প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
15

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৪০]
~আফিয়া আফরিন

সন্ধ্যা নামার পর পড়শী বারান্দায় বসেছিল। সারাদিন পর মাত্র নিজের জন্য একটু ফুসরত পেয়েছে। আজ সারাটা দিন আয়ানের কথা মনে পড়েছে। কতদিন হলো কথা হয়না! ফোনটা হাতে নিয়েছিল, নাম্বারও ডায়াল করেছে কয়েকবার কিন্তু পরক্ষণেই আঙুলগুলো স্ক্রিনে থেমে গেল। কল বাটনে চাপতে পারল না। সাহসের অভাব? নাকি ভয়? বুঝতে পারছিল না।
মনে মনে প্রশ্ন এল, আজকের এই দিনটায় আয়ানও কি ওকে মনে করছে? আয়ানও কি কোথাও বসে একবার হলেও পড়শীর কথা ভেবেছে?
পড়শী আকাশের দিকে তাকাল। জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক ঝলমল করছে, অথচ নিজের মনটা কেমন নিভে আছে। বুক থেকে ভেসে এলো দীর্ঘশ্বাস। আকাশটা এত সুন্দর, এত কাছে মনে হলেও আসলে কত দূরে। আয়ানের সাথে ওর নিজের দূরত্বটাও এরকম। যতই তাকায়, ছুঁতে যায়, ততই বোঝা যায় অসম্ভব। আলোটা আছে, সৌন্দর্যটা আছে, কিন্তু হাত বাড়ালেই ফাঁকা। হুট করে উপলব্ধি করল, এই আকাশই তাদের গল্পের প্রতিচ্ছবি। মিল নেই, তবুও অদ্ভুতভাবে বাঁধা।

অন্যদিকে, শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়েই হঠাৎ আয়ানের চোখে ভেসে উঠল পড়শীর সেই চেনা হাসি। গাড়ির শব্দ, মানুষের ভিড়; সব থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। আজকের দিনেই তো প্রথম তারা একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল প্রেমময় দৃষ্টিতে। কেমন স্বপ্নময়, কেমন আলো ঝলমলে ছিল সেই মুহূর্ত! মনে হলো, একটুকরো ক্ষতবিক্ষত ইতিহাস আজও অক্ষত অবস্থায় বুকের গহীনে বেঁচে আছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আয়ানকে ছিঁড়ে ফেলল, পড়শী কি সব ভুলে গেছে? সংসারের চাপে, স্বামীর স্পর্শে কি মুছে গেছে সেই দৃষ্টি, সেই ভালোবাসা? নাকি কোথাও একটুকরো ছাই হয়ে এখনও জ্বলছে?
সে হাঁটছিল, মনে হচ্ছিল পথই থেমে গেছে। শুধু স্মৃতি, আর সেই অব্যক্ত প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছিল।
.
দু’দিন কেটে গেল চোখের পলকে। আজ বিকাল নাগাদ ওদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা।
প্রতিবার বিদায়ের সময় নাবিলার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠত, অকারণ মনখারাপ গলার ভেতর দলা পাকিয়ে দিত। কিন্তু এইবার অন্যরকম। চোখেমুখে কোনো দুঃখ নেই। কেনই বা দুঃখ পাবে? এতদিন যাকে নিয়ে শূন্যতা, অপেক্ষা আর কষ্ট ছিল; সেই মানুষটা তো পুরোদস্তুর সামনে এসে হাজির হয়েছে। মা-বাবার থেকে বিদায় নিয়ে সামিরের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য পুরান ঢাকা, লালবাগ এলাকা।
বাসে উঠে সামিরের পাশে বসতেই নাবিলা কেমন গুটিয়ে গেল। সামির খেয়াল করে আরও গা ঘেঁষে বসল। নাবিলা বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই হেসে কানে ফিসফিস করে বলল,
— “এভাবে গুটিসুটি মেরে বসে আছো কেন? আমার পাশে বসতে কি লজ্জা লাগে?”

নাবিলা তাড়াতাড়ি পেছনের সিটে তাকাল। মামণি-বাবা এখানেই আছেন। তারপর নিচু স্বরে বলল,
— “লজ্জা নয়… কেউ দেখলে কি মনে করবে?”

সামির ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হাসল,
— “দেখুক না, তাতে কী! আমি বউকে পাশে পেয়ে একটু খুশি হলে অন্যায় হবে?”
— “চুপ। মামণি শুনে ফেলবে।”
— “তখন বলব, বউ ঘুমিয়ে পড়েছিল। আদর-সোহাগ করে ঘুম ভাঙ্গাচ্ছিলাম। এটা বড় অপরাধ নাকি?”
নাবিলা আর কিছু বলল না। মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। বাস তখন মোড় ঘুরিয়ে বড় রাস্তায় উঠছিল।ভেতরে হালকা দুলুনির মত হলো আর সামির ইচ্ছাকৃতভাবেই নাবিলার দিকে ঝুঁকে এলো। নাবিলা তো বুঝতেই পারছে কান্ডকারখানা।
— “কি হচ্ছে?” নিচু স্বরে প্রশ্ন করল নাবিলা।

সামির একদম নির্বিকার মুখে। মনে হচ্ছে, এ তো একদম স্বাভাবিক ব্যাপার। তার মুখটা ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারা মানুষের মত।
— “কি করলাম? বাস কাঁপছে, তাই ধরতে হয়েছে।”

নাবিলা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াল,
— “অসভ্যতামি করবে না, এখানে সবাই আছে।”

সামির নিস্পাপ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল,
— “তাহলে কী হলো? সবাই থাকলেই তো নিরাপদ। তাছাড়া, আমি তো তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি না কিংবা আমরা আগেরবারের মতো পালিয়েও যাচ্ছি না।”

নাবিলা কটমট চাহনি নিক্ষেপ করল। সামির আবার ফিসফিস করে বলল,
— “ওইভাবে তাকালে আমি ভয় পাই না বরং আরও কাছে আসতে ইচ্ছে করে।”
এইবার নাবিলা তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল। মামণি একবার তাকালেই বুঝে ফেলবে। অথচ ভিতরে ভিতরে, এই নির্বিকার খুনসুটি ওকে আরও অস্থির করে তুলছিল। তবে বিরক্ত গলায় বলল,
— “হাত ছাড়ো।”
— “এত সহজ? বললেই ছাড়ব? ধরে রাখতেই তো কতদিন অপেক্ষা করেছি।”
নাবিলা ভেবেছিল, সবার সামনে অন্তত সামির ভদ্রের খোলসে ঢুকে যাবে। শান্ত-শিষ্ট জামাই সাজার অভিনয় করবে। কিন্তু উল্টোটাই হলো।
গোটা রাস্তায় ভদ্রতার সংজ্ঞাই উল্টে দিল। কখনো গোপনে আঙুল দিয়ে ওর হাতের তালুতে অকারণ আঁকিবুঁকি কাটছিল। কখনো কোমড়ে হাত রেখে জড়িয়ে ধরেছিল, কখনো কাঁধে মাথা রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। কখনো নিঃশব্দে আঙুলে খোঁচা দিচ্ছিল, কখনো আবার কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে এমন সব কথা বলছিল যে নাবিলা লজ্জায় টমেটোর মতো লাল হয়ে যাচ্ছিল। পুরোটা রাস্তা সামির একটাই কাজে ব্যস্ত ছিল, নাবিলাকে জ্বালিয়ে খাক করে দেওয়া।
বাড়ির সামনে এসে সামির নাবিলাকে ঝুঁকে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
— “তুমি এত ভদ্রতা আশা করছ কেন? আমি কি পাশের বাসার ভাই যে লাজুক ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে থাকব?”

নাবিলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ভাবল, এবার ধমক দিয়ে আগের মত দমিয়ে দেবে। কিন্তু সামির তার আগেই গম্ভীর গলায় বলল,
— “এইভাবে তাকালে কিন্তু জনসম্মুখে টুক করে একটা চুমু খেয়ে ফেলব।”
ব্যস! নাবিলাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। ও মুখে একটাও কথা বলল না। চুপচাপ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সামির মুচকি হেসে পিছু নিল। ভেতরে ঢুকেই নাবিলা জ্বলে উঠল,
— “এই সব ন্যাকামি বাদ দাও তো।”

