবা ছুটে চলা ট্রেনে চেপে বসছে… কোনো রোমান্টিক বাংলা সিনেমার কাহিনী। প্রেমিক-প্রেমিকার এইরকম সিনেমাটিক কাহিনী ও আগে কখনো দেখা তো দূর… শোনেও নাই!
অন্বেষা আরও বলল, সব ঠিকঠাক করে সে সামিরকে জানাব। অবশ্য সামিরকে জানানোর গুরু দায়িত্বটা নাবিলাকেই পালন করতে হবে।

তন্ময়ের কারণে প্রথমে টুকটাক আলাপ দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে পরিচয় হয়ে গেল মাহিন, সাদিক আর আকসার সাথে। তন্ময় সবসময় একটু ঠাণ্ডা মাথার, ভদ্রভাবে কথা বলে। মাহিন একেবারে উচ্ছল, যেকোনো মুহূর্তে এমন কাণ্ড করে বসবে যে সবাই হেসে লুটোপুটি খাবে। সাদিক শান্ত, তবে কথার ভেতরে একরকম গভীরতা। আর আকসা, দুষ্টুমি না করলে ওর দিনই পরিপূর্ণ হয় না। প্রতিদিন ক্লাস শেষে অথবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিঁড়ির ধাপে বসে ছয়/সাতজনের দলটা একসাথে গল্পে মেতে ওঠে।
একদিন ক্লাস শেষে সবাই মিলে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আলাপটা শুরু হলো খুব সাধারণভাবে। এরইমধ্যে আকসা হঠাৎ নাবিলাকে বলল,
— “তোকে তো কেউ একজন এসে নিয়ে যায় প্রতিদিন, তাই না?”

মাহিন সঙ্গে সঙ্গে বলল,
— “আমিও জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম। ওটা কে?”

তন্ময় হেসে যোগ করল,
— “কে রে, পার্সোনাল কেউ?”

নাবিলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লুকানোর কিছু তো নেই। তবুও বলল,
— “আমার আসামি।”
— “আসামি?”
— “হুমম।”
— “কেমন আসামি?”
— “জেলে বন্দী আসামি। যাইহোক, পরে বলব।” নাবিলা তড়িঘড়ি করে বলল। সামির-ই ওকে বলতে মানা করেছিল। ওর কি দোষ?

সাদিক ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করল,
— “আসমি বেশ কেয়ারিং, নিয়মিত নিতে আসে?” নাবিলা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। বন্ধুদের কাছে সামিরকে আসামি বললেও, নিজের মনে তো সেই সম্পর্কের ব্যাখ্যা আলাদাও নয়; সে তো স্বামী নামক আসামি-ই।
ওদিকে নাবিলার আসামি নীরবে সবকিছুই লক্ষ্য করছিল। নাবিলা কখন ক্লাসে ঢুকল, কোন ক্লাস করল, কোনটা করল না, কখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, সবটাই তার নজরে। তবুও সে নীরব। কিছু বলার নেই, বলার অধিকার আছে। তবে বন্ধুত্ব তো এই বয়সেই স্বাভাবিক, মানুষ এসময়েই ডানা মেলে, উড়তে চায়। সে নিজেও এককালে উড়েছিল।
কিন্তু সামিরের চিন্তা অন্যদিকে। নাবিলার তো এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়ার বাতিক আছে। এখানেও উড়তে উড়তে যদি হঠাৎ ধপাস করে পড়ে যায়? তখন? কে হাতে ধরবে, কে ওকে রক্ষা করবে? সামিরকেই তো তখন হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নাবিলাকে চোখে চোখে রাখা তার কাছে দায়িত্বের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামির নিজেও বুঝতে পারে না, এই দায়িত্ববোধ তার কবে থেকে আর কেনো এলো। নাবিলাকে বিয়ে করেছে বলেই? বউ বলেই? নিজের মনেই সে প্রশ্ন করে আবার উত্তরও নিজেই দিয়ে ফেলে, “হুম, হয়তো তাই। বউ বলেই…”

তবে শুধু ‘বউ’ শব্দটা দিয়ে কি সব বোঝানো যায়? থেকে থেকে মনে হয়, ব্যাপারটা কেবল সম্পর্কের কাগজে-কলমের বাঁধনে আটকে নেই। অনেকদূর গড়িয়েছে। কিন্তু কতদূর? নাবিলাকে ঘিরে যে এক অদৃশ্য টান তৈরি হয়েছে ওই পর্যন্তই তো; এটাই কি অনেক? এই টান তো অন্য কারো জন্য কখনো হয়নি। অন্যকারো প্রতি এইরকম কতৃত্ববোধ, এইরকম অস্থিরতা, এইরকম অযাচিত দায়িত্ব নেওয়ার মত ইচ্ছে তার জীবনে আসেইনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই দায়িত্ববোধের ভেতরে একটা টান আছে কিন্তু ভালোবাসা নাই। ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা সহজ না। তার ভাবনায়, ভালোবাসা কোনো হঠাৎ আসা অনুভূতি নয় বরং দীর্ঘসময়ে জন্ম নেওয়া এক জটিল বন্ধন। এটা তো সামিরের নিজস্ব ভাবনা কিন্তু যদি সে একবার নিজের মনকে সত্যি সত্যি প্রশ্ন করত তবে উত্তরটা পরিষ্কার আসত, “আরেহ্ পাগলা, মনের টান আর ভালোবাসা আলাদা কিছু না। একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়ানো। যেমন আকাশে মেঘ জমলে বৃষ্টি নামবেই, যেমন ভোর এলে আলো ফুটবেই, তেমনি টান থাকলে ভালোবাসা জন্মাবেই। ভালোবাসা শুধু মিষ্টি শব্দ নয়, ভালোবাসা নিরব উপস্থিতি, নিঃশব্দে খেয়াল রাখা। ভালোবাসা কারো দিকে তাকিয়ে না থেকেও তার প্রতিটি পদক্ষেপে দৃষ্টি রাখা। আর সেই অদৃশ্য দৃষ্টি যখন বুকের ভেতর থরথর কাঁপন তোলে; তখন বুঝতে হবে, এই টান-ই তো ভালোবাসার অন্য নাম।”

রাতে সামির ঘরে ফিরে নাবিলার মুখোমুখি বসল। তার ভালোবাসা থাকুক ছাই মনের টান, নিজের দিকটা পরিষ্কার রাখা দরকার। সে হচ্ছে পবিত্র পাত্র। মানুষ তার সম্পর্কে যা-তা ভাববে তা হবে না। সামির বলল,
— “শোনো, সেদিন আমার সাথে একটা মেয়েকে দেখেছিলে, ওর নাম তানিয়া। ও আমার…”

নাবিলার মনোযোগ তখন বইয়ের পাতায়। সামিরের হঠাৎ বলা কথায় সে মাথা তুলল। মাঝপথে বলল,
— “আপনার গার্লফ্রেন্ড?”

