#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৪৫]
~আফিয়া আফরিন
কয়েক মাস কেটে গেছে। সেদিনকার সকালটা ছিল একেবারে স্বাভাবিক। নাবিলা চোখেমুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে সামিরের অফিসের কাগজের ফাইলের ভেতর একখানা ছোট্ট জিনিস গুঁজে রেখে দিল। ভেবেছিল, সামির দেখেই আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু কিছুক্ষণবাদে সামির ফাইল খুলতেই কপাল কুঁচকে গেল। জিনিসটা হাতে নিয়ে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল,
— “এ আবার কাগজের ভেতর কী ঢুকিয়ে রেখেছে? কে রাখে এগুলো অফিস ফাইলের মধ্যে! ড্রয়ারে রাখলেই হয়।” বিরক্তি নিয়ে জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিল একপাশে। এদিকে দরজার আড়াল থেকে নাবিলা সব দেখছিল। রাগে লাল হয়ে গজগজ করল, “অসভ্য ছেলে একটা! বোকা একটা! ফাজিল একটা! কী আশ্চর্য বুদ্ধি এনার! এরকম গন্ডমুর্খের সাথে আমি এত বছর ধরে সংসার করছি? ওহ, নো।” ঠিক তখনই সামির চেঁচিয়ে ডাকল,
— “নাবিলা শোনো!”
ভেতরে এসে নাবিলা বলল,
— “ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছো কেনো?”
সামির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
— “ওহ, এখানেই ছিলে? আমি একটু বের হচ্ছি।”
— “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
— “আয়ান ফোন দিয়েছিল। দেখি কী বলে।”
— “তো যাও না। আমার মাথা খাচ্ছো কেন?”
— “মাথা খাচ্ছি কই? একটু অনুমতি নিলাম। নাহলে পরে বলবে, আমি কিছু বলি না, এটা-সেটা লুকাই…”
নাবিলা চোখ গোল করে ধমক দিল,
— “চুপচাপ বের হও তো।” সামির হেসে বেরিয়ে গেল। ওর পেছনেই নাবিলা ঝট করে ছুঁড়ে ফেলা সাদা জিনিসটা তুলে নিল। ছোট্ট স্ট্রিপটায় দুটো গাঢ় দাগ জ্বলজ্বল করছে। নাবিলা একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হেসে বিড়বিড় করল, “হায় হায়… এত বড় বোকার রাজা হতে পারে মানুষ! এত আনন্দের খবর ফেলে দিলো আরেকটু হলে বোধহয় জিনিসটাকে ভেঙেই ফেলত।”
নাবিলার চোখে পানি এসে গেল আনন্দে। মনে পড়ে গেল গতদিনের কথা। সকালটা অন্যসব দিনের মতই ছিল। মাসের তারিখ মেলাতে গিয়েই ওর প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল। মাথায় ঘুরছিল অজস্র প্রশ্ন, সত্যিই কি? নাকি আবারও আগের মতো ভুয়া আশা? যেদিন টেস্ট করল, সেদিন সকাল থেকেই হাত কাঁপছিল। টেস্ট কিটে দৃষ্টি আটকে গেলেই মনে হচ্ছিল, নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল দুটো দাগ। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কয়েকবার চোখ মুছে তাকাল। কিন্তু না, ভুল দেখছে না। সত্যিই দুটি দাগ!