সামির বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। বরং সোজা, শান্ত অথচ দুষ্টুমিশ্রিত গলায় বলল,
— “ন্যাকামি না, এটাকে বলে ভালোবাসার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস।”
নাবিলা থমকে দাঁড়াল। সামির পাত্তা দিল না, উল্টো ওর গালে চুমু খেয়ে ঘুরে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। সোজা রওনা হলো বড় আব্বুর বাসায়। অনেকদিন পর বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রেখে পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ে গেল।
সামির বাসায় ঢুকতেই আয়ান আর রায়হান দু’জনেই এগিয়ে এলো। সামিরের উপস্থিতিতে পুরো ঘর আনন্দে ভরে উঠল। অনেকদিন পর তিন ভাই একসাথে হাসি-ঠাট্টার ঝুলি খুলে বসল। অন্বেষা ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম থেকে উঠেই চোখ বড় করে সামিরের দিকে তাকাল।
— “কিরে, তুই কোথা থেকে এলি? বউকে ছেড়ে আমাদের কথা অবশেষে মনে পড়ল! নাবিলা কোথায়? আমাকে ছাড়া গল্প করছিস কেনো?”
— “আসছে! শাহিদ ভাই তার বউরে শিক্ষা দিতে পারল না। ভালোমন্দের জিজ্ঞেস করার খবর নাই উল্টো কোমড় বেঁধে ঝগড়া করছে।”
— “এই আমায় স্বামীকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।” এরপর হাসিঠাট্টায় সময় কেটে গেল। রায়হান ওই প্রসঙ্গটা ফের তুলছিল। তবে পুরোপুরি কিছু বলার আগেই সামির চুপ করিয়ে দিল। আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে এই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বলল। আর এটা কোনো বিষয় হলো? সংসারে একসাথে থাকতে গেলে টুকটাক ঝামেলা হতেই থাকে। তারমধ্যে এরা হচ্ছে, জা… এরা ঝগড়া করবে না তো কারা করবে? সামিরের দিক থেকে নিশ্চিত হয়ে রায়হান শান্তি পেল। সামির যদিও এই কথাগুলো বলল, কিন্তু একদম মন থেকে বলে নাই। শুধুমাত্র বড় ভাইকে অপরাধবোধ থেকে বাঁচাতেই বলেছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কামিনীর সাথে দেখা হয় নাই। ইচ্ছে করেই সামনে আসে নাই… ভালো হয়েছে, ওরে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যাবে। না চাইতেও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টাপাল্টা কথাও বলে ফেলতে পারে।
রাতের নীরবতা ও মৃদু বাতাসে ছাদে আয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ বাদে সামির এসে পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখল। আয়ান এতক্ষণ প্রাণচাঞ্চল্য ছিল, তবে তার চোখে যে বিষণ্ণতার আভা, মুচকি হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যথা; সবই চোখে পড়ছিল সামিরের। অন্বেষা বারবার বলছিল,
— “বাড়ি যাচ্ছিস না কেন? তোর বউ অপেক্ষা করছে, যা।”
সামির জানে, নাবিলা অপেক্ষা করছে। করুক অপেক্ষা, আজ তো খুব দূরদূর করছিল, অসভ্য বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল; এখন করুক অপেক্ষা। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। যখন নিজে থেকে কাছে টানবে তখনই যাবে… হুহ, ওর জন্য সামির ইয়াসিরের হৃদয় প্রলুব্ধ হয়ে যাচ্ছে না।
রাত বারোটা নাগাদ, শহরের আলো মৃদু ঝলমল করে ছাদে ভেসে উঠছে। সামির আর আয়ান ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, চুপচাপ কথার মধ্যে ডুবে আছে। বাতাসে ঠান্ডা আঘাত।
— “মন খারাপ কেন তোর?”

আয়ান নীরবভাবে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকল। তারপর নিজস্ব কণ্ঠে বলল,
— “জানিসই তো।”

সামির ভুরু কুঁচকে কিছুটা বিরক্তি মিশিয়ে হেসে বলল,
— “ধুর শালা, অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। এখনও ভুলতে পারিস নাই?”
— “সম্ভব না।” আয়ানের কণ্ঠে হালকা হতাশা।
— “এইভাবেই থাকবি?” সামির ধীরে প্রশ্ন করল।
— “আছিই তো।” আয়ান খুঁজে পেল অল্পস্বল্প সাহস।

সামির সহজ ভঙ্গিতে বলল,
— “বড়মা তোর জন্য চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাড়ির সবাই তোকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। বুঝতে পারছিস না?”

আয়ান মাথা হেলাতে হেলাতে মৃদু আওয়াজে বলল,
— “আমাকেও কেউ বোঝার চেষ্টা করছে না। মা বিয়ের জন্য পারলে অনশন করে।”
— “সব জিনিসই সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যায়। যা চলে গেছে, সেটা কেবল অতীত। তার জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার দরকার নেই।”
— “মনে পড়ে যায় সবসময়। আমি চাইছিলাম সবকিছু অন্যভাবে হোক।” আয়ান মৃদু স্বরে বলল।

— “কিন্তু বাস্তব তো বদলানো যায় না। যেটা হয়েছে, সেটা হয়েছে। জীবনকে তো এগিয়ে নিতে হবে।” সামির হাতটা আয়ানের কাঁধে রাখল, সান্ত্বনার ছোঁয়া দিয়ে।

— “কেমন করে এগিয়ে নেওয়া যায়? কষ্ট তো এখনো রয়ে গেছে।”
— “ধীরে ধীরে। ছোট ছোট পদক্ষেপ। তুই তো একা না; আমি আছি, আমরা আছি। সবাই আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হবে, আর নিজের মনকে একটু শান্ত করতে হবে।”

আয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “আমি চেষ্টা করব।”
— “সেটাই যথেষ্ট। মনে রাখিস, কারো জন্য মনখারাপ করা মানে নিজের জীবনটা ক্ষয় করা।”
আয়ান হালকা চালে মাথা নাড়ল। তার মধ্যে বয়ে যাচ্ছে সমঝোতার নীরব সুর। রাতেই সামির বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। ঘরে ঢুকতেই দেখল নাবিলা বিছানার এককোণে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। অবিলম্বে হাতটা তার চুলের উপর বুলিয়ে দিল, তারপর ধীরে ভালোভাবে শুইয়ে দিল। নাবিলার গা সামান্য কেঁপে উঠল, কিন্তু ঘুমের অগোচরে টের পেল না। সামির নিজেও লাইট অফ করে নাবিলার পাশে শুয়ে পড়ল। জেটল্যাগের কারণে ঘুম আসছে না, তাই চোখ বন্ধ করার বদলে নাবিলার দিকে তাকিয়ে থাকল। আস্তে করে ওর গালে হাত রাখল। তার আঙুলের নরম স্পর্শ ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল চোখেমুখে, গালের রেখা অতিক্রম করে নাকের কাছে এসে মৃদু ছোঁয়া দিল। ওই কোমল স্পর্শে নাবিলা অজান্তেই সামিরের দিকে একটু এগিয়ে এল। সামির কপট হাসি হেসে চুমু খেল। মনে মনে কুটিল হেসে বলল, “অসভ্য বলো ঠিকই, কিন্তু ঘুমের ফায়দা নিব না। ঘুমের মধ্যে অসভ্যতামি করার মজা নেই। জেগে উঠো, সকালে আবার শুরু করব।”
তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করল। অনেক রাত পর্যন্ত এপাশ ওপাশ করল। ঘুম আসতে আসতে মোটামুটি ভোর হয়ে গেল।

আটটা নাগাদ নাবিলার ঘুম ভাঙল। এক চটকানো মুহূর্তে চোখ খুলতেই নিজের এক হাত সামিরের গায়ের উপর আবিষ্কার করল। তারমানে, ঘুমের মধ্যে ও সামিরকে জড়িয়ে ধরেছিল। উফফ… নাবিলা উঠে বসল। কাল রাতে কখন আসলো, টেরই পায়নি! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল, বুঝতে পারল না কখন ঘুমে হারিয়ে গিয়েছিল। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর, ও কাঁথাটা সামিরের গায়ে টেনে দিয়ে উঠল। নাবিলা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলেই রেশমার হাসিমিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে এল,
— “উঠে পড়েছো? এত তাড়াতাড়ি? ভালো ঘুম হলো?”

মামণির কথায় নাবিলা এত লজ্জা পেল! ইশশশ, তিনি কি ভাবছেন? স্বামী কাছে থাকাও এক বিপদ, না থাকাও আরেক আপদ। একদিকে কাছে পেয়ে লাজ, অন্যদিকে দূরে গেলে মাথায় বাজ; ভীষণ যন্ত্রণার।
নাবিলা ছোট্ট করে জবাব দিল,
— “হুম।”
— “সামির কোথায়?”
— “ঘুমাচ্ছে।”
— “আচ্ছা, ঘুমাক। তুমি ক্লাসে যাবে আজকে?”
নাবিলা মাথা নাড়ল না-বোধকভাবে। মনে মনে ঠিক করেছিল, আজকের ক্লাসের সময়টুকু সামিরের সঙ্গে কাটাবে। ক্লাস খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু নাবিলার ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিছুক্ষণ বাদে উঠেই কোনোরকম খেয়ে সামির বাইরে বেরিয়ে গেল। বন্ধুদের সাথে দেখা হয় নাই। এরপর বেশি দেরি করলে ওরা মাথা চিবিয়ে খাবে‌। বহুত কাজ আছে এরপর… সবাই ফোন করছে দেখা করার জন্য।
অথচ সেদিন সারাদিন নাবিলা নিরবধি অপেক্ষা করছিল। সামির যে ইচ্ছে করেই ওকে রাগাচ্ছে, তা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে। এই কারণে সামিরকে কিছু করতে পারছিল না, বলতেও পারছিল না। শেষমেষ লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে শাশুড়ির কাছে গিয়ে বিচারের হাঁড়ি খুলল,
— “মামণি সামির কিন্তু ইচ্ছে করে আমাকে রাগাচ্ছে। আমি আজ সারাদিন অপেক্ষা করছি, আর ও গিয়ে আড্ডা মারছে।”
— “তুমি কিছু করছো না কেন? ঘরের মধ্যে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখবে। বউ হয়েছ, এটুকু পারছ না? আঁচলে বেঁধে রাখতে হবে, বুঝেছ।”

নাবিলা লজ্জা পেয়ে গমগমে কণ্ঠে বলল,
— “আমি এতকিছু করতে পারব না। তোমার ছেলেকে তুমি সামলাও। এমন করলে কিন্তু আমি কথাবার্তা বন্ধ করে দিব বলে দিলাম।”

তিনি হেসে বললেন,
— “হুম, একদম বাপের মত হয়েছে। ওকে কেমনে বোঝাব আমি?”
— “থাক, ওকে আমিই বুঝিয়ে নিব। এখন আমাকে গল্প শোনাও।”
— “ওমা কীসের গল্প?”