সামিরের স্বর খানিক গম্ভীর হলো,
— “কথার মাঝখানে কথা বলবে না।”
— “আচ্ছা, বলুন শুনি। আমি তো আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলামই। তখন এমন ব্যবহার করলেন, যেন অপরাধ করেছি। এখন হঠাৎ বলতে আসছেন কেন?”
— “শাট আপ। চুপ করে আমার কথা শোনো।”

নাবিলা নীরবে মাথা নাড়ল। সামির আবার বলল,
— “ও আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। একটা বিষয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।”

নাবিলা জিজ্ঞেস করল,
— “আচ্ছা। বাট আমি তো কৈফিয়ত চাই নাই।”

এইতো, মেয়ে দিচ্ছে মাথা গরম করে। সামির রাগ সামলে বলল,
— “কৈফিয়ত আমিও দিই নাই। শুধু জানালাম। সেদিন জানতে চেয়েছিলে। ভাবলাম, একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছে, আমি উত্তর না দিলে কষ্ট পাবে।”
— “ইশশশ, নিজেকে কি ভাবেন? এত সামান্যতে আমি কষ্ট পাই না।”
— “তাই?”

নাবিলা হাসল,
— “জি। আচ্ছা, আপনি হঠাৎ এত ভালো হলেন কীভাবে? রাগারাগী করছেন না, আবার ভালো ভালো কথা বলছেন। আশ্চর্য লাগছে।”

সামির কলার নাচিয়ে উত্তর দিল,
— “আমি ভালোই। আমাকে চিনতে তোমার ভুল হয়েছে।”

নাবিলা আড়চোখে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করল,
— “খুব তাই না? আবার শুরু করলেন? একটু প্রশংসা করেছি বলে মাথার চড়ে নাচছেন? এইজন্য মানুষের ভালো বলতে হয় না।”

সামির খুব হেসে বলল,
— “আমি তোমার মাথায় চড়ে নাচছি? কীভাবে? কার সাথে? ব্রেকডান্স না কাপল ডান্স? তারচেয়ে বলতে তোমার সাথে নাচার কথা। বিষয়টা মানাত। কাম অন, একটা কাপল ডান্স হয়ে যাক।” নাবিলা বালিশে হেলান দিয়ে দেখছিল সামিরের কর্মকাণ্ড। পাগল হয়ে গেল নাকি?
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৯]
~আফিয়া আফরিন

নাবিলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিচ্ছিল। চুলগুলো শেষবারের মত আঁচড়াল ঠিক তখনই সামিরএসে হঠাৎ বলল,
— “আজ কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।”
ব্যস, কথা এখানেই শেষ। কোনো ভূমিকা নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফটাফট এলো, নিজের মতামত প্রকাশ করল আবার বেরিয়ে গেল।
নাবিলা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। ওকে কিছু বলারও সুযোগ দিল না। কি কারণে যেতে মানা করল, তার উত্তর দিবে না? ভেতরে ভেতরে বিরক্তি জমতে লাগল। এতক্ষণ ধরে রেডি হচ্ছিল; বই, ব্যাগ সব গুছিয়ে যখন বেরোনোর প্রায় মুহূর্ত, তখন এসে যদি হুট করে “যেয়ো না” বলে দেয়, কেমন লাগে? তার ওপর কারণও বলে না।
নাবিলা ঠোঁট কামড়ে ভাবল, এখন যদি কথা না শোনে তো আবার পরে এসে উপদেশের বন্যা বইয়ে দেবে, “তোমার তো বোঝা উচিত ছিল। আমি যখন বলেছি না যেতে তখন না গেলেই হতো।” টাইপের জ্ঞান।

নাবিলা ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে আসতেই দেখল, শশুর মশাই টেবিলে বসে আছেন। চোখাচোখি হতেই অকারণ অস্বস্তি কাজ করল। শ্বশুরকে সে খুবই সম্মান করে, উনিও যথেষ্ট স্নেহশীল কিন্তু নাবিলার ভেতরে সবসময় একধরনের জড়তা লেগে থাকে। ফ্রিলি, খোলামেলা কথাবার্তা বলা হয়ে ওঠে না। ও উল্টো দিকে ঘুরল। ঠিক তখনই সাখাওয়াত হোসেন ডাক দিলেন,
— “নাবিলা, মা।”

ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল। এইদিকে ঘুরে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। সাখাওয়াত হোসেন হাত তুলে বসতে ইশারা করলেন। নাবিলা ভদ্রভাবে বসল।
— “কি ব্যাপার মা? খাওয়া-দাওয়া শেষ?”
— “জি, জি।”
— “কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো, মা?”
— “না না, আপনারা আমার এত খেয়াল রাখেন। মামণি আছে, সমস্যা কীসের? আমি বেশ আছি।”

তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
— “সামির কি চলে গেছে?”

নাবিলা একটু থেমে উত্তর দিল,
— “সকালেই বের হয়েছিল। আবার আসলো, তারপর চলে গেল।”

সাখাওয়াত হোসেন ভুরু কুঁচকে বললেন,
— “কী সমস্যা ওর? এত যায় আসে কেন?”

নাবিলা এবার অভিযোগের সুরে উত্তর দিল,
— “আমাকে তো তা বলল না। শুধু বলে গেল, আমি যেনো আজ ক্লাসে না যাই।”
নাবিলা দেখেছে, সামির একমাত্র বাবাকেই ভয় পায়। অন্যকারো কাছে নয়, বাবার কাছেই একটু নত হয়। বাবার কথা মানে সামিরের কাছে আদেশ; সেখানে কোনো অজুহাত, কোনো বাহানা চলে না। বাবার কথায়ই তো সেদিন বিয়েটা করতে হয়েছিল।
নাবিলা অনেকদিন এখানে আছে কিন্তু কখনো কারো কাছে সামিরের নামে অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধ করে নাই। ও জানে, সামির একটু রাগী, একটু নিজের মত চলে তবুও তার ভেতরে একটা সীমা আছে। অন্তত নাবিলার সবসময় সেটাই মনে হয়। আজ একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো। তাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
— “আপনার ছেলে তো সারাক্ষণ বাইরে বাইরেই থাকে। ঘরে থাকার সময় আছে নাকি তার? সেদিন তো রাতে বাড়ি ফিরল, একেবারে বারোটায়। বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা, ঘুরাঘুরি, এই চলছে প্রতিদিন। আজও দেখেন, কোনো কাজ নেই তাই আবার বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে গেল।”

