#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৭]
~আফিয়া আফরিন
গয়নার দোকানে ঢুকতেই ঝলমলে আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল সবার। একেকটা গয়না গলা ডুবিয়ে দেয়ার মতো দামি আর ঝকমক করছে। এর মধ্যেই কামিনী একখানা ভারী নেকলেস হাতে তুলে আয়নার সামনে ধরে বলল,
— “দেখো না, কেমন লাগছে?”
রায়হান এক ঝলক তাকিয়েই চোখ বড় বড় করে ফেলল। ঠোঁট কামড়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “চমৎকার… না নিলেই বাঁচি।”
কামিনীর ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল, এটা সে কিনবেই; কিনতেই হবে।
রায়হান কপাল চাপড়ে বলল,
— “বুঝলি সামির, আজকে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের জানাজা পড়া হবে।”
সামির পাশে দাঁড়িয়ে চাপা হেসে বলল,
— “ভাইয়া, আমার ভাবিজানের আবদার বলে কথা! মানা করো না, কিনতে দাও।”
নাবিলা হেসে ফেলল। সামিরের মুখে ভাবিজান ডাকটা বেশ লাগে। ইচ্ছে করেই খোঁচা মেরে বলে। রায়হান বুঝতে না পারলেও কামিনী তো বোঝে, এমনভাবে তাকায় যে চোখের আগুনে ভষ্ম করে দিবে। এইবারও তাকাল। রায়হান কামিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে,
— “শোনো এই নেকলেসটা খুবই হেভি, তোমার গলায় কষ্ট হবে।”
কামিনী কটমট করে তাকাল,
— “আমার গলায় কষ্ট হবে নাকি তোমার পকেটে?”
এরপর আর কিছু বলার থাকে না। ওরা ওই দোকান থেকে বেরিয়ে অন্য কেনাকাটাগুলো সেরে ফেলল। ওই সময়টায় তিন ভাই বাইরে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ছাড়া পায় নাই। কেনাকাটা যখন শেষ হলো, তখন প্রায় এগারোটা ছুঁইছুঁই। ক্ষিদেয় একেকজনের পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। তবে মেয়েরা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না, আনন্দে আছে কারণ কেনা জিনিসপত্র সবকিছুই পছন্দমত হয়েছে।
ঘণ্টাখানেক ধরে দোকান থেকে দোকান, শাড়ি থেকে জামা, নেকলেস থেকে নাকফুল; এমন কোনো জিনিস নেই যা ওরা ঘেঁটে দেখেনি। একেকজন ভাইয়ের চোখের কোণে ক্লান্তির রেখা একদম ম্যারাথন দৌড় শেষ করা খেলোয়াড়ের মতো। অবশেষে সবাই এসে ঢুকল ফুড কোর্টে। মেয়েরা বসেই মেন্যু কার্ড নিয়ে আবারও গল্প শুরু করল।
— “পিজ্জা খাই?”
— “না না, পিজ্জা ভারি হবে। বার্গার খাওয়া যায়।”
— “বার্গার প্রতিদিন খাই। আজ চাইনিজ হলে কেমন হয়?”
— “চাইনিজের সঙ্গে একটু ফ্রাইড চিকেনও চলে।”
একটার পর একটা অপশন আসছে। মনে হচ্ছে, জাতীয় সংসদে বাজেট পাস হচ্ছে। উফফ, মেয়েরা এত চুজি! সবকিছুতেই তাদের সমস্যা। কাপড়চোপড় বাচাইয়ের ক্ষেত্রেও, খাবারেও আবার পাত্র নির্বাচনেও। ওরা বাকিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে কী খাবে? তিন ভাই একসাথে মাথা ঝাঁকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল,
—“আমাদের যেকোনোটা দিলেই হবে। খালি চুপচাপ শান্তিতে খেতে দাও।”
আয়ান নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “আজ আমাদের ধৈর্য্যের ইন্টারন্যাশনাল টেস্ট হলো এবং আমরা সেখানে পাশ করে গেলাম।”
রায়হান গম্ভীর ভঙ্গিতে কপাল মুছল,
— “এই অন্বেষাকে বিদায় দিই তারপর তোর ব্যবস্থা করছি। তখন বুঝবি আসল ভোগান্তি কী। একা একা আমরা কেনো, এই ভোগান্তির স্বীকার হব?”
এদিকে মেয়েরা দারুণ মুডে, উচ্ছ্বসিত গলায় প্ল্যান করছে বিয়ের মেনুর। ডেজার্টে আইসক্রিম, না হলে কিছুই চলবে না… বিরিয়ানি থাকতে হবে, কাচ্চি না তেহারী… ওদিকে তিন ভাই তখনও পানির বোতল হাতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে হিসাব কষছে, এই ফুড কোর্ট থেকে বেঁচে বেরোতে পারলেই বাঁচে। জীবনেও আর কোনোদিন এইমুখো হবে না তারা।
.
সবাই শপিং থেকে ফিরে যে যার ঘরে চলে এলো। সামির নিজের ঘরে বসে ব্যাগের ভেতর লুকানো শাড়িটার দিকে তাকাল। সারাদিনের খাটাখাটুনি এখন হাতের মুঠোয়। তার ভেতরে একটা মিষ্টি উত্তেজনা, “এটা ওকে দিলে খুশি হবে… না হলেও অন্তত অবাক হবে।” কিন্তু দেওয়ার সময় ঠিক হচ্ছে না। নাবিলা এখন ঘুমে। বাইরে থেকে টায়ার্ড হয়ে এসেই শুয়ে পড়েছে। সামির শাড়িটার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে আলমারির গোপন কুঠুরিতে ভারি যত্ন করে রেখে দিল। যেভাবে আজকাল নিজের ভালোবাসার অনুভূতিগুলো মন কুঠুরিতে যত্ন করে আটকে রাখে।
আজকাল নাবিলাকে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সকাল থেকে রাত অব্দি কারো না কারো সাথেই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় অন্বেষার সঙ্গে। অন্বেষার ঘরে ঢুকলেই দেখা যায়, নাবিলা ওর পাশে বসে আছে, কখনো আড্ডা দিচ্ছে, কখনো আবার হেসে খুন, কখনো নিঃশব্দে শুধু সঙ্গ দিচ্ছে। অন্বেষার বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। সেই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত নাবিলা তার সাথে থাকবে বলেই ঠিক করে নিয়েছে। ইদানিং তো আবার রাতেও ওই বাড়িতে থেকে যাচ্ছে। সামির মন থেকে চেয়েছিল, বাড়িতে ফিরে আসুক। কিন্তু বাড়িতে ফেরার জন্য যে অধিকারবোধ দেখানো দরকার তা দেখায় নাই। বিধায়, দুজন দুদিকে ভেসে গেছে। মন টানলেও কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই।
তবে আজ রাতে নাবিলা অবশ্য বাড়িতেই থাকল। সামির লিভিংরুমের কোণ থেকে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। মনে মনে ভাবল, “আজকেই সময়। অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করছি, আর দেরি করলে আর হবে না। শাড়িটা এখনই দিতে হবে। দু’দিন পর অন্বেষার বিয়ে, ঠিক ওইদিনই নাবিলা শাড়িটা পড়ুক।”
সামির ঘরে গেল কিন্তু নাবিলা তখনও ঘরে আসছিল না। হঠাৎ ডাইনিং থেকে আসা আলোর রেখা তার চোখে পড়ল। কৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়ে দেখল, নাবিলা বসে আছে। ওর দৃষ্টি ছিল ডাইনিংয়ের ওপাশে বসে থাকা মামণি আর বাবার দিকে। দু’জনেই হালকা গলায় গল্প করছে। মামণি কিছু একটা বলে হেসে উঠছে, বাবা মজা করে খোঁচাচ্ছে আবার মুহূর্তে দুজন একে অপরকে বোঝাপড়ার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
ঝগড়াঝাঁটি নয়, মান-অভিমান নয় শুধু একটা সুন্দর সমঝোতা। এ বোধহয় বহু বছরের সাথী হওয়ার এক নীরব প্রমাণ। নাবিলা চুপচাপ তাকিয়ে আছে। এতদিনে এই দৃশ্য তার চোখে ধরা পড়েছে নতুন রূপে। নিজের মা-বাবার ক্ষেত্রেও এই দৃশ্যটা নজর কেড়েছে। আগে কখনো এতটা খেয়াল করার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এখন… এখন ভেতর থেকে খুব প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। একটা আকাঙ্ক্ষা, একটা শূন্যতা গলা টিপে ধরছে তাকে। সামির নীরবে দাঁড়িয়ে সবই লক্ষ করল। কিছু বুঝল কিনা কে জানে? তারপর নাবিলার পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল,
— “মন খারাপ কেনো?”