নাবিলা একটু লাজুক হেসে ঠোঁট কামড়ে বলল,
— “তোমার আর বাবার কাহিনী।”

রেশমা হেসে বললেন,
— “আমাদের কী কাহিনী শুনবে?”
— “যখন বিয়ে হয়েছিল, সেই বাসর রাতের কাহিনী।”

রেশমা হাসলেন ঠিকই। তবে ছেলের বউয়ের কথায় ওই সময়টা মনে পড়ে গেল। বললেন,
— “আচ্ছা, শোনো। যখন তোমার বাবা আর আমি নতুন বিবাহিত দম্পতি ছিলাম, তখন রাতটা… ওহ! কত যে মজার ছিল। বাসর রাতে তোমার শ্বশুর আমাকে দেখেই একেবারে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি তখন মাথা নিচু করে বসে আছি, লাজে মরার দশা। তার তো মুখে আবার বিখ্যাত ডায়লগ, ‘তুমি কি আমার দিকে একেবারে না তাকিয়েই আজকের রাতটা পার করে দেবে?’ কী লজ্জা! কী লজ্জা! তারপরের রাতগুলোতে আমরা দু’জন একসাথে এককোণে বসে গল্প করতাম, হেসে হেসে সময় কাটাতাম। তোমার শ্বশুর একটু দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আর আমি ভোলাভালা… তখন বালিশে মুখ লুকিয়ে একে অপরকে দেখতাম। বুঝছো, সবটাই লাজুক খুনসুটি কিন্তু সেই খুনসুটি আমাদের একে অপরের কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।”

নাবিলা হেসে গড়িয়ে পড়ল,
— “বাবা এমনও বলতে পারে? দেখে কী গম্ভীর মনে হয়।”
— “এরা বংশগতভাবে এমন। দেখে মনে হয়, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। অথচ ভাজা মাছ উল্টে যে বুভুক্ষের মত খেতে পারে, তা কেউ জানে না।”
নাবিলা বেশ শব্দ করে হেসে উঠল। মনে মনে ভাবল, “হুম, আমাদেরও এমন হবে একদিন। কিন্তু ওই অভদ্রটা যে কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে? বাবা এত মিষ্টি কথা বলতেন? কেবল একবার তাকানোর জন্যও এভাবে অনুরোধ করতেন… আহা, কী সুন্দর ভালোবাসা! আর তার ছেলে হয়ে সামির কি করছে? বাপের নাম ডুবানোর জন্য সারাক্ষণ খোঁচা, দুষ্টুমি, অসভ্যতামি… এক ফোঁটা মিষ্টি কথা নাই। ওর রোমান্স কোথায় লুকিয়ে রেখেছে? আর রোমান্স? তার আনন্দ তো শুধু আমাকে রাগানোর মধ্যেই।”
নাবিলা গালে হাত দিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বসে রইল। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হয়তো একদিন সামিরও বাবার মতই বলবে, ‘তুমি কি আমার দিকে একেবারে না তাকিয়েই আজকের রাতটা পার করে দেবে?’ নাবিলার ভাবনার মাঝেই সামির “মা মা” করতে করতে বাড়িতে ঢুকল। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
— “মা, বড়মা তোমাকে ডাকছে। যাও তো, দেখে আসো।”

রেশমা অবাক হয়ে তাকালেন,
— “এত রাতে? কোনো সমস্যা হলো নাকি? আমি বরং ফোন দিই।”

সামির তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল,
— “মোটেও অনেক রাত হয়ে নাই। সবে আটটা পার হয়েছে। সারাদিন ঘরে বসে বোর ফিল করো, আমি জানি। এই হাঁটুর বয়সী মেয়ের সাথে গল্প করে মজা পাবা না। যাও, ঘুরে আসো। ফোন করার দরকার নাই।”

কিছুটা ইতস্তত করে রেশমা যখন উঠতে যাচ্ছিলেন। সামির ফিসফিস করে যোগ করল, “পারলে আজকে রাতটা থেকে কাল সকালে এসো। আর উমম… আরো ভালো হয় তোমার স্বামীকে সাথে নিয়ে গেলে।”
শেষ কথাগুলো মিনমিন করে বলল, তাই কেউ শুনতে পেল না। তবে সে নিজে গিয়ে মাকে নিচে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো। নাবিলা তাজ্জব বনে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ মামণিকে বের করে দিল কেন সামির? চোখে বিস্ময়ের ছাপ।
— “এমন করছো কেন? মামণিকে এভাবে…?”

সামির দরজার কপাট টেনে ভেতরে এসে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি, চোখে সেই চেনা কুটিল খুনসুটি। নাবিলাকে পুরো কথা শেষ করতে দিল না। ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বলল,
— “তোমাকে একা পাওয়ার জন্য। এখন ফটাফট কিছুমিছু করতে হবে। সুযোগ তো আর প্রতিদিন আসবে না।”
— “কিছুমিছু মানে?” নাবিলা বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে।”

সামির গম্ভীর হয়ে বলল,
— “ওহ এখনও জানো না? তারমানে, তোমাকে এখন প্রাকটিক্যাল ক্লাস করাতে হবে। কাম অন বউ, লেট’স স্টার্ট আওয়ার প্র্যাকটিকাল ক্লাস।”
— “সামির, এসব একেবারেই ঠিক হচ্ছে না।”

সামির পাত্তা দিল না। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে ঠিক ওর সামনে দাঁড়াল।
— “ঠিক-ভুল পরে দেখা যাবে। আগে তুমি বলো, আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে তো?”

নাবিলার গলা শুকিয়ে গেল। কোনো উত্তর দিতে পারল না। সামির হেসে ফেলল। চোখ নামিয়ে নরম স্বরে বলল,
— “চুপ করে থাকলেই উত্তর মিলে যায়। ‘না’ বলতে চাইলে তো অনেক আগেই বলে দিতে পারতে।”
নাবিলা বুক ধড়ফড় করে উঠল। সামির এক পা এগিয়ে এসে ওর গালের খুব কাছে মুখ আনল। শ্বাসের উষ্ণতা ছুঁয়ে যেতেই নাবিলা হকচকিয়ে পেছাতে চাইল কিন্তু পিঠ ঠেকে গেল দেওয়ালে।
— “সামির… প্লিজ… কেউ দেখে ফেলবে।”
— “জীন-ভূত, মা-বাবা কেউ নেই। এখন ঘরে শুধু আমরা দু’জন।” বলতে বলতেই সামির ওর চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ে চুমু খেল।
নাবিলা অস্থির কণ্ঠে বলল,
— “তুমি খুব খারাপ।”

সামির চোখ টিপে বলল,
— “খারাপ না হলে তো ভালোবাসা এভাবে আদর পায় না।”
নাবিলা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েই বুকের ভেতর ঢেউ খেলানো শ্বাস নিতে লাগল। সামির আর একমুহূর্ত দেরি করল না। আলতো করে ওর মুখে হাত ছুঁয়ে দিল, আঙুলের ডগা দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে নিল। নাবিলা শিউরে উঠল।
— “সামির…” কণ্ঠটা কেঁপে গেল।

সামির নাবিলার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল, তারপর চোখের পাতায়। নাবিলা চোখ বন্ধ করে ফেলল, মুহূর্তটাকে নিজের ভেতর গেঁথে রাখতে চাইছে। তারপর সামির ওর হাত দুটো ধরে নিজের বুকে টেনে নিল। নাবিলার শরীর কেঁপে উঠল। মনে হলো, পালিয়ে যাবে। কিন্তু পারল না। সামিরের শক্ত বাঁধনে বন্দী হয়ে রইল।
— “এতদিন দূরে থেকেছি শুধু এই মুহূর্তটার জন্য।” তারপর আলতো করে ঠোঁটে একটা চুমু খেল।

নাবিলা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে বলল,
— “তুমি সত্যিই অসভ্য।”
— “আমার অসভ্যতায় যদি প্রতিবার এইভাবে তুমি কেঁপে ওঠো, তবে আমি সারাজীবন অসভ্যই থাকতে চাই।”
দ্বিতীয় চুমু খাওয়ার জন্য সামির ঝুঁকে আসছিল। ঠিক তখনই বাজখাঁই শব্দে কলিংবেল গোটা ঘরটা কাঁপিয়ে দিল। দু’জন একসাথে থমকে গেল। চোখাচোখি হলো, নিঃশ্বাস থেমে গেল। সামির পাত্তা দিল না। যে আসছে, সে সাড়া না পেয়ে চলে যাবে। কিন্তু নাবিলা অস্থির গলায় বলল,
— “মনে হয় বাবা। আমি যাই।” ও ছাড়িয়ে বেরোতে চাইলে সামির আঁকড়ে ধরল আরও জোরে। এরইমধ্যে কলিংবেল আবার বেজে উঠল, আগের চেয়ে জোরে। এবার আর নাবিলা একমুহূর্ত দেরি করল না, ঝটপট সামিরের হাত সরিয়ে দৌড়ে দরজার দিকে চলে গেল।
সামির বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কপালে হাত চাপড়ে বলল,
— “আফসোস, নিজের বাপও আজ আমার শত্রু হয়ে গেল!”
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৪১]
~আফিয়া আফরিন