উত্তেজনায় শাশুড়িকে গিয়ে দেখাল। তৎক্ষণাৎ কোনো কথাও বলতে পারল না উনাকে। রেশমা নিজেও কতটা খুশি হলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। তিনি নাবিলাকে নিয়ে সোজা ডাক্তারের কাছে চললেন টেস্ট করে নিশ্চিত হতে। সেই রিপোর্ট আজ সকালে হাতে পেয়েছে নাবিলা। একমুহূর্তে শরীর কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঢেউ বয়ে গেল। গলার ভেতর কিছু আটকে এলো। মা… সত্যিই মা হতে যাচ্ছে ও! ঘরে এসে চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বসে রইল। চোখ থেকে কান্না গড়িয়ে পড়ল, এই কান্না আনন্দের। এক নতুন জীবনের শুরু… নিজের ভেতরে আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে, এই ভেবে কেমন অদ্ভুত মায়া জন্ম নিল নিজের শরীরের প্রতিটি রক্তকণার প্রতি। মনের মধ্যে ঝড় তুলল হাজারো স্বপ্ন। কিটটা রেখে দিয়েছিল সামিরকে দেখানোর জন্য, মুখে বলতে ভীষণ লজ্জা লাগবে। কিন্তু হায়! সামির তো এখন ভাবের রাজা থেকে বোকার হদ্দ হয়েছে।
ছুটির দিন মানেই সামিরের কাছে বিছানায় একটু বেশি সময় পর্যন্ত গড়াগড়ি করা, দেরি করে নাস্তা খাওয়া আর বন্ধুদের সাথে আলসেমি ভরা আড্ডা। কিন্তু আজ সাতসকালে আয়ানের ফোন পেয়ে সব কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। মোড়ের মাথার পুরনো সেই চায়ের দোকানে বসে আছে সামির আর আয়ান। সামির চেয়ারে ঠেস দিয়ে দোকানির দিকে চেঁচিয়ে উঠল,
— “মামা, কড়া করে এক কাপ চা চাও তো।” তারপর আয়ানের দিকে ঘুরে তাকাল। চোখে কৌতূহল, “কি সমস্যা? সকাল সকাল জরুরী তলব।”
আয়ান গম্ভীর মুখে হাসল,
— “চা খাই, তারপর বলি?”
— “খেতে খেতে শুনি। তোর মুখ দেখে সিরিয়াস টাইপ মনে হচ্ছে। শুকনো মুখে সিরিয়াস কথা শুনতে ভালো লাগে না।”
ঠিক তখনই মামা ধোঁয়া ওঠা চা রেখে গেল। আয়ান কাপটা হাতে নিয়ে একচুমুক খেয়ে বলল,
— “আজকে ওই লোকটাকে দেখেছি।”
সামির ভুরু কুঁচকাল,
— “কে?”
— “নাম কী যেনো? হুম… আজাদ রহমান।”
সামির ঠোঁটের কোণে টান পড়ল।
— “ওই যে সরকারী চাকুরীওয়ালা ব্যাটা? তোর সতা?”
আয়ান থতমত খেল,
— “সতা আবার কী?”
— “সতীনের মেল ভার্সন।” তারপর গম্ভীর সুরে যোগ করল, “যাইহোক, তাকে দেখে সেন্টি খাচ্ছিস কেন? কিছু বলেছে? আই মিন, পড়শীর কথা…”
আয়ান মাথা নাড়ল,
— “না, কথা হয় নাই। সম্ভবত আমাকে চিনেও না।”
— “তাহলে?”
আয়ান চেয়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
— “ব্যাটাকে শক্ত একটা মাইর দিতে ইচ্ছে করছে।”
সামির সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
— “জব্বর প্ল্যান! কী করবি?”