সাখাওয়াত হোসেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন। ছেলে অগোচরে এত উচ্ছন্নে যাচ্ছে? তিনি বললেন,
— “আচ্ছা মা, আমি দেখছি ব্যপারটা। তুমি চিন্তা করো না, মন খারাপ করো না।”
নাবিলা মৃদু হাসল, তিনিও নিজের কাজে বেরিয়ে গেলেন। এটা হচ্ছে হঠাৎ করেই মনে আসা সামির ইয়াসিরের জন্য একটা টোপ। নিজে যা বোঝো তাই তো করো সবসময়, এইবার দেখো কী আছে তোমার কপালে! হুহ… নাবিলা উঠে গেল। রেশমা অন্বেষাদের বাড়ি গেল। ওকেও নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু গেল না। কামিনীর ব্যবহার, তাকানো কোনোটাই ভালো লাগে না। একটা সতীন টাইপের ভাব দেখায়। সামির ছিল তো ওর এক সময়কার এক্স, তার প্রতি এখনও কী নাবিলার বুঝে আসে না। অথচ নিজেও বিয়ে করেছে, সুখে শান্তিতে সংসার করছে তাও এমন করে। আসলে কিছু মানুষের অন্যের সুখ, ভালো হজম হয় না। ওরা ভাবে, পৃথিবীর সমস্ত সুখ শুধু ওদের পায়ের কাছে এসেই লুটোপুটি খাবে। আর এই ভাবনা যখন মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখনই শুরু হয় হিসহিসানি।
সামির এলো বিকাল নাগাদ। তখন নাবিলা ঘুমে… এসেই হাঁকডাক করে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে দিল। ভীষণ জরুরী গলায় বলল,
— “নাবিলা তাড়াতাড়ি রেডি হও, একটু বের হতে হবে আমাদের।”

সামিরের কণ্ঠস্বরটা শান্ত, কোনো রাগ নেই, শুধু একধরনের তাগিদ।
নাবিলা অবাক হলো। হঠাৎ এত ভালোভাবে কথা বলছে কীভাবে? তবুও নিজের জেদটা ধরে রাখার জন্য সে ঘুমের ভান করছিল। সামির হাত দিয়ে কাঁধ নাড়ল, কিন্তু সে পাত্তা দিল না। ভেবেছিল, বেশিক্ষণ ডাকাডাকি করে সামিরই হাল ছেড়ে দেবে। কিন্তু সামির থামল না। বারবার ডেকে গেল। শেষ পর্যন্ত মুখে পানির ছিটে আসতেই নাবিলার অভিনয় ভেঙে গেল। ও ফট করে উঠে বসে রাগভরা গলায় বলল,
— “কী হয়েছে?”
— “বের হব, উঠো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেখো, অলরেডি পাঁচটা বেজে পার হয়েছে।”

নাবিলার চোখে বিস্ময়,
— “কোথায় যাব?”

সামির খানিক অনুরোধের সুরে বলল,
— “যেতে যেতে বলছি। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। তুমি রেডি হয়ে দ্রুত এসো, প্লিজ।”
এই “প্লিজ”টা নাবিলার বুকের ভেতরে কেমন দোলা দিল। ভাবের রাজা হঠাৎ এত ভদ্র, এত অনুরোধমাখা সুরে কথা বলছে? এতদিনের রূঢ়, ভাবুক সামির হঠাৎ হঠাৎ কোমল ভদ্রতায় কীভাবে বদলে যায়? নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটে একচিলতে হাসি এলো। এইভাবে অনুরোধ করছে? এরপরেও কি নাবিলা বারণ করতে পারে? ও উঠে ফ্রেশ হয়ে ফটাফট রেডি হয়ে নিচে নামল। সামির তৈরিই ছিল, নাবিলা এলেই ওকে নিয়ে উড়াল দিবে। নাবিলা এত তাড়াহুড়োর কারণ উদঘাটন করতে পারছিল না। পথিমধ্যে সামিরকে জিজ্ঞেস করল,
— “এইবার তো বলুন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

সামির রাখঢাক না রেখে বলে দিল,
— “কাজি অফিসে।”
— “কি?” নাবিলা আকাশ থেকে পড়ল।

— “হুম।”
— “কিন্তু কেনো?”
— “কাজি অফিসে মানুষ কেন যায়?” সামির প্রশ্ন করে।
— “বিয়ে করতে।”
— “জানো যখন তখন নতুন করে জিজ্ঞেস করছ কেনো?”
— “মানে কি? কে বিয়ে করবে? কাকে করবে? আপনার-আমার সেখানে কাজ কি?” নাবিলা চোখ বড় বড় করে তাকাল।

সামির একটু দুষ্টুমি করে বলল,
— “আমি বিয়ে করব, তুমি দেখবে।”

নাবিলা পেছন থেকে ওর পিঠে বেশ জোরেশোরেই একটা খামচি মারল,
— “সত্যি করে বলুন।”
— “ইশশ, হাত না লোহা?”

নাবিলা জেদ ধরা গলায় বলল,
— “বলুন, বলছি।”
— “আগে তো চলো।”
— “আশ্চর্য! এরকম হেঁয়ালির মানে কি?”

ওরা পুরান ঢাকার একটা কাজি অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। নাবিলা নেমে চারপাশে তাকাল। জীবনে কোনোদিন এমন জায়গায় আসা হয়নি। সামনে দোতলা একটা ভবন, দেয়ালের রং ফিকে হয়ে খসে পড়ছে। দরজার ওপরে টিনের সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা “কাজি অফিস”, তার নিচে ছোট অক্ষরে আরও কতকগুলো আইন-কানুনের কথা, যা দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না।
গলির মধ্যে চা-সিগারেটের দোকান, পুরোনো বৈদ্যুতিক তার ঝুলে আছে মাথার ওপরে। কোথাও পানের দোকান থেকে এলাচের গন্ধ, সিগারেটের উটকো গন্ধ আবার ধোঁয়া উঠা চায়ের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। সামির ফোনে কথা বলছিল। সেখানেও তাড়াহুড়ো, কাকে যেনো ধমকাধমকি করল। নাবিলা নিঃশব্দে চারপাশে তাকিয়ে রইল। সামির এসে ওর হাত ধরে বলল,
— “চলো, ভেতরে যাই।”

ভেতরে ঢুকতেই নাবিলার আরও অবাক। সাদামাটা হলঘর, একপাশে বড় কাঠের টেবিল, টেবিলে মোটা মোটা রেজিস্টার বই স্তূপ করে রাখা। দেয়ালে ধুলোমাখা সরকারি নোটিশ ফ্রেমে বাঁধানো। একজন বয়স্ক কেরানি চশমার ফাঁক দিয়ে কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। পাশের বেঞ্চিতে কয়েকজন ছেলে-মেয়ে বসে আছে। এদের কি নাবিলা চেনে? মনে করার চেষ্টা করল, পারল না। ও ফিসফিস করে বলল,
— “কাহিনী কি একটু বলবেন?”

সামিরকে কিছু বলতে হলো না। তক্ষুনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অন্বেষা আর শাহিদ। বর-বউ বেশে সজ্জিত। তাদের দেখে নাবিলা যা বোঝার বুঝে গেল। বুকটা ধক করে উঠল, চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
উঠে দৌড়ে যেতে নিচ্ছিল, এমন সময় সামির শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল। শান্ত স্বরে বলল,
— “ছোটাছুটি করো না। যা কথা বলার বিয়ের পর বলো। আগে বিয়েটা হয়ে যাক।”

নাবিলা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। গলাটা শুকিয়ে এল, ঠোঁট কাঁপছিল।
— “বাসার কেউ জানে না?”