দরজা খোলার পর নাবিলা নেওয়াজ আহসানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তিনি নাবিলাকে দেখেই স্নেহমাখা হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বাবা ঘরে ঢুকে বসতেই সামিরও বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। মুখে গম্ভীর ভদ্রতার মুখোশ। নাবিলার দিকে একঝলক তাকাল। ও চা করার নাম করে রান্নাঘরের দিকে ছুটল। আর সামির সোফায় বসে গম্ভীর মুখে বাবার সাথে গল্প শুরু করল। একেবারেই নির্দোষ, শান্ত ছেলেমানুষের ন্যায়।
নাবিলা চা নিয়ে আসতেই শুনতে পেল বাবা সরলভাবে প্রশ্ন করলেন,
— “আমি তো ভেবেছিলাম, তোকে বাড়িতেই পাব না। বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত থাকবি।”

সামির দিব্যি শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
— “নাবিলার পড়াশোনা বিষয়ক একটা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিচ্ছিলাম। পড়াশোনার হাল খুব খারাপ, দেখা যাচ্ছে।”
নাবিলা ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠল। কী সর্বনাশ! বাবা সামনে বসে আর এই ছেলেটাকে অস্বস্তি একটুও কাবু করছে না। নাবিলা তাড়াতাড়ি কথাটা কাটিয়ে উঠতে গলা খাঁকারি দিল,
— “বাবা চা নিন। ক্লান্ত হয়ে এসেছেন।”

বাবা কিছু বলার আগেই সামির খোঁচা দিল,
— “চা-টাও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের অংশ, তাই না নাবিলা?”

বাবা বললেন,
— “ভালো করে সামিরের কাছ থেকে ক্লাসগুলো বুঝে নিও মা। তোমার তো অনেকগুলো ক্লাস মিস হয়েছে। সমস্যা হতেই পারে।” সামির দিব্যি গম্ভীর চেহারা ধরে রাখল। নাবিলা লজ্জায় মাটিতে চোখ রাখল। এখন বাবাও ছেলের পক্ষে ক্লাসের কথা তুলছে! নাবিলা মনে মনে বলল,
“এই ক্লাস সম্পর্কে বাবা যদি জানতেন, তাহলে কি আর এত নির্লিপ্তভাবে উৎসাহ দিতেন?”
কিছুক্ষণ বাদেই রেশমা ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকেই দেখলেন সামির বাবার সাথে বসে গল্প করছে। নাবিলাকে দেখতে পেলেন রান্নাঘরে। সামিরকে মিথ্যা কথা বলার জন্য কিছুক্ষণ বকাঝকা করে থিতু হলেন।

দুদিন পর…
সকালের আলো জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। টেবিলে বই খুলে বসে আছে নাবিলা। বইটা নিয়ে একটু বাদেই বিছানায় বসে হাই তুলল। পরীক্ষার চাপ একদিকে, অন্যদিকে সামিরের অভিমান; মনটা কেমন অস্থির। সে বেশ ফুলেছিল সেদিন। নাবিলা মানানোর চেষ্টা করলেও মানাতে পারে নাই। এখন সে বাসায় নেই। “দশ মিনিটে আসছি” বলে কোথাও একটা বেরিয়ে গেল। এরইমধ্যে আবার ফিরেও এলো। নাবিলাকে জিজ্ঞেস করল,
— “তোমার শাশুড়ি গেল কই?”

নাবিলা বই থেকে চোখ তুলে অবাক হয়ে বলল,
— “জানিনা তো… বাড়িতে নেই নাকি?”
— “মাত্র বের হতে দেখলাম।” তারপর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে এল। নাবিলার হাতে ধরা কলমটা থমকে গেল।
— “কি-কি? দরজা বন্ধ করছ কেনো?”

সামির কোনো জবাব দিল না। চোখে-মুখে দুষ্টুমি খেলে গেল। বসে পড়ল।
— “আজ যদি কেউ আমাকে ডিস্টার্ব করে…” সামির এগিয়ে এসে বইটা বন্ধ করে দিল। নাবিলা হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কথা শেষ না হতেই সামির হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে চাইলে নাবিলা ছিটকে সরে গেল। খিলখিল করে হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। তারপর শুরু হলো ছোটাছুটি। ঘরজুড়ে দৌড়াদৌড়ি, চেয়ারের আড়ালে লুকানো, পর্দার আড়ালে উঁকি দেওয়া। নাবিলা বারবার ধরা পড়ে আবার ছুটে গেল, আর সামির প্রতিবারই ধরেও ছেড়ে দিল। একসময় নাবিলা হাঁপাতে লাগল। এলোমেলো চুলগুলো কোনোরকম হাত খোঁপা করে বাঁধল। এবার আর পালাতে পারল না। সামির ওর হাত ধরে কাছে টেনে আনল। মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল,
— “এইবার কোথায় পালাবে?”
— “তুমি একদম সহ্যের বাইরে!”
— “সহ্যের বাইরে হতেই তো চাই।”
নাবিলা চোখ বুজে সামিরের বুকে মাথা রাখল। তারপর নিজের সমস্ত দ্বিধা, ভয়, সংকোচ ভুলে গেল। লাজুক চোখ নামিয়ে শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করল,
— “আমি আর পালাতে চাই না…”
সামিরের ঠোঁটে তখন প্রশান্ত মহাসাগরের ন্যায় হাসি। সে বুঝল, নাবিলা এবার পুরোপুরি ওর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে; মন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। এরপর দমে দমে নিঃশ্বাস মিলছিল, হৃদয়স্পন্দনও এক রিদমে বাঁধা।
ঠিক তখনই ওদের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো। সামির হিসহিসিয়ে উঠল। শার্টের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে দরজা খুলে উঁকি দিল। ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল রেশমা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
— “নাবিলা কোথায় রে?”
এতদিন সামির বাড়িতে ছিল না। তাই প্রতিদিন নাবিলার সঙ্গে সময় কাটানো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হয়তো অভ্যাসবশত তিনি জিজ্ঞেস করতে এসেছেন। ছেলে যে ফিরে এসেছে, তার যে বউ প্রয়োজন, এটা হয়তো খেয়ালও নেই। সামির শান্ত ও ভালো মানুষের মতো উত্তর দিল,
— “নাবিলা ঘুমাচ্ছে। পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে।”
— “ও আচ্ছা। তাহলে থাক।”
— “কোন দরকার ছিল মা? ডেকে দেওয়া লাগবে কি?”
— “না, একদম দরকার নেই।”
সামির ফের দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো। ঘরের মধ্যে হালকা নিঃশ্বাস আর ধীর হাওয়ার শব্দ। সামির নাবিলার পাশে এসে বসল।
— “এখন শুরু করব তোমার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস।” ফিসফিস করে সামির বলে; স্বর যতটা মিষ্টি, ততটাই ইঙ্গিতপূর্ণ। নাবিলা মৃদু হেসে লাজুক ভঙ্গিতে সামিরের দিকে তাকায়। সামিরও কোনো কথা না বলেই শুধু দৃষ্টিতে, স্পর্শে তার অনুভূতি জানিয়ে দেয়। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঠিক সেসময়ে একজোড়া কপোত-কপোতীর উদ্দাম ভালোবাসার শুভ সূচনা হলো।
.
একপ্রকার তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে পড়শীর ডিভোর্স সম্পন্ন হলো। শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ থাকায় প্রক্রিয়াটি দ্রুত এবং সহজেই শেষ হয়েছিল। শুরুতে পড়শী নিজেও বিষয়টা চেপে রেখেছিল। মায়ের কাছে ভুলেও বলে নাই। কেন বলবে? মায়ের উপর ওর ছিল এক আকাশ অভিমান। আর এইটা জানানোর মতো কোন বিষয়ও ছিল না, তাই নিজেই সবকিছু লুকিয়ে রাখছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন সীমা অতিক্রম করল, তখন না জানিয়েও পারল না।
বাপের বাড়িতে ফিরে এসে পড়শী একেবারেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নির্লিপ্ত চোখে চারপাশ তাকায়, কারো সঙ্গে কথাবার্তা নেই। কারোর প্রতি অভিযোগ নেই, কোনো রাগ নেই, শুধু এক শূন্যতার শাস্তি। সুরাইয়া প্রতিনিয়ত মেয়ের জন্য আক্ষেপ করেন। নিজেকেই দায়ী করেন মেয়ের এই অবস্থার কারণে। কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই। তিনিই পছন্দ করেছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী পাত্র। ভেবেছিলেন মেয়ের জীবন সেখানেই স্থির, সুরক্ষিত এবং সুখের সঙ্গে কাটবে। কিন্তু কে জানত, সেই পছন্দের পাত্রের আড়ালে এমন অচিন্তিত দিক লুকিয়ে আছে? যে ছেলেটা দেখায় ছিল স্থির, দায়িত্বশীল এবং মনোরম; সে বাস্তবে কি করে এমন অমানুষ, অমানবিক হয়ে উঠতে পারে? ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের সঙ্গে ভরাট প্রত্যাশার সেই আকাশ হঠাৎই ভেঙে পড়ল সুরাইয়ার মাথার উপর। কোন মা নিজের মেয়ের ভালো চায় না?
সুরাইয়া বারবার চেষ্টা করলেন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। যতই নরম স্বরে, যতই মায়ের স্নেহপূর্ণ আহ্বান, মেয়ে কোনো উত্তর দেয় না। মুখ খোলার আগে কৌতূহলের অনুভূতিটুকু চোখে ঝলসে উঠলেও, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফের নির্লিপ্ত।
পড়শীর একাকীত্ব ভাঙার জন্য সুরাইয়া শেষ চেষ্টা করলেন। একমাত্র বোনের মেয়ে শুভ্রাকে ডেকে পাঠালেন। শুভ্রা চঞ্চল মেয়ে, প্রাণোচ্ছল কথায় চারপাশ মাতিয়ে রাখে। হয়তো সমবয়সী কাউকে পেলে পড়শীর মন হালকা হবে, হাসিটা একটু ফিরবে, এই আশাতেই আসা। ও প্রাণপণে চেষ্টা করল পড়শীকে কথোপকথনের ভেতরে টেনে আনতে। কিন্তু পড়শী নিজের নিঃসঙ্গতার ভেতরেই স্বস্তি খুঁজে নিয়েছিল। শুভ্রার দমফাটা প্রাণশক্তিও সেখানে কোনো ফাঁক খুঁজে পেল না। পড়শী নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাকিটা জীবন সে এভাবেই কাটাবে। চুপচাপ বসে থাকবে, কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। কথা বললে সবটা দুঃখই জাগায়, তাই মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। একটা কথা বলা মাত্রই জীবনটা ফের ভারী হবে, ঝনঝনিয়ে উঠবে ব্যথার শব্দ; মানুষের মুখে পড়বে কৌতুহল, উপদেশ, অনেক সময় দমনে-দমে শোনানো প্রশান্তির মিথ্যা আশ্বাস। জীবনে সুখ লাগে না এমন নয়, কেবল এখন কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই। রাতের গভীরে নিজেই কানে কানে নিঃশব্দে গভীরভাবে বলে, “সুখের কথা এখনও কোথাও লুকিয়ে আছে; তবুও শুধু দুঃখের সঙ্গেই চলি।” কথাগুলো খুব নরম, কোনো বদলে যাওয়ার দাবী ছাড়া, নিজের বাসযোগ্য এককোণে নামিয়ে নেওয়ার মতো।

