মিঠুর বাবা পর্ব-০১

0
15

মিঠুর_বাবা (১)
নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মৃত বাবাকে চোখের সামনে দেখে আট বছরের মিঠু তার পিছনে ছুটতে শুরু করে। মিঠু ছুটতে ছুটতে ‘বাবা’ বলে ডাকে। তবে মিঠুর বাবা তার ডাক না শুনে অটোতে উঠে চলে যায়। মিঠু কিছু সময় অটোর পিছনে দৌঁড়ে থেমে যায়। এভাবে তাকে ধরা সম্ভব নয়। মিঠু রাস্তার পাশে ক্লান্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার চোখজোড়া তার বাবার চলে যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে। সেই সময়ে মিঠুর বন্ধুরা তার কাছে চলে আসে। রাজু কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,“এই মিঠু তোর মাথা খারাপ হয়েছে? তুই বাবা বলে এভাবে ছুটলি কেন?”

“বাবা…।”
মিঠু মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ বের করতে পারে না। সে বলতে পারছে না। তখন শান্তা বলে,“বাবা মানে? তোর বাবা না তোর ছোটবেলায় মা রা গেছে?”

এই কথা শুনে মিঠু কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। সে তো এটাই জানতো। তার ছোট সময়ে তার বাবা মা রা গিয়েছে। কিন্তু আজ যে সে তার বাবাকে দেখেছে। মিঠু এই কথা বলতে রাজু গুরুত্ব না দিয়ে বলে,“আরে বুঝছি। তোর বাবা নাই বলে তো মনে খুব দুঃখ, তাই তোর মনে হলো তুই তোর বাবাকে দেখেছিস। এটা মনের ভুল।”

“না। আমি সত্যি বাবাকে দেখেছি।”

“তুই তোর বাবাকে কিভাবে দেখবি?
তুই তোর বাবাকে চিনিস? চিনিস না তো। তাকে তো কখনো দেখিসনি।”
শান্তর এই কথায় মিঠুর চোখে তার দেখা লোকটির মুখ ভেসে উঠে। সেই সঙ্গে সেদিন তার বাবা মায়ের যে ছবিটি দেখেছিলো সেটার কথা ভাবে। তার বাবাকে ছবিতে যেমনটা দেখছিলো, এই ভদ্রলোক তেমনই দেখতে। যাকে দেখে কয়েক মূহুর্তে তার মনে হয়েছে, ঐ যে তার বাবা যাচ্ছে। মিঠুর এসব কথায় তার বন্ধুরা গুরুত্ব দেয় না। সে ভুল ভাবছে বলে মজা নেয়। অতঃপর মিঠু তাদের সঙ্গে খেলা বাদ দিয়ে বাড়ি চলে আসে। সে বাড়ি এসে তার মায়ের অপেক্ষা করে। তার মা চাকরি করে। তার অফিস ছুটি হবে বিকাল পাঁচটায়। বাড়ি আসতে সাড়ে পাঁচটা বাজবে। তাই খানিকটা সময় মিঠুকে অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়টা সে চাইলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করে কাটাতে পারতো। কিন্তু আজকে যা ঘটেছে তারপর তার ইচ্ছে করছে না খেলা করতে। তার মন বলছে, সে যাকে দেখেছে সে তার বাবা। তাই মনটা অস্থির হয়ে পড়েছে।

____

মিঠুর মা অফিস শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরে। সে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসতে মিঠু মায়ের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে। মা মিঠুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে পানির গ্লাস হাতে নেয়। এক চুমুকে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে বলে,“দিন কেমন কাটলো আমার বাবাটার?”

“মা আমি আজ বাবাকে দেখেছি।”
মিঠুর মা এই কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। সে বিষ্ময় নিয়ে মিঠুর চোখের দিকে তাকায়। তার কথা পুরোপুরি বুঝতে না পেরে আবার বলে,“কাকে দেখেছো?”