নাবিলা তার দিকে তাকাল। ঠোঁটে অর্ধেক হাসি রেখে বলল,
— “না, কিছু না। শুধু… কিছু কিছু জিনিস অনেক দেরিতে চোখে পড়ে। তাই দেখছিলাম।”
সামিরের মনে হলো, এটাই উপযুক্ত সময়। শাড়িটা দেখলে হয়ত নাবিলার ভালো লাগবে। মনটা ভালো হবে। কিন্তু হায়, বোকা প্রেমিক মন ভালো করার আসল কারণটাই খুঁজল না। সে গম্ভীর গলায় বলল,
— “ঘরে এসো। একটা জিনিস দেওয়ার আছে।”
নাবিলা কৌতূহলী ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকাল।
— “কী?”
— “আগে আসো।”
সামিরের পিছু পিছু নাবিলা ঘরে ঢুকল। সামির আলমারির দরজা খুলে ভেতর থেকে হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা বের করে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নাবিলার দিকে বাড়িয়ে দিল। নাবিলা জিগাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সামির বলল,
— “এটা শাড়ি।”
— “দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কি জন্য?”
সামির খানিক চাপা ভঙ্গিতে বলল,
— “তোমার জন্য।”
নাবিলা বিস্মিত হলো,
— “আমিতো শাড়ি পরি না। পরতেও পারি না।”
— “কাউকে বললেই পড়িয়ে দেবে।”
— “কিন্তু কেন আনলেন?”
এই প্রশ্ন সামিরকে খানিক থমকে দিল। এত প্রশ্ন করার কি মানে? শখ করে কিনে এনেছে, এটা কি বোঝা এত কঠিন? সামির স্বভাববশত কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “এনেছি অন্বেষার বিয়েতে যাতে পরো।”
নাবিলা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল,
— “তা বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ শাড়ি আনতে গেলেন কেন? আমি তো শাড়িটা নিতে পারব না।”
সামির বিস্মিত,
— “কেন?”
নাবিলা আবারও হাসল। কেমন নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য ছিল সে হাসিতে,
— “কারণ বিয়ে করা বউকে একটা শাড়ি দেওয়া উচিত, এই ভাবনা থেকে আপনি দিয়েছেন। মানে, লোক দেখানো। কিন্তু মন থেকে? উঁহু। মন থেকে যদি কখনো দেন তবে নিব।”
কথাগুলো সামিরের বুকের ভেতর হঠাৎ তীব্র আঘাতের মতো বাজল। লোক দেখানো? ওর মাথায় এমন কথাও আসে নাই। নাবিলা কীভাবে ভাবল এটা? আহত গলায় সামির শুধু বলল,
— “আচ্ছা।”
তারপর রাগে-জিদে শাড়িটা মুচড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলল। মুহূর্তে ঘরটায় নীরবতা নেমে এলো। নাবিলা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুধু দেখতে পেল, শাড়িটা উড়তে উড়তে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামির আর কিছু বলল না, কোনো প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করল না। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল। নাবিলা ওখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। কী করা উচিত বুঝতে পারছিল না।
.
এই ঘটনার পর থেকে সামির আর নাবিলার সম্পর্কটা ভেতরে ভেতরে বদলে গেল। প্রথমদিকে অজান্তেই তারা একে অপরের একটু কাছাকাছি চলে এসেছিল। নীরব বোঝাপড়া, মৃদু ইশারায় ভেসে যাওয়া দৃষ্টি; সবকিছু মিলিয়ে অদৃশ্য টান ছিল। কিন্তু এক ঝটকাতেই সেই টান ছিঁড়ে গেল, আবারও তাদের মাঝখানে বিশাল দূরত্ব তৈরি হলো।
এরইমধ্যে অন্বেষার বিদায় হলো। কিন্তু সামির আর নাবিলা একই ঘরে, একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় থেকেও অপরিচিত। দু’জনের মাঝখানে অদৃশ্য দেয়াল, যা তারা ভাঙতে চাইলেও ভাঙতে পারছে না। একে অপরকে ছুঁয়ে ফেলার মতো কাছে থেকেও তারা শুধু দূরের মানুষ হয়ে রইল।
সময় কিন্তু তার নিয়মেই বয়ে গেল। সামিরের পরীক্ষা এল, নিয়মমাফিক শেষও হলো। হাতে এখন অফুরন্ত অবসর। অথচ এই অবসরটাই মাথার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়াল। ২৪ ঘণ্টা তার কাছে এখন একেকটা ১০০ ঘণ্টার মতো। মিনিটগুলো টেনে টেনে কেমন মাঝপথে কেটে যাচ্ছে।
ঘড়ির কাঁটা ঠিকই ঘুরছে, কিন্তু সামিরের ভেতরে সময় জমে আছে বরফের মতো। কোথাও কোনো গতি নেই। সময় কাটবে কি করে? সময় তো তখনই কাটে, যখন মন ভালো থাকে। মন যদি ভালো না থাকে, তবে সময়ও বেইমানি করে, কষ্ট দিয়ে যায়। প্রতিটা মুহূর্তই দীর্ঘশ্বাসে ভরা।
এখন কিছু করতে গেলেই সামিরের বুক কেঁপে ওঠে। কোনো ছোট্ট খেয়াল, সামান্য ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছে, সবকিছুই সে নিঃশব্দে বুকের ভেতর গিলে ফেলে। ভেতরে ভয়। যদি আবার শুনতে হয়, “সব লোক দেখানো।”
একটা কথা, একটা মুহূর্ত কীভাবে মানুষকে বদলে দিতে পারে, তা এখন সামির টের পাচ্ছে। যেখানে আগে সে নির্দ্বিধায় নাবিলার সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করত, এখন সেখানে কেবল দ্বিধা আর শঙ্কা।
মন থেকে কিছু দিলেও যদি ভুল বোঝে? ভালোবাসা প্রকাশ করলেও যদি অবহেলা মেলে? তাহলে না দেওয়াই ভালো। চুপচাপ নিজের ভেতর জমিয়ে রাখা নিরাপদ। অন্তত দিনশেষে হতাশ হতে হয় না।
নাবিলা নিজেও বুঝতে পারছে, ও আগের মতো নেই। আগে যতটা সহজভাবে হাসত, খোলামেলা কথা বলত, এখন ততটাই গুটিয়ে গেছে।
প্রতিটা মুহূর্তে একটা অদৃশ্য হিসাব মেলাতে হয়; কে কতটুকু আন্তরিক, আর কতটুকু লোক দেখানো। তবে আজকাল নিজের হাসিটাই লোক দেখানো মনে হয়। সামিরের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে কিছু একটা মনে হয়। হয়তো কিছুর একটা আকাঙ্ক্ষা… কিন্তু সেটা পূরণ করতে পারে না নাবিলাও পূরণ করার কথা বলতে পারে না। ভয় পায়, যদি সেটা সত্যি না হয়? যদি কেবল দায়িত্ববোধ থেকে হয়? তাহলে কি একদিন এই সম্পর্ক শুধু ফাঁকা খোলস হয়ে যাবে? এই ভয়ই ওকে বদলে দিয়েছে। কথার ভেতর তিক্ততা, আচরণের ভেতর শীতলতা এসেছে। কিন্তু আসলে সেটা তার ইচ্ছা না বরং নিজের ভয় ঢাকতে গিয়ে তৈরি করা একধরনের দেয়াল।
ওদের দুজনের মধ্যে যে একেবারে কথাবার্তা হয় না, তা না। একেবারে কথাবার্তা বন্ধ করে তো একঘরে থাকা যায় না। কথা হয় কিন্তু শুধু প্রয়োজনে, খুব সামান্য। খাবারের সময় হয়ত নাবিলা এসে বলে,
— “মামণি খেতে ডাকছে, আসবেন?”
সামির মাথা নাড়ে, মুখ থেকে শব্দ প্রায় বের হয় না। আবার কখনো কখনো খুব সংক্ষেপে উত্তর দেয়,
— “আসছি।”
নাবিলা কিছু না বলে চলে যায়। সামির হয়ত ফের বলে,
— “আরেকটু দাড়াও, আমার নীল শার্টটা দেখছো?”