অন্বেষা একটু অসুস্থ। প্রেগন্যান্সির সময়কার স্বাভাবিক ঝক্কি-ঝামেলার বাইরেও নানারকম সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। কখনও হঠাৎ করে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, সামান্যতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা; অস্থির হয়ে উঠেছে অন্বেষা। অসুস্থতার ক্লান্তি আর অবসাদ মিলিয়ে এখন বেশিরভাগ সময় চুপচাপ শুয়ে থাকে। কারো তেমন কোনো খোঁজখবর নিতে পারে না। নাবিলার পরীক্ষা চলছে এখন, তবুও প্রতিদিন বিকালে একবার এসে দেখা করে যায়। কারো সাথে গল্প করার সময়টুকু বেশ ভালো কাটে। এছাড়া বাড়িতে কামিনীও আছে। সেও এখন অনেকটা নিস্তেজ। তার ডেলিভারি ডেট সামনের মাসে তাই হাঁটাচলা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতেই বাড়তি সতর্কতা মানতে হচ্ছে। বর্তমানে ইয়াসমিন এই বাড়ির কন্ট্রোলরুমের ভূমিকা পালন করছেন। ছেলের বউ আর মেয়েকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছে। মাঝেমাঝে যে বিরক্তবোধ করেন না, তা না। তখন গজগজ করে বলেন,
— “আয়ান একটা বিয়ে করলে আজকে আমাকে এইদিন দেখতে হতো না। ঘরে আরেকটা বউ থাকলে একটা দিক অন্তত সামলাতে পারতো। আমি একা মানুষ কয়দিক সামলাবো?”

— “ভাগ্যিস আরেক ছেলেকে এখনও বিয়ে করাও নাই, না হলে আরও একটা ঝামেলা বেড়ে যেত!” বলেই খোশ মেজাজে হেসে উঠে অন্বেষা।

ইয়াসমিন সেটা শোনেই ঠোঁট টিপে ব্যথাতুর গলায় বলেন,
— “বিয়ে করলে তো? ভালো মেয়েগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, কে ধরে রাখবে ওদের? সামিরকে তো আমি আগে থেকেই বলেছি, তুই একটু রাজি করাই দে। কিন্তু আয়ানের তো রাজি হওয়ার অবস্থাই দেখছি না। ছেলেটা আমার সারাজীবন এইভাবে কাটাবে? মা হয়ে সহ্য করব কেমনে বল দেখি?”
— “মা, তুমি এত চিন্তা করো কেনো? যার সময় যখন হবে তখনই আসবে। ভাইয়া যদি এখনি না চায়, তাকে জোর করে টেনে তো লাভ নেই। হয়তো এখনও মন থেকে কাউকে জায়গা দিতে পারছে না। কিন্তু একদিন পারবে। মনে একজনকে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করলে এটা তো তার প্রতি অন্যায় হবে, তাইনা? আসলে, তুমি আমি যা ভাবছি তারচেয়ে ভাইয়া নিজেকে বেশি বুঝে। একটু সময় দাও মা। তুমিই তো বলো, ধৈর্য্য ধরলে সবই সহজ হয়। এইবার নিজেও একটু ধৈর্য্য ধরো।”
ইয়াসমিন সব জানেন, বোঝেন তবুও মনটা মানতে চায় না কিছুই। ছেলের চিন্তায় চিন্তায় মাঝেমাঝে হাঁসফাঁস লাগে। বড়টার জন্য বউ নিয়ে এসেছিলেন পছন্দ করেই। যেমনই হোক ভালো-মন্দ মিলিয়ে চলার মত। এখন ছোটোটার গতি করতে পারলেই হলো।

ইশরাকের বাড়ি দক্ষিণ পাড়াতেই। পরীক্ষা দিতে আসার আগে নাবিলার সাথে দেখা হয়ে গেল। সাধারণ কথাবার্তার ফাঁকে নাবিলা হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল,
— “ভাইয়া, পড়শী আপুর বাসা তো আপনাদের পাশেই, তাইনা? আপু বাড়িতে আসলে আমাকে একটু জানাবেন। কোনো খোঁজখবর নাই।”
তখন ইশরাক ডিভোর্সের কথাটা জানাল। শুনে তো নাবিলার আক্কেলগুড়ুম। ওকে কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু ফোন ধরে নাই। পরীক্ষার হলে বসেও নাবিলার মন অন্যখানে পড়ে ছিল। কোনোরকম পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়ে এলো। মাথায় কেবল ঘুরছিল ইশরাকের বলা কথাগুলো, ডিভোর্স!
কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। গেটের বাইরে প্রতিদিনের মতোই সামির দাঁড়িয়ে ছিল। হেলমেট হাতে নিয়ে বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে, ঠোঁটে পরিচিত হাসি। নাবিলাকে দেখেই বলল,
— “আজ মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি বের হলে? চলো, কোথাও যাবে নাকি সরাসরি বাসায়?”

পেছনে বসেই নাবিলা তড়িঘড়ি করে বলল,
— “আমাকে একটু পড়শী আপুদের বাসায় নিয়ে যাবে? খুব জরুরি।”

সামির ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
— “ওখানে আবার কী কাজ?”
সংক্ষেপে ইশরাকের সাথে হওয়া কথোপকথনটা জানাল নাবিলা। ডিভোর্সের কথা শুনেই সামিরের মুখের ভাঁজ গভীর হলো। দ্রুত বাইক স্টার্ট দিল। নাবিলাকে ওই বাড়িতে পৌঁছে দিতেই নাবিলা তাকে চলে যেতে বলল। ও কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে আসবে। তারপর পড়শীর সাথে কথা বলতে ভেতরে গেল। পড়শী তো এমনিতেই কারো সাথে দেখা করছিল না, কথা বলছিল না; তবে হঠাৎ নাবিলাকে দেখে সুরাইয়া বেশ খুশি হলেন। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে পড়শী শুধু নাবিলার সাথে কথাই বলল না, ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটিও করল। নাবিলা থামানোর চেষ্টা করল না, মনের মধ্যে যে ঝড় বয়ে চলছে তার অবসান হওয়া দরকার। তাই কান্না করতে দিল। পড়শী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— “আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না। এই সংসার, এই মানুষ, কেউ কিছু বুঝে না… সবাই আমাকে ভুল বোঝে।”

নাবিলা হাত ধরে বলল,
— “সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু একটু ধৈর্য ধরো।”
— “আমি আর কিছুতেই শান্তি পাই না। ওরা… ওরা সব নষ্ট করে দিল। কেউ আমাকে বোঝার প্রয়োজন মনে করো না।”

নাবিলা কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বলল,
— “আমি আছি তো। দেখো তোমার মা-বাবাও সাথে আছে। তারাও তো কষ্ট পাচ্ছে নিজেদের করা ভুলের জন্য। আমি শুনলাম তুমি নাকি কারো সাথে কথাবার্তা বলো না।”

পড়শী চোখ মুছতে মুছতে বলল,
— “যন্ত্রণার মধ্যে আছি… আমার কিছুই ভালো লাগেনা আর।”
— “আয়ান ভাইয়াকেও ভালো লাগেনা?”

