#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
১.
তিহুর বিয়ে হয়েছে এক বনেদি পরিবারে। ছেলে সরকারি চাকুরিজীবী। মাঝ বয়সী লোকটা তার বাবার থেকে হাতে গোনা কয়েক বছরের ছোট। ঘর,বর কোনোটা নিয়েই তিহুর আপত্তি নেই। আপত্তির জায়গা হলো তার শ্বাশুড়ি মা। তিহু যেদিন থেকে এ বাড়িতে পা রেখেছে সেদিন থকেই বাড়ির সকল কাজের ভার চেপে বসেছে তিহুর কাঁধে। যেন তিনি ছেলে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে বউ নয় কাজের লোক নিয়ে এসেছেন।
এ বাড়িতে তিহু ছাড়া আরো তিন জন বৌ রয়েছে। বয়সের দিক থেকে সবাই বড় হলেও সম্মানের দিক থেকে ছোট। কারণ তার বর মশাই এ বাড়ির বড় ছেলে। তিহু খুব করে সন্দেহ করছে তার বৃদ্ধ বরের হয়তো পূর্বে কোনো বউ ছিলো। হয়তো রোগে আক্রান্ত হয়ে পটল তুলেছে আর নয়তো বুরো বরকে সহ্য করতে না পেরে যুবক কারো হাত ধরে পালিয়েছে। তিহুর মতে দ্বিতীয় কারণটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তিহুর নিজের ও উচিত পালিয়ে যাওয়া। তার বাবার মতো বুদ্ধিমান মানুষ তাকে এই পরিবারে বিয়ে দেওয়ার মতো বোকামি কেন করলো তিহু বুঝতে পারে না। এইতো আজ সকালেই সে বাড়িতে টেলিফোন করেছিল। কল ধরেছিল তার মা। তিহু মায়ের সাথে কথা বললো না। বলবেই বা কেন? কত করে বলেছিল সে তাকে বিয়ে না দিতে। একটু তার কথা শুনলে কি হতো?
বাবার উপর রাগ করতে পারেনা তিহু। তার মতে তার বাবা অন্যসবার থেকে সেরা। হোক সেটা বুদ্ধিতে কিংবা বোকামিতে। তার বাবার বুদ্ধির সেরা উদাহরণ হচ্ছে তিহুকে জন্ম দেওয়া। আর বোকামির সেরা উদাহরণ তিহুকে এক বুরো লোকের সাথে বিয়ে দেওয়া।
তিহু তার বাবার সাথে কথা বললো। কথা বললো কম অভিযোগ করলো বেশি। সে যখন বললো তাকে কেন এমন খারুজ পরিবারে বিয়ে দেওয়া হলো তার উত্তরে তার বাবা জানিয়েছে,
‘ওটাকে খারুজ বলেনা আম্মা। ওটার শুদ্ধ ভাষা হলো বনেদি। তোমাকে খারুজ নয় বনেদি পরিবারে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
বাবার কথার বিপরীতে কথা বলতে পারেনা তিহু। কি বা বলবে? বলেই বা কি হবে? তার বাবা পই পই করে বলে দিয়েছেন,
‘আমাদের বংশের সব মেয়েদেরই বনেদি পরিবার খুঁজে বিয়ে দেওয়া হয়। সকলে মানিয়ে নেয় তাদেরকে নতুন পরিবারে। তোমাকেও মানিয়ে নিতে হবে আম্মা। এ বিষয়ে আর কোনো অবজেকশন শুনতে চাই না আমি। শ্বশুর বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে আসার মতো মহৎ কাজ করলে এ বাড়িতে তোমার জায়গা হবেনা আম্মা। আমার এ বাড়িতে মহৎ ব্যক্তিদের জন্য কোনো জায়গা নেই। তাই বুঝে শুনে কাজ করবেন আম্মা।’
শেষ কথাটায় তাকে আপনি বলে সম্বোধন করা হয়েছে মানে তাকে প্রথম এবং শেষ ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে। তার বাবা একমাত্র হুমকির ক্ষেত্রেই আপনি করে সম্বোধন করেন তাকে।
তিহু মন খারাপ করে জানালার পাশে বসে থাকে। তার রুমের সাথে কোনো বারান্দা নেই। কেবল তার রুমে না। গোটা বাড়িটাতেই কোনো বারান্দা নেই। বাড়ির বাহিরের দেয়ালের রং খসে পড়েছে। বিশ বছরেও রং করা হয়েছে বলে মনে হয় না। বাড়ির স্ট্রাকচার বেশ পুরোনো আমলের। তার শ্বাশুড়ির মুখে শুনেছিল তার শ্বাশুড়ি যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল তখন এ পাড়ায় কেবল এই একটা বাড়িই দালান ছিলো। যেন মহল্লার উপর তিনতলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ। তার শ্বশুর অর্থাৎ তিহুর দাদা শ্বশুর তার জমানো সকল টাকা খরচ করে নাকি দালানটা করেছিলেন।