— “হ্যাঁ, ওটা ড্রয়ারের ভেতরে রেখেছিলাম।”
— “ঠিক আছে, ধন্যবাদ।”
এই অতি সাধারণ কথাবার্তা। প্রতিটি কথায় ফর্মালিটি। ওরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে কয়েকদিনে। অথচ প্রথমদিকেও সামিরের সাথে এইরকম সম্পর্ক ছিল না। তাই খারাপ লাগলেও মেনে নিয়েছে যেহেতু ভবিষ্যতে এই ফর্মালিটি মেইনটেন করে চলতে হবে। আসলে শুরুতেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। যদি নিজেদের লাগাম টেনে ধরে একে অপরের সাথে এত না মিশতো তবে এইদিনের কষ্টটা কাউকে পেতে হতো না, নিজের মত করে থাকতে পারত।
মানুষ আসলেই অভ্যাসের দাস। কারও সাথে কথা বলা, হাসি, রাগ, অভিমান কিংবা নিছক চুপচাপ বসে থাকার অভ্যাস; সবই ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরে গেঁথে যায়। প্রথমে সেটা খেয়ালই করা হয় না। কিন্তু সময় যত এগোয়, অভ্যাসগুলো অদৃশ্য সুতোয় জড়িয়ে ফেলে আমাদের মনকে। কোনো মানুষকে প্রতিদিন সামনে দেখা, তার কণ্ঠ শোনা, তার অঙ্গভঙ্গি বোঝা সবই নিছক রুটিন বলে মনে হয়। অথচ এই রুটিনই হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় স্বস্তি। আর যখন হঠাৎ সেই অভ্যস্ত রুটিনটা নিভু নিভু হয়ে আসে, তখনই মনে হয়; কিছু একটা নেই। এই বুঝি সব গেল… নিঃশ্বাসের মতো স্বাভাবিক জিনিসটাই তখন ভারী হয়ে যায়। অভ্যাসের আলো কমে গেলে চোখ ভরে যায় অন্ধকারে। তখন আর বোঝা যায় না, মানুষ হারিয়েছে নাকি শুধু নিজের ভেতরের একটা অংশ ভেঙে গেছে।
সামিরের যাওয়ার দিন-তারিখ একেবারে পাকাপাকি হয়ে গেল। এখন জুলাই মাস চলছে, আর সামনে সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখেই ওর ফ্লাইট। দিন যতই কাছে আসছে, বাড়ির সবার ভেতর এক অদৃশ্য মন খারাপের ছায়া তত ঘনিয়ে আসছে। হাসিঠাট্টার ভেতরেও নীরবতা জমে উঠছে। ঠিক তখনই অন্বেষা বিষণ্ণ পরিবেশটা ভাঙার জন্য হাজির হলো,
— “সামির চলে যাওয়ার আগে আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত। সামির আর নাবিলার বিয়ে হলো কতদিন, এখনো তো কোথাও গেল না। কতবার বলেছি, এরা ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে দেয়। এবার আর ছাড়ব না।”
ওর গলায় ছিল অভিমান আর শিশুসুলভ বায়না। শাহিদ পাশ থেকে সায় দিয়ে বলল,
— “একদম ঠিক কথা। চলো আমরা সবাই একসাথে যাই।”
কিন্তু সামির একেবারেই রাজি হলো না। নাবিলাও অনাগ্রহ দেখাল। দু’জনের মধ্যে অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাই এমন প্রস্তাবে স্বাভাবিক আনন্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কিন্তু অন্বেষা হাল ছাড়ার মেয়ে নয়। সাজেকে যাওয়ার স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। সেই স্বপ্ন এখনই পূরণ করতে চায়। বাচ্চাদের মত বায়না ধরল। ও সামির, নাবিলা, রায়হান আর কামিনীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। রায়হান রাজি হলো, সে ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু সামিরকে কোনোভাবেই রাজি করানো যাচ্ছে না। অন্বেষা নাবিলাকে চেপে ধরল,
— “শোনো তুমি যদি রাজি হও, সামিরকে আমি একনিমিষে রাজি করিয়ে ফেলব। ও তোমার কথা কখনো কাটাতে পারে? এ তো জানিই।”
— “আমি কেন বলব? ওর মন চাইলে যাক।”
অন্বেষা একচুল নড়ল না। হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
— “না, তুমি এসব বললে হবে না। হয়, সামিরকে রাজি করাও নয়ত নিজে রাজি হও। তুমি সামিরকে বললে ও আর না করতে পারবে না। আমরা যাব সাজেক, অথচ তোমরা সাথে না গেলে আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তুমি একবার বলো, আমার জন্য হলেও…”
— “আচ্ছা।” বলে নাবিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন সামিরের সাথে আবার কথা বলতে হবে, ভাবতে কেমন লাগছে। জানেই যে যাবে না, তারপরেও গিয়ে অনুরোধ করে রিক্ত হাতে ফিরে আসা; নিজের কাছে নিজেকে ছোট করা ছাড়া আর কিছুই না। তবুও সেদিন সন্ধ্যায় সাহস সঞ্চয় করে সামিরের ঘরে ঢুকল। জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি যেতে চাচ্ছেন না কেনো?”
— “কোথায়?”
— “আপুদের সাথে।”
সামির ঠান্ডা গলায় বলল,
— “ওহ আচ্ছা। তুমি যাও। আমি কেনো যাব? কোথাও গেলে তো সেটা কারো কারো কাছে লোক দেখানো হতে পারে তাই না? আর শুধু মনে হবে না, এখন সত্যিই সেটা লোক দেখানো হবে। কখনো মন থেকে যেতে ইচ্ছে করলে যাব।”
নাবিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “এত জেদ ভালো না।”
— “আচ্ছা।”
নাবিলা এবার একটু নরম স্বরে অনুরোধ করল,
— “তবে কাছেপিঠে কোথাও চলুন না। ওরা এতবার আমাকে বলছে… আমি কি করতে পারি? আমার খারাপ লাগছে।”
সামির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে বলল,
— “আচ্ছা।”
এই একটা শব্দে নাবিলার মুখে ক্ষণিকের জন্য আলোর হাসি ফুটে উঠল। সেই খবরটা অন্বেষাকে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সামির আবার ডাকল।
— “শোনো, নাবিলা।”
সে ফিরে তাকাল।
— “হুম?”
— “এই যে কাছে কোথাও যাব, এটাও কিন্তু লোক দেখানো। মন থেকে যাচ্ছি না।”
কথাটা ছুরির মত বিঁধল। নাবিলা ভেতরের শক্তিটা চেপে ধরে বলল,
— “আমি জানি।”
তারপর আর কিছু না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মনের ভেতরে জমাট বাঁধা কষ্টের ঢেউ। সামিরকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলল, “স্বার্থপর একটা। দু’দিন পরেই চলে যাবে। এই কয়েকটা দিনেও নাটক করতে হবে? মন কি সাথে থাকে না? কাকে বেঁচে দিয়ে আসছে? নাকি দান করে দিয়ে যাচ্ছে, কে জানে? ঠিকই আছে… মন থেকে তোমার কাছে আর কিছুই আশা করব না।”
.
.
.
চলবে……
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৮]
~আফিয়া আফরিন
সাজেক নিয়ে সবার ভেতরে যতই শোরগোল থাকুক না কেন, সামির তো রাজি হলো না। আর তাকে জোর করার মতো সাহস কারো ছিল না। তবে কাছেপিঠে কোথাও যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে অর্ধেকটা দায় মিটিয়ে দিল। অবশেষে সামিরের যাওয়ার পনেরো দিন আগে সবাই মিলে নারায়ণগঞ্জ এলো।
শীতলক্ষ্যা নদীর শান্ত পাড়ে, রিভার প্যারাডাইস ইকো রিসোর্ট–এর ওয়াকওয়ে জুড়ে সোনালি আলোর নরম ছটা। সূর্যাস্তের আগমুহূর্তে আকাশ রঙের উল্লাসে মেতে উঠেছে। নাবিলা একা এসে দাঁড়াল সেই ওয়াকওয়ের কিনারে। চারপাশের কোলাহল মিলিয়ে গেছে। মুহূর্তটা বোধহয় কেবল তার জন্যই রচিত; স্বর্গীয়, নির্জন অথচ অসীম।
সামির থাকলে মুহূর্তটা পরিপূর্ণ হতো, এই আক্ষেপ বুকের গভীরে খেলে গেল। কিন্তু ওকে ডাকা যাবে না। কিছুক্ষণ আগেই তো বলেছিল,
— “তোমার গর্দভ টাইপ কাজকর্মে আমাকে জড়িও না।”
ঠিক আছে, থাকুক। নাবিলার তো কিছু যায় আসে না! বরং সে-ই মিস করবে এই অসাধারণ দৃশ্য, সূর্যাস্তের মুহূর্ত, আকাশের সোনালি রঙ, নদীর নির্জনতা আর এই অচেনা সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়া নাবিলাকে। হঠাৎ খেয়াল হলো, এমন আকাশ আগে কখনো এভাবে চোখে পড়েনি। বিশালতা ভরে দিল মন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ করল সূর্যের রঙ। অস্ত যাওয়ার আগে সূর্য এমন আগুন, এমন কোমল সোনালি রূপ নেয়? নাবিলা বিস্ময়ে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইল, কয়েক পা পিছিয়েও গেল।
অচেতনেই ধাক্কা খেল কারো সাথে। খেয়ালই করল না প্রথমে, দৃষ্টি আটকে আছে আকাশের রঙে। ঠোঁটে ঝলমলে হাসি ফুটে উঠল। পিছনে দাঁড়িয়ে সামির। সূর্যাস্তের আলোয়, নদীর পাড়ের বাতাসে, নাবিলা সামিরের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বিস্ময় নিয়ে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে; আর সামির নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল ওর দিকে, যেন পুরো প্রকৃতির সৌন্দর্য নাবিলার মুখমণ্ডলেই প্রতিফলিত হচ্ছে। তখন গোধূলির রঙ মুছে গিয়ে একেবারে নীল অন্ধকার নেমে এসেছে। চারপাশে হালকা আলো ঝিকমিক করছে, জোনাকি পোকার মতো। দূরে নৌকার হুইসেল ভেসে আসে, আর নদীর জলে ঝিরঝিরে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এই নীরব মুহূর্তে হঠাৎ নাবিলা সামিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— “কিছু বলবেন?”