পড়শী চোখ মুছে চুপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে জীবনে অভিশাপ বসে গেছে, সবকিছুই ব্যর্থতার মতো মনে হচ্ছে। নাবিলার কোমল সুর শুনে ওর চোখে অশ্রু ভেসে এল। কণ্ঠটা কাঁপছিল,
— “আমি তো ওকে ঠকিয়েছি। অভিশাপ দিয়েছে তাই আজ এই শাস্তি পাচ্ছি।”
— “কান্নাকাটি করো না। যা হয়েছে, তা ভুলে যাও। ভাইয়া তোমাকে অভিশাপ দেওয়ার কথা ভাবেও না। তোমাকে ভালোবাসে, এখনো ভালোবাসার মধ্যেই রেখেছে। একমুহূর্তের জন্যও তোমার অমঙ্গল কামনা করেনি।”

পড়শির চোখ ফের ভিজে এলো,
— “চোখ বন্ধ করলেই সব মনে পড়ে যায়। হাজার চেষ্টা করেও ভুলতে পারি না।”
— “সব স্মৃতি হঠাৎ চলে যাবে না। কিন্তু যেটুকু সম্ভব, সেটুকু কিন্তু চেষ্টা করলেই সামাল দিতে পারবে।”
পড়শী চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, হয়তো স্মৃতির আঘাত কখনোই কমবে না কিন্তু পাশে কেউ থাকলে, অন্তত সেই আঘাত সামলানো সহজ হয়ে যেত। নাবিলা পড়শীর পাশে কিছুক্ষণ আরও বসে রইল। মাঝেমাঝে মৃদু কথাবার্তা হলো। অনেকদিন পর পড়শীও ওকে পেয়ে ছাড়তে চাইছিল না। যাওয়ার আগে নাবিলা বলে গেল, ও আবার আসবে। ওকে যে আসতেই হবে আবার!
বের হতেই সামিরকে দেখতে পেল। পড়শীদের বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ। তাও দেড়ঘন্টার কম না। এতক্ষণ এখানেই ছিল নাকি? নাবিলা এগিয়ে যেতেই তার হাতে সিগারেট দেখে মেজাজ খারাপ হলো। একটু হতাশা মিশিয়ে বলল,
— “এতক্ষণ এখানে বসেছিলে, আর এটা কি? সিগারেট?”

সামির ঢঙের সঙ্গে হেসে উত্তর দিল,
— “হুঁ, খাবে?”

নাবিলা তেতো গলায় ফিরিয়ে বলল,
— “তুমি মাইর খাবে?”
— “উঁহু। এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর ফল হিসেবে তুমি আমার সিগারেট খাওয়ায় বাঁধা দিতে পারবে না।”
— “এতক্ষণে কয়টা শেষ করেছ?”
— “মাত্র তিনটা।”

নাবিলা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল,
— “এটা মাত্র?”
— “তো? দেড় ঘন্টায় পুরো এক প্যাকেট সাবার করে দিতে পারতাম।”
— “ব্যাস, এতো হিরোগিরি দেখাতে হবে না। বাড়ি চলো।”

সামির বাইকের স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “কি কথাবার্তা হলো?”
— “তেমন কিছু না আবার অনেককিছুই। আচ্ছা, একটা ডিভোর্সী মেয়ের সঙ্গে একটা অবিবাহিত ছেলের বিয়ে হলে কি কোনো সমস্যা হয়?”

সামির কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,
— “আয়ান আর পড়শীর কথা ভাবছ?”,
— “সেটা কি স্বাভাবিক না?”
— “হুম। আমার মতে, আমাদের পরিবারের দিক থেকে কোনো সমস্যা হবে না। আয়ান তো পড়শীকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। পড়শীর বাড়ি থেকে কি যে করবে? বড়মা তো ভুলেও প্রস্তাব নিয়ে যাবে না। তিনি অবশ্যই আপত্তি করবেন।”
— “কেন আপত্তি করবে? তার ছেলে যে সুখে থাকবে, এটা ভাবছে না?” নাবিলার কণ্ঠে বিস্ময়।
— “অনেককিছুর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারা সমাজে থাকে, তাই যথাযথভাবে সমাজের নিয়ম মানে। আমার মা হলেও একই কাজ করত।”

নাবিলা মুখ ভেংচে বলল,
— “ভাগ্যিস তুমি কামিনীর জন্য কোনো পাগলামি করোনি।”
— “করতামও না। আমাদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। আমার কথা হচ্ছে, যে যাওয়ার তাকে কলিজার সাথে বেঁধেও রাখা যাবে না আর যে থাকার তাকে কোনভাবে রাখলেও থেকে যাবে। তবে হ্যাঁ, যত্নের প্রয়োজন আছে।”

নাবিলা চোখ বড় বড় করে তাকাল,
— “আমাদের? কামিনী আর তোমার ব্যাপারটা মিলিয়ে আমাদের? ভালোই।”

সামির তৎক্ষণাৎ হেসে উঠল,
— “ওটাতো কথার কথা। হিংসে করো না, নাবিলা। এখন তো শুধু তুমি আর আমি আছি।”

নাবিলা ভোঁতা ভঙ্গিতে বলল,
— “আমি থাকলেই বা কি?”
— “অনেককিছু।”
অনেককিছু কী কী, জানার ইচ্ছে থাকলেও হঠাৎ করেই মনে হলো, সবটা জানার যথেষ্ট প্রয়োজন নেই। দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে অনেক কিছুই একটু কম জানতে হয়, কম বুঝতে হয়; ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা বেশ কাজে দেয়। সামিরই একদিন বলেছিল, “তুমি আমার জীবনসঙ্গী, মরণসঙ্গী, অমরসঙ্গী, হৃদয়সঙ্গী, প্রাণসঙ্গী, অন্তঃসঙ্গী, মধুসঙ্গী, চিরসঙ্গী, আত্মসঙ্গী…”
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৪২]
~আফিয়া আফরিন

আজ সকাল আটটা নাগাদ কামিনীর ছেলে হলো। হাসপাতালের করিডোরে বাড়ির সবাই এসে জমায়েত হয়েছে। শারীরিক জটিলতার কারণে দু’দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ওকে, বাচ্চাটাও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জন্ম নিয়েছে তাই সবাই একটু চিন্তিত ছিল। তবে ডাক্তার জানালেন, মা-ছেলে দু’জনেই ভালো আছে। বাচ্চার কান্নার শব্দেই একরকম উদ্বেগ মিশে ছিল। নাবিলা এককোণে দাঁড়িয়ে দেখছিল। সবাই বলছে, বাবার মত দেখতে হয়েছে কিন্তু বাচ্চাটার মুখ, নাক-মুখের ছোট ছোট অভিব্যক্তি; সব ছোট্ট বাবুরই প্রতিচ্ছবি। মনটা কেমন নরম হয়ে উঠল। কোলে তুলে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও পারল না। ভয়ও লাগছিল, এতটাই ছোট যদি কোনভাবে হাত ফসকে পড়ে যায়?
কামিনী সুস্থ আছে। সবকিছু দেখে বেশ ভালো লাগছিল, মনের মধ্যে প্রশান্তি আসছিল। হাসপাতালে সবার ভিড়, আনন্দের আবহ। শুধু সামির নেই। ওর অনুপস্থিতি নাবিলার চারপাশের কোলাহলের মাঝেও একটা শূন্যতার মত। এখানে এসেই ফোন করেছিল,
— “এটা কি রাগ করে থাকার সময়? তুমি বাবুকে দেখবে না? যাইহোক, তুমি তো কাকা হয়েছ।”

সামির ফোনে ব্যস্ততা সামলে শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
— “সত্যিই আমার কাজ আছে।”

নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “উঁহু, আমি জানি। তুমি এখনও ওই ঘটনা মাথা থেকে সরাও নাই।”
— “তা ঠিক… তবে এই কারণে আমার ভাইয়ের বাচ্চার মুখ দেখবে না, ব্যাপারটা মানানসই না। আমার বড় ভাইয়ের বাবু, ফিরে এসে দেখব।” সেদিন ওরা সকাল থেকে রাত পুরোটা সময় হাসপাতলে কাটিয়ে দিল। রাত নামতেই খেয়াল হলো, এবার বাড়ি ফেরা উচিত। নাবিলা অনেকদিন বাদে কামিনীর সাথে এতক্ষণ যাবত কথা বলছিল। বিদায় নেওয়ার আগে আরেকবার বাচ্চাটার দিকে তাকাল। দুনিয়াতে এসে গেছে, কান্নাকাটি ছাড়া আপাতত ওর বোধহয় কোনো কাজ নেই। কামিনীর রিলিজ আরও দু’দিন পর তাই ওরা আবার আগামীকাল আসবে জানাল।