“বাবাকে।”
মিঠুর মুখে এই কথা শুনে মিঠুর মা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,“বোকার মতো কিসব বলছো। তোমার বাবাকে দেখেছো মানে? তাকে কিভাবে দেখবে?”

“মা আমি সত্যি বাবাকে দেখেছি।
সেদিন তোমার লুকিয়ে রাখা বাবার ছবিটা আমি দেখে নিয়েছিলাম। আর আজ সত্যিকারের বাবাকে দেখেছি।”
এই কথা বলে মিঠু পুরো ঘটনা খুলে বলে। এসব শুনে মিঠুর মা পাখি তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। সে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ম্লান কন্ঠে বলে,“না বাবা। তুমি কাউকে দেখোনি।
এটা তোমার মনের ভুল। তোমার এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া কেউ নেই। আমিই তোমার মা আর আমিই তোমার বাবা। তুমি যা দেখেছো সবটা ভুল। শুধুমাত্র ভুল।”
এটা বলে পাখি মিঠুকে বুকে জড়িয়ে অতীতের এক ভয়াবহ স্মৃতি কল্পনা করে। তার স্মৃতিতে সেটা ভেসে উঠতে সে ভয় পেয়ে যায়। সে মিঠুর মাথাটা বুকের মাঝে ধরে রেখে বলে,“আমাদের জন্য শুধু আমরা আছি।”

“তুমি তো আমার মা।
তুমিই বাবা কিভাবে হবে মা?
সবার তো মা আর বাবা একজন হয় না। সবার বাবা, মা আলাদা আলাদা হয়। আমারও তো বাবা আলাদা। আমি তো আজ আমার বাবাকেও দেখলাম।”
মিঠুর এই কথা শুনে পাখি তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। সে ধমকে বলে,“চুপ। আমি বললাম না তুমি তোমার বাবাকে দেখোনি। তোমার বাবাকে কিভাবে দেখবে, সে তো মা রা গেছে। মৃত মানুষ কখনো ফেরত আসে। তুমি কখনো শুনেছো ম রে যাওয়া মানুষ আবার ফেরত আসে?”

মিঠু মায়ের কথা বুঝতে পারে না। তার স্পষ্ট মনে হলো সে তার বাবাকে দেখেছে৷ একদম ছবিতে থাকা সেই ব্যক্তিটাকে। মিঠুর অবুঝ মুখটা দেখে পাখি তার কপালে চুমু দেয়। নিজেকে সামলে নরম গলায় বলে,“তোমার মা তোমাকে ভালোবাসে না মিঠু?”

“হ্যাঁ বাসে।
আমার মা তো আমায় খুব ভালোবাসে। তুমি তো সবসময় বলো আমিই তোমার জীবন। তোমার সব। এটা তো অনেক ভালোবেসেই বলো।”
মিঠু মূহুর্তে সব কথা ভুলে মায়ের প্রশ্নের জবাব দেয়। পাখিও তার কথা শুনে খুশি হয়। সে মিঠুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“মায়ের ভালোবাসা, মায়ের সঙ্গে তুমি খুশি নও?”

“খুব খুশি। তুমি এসব কেন জিজ্ঞেস করছো মা?”

“কারণ আমার তো মনে হচ্ছে তুমি আমার সঙ্গে ভালো নেই। সেজন্য যে নেই তার কথা ভাবছো। তার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছো। রাস্তায় মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজছো।”
এই কথা শুনে মিঠু তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,“না মা। আমি তোমার সঙ্গে খুব খুশি। খুব ভালো আছি। তুমি ভুল ভাবছো মা।”

“আমি ভুল ভাবছি?
তাহলে আমার বাবাটা অন্যকারো কথা ভেবে এমন মুখ করে রাখে কেন?”
এভাবেই কথা দিয়ে মিঠুকে ভুলিয়ে নেয় পাখি। সেই সঙ্গে কথা নেয়, তার বাবার বিষয় নিয়ে আর কোন কথা তুলবে না। মিঠুও কথা দেয় সে আর কিছু বলবে না। তার কাছে তার মা আছে এটাই অনেক। মিঠুকে এভাবে বুঝিয়ে পাখি মনেমনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
____
রাতের খাবার খাইয়ে মিঠুকে বিছানায় শুইয়ে গল্প বলতে শুরু করে পাখি। এভাবেই মায়ের মুখে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে মিঠু। এটাই তার অভ্যাস। তবে আজ তার ঘুম আসছে না। এটা দেখে পাখি বলে,“আজ আমার বাবাটার চোখে ঘুম নাই যে?”

“হ্যাঁ ঘুম আসছে না।”
এটা শুনে পাখি কৌতুহলী হয়ে বলে,“কেন?”

“সত্যি বলবো?
তুমি রাগ করবে না তো?”

“না। রাগ করবো না।
বলো কেন ঘুম আসছে না?”

“শুধু বাবার কথা মনে পড়ছে। তখন রাস্তায় যে তাকে দেখলাম।”
এটা শুনে পাখির মুখটা মলিন হয়ে যায়। সে চুপ হয়ে যায়। মিঠু মাকে এমন চুপ হয়ে যেতে দেখে বলে,“মা তুমি রাগ করেছো? রাগ করো না। আমার সত্যি এজন্য ঘুম আসছে না। তাই বললাম। ও মা তুমি ভীষণ রাগ করেছো? কথা বলছো না কেন মা?”

“না। আমি রাগ করিনি।
আমি আমার বাবাটার উপর রাগ করতে পারি।”
পাখি মনমরা কন্ঠে কথাটা বলে। এটা শুনে মিঠু বুঝতে পারে সে বাবার কথা তুলে মাকে কষ্ট দিচ্ছে৷ তাই বলে,“আমি আর বাবার কথা বলবো না। ঐ ঘটনাও ভুলে যাবো মা। এই তো আমি ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছি।”

এটা বলে মিঠু চোখ বন্ধ করে৷ পাখি মিঠুর কান্ড দেখে ম্লান হাসে। সে মিঠুর কপালে চুমু দেয়। অতঃপর অতীতের কিছু স্মৃতি কল্পনা করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনেমনে বলে,“ও এই শহরে কেন আসছে? কোন কাজে? আবার কী আমাদের দেখা হবে? ভাগ্য বুঝি আমার সঙ্গে এতটাই নিষ্ঠুর খেলা খেলছে? আজ নাহয় মিঠু চুপ করলো। ভবিষ্যতে কী করবে? তাকে আমি কিভাবে বলবো, আমিই তাকে তার বাবার থেকে আলাদা করেছি। সে কী এই সত্যি মেনে নিতে পারবে?”
একটু থেমে মিঠু আবার মনেমনে বলে,“আমার দোষটা কোথায়? আমি তো অজান্তেই কারো গল্পে ভিলেন হয়ে ধরা দিয়েছিলাম। যাতে এই সমাজ আমাকে এই ভিলেন তকমা না দিতে পারে তাই তো সময় থাকতে সরে এসেছি। জানি এজন্য আমার সন্তানের কপালে বাবার আদর জোটেনি। হয়তো এখানে দোষটা আমারই। কিন্তু আমি যদি সেদিন এতবড় সিদ্ধান্ত না নিতাম তাহলে কী সত্যি মিঠুর কপালে বাবার আদর জুটতো? নাকি বাবা, মায়ের কলহে দেখে বড় হতো ও। সেটা ওর জন্য সুখের হতো।”
পাখি এসব ভেবে মিঠুর দিকে তাকায়। মিঠুর এতক্ষণ চোখ লেগে গেছে। পাখি তার নিষ্পাপ মুখের পানে তাকিয়ে মনেমনে বলে,“আমি চাইবো তোমার সঙ্গে এ জীবনে আমার আর না দেখা হোক।”


চলবে,