— “কিছু বলতে আসছি তা কেনো মনে হলো?”
নাবিলা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। একটা কথা বলব?”
— “বলো।”
নাবিলা গম্ভীর হলো। তার চোখে আলোটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল, ক্লান্ত নদীর মতো।
— “আপনি কিন্তু চাইলে এই কয়েকটা দিন ভালো হয়ে থাকতে পারেন। আর ১৪/১৫ দিনের ব্যাপার।”
সামির থেমে গেল কিছুক্ষণ। মৃদু হাসি দিলেও সেই হাসি চোখে পৌঁছাল না,
— “আমি খারাপ? তাহলে তো ভালো হওয়াটা লোক দেখানো…”
— “অন্তত লোক দেখিয়ে হলেও ভালো হন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে মৃদু স্বরে বলল,
— “আচ্ছা। চেষ্টা করব।” কিছুক্ষণ বাদেই নীরব কথোপকথনের পর সামির হঠাৎ ভঙ্গি বদলে জিজ্ঞেস করল,
— “বাকিরা কোথায় গেল?”
নাবিলা উত্তর দেওয়ার আগেই দূর থেকে একগাল হাসি নিয়ে বাকিরা এগিয়ে এলো। রায়হান, কামিনী, অন্বেষা আর শাহিদ সবাই একসাথে কথা বলতে বলতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল। অন্বেষা ওদের দেখে চোখ কুঁচকে বলল,
— “কীরে তোরা এই আঁধারে কি করিস? লুকোচুরি খেলা চলছে নাকি রোমান্টিক ফিল্মের শুটিং চলছে? আমাদের সাথে গেলি না। অথচ ভালোই তো ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে।”
— “তোর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।” সামির বলল।
অন্বেষা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “আমার মনে হয় না। রিসোর্টের নিয়মে নতুন আইন জারি করা উচিত, ‘অন্ধকারে রোমান্স করলে জরিমানা ৫০০ টাকা।’ তাই যা করবি বুঝেশুনে করিস। ভদ্রভাবে থাকিস।”
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কামিনী বলল,
— “আমদের বোধহয় একটু দূরে থাকাই ভালো। এদের ‘প্রাইভেসি’র ক্ষতি হোক, সেটা ঠিক না। আমরা কি চলে যাব?”
কথাটা কামিনী কাকে যে উদ্দেশ্যে করে বলল! সাধারণ মনোভাব থেকে বলল না কীভাবে বলল, তাও স্পষ্ট বোঝা গেল না। তবে ওর কথার উত্তরে কেউ চলে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল না। তবে ঠাট্টা-তামাশার মধ্যে গম্ভীরতার ভারটা খানিকটা নেমে গেল। সামিরও জোর করে হলেও একচিলতে হাসি ফুটাল। ভালো হয়ে থাকার চেষ্টা করতে হবে। আর নাবিলা… সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেও ভেতরে কোথাও একটু হালকা হলো।
সামিরের ভালো হওয়ার চেষ্টা শতভাগ সফল হলো। কোনোকিছুতে না করে নাই। সবার সাথে বসে আড্ডা দিয়েছে। নাবিলার সাথেও সহজ ব্যবহার করেছে। সামিরকে এইরকম স্বতঃস্ফূর্ত দেখে সবার মনে স্বস্তি এলো। জীবন কয়দিনের? দম ফুরালেই সব শেষ। বেঁচে থাকতেই যদি মানুষ সর্বক্ষণ হাঁড়ির মত মুখ করে রাখে তবে বেঁচে থাকার মানে কি? হঠাৎ হঠাৎ কী যে হয়!
রাতের অন্ধকারে নদীর ধারে সবকিছুই নিস্তব্ধ, শুধু পাতার ফিসফিসানি আর নদীর কলকলানি শোনা যায়। নাবিলা হঠাৎ সেই সরসর আওয়াজে চমকে হাত বাড়িয়ে সামিরের হাত ধরে ফেলল। সামির বলল,
— “ভয় পেয়েছো?”
— “না।”
— “তাহলে হাত ছাড়ছো না কেনো?”
নাবিলা দ্রুত হাত সরিয়ে নিল কিন্তু সামির আবার হাত ধরে বলল,
— “হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য কথাটা বলি। সত্যি ভয় পেয়েছ কিনা জানতে চাইছি।”
— “একটু।”
— “ভয় পেয়ো না। এটা শুকনো পাতার আওয়াজ।”
নাবিলা অবাক চোখে সামিরের দিকে তাকাল। অবাক হওয়ার কারণ আছে। এক কয়েকদিন সামিরকে ভিন্নরূপে দেখেছিল। আজ আবার দেখতে হচ্ছে… মনে হচ্ছিল, এই শান্ত রাতে সে ওর সাহস যাচাই করছে। নাবিলা সেই সাহসের পরীক্ষায় ডাব্বা মেরে সামিরের দৃষ্টিতে ভরসা খুঁজে পেয়েছে।
নাবিলা সামিরকে ঘিরে কেমন বিভ্রান্তিতে রয়েছে। একটা রহস্য ভেতর ভেতর জ্বলে। এতগুলো দিন ধরে দেখছে তবুও তাকে বোঝার সাধ্যি হলো না। সুযোগ আসেনি পুরোপুরি। যতবার সুযোগ এসেছে ততবারই অন্যরকম কিছু হয়েছে। নাবিলা যতবার সামিরের কাছাকাছি আসে, ততবার সামির নিজেকে অন্যভাবে উপস্থাপন করে।
আজও হাত ধরে, হাত ছাড়ে; সবকিছু খোলামেলা। একমুহূর্তে সাহসী, পরের মুহূর্তে আবার সংযত। ওর মনে হয়, সামিরের আসল চেহারা ধরতে পারলেই জীবনের কোনো রহস্য উদঘাটিত হবে। কিন্তু ধরা যায় না। মনের মধ্যে একটা জটিল ফাঁদ, নাবিলা চেষ্টা করে সেই ফাঁদে আটকা পড়ছে কিন্তু কোনোভাবেই জট খুলতে পারছে না।
ভালো থাকতে থাকতেই সামির হঠাৎ করে এমন একটা কান্ড করল, যার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব না। এটা কি ফাজলামি? নাকি অজান্তে আত্মপ্রকাশের ছাপ? সামিরের আচরণ এমন যে বোঝাই যায় না, এটা পরিকল্পিত নাকি কেবল মুহূর্তের আবেগের প্রকাশ।
ওরা ফিরে যাওয়ার আগের দিন রাতে। নাবিলা ঘরে ছিল। এই ঘরটা সুন্দর। জানালা থেকে নদী দেখা যায়, সবুজ প্রকৃতি দেখা যায়। যদিও এখন রাত। রাতের প্রকৃতিরও আলাদা ভাষা রয়েছে। জানালার ধারে বসেছিল ও। সামির কোথা থেকে ছুটে এলো। জিজ্ঞেস করল,
— “ওখানে কি করছো?”
নাবিলা না তাকিয়েই জবাব দিল,
— “দেখছিলাম।”
— “কী?”