এটা সত্যিই যে কিছুদিন যাবত মানে দেশে ফেরার পর থেকেই সামির একটানা ব্যস্ত। একটা টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল যেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে, সেখানেই নিজের ক্যারিয়ার গড়বে। ওখানে সুযোগও ছিল প্রচুর। কিন্তু মা–বাবার শক্ত আপত্তি, যতই সুযোগ থাকুক না কেন আমাদের একমাত্র ছেলে, চাকরির জন্য বাইরে যেতে হবে? বাংলাদেশে কি চাকরির অভাব পড়েছে? পড়াশোনা করেছে, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু সারাজীবন যদি দেশের বাইরে থাকে, বছরে একদিনও যদি ছেলের মুখ না দেখে, তাহলে তারা বাঁচবে কীভাবে?
এই কথার জবাব দিতে পারেনি সামির। বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করে সেই আশা বাদ দিল। গতমাসেই একটা চাকরি হলো, পোস্টিং পড়ল রাজশাহীতে। প্রথমে এটাই কনফার্ম করতে চেয়েছিল কিন্তু নাবিলা এসে বলল,
— “এখানেই থাকো না, দূরে যেতে হবে না।”
সামির তখন চুপ করে তাকিয়েছিল ওর দিকে। সত্যি তো, দূরে গিয়ে লাভ কী? মনও টানছে না বরং কাছেই থাকাই ভালো। সামির মাথা নাড়িয়ে সায় দিল, নাবিলার চোখে তখন একরকম স্বস্তি ফুটে উঠেছিল। সেও আর রাজশাহীর পোস্টিং নিয়ে ভাবল না। এখন এখানেই চাকরির চেষ্টা চালাচ্ছে।
নাবিলার ভেতরে ভেতরে আনন্দের শেষ নেই। সামির দূরে গেলে ওর পক্ষে আর থাকা সম্ভব না। রাজশাহীর মতো অন্য শহরে চলে গেলে হয়তো মাসে একবার কিংবা সপ্তাহেই একবার দেখা হতো না, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। সারা সপ্তাহ অপেক্ষার আগুনে পুড়তে পুড়তে ওই একদিন মন ভরতো না। যদিও সামির বলেছিল, যেখানেই যাবে নাবিলাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। নাবিলা মানা করে দিয়েছে। ও বাড়িতেই থাকতে চায়। মামণির খুব শখ, ছেলে আর ছেলের বউকে নিজেদের সাথেই রাখার!
সামিরের কাছে এই সময়টাতেই নাবিলাকে অনেক বেশি পরিণত মনে হচ্ছে। যদিও নাবিলা যথেষ্ট ম্যাচিওর। তবে মাঝেমাঝে এমন বাচ্চামি করে না! অকারণে মুখ ফুলিয়ে থাকবে, ড্রাগন ফল খাওয়ার বদলে ঠোঁটে চেপে রাখবে যাতে ঠোঁট গোলাপী হয়। ওর কান্ডকারখানায় না হেসে পারা যায় না। আরেকটা আছে অবশ্য, সেটা হচ্ছে পড়াশোনার অযুহাতে আদর চাওয়া। যেদিন পরীক্ষা থাকে অথবা দীর্ঘক্ষণ পড়াশোনা করে তখনই এসে বায়না ধরে,
— “দেখো, আজ অনেক পড়েছি আমি।” তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে চোখে একটু ছলকানো চাহনি নিয়ে বলে, “এখন আমার পুরস্কার কই?”

সামির হাসে, ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,
— “কী পুরস্কার চাও?”
— “আমার আদর!”
সামির হেসে হাত বাড়ায়, ওকে কোলে বসায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বুকের কাছে টেনে নেয়। কণ্ঠে উষ্ণতা ঢেলে বলে,
— “একেবারেই ছোট্ট বাচ্চা, তাইনা? প্রতিদিন পড়াশোনার পরই আদর লাগে? আমাকে কে আদর করে শুনি?”

নাবিলা চোখ বন্ধ করে সামিরের বুকের কাছে মাথা রাখে। আদুরে গলায় বলে,
— “তুমি তো করছই, আবার তোমারও দরকার?”
— “অবশ্যই।” বলেই হাসিমুখে নাবিলার দিকে গাল এগিয়ে দেয়। নাবিলা তখন লাজুকভাবে না-বোধক মাথা নেড়ে ধীরগভীর কণ্ঠে বলে,
— “গালে না, ঠোঁটে।”
— “ঠিক আছে, করো।”
নাবিলার এই ছেলেমানুষির মধ্যে তার জীবন নিহিত। ওর হাসি, অভিমান, ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলো সামিরের জীবনে অনন্য কিছুর যোগান দেয়। প্রতিদিনই নাবিলার জন্য নতুনভাবে নিজেকে চিনে, নতুনভাবে অনুভব করে ভালোবাসার গভীরতা। ওর প্রতিদিনের জন্যই সামিরের জীবন নিখুঁত, পূর্ণ, এবং অর্থবহ হয়ে উঠছে দিনদিন; এটা আজকাল খুব করে উপলব্ধি করতে পারে সে।
.
পরদিন নাবিলা একা হাসপাতাল গেল না, সামিরকে সঙ্গে নিয়ে এলো। আয়ানও সেখানে উপস্থিত ছিল। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কামিনীকে নিয়ে এত ব্যস্ততার মধ্যে পড়শীর কথা তুলতে পারেনি নাবিলা। ভাঙ্গা পরিস্থিতি আর চাপাচাপা ভাবের মাঝে ওর যা বলার তা বলতে পারলেও কথাগুলো সেভাবে কারো কাছে গুরুত্ব পাবে না। স্বচ্ছন্দে, শান্তভাবে সুশৃঙ্খল পরিবেশে প্রকাশ করতে চাচ্ছে যাতে সবাই বুঝতে পারে। অন্বেষার সঙ্গে ইতোমধ্যে ঘটনার অংশবিশেষ ভাগাভাগি করা শেষ।
নাবিলা অস্থির হয়ে উঠেছিল। ওর অস্থিরতার কারণে নার্স বাবুকে এনে সামিরের কোলে দেয়। সামির বাবুকে কোলে নিল। ছোট্ট প্রাণটার ওজনে হাত একটু কেঁপে উঠল। ছোট্ট একটা বাচ্চা, কেমন কান্নাকাটি করে আবার সেকেন্ড না গড়াতেই ঘুমিয়ে পড়ে। সামির কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে থেকে ফিরিয়ে দিল। তারপর নাবিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— “তুমি এত নাচানাচি করছ কেনো? যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই, তাইনা?”
— “এমন বলছ কেনো? আমি খুশি হব না?”

সামির ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল,
— “হও। কিন্তু বাড়াবাড়ি ভালো না।”
— “মানে? এখন আমি খুশি হলেও সমস্যা? আমার খুশি দেখলে তোমার হিংসা হয়?”

সামির হেসে বলল,
— “না, হিংসা নয় তবে একটু রয়েসয়ে। সব জায়গায় আনন্দ প্রকাশ করার একটা লিমিট থাকে। লিমিটের বাহিরে গেলে সমস্যা। ভেতরে থেকে আনন্দ প্রকাশ করো, নাচো, খুশি হও; যা ইচ্ছে হয় করো। যা বললাম সেটা বুঝো আর ওই ভাবেই করো, নিজে থেকে বেশি সুযোগ দিলে কিছু মানুষ মাথায় চড়ে বসে। তাদের নিশ্চয়ই এই সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।”

নাবিলা বিস্মিত হয়ে বলল,
— “মানে?”
— “মারাত্মক কিছু না, আবার অনেককিছু। তুমি আমার বউ তো, তাই আমাকে তোমার সবটা খেয়াল রাখতে হয়‌। আমি চাইনা, তুমি কষ্ট পাও। সুযোগের সদ্ব্যবহার কে করে না, বলো? যাও, এখন বাবুর কাছে যাও। আমার কথায় মনখারাপ করো না, আমি খারাপ কিছু বলি নাই। যা বলেছি, যতটুকু বলেছি সবটা তোমার ভালোর জন্য বলেছি পাখি।” সামির কথা শেষে নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে এলো। নাবিলা তার কথার সারমর্ম বুঝেছিল। খানিকবাদে বেরিয়ে সোজা পড়শীদের বাড়ি চলে এলো। দুপুরের পরের সময়টা ওর সাথে কাটিয়ে তারপর অন্বেষার কাছে এলো। পড়শীর সাথে এইভাবে একা একা দেখা করছে, গল্প করছে শুনে হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ওর আটমাস চলছে, পেট বেশ উঁচু হয়েছে। নাবিলার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে পেটের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্পর্শে ছুঁয়ে দেখছে, বাচ্চার ছোঁয়া খেয়াল করছে। ও অন্বেষার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে দেখল। চেহারায় নতুন কোমলতা, নতুন উজ্জ্বলতা এসেছে; তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গোলগাল ফর্সা মুখ, আগে এতটা ফর্সা ছিল না, এখন আরও ঝকঝকে হয়েছে। গোলগাপ্পা টোনে মুখটা মিষ্টি… একদম রসগোল্লার মত লাগছে। মুখটা দেখলে শাহিদ ভাইয়ারও হয়তো টুক করে খেয়ে ফেলার ইচ্ছে জাগে! তবে এইমুহূর্তে মনের কথাটা মুখে বলল না।
কামিনীকে এত ভালো করে লক্ষ্য করে নাই কিন্তু অন্বেষার পুরোদস্তুর অবয়বটাকেই কোমলতার প্রতীক মনে হলো। গেল মাসে নাবিলার এক বান্ধবীরও বাবু হয়েছে। ওই মেয়েটাও একরকম সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। তারমানে, এইসময় জটিলতার পাশাপাশি আনন্দও রয়েছে। অথচ মানুষ সবার আগে কষ্ট, ব্যথা, দুর্ভোগের কথা বলে। কিন্তু কতটা শান্তি, কতটা আনন্দ আসে জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে, তা খুব কমই বলা হয়। মাতৃত্বের সেই অদ্ভুত শান্তি, অন্তরের গভীরে কোমল অনুভূতি, যা ব্যথা-সমস্যার মাঝেও প্রশান্তি এনে দেয়; সেটা কতোটা মধুর, নাবিলা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। অন্বেষা হয়ত পারছে।
হুহ, নাবিলা নিজেকে টেনে আনল ভাবনার রাজত্ব থেকে, “আমি এত ভাবছি কেনো? আমার তো আর বাবু হচ্ছে না।”