সামির গভীর শ্বাস নিয়ে উত্তর দিল,
— “না। শুধু আয়ান জানে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছি।” তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যোগ করল, “প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে, আর হয়তো দশ মিনিট লাগবে।”
অন্বেষা নিজেই এগিয়ে এলো নাবিলার দিকে। দু’জন ফিসফিস করে কিছুক্ষণ কথা বলল। এদিকে আয়ান আসতে আসতে দেয়ালঘড়ি প্রায় সাতটা বাজিয়ে দিল। সে আসার পর তড়িঘড়ি সব প্রস্তুতি মিটিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হলো।
অন্বেষার বুকের ভেতর ভয়াবহ কাঁপুনি লেগে রইল। মা-বাবাকে না জানিয়ে হুট করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল। তাই এই আনন্দের ভেতরেও অস্থির অন্ধকার জমে আছে। বাবা-মায়ের মুখোমুখি হলে কীভাবে ব্যাখ্যা দেবে? কেমন প্রতিক্রিয়া হবে তাদের?
অন্যদিকে নাবিলার মনে হচ্ছিল, সে হঠাৎ করেই একটা সিনেমার কাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়েছে পার্শ্ব চরিত্র হয়ে। ওর প্রধান কাজ হচ্ছে, সবটা দাঁড়িয়ে অবলোকন করা এবং ভয়ে সিটিয়ে যাওয়া। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটল যে ওর মাথা ঘুরছিল। সবকিছু শেষে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ওরা যখন ধীরে ধীরে পুরান ঢাকার গলি পেরোচ্ছিল, তখন নাবিলা সামিরকে জিজ্ঞেস করল,
— “যদি বাড়িতে না মানে?”

সামির নির্ভার গলায় উত্তর দিল,
— “মানবে না কেন? না মানার কোনো কারণ নেই।”

নাবিলা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “আছে। আপনি বিষয়টাকে এতটা সহজভাবে নিচ্ছেন কেনো, সেটাই বুঝলাম না।”
— “এটা কি জটিল করে নেওয়ার মত বিষয়? দু’জন মানুষ ভালোবাসে, তারা বিয়ে করেছে। দেখো নাবিলা, যেকোনো কঠিন বিষয় যদি সহজভাবে ভাবো তবে সেটা মোটেও কঠিন থাকে না। এতটাই সহজ হয়ে যায় যে সেটা নিয়ে চিন্তা করে মাথা ধরাতে হয় না।”
নাবিলা চুপ করে গেল। সামিরের কাছে মানুষের সমস্ত সমস্যা পানির মতো হালকা, কিন্তু নাবিলা বেলায় সে সবকিছুকেই দার্শনিক, কঠিন, জটিল, গুরুগম্ভীর, দস্যু, দুর্বোধ্য। উফফফ কী অশান্তি!

বাড়িতে এসে নাবিলা যা ভেবেছিল, একেবারে তার উল্টো কাহিনী ঘটল। ভেবেছিল একটা চিৎকার, চেঁচামেচি হবে কিন্তু সবাই হাসিমুখে মেনে নিল। তবে প্রথম বিস্ফোরণটা ঘটাল রায়হান। আদরের ছোট বোন আর সেই অপ্রিয় বন্ধুকে একসাথে, এই অবস্থায় দেখে মেনে নিতে চাইল না। একমুহূর্তও নষ্ট না করে সে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেল। কেবল দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটা কানে বাজল সবার, ভারী কোনো আঘাত এসে পড়ল ঘরের ভেতর। তবে এইভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলা, পরিবারের সবাইকে বাদ দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া, এতে কারও সন্তুষ্টি নেই। অন্বেষা নিজেও একটা বড়সড় ঝড়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেসব কিছুই হলো না বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল। তবে এখন বাবা-মায়ের মুখ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল।

অন্বেষার বাবা সরফরাজ হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন,
— “এইভাবে তো আমরা মেয়ে বিদায় দিতে পারি না, আবার একমাত্র মেয়ে জামাইকেও ঘরে তুলতে পারি না। সমাজে আমার একটা মান-সম্মান আছে। মানুষ শুনলে কি মনে করবে? কোনো কথাবার্তা নাই, হুট করে বিয়ে করে ফেললেই তো হলো না, তাই না?”
ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তিনি নিজেই মেয়ে-জামাইকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে কিছুক্ষণ কথা বললেন। শেষমেশ তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, অন্বেষা আপাতত এখানেই, নিজের বাড়িতে থাকবে। পরে দু’পরিবার বসে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলে বাকি আয়োজন সম্পন্ন করা হবে। সবাই মাথা নাড়ল, পরিস্থিতি মেনে নিল। মুখে একচিলতে হাসিও ফুটল।
সবের ভেতর, অগোচরে সামির নাবিলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তার চোখের ভাষায় স্পষ্ট লেখা ছিল, দেখলে? সবকিছু সহজভাবে নিলে জীবনও সহজ হয়ে যায়।
নাবিলার ঠোঁটের কোণেও ফুটে উঠল নিঃশব্দ মিষ্টি হাসি।
.
একটু রাত করেই নাবিলা আর সামির বিদায় নিল। বাইরে তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। সারাদিন ঝরঝরিয়ে নেমে আসার পর এখন শুধু নরম ফোঁটা, নিঃশব্দে ভিজিয়ে দেওয়ার মত বৃষ্টি পড়ছে। সামনের গলিটা পেরোলেই তাদের গন্তব্য, কিন্তু তাড়াহুড়ো করছিল না কেউ। বরং হাঁটছিল অনেকটা ধীরগতিতে। বৃষ্টির ভেতর দিয়েই বাড়ির পথে হাঁটছিল। সরু গলির ভেজা ইট, রাস্তার ধুলো ধুয়ে মসৃণ হয়ে গেছে, বাতাসে কেমন একটা ঠাণ্ডা, স্নিগ্ধ গন্ধ ভেসে আসছে। দূরে স্ট্রিটলাইট বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে খেলে সুন্দর ঝলমলে আলো তৈরি করেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঠিক গায়ে লাগার মতো ভারী নয়, তবুও সতেজতা আছে। হঠাৎ গায়ে লাগলে হালকা শিহরণ জাগছে আর মনে অকারণ ফুরফুরে আনন্দ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে নাবিলা আচানক হেসে উঠল। ওর হাসিটা শোনালো নিশিকন্যার মত।
— “আজকে আয়ান ভাইয়া খুব আফসোস করছিল জানেন? বলছিল, ছোট ছোট ভাই-বোনগুলো একে একে বিয়ে করে ফেলছে আর তার হলোই না।”

সামিরও হাসল,
— “ভালো হয়েছে হয় নাই।”

নাবিলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— “কেনো? ভালো কেনো?”
— “শান্তিতে আছে।”
— “বলছে আপনাকে?”