সামির এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন নাবিলা কাউকে দেখছিল। ভুরু কুঁচকাল। তবে কণ্ঠে সরলতা এবং রহস্যময়তা রেখে বলল,
— “আকাশ-পাতাল।”
— “ওহ, আচ্ছা।”
নাবিলা নিজেই সামিরের কাছে এগিয়ে এল। রাতের নীরব ঘর আর জানালার মৃদু আলোয় তার চোখে হালকা উদ্বেগের ছাপ।
— “তাড়াহুড়ো করে কোথা থেকে এলেন? কোনো সমস্যা?” নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল নাবিলা।
সামির কোনো উত্তর দিল না। এমন প্রয়োজনই সে মনে করল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুধু নীরবতায় নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করল। শব্দহীন, হালকা ছন্দে যেমন রাতের নিঃশব্দে নদী বয়ে চলে ঠিক সেইভাবেই সামির ইয়াসির নাবিলাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। ও হকচকিয়ে গেল। হৃদয় দ্রুততর স্পন্দন করছিল… কী হলো বোঝার চেষ্টা করতেই বুঝল। আর যখন বুঝতে পারল তখন ও নিজেও কিছুটা বিশ্রাম নিতে চাইল এই অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু অদ্ভুত সান্ত্বনাময় আলিঙ্গনে। তবে সুযোগ নেই… একটু থমথমে ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “এটা কি করলেন?”
সামির হালকা গলায় বলল,
— “ভালো হয়ে থাকতে বলেছিলে। চেষ্টা করছি। এখন কি পছন্দ হচ্ছে না?”
— “আপনি ভালো হন না। আমাকে কেন জড়িয়ে ধরলেন?”
সামির ফটাফট উত্তর দিল,
— “মানুষ কখন ভালো হয় জানো? ভালো থাকা যখন সহজ হয়। আর ভালো থাকা কখন সহজ হয় জানো? যখন তুমি কাছে থাকো। আমার কাছে ভালো হওয়ার সর্বোত্তম উপায় এটা ছিল। আপাতত এটা ছাড়া আর কিছু প্রয়োগ করতে পারছি না।”
নাবিলা অজান্তেই একটু নরম হলো,
— “তাহলে সবসময় এমন জোর করে আলিঙ্গন করবেন?”
— “না, কিন্তু মাঝে মাঝে… হৃদয় কখনো নিজ থেকে চাইলে, মনও বাধ্য হয়ে যায়।”
সামির তখনও নাবিলাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ওখানেই পৃথিবীর সব শব্দ থেমে গেছে। নাবিলা সামান্য কেঁপেছিল কিন্তু কোনো প্রতিরোধ দেখায়নি, হাতগুলো অচেতনভাবে সামিরের বুকের দিকে আঁকড়ালো। দুজনের শরীরের কাছে কাছের এই নীরব সংযোগে সময়ই থেমে গেছে, মনেই না কেউ চারপাশে আছে। নাবিলার কণ্ঠে অজান্তে ভেসে উঠল,
— “আপনি কি… আসলেই বুঝতে চান?”
— “আমি তোমাকে অনেকবার বুঝতে চেয়েছি, তোমার নিয়মে।”
নাবিলা ধীরে বলল,
— “আপনি ঠিকমতো বোঝেন কি, আমি কতটা…”
সামির চুপচাপ নাড়ল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
— “আমি বোঝার চেষ্টা করি, যতটা পারি।”
— “চেষ্টা… তা কি যথেষ্ট?”
সামির চোখে একটি নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি ফুটল,
— “পর্যাপ্ত না হলে, আরও চেষ্টা করব।”
নীরবতা তাদের মাঝে দৃঢ় হয়ে গেল, দু’জনের অনুভূতির একরূপ প্রতিচ্ছবি। নাবিলার হৃদয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল কিন্তু ও জানতো, এখনই কোনো অতিরিক্ত পদক্ষেপের সময় নয়। সামিরও নিজের ভেতরের উদ্দীপনা নিয়ন্ত্রণ করছিল, শুধু অনুভব করতে চাচ্ছিল এই মুহূর্তের সরল সত্য। হাওয়ার সঙ্গে লতা-পাতার ফিসফিসানি, নদীর ঢেউয়ের চুম্বন; সব তাদের অদৃশ্য সংলাপে বেঁধে রেখেছিল।
.
স্মৃতির ওজন ভারি, কিন্তু তা জমা রাখতেই হয়। মানুষের জীবন সবসময়ই স্মৃতিতে বেঁচে থাকে। সামির পরশু চলে যাবে, এই ভাবনায় নাবিলার বুক দমবন্ধ করছে। হৃদয় চিৎকার করছে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। কষ্টটা প্রকাশ করার সাহস নেই, ইগো দাঁড়িয়ে আছে বাঁধা হয়ে। নিজের আবেগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে সে একাকী ভয়ানক চাপ অনুভব করছে। সামির ওকে আশ্চর্যজনক বাঁধনে বেঁধে অদ্ভুত দোলাচলে ফেলে দিয়েছে। তারপর চলে যাচ্ছে। কেনো যাচ্ছে? যেতেই হবে?
সামিরের ইচ্ছে হচ্ছিল না যাওয়ার। মনে হচ্ছিল, এমনকিছু ঘটুক যাতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ওর মনে একটা অপূর্ণ ইচ্ছে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু যদি যেতে হয়, তবে সেই অপূর্ণ ইচ্ছে এবার পূর্ণ করে নিয়েছে। আচ্ছা, তার যাওয়ার ভিত্তিতে নাবিলা কি বলে? ও যদি একবার মানা করত? করবে কি? জিজ্ঞেস করে দেখা যাক। সামির নাবিলার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “আমি তো চলেই যাচ্ছি।”
নাবিলা হেসে বলল,
— “হুম, জানি। পরশু বিকাল, পাঁচটা নাগাদ ফ্লাইট।”
— “বাহ, মুখস্থ করে রেখেছ।”
— “হুম।” নাবিলা স্বল্পসুরে জবাব দিল।
সামির একটু কণ্ঠ ঢিমে করে বলল,
— “আমি গেলেই তো তোমার ভালো।”
— “হুম।” নাবিলা শান্তভাবে উত্তর দিল।
— “তাহলে তো যেতেই হবে।” সামিরের কণ্ঠে মিশ্রিত হতাশা।
— “হুম।” নাবিলা আবারও ছোট্ট সম্মতির শব্দ।
— “ফিরে না আসলেও চলবে?” সামিরের চোখে এইবার অজানা শঙ্কা।
নাবিলা মৃদু হাসল,
— “হুম। আপনার এই ঘরটায় আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিব।”
— “মনে পড়বে না?”
নাবিলা ধীরে ধীরে বলল,
— “পড়লে বা কি? মন নিয়ন্ত্রণের উপায় আমি জানি।”
সামির একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— “আচ্ছা। তাহলে থাকো। আমি আর ফিরছি না।”
নাবিলা সরাসরি সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আপনি ঠিকই ফিরবেন, আপনার বাবা-মায়ের টানে।”
— “আর কারো প্রতি টান নেই বলছো?”
নাবিলা একটু থেমে বলল,
— “হয়ত আছে… ভাই-বোন।”
— “আর কেউ?”
— “আর কে থাকবে?”
— “নেই বলছ? না থাকলেই বেঁচে যাই।”
নাবিলার সাথে আর কথা বলা উচিত না। যত কথা বলবে, তত মায়া বাড়বে। কষ্ট হবে। সামির দিনটা বাহিরে কাটাতে শুরু করল এবং রাতের কিছুক্ষণ বাবা-মায়ের সাথে বাকি সময়টা নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে করতেই শেষ হয়ে যায়।
মুহূর্তটা ভারি হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনেরা দেখা করতে এসেছে। সামির সবকিছু চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তার বিদায়টা সবার জন্য উৎসবে রূপ নিচ্ছে। সবাই কথাবার্তা বলছে, হাসছে, আড্ডা দিচ্ছে। অনেকদিন বাদে সবাই এক হওয়ার খুশিতে মত্ত। অথচ উৎসবের হাসির আড়ালে একটা চাপা বিষণ্ণতা চোখেমুখে ঘোরাফেরা করছে। নাবিলা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিল, অথচ সামির বারবার খুঁজে নিচ্ছিল সেই একজোড়া চোখ। নাটোর থেকে নাবিলার বাবা-মাও এসেছেন। সামির তাদের সাথে কথা বলার সময় নাবিলাকে দেখল, এছাড়া সারাদিন ওকে আর পাওয়া যায় নাই। নাবিলা একটু অপ্রস্তুত হলেও, বাবা-মাকে দেখে মুখে আলগা হাসি ফুটিয়ে তুলল। যাওয়ার দিন সকালটা দমবন্ধ লাগছিল। দমবন্ধের ভেতর থেকে হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
— “নাবিলা, আমি আর তোমাকে দেখতে চাচ্ছি না। তুমি আমার সামনে আসবে না।”
কথাটা বলার পরপরই সামিরের-ই অবাক হওয়ার পালা। এ তো সে বলতে চায়নি! আসলে বলতে চেয়েছিল, “যাওয়ার এই সময়টুকু পর্যন্ত আমার সামনে এসো না, তোমাকে দেখলে থেকে যাওয়ার টান পড়ে অথচ তুমি তো চাইছো না আমি থাকি।”
কিন্তু ভুল করে বেরিয়ে গেল উল্টো কথাই। এখন কথা ফিরিয়ে নেবে কীভাবে? শব্দ একবার বেরিয়ে গেলে তো আর ধরা যায় না। নাবিলা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। চোখমুখে বিস্ময়ের ছাপ, ভেতরে রাগের ছিটেফোঁটা। পেয়েছেটা কি? বিয়ে করে কি মাথা কিনে খেয়েছে? যখন যা বলবে তাই করতে হবে? নাবিলা ঠাণ্ডা, কাঁপা স্বরে যোগ করল,
— “আমিও যার-তার সামনে আসতে চাই না। এটাও চাই না, যে সে আমাকে দেখুক। কাউকে দেখতেও যথেষ্ট যোগ্যতা লাগে। সেটা সবার থাকে না।”
তারপর একমুহূর্ত দেরি না করে মুখ ফিরিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হওয়ার শব্দ, আর তারপরে এক গভীর শূন্যতা।
সামির একা হয়ে বসে রইল। এত ভুল করার পর এই প্রথম সে বুঝতে পারল, নাবিলা তাকে ভুল বুঝেছে। আর ভুল বোঝার সুযোগ সে নিজেই তৈরি করে দিয়েছে।
.
নাবিলাকে আর দেখা গেল না সারাদিনে। মানে সামির দেখতে পেল না। যাওয়ার সময়েও না। বাড়ির উঠোনে লোকজনের ভিড়, কোলাহল, সেই ভিড়ের ভেতর সামির বারবার একটা মুখ খুঁজছিল। কোথাও নেই… গেট পর্যন্ত আসার আগে একবার থেমে তাকাল চারদিকে। দালানঘরের বারান্দা, জানালা, সিঁড়িঘর সবখানে চোখ বুলিয়ে নিল। কেউ নেই। মনটা কেমন ভেঙে পড়ল। তাহলে এভাবেই যেতে হবে? একটুখানি দেখাও পাবে না?
আসলে সবাই ভেবেছিল, নাবিলার মন খারাপ। তাই ইচ্ছে করেই সামিরের সামনে আসছে না। অদৃশ্য থেকে বিদায় নেওয়ার অভিমানী খেলা, সবাই সেভাবেই ধরে নিল। কিন্তু সত্যিটা ছিল ভিন্ন।
নাবিলা একদম একা দাঁড়িয়ে ছিল ছাদে। সেখান থেকেই চুপচাপ দেখছিল সবকিছু। দূরের ফাঁকা আকাশের মত ওর বুকের ভেতরেও ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে রেখেছিল, চোখে কষ্ট জমলেও বাইরে প্রকাশ পায়নি।
সামির গাড়িতে উঠল মন খারাপ করেই। শেষবার গাড়ির জানালা দিয়ে আশেপাশে তাকাল, এমনকি উপরের দিকেও; কোথাও নেই নাবিলা। পৃথিবীর সব ভিড়ের মাঝেই সে একেবারে হারিয়ে গেছে।
আর ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিলা কেবল নিজেকেই বলল নিঃশব্দে, “যখন একবার আমায় বলেছেন আর সেই কথায় আমার মনে আঘাত লেগেছে তখন আপনি তাকালেও, আমায় দেখতে পারবেন না। আমার উপস্থিতি টের পাবেন না।”
.
.
.
চলবে……
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৯]
~আফিয়া আফরিন
নাবিলা নিজের দিনগুলোকে নতুন মোড় দেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠল। নিজের শূন্যতা ঢাকতে সেদিনই জীবনটা একটা নির্দিষ্ট রুটিনে আবদ্ধ করে নিল। বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিল কিন্তু মাঝখানে কিছু ঘটনার জন্য অনেকদিন ক্লাসে যাওয়া হয় নাই। এইবার নিয়মিত হওয়া উচিত। এখন নিজের দিকে একটু মনোযোগ দিতে হবে… কৃত্রিমভাবে হলেও। কোথাও কেউ নেই তবুও মন কাউকে খুঁজে বেড়াবে, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ও হ্যাঁ, তার আগে আরেকটা বিশেষ কাজ আছে। সামিরকে ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দিল যেহেতু সে ওকে দেখতেই চাচ্ছে না। যোগাযোগ করবে কি সে? করলে করবে না করলে নাই, নাবিলা মরে যাবে না তাতে। পরদিন সকালে বহুদিন পর ক্লাসে এলো। সবাই একটু অবাক। এতদিন অনুপস্থিত থাকার কারণ হিসেবে একেকজন একেক কথা বলছে। একজন জিজ্ঞেস করল,
— “এতদিন কোথায় ছিলে? ভাইয়ার কাছে একদিন খোঁজ করতেই বলেছিল, তুমি নাকি তোমার বাড়ি গেছো। কাহিনী কি?”
আরেকজন মুচকি হেসে বলল,
— “আমার মনে হয় নাবিলার বাবু হবে।”
এবার তৃতীয়জন যোগ করল,
— “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো! শিমুরও তো বাবু হবে, সেও তো এমনই করে। বাপের বাড়ি থাকে, ক্লাসে আসে না, শুধু পরীক্ষা দিতে আসে।”
নাবিলাকে ওরা কিছু বলারই সুযোগ দিচ্ছিল না। ওদের কথার চাপে পিষ্ট হয়ে কিছু যে বলবে তাও পারছিল না। এরইমধ্যে ওরা আবার খিলখিল করে হাসতে লাগল,
— “চুপচাপ কেনো? সত্যিই নাকি? মিষ্টি কই?”
নাবিলা হাসি চেপে জবাব দিল,
— “আরে না। এমন কিছুই না। কিছু ব্যস্ততার কারণে আসতে পারিনি। এখন থেকে ভাবছি রেগুলার ক্লাস করব।”
সেদিন সময়টা বেশ কাটল। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মানেই কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বের করে নিয়ে আসা। কে ক্লাসের হ্যান্ডসাম হিরো, কে বেশি স্মার্ট, কে আবার শুধু ছ্যাঁচড়ামির মাস্টার, কে বিখ্যাত ফ্ল্যার্টবাজ এসব নিয়ে সবাই একে অপরকে টেনে টেনে হাসাহাসি করছে। নাবিলা মুখ গম্ভীর করার চেষ্টা করেও হেসে ফেলল। ফেরার পথেও পরিচিত কয়েকজনের সাথে ফিরল। কিন্তু মনে শান্তি নেই। ভেতরে ভেতরে আগুন জ্বলছে। মনটা কিছু একটা করার জন্য হাহাকার করছে, আয়তারা-পাঁয়তারা করছে। হাত নিশপিশ করছে, কাউকে মারতে পারলে হয়তো ভালো লাগত। অথচ নিজেও জানে, এই সব অস্থিরতার একটাই নাম।
নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিচিত পথে, যেই পথে হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে। আশেপাশে পুলিশি দৃষ্টি মেলে ভাবে, “আমার আত্মসম্মানবোধটা কোথায় খুলে পড়ে গেল? যাকে নিয়ে সে এত প্রশ্ন করে, এত দ্বিধায় ভোগে, এত অভিযোগ করে, যে মানুষটা বুঝতে চায় না; তার দিকেই কেন মন ছুটে যায়? আমার মন কেমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, নিজের মতো ছুটে চলছে। তাকে ধরে রাখার সাধ্য হচ্ছে না। শালা আমার খায়, আমার পড়ে, আমার কাছে থাকে, কিছু হলে আমাকেই প্রশ্ন করে… তবুও কি-না অন্য কারো কথা ভাবে? কেনো ভাবিস, মনের বাচ্চা মন।” চোখে আগুনের ঝিলিক নিয়ে মনে মনে গজগজ করে নাবিলা।
মনকে যদি সত্যিই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত, নাবিলা নির্ঘাত মামলা ঠুকে দিত, “মনের বিরুদ্ধে কেস: আমার আত্নসম্মান খেয়ে ফেলার দায়ে।”
সামির পৌঁছেও একটা ফোন দিল না। নাবিলার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। এতদিন ধরে যা না বলা কথা জমে আছে, ইচ্ছে করছিল ফোন করেই ঝাড়ি মেরে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে বুকটা হালকা করে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। তাই ঘরের কোণে রাখা সামিরের একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
— “এই যে মহাশয়! কি ভাবছো, খুব বড়লোক হয়ে গেছো তাইনা? এমনিতেই ভাবের রাজা তার উপর দুদিনে আরও সাপের পাঁচ পা দেখেছ তুমি। ফোন করা যায় না? শালা এত ব্যস্ত থাকে নাকি কেউ?
আমার থাকলা আমার সাথে, থাকলা একই ঘরে, আমাকেই জড়িয়ে ধরে আউলা-ঝাউলা কথা বললা, আমার মনের দখলদারিত্ব নিলা আর আমাকেই এখন মনে পড়ে না? ধুর বজ্জাত! তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার জন্য কাঁদব? উল্টা তোমার জন্য হাসব, নাচব তবুও তোমাকে পাত্তা দেব না। অভিনয়ের জন্য পুরুষ মানুষ সেরা রেহহহহ, এটা মিথ্যা কথা না। এই নাবিলা ইবনাত তা হারে হারে টের পাচ্ছে।”
গলা ভারী হয়ে যাওয়ার কারণে একটু থামল নাবিলা। কিন্তু মুখের অভিমান অটল রাখল।
— “যাও, থাকো তোমার ওই বিদেশে। আমি একবিন্দু চিন্তাও করব না। তুমি শালা রং-তামশা ভালো জানো। যদি কোনো উল্টাপাল্টা কথা তোমার নামে শুনেছি তো তুমি খতম। এদিকে একটারে সামাল দিছি, ওইদিকে আবার কোন বজ্জাত পিছু নেয় কে জানে?” নাবিলা টেনশনেই শেষ। ব্যাডা মানুষ বিশ্বাস করতে নাই। এদের দ্বারা দুনিয়ার সব সম্ভব। এরা ঘরে বউ রেখে বাইরে তিন/চারটা প্রেমও করতে পারে আবার প্রেমিকা রেখে বিয়েও করতে পারে। মামণিকে বলতে হবে। তিনি যদি ছেলেকে একটু সাবধান করে দেন।
.
পরদিন ক্লাস থেকে ফেরার পথে নাবিলা বান্ধবীদের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে অনুমতি নিয়েই বেরিয়েছিল, তাই মনটা হালকা ছিল। হাসি-ঠাট্টায় সময়টা কেটে গিয়েছিল বেশ। সিনেমার গল্প নিয়েই আলোচনা করতে করতে ওরা হাঁটছিল। হঠাৎ করেই নাবিলার চোখে পড়ল, সামনের মোড়ে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা গম্ভীর, চোখে মৃদু চিন্তার ছায়া। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। কথোপকথনের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা দু’জন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে কথা বলছে। নাবিলার কৌতূহলটা আরও বাড়ল যখন মেয়েটাকে ভালো করে চিনতে পারল। এর আগে একাধিকবার অন্বেষাদের বাড়িতে যাওয়া-আসার সময় চোখে পড়েছিল। একেবারেই অচেনা না, এ পাড়াতেই থাকে। নাবিলা দাঁড়িয়ে পড়ল। বান্ধবীরা এগিয়ে গেলেও সে নীরব দাঁড়িয়ে রইল। সামনের দিক থেকে এক বান্ধবী গলা চড়িয়ে ডাক দিল,
— “কিরে নাবিলা, ওখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিস কেন? আয় না।”
নাবিলা চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি উত্তর দিল,
— “তোরা যা, আমি আসছি।”
আসলে ওর ইচ্ছে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আয়ান আর মেয়েটার কথাবার্তা একটু শোনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দুজন উল্টোদিকের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল। অগত্যা নাবিলার আর উপায় রইল না। পা চালিয়ে বান্ধবীদের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল। তবে আয়ান আর ওই মেয়েটার অস্থির চোখমুখ গোপন কোনোকিছুর আভাষ দিচ্ছিল। কিছু কি চলছে ওদের মধ্যে? কিন্তু আয়ান ভাইয়া বলেছিল, বিয়ে করবে না। ওসব কি সব বানোয়াট কথাবার্তা? নাবিলা তাড়াতাড়ি ফিরল। অন্বেষা আপুর সাথে এখন তো হার হামেশাই দেখা হয় না তাই ফোনে জানাতে হবে।
নাবিলা ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে মামণির সাথে গল্প করল খানিকক্ষণ। তারপর ঘরে এসে ফোন হাতে নিয়ে বসল। এই ঘরটা এখন পুরোপুরি ওর নিজের। দখলদারিত্ব একেবারেই নাবিলার। ভালোই হলো বিছানার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া যাবে, বই ছড়িয়ে রাখলেও কেউ ধমকাবে না, জিনিসপত্র এদিক-ওদিক হলেও বলার কেউ নাই। ইচ্ছে হলে রাত জাগা যাবে, গান শোনা যাবে। একেবারে স্বাধীন জীবন, কোনো বাঁধন নেই।
অন্বেষাকে ফোন করতে চেয়েছিল। তবে ফোন করতে হলো না, অন্বেষাই ফোন করল। আপুর শ্বশুরবাড়ির কাছেই, খুব দূরে নয়। তাই প্রায় সময়ই এখানে চলে আসে। অথচ বিয়ের আগে খুব বড় মুখ করে বলেছিল, বিয়ের পর ভুলেও আর বাপের বাড়ি আসবে না। অথচ এখন দুদিন অন্তর অন্তর নাচতে নাচতে এসে হাজির হয়। হাসতে হাসতেই নাবিলা ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে অন্বেষার জরুরী গলা,
— “এই নাবিলা, ফ্রি আছো?”
— “হ্যাঁ, আছি তো।”
অন্বেষা দেরি না করে বলল,
— “আচ্ছা, সামিরকে বলতেছি। ও তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
সামিরের কথা কানে আসতেই নাবিলা চমকে উঠল। কথা বলবে না তার সাথে। তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত গলায় বলল,
— “না না আপু! ভুলে গেছিলাম, পড়াশোনা করছি। আমি একদমই ফ্রি নই এখন।”
— “কী বলো? সামির আমাকে কতক্ষণ ধরে জ্বালাচ্ছে। আয়ানকেও ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে, তুমি আমাদের বাড়িতে আছো কিনা। তাহলে কি ওকে বলে দিব, এখন যেন ফোন না করে?”
নাবিলা ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
— “অবশ্যই।”
ফোনটা কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় ছুঁড়ে মারল। চোখ কুঁচকে একরাশ রাগ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “জমিদার হইছে নাকি? সারা বাংলার মানুষকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছে, সে কত উদার, কত মহান! উহ, ভণ্ড ব্যাটাচ্ছেলে কোথাকার!”
সামিরের জন্য আয়ান ভাইয়ার প্রসঙ্গটা আর তোলা হলো না। থাক, পরে কথা বলে নিবে। তারপর নাবিলা সত্যি পড়াশোনায় ব্যস্ত হলো। বই খুলল ঠিকই কিন্তু পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছিল, কিছুই চোখে আটকে থাকছিল না। কলম হাতে নিয়ে দুই-এক লাইন লিখল, আবার খাতায় আঁকিবুঁকি শুরু করল। মাঝেমাঝে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, আবার ফোনটা তুলে নাম্বার তালিকা ঘেঁটে দেখছে, কারো কাছেই ফোন দিচ্ছে না। শেষে বিরক্ত হয়ে বই বন্ধ করে বিছানায় ছুঁড়ে দিল। খাতাটা নিজের কাছে টেনে নিল। হঠাৎ আঁকতে লাগল একটা বেঁকা নাকওয়ালা কার্টুন মুখ, তার পাশে লিখল “জমিদার”। নিজেই দেখে হেসে ফেলল। আবার আঁকল, কাটাকুটি করল। পড়াশোনার চেয়ে এইমুহূর্তে অকারণ আঁকিবুঁকি করাই বেশি সহজ কাজ মনে হলো। এরইমধ্যে রেশমা দৌড়ে এসে বললেন,
— “নাবিলা, তুমি কি ফোন বন্ধ করে রেখেছ?”
নাবিলা বিস্মিত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখল, স্ক্রিন অন।
— “না তো।”
— “তাহলে সামির আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছে, তোমাকে ফোন করবে কিনা?”
নাবিলা আকাশ থেকে পড়ল। এই ছেলে আবার কি শুরু করেছে? থতমত খেয়ে বলল,
— “মামণি, আমি এখন খুব ব্যস্ত, পরে কথা বলব।”
রেশমা ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
— “পড়াশোনা করছো?”
— “হ্যাঁ, করছিলাম।”
— “তাহলে তাই করো। সারাদিন এত বকবক করতে হবে না। স্বামী হয়েছে তো কি হয়েছে, সর্বক্ষণ বকবক করতে হবে না। পড়ো মা, তুমি পড়ো।”
তিনি যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। সামির কি শুরু করেছে? কী আর করবে? কতক্ষণ করবে? ওতদূর থেকে বসে নাবিলাকে ধরা সম্ভব না। যা ইচ্ছে হয় করুক। খুব তো বলেছিল… নাবিলা কি সব ভুলে গেছে নাকি? ভোলে নাই কিছুই। দরকার হলে লিখে চোখের সামনে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখবে, যেন একবারে চিরকালের মত মনে থাকে।
পরদিন ক্লাস শেষে গেট দিয়ে বেরোতেই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাক দিল,
— “এই নাবিলা!”
চমকে পেছন ফিরে দেখল অন্বেষা। নাবিলা মুহূর্তেই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।
— “আরে আপু, তুমি এখানে? কী আশ্চর্য!”
অন্বেষা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
— “আশ্চর্য নয়, জরুরি। তোমার জন্য এসেছি। সামির পাগল করে ছাড়ছে। তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছে। ফাস্টে তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। কাকি বলল, তুমি ভার্সিটিতে। তাই আমি সরাসরি চলে এলাম।”
নাবিলা কপালে হাত ঠেকাল,
— “ওহ আল্লাহ! তোমাকে বারবার বিরক্ত করছে কেনো? আমাকে সরাসরি ফোন দিলেই তো পারে।”
— “তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে ফোন দিবে না।”
নাবিলা চোখ বড় বড় করে তাকাল,
— “এত ভদ্রতা কবে শিখল সে? যাইহোক, এখন তো কথা বলতেই পারব না। আমি তো রাস্তায় আছি। কথা বলতে বলতে যদি গাড়ি চাপায় এক্সিডেন্ট করে মরে যাই, তখন কী হবে? ও না হয় বউ হারাবে, বিয়ে করে শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে। কিন্তু আমার মা-বাবা? আমাকে তো আর ফিরে পাবে না।”
অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিন্তিত গলায় বলল,
— “কথাটা ঠিকই বলেছ।”
নাবিলা হাত নেড়ে বলল,
— “তাহলে এইজন্যই বলছি, এখন আর কথা বলব না।”
অন্বেষা বিরক্ত মুখে সামিরকে ফোন করে নাবিলার বলা কথাগুলো বলল। ওপাশে সামির কি বলল কে জানে! অন্বেষার ভ্রু ক্রমশ কুঁচকে যাচ্ছিল। শেষমেষ সে ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিল।
— “এই ছেলেটা একদমই মাথামোটা!” বলে হাঁফ ছাড়ল অন্বেষা। নাবিলা হাসি চাপতে পারল না।
অন্বেষার সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাবিলা চোখে রেখেছিল আশেপাশে। গতকালের মতো আজও আচমকা নজর পড়ল আয়ানের দিকে। কিন্তু আজ সেই মেয়েটা ওখানে নেই। নাবিলা কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে অন্বেষাকে বলল,
— “দেখেছো, আয়ান ভাইয়া?”
অন্বেষা ঘুরে তাকাল। ঠিক সেই মুহূর্তে, ওই মেয়েটা ধীরে পায়ে আয়ানের দিকে এগিয়ে এলো। নাবিলা এবং অন্বেষা দুজনেই হকচকিয়ে তাকিয়ে রইল। নাবিলা স্বাভাবিকভাবে অন্বেষার কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে আড়ালে দাঁড়াল।
ওরা দু’জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে গভীর আলোচনা করছিল। কথাবার্তা তো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না কিন্তু দৃষ্টি, ভঙ্গি, হাতের ইশারা; সবই বোঝাচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে কথা হচ্ছে। কি এমন বিষয় হতে পারে যে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এভাবে ফিসফিস করতে হবে? কিছু সময় পর ওরা দু’জন আলাদা পথে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর এই দু’জন আস্তে করে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। অন্বেষা বলল,
— “পড়শী?”
— “ওহ হ্যাঁ, নামটাই ভুলে গেছিলাম। আমি গতকালও এইখানেই দেখেছি দু’জনকে।”
অন্বেষাকে ভাবুক দেখাল,
— “কি রহস্য চলছে। লুকিয়ে দেখা, গোপন মিটিং, ফিসফিস সবকিছু একসাথে। কি করা যায়? চলো, ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করা যাক।”
— “ঠিক হবে না। ভাইয়া হয়তো বিষয়টা গোপন রাখতে চাচ্ছে।”
— “কিন্তু এত গোপনীয়তা কীসের? দু’জন ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে, বুঝতে পারছ? কিন্তু ভাইয়া পড়শীর সাথে? এতদিন বুঝতেই পারিনি। অথচ আমার চোখের সামনে আমাদের বাড়িতে কথাবার্তা বলত। তুমিও তো দেখেছ, তাইনা? চলো, ভাইয়ার কাছে যাই।”
— “থাক আপু, এখন কিছু বলো না। ভাইয়াকে চিন্তিত দেখাল। পরে সময় হলে, মনমেজাজ ভালো থাকলে জিজ্ঞেস করো।”
— “বলছ? ঠিক আছে। চলো এখন, বাড়ি গিয়ে তোমাকে সামিরের সাথে কথা বলিয়ে আমরা মজা করব।” অন্বেষা বলল।
সামিরের সঙ্গে ও কথা বলবে না। যতবার কথা বলার প্রসঙ্গ উঠবে, ততবার এড়িয়ে যাবে। এতদিন কাছে থেকে নাবিলাকে মজা দেখিয়েছে, এবার দূর থেকে নাবিলা তাকে সেই মজার দৃশ্য উপভোগ করাবে। নাবিলা মনে মনে বলল, “ইট মারলে যে পাটকেল খেতে হয়, তা তোমাকে এইবার বুঝতে হবে। কত ধানে যে কত চাল, তাও তোমাকে বুঝিয়ে ছাড়ব। তুমি যদি ডালে ডালে চলো, তবে আমি পাতায় পাতায় দৌড়াব মিস্টার।”
নাবিলা সত্যিই সামিরের সাথে আর কথা বলল না। সেদিনও দু’বার সামির লোক মারফত খবর পাঠাল, কিন্তু নাবিলা ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে গেল। মুখে না বললেও, এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিটুকুই ছিল যথেষ্ট।
কামিনী দূর থেকে কৌতূহলী চোখে ওর প্রতিটি আচরণ লক্ষ করছিল। বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে ও ভাবছে, সামির এমন মরিয়া হয়ে কথা বলতে চাইছে কেন? আর নাবিলা কেন এভাবে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে?
নাবিলা লক্ষ্য করল কামিনীর এই হাবভাব। একসময় হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে ভাবিজান? এত কৌতূহল কীসের?”
কামিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “তুমি আমাকে এভাবে ডাকবে না তো, বিরক্ত লাগে।”
— “আমার স্বামী তো তাই ডাকে আপনাকে।”
— “মানা করতে পারো না?”
— “ওমা! সম্পর্কে তো ভাবিই হচ্ছেন।”
কামিনী বিরক্ত হয়ে বলল,
— “তো এইভাবে রঙচঙ মিশিয়ে ডাকতে হবে? যত্তসব।” বলেই মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল। নাবিলা তখন হেসে কুল পেল না। সামির নেই ঠিকই কিন্তু ওর কর্মকাণ্ড, ওর উপস্থিতি, এমনকি ওর তরফের খুনসুটিও এখনো ঘরজুড়ে রয়ে গেছে। সেদিন রাতে অন্বেষা বাড়িতে ছিল। দু’জনে মিলে সারারাত ধরে মুভি দেখে, গল্প করে, হাসাহাসিতে সময় কেটে গেল। সামিরের টানাপোড়েনের চিন্তা থেকে একটু হলেও মুক্তি পেল নাবিলা।
সকালে বাড়িতে ফিরতেই থতমত খেল, চোখ কপালে উঠল, মুখ হাঁ হয়ে গেল, তাজ্জব বনে গেল, রীতিমতো লজ্জায় পড়তে হলো।
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]