সামিরের কথায় আয়ানের উৎসাহ দ্বিগুন হলো। ভাবল কিছুক্ষণ, মনে মনে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করাল। এরপর সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “একটু ভয় দেখানোই যথেষ্ট।”
— “চল, শুরু করি।”
চায়ের বিল মিটিয়ে দুজন সোজা মার্কেটে গেল। ওখান থেকে দুটো মাংকি ক্যাপ কিনে নিল। দোকানদার অবাক হয়ে ভাবছিল, এই গ্রীষ্মের ঠাডাপড়া গরমের মধ্যে এরা মাংকি ক্যাপ দিয়ে কী করবে? সেদিন সারা দুপুর দুইভাই বাইকে চড়ে ওই ব্যাটাকে ফলো করল। কোথায় যায়, কী করে, কখন ফ্রি থাকে… সারাদিন অবশ্য একলা পাওয়া গেল না। সন্ধ্যার পর নিজের বাড়িতে গেল। এই বাড়িতে বর্তমানে কে কে থাকে, তা ওদের অজানা। বাড়ির সামনে এসে ঝামেলায় পড়ল। শুধুমাত্র এই চাকরিজীবী ব্যাটাকেই একটু টাইট দেওয়ার ইচ্ছে আছে, বাড়িতে এসে বাড়তি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার মানেই হয় না। সামির এক কাজ করল। কয়েকটা ইটের টুকরো তুলে বাড়ির দিকে ছুঁড়ে মারল পরপর কয়েকবার। বাড়ির সামনের দিকটা ফাঁকা বলে সুবিধা হলো, কেউ দেখে ফেলার ভয় নেই।
ব্যাটা ভেবেছিল, পাড়ার ছোকরারা হয়ত এই রাতে দুষ্টুমি করে ছাদে ঢিল ছুঁড়ছে। লুঙ্গি পড়ে গজগজ করতে করতে বের হলো। কেউ নাই! ঠিক তখনই মানকি ক্যাপ পরে অচেনা দুটো ছায়া এসে সামনে পেছনে দাঁড়াল। লোকটা ভয় পেয়ে বলল,
— “কে… কে এখানে?”
সামির কণ্ঠ ভরাট করে হেসে বলল,
— “চিন্তা করো না, আমরা তোমার বন্ধু।”
— “তোমার সাথে আমরা এখন বক্সিং করব, বেবি।”
লোকটা চোখ বড় করে তাকিয়ে রীতিমতো থরথর কাঁপতে লাগল। হঠাৎ আয়ান আবার বলে,
— “প্রস্তুত তো?”
লোকটার কণ্ঠও কাঁপছিল। সামির সামনে এসে হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
— “ভাই আমি কিন্তু বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন। আমি ধরলে আর বাঁচবেন না, আপনাকে যা করার ওই বাদড় করবে। আমি বসলাম।” লোকটা কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে, চোখে ভয়, অস্থির ভঙ্গি। কোথা থেকে হুট করে এই দুটো ছেলে এসে উদয় হয়েছে?
আয়ান সামনের দিকে এগোচ্ছে। সামির সত্যিই পাশে বসে পড়েছে। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে কাহিনী দেখছিল। আয়ান চটপট, চটুল হস্তে লোকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবার ঠাস। সামির পাশ থেকে বলল,
— “অ্যাই মিয়া, একটা হাঁটুর বয়সী ছেলের সাথে পারছেন না? মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। উঠুন, উঠে প্রতিরোধ করুন।”
উনি এইবার যা করলেন তা হচ্ছে, হোঁচট খেতে খেতেই জুতার ফিতার মতো লুঙ্গি ধরে টানাটানি করে পড়ে মরি করতে করতে আঁধারে গা ঢাকা দিল। তারপর ঘরের মধ্যে দৌড়ে দরজায় খিল দিল। ওই দৃশ্য দেখে আয়ান প্রথমে হা করে তাকিয়ে রইল, পরক্ষনেই হো হো করে হেসে উঠল। সামিরও উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
— “ব্যাটা গিনেস বুকে নাম লেখাবে বোধহয়, যেমনে দৌড়াল। তোর বক্সিংয়ের শখ গেল। শালা সামান্যতেই ভয় পেয়ে গেছে। কিছু করলে বোধহয় হার্টফেল করত।”
— “ব্যাটা এই হার্ট নিয়ে বউ পিটাইতো। ভাবতে পারছিস? কী ভয়ঙ্কর!”