সামির মৃদু চালে মাথা নাড়ল,
— “বলা লাগে? আমি জানি না? আমি নিজেও ওই জীবন কাটিয়ে এসেছি।”
নাবিলা থেমে দাঁড়াল। ভেজা আঙুল দিয়ে সামিরের হাতে খামচে ধরল। সামিরও থেমে দাঁড়াল, তার চোখে প্রশ্ন। নাবিলা গম্ভীর স্বরে বলল,
— “কি বোঝালেন?”

সামির ফের হাসল,
— “এইতো এটাই। আজকে কয়বার খামচালে?”
— “আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
— “বুঝলা না?”
— “না।”

সামির মজা করে বলল,
— “এইতো বিয়ে করলে রোজ ওর বউ খামচাতো। রাত এগারোটায় বৃষ্টিতে ভিজতে বের হতো, বায়না করতো। আরো কত ছেলেমানুষি সহ্য করতে হতো।”

নাবিলা কোমরে হাত চেপে দারোগার ভঙ্গিতে দাঁড়াল,
— “আমি ছেলেমানুষি করি?”

সামির কাঁধ ঝাঁকাল,
— “তো? তুমি না থাকলে আমি এক দৌড়ে বাড়ি চলে যেতাম।”

নাবিলা এবার জেদ ধরেই বলল,
— “এখন তো আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। চলেন, আমরা দু’জন মোড়ের মাথা থেকে ঘুরে আসি। দেখুন না রাস্তাঘাটে কেউ নাই, শুধু আপনি আর আমি… কী দারুণ মুহূর্ত! এইরকম সময়ে বাড়ি গিয়ে কোনো কাজ নেই। বৃষ্টিটা ভালো লাগছে। উপভোগ করি। সবসময় এমন বৃষ্টিও পাব না, সময়ও পাব না, আর আপনাকেও পাব না।”
নাবিলা নিজেও জানে না, কোন খেয়ালে কথাগুলো বলল। বলেই সামিরের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর খুশিতে হঠাৎ বাচ্চার মতো দৌড়ে উঠল।
— “চলেন চলেন, বাতাসের সাথে ভেসে যাই!”

সামির ওর বিপক্ষে কিছু বলল না। শুধু সাবধানী কণ্ঠে বলল,
— “আস্তে যাও। দেখো, আবার যেন পড়ে যেও না। রাস্তা পিছল।”
বৃষ্টির ফোঁটা তখন বাতাসের সঙ্গে নেচে উঠছে আর সেই নাচের ভেতরে ভেসে যাচ্ছিল দু’জন মানুষ।
হঠাৎ করেই দূরে কোথাও বাজ পড়ল। মুহূর্তে চারপাশ কেঁপে উঠল, বৃষ্টির ফোঁটাও হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। নাবিলা আঁতকে উঠতেই সামির শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল। কোনোদিকে তাকাল না, দ্রুত পা চালিয়ে ভিজতে ভিজতেই বাড়ির পথে ফিরল।
বাড়ি ফিরেই নাবিলা ভেজা কাপড় বদলাতে গেল। চেঞ্জ করে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। নাবিলা থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল, ভেবেছিল সঙ্গে সঙ্গেই আইপিএস জ্বলে উঠবে। এর আগেও তো হয়েছে। কারেন্ট গেলে একমুহূর্তও অন্ধকার থাকেনি। কিন্তু আজ চারপাশে এখনও গাঢ় অন্ধকার।
জানালার বাইরে থেকে মাঝে মাঝে বিজলি চমকানির আলো আসছিল। প্রতিবার ঝলকানি কাটলেই ঘরটা আরও বেশি অন্ধকার, আরও বেশি ভৌতিক হয়ে উঠছিল। নাবিলার বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল। অন্ধকার ভেদ করে হাত বাড়িয়ে ঘরের বাইরে বেরোল সে। “মামণি, মামণি” শব্দে দৌড় দিল, দু’টো ঘর পেরোতেই কারো গায়ে ধাক্কা খেল। বিন্দুমাত্র দেরি না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। উফফ, মামণি ঠিক সময় চলে এসেছে! মামণি তাকে এত্ত বোঝে! কিন্তু হঠাৎ সেই আলিঙ্গনে একটা অস্বস্তি ধরা দিল। অন্যরকম লাগছে… পরক্ষণেই ভাবল, “না না, এটা তো মামণিই। আচমকা ভয় পেয়েছি, তাই সবকিছু এলোমেলো লাগছে।”
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২০]
~আফিয়া আফরিন

অন্ধকারে নাবিলা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল যাকে, প্রথমে ভেবেছিল সেটা তার মামণি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বুকের ভেতর ধুপধুপ শব্দ হচ্ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তার নাকে ভেসে এলো অচেনা অথচ খুব আপন ঘ্রাণ। ভেজা জামাকাপড়ে মিশে থাকা সামিরের শরীরের উষ্ণ ঘ্রাণ, যা নাবিলা এইমুহুর্তে চিনতে ভুল করল না। ও থমকে গেল। বুঝেও সরে আসতে পারল না, পা দু’টো কীভাবে যে আটকে গেছে ওখানে। এটা কি সম্মোহন হওয়া? নাবিলা কি সম্মোহিত হতে যাচ্ছে? পরক্ষণেই টের পেল, সামিরের হাত ওর কাঁধ ছুঁয়েছে। নাবিলা তো এইবার কাঁপতে কাঁপতে বেহুঁশ হয়ে পড়েই যাবে। এটা কি হচ্ছে ওর সাথে? এই একটা ভুলবশত আলিঙ্গন… বেশি কিছু ভাবতে পারল না। বাস্তবতা নিশ্চিত করার জন্য নিজের আঙুলের ডগা গিয়ে ছুঁলো সামিরের কাঁধ, ভেজা জামার ভাঁজ, আর তাকে। শরীরের তাপটা স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ল নাবিলার ভেতরে। ও খানিক কেঁপে উঠে ফিসফিস করল,
— “আপনি…?”
— “হ্যাঁ, আমি।”

কণ্ঠের সুরটা একসাথে ভরসা আর আপনত্বের প্রতিশ্রুতি ছিল। নাবিলা চোখ বুজে কান পেতে রইল। মনে হলো, সামিরের বুকের ভেতর ধকধক করে বাজছে হৃদস্পন্দন, যা ওর নিজের ভেতরের স্পন্দনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আর ও কান পেতে তা শুনছে। একমুহূর্তে ভয় গলে গেল। আতঙ্কে কাঁপতে থাকা হাত এবার শক্তভাবে ধরল সামির ইয়াসিকে, বর্তমানে সেখানেই তার সমস্ত নিরাপত্তা লুকিয়ে আছে।
বিজলি আবার চমকালো বাইরে। সেই ক্ষণিকের আলোয় নাবিলা স্পষ্ট দেখতে পেল সামিরকে, তার চোখ; চোখের ভেজা পাপড়ি, শান্ত ভঙ্গি, চুল বেয়ে এখনও পানি পড়ছে, আর তাকিয়ে আছে ওর দিকেই, চোখদুটো বোধহয় বিশাল এক সমুদ্র। সেই দৃষ্টি বলল সব কথা, যা মুখে বলার দরকার হয় না। নাবিলা বলল,
— “আমি ভেবেছিলাম মামণি…”

সামির ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে ফিসফিস করে বলল,
— “আর আমি ভেবেছিলাম, তুমি আর কতবার ভুল করবে।” নাবিলা তখনও সামিরের বুকের ভেতর মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। সরে আসতে ইচ্ছে করছিল না। সরে আসার কথা ভাবতেই অভ্যন্তরীণ থেকে কী একটা ‘না, না’ আর্তনাদ করে উঠছে। নাবিলা হাত দিয়ে তার টি-শার্টের বুকের দিকটা খামচে ধরেছে। সামিরের কথার জবাবে বলল,
— “ভুল করি নাই তো।”

অন্ধকার ঘরটা নিস্তব্ধ। শুধু জানালার বাইরে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ আর মাঝে মাঝে বিজলি চমকে ওঠার ক্ষণিক আলো। সামির মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “ভয় পেয়েছিলে?”