কামিনী হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হলো। সামির তখন পড়শীর কথা বলল আর সাথে আয়ানের কথাও তুলল। আয়ান দিনদুয়েক আগে জানতে পেরেছিল, পড়শীর বর্তমান অবস্থার কথা। মনে মনে একটা আশা জাগল, এখন হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে ইয়াসমিন কড়া স্বরে প্রতিবাদ করলেন,
— “আমি এমন মেয়েকে কিছুতেই ঘরে তুলবো না। আমার ছেলে কি দোষ করেছে? সে তো অবিবাহিত। তবে বিবাহিত মেয়ে ঘরে আসবে কেন? দুনিয়ায় কি আর কোনো মেয়ে নেই? যদি বিয়ে না করতে চায় তবে না করুক, তবুও ওই মেয়েটাকে আমি ঘরে তুলবো না।”

সবাই নানা উপায়ে বোঝানোর চেষ্টা করল। আয়ান দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “বিয়ে আমি ওকেই করব।”

ইয়াসমিন তখন সরাসরি বললেন,
— “ওই মেয়ে যদি এই ঘরে আসে, আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে যাব বলে দিলাম।”
— “তুমিও থাকবে, আর পড়শীও।”
সামির আর রায়হান একসাথে সরফরাজ হোসেনের সাথে কথা বলল। তিনি কোনো আপত্তি করলেন না এবং জানালেন, ছেলে যার সাথে সত্যিই সুখী থাকবে; সেই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে।
ইয়াসমিনের একরোখা মনোভাব কারো কথাতেই নরম হলো না। তার সোজাসাপ্টা ঘোষণা, ওই মেয়ে এ বাড়িতে এলে তিনি থাকবেন না।সবাই বুঝে গেল, যুক্তি-তর্কে তাকে রাজি করানো সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত সরফরাজ হোসেন, সাখাওয়াত হোসেন আর রায়হান অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, আয়ান আর পড়শীর বিয়েটা চুপিসারে নিজেরা পড়িয়ে আনবে। কারণ, নতুন বউয়ের সামনে তো মা আর এতকিছু বলতে পারবে না। সময় গেলে, ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এই সিদ্ধান্তে অবশেষে সবাই রাজি হলো। আয়ান জানাল,
— “ওদের বাড়িতে কথা বলার আগে আমি একবার পড়শীর সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই। সবটা ওর মুখ থেকে শুনতে চাই।”

এই ব্যবস্থাটা করে দিল নাবিলা। কফিশপে দুজনকে একসাথে রেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ করছিল। ঠিক তখনই পেছন থেকে সামির এসে দাঁড়াল।
— “তোমার কাজ শেষ তো? চলো, এখন।”

নাবিলা গা ছেড়ে দিয়ে উত্তর দিল,
— “আরে দাঁড়াও না। দেখি একটু, ওরা কি বলে।”
— “ছিঃ ছিঃ… বড় ভাসুরের প্রেমকাহিনী দেখতে তোমার লজ্জা করছে না?”

নাবিলা মুচকি হেসে বলল,
— “মোটেও না। তুমিও দেখো না, বেশ মজা লাগবে।”

সামির চোখ উল্টে গম্ভীর সুরে বলল,
— “একদম ইচ্ছে নেই। এসব দেখতে হবে না। আমার সাথে আসো।”
নাবিলা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সামির একরকম জোর করেই ওর হাত ধরে টেনে নিল, “চলো, প্রেম করা কিংবা দেখা; যা লাগে, আমি দেখাচ্ছি।” দুজন ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ল।

কফিশপের নিরিবিলি কোণে ছোট্ট টেবিলে মুখোমুখি বসল আয়ান আর পড়শী। দীর্ঘদিন পর এই দেখা। পড়শীর চোখেমুখে টানটান আড়ষ্টতা; কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে, সেই দ্বিধায় চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। হাতের আঙুলগুলো অযথা টেবিলের উপর আঁকিবুঁকি করছিল, ভেতরের অস্থিরতাকে লুকোনোর চেষ্টা। আয়ান পুরোটা সময় স্বাভাবিক। পড়শীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
— “কেমন আছো?”

আড়ষ্ট কণ্ঠে পড়শী উত্তর দিল,
— “ভালো… মানে, চেষ্টা করছি।”

আয়ান ভণিতা না করে সরাসরি মূল কথায় এলো,
— “বাড়িতে এখন বিয়ের কথা বলছে। আমি স্পষ্ট করে বলেছি। তোমার আপত্তি নেই তো?”

পড়শী গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “শুনেছি কিন্তু কীভাবে সম্ভব বলো? আমার তো একবার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি এখনো অবিবাহিত। সমাজ এটা মানবে না… তোমার পরিবারও না।”

আয়ান দৃষ্টি স্থির রেখেই উত্তর দিল,
— “সমাজ আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেবে না। আমি জানি, আমি কাকে চাই। ভুলে যেও না, ভালোবাসা হিসেব মানে না।”

পড়শী নিচু স্বরে বলল,
— “আমি তোমাকে শুধু কষ্টই দিয়েছি…”

আয়ান তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বলল,
— “উঁহু তুমি আমার স্বপ্ন দিলে, আছো এবং থাকবে। তুমি চাইলে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে পারি। প্রশ্ন শুধু, তুমি চাইছো তো?”
— “আমি সবসময়ই তোমাকে চাই।”

আয়ান হাসল তারপর বলল,
— “ঠিক আছে। মা’কে একটু সামলে নিও।”
অতঃপর কোনো শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করা হলো না। সবকিছু দ্রুতই ঘটে গেল। পরদিন সকালে কাজী অফিসে সাদাসিধা আয়োজন করা হলো। নাবিলা যাওয়ার আগে আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করল। মামণিকে গিয়ে বলল, পড়িয়ে দিতে। তিনি বিয়েতে যাবেন না। জা’কে মানানোর জন্য বাসায় থাকতে হবে। অন্বেষা আর কামিনীও অনুপস্থিত।
নাবিলা শাড়ি পরে প্রস্তুত হলো। ওর পড়নের শাড়ি দেখে সামির বিস্মিত। চোখে প্রশ্নের ছায়া। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নাবিলা হেসে বলল,
— “মনে পড়ে?”

সামির চোখ ছোট করল,
— “এটা…”
— “হুম যেটা ভাবছ, সেটাই। অন্বেষা আপুর বিয়ের সময় তুমি আমাকে দিয়েছিলে।”

সামিরের মুখের রেখা বদলে গেল,
— “কিন্তু… আমি তো সেটা ফেলে দিয়েছিলাম।”
— “রাতের আঁধারে আমি তুলে এনেছিলাম। জানো, একেবারে কাঁদামাটির মধ্যে পড়েছিল। পরদিন ওয়াশ করতে দিয়েছিলাম। তারপর যত্ন করে তুলে রেখেছি।”

সামির অবাক, সত্যিই অবাক! শাড়িটার প্রতি একটা টান ছিল। তখন খুব কষ্ট লেগেছিল, নাবিলা ওইভাবে ফিরিয়ে দিল?
— “সাথে সাথে নিলে কি হতো?” গলায় নরম অভিমান।

নাবিলা মুচকি হেসে বলল,
— “অনেককিছু হতো। যখন তোমার উপর অন্যরকম ফিলিংস আসে তখনই তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার ফিলিংসের ফালুদা বানিয়ে ছাড়ো।”
— “সরি… আচ্ছা বলো তো, সেদিন কয় তারিখ ছিল?”

নাবিলা ভ্রু কুঁচকালো,
— “উমম… মনে নেই তো।”
— “০২ তারিখ।”
এইবার নাবিলাও অবাক হলো! সামির যাওয়ার পর প্রত্যেক মাসে শাড়িগুলো ০২ তারিখে আসত। তাহলে এই রহস্য?
— “আগে তো জিজ্ঞেস করেছি, বলোনি কেনো?”
— “কখনোই বলতাম না। আজ এই শাড়ির উসিলায় বললাম। সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

নাবিলা সব ভুলে মুচকি হাসল। সামির হাত বাড়িয়ে দিল,
— “চলো এখন।”
শাড়ির রহস্য আসলে আগেই উন্মোচিত হয়েছিল। প্রতিমাসে দরজার সামনে শাড়ি রেখে যেত অন্বেষা। তবে নাটোরে একবার শাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল ইশরাক। মামণিও সব জেনে মুচকি হাসতেন।

আয়ান আর পড়শীর বিয়েটা শেষমেশ হয়ে গেল। এখন বাড়ি ফেরার পালা। তারপর কী হবে? কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ইয়াসমিন? গাড়ি থেকে নেমে নবদম্পতি বাড়ির দরজায় পা রাখল। পড়শীর চোখেমুখে অস্বস্তির ছাপ। ইয়াসমিন দীর্ঘক্ষণ একনাগাড়ে সবকিছু দেখলেন; বিয়ের সাজে পড়শী, পাশে আয়ান আর চারপাশে পরিবারের সদস্যরা। তার মুখে কোনো রাগ নেই, আবার হাসিও নেই। খুবই শান্ত স্বরে নবদম্পতিকে ঘরে যেতে বললেন। তারপর ইন্ধন দাতাদের দেখলেন। নাবিলা ভয়ে টুক করে সামিরের পেছনে লুকিয়ে পড়ল।
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]