— “তোর বউ লুঙ্গি-ম্যানকে ভয় পেয়েছিল, সেটার সুযোগ নিয়েছে। প্রথমেই যদি শক্ত হাতে হাল ধরতে পারত, তবে এদিন দেখতে হতো না।”
আয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “ভাগ্যিস প্রথমে শক্ত হাতে হাল ধরে নাই। ধরলে আমি আজকে পড়শীকে পেতাম কী আর? তবে আফসোসের বিষয় হচ্ছে, বেচারিকে অনেককিছুই সহ্য করতে হয়েছে।”
— “ফর সিওর, এখানে নাবিলা থাকলে এই লুঙ্গি-ম্যানের অস্তিত্ব বরবাদ করে দিত।”
— “তোর দেয় নাকি?”
দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি হাসিতে ফেটে পড়ল। মানকি ক্যাপ দুটো সযত্নে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এটা বেশ উপকারে দিয়েছে। ভবিষ্যতে কাউকে টাইট দিতে গেলে আবার প্রয়োজন পড়বে।
সন্ধ্যার ঘটনা দু’ভাই কাউকে জানাল না। রাতে বাড়ি ফেরার সময় সামির একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। নাবিলা তখন বসার ঘরে বই পড়ছিল। সামির একপলক তাকাল, কোনো কথা বলল না। চুপচাপ ঘরে গিয়ে শার্ট-প্যান্ট বদলাল, তারপর ফিরে এলো।
সোফায় নাবিলার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। কাঁধ ছুঁয়ে চোখ নামিয়ে দিল বইয়ের পাতায়। বলল,
— “সামনে পরীক্ষা আর তুমি এখানে প্রেমের গল্প পড়ছ? দেখি, কী বই পড়ছ? বাহ, প্রেমের উপন্যাস! এদিকে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে আর আমার বউ দিব্যি প্রেমের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
নাবিলা কোনো জবাব দিল না। ঠোঁট শক্ত করে চেপে একটু সরে গেল। চোখ নামিয়ে চুপচাপ বসে রইল। সামির নিজেই এগিয়ে এসে বলল,
— “আমাকে বাদ দিয়ে অন্যকাউকে নিয়ে পড়াশোনা চলছে?”
নাবিলা তাকাল না, শুধু সোফার হাতলে আঙুল চালিয়ে গেল। সামির স্পষ্ট বুঝল, কোন কারনে ওর মনখারাপ। কিন্তু সেই কারণটা কি? না বললে বুঝবে কিভাবে? বাহিরে বের হওয়ার আগে তো বলেই গিয়েছিল, তাই এই বিষয়ে রাগ করার চান্স নেই। সামির মনে করার চেষ্টা করল, সে কি আর কোন অকাম-কুকাম করেছে? এমনিতে নাবিলা সামির দুজনেই থিতু হয়েছে। কেউ বাড়াবাড়ি রাগ কিংবা অতিরিক্ত কিছুই করে না। সামিরের রাগার তেমন কারণ নেই, কারণ নাবিলা নির্ঞ্ঝাট। তবে মাঝেমাঝে নাবিলা যেসব কারণে মান করে তার কারণগুলো সামিরের কাছে সাধারণ মনে হলেও নাবিলার কাছে ভয়ঙ্কর।
তার কাছে নীরবতা সবচেয়ে বড় শাস্তি। বইটা নাবিলার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রাখল। তারপর নরম গলায় বলল,
— “এই যে… কথা বলছ না কেনো? আমি কিছু ভুল করেছি?”
— “আমি চুপ করে থাকলেই তুমি ভাবো, রাগ করেছি। কী আশ্চর্য। রাগ করি নাই, বই পড়ছিলাম তাই চুপচাপ ছিলাম।
সামির হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। নাবিলা সামিরের কাঁধে হেলান দিল। এটা নাবিলার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা; এখানে যে শান্তি পাওয়া যায় সে শান্তি দুনিয়ার আর কোথাও পাওয়া যায় না। এখানে ও আস্ত একখানা সংসার লুকিয়ে রেখেছে। সেই সংসার, যে সংসার মানে শুধু এক ছাদের নিচে থাকা নয়; এই সংসার হচ্ছে প্রিয়জনের কাঁধে হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস ফেলা। নাবিলার চোখে অজান্তেই একটু জল জমে গেল। আজকাল শুধু কান্না পায় অথচ এত ছিঁচকাদুনে ও কখনোই ছিল না। অবশ্য এত স্বর্গসুখের মত সুখের মুখটাও কখনো দেখে নাই; এই কান্না বড্ড সুখের, শান্তির, সমৃদ্ধির। এই কান্না একমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় গত কয়েকবছরের সবকিছু; ঝগড়াঝাঁটি, অভিমান, লুকিয়ে একে অপরকে চাওয়া, চলে যাওয়া আবার হাত ধরে ফিরে আসা। প্রতি দিনের, প্রতিটি ঘটনা ওদের জীবনের গল্পটাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছে। নাবিলা নিজের মধ্যেই ফিসফিস করে ভাবল, “এই মানুষটা আমার পাশে থাকলে জীবনে কীসের অভাব থাকতে পারে? প্রতিটি সকাল, প্রতিটি রাত যদি এভাবেই তার কাঁধে মাথা রেখে কাটাতে পারি… তবে এটাই আমার নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ এবং সার্থকতা।” তারপর সামিরের হাত চেপে ধরে বলল,
— “জানো, আমাদের বাবু হলে আমি ওকে তোমার সব পাগলামির কাহিনী শোনাব।”
সামির অবাক হয়ে তাকাল,
— “আমার পাগলামি? আমি আবার পাগলামি করি নাকি?”
— “একেবারে ফুল-টাইম পাগল তুমি। বলব, ‘তোমার বাবা এত পাগল ছিল; বৃষ্টি খুব একটা পছন্দ করত না অথচ আমি পছন্দ করি বলেই বৃষ্টি নামলে আমাকে নিয়ে ভিজতে চাইত, মাঝেমাঝে বই টেনে নিয়ে লেকচার দিত, আবার রাগ দেখানোর বদলে আদুরে কথায় ভোলাত।’ শুনে ও হাসবে, বলবে, ‘আমার বাবা আসলেই পাগল!’ মজা হবে না? রাত জেগে জেগে আমরা এসব গল্প করব।”
সামির হেসে কপালে হালকা চাপড় দিল,
— “তাহলে আমিও শোনাবো, ‘তোমার মা কত বড়ো জেদি ছিল! সামান্য অভিমানে নীরব হয়ে যেত, আবার একটু আদরে গলে যেত।’ কিছু কথা অবশ্য শোনাবো না, তাহলে অল্প বয়সে পেকে যাবে।”
নাবিলা হেসে ফেলল। সামির নাবিলার হাত দুটো নিজের মুঠোয় বন্দি করে টেনে কাছে নিল। বলল,
— “সব পরে, তার আগে বাবুর মাকে একটু শাসন করা দরকার।”
— “শাসন করবে? আমাকে?”
— “অবশ্যই। কারণ তুমি চুপচাপ থাকলে আমার বুক ধড়ফড় করে। তাই আজ থেকে আইন জারি করলাম। প্রথম আইন হলো, আমার সামনে চুপ থাকা নিষেধ।”
নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হাসল।
— “আর দ্বিতীয়?”
সামির আলতো করে ওর মুখটা উপরে তুলে চোখে চোখ রাখল।
— “দ্বিতীয় আইন, আমি যখন তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইব, তখন ‘না’ বলা যাবে না।”
— “এই আইন মানতে একটু ভেবে দেখতে হবে।”
সামির হ্যাঁচকা টান দিয়ে নাবিলাকে বুকে জড়িয়ে নিল,
— “কোনো লাভ নেই। এই আইন এখন থেকেই কার্যকর।”
নাবিলা মনে মনে কপাল চাপড়াল। বোকার হদ্দটাকে বাবুর কথা বলার পরেও বুঝল না।
সামিরের অজান্তেই নাবিলা কিছুদিন ধরেই ছোট্ট ছোট্ট ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল। কখনও হঠাৎ করে বাবুদের কাপড় দেখাত আবার কখনও বাচ্চাদের খেলনা হাতে নিয়ে আলাপ করত। সামির এসবকে নিছক নাবিলার বাবুপ্রেম ভেবেই উড়িয়ে দিত। তার মাথায় আসেনি, নাবিলা যে সত্যিই নতুন প্রাণের অপেক্ষায় বুক বেঁধে বসে আছে। এভাবেই দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল।
একদিন অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল সামির। টেবিলের ওপর ছোট্ট একটা খাম দেখে কৌতূহলবশত এগিয়ে গেল। তার ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “Surprise for you.” সামির অবাক হয়ে খামটা খুলল। ভেতরে সযত্নে রাখা একটি সোনোগ্রাফি রিপোর্ট। ছবিটা দেখে প্রথমে কিছু বুঝতেই পারল না। চোখ কুঁচকে মনোযোগ দিয়ে দেখতেই বুকের ভেতর হঠাৎ করে ঝড় বইতে লাগল। ছোট্ট একটা দাগ, ছোট্ট একটা স্পন্দন…
নাবিলা তখন পেছনে দাঁড়িয়ে। সামির রিপোর্টটা হাতে নিয়ে স্থির। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে নাবিলার দিকে তাকাল, চোখে উজ্জ্বলতা আর মুখে বিস্ময়কর হাসি। ছুট্টে এসে ওকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরল। ধীরে ধীরে নাবিলার হাত ধরে হালকা কণ্ঠে বলল,
— “নাবিলা এটা সত্যি?”
নাবিলা সামিরের উচ্ছ্বাস দেখে হেসে ফেলল। লাজুক কণ্ঠে বলল,
— “হুঁ।”
নাবিলার কথাটা বলতে দেরি সামিরের বাদড়ের মত লাফিয়ে উঠতে দেরি হলো না। একে একে ওর মুখখানা ভরিয়ে দিল ছোট ছোট শ’খানেক চুমুতে। প্রতিটা চুমুতে সামির ইয়াসির আনন্দ ও ভালোবাসা হিসেব ছাড়াই ঢেলে দিচ্ছে।
সে নিজের আনন্দে আর সহজে থামতে পারল না। বাচ্চার বাবা হওয়ার আগে নিজেই ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গেল। ঘরের চারপাশে লাফালাফি, টেবিলের চারপাশে দৌড়ঝাপ, এমনকি মা-বাবাকে ঘটনা জানানো। কিন্তু তারা তো আগে থেকেই জানতেন। বরং সামির এইমাত্র জানল, সেটা শুনে তাকে নিয়ে সকলে একদফা হাসাহাসি করল। সামির অল্প সময়ের জন্য মুখ কালো করে ফেলল, এত বড় একটা খবর সারা দুনিয়া জেনে গেছে অথচ আক্ষরিক অর্থে যে এই খবরের মালিক তাকেই জানানো হলো না।
সামিরের তুলকালাম কান্ডের সাক্ষী হলো দিনগুলো, মাসগুলো।
নাবিলা অবাক হয়ে দেখে, ওর স্বামী একেবারেই বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে। ছেলে হবে না মেয়ে হবে কেউ জানে না; তাও নাম ঠিক করে রেখেছে।
শুধু নামেই থেমে নেই, খেলনার দোকান থেকে ছোট ছোট গাড়ি, রঙিন বল, টেডি বিয়ার, পুতুল; যা হাতের সামনে পাচ্ছে তাই কিনে নিয়ে আসছে। একদিন তো নাবিলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শপিংয়ে। আজই নাকি তার বাচ্চার কাপড়চোপড় কিনা চাই। নাবিলা যখন একটু লজ্জা পাচ্ছে, সামির তখন গর্বের সহিত সবার সামনে বলছে,
—“আমার বাবুর জন্য কিনছি, কারও কোনো অসুবিধা আছে?”