নাবিলা ঠোঁট কামড়ে খুব ধীরকণ্ঠে; শোনা যায় না এমনভাবে উত্তর দিল,
— “হুম।”
— “অন্ধকারে ভয় পাও?” সামিরের কণ্ঠে টানাটানি করা কৌতূহল।
— “হুম।” আবার মাথা নাড়ল নাবিলা তবে কণ্ঠটা আগের মতই, প্রায় শোনা যায় না।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দু’জন। নীরবতা আরও গভীর হলো। অন্ধকার ঝেঁকে বসল। সামির মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল,
— “কিন্তু এখন তো অন্ধকারই আছে। ভয় পাচ্ছো না কেন?”

নাবিলা কেঁপে উঠে মুখ তুলল। বিজলি চমকালো আবার বাইরে। আগের মত স্পষ্ট হলো না। তবে সামিরকে ও ঠিকই স্পষ্ট দেখতে পেল। নাবিলা চোখ সরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। নিজেও একটু সরল। ওর ঠোঁট নড়ল কিন্তু শব্দ বের হলো দমবন্ধ করে,
— “আছে… সাথে আপনিও তো আছেন।”
এই উত্তরটা বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই নাবিলা বুঝল, সে যা বলতে চেয়েছিল তা বলার ইচ্ছে ছিল না। বুকের ভেতর ধপধপ শব্দ বাড়ল আরও। সামির মৃদু হেসে মাথা নিচু করল। গলায় মজা মেশানো গাম্ভীর্য,
— “মানে? আমি থাকলে ভয় নেই?”

নাবিলা বেশ জেদি গলায় বলল,
— “আমি কি তাই বলেছি? আপনি ইচ্ছে করে অন্য মানে বের করছেন।”

সামির একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
— “তাহলে ঠিক মানেটা বলো।”
অন্ধকারে সামিরের প্রশ্নের উত্তর দিল না নাবিলা। উল্টো ঘুরে উল্টো পথে পা বাড়াল। ঠিক তখনই সামির ওর হাত চেপে ধরল শক্ত করে। শক্ত করেই ধরেছে তবে লাগছে না বরং মনে হচ্ছে সে এই হাত জন্ম জন্ম, সহস্র জন্ম ধরে থাকুক। সামির নাবিলার হাতটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে সামান্য কাছে ঝুঁকল। অন্ধকারে চোখে চোখ দেখা না গেলেও নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছিল। সে গলায় রহস্যময় হাসি মিশিয়ে ফিসফিস করল,
— “বলো?”

নাবিলা থেমে গেল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “কী বলব?”

সামির আর একচুল কাছাকাছি এলো,
— “ঠিক মানেটা। আমি থাকায় ভয় পাচ্ছো না… নাকি অন্য কোনো কারণে?”

নাবিলা ঠোঁট কামড়ে নিচু স্বরে উত্তর দিল,
— “জানিনা।”
— “উঁহু, জানো।”

— “উফফ… জানিনা বলেছি তো!” নাবিলা কণ্ঠে উপর উপর বিরক্তি দেখালেও তাতে কেমন গোপন কম্পন ছিল। ফের বলল,
— “ফোর্স করছেন কেনো?”

সামির ফিসফিস করে বলল,
— “একটু করলে কী হয়?”
এইবার আর কোনো উত্তর দিতে পারল না নাবিলা। বুকের ভেতর তীব্র ধুকপুকানি, নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে। কথা বলতে গেলে ঠোঁট কেঁপে যাচ্ছে।
সামির দেখতে পাচ্ছিল না ওকে, নাবিলাও দেখতে পাচ্ছিল না সামিরকে; তবু তারা দু’জন একে অপরকে অনুভব করছিল ভেতরের প্রতিটি কাঁপুনিতে। দূরত্বের রেখা নেই বললেই চলে। শুধু ‘দুরত্ব ঘুচল’ স্বীকার করার সাহসটাই বাকি। নাবিলার মনে হচ্ছিল, এ অন্ধকারের আড়ালে নিজের সব সত্যিই লুকিয়ে রাখা যায়। অথচ সামিরের শক্ত হাতের চাপে বারবার মনে হচ্ছিল, আর কতক্ষণ নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব? অবশেষে নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে সামিরের বুকে আলতো ধাক্কা মেরে বলল,
— “কচু হয়…” বলেই এক নিমেষেই ঘুরে দাঁড়াল নাবিলা। ছুট্টে পালাল অন্ধকারের মধ্যেই। সামির দাঁড়িয়ে রইল, ঠোঁটে অদৃশ্য হাসি ঝুলিয়ে। আর ঠিক তখনই কারেন্ট চলে এলো। অন্ধকার তো কেটে গেল তবে সেই অন্ধকারের রেশ এখনও রয়ে গেছে।
সামির নিজের টি-শার্টের দিকে তাকাল। ঠিক বুকের বাম পাশে, যেখানে নাবিলার হাত শক্ত করে ধরা ছিল সেই অংশটা এখনও কুঁকড়ে আছে। অল্পক্ষণের জন্যেও চাপা রাখা উষ্ণতার চিহ্ন এখনো টিকে আছে। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, হাওয়া হালকা ঠান্ডা। এতক্ষণ ভিজে থাকার পর শার্ট প্রায় শরীরেই শুকিয়ে আসছে। সামির হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখল সেই অংশটা। সরাসরি ঘরে গেল না। উল্টোদিকে ঘুরে কোথায় যে গেল কে জানে!