এসবই তার শ্বাশুড়ির মুখ থেকে শোনা কথা। তিহুর শ্বাশুড়ি একটু জল্লাদ ধরণের হলেও মাঝে মধ্যে চমৎকার কিছু কাজ করে। এই যেমন বিকেল হলেই তিনি তিহুকে নিয়ে ছাদে যাবেন। ছাদে যাওয়ার পূর্বে তিহুর কাজ হচ্ছে এক ফ্লাক্স চা তৈরি করা। চায়ের ফ্লাক্স আর দুটো কাপ নিয়ে তারা ছাদে যায়। পুরো বিকেল চা খেতে খেতে গল্প করবেন তিনি। তার বিয়ের গল্প, কিভাবে তাকে বিয়ের জন্য পছন্দ করা হলো তার গল্প। দিনের ঐ একটা অংশ তিহুর খুব আনন্দে কাটে।
এ বাড়ির আর কারো সাথেই তিহুর সেভাবে কথা হয়নি। তার দুজন ননদ আছে। তারা সকাল হলে কলেজে যায় দুপুর হলে ফেরে। এরপর আর তাদের রুম থেকে বের হতে দেখা যায় না। দুপুরের খাবার, রাতের খাবার তারা রুমে বসেই খায়। কাজের মেয়েটা সময় মতো খাবার রুমে পৌঁছে দেয়। বাড়ির বাকি তিন বউদের কেবল খাবার সময় টেবিলে দেখা যায়। চুপচাপ খেয়ে যে যার রুমে চলে যায়। যেন কারো সাথে কারো কথা বলা নিষিদ্ধ এ পরিবারে। তাদের কখনো রান্নাঘরে দেখেনি তিহু। কৌতুহল হয়ে কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো,
‘এই বাড়ির নতুন বউদের এক সপ্তাহ ধরে সংসারের সকল কাজ কাম সামলানো লাগে। এইডা এই বাড়ির পুরাতন নিয়ম। আপনের শ্বাশুড়ি ও বউকালে এই নিয়ম পালন করছে। আপনের এক সপ্তাহ পূরণ হইলে কাজ ভাগ কইরা দেওন হইবে। তখন আরাম পাইবেন। আর তো কেবল দুই একটা দিন বাকি।’
এমন নিয়মের কথা তিহু আগে কখনো শোনেনি। তাদের পরিবারে এমন নিয়ম নেই। বরং নতুন বউদের এক সপ্তাহ ধরে কোনো কাজ ওভাবে করতে দেওয়া হয়না। সকলে কেমন নতুন বউকে আগলে থাকে সারাদিন। আর এরা? তিহু এ বাড়িতে এসেছে আজ পাঁচদিন। অথচ এখন পর্যন্ত তার কোনো ননদ তার সাথে সেদে এসে কথা বলেনি। আর রইলো তার বরের কথা। তিহু তো তাকে এক পলকের জন্য ও দেখতে পায়নি। লোকটার নাম প্রাণ, প্রাণী এমন কিছু একটা শুনেছিল। ঠিক মনে নেই!
লোকটা গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চতর পদের কর্মকর্তা। ভিষণ ব্যস্ততার জীবন। এতটাই ব্যস্ত তিনি যে কবুল পড়েছেন মোবাইলের মাধ্যমে। ব্যাস ঐ পর্যন্তই। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তাকে কেউ কলে পায়নি। তিহু কোনো মানুষকে বিয়ে করেছে নাকি কলা গাছকে তা সে জানেনা। কিন্তু বর ছাড়া সে দিব্যি সংসার করছে। প্রতিদিন সকাল হলে নাস্তা বানাচ্ছে, দুপুরে দুই তিন পদ রান্না করছে। রাত হলে আবার রান্না করছে। মাঝে বিকেল সময়টাই কেবল সে একটু শান্তিতে কাটাচ্ছে।
তিহুর মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে দুদিন যাবত। তার বিয়ে করা বুরো কলাগাছটা কি কোনো মিশনে গিয়ে পটল তুলেছে? নয়তো বিয়ে করেও একটা লোক এভাবে নিশ্চুপ থাকে কিভাবে? পৃথিবীর কোনো পুরুষ নারীকে অস্বীকার করতে পারে না। সে যতই রসকষহীন হোক না কেন। তাহলে তার বরের ক্ষেত্রে এটা কিভাবে টুপ করে পাল্টে যেতে পারে? নিশ্চয়ই এখানে কিছু ঘটেছে। অবশ্য এমন কিছু হলে তিহু দুঃখ পাবে না। তার দুঃখ পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং নিশ্চিন্তে সে তার বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবে। কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই সে ও বাড়ির গেট পেরিয়ে যেতে পারবে।
______________
তিহুর রুমটা খুব একটা বড় না হলেও ছোট না। রুমটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। তার থাকার জন্য পারফেক্ট। এ রুমের মালিক তার থাকার জন্য সকল ব্যবস্থা করে রেখেই গেছেন। কেবিনেটের এক সাইডে তার কাপড় রাখার জন্য জায়গা করে রাখা। টেবিলের এক সাইড চার প্