বাড়ি ভর্তি ছোট্ট জামাকাপড় আর খেলনার স্তূপ দেখে নাবিলা হাসতেও পারে না, কাঁদতেও পারে না।
দিনগুলো এইভাবেই পেরিয়ে যাচ্ছে। সামিরের কর্মকান্ডে সবাই হাসে, গল্প করে, দুষ্টুমি করে… নাবিলা এখন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়। সামির সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। অফিসে থাকাবস্থায় তার প্রথম কাজ হচ্ছে, মিনিটে মিনিটে ফোন দিয়ে নাবিলার খোঁজখবর নেওয়া।
— “খাওয়া-দাওয়া করেছ?”
— “দুপুরে ঠিকমতো বিশ্রাম নিয়েছ?”
— “ওষুধগুলো খেলো তো?”
নাবিলা এই ছেলেমানুষিতে চরম বিরক্ত হয়ে বলে,
— “তুমি কি ডাক্তার, পুলিশ নাকি গোয়েন্দা? এত জেরা করো কেন?”
সামির বিরক্ত হয় না। উল্টো হেসে উত্তর দেয়,
— “আমি আপাতত ফুল-টাইম কেয়ারটেকার, পার্ট-টাইম স্বামী। পরে ফুল-টাইম বাবা হবো। এখন ধমকাচ্ছো তো? ঠিক আছে। আমার চ্যাম্প দুনিয়াতে আসলে আর পাত্তাই দিব না।”
এইতো গেল অফিসে থাকাকালীন কথাবার্তা। বাড়ি এসেও কখনো রান্নাঘরে ঢুকে নিজেই জুস বানিয়ে আনে, কখনো ফল কেটে প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আসে। নাবিলা খেতে চাইলে একরকম জোর করেই খাওয়ায়,
— “ তুমি না খেলে নাই। আমার বাবুর খাবারের প্রতি অবহেলা চলবে না।”
সবমিলিয়ে নাবিলা ভীষণ খুশি। মা-বাবা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, অন্যান্য আত্মীয়রা সবাই খোঁজখবর নিচ্ছে, যত্নাআত্তি করছে। মাঝেমাঝে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে অবাক হয়। এখন আর একা নেই, ওর ভেতরে আরেকটা প্রাণ ধুকপুক করছে। সামির নাবিলার এই আনন্দকে আরও দশগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামিরের প্রতিটা খেয়াল, প্রতিটা যত্নে নিজেকে ভীষণ আপন মনে হয়। সামির শুধু স্বামী না, বন্ধুর মত, অভিভাবকের মত… তার অগোছালো দুষ্টামি, পাগলামি, আরেকদিকে নিখুঁত যত্ন; এমনভাবে করে যেন সবটা তার বাচ্চার জন্য। অথচ গম্ভীর মুখে একেবারে রাজকুমারীর মতো ট্রিট করে নাবিলাকে। সামিরের বাহুডোরে বসে, কিংবা শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেই বুক ভরে যায় একরাশ কৃতজ্ঞতায়।
আজ বিকেলের হালকা রোদ্দুর বারান্দায় গা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ঠিক তখনই অন্বেষার আগমন ঘটল। রেশমা দরজা খুলতেই, আরিহান মায়ের কোল থেকে নেমে “মামী… মামী!” বলে নাবিলার কাছে চলে এলো। নাবিলা ওর গালে চুমু খেয়ে বলল,
— “মামীর রাজপুত্র এসেছে নাকি?”
আরিহান খিলখিলিয়ে হেসে তার ছোট্ট হাত নাবিলার মুখে রাখল। অন্বেষা এসে পাশ থেকে হাসিমুখে বলল,
— “রাজপুত্র না, মামীর জামাই এসেছে।” নাবিলা হো হো করে হেসে উঠল।
অন্বেষার দৃষ্টি নাবিলার স্ফীত পেটের দিকে গিয়ে নরম হলো। নাবিলার পেটের ভাঁজ স্পষ্ট হচ্ছিল, ডেলিভারির সময় একেবারেই সামনে চলে এসেছে। নাবিলা বুঝতে পেরে নিজেও তাকাল। মৃদু হাসিতে চোখে ভয় আর আনন্দ মিলেমিশে আছে। মা হওয়ার উত্তেজনা, আবার অজানা দুশ্চিন্তাও। অন্বেষা এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল।
— “দেখো, একদম চিন্তা করবে না। সবকিছু ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ। আমরা আছি তো। আর এই রাজপুত্রও তার রাজকন্যাকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে তৈরি হচ্ছে।”
নাবিলা হেসে মাথা নাড়ল। দিনগুলো গুনে গুনে কাটছিল। ভয়ও লাগছিল খুব। রাতেরবেলা বিছানায় শুয়ে কখনো হঠাৎ সামিরকে ডেকে বলে,
— “শোনো, আজকে বাচ্চাটা খুব নড়ছে।”
সামির চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে ওর পেটে হাত রাখে অবাক চোখে হয়ে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। ভেতরে তার হৃদয়ের অংশটা লাফাচ্ছে। সামিরের অস্থিরতাও সীমা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। রাতে ঘুম আসত না। নাবিলার পাশেই শুয়ে থাকত, বারবার উঠে দেখত, সব ঠিক আছে তো? কষ্ট পাচ্ছে না তো? মাঝেমাঝেই নাবিলা চোখ খুলে দেখত, সামির কপালে হাত রেখে বসে আছে।
— “তুমি আবার বসে আছো কেনো?”
— “না মানে… যদি হঠাৎ কিছু হয়, আমি যেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন দিতে পারি।”
সামিরের ভেতরের ভয়টা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে সে কোনোভাবে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। একদম গম্ভীর হয়ে বলত,
— “শোনো যদি তোমার সামান্যও কষ্ট হয়, আমি সহ্য করতে পারব না। ডাক্তারকে বলে দেব, সব দায়িত্ব আমাকেই দিতে।” নাবিলা হেসেও চোখের পানি আটকাতে পারত না। বাইরে তখন আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল নতুন একটা অধ্যায়ের অপেক্ষায় পুরো পৃথিবী থেমে আছে।
.
অবশেষে সেই প্রতীক্ষার দিনটি এলো। সামির একবার ঘড়ি দেখে আরেকবার দরজার কাছে ছুটে যায়। সবাই ওকে সামলাতে গিয়ে একপ্রকার হিমশিম খাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই নার্স বেরিয়ে এলেন।
— “অভিনন্দন! আপনাদের মেয়ে হয়েছে।”
সামির প্রথমেই বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল। এতদিনের অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা সব মিলেমিশে আনন্দের ঝড় বইয়ে দিল। ঘরে ঢুকেই দেখল, নাবিলার ক্লান্ত মুখখানা কিন্তু তাতে রাজ্যের প্রশান্তি। পাশে ছোট্ট তুলোর মতো একটা মেয়ে। গোলাপি গাল, চোখদুটো এখনও আধবোজা। সামির নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বিছানার ধারে বসে পড়ল। একহাতে শক্ত করে নাবিলার হাত ধরল, অন্যহাতে মেয়েটার ছোট্ট আঙুল ছুঁয়ে দিল। এই ছোঁয়া অবিশ্বাস্যভাবে নিজের হৃদয়ের স্পন্দনকে ছুঁয়ে যায়। চোখের কোণটা ভিজে উঠল। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা তার মেয়ে! নিজের একটা অংশ!
সামির ইয়াসির মেয়ের নামটা নিজের নামের সাথে মিলিয়েই রাখল, “সাইরা ইয়াশিকা।”
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ২৭৯০