#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৪]
~আফিয়া আফরিন
ওদের দেখে আয়ান ভয় পাচ্ছে। কী থেকে যে কী করে ফেলে, কোনো ভরসা নাই। পড়শীর সাথে যে তার লোক দেখানো প্রেম চলছে ব্যাপারটা তা না, এমনিতে ভালোবাসে। এটা পড়শীও জানে। সেও ভালোবাসে, তবে ওর তরফ থেকে স্বীকারোক্তি মিলে নাই। ওদের কথায় তো রাজি হলো কিন্তু শক্ত মুখে বলে দিল,
— “তোরা যা ইচ্ছে করিস, তবে বেশি জল ঘাঁটিস না। আর আমারে লজ্জায় ফেলিস না।”
অন্বেষা চোখ গোল করে বলল,
— “আরে ভাইয়া, প্রেম আর পরীক্ষার ফেল; দুটো দারুন বিষয়, লজ্জা পেতে হয় না।”
নাবিলা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল,
— “আমাদের হাতে দিয়েছেন না ভাইয়া, সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। আপনি শুধু হ্যাঁ-হুঁ করবেন।”
তারপর দুজন ষড়যন্ত্রকারীর মত গম্ভীর হয়ে বসল। অন্বেষা কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করল।
“প্ল্যান নাম্বার ওয়ান: পড়শীর সাথে আলাদা করে দেখা করা।”
“প্ল্যান নাম্বার টু: পড়শীর সাথে কথা বলে বাড়িতে দ্রুত জানানো।”
“প্ল্যান নাম্বার থ্রি: পড়শীকে কফি খেতে বাসায় ডাকা।”
“প্ল্যান নাম্বার ফোর: ভাইয়াকে কফি বানাতে বাধ্য করা।”
“প্ল্যান নাম্বার ফাইভ: ওরা একসাথে বসে থাকলে আমাদের হঠাৎ ঘর থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া।”
“প্ল্যান নাম্বার সিক্স: সোজা বিয়ে।”
আয়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
— “তোরা এসব আবার কি শুরু করলি? সবকিছুতেই নাটক করা লাগে, তাইনা?”
অন্বেষা সেই কথায় পাত্তা দিল না। সবাই জানে, নাটক না করলে ওদের পেটের ভাত আজকাল হজম হচ্ছে না। যেতে যেতে নাবিলা আবার গান ধরল,
— “আয়ান ভাইয়ার বিয়ে!
টোপর মাথায় দিয়ে!
বউ আনব ঘরে,
মিষ্টি মুখ করে!”
অন্বেষাও তাল মিলিয়ে গুনগুন করে গাইল,
— “ভাইয়া বউ আনবে ঘরে,
লজ্জায় গাল লাল করে…”
শীতের বিকেলের নরম রোদ মেঘের আড়াল থেকে গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার ধারে ছোট্ট সুন্দর কফিশপটায় নাবিলা আর অন্বেষা আগেভাগেই এসে কোণার একটা টেবিলে বসল। মৃদু আওয়াজে জ্যাজ মিউজিক বাজছে। পড়শীও আসবে, গতকাল অন্বেষা বলেছে জরুরি কথা আছে যেন দেখা করে। ওরা দু’জন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট দশেক পার হলো। ঘড়ির কাঁটা দেখে অন্বেষা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— “আসবে তো?”
নাবিলা চেয়ারে হেলান দিয়ে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলল,
— “সবক্ষেত্রেই নায়িকারা সবসময় একটু দেরি করেই আসে। এটাই নিয়ম।”
ঠিক তখনই দরজার উপরে টাঙানো ঘণ্টাটা টুং করে বেজে উঠল। ভেতরে ঢুকল পড়শী। হালকা গোলাপি রঙের শাল কাঁধে জড়ানো, চুল খোলা, মুখে অপ্রস্তুত হাসি। চারপাশে তাকিয়ে দু’জনকে দেখে এগিয়ে এলো। নাবিলা আর অন্বেষা দু’জনেই প্রফুল্ল চিত্তে হেসে খুব ভদ্রভাবে ওকে স্বাগত জানালো। চোখাচোখি হতেই অস্বস্তি লাগল। ওয়েটার কফি দিয়ে গেলে ওরা কফির কাপটা হাতে তুলে নিল। অন্বেষা পড়শীর দিকে তাকাল। ওর চোখেমুখে কৌতূহল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে খানিকটা অস্বস্তি কাজ করছে, তা বোঝা যাচ্ছে। একসময় চারপাশে তাকিয়ে খুব ধীরে বলল,
— “হঠাৎ আমাকে এভাবে জরুরি তলব? কী হয়েছে আপু?”
নাবিলা দুষ্টু হেসে সামনের দিকে ঝুঁকে বলল,
— “কিছু হয় নাই বরং হবে। মিশনে আছি আমরা। আমাদের ভাইয়ার কেসটা আজকেই ডিসমিস করতে হবে।”
পড়শী চমকে উঠে ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “ভাইয়া? কোন ভাইয়া?”
নাবিলা চোখ টিপে হেসে ফেলল। ঠোঁটে একরকম দুষ্টু ঢেউ, গলায় নাটকীয় ভঙ্গি,
— “আমাদের আয়ান ভাইয়া… যে আজকাল তোমার সাথে কানামাছি খেলায় ব্যস্ত।”
— “ইয়ে মানে, আমার সাথে কেনো? আমি শেষ কবে কানামাছি খেলেছি, ভুলেই গেছি।”
অন্বেষা তখন হেসে ফেলল,
— “কিন্তু আমরা দু’জন গুপ্তচর, সব জানি! এখানে কোন খেলার কথা বলা হচ্ছে, তা আশা করি তুমিও বুঝতে পারছ। এখন কথা হচ্ছে, বিয়েশাদীর কি প্ল্যানিং?”
পড়শী কাপটা নামিয়ে নিল। গাল লাল হয়ে উঠল কিনা বোঝা গেল না, তবে দৃষ্টি নামিয়ে দিল। তা ওদের চোখ এড়াল না। পড়শী দু’জনের মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর সামান্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরক্ষণেই যা বলল তার মূলভাব হচ্ছে, আসলে বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে ও এখনো কিছু জানি না। বাড়িতেও কেউ সেভাবে বলেনি। তবে মায়ের মুখে এক-আধবার শুনেছে, পড়াশোনা করতে করতে যদি ভালো মোটামুটি বয়স আছে এমন কোনো সরকারি চাকরিজীবী পাত্র মেলে, তাহলে নাকি বিয়ের কথা ভাববে। তার বাইরে তেমন কিছুই স্থির হয়নি।
অন্বেষা আর নাবিলা চোখাচোখি করল। মেয়ের মায়ের যদি সরকারি চাকরিজীবী পাত্র পছন্দ হয়, তাহলে তো মুসিবত! আয়ান যে প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে।পড়শী কথাগুলো বলতেই অন্বেষা ঠোঁট কামড়ে নাবিলার কানে ফিসফিস করে বলল,
— “এবার তো কেস টাইট। বয়সের ক্ষেত্রেও ভাইয়া গোল্লা আর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও।”
নাবিলাও ভুরু কুঁচকে ফিসফিস স্বরে উত্তর দিল,
— “হুম, আসলেই ঝামেলা।”
ওরা চুপ করে যায়। পড়শী অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। বাড়িতে গ্যাঞ্জাম করার মত সাহস অথবা সাধ্য তার নেই অথচ একজনকে মন দিয়ে বসে আছে। এই সম্পর্ক যে বাড়িতে মানবে না, তা স্পষ্ট। তবুও মানানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। এখন ভয় হচ্ছে, মা শুধু কথায় কথায় সরকারি চাকরির কথা বলে আর ছেলের মোটামুটি বয়সের একটা গ্যাপ থাকবে। কারণ, অল্পবিস্তার বয়সের ফারাক থাকলে সে ছেলেরা নাকি চাঁচাছোলা টাইপের হয়, সংসার জীবনে স্থির থাকে না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও না… তার পছন্দমত এমন ছেলের হাতেই মেয়ে তুলে দিবে।
পড়শীর ভাবনার মাঝেই নাবিলা আচমকা গম্ভীর মুখ করে বলল,
— “আচ্ছা, সরকারি চাকরিওয়ালা মানে কারে বোঝায়? ওই যে ভুঁড়ি ওয়ালা, পেট মোটা, টাকলা মামাদের মত? অফিসে বসে শুধু চা খায়, সিগারেট ফুঁকায়, আর ফাইলের ওপর ঘুমায়?”
অন্বেষা গা শিউরে বলল,
— “উফ! ওই টাইপ মানুষ? আমি তো ভাবতেই পারছি না, ৩৫+ কেউ জুটলে পড়শীর জীবন শেষকৃত্য হয়ে যাবে। পড়শী, তোমার বয়স কত? একুশ/বাইশ?”
— “হুঁ।”
নাবিলা হেসে কুটিকুটি,
— “কাকু অফিস থেকে ফিরে এসে পিচ্চি বউকে বলবে, ‘চা দাও গো ময়নার মা, সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম।’ তারপর বউ বেচারী চা নিয়ে রোমান্টিক মুডে আসতেই দেখবে তার স্বামী মহাশয় নাক ডেকে ঘুম!”
অন্বেষা যোগ করল,
— “আর ছুটির দিনে? লুঙ্গির গিট্টু দিয়ে একহাতে খবরের কাগজ, আরেক হাতে পেট খামচে বসে বসে প্রমোশনের কথা ভাববে। বউ তখন রান্নাঘরে হাপুসনুপুস করবে। বাই দ্যা ওয়ে পড়শী, তুমি কি এমন কাউকে বিয়ে করতে চাও?”
পড়শী তৎক্ষণাৎ ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়াল। ও তো কল্পনাই করতে পারছে না। আয়ানই ঠিক আছে, পারফেক্ট। দেখতেও সুন্দর, মাথায়ও যথেষ্ট চুল আছে, যথেষ্ট সময় দেয়, বোঝার চেষ্টা করে আর ইয়ে… মানে, ওর ভুঁড়িও নেই।
অন্বেষা এইবার বেশ গম্ভীর স্বরে বলল,
— “এমন কাউকে বিয়ে করলে সারা জীবন এটা বলতে বলতেই কাটবে যে, ‘আমি জোয়ান একটা মাইয়া, বুইড়া জামাইয়ের কাছে আমায় বাবায় দিছে বিয়া। ও সে যৌবন জ্বালা মিটায় নারে মরে কুঁকাইয়া। বুইড়া জামাইয়ের কাছে আমায় বাবায় দিছে বিয়া। বুইড়ায় আকিজ বিড়ি খাইয়া শেষে, খ্যাক্কেরখ্যাক্কের কইরা কাশে। হায়রে কাশিতে কাশিতে যায় লুঙ্গি খুলিয়া, বুইড়ার কাশিতে কাশিতে যায় লুঙ্গি খুলিয়া…’ ভেবে দেখো, তুমি কিন্তু শেষমেশ যৌবনের আগুনে অঙ্গার হয়ে যাবে।”
পড়শী লজ্জায় লাল নীল হয়ে মাথা নিচু করল। এরা এত পঁচা পঁচা কথা কিভাবে বলে? কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগল। অন্বেষা আরো কথা বলছিল। নাবিলা ওর হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করল। ফিসফিস করে বলল,
— “এত বাজে বাজে কথা কেন বলছ? এটা কফি শপ, আশেপাশে মানুষ আছে।”
অন্বেষা চোখ ঘুরিয়ে হাসল,
— “আমি কি এসব থোড়াই কেয়ার করি? মানুষ আছে দেখে কি হয়েছে? এই সাইন্স সবারই জানা আছে।”
নাবিলা নিজেও লজ্জা ঢেকে রাখতে পারল না, মাথা নিচু করে বসে রইল। শেষমেষ ফাজলামি বাদ দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা হলো। অন্বেষা হেসে বলল,ওরা শীঘ্রই বাসায় বড়দের সাথে আলোচনা করবে। এরপর বাসা থেকে পড়শীদের বাসায় প্রস্তাব পাঠানো হবে। তাহলেই আর কোনো সমস্যা হবে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, পড়শীর বাবার সাথে ওদের পরিবারের মোটামুটি ভালোই সখ্যতা আছে। কথাবার্তা শেষে তিনজন উঠল, যে যার গন্তব্যে পা চালাল।
.
আজ ০২ তারিখ। এই দিনটার জন্য নাবিলা গত কয়েকমাস ধরে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার ফলও হাতে পায়। কোনোবারই খালি হাতে ফেরত যেতে হয় না। আজকেও রীতিমতো কলিংবেল বাজল, নাবিলা দৌড়ে গেল। হৃদয় তাড়নায় ভরা অনুভূতিতে ধীরে ধীরে প্যাকেটটি হাতে নিল। বাইরে সকাল ঠান্ডা হলেও ওর মধ্যে একরকম উষ্ণতা নেমে এসেছে। ঘরে এসে প্যাকেট খুলতেই চোখে পড়ল শাড়িটার হালকা সবুজ রঙ, মসৃণ রেশমি ছোঁয়ায় হাতে স্পর্শ পেলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। ভাঁজ খুলতে খুলতে সামনে এল ছোট্ট, কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া চিরকুটটা। নাবিলা তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, “আমার অপেক্ষাগুলো মূল্যবান করে তোলার জন্য তোমায় অনেক অনেক ধন্যবাদ, সামির ইয়াসির।”
নাবিলা চিরকুটটা খুলে পড়তে আরম্ভ করল,
“মনটা কেমন আজকাল অসুখে ভরা; চুপচাপ, শান্ত, আর কখনো কখনো অচেনা উদাসী। মনে হয়, শুধু তোমার সান্নিধ্যই আমর ভালো থাকার ওষুধ। ২৪ ঘন্টা… কত দীর্ঘ, কত বিরক্তিকর মনে হয়। কিন্তু তারপরও যখন তোমার কথা মনে আসে, যখন ভালোবাসার ভাবনায় ডুবে যাই, তখন সবকিছুই ম্লান হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়, এই বিরক্তিকর মুহূর্তগুলোও মনে হয় কত মধুর! আমার আনন্দের ঢেউ কিংবা নিঃশব্দ দুঃখ; আমি চাই সবটাই তোমায় স্পর্শ করুক। দুঃখের কথা শুনে অবাক হচ্ছো, তাইনা? আমি চাই, তুমি আমার অনুভূতির গভীরে থাকা সবকিছুকে জানো, অনুভব করো। দুঃখ তোমার হৃদয়কে ছুঁয়ে দিলে তুমি বুঝতে পারবে, আমার ভালোবাসা শুধু সুখে নয় দুঃখেও তোমার কাছে বাঁধা। এই ছোট্ট উপহারটা তোমার কাছে আমার পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমার সেই দুঃখকে জাগ্রত করে আমার হৃদয়টা একটু শান্ত করা। শাড়িটা হাতে তুলে নিলে অনুভব করতে পারবে আমার ভালোবাসার ছোঁয়া, আমার চুপচাপ না বলা কথাগুলো। প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি সূচকী খোঁপা আমার মনে থাকা যত্ন, ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
আমি চাই তুমি জানো, কোথাও কেউ আছে যে শুধু তোমাকে চিনে, তোমার সুখ-দুঃখ বোঝে এবং তোমার জন্য অপেক্ষা করতে জানে। আমার এই অপেক্ষার প্রতীক্ষায় আমি শুধু তোমাকে চাই, তোমার জন্য ভাবতে চাই, তোমাকে ভালোবাসতে চাই; এটাই আমার অসুখ, আর এই অসুখের ওষুধ শুধুমাত্র তুমি।”
নাবিলার চোখ ভিজে গেল। চুপচাপ সামিরের চিরকুট হাতে একগাদা অনুভূতি অনুভব করল। হেসে হেসে নিজের লাজুকতা লুকাতে চেষ্টা করল। তারপর দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে একটা মেজেস পাঠাল,
— “এইযে শুনুন!”
বসে রোমাঞ্চ ও কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। চোখের কোণে দীপ্তি, মুখে লাজুক একটি হাসি, আর মনটা দ্রুততর ছন্দে ধকধক করছে। সামিরের মেসেজ এসেছে,
— “জ্বি, বলুন।”
পড়ে মনে হলো, সামনের জগতের এক অদৃশ্য নরম হাত ওকে হতবিহ্বল ভাবে স্পর্শ করছে। নাবিলা লিখল,
— “এভাবে কেউ আমার অন্তর স্পর্শ করবে, সেটা কল্পনাও করিনি।”
— “কে করল?”
নাবিলা উত্তর দিল শান্তভাবেই,
— “চিঠিওয়ালা। বলেছিলাম না তার কথা?”
— “হুম। খুঁজে পেয়েছ?”
— “পেয়েছি আরো আগেই। প্রথমদিনেই।”
— “তাহলে তো ভালোই।”
নাবিলার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল,
— “হুম। কেমন আছেন? কি করেন?”
— “আমি ঠিকই আছি। আজকাল শুধু ব্যস্ত। তুমি কি করছ?”
নাবিলা দুষ্টুমির ছলে মনের কথা লিখল,
— “আপনার কথাই ভাবছিলাম। আপনি ছাড়া দিনটাই আমার অসম্পূর্ণ।”
সামির ভুরু কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। নাবিলার কথাটা ঠিক ওর সাথে যাচ্ছে না। উঁহু, ওর মধ্যে যেই মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া একটা ভাব ছিল তা আজকাল দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাবে কি করে? বলেই তো দিয়েছে, এখন তার অন্তরে স্পর্শ করা হয়েছে। সামির লিখল,
— “অসম্পূর্ণ? তাহলে তো আমাকে অবিলম্বে দিনটা সম্পূর্ণ করতে আসতে হবে, নাবিলা।”
— “লজ্জা পেলাম। দিনদিন বোধহয় আমি একটু বেশিই লাজুক হয়ে যাচ্ছি।”
সামির মেসেজ টাইপ করতে গিয়ে কয়েকবার ডিলিট করল। শেষে একটু থেমে লিখল,
— “লজ্জা পাওয়া ভালো তবে বলি কি… দিনে নয়, রাত হচ্ছে লজ্জা পাওয়ার আসল সময় আর রাত-ই লাজুক মানুষের সাহসী হওয়ার সময়।”
নাবিলা সামিরের মেসেজটা পড়তেই একমুহূর্তেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ভাগ্যিস সামির সামনাসামনি নাই। থাকলে কী হতো… ভাবতেও চায় না। বুকের ভেতরকার অনুরণন শুনছিল শুধু। ফোনের স্ক্রিনে হাত রাখল, কিন্তু আঙুল কিবোর্ডে নামতেই চাইছে না। অনেকক্ষণ বসে রইল নীরব হয়ে। উফফ, কী পাজি ছেলেটা।
সামির জানত, সহজে এই মেসেজের জবাব পাওয়া যাবে না। নাবিলা লজ্জায় ডুবে গিয়ে জবাব দিতেই ভুলে যাবে। সামির মনে মনে হাসল। লিখল,
— “দিনকাল সম্পূর্ণ করতে চাইলাম। আসতে বললে না তো।”
নাবিলা এইবার উত্তর দিল,
— “ইশশশ, আমি বললেই যেন আপনি আসেন! আমার কথায় কী যায় আসে?”
— “তাও বললেই পারতে।”
নাবিলা গম্ভীর ভঙ্গিতে লিখে পাঠাল,
— “যা হবে না, তা বলি না।”
— “ওহ।”
— “আচ্ছা। যাই, মামণি ডাকছে।”
— “আচ্ছা।”
নাবিলা ঠোঁট উল্টাল, বিরক্ত মুখে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল। যাচ্ছি বললেই যেতে দিতে হবে নাকি? জোর করে ধরে রাখা যায় না? হুহ, বেশি ঢং! শুধু কাগজ ভর্তি বড় বড় কথা… মুখে বলার সময় যত কিপটেমি। ধ্যাত্তেরি!
ইদানিং নাবিলার সাথে অন্বেষার গুজুরগুজুর চোখ এড়ায় না কামিনীর। ভেতরে ভেতরে তার মেজাজ বড্ড খারাপ হয়। কই! তার সাথে তো এত পিরিতি দেখায় না, অথচ নাবিলার সাথে? আবার নতুন করে আয়ানকে নিয়েও মেতে উঠেছে। এত কীসের টান? অন্বেষার কথা আলাদা, ওর তো নিজের ভাই। কিন্তু নাবিলা? ওর কে? শুধুই ভাসুর, তাও একদমই নিজের নয়।
কামিনীর বুকের ভেতরে হাহাকার জমে ওঠে। অন্বেষার সাথে নাবিলার খুনসুটি হজম করাই তার জন্য কঠিন ছিল, তার উপর এখন আবার আয়ানের সাথেও নাবিলার মেলামেশা! বয়স তো কম… এই বয়সে সব সম্ভব। মুখে সাধু-সাধু করে, ভেতরে কী করছে কে জানে?
নাবিলার প্রতি এই হিংসা কোথা থেকে আসে তা কামিনী নিজে জানলেও ভেতরে চেপে রাখে। শুধু সামিরের বউ বলেই, এই অস্থিরতা। ইদানিং এত যে সখ্যতা ওদের সেই সম্পর্কে হয়তো কারও কানে সামান্য ইঙ্গিত দিলেই আগুন জ্বলে উঠবে… তখন সবাই ওদের দোষ ধরবে। নাবিলার মুখ কালো হবে, সামিরের বউ হিসেবে।
এই কুৎসিত একটা ভাবনা কামিনীর মাথায় আসতেই নিশ্চিন্তে কুটিল হাসল সে। পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিল। চোখে পড়ল ড্রয়িংরুমে বসে থাকা অন্বেষা, আয়ান আর নাবিলা একসাথে বসে কী নিয়ে হাসাহাসি করছে! নাবিলার হাত নাড়ানো, আয়ানের খুনসুটি, অন্বেষার উচ্ছ্বাস; সবকিছু তার কাছে অস্বাভাবিক রকম ঘনিষ্ঠ মনে হলো। কামিনীর চোখ সরল না। ঠোঁট কামড়ে ভাবল, “দেখো দুনিয়া, কি করছে ওরা! সামিরকে জানাতে হবে। সে-ই দেখুক, তার বউয়ের কর্মকাণ্ড! আমি সরাসরি মুখে বলব না, শুধুমাত্র ইঙ্গিত দেব।”
কামিনী পর্দার ফাঁক নামিয়ে দিল। অন্বেষা এইদিকেই আসছিল। কামিনীকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা ভয় পেয়ে গেল।
— “ওমা ভাবি! এখানে কি করছ? আসো না, আমরা গল্প করছিলাম। ভাইয়ার বিয়েতে কি করব তাই প্লানিং করছি। মানে, যার বিয়ে তার হুঁশ নাই আর পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই আর কী। আসো।”
কামিনী অন্বেষার সাথে বসার ঘরে এলো। ওদের দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ ভরা হাসি দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “আহা! এত আনন্দ? আমি বুঝি ভুল জায়গায় চলে এলাম।”
নাবিলা পাশে বসার জায়গা করে দিল। কামিনী বসল না উল্টো এগিয়ে এসে বলল,
— “উঁহু, বসব না। তবে তোমাকে বলি, বয়সটা কিন্তু কম। এই বয়সে খামখেয়ালিপনা অনেক হয়। একটু সাবধানে চলাফেরা করা দরকার। সবকিছুতে এত হইচই করা ভালো না। লোকে তো অনেককিছুই ভাবে।”
কথাটা শুনে আয়ান, অন্বেষা দু’জনেই একমুহূর্ত থেমে গেল। নাবিলা হতবাক চোখে তাকাল কামিনীর দিকে। এটা কেনো বলল? কি উদ্দেশ্যে? আর ওকেই কেনো বলল? নাবিলা কিছু বলার আগে কামিনী আবারও মিষ্টি গলায় যোগ করল,
— “আসলে কিছু বলছি না গো, শুধু মনে করিয়ে দিলাম। এই বয়সে ভুল বোঝাবুঝি হলে মান-সম্মান ক্ষুণ্ন হতে দেরি লাগে না।”
নাবিলা ভুরু কুঁচকালো, আয়ান আর অন্বেষা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কিন্তু কারোরই মাথায় কিছুই ঢুকল না। “বয়সটা ভালো না… সাবধানে চলাফেরা করো।” এর মধ্যে কীসের ইঙ্গিত? তারা কেউই ধরতে পারল না। আসলে ধরবেই বা কীভাবে? তাদের মনে তো কোনো পাপ নেই। ওরা যেটা করছিল, সেটা স্রেফ আপনজনের হাসাহাসি, গল্পগুজব। কামিনীর কথার ভেতরের কটাক্ষ তাদের কাছে অচেনা ভাষা।
.
.
.
চলবে…..
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৫]
~আফিয়া আফরিন
কামিনীর কথায় ভরা ঘরে আচমকা একটা শীতল বাতাস ঢুকে পড়ল। গল্পের হাসি-ঠাট্টার তাল একনিমিষে কেটে গেল। নাবিলা নিঃশব্দে উঠে চলে গেল, মুখে কিছু না বললেও চোখেমুখে বিরক্তি ছিল স্পষ্ট। অন্বেষাও ক্ষেপল, তবে কামিনীকে কিছু বলল না। খানিক পরেই ফোন করে শাহিদকে ডাকল, ওকে যেন এসে নিয়ে যায়। সাধারণত নিজেই যায়, মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই একটু আহ্লাদ করতে ইচ্ছে হলো।
শাহিদ আসতেই, তার সাথে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্বেষা হালকা গলায় সব পরিকল্পনা খুলে বলল। বলতে বলতেই আচমকা ওর হাতটা শাহিদের হাতে জড়িয়ে নিল। শাহিদ হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
— “কি হচ্ছে কি? রাস্তায় মানুষ আছে।”
অন্বেষা ভ্রু কুঁচকে আবার হাত ধরে বলল,
— “কেন? ভয় পাও?”
— “ভয়ের প্রসঙ্গ আসছে কেন? মানুষজন দেখলে কী ভাববে?”
অন্বেষার ঠোঁটে দুষ্টুমি ভরা হাসি ফুটে উঠল,
— “ভাবুক যা ইচ্ছে। আমি কি তোমার বউ না? হাত ধরো, ভালো করে ধরো। মানুষ জানুক আমি তোমার স্ত্রী। এতে দোষ কী? উল্টো যদি কোথাও অন্যকারো সাথে তোমার ইন্টুপিন্টু দেখে, তখন ওরাই এসে আমায় জানাতে পারবে।”
শাহিদ হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। চোখে উজ্জ্বল খুনসুটি। এবার অন্বেষার হাতটা শক্ত করেই ধরে ফেলল। একরাশ উচ্ছ্বাসে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় যাকেই পেল বাবার সমবয়সী, চাচা, ভাই কিংবা পাড়ার দাদা সবাইকে গলা ফাটিয়ে বলল,
—“শুনেন সবাই, এইটা আমার একমাত্র বউ। চিনে রাখেন। ছোট ভাই, এটা তোমাদের ভাবি। ওওও কাশেম চাচা, আপনাদের বউমা।”
অচেনা মানুষের বিস্ময় আর চেনাজানা মুখের হাসির ঢেউ চারদিক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। অন্বেষা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করল। এত মানুষের সামনে শাহিদের এই অকপট স্বীকারোক্তি ওর গাল গরম করে দিল। তবে মনে মনে বুক ভরে গেল আনন্দে, নিশ্চয়তায়।
কামিনী রান্নাঘরে ছিল। দুপুরের রান্না করছিল, কিন্তু মনটা মোটেও রান্নায় ছিল না। মাথার ভেতর দৌড়াচ্ছে হাজারো চিন্তা, “কীভাবে কি করলে সুবিধা হবে? কার সাথে আগে কথা বলতে হবে? কোনভাবে কথাটা সাজালে আমার কথাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হবে…” তরকারির ধোঁয়া চুল্লি পেরিয়ে বাতাসে উঠছিল, কিন্তু ওর খেয়ালই নেই। পেছনে কেউ ঢুকেছে, সেটাও টের পেল না। হঠাৎই কানে বাজল কড়া গলা,
— “ও কি করছ তুমি? তরকারি পুড়ে যাচ্ছে, মন কোনদিকে তোমার?”
চমকে উঠল কামিনী। হাতের খুন্তি আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। ঘুরে তাকাতেই সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাশুড়ি। কপালে ভাঁজ, চোখে বিরক্তি।
— “কী ব্যাপার, খেয়াল নেই কেন?”
কামিনী ঠোঁট কামড়াল। কিছু না বলে তাড়াহুড়ো করে কড়াইতে পানি ঢেলে দিল। কামিনী অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছিল, কখন সুযোগ পাবে নিজের কথা বলার। হঠাৎ মনে হলো, এই তো সময়। গলাটা মিষ্টি করে নরম করল,
— “মা, আয়ান ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে ভাবলেন কিছু?”
ইয়াসমিন হাতের কাজ থামালেন না,
— “নাবিলা আর অন্বেষা বলেছে, পাত্রী নাকি ঠিক আছে। সময়মতো জানাবে।”
উফফ… আবার এই নাবিলা? কামিনী বিরক্ত হয়ে বলল,
— “ওরা কী জানাবে? বিয়েশাদী দিয়ে দেন, মা। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ে, কে জানে কবে কী হয়!”
— “হ্যাঁ দিব।” ইয়াসমিন শান্ত গলায় জবাব দিলেন।
কিন্তু কামিনী থামল না। খোঁচা মারার ভঙ্গিতে বলে উঠল,
— “নাবিলাও আজকাল আসছে খুব। বাড়িতে অবিবাহিত ছেলে আছে একটা…”
ইয়াসমিন এবার হাত থামিয়ে দিলেন। মাথা ঘুরিয়ে কামিনীর দিকে তাকালেন। ভুরু কুঁচকাল, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। গলা গম্ভীর, প্রায় শীতল,
— “কি বলতে চাও তুমি?”
কামিনী একটু হকচকিয়ে গেলেও হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল,
— “না, তেমন কিছু না। আপনি তো বোঝেনই তাই না…”
ইয়াসমিন কথাটা খড়গের মত কেটে দিলেন,
— “বুঝি মানে? এটা কীসের ইঙ্গিত দিলে তুমি? নাবিলা এই বাড়ি, এই বংশের ছোটো বউ। আয়ান আমাদের ছেলে। তুমি এটা কীরকম কাঁদা ছুঁড়লে?”
ইয়াসমিনের কঠিন গলায় থমকে গেল আশপাশ। তবু কামিনী চুপ থাকল না। খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়তে নাড়তে নিচু স্বরে বলল,
— “মা, আমি তো শুধু ভেবেছিলাম… নাবিলা যদি এভাবে যাওয়া-আসা করতে থাকে, লোকে তো কথা বলবেই।”
ইয়াসমিন এবার সত্যিই ক্ষেপে উঠলেন,
— “লোকে কি বলবে, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। তোমার না। নাবিলা আমার মেয়ের মতো। ওর নামে এমন কথা বলার সাহস তুমি কোথা থেকে পাও?”
— “মা, আমি ভালোর জন্যই ভাবছিলাম। সমাজ তো আর আমাদের মতো বোঝে না।”
ইয়াসমিন এবার গম্ভীর মুখে বড় ছেলেকে ডাকলেন। যে অভিযোগ কামিনী করছে, তা তিনি সামলাতে পারবেন না। এখনই তো গা-মাথা ঘুরাচ্ছে। এই কথা পাঁচ কান হলে, কী সর্বনাশ ঘটবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
— “রায়হান, একবার এখানে আয়।” রায়হান এসে দাঁড়াতেই তিনি হাতের ইশারায় কামিনীকে দেখালেন। কণ্ঠে কঠোরতা, “দেখ, তোর বউ কি বলছে। ওর মাথা গেছে বোধহয়। সামলাস ওকে। নইলে এই বাড়ির শান্তি থাকবে না।”
রায়হান হকচকিয়ে মায়ের দিকে তাকাল,
— “কি হয়েছে মা?”
ইয়াসমিন চোখ মেলে কামিনীর বলা সবকিছু ছেলেকে খুলে বললেন। রায়হান গম্ভীর মুখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। কামিনী ঠোঁট কামড়ে নিচু গলায় বলল,
— “আমি তো শুধু…” কিন্তু বাকিটা শেষ করতে পারল না। রায়হান হাত তুলে থামিয়ে দিল,
— “চুপ। আর একটি শব্দও নয়। তোমার সাহস দেখে আমি সত্যি হতবাক! ঘরে এসো, কামিনী।”
কামিনী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে মনের মধ্যে ঝড় তুলল। যা করতে চেয়েছিল, ঠিক তার বিপরীত হলো! সবাই তাকেই দোষারোপ করছে। যুগ যুগ ধরে তো এমনই হয়ে আসছে। সত্যি কথার ভাত নাই, কপালে শুধু ঝামটাই। ঠোঁট বাঁকিয়ে বিরক্তিভরে মুখ ঝামটাল ও। রায়হান গম্ভীর মুখে চোখের ভাঁজ শক্ত করে বলে দিল, পরবর্তীতে এসব উল্টোপাল্টা কথা যেন ভুলেও মুখ থেকে বের না হয়। একবার হলে হয়েছে। ওদের জন্য এরচেয়ে বড় লজ্জার কিছু নেই। কামিনী প্রতিবাদ করতে চাইছিল, কিন্তু রায়হান হাত তুলে থামিয়ে দিল। মাকেও সে বলে এসেছে, যা হয়েছে ভুলে যেতে। আর নাবিলার কানে যাতে না যায়, সেটা খেয়াল রাখতে। একবার কাকির কানে গেলে কি হবে? কতটা অসম্মানজনক! ছিঃ! শুধু কাকিই নয়, সামিরও তো আছে। নাবিলাকে নিয়ে এইসব বাজে কুৎসা শুনলে ও কি ভাববে? যাদের নিয়ে এসব বলা হচ্ছে, তারাই বা কি ভাববে?
রায়হানের কথায় যেই চাপা ধমক ছিল তাতে কামিনী আর কোনো উত্তর দিল না। শুধু চোখ ফিরিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসল। মনে মনে গজগজ করলেও এইমুহূর্তে কিছু বললে অবস্থাটা আরও খারাপ হবে, সেটা ভালো করেই বোঝে। ভেতরে ভেতরে জ্বলছে, কিন্তু বলার সুযোগ নেই।
কামিনী একলা ঘরে বসে আছে। হাতের আঙুলগুলো চেপে চেপে রাগ সামলাচ্ছে। আগুনে জ্বলছে সারা শরীরে। ভাবছে, “সবাই আমাকে দোষারোপ করছে। কিন্তু মানুষ দোষ চাপায় কখন? যখন সত্যিটা ঢাকতে চায়। তাহলে তো আমার সন্দেহই সঠিক।” নিজের কথাই নিজেকে বুঝিয়ে চলল কামিনী। “আমার চোখ ভুল দেখে না। আমি জানি, কোথাও না কোথাও আগুন আছে বলেই এত ধোঁয়া উঠছে। আর এই বাড়ির সবাই সেই আগুন ঢাকতেই এখন আমার গলা টিপে ধরছে।”
চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, “আজ আমি খারাপ, আমি দোষী। কিন্তু কাল যখন সত্যিটা বের হবে, তখন সবাই বুঝবে কে আসল আর কে নকল।”
হঠাৎই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ফোন হাতে নিয়ে সামিরের নাম্বারে ডায়াল করল। সামিরের সাথে ফোনে কথা হয় না অনেক বছর। সামির এড়িয়ে গেছে প্রতিবার তবে এইবার সুযোগ নেই, সিমটা নতুন। সামির ফোন রিসিভ করল। কামিনী নিজের পরিচয় দিল। সামির চুপ। সেই নীরবতার কারণেই কামিনী সাহস পেল আরও এগোবার। তারপর ও কথাগুলো একসাথে ঝেড়ে দিল। মিথ্যেমিশ্রিত সত্যি গিলিয়ে দিল খুব চতুরভাবে। কিন্তু ওপাশ থেকে সামির নিরব। কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। এতে কামিনী খানিকটা অস্থির হলেও নিজেকে সামলালো। আরও কিছু বলল, আবারো রঙ চড়াল ঘটনার ওপর। একসময় ওপাশ থেকে একঘেয়ে স্বরে শুধু একটা শব্দ ভেসে এল,
— “হুম… দেখছি।”
এরপর টুট… টুট… লাইন কেটে গেল। কামিনী কিছুক্ষণ ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি ফুটল। সামির যখন বলছে ‘দেখছি’, তখন কিছু না কিছু করবে। মানুষটা নীরব, আর এই নীরবতাই সবচেয়ে বড় ঝড়ের পূর্বাভাস।
.
দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে। বন্ধুরা সবাই নিয়মিত আসছে, কিন্তু নাবিলার মনই বসছে না এত্ত সিরিয়াস পরিবেশে। ভার্সিটি মানেই একসময় মনে করেছিল, স্বাধীনতার জায়গা, একটা সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে একটাই বই পড়া, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে ক্যান্টিনে আড্ডা মারা, লাইব্রেরিতে গিয়ে গল্পগুজব করা, কিংবা কখনো শুধু ক্যাম্পাসের গাছতলায় বসে গল্প শোনা।
আজ অবশ্য অনেকদিনের আলসেমি ভেঙে ক্লাসে হাজির হলো। বিশাল হলঘরে মাইক্রোফোন হাতে স্যার কীসব থিওরি বুঝিয়ে যাচ্ছেন। নাবিলা ব্যাগ থেকে খাতা বের করলেও, চোখটা বারবার জানালার দিকে চলে যাচ্ছিল। বাইরের রোদে ঝলমল, পাশ থেকে বান্ধবীদের হাসাহাসি ভেসে আসছে।
আগে যখন সামির ছিল তখন ইচ্ছে না থাকলেও প্রায় ক্লাস করতে হত। এখন সামির নেই, ফাঁকি দেওয়াই যায়। যেই না কথাটা বলতে যাবে ওমনি পাশের বান্ধবী খোঁচা দিয়ে বলল,
— “খাতা-কলমে কিসের আঁকিবুঁকি করছিস? থিওরি লিখছিস, নাকি কারো নাম?”
নাবিলা মুখ গম্ভীর করে বলল,
— “লিখছি, প্রেমের ইতিহাস।”
— “তাহলে তুই নিজের প্রেমের কেসটা সিলেবাসে ঢুকাইতেছিস! আমাদেরই এখনও পুরোপুরি কিছু বলিস নাই আর জাতিকে জানানোর ইচ্ছে?”
নাবিলা ভুরু কুঁচকে জবাব দিল,
— “চুপ কর। স্যার শুনে ফেললে আমাকেই সিলেবাস থেকে বাদ দিবে।”
— “এতদূর থেকে স্যারের শোনার কথা না। শুনলে বলব, প্রেমের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছি স্যার। আপনি চাইলে অংশ নিতে পারেন। আমরা আপনার প্রেমকাহিনীও শুনতে ইচ্ছুক।”
নাবিলা হেসে উঠল,
— “ক্লাস বোরিং লাগতেছে। চল, কোথাও যাই।”
— “ওকে। স্যার বের হোক, পিছু পিছু আমরাও দৌড়াব।”
ঠিক তখনই স্যার হঠাৎই ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “ওখানে এত হাসাহাসি কী হচ্ছে? কৌতুক শোনাচ্ছো নাকি?”
ওরা তৎক্ষণাৎ চুপ হয়ে গেল। কিন্তু দৃষ্টি রাখল ঘড়ির কাটায়। ওই ক্লাস শেষে ওরা লাইব্রেরীতে গেল। বান্ধবীরা নিজেদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে গল্প করছে।
একজন বলছে, “আমার বয়ফ্রেন্ড এত ভালো গান গায়! এমন রোমান্টিক লাগে, শুনলে মনে প্রেম এসে যায়।”
আরেকজন হেসে যোগ করল, “আমার ও তো গতকাল সারারাত ফোনে কথা বলল। নিজেও ঘুমাল না, আমাকে ঘুমাতে দিল না। আজকে আমার চোখদুটো দেখ…”
হাসাহাসি, খুনসুটি চলছিল। একেকজনের ভালোবাসার গল্প প্রতিযোগিতার মাঠে নামছে। শুধু নাবিলা নীরব। মনোযোগ দিয়ে সব শোনে, ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে সঙ্গ দেয় কিন্তু নিজের কথা একবারও বলে না। ওর বুকের ভেতর গোপন ভাণ্ডার আছে, সেখানে তালা ঝুলানো। কারণ সামিরের কথা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায় না। সামির ওর কাছে শুধু ভালোবাসার মানুষ না, বরং একান্ত নিজের। ওর প্রতিটি স্বভাব, ছোট ছোট অভিমান, নীরব ভালোবাসা; সবই নাবিলার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই সম্পদ দেখানোর নয়, রক্ষা করার। অন্যদের প্রেম নিয়ে হাসাহাসি করলেও ওর হৃদয়ের গভীরে নীরব গর্ব বাজতে থাকে, “তোমরা যাদের কথা বলছ, তারা হয়তো আসবে যাবে। কিন্তু আমার সামির? ও তো আমার নিজের জন্যই তৈরি।”
কলেজ থেকে ফিরে নাবিলা ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে বসার ঘর পার হচ্ছিল। তখনই কানে এল, মামণি আর বড়মার চাপা গলায় কথাবার্তা। দু’জনেই কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাতে নাবিলা নিজের নামটা স্পষ্ট শুনতে পেল। ও পা থামাল, কৌতূহলী চোখে তাকাল ওদের দিকে। দু’জনেই নাবিলাকে দেখে মুহূর্তেই চুপ হয়ে হাসলেন। অপ্রস্তুত হয়ে নাবিলা নিজেও হাসলো। তারপর কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলো। একটু এগোতেই তাদের ভয়াবহ কথোপকথন ওর কানে এলো। নাবিলা অবাক! তখনই বুঝতে পারল, এইজন্যই সেদিন কামিনী ওর বয়সের নিয়ে বাজে কথা বলছিল। ইশশশ! ও একটুও বুঝতে পারেনি, নাহলে মুখের উপর জবাব দিয়ে দিত।
বড়মা যা বললেন তার মূলভাব হচ্ছে, কামিনী যেটা সন্দেহ করেছিল সেটা সামিরকেও জানিয়েছে। সামির তখন রায়হানকে ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করেছে, তার বউয়ের হঠাৎ এই সন্দেহের কারণ কি? এই কথায় রায়হান ভীষণ লজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। ঘটনা ওদের বাড়িতে মোটামুটি সবাই জানে, শুধু সরফরাজ হোসেন বাদে। অন্বেষা শোনার পর সরাসরি নাবিলার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ইয়াসমিন বারণ করেছিলেন। নাবিলাকে তিনি এখনই বিষয়টা জানাতে চান না। ও বাচ্চা মেয়ে, মন খারাপ করবে।
নাবিলার মন খারাপ ঠিকই হলো তবে এই পরিস্থিতিতে একেবারে চুপ করে থাকা যায় না। অন্ততপক্ষে নিজের দিকটা পরিষ্কার করে সবাইকে বলা উচিত।
নাবিলা অবশেষে সব সত্যিটা বলল। শান্ত কণ্ঠে কিন্তু স্পষ্টভাবে জানাল, আয়ান ভাইয়ার সাথে একজনের প্রেম চলছে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই ওরা দীর্ঘদিন ধরে একপ্রকার মজা করেই বিয়ের পরিকল্পনা করছিল। সেটা নিয়েই হয়তো কামিনীর মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। নাবিলার কথা শুনে ছেলের বউয়ের এহেন কর্মকান্ডে ইয়াসমিন লজ্জিত হলেন। ক্ষমাও চাইলেন। নাবিলা তৎক্ষণাৎ বলল,
— “ছিঃ বড়মা, আপনি কীভাবে এমন কথা ভাবলেন? অন্যায় যে করেছে, সে ক্ষমা চাইবে। লজ্জা পাওয়া উনার প্রাপ্য, আপনার না। আপনি কেনো নিজেকে দোষী মনে করবেন?”
তারপর নাবিলা ভাবল সামিরের কথা। ঘটনাটা তো তার কানেও পৌঁছে গেছে। স্বভাবতই তার কথা বলার ছিল, কিছু জিজ্ঞেস করা, ভালো-মন্দ বোঝা, খোঁজ নেওয়া। কিন্তু ও চুপ। কেন? নাবিলা নিজেই ওর দ্বিধা স্পষ্ট করে একটা মেসেজ পাঠাল,
— “কেন চুপ আছেন? সব ঠিক আছে তো? আমি শুধু জানতে চাইছিলাম, আপনার কাছে আমি ঠিকমতো নিজেকে বোঝাচ্ছি কি না। আর হ্যাঁ… আজকের চুপ থাকার মানে কিন্তু শুধু শুধু আমাকে কৌতূহলী করে তোলা।”
সামিরের চুপ থাকাটা নাবিলা মানতে পারছিল না। কামিনীকে কিছু বলার না থাকলে নাবিলাকেই বলুক, তাও বলুক! রাগ করুক, কথা শোনাক বা ঝগড়া করুক কিন্তু এভাবে নির্লিপ্ত কেন থাকবে? সামিরের রিপ্লাই এলো অনেকক্ষণ পর,
— “আমি আশাই করতে পারিনি এমন কথা কোনদিন আমায় শুনতে হবে। আর শোনালও এমন একজন মানুষ! ঘটনাটা আমার কানে এসেছে গতকাল। আর তোমার কৌতূহল আজ হচ্ছে? কেনো? সারাদিন কোথায় ছিল তোমার কৌতূহল? রাগ তো আমার তোমার উপর করা উচিত, আর করেছিও। অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। মানুষের সাথে বেশি মিশলে মানুষ সস্তা মনে করে, সহজলভ্য ভাবে। নূন্যতম বুদ্ধি-বিবেক বেঁচে থাকলে ওই কাল নাগিনী থেকে দূরে থাকো।
পুনশ্চ: ডোন্ট মেসেজ মি রাইট নাউ!”
সেই সারারাত আর নাবিলার ঘুম এলো না। বুকের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলতে লাগল। সারারাত মোবাইলে হাতে ধরে বসে রইল।
.
.
.
চলবে…..
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৬]
~আফিয়া আফরিন
সামিরের দুইটা দিন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো কেটেছে। ভোর থেকে রাত কাগজ, নোটস, চার্ট আর কয়েকটা এসাইনমেন্টের ভিড়ে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। গুরুত্বপূর্ণ এসাইনমেন্ট তাই এড়িয়েও যেতে পারছিল না। এরই মধ্যে কামিনী ফোন দিল, নাবিলাকে দিয়ে উল্টাপাল্টা সব কথা বলল।
সামির শুনে অবাক হয়নি, বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু ওকে কিছু বলার ইচ্ছেই হলো না। মনে হলো, অযথা সময় নষ্ট। বাজে কথার উত্তর দিলে কথাটা আরও বাজে হবে। চুপ থাকাই ভালো। তবে তার রাগটা সত্যি। কেন থামালো না নাবিলা ওকে? কেন তার কান অব্দি এতগুলো কথা পৌঁছাতে দিল? যেদিনই কথাটা শুনেছিল, সেদিনই কামিনীকে চুপ করিয়ে দিতে পারতো তো! রাগ আর নিজের কাজের চাপের এতটাই প্রবল ছিল যে নাবিলাকে তৎক্ষণাৎ মেসেজ করতেই মানা করে দিয়েছে। ভালো করেই জানত, এমন নিষ্ঠুর কথায় মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। তবুও… মাথার ভেতর তখন শুধু ডেডলাইন আর দায়িত্ব ঘুরছিল।
সামিরের চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ল্যাপটপের আলোতে তার ক্লান্ত চোখ আধশোয়া। স্ক্রিনে বাংলাদেশের সময়টা একবার দেখে নিল, ভোরের আলো ফোটার আগের মুহূর্ত। দ্বিধা নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিল, নাম্বার ডায়াল করল। ভেবেছিল, হয়তো নাবিলা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু ওপাশ থেকে সাথে সাথেই কল রিসিভ হলো। সামির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “এখনো জেগে আছো? পাঁচটা বাজে, একটু পর আজান হবে।”
নাবিলা একমুহূর্ত থমকে গেল। ওর চোখের ক্লান্তি মিলিয়ে গেল এই একটুখানি সুরে। মনে হলো, রাতভর না ঘুমিয়ে বসে থাকার একমাত্র কারণ খুঁজে পেল সে। ও গলা ভারী করে বলল,
— “হ্যাঁ, জেগে আছি।”
— “ভাবছিলাম তুমি তো ঘুমিয়ে পড়বে… ফোনে পাওয়াই যাবে না।”
নাবিলা নিঃশ্বাস ফেলল ধীরে। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,
— “ঘুম আসছিল না। বুকের ভেতর কেমন জানি লাগছিল। মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে ডাকছে।”
সামির হেসে ফেলল আচমকা,
— “এত রাতে ঘুম বাদ দিয়ে তোমায় ডাকাডাকি কে করছে?”
— “কী জানি? আপনি আমার উপর রাগ করে আছেন, তাইনা?”
— “রাগ করা কি উচিত নয়?”
— “কেনো উচিত? দুটো কারণ দেখান।”
— “কেনো উচিত না, তার দুটো কারণ তুমি দেখাও।”
নাবিলা না-বোধক মাথা নেড়ে জবাব দিল,
— “লেডিস ফার্স্ট।”
— “ওইজন্যই তো বললাম, তুমি আগে কারণ দেখাও।”
— “জিজ্ঞেস আমি আগে করেছি।”
সামির কিছুক্ষণ চুপ থেকে গভীর শ্বাস নিল। তারপর ধীর গলায় বলল,
— “শোনো, কামিনীর মতো মানুষ যা খুশি তা বলতেই পারে। কিন্তু আমার কানে সেটা আসবে কেনো? তুমি যদি প্রথমেই থামিয়ে দিতে, যদি শক্ত হয়ে কিছু কথা বলতে পারতে তাহলে বিষয়টা এতদূর গড়াতো না। মানুষের মুখ বন্ধ করা না গেলে, তাদের কথা ছড়িয়ে যায়। আর আমি একেবারেই চাই না, তোমাকে নিয়ে কেউ ঘৃণ্য গল্প বানাক। কিছু সম্পর্ক যতটা পবিত্র, ততটাই ভঙ্গুরও। একচিলতে সন্দেহই সব ভেঙে দিতে পারে।”
নাবিলা নিশ্চুপ। সামিরের কথা শুনে মনটা হালকা হলো। ভেবেছিল, তার রাগের উৎস নাবিলা নিজেই। কিন্তু না… সামির থেমে আবার বলল,
— “কামিনীর কথা আমি পাত্তা দিই না। কিন্তু রাগ হয়েছে এই ভেবে, নাবিলা কেন ওকে থামালো না? কেন নিজের হয়ে একটা কঠিন শব্দও উচ্চারণ করল না?”
নাবিলা একটু ঝিমিয়ে গলাটা নামিয়ে বলল,
— “আমি আসলে জানতাম না।”
— “বুঝেছি। তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। আশা করি ইতোমধ্যে সব ঠিকঠাক।”
নাবিলা দ্রুত বলল,
— “হ্যাঁ।”
— “এরপর আর সুযোগ দিও না। আসলে আমার তোমাকে আরো আগেই সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল।”
— “বাদ দিন। ও আপনাকে তো ফোন করেছিল। কথা বলেছেন?”
ওর কণ্ঠে কেমন পোড়া পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সামান্য হিংসে, সামান্য অভিমান। সামির ফোনের ওপাশে শব্দ করেই হেসে উঠল।
— “ফোন দিলে কথা বলবো না নাকি?”
— “বলবেন কেনো?”
— “হিংসে হয়?”
— “একটু একটু…” নাবিলার স্বীকারোক্তি খুব নিচু স্বরে, প্রায় নিঃশ্বাসের মতো।
সামির গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “কেনো হবে? তুমি আর ও কি এক? তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক, তার মাপজোখ কি কারো সাথে হয়?”
নাবিলা হালকা গলায় বলল,
— “আচ্ছা আপনি আমায় বিশ্বাস করেন? যদি আপনি কোনোদিন ভুল বোঝেন কিংবা আপনার মনে আমার ব্যাপারে সন্দেহ জন্মায়?”
সামির হাসল,
— “সন্দেহ? ভেতরের মানুষের ব্যাপারে এত খচখচানি থাকতে নেই, নাবিলা। বাইরে কে কী বলল, তাতে কি আসে যায়? আমার কান শোনে বটে, কিন্তু মন বিশ্বাস করে তোমাকেই।”
— “আমার প্রতি বিশ্বাসটা কিভাবে এলো? বিশ্বাস জোগানোর মতো কোনদিন কিছু করি নাই তো।”
— “বিশ্বাস কোনোদিন প্রমাণ দিয়ে তৈরি হয় না। বিশ্বাস তৈরি হয় অনুভব দিয়ে। তুমি হয়তো আলাদা করে কিছু করোনি, কিন্তু তোমার চোখ, তোমার কথাবার্তা, তোমার নিঃশব্দ অপেক্ষা সবটাই আমার ভেতরে বিশ্বাসের বীজ বুনেছে।”
নাবিলা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
— “কথাগুলো বিশ্বাস করি… কিন্তু তবুও কেমন জানি ভয় পাই।”
— “ভয় কীসের?”
— “সময়ের! দিনশেষে আমার জন্য আপনার সময়ই বা কতটুকু থাকে?”
সামির খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে ধীরস্বরে বলল,
— “সময় তো আমি দিই না, সময় নিজে থেকেই তোমার কাছে আসে। দেখো, রাত গভীর হলেও আমি এখনো তোমার সাথে… আর তুমিও আমার জন্যই জেগে আছো।”
সামিরের কথাটা শুনে নাবিলা নিঃশব্দে থমকে গেল। কথাটা কানে ঘণ্টার মতো বাজতে থাকল। সত্যিই তো, সামির যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, শেষমেশ সবকিছুর ভেতরেই সে নাবিলাকে জায়গা দেয়। আজ এমন একটা সময়ে, যখন প্রকৃতিও ঘুমিয়ে; তখন দুজন একে অপরের জন্য জেগে রয়েছে, এটা কি ভালোবাসা নয়? এরইমধ্যে সামির পুনরায় গলা নরম করল,
— “সরি।”
নাবিলার ভ্রু কুঁচকে গেল। অবাক সুরে বলল,
— “কেনো?”
— “তখন ওইভাবে কথা বলেছিলাম বলে। কষ্ট পেয়েছ? কষ্ট দেওয়ার জন্যই বলেছি। এখন মাফ করেছ? কানে ধরব?”
নাবিলা আরেক দফা অবাক হলো। ওর মনে একটা কথাই ঘুরতে লাগল, “আমি কীভাবে না ভালোবাসি এই মানুষটাকে? যে আমার জন্য সময়কে পর্যন্ত থামিয়ে নিজে দোষী না হয়েও দোষ স্বীকার করতে পারে…”
.
পরদিন সকালে সামির ফোন করল কামিনীকে। কখনও যে ওকে নিজ ইচ্ছায় ফোন করতে হবে, তা কল্পনাও করে নাই। নাবিলাকে যা বলার বলে দিয়েছে কিন্তু ও সেটা কতটুকু মনে রাখতে পারবে তা সামির জানেনা। তবে, কামিনীকে এইমুহূর্তে নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই সামির একদম সরাসরি বলল,
— “আমি অযথা কথা বলার মানুষ নই, তা আশা করি আপনার মনে আছে। তবে প্রয়োজন হলে চুপও থাকি না, এটাও জানেন। একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিই, আমার নিজস্বতাকে নিয়ে কটু কথা আমি সহ্য করব না। বউ আমার, সংসার আমার, দায়িত্বও আমার। এর ভেতরে অন্যকারও মন্তব্যের প্রয়োজন নেই। সহ্যের নির্দিষ্ট সীমা আছে। সেই সীমা কেউ ছাড়িয়ে গেলে ফলাফল ভয়ঙ্কর হয়। ভাইয়ের বউ হিসেবে আপনাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। তবে আপনি সেই সম্মানের বিনিময়ে আরেকজনের সম্মান নিয়ে খেলছেন? আপনার সমস্যা থাকলে সেটা সরাসরি নিজে সামলাবেন, নাবিলাকে নিয়ে পিছনে ফিসফাস করবেন না। একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে টানাটানি করা ভদ্রতা নয়, মানসম্মানের কাজ তো নয়ই। এতে আপনি নিজেই ছোট হচ্ছেন। প্রথমবার এবং শেষবার সতর্ক করলাম। ভবিষ্যতে এই ধরণের কিছু আমার কানে যেন না আসে। আমি এখনও চাচ্ছি, দুজনের মর্যাদাই অটুট থাকুক।”
সামিরের কণ্ঠ বেশ সংযত ছিল। কামিনী বাস্তবে ভড়কে গিয়েছিল। সবার কথা তাকে হজম করতে হচ্ছে। আশ্চর্য! তেতো গলায় বলল,
— “তুমি আমাকে বলছো অথচ নিজের বউয়ের দোষ দেখছো না?”
সামির বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
— “দোষ যে করেছে তারটা আমি দেখছি। আমার বউ কোনো দোষ করেনি। আর যদি করেও থাকে, তবে দায় সম্পূর্ণ আমার। আমার বউয়ের চাকরির জন্য আপনাকে আমি নিযুক্ত করি নাই। ও কাজের জন্য আমিই যথেষ্ট।”
কামিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
— “আজকাল তো দেখি খুব বউ-প্রেমিক হয়েছো!”
সামির একদম স্পষ্ট আর দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল,
— “ইয়েস, অফ কোর্স। আই লাভ হার। অ্যান্ড আই’ম নট অ্যাশেইমড টু সে ইট আউট লাউড। বিকজ শি’স দ্য অনলি ওয়ান আই’ল এভার লাভ।”
এই অসামান্য কথা কামিনীর অন্তরাত্মা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর ক্রোধে ফেটে পড়ে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল সোফার উপর। দাঁত চেপে বিড়বিড় করল। সে আসলে হারা খেলায় চাল দিয়েছিল এবং হারা খেলায় আবারো হেরে বসে আছে…
এরপর কয়েকদিনের দিনগুলো ঝরনা-ধারার মতো শান্তভাবে কেটে গেল। নাবিলার দিনগুলো ভালো কাটছে, হৃদয়টা হালকা, মনটা প্রশান্ত। প্রতিটি মুহূর্তে সামিরের কথা ছড়িয়ে আছে; তার নীরব হাসি, অল্প কথায় বোঝার সক্ষমতা, এমনকি তার ক্ষুদ্র অভিমানও নাবিলার কাছে রূপকথার মতো বিশেষ হয়ে উঠেছে। ছলে বলে, কৌশলে নাবিলা সামিরের মনের অনুভূতি বুঝে নিয়েছে; সে কখন খুশি, কখন চিন্তায়, কখন অবাক। প্রত্যেকটি মুহূর্তে ও নিজের জন্য সেই জ্ঞানকেই সংগ্রহ করছে, কোনো অমূল্য ধনের ন্যায়।
নাবিলা নিজের স্বামীহীন সংসারটা যত্নসহকারে গুছিয়ে রাখে। ঘরটা শুধু ওর থাকার জায়গা নয়, নিজের তৈরি একটি ছোট বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সকাল শুরু হয় জানালা ভেদ করে আসা রোদের সোনালী স্পর্শে, বিছানা ঠিক করা আর ঘরটা সাজানোর মধ্য দিয়ে। প্রতিটি কাজে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে। সামিরের শার্টের ভাঁজে ওর মন জড়িয়ে থাকে। তারপর শাশুড়ির সাথে টুকিটাকি কাজ থাকলে করে। মা-বাবার সাথে কথা, কাজিনদের সাথে কথাবার্তা সবই নিয়মমাফিক হচ্ছে; কোনোকিছুর হেরফের নেই। বিকেলে ছোট্ট ফুলের গাছগুলোয় পানি দেয়। ওইসময় মাঝে মাঝে ফোনে সামিরের মেসেজ আসে। নাবিলা লাজুক হাসি দিয়ে ফোন ধরে রাখে, মনে মনে সামিরের উপস্থিতি অনুভব করে। রাতের নিস্তব্ধতায় ও বসে নিজের প্রিয় কোণে। ঘরের বাতি জ্বলে, ধীরে ধীরে ঘরে অমোঘ শান্তি আসে। দিনের সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে, ছোটখাটো সুখ, চিন্তা, ভালোবাসা; সবমিলিয়ে নিজের জন্য শান্ত, পরিপূর্ণ সংসার তৈরি করে। তখন একা থাকা সংসারও ভরা, জীবন্ত, হৃদয়ময় হয়ে ওঠে।
ওইদিকে পৃথিবীর অন্য একটি প্রান্তে সামির ইয়াসিরের দিনকাল কাটছে স্মৃতিবিজড়িত ভাবে। ওই স্মৃতি হাতে ছোঁয়া যায় না… সকালে তার উঠে প্রথম কাজ তার ল্যাপটপ খুলে ইমেল চেক করা। নাস্তা করতে করতে মন মাঝেমাঝে নাবিলার দিকে ভেসে যায়। কেমন আছে, ক্লাসে গেছে কিনা, পড়াশোনা করছে তো ঠিকমত, এখন কি করছে, ছোট ছোট প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। নাবিলা তাকে চিন্তা করছে, একথা ভাবলেই আনন্দ লাগে।
দুপুরে ক্লাসের পর বিরতিতে ওদের পুরোনো মেসেজগুলো চেক করে, নতুন মেসেজ জমা হলে তার রিপ্লাই করে; এগুলোই এখন প্রতিদিনের অভ্যাস। বিকালের দিকে অর্জুন আর চেনের সাথে কফিশপ বা লাইব্রেরিতে দেখা করে, আড্ডা দেয়। প্রতিদিনের তালিকায় সবাইকে রেখেছে…
মাঝে মাঝে সামির নিজেকে ইচ্ছেকৃত কিছু সময় নষ্ট করতে দেয়। এই সময়গুলো যেমন অব্যর্থ আনন্দের খনি, তেমনই তার নিজের চিন্তাভাবনার এক ধ্যানমগ্ন অঙ্গ। সবকিছু থেকে দূরে, শুধু নিজেকে খুঁজে পাওয়ার নিঃশব্দ আনন্দ। রাত গভীর হলে সে নিজের কাজ শেষ করে। ঘরটা তখন শান্ত, কিন্তু মনে একধরনের উত্তেজনা থাকে নাবিলার জন্য। সামির জানে, দূরে থাকা মানে শারীরিক উপস্থিতি না থাকা কিন্তু মনমোলায়েকভাবে সে নাবিলাকে কাছে রাখে। নিদ্রার আগে, বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে বা নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে দিনটা শেষ করে; একটি শান্ত, সুশৃঙ্খল, নাবিলাময় দিন।
.
এই সুন্দর সুখময় দিনগুলোতে হঠাৎ করে একটা কঠিন সংবাদ এসে হুমড়ি খেল। পড়শীর বিয়ে হয়ে গেছে, ওর মায়ের পছন্দ করা একজন সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। খবরটা নাবিলা প্রথমে মামণির মুখ থেকে পেল। মামণি নিজেই হাসতে হাসতে সব বললেন, যেন এরচেয়ে খুশির খবর দুনিয়ায় দ্বিতীয়টা নেই। পড়শী মেয়েটাকে তো চেনেন; সাদাসিধে, বিনয়ী আর বড্ড ভালো মেয়ে। তিনি তো আর এটা জানতেন না এই বড্ড ভালো মেয়েকে তার ভাস্তে বড্ড ভালোবাসে। জানলে হয়তো এত খুশি হতেন না।
পড়শীর মধ্যেকার বিষাদ, নীরব হতাশা নাবিলাকে আনমনে নাড়া দিয়ে গেল। এই সংবাদ নাবিলার কাছে শুধু সাধারণ খবর নয়; বরং স্মরণ করিয়ে দিল; ভালোবাসা সবসময় নিজের মতো হয় না, কেউ কখনো পরিকল্পনা করে তা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। জীবনে সুখ-দুঃখেরও একটা সংবেদন থাকে।
নাবিলা দ্রুত ফোন করল অন্বেষাকে। ঘটনার বিস্তারিত জানতে হবে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “পড়শী আপু রাজি হলো?”
— “উঁহু,” অন্বেষা বলল, “এতদিন ওর মা পাত্র দেখছিল, ওকেও পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হচ্ছিল। কিন্তু কাল হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে গেল। পড়শী ভাইয়ার কথা বাসায় বলেছিল, তখন ওর মা ওকে থাপড়ে ফোন নিয়ে নেয়। ও বেচারী আর কি করতে পারে? বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে।”
নাবিলা খানিকটা শোকাভিভূত,
— “শশুরবাড়ি চলে গেছে?”
— “হুম, আজ সকালেই।”
— “আমাদের ভুলে হয়ে গেল না তো? আগেই বাসায় জানানো উচিত ছিল।”
— “সেটা তো পড়শী মানা করেছে বলে। নাহয় আমাদের তরফ থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। ও বলেছিল, সিরিয়াস বিয়ের কথাবার্তা চললে তখন ব্যবস্থা নিবে।”
নাবিলা গভীর নিঃশ্বাস নিল,
— “নিজেও বোধহয় বুঝতে পারেনি, এইভাবে হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু ওর মায়ের এটা করা উচিত হয়নি। আর ভাইয়ার কি খবর?”
— “কী জানি! ফোন বন্ধ। কথা হয়েছিল আরো আগে, কিন্তু এই বিষয়ে কিছু বলেনি। মাকে ফোন দিয়ে শুনলাম, ভাইয়া বাড়িতেও নেই। একটু টেনশন হচ্ছে আমার।”
নাবিলা একহাত মাথায় ভর করে মনে মনে ভাবল, জীবন কত দ্রুত কখনো কখনো সবকিছু বদলে দেয়। আনন্দ আর দুঃখ, আশ্চর্য ও হতাশা একসাথে নাড়া দিয়ে গেল। এই ক্ষুদ্র ঘটনাটা জানিয়ে দিল, মানুষ কখনোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
তারপর সামিরকে ফোন দিয়ে সব বলল। সামির সবে ক্লাস শেষ করে বের হয়েছিল। এই সময় সচরাচর নাবিলা ফোন করে না, একটা নির্দিষ্ট রুটিন আছে ওর ফোনকল অথবা মেসেজের। আজ তাই অসময়ে ফোন পেয়ে চমকে উঠেছে। ওর মুখ থেকে সব শোনার পর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
— “যেটা হওয়ার, সেটা হয়েছে। এত মন খারাপ করার কি আছে?”
নাবিলা আহত ভঙ্গিতে বলল,
— “আপনার কাছে সবটা এত সহজ মনে হচ্ছে?”
— “সহজ করে ভাবলে সব সহজ।”
নাবিলা থমকানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “আয়ান ভাইয়ার জন্য আপনার খারাপ লাগছে না?”
— “আমার ভাই যথেষ্ট স্ট্রং। এত সহজে সেন্টি খাবে না, চিন্তা করো না।”
নাবিলার কণ্ঠ ক্ষুদ্ধ হলো,
— “ধুরু। সবাইকে কি নিজের মতো ভাবেন? অনুভূতিহীন আর হৃদয়হীন!”
— “আমি মোটেও হৃদয়হীন নই নাবিলা। আমার হৃদয় আছে, আর সেটা নির্দিষ্ট একটা সময়ে একজনের জন্য ঠিকই ধুকপুক করে।”
নাবিলা শুনল, মনে হলো সামির নির্ভেজাল সত্যি বলছে। তবুও তার কণ্ঠে অভিযোগের লহর রয়েই গেল,
— “তবে এমন নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছেন কেনো?”
— “আমি নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছি না, নাবিলা। সত্য কথা বলছি। জীবন মাঝেসাঝে আমাদের প্রত্যাশার বাইরে কিছু মুহূর্ত নিয়ে আসে। পড়শীর এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তোমাদের কি এখানে কিছু করার আছে? তোমরা কি এখন ওর হাজবেন্ডের সাথে ডিভোর্স করাতে পারবে? যাও, যদি পারো করাও। তবে সেটা সম্ভব হতো, তাহলে দুনিয়া এত সুন্দর হতো না আর সম্পর্কও এত শান্তির হতো না। সব প্রেম বাস্তবায়ন হওয়া হয়ত ভালোকিছুর লক্ষণ নয়। যা বাস্তব, তা মেনে নাও।”
নাবিলা কিছুটা হতবাক, সামিরের কথায় মনে হলো বাস্তবের কঠোর সত্য ওকে সপাটে চড় মেরেছে। সামির আরও বলল,
— “আয়ানের কপালে যদি পড়শী থাকতো, ঠিকই দুজন দুজনকে পেত। এইমুহূর্তে যদি কপালে না থাকে ঘি, তবে ঠকঠকিয়ে হবে কি?”
সামিরের কথার যুক্তির কাছে নাবিলা কিছুই বলার মত খুঁজে পেল না। কিন্তু এরপর ও আয়ানের চোখেমুখে গভীর হতাশা এবং দুঃখের ছায়া দেখেছে। আসলে যে যাকে হারিয়েছে, শুধু সে জানে সেই ক্ষতি কতটা গভীর!
আরও কয়েকমাস পেরিয়ে গেল। এক বসন্ত পেরিয়ে আরেক শরৎ এল। বাড়ির সবাই এখন পড়শী এবং আয়ানের না হওয়া সম্পর্কের কথা জানে। ইয়াসমিন নানা উপায়ে চেষ্টা করছেন, ছেলেকে বিয়ে দিতে। কিন্তু আয়ান স্থিরচিত্তে, নির্দ্বিধায় এবং অবিচল কণ্ঠে ঘোষণা করে দিল,
— “আমি আর কোনোদিন বিয়ে করবো না।”
বাড়িতে শোকের শান্ত ছায়া নেমে আসে, যেখানে সবাই জানে কিছু ক্ষত আছে যা আর সারানো যায় না। আর আয়ানের অমোঘ অঙ্গীকার সেই ক্ষতর সামনে এক নির্ভীক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাবিলা অন্বেষার কাছ থেকে এসব খবর পায়। পারতপক্ষে ওই বাড়িতে যায় না। ওর হৃদয়ে একটা অদৃশ্য বাঁধা আছে। অন্বেষা কিংবা ইয়াসমিন কেউও সরাসরি ওকে যেতে বলার সাহস দেখায় না। এমনিতেই নাবিলার কাছে তাদের মুখ ছোট হয়েছে, আর পরিস্থিতি জটিল করে লাভ নেই। নাবিলা চুপচাপ সব ঘটনা ছাপিয়ে যায়। কামিনীর সাথে আর কথা হয় নাই। অন্বেষার সাথে যদি খুব প্রয়োজনে দেখা করতে ইচ্ছে হয় তাহলে হয় অন্বেষা চলে আসে নয়তো ও নিজেই গলির মোড়ে গিয়ে দেখা করে। আজও অন্বেষার সাথে দেখা করে ফিরছিল। বাড়িতে ঢুকে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দেখলো মামণি কারো সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। নাবিলা খেয়াল না করেই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তেই বুঝল ওপাশের ব্যক্তিটি সামির, ও তৎক্ষণাৎ সরে গেল। ঠিকমতো তাকাতেও পারল না; সামিরের চোখে ধরা পড়ল শুধু নাবিলার ওড়নার প্রান্তদেশ আর ঘন কালো চুল।
সামির স্পষ্ট বুঝতে পারল, নাবিলার নিজেকে সরিয়ে নেয়ার কারণ। অভিমান এখনও আছে। কিন্তু নাবিলা কেনো বুঝতে পারছে না, সেই অনির্বচনীয় বোঝাপড়ার জটিলতা। এই না বোঝার চক্করে তারা এক বছরের বেশি সময় কাটিয়ে দিল একে অপরকে না দেখেই…
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]