ওদিকে নাবিলা চুপচাপ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। অদ্ভুত কাঁপুনি ছড়িয়ে আছে শরীরে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজটা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। এতটাই জোরে ধুকপুক করছে যে, নিস্তব্ধ আঁধার রাতে সে নিজেই নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে আর মনে হচ্ছে, সামিরও যদি কাছাকাছি থাকত সেও হয়তো শুনতে পেত।
আজকে সামিরের মুখোমুখি হতে অদ্ভুত অস্বস্তি লাগবে নাবিলার। চোখে চোখ রাখতে পারবে না, তাকাতে পারবে না; স্রেফ মরে যাবে। ঘরের ভেতর অস্থিরতার চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল। তাই পাশের ফাঁকা ঘরটার দিকে দৌড়ে গেল ও। যাওয়ার আগে দুটো বই নিল, বইয়ের পাতার আড়ালে সে সহজেই লুকিয়ে ফেলতে পারবে নিজের দোটানা, নিজের ধড়ফড়।
ঘরে ঢুকে দরজাটা টেনে দিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। বই খুলে রাখল সামনেই। শব্দগুলো ঠিকঠাক চোখে পড়লেও মনের ভেতর কেবল সামিরের চোখ, সামিরের হাসি, সামিরের বুকের ভাঁজ হয়ে থাকা জামা আর ওই ঐন্দ্রজালিক সুন্দর মুহূর্তটা ঘুরপাক খাচ্ছে। বালিশে হেলান দিল। মামণি যদি হুট করে এসে দেখে তবে বলতে পারবে, পড়তে এসেছিল এই ঘরে আর পড়তে পড়তে চোখ লেগে গেছে।
মিথ্যা বৈকি; মন জানে, এ কেবল অজুহাত। আসলে সামিরকে এড়িয়ে চলার এক মরিয়া চেষ্টা। চোখদুটো নামিয়ে নিল বইয়ের পাতায়, অথচ একেকটা অক্ষর সামিরের নাম হয়ে ঝিলমিল করছে।

সামির উত্তরের বারান্দার এককোণায় দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, শুধু টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ। অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে আছে, বাতি জ্বালায় নাই। আপাতত অন্ধকার ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ আগেই এমন অন্ধকারে নাবিলা তার হাত শক্ত করে ধরেছিল। সে ভাবছিল,
“আমি কি খুব কাছে চলে যাচ্ছি ওর‌ নাকি গেছি? নাবিলা তো কিছু বলে না শুধু দৌড়ে পালায়। এই দৌড়াদৌড়ির অর্থ কি? যদিও ওর স্বভাবের সাথে স্থির হয়ে বসে থাকাটা মানায় না। এই দৌড় কি লজ্জা থেকে আসা নাকি দ্বিধাদ্বন্দ্ব? কিন্তু ওর চোখ, ওর নিঃশ্বাস, সবকিছুই তো বলে দিচ্ছে… কিছু একটা আছে। যদি জিজ্ঞেস করি, উত্তর দিবে নাকি আবার কচু বলে পালাবে?”
তার বুকের ভেতরও ঢিপঢিপ করছে, কিন্তু চেহারায় সেই দস্যি-শান্ত ভাবটাই ধরে রাখল। বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারবে না, ভেতরে সে ঠিক কতটা আলোড়িত।
.
সকালে নাবিলা ছুটে পালাল। ঘরে ঢুকেই দেখল সামির গভীর ঘুমে। তার নিঃশ্বাসের ধাক্কা, উঠানামা… অথচ সেই দৃশ্যের দিকে ভালো করে তাকাতেই পারল না ও। বুকের ভেতর কম্পন উঠল। কোনোরকমে মুখ-হাত ধুয়ে, তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে খেয়ে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
ওদিকে সামিরের ঘুম ভাঙল অনেক দেরিতে। রাত জেগে থাকার কারণে সকালে বেশ ভালো একটা ঘুম হয়েছে। নাবিলাকে কোথাও দেখতে পেল না। মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানল, ও আরোও আগেই বেরিয়ে গেছে।
সে গতরাতে ঘরে ফিরেছিল মাঝরাতে। এসে নাবিলাকে খুঁজে পায়নি নিজের ঘরে। চারিদিক ঘুরে অবশেষে পাশের ঘরটাতে গিয়ে দেখে, বালিশে মাথা এলিয়ে বই মুখের ওপর চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সামির বইটা আলতো করে সরিয়ে রেখেছিল, যেন নাবিলার ঘুম ভেঙে না যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর ঘুমাল, সেই ঘুম মাত্র ভাঙ্গল। নাবিলা একবার ডাকলেও পারত। একা একা চলে যাওয়ার কি দরকার ছিল? সামির রেডি হয়ে নিল ফটাফট, ওকেও বের হতে হবে এখন।

ভার্সিটি লাইফে নাবিলার বেশ ক’মাস পেরিয়ে গেছে। নতুন বন্ধু, গ্রুপ স্টাডি, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, সিনিয়রদের সাথে মেলামেশা, সবকিছু মিলিয়ে দিনগুলো ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে। সবার সাথে মিশে ভালোও লাগছে।
সিনিয়রের মধ্যে একজনের নাম বেশি শোনা যায় ওদেরকে কেন্দ্র করে, তার নাম আদনান। একই ডিপার্টমেন্টের তবে থার্ড ইয়ারে। নাবিলা আদনানকে প্রথম চিনেছিল একটা প্রেজেন্টেশনের সময়। সেই থেকে ওর সাথে ভালো একটা যোগাযোগ হয়ে গেছে। প্রতিটা এসাইনমেন্টেও সাহায্য করে।
আজও লাইব্রেরিতে এসাইনমেন্টের কাজ চলছিল। টেবিলের চারপাশে বইয়ের স্তূপ, কাগজে আঁকিবুকি আর ফিসফিসে আলোচনার ভেতরে নাবিলা বসে আছে। সবাই একসাথে আছে, গল্পগুজব হচ্ছে, মাঝে মাঝে হেসে উঠছে আবার সিরিয়াসভাবে নোট নিচ্ছে। আদনান খুব ধৈর্য নিয়ে কয়েকটা পয়েন্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল। ওর বলার ভঙ্গীটা সুন্দর আর সহজ। অনেকক্ষণ বাদে একটানা পড়ার পর নাবিলা বই বন্ধ করে বলল,
— “আমি উঠি এখন।”

আদনান মুখ তুলে তাকাল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
— “দু’মিনিট দাঁড়াও, আমিও আসছি।”
নাবিলা ঠোঁট কামড়াল। অজান্তেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিল। মনটা কেমন দুরুদুরু করছে। আজও কি সামির অপেক্ষা করছে? ও কি আজ এসেছে নিতে? এমনিতে তো সবসময়ই আসে। কালকের ঘটনাটা কি সহজভাবে নিয়েছে? কেনো নিবে না? সে তো আর নাবিলার মত অনুভবের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে মরছে না। সামির হয়ত মনেই রাখে নাই কিংবা মনে রাখলেও পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে নাই। অন্যান্য সব ঘটনার মত ছোটোখাটো অপ্রয়োজনীয় একটা ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে গেছে।
আদনান নাবিলার চোখের সামনে তুড়ি বাজাল। ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে নাবিলা ফের ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ির কাঁটা বলছে, হাতে এখনও দশ মিনিট আছে। একটু ভেবে অন্যমনস্ক হাসি দিয়ে উত্তর দিল,
— “আচ্ছা।”
আদনান একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছিল কোনো জটিল টপিকের উপর। নাবিলার মনে হলো, সে দু’মিনিটের কথা বলে আরও বেশি সময় অপেক্ষা করাবে। এইদিকে ও এইভাবে চলেও যেতে পারছিল না। তাই একটা বই নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল।

সামির প্রতিদিনের মতো যেখানে দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল। চারপাশের ভিড় হালকা হয়ে যাচ্ছে অথচ নাবিলা আসছে না। কপালে একটা চিন্তার রেখা, নাবিলা চলে গেছে? কিন্তু কেনো যাবে? তো জানেই তো, আমি আসব ওর জন্যই…
মাঠের দিকটা ফাঁকা দেখে সামির লাইব্রেরীর দিকে এগোল। ও যে এইসময় ক্লাসে থাকবে না তা নিশ্চিত।
নাবিলা তখন বইপত্র গুছিয়ে বের হচ্ছিল। ওর দুই কদম সামনে হাঁটছে আদনান। দরজার কাছে আসতেই চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের; সামির আর নাবিলার। একমুহূর্ত শব্দহীন, সময় থমকে থাকা। দু’জন দু’জনের দিকে শুধু চেয়ে রইল। নাবিলার দৃষ্টির ভেতর লুকিয়ে ছিল অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্ন, গভীর টান আর সামিরের দৃষ্টিতে লুকানো ছিল স্বীকার না করা স্বীকারোক্তি। তবে কেউ কারো দৃষ্টি সম্পর্কে অবগত ছিল না তাই কিছু বুঝতেও পারল না। নাবিলা চোখ নামিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করা শব্দটা বেড়ে গেল। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। ঠিক তখনই আদনান ফিরে তাকিয়ে বলল,
— “নাবিলা এসো। এতক্ষণ না তাড়াহুড়ো করছিলে?”

ও অপেক্ষায় ছিল সামিরের দৃষ্টি থেকে ছুটে পালানোর। তাই আদনান ডাকতেই চলল দ্রুত পায়ে, আদনানের পেছন পেছন।
সামির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর অচেনা এক ধাক্কা খেল।
এটা কী হলো? সে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, তবুও নাবিলা অন্যকারো সঙ্গে বেরিয়ে গেল? নাবিলার সেসময় চোখ নামিয়ে নেওয়া, তারপর এক দৌড়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া; সবকিছু চোখের সামনে ধীর গতিতে বারবার ভেসে উঠছিল। বিয়ষটা তার মানে লাগল। রাগে জিদে সামির দাঁতে দাঁত চেপে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল, মুঠো শক্ত করে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো।
নাবিলা দাঁড়িয়ে ছিল সামিরের অপেক্ষাতেই। কিন্তু সামির ওকে চোখেও দেখল না। বাইকে উঠে, স্টার্ট দিয়ে শা শা শব্দ তুলে নাবিলাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। এত দ্রুত, এত তীব্র গতিতে যে নাবিলা চমকে মাথা তুলে তাকিয়েও বুঝতে পারল না, শুধু বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগল। হাঁ করে তাকিয়ে রইল সামিরের গমন পথে… এটা কি হলো?

সামির এমনই, রাগ করলে সরাসরি বিস্ফোরিত হয় না বরং নীরবে জমিয়ে রাখে। বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে ঝড় চলে। তার জেদ প্রবল, একবার কিছু ঠিক করে নিলে বা কষ্ট পেলে সহজে নরম হতে পারে না। কথায় কম প্রকাশ পায়, কিন্তু কাজে হঠাৎ চুপ করে যাওয়া, উপেক্ষা করা অথবা আচমকা তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়। আর তার ব্যক্তিত্বে দৃশ্যমান কঠোরতা আছে, আবার ভেতরে অদৃশ্য গভীর আবেগও লুকিয়ে আছে।
সে তো আবেগটা দেখাতে পারে না তাই বারংবার কঠোরতাই ফুটে উঠে। এইবারও তাই হলো। ওই ঘটনার পর থেকে সে নাবিলার সাথে আগের মতো কথা বলে না। তার নিরব অভিমান চারপাশে ছড়িয়ে আছে। নাবিলা অনুভব করছে, সামির ইচ্ছে করেই ওকে এড়িয়ে চলছে।
বাড়িতে থাকলেও সামিরের উপস্থিতি না থাকার মতই। বেশিরভাগ সময় বাইরেই কাটিয়ে দেয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, হুটহাট বেরিয়ে যাওয়া বাড়ছে দিনকে দিন। কথার কমতি নয়, একধরনের অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি করছে সে। নাবিলা বোঝে, এটা সামিরের জেদ। কিন্তু এই জেদ কী কারণে তা বোঝে না।

সেদিন রাতে সাখাওয়াত হোসেন সামিরকে ডেকে পাঠালেন। ইদানিং ছেলের অতিরিক্ত ঘোরাঘুরি তার চোখেও পড়েছে। তারমধ্যে নাবিলাও বলছিল সেদিন। সামিরের পিছু পিছু নাবিলাও এলো। তবে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। এখান থেকেই দেখবে শশুড় আব্বা তার আদরের সুপুত্রকে কী কী বলেন?
সামির চোখেমুখে তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যটা ধরেই রাখল। সাখাওয়াত হোসেন ছেলেকে কিছুক্ষণ নিরবে দেখলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন,
— “ইদানিং তোমাকে কম ঘরে পাই। বেশি বাইরে থাকা হচ্ছে… কীসের এত ব্যস্ততা বলো তো?”
সামির কোনো উত্তর দিল না। ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তার এই চুপ করে যাওয়া বাবাকে আরো গভীর দৃষ্টিতে তাকাতে বাধ্য করল।
— “দেখো আমি তোমার বাবা। তোমার বয়স, সময় পার করে এসেছি। ইদানিং খুব উদাসীন মনে হচ্ছে সবকিছুতে। আমার চোখ ফাঁকি দেয়া কিন্তু সহজ না। বাড়িতে সবাই আছে, নাবিলাও আছে… তারপরেও বাইরে বাইরে ঘোরা, এসব দেখতে ভালো লাগে না। তোমাকে নিয়ে আমার ভরসা আছে। আমি চুপচাপ থাকি কিন্তু তার মানে এই না যে আমি কিছু টের পাই না। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না, বুঝেছো?”

সামির বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে চারপাশে তাকাল। তখনই দৃষ্টি গিয়ে আটকাল অদূরের পর্দার আড়ালে। নাবিলার ছায়া, চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছে। মুচকি মুচকি হাসছে। সামির তাকাতেই ওর দিকে এমন এক হাসি দিল যে ভেতরে জমে থাকা রাগ দ্বিগুণ হয়ে গেল।
নাবিলা সামিরের চাহনিতে মুহূর্তে মুখে টেনে আনল দুষ্টুমি মেশানো মৃদু হাসি। সেই হাসির ভেতরে গুপ্ত বিজয়ের আনন্দ। ঠোঁটের কোণে খেলল ‘ইয়াহু জিত্তা গেছি’ টাইপের ভঙ্গি। মনে মনে উল্লাস করে উঠল,
— “ইশশশ… তাকাইছে রে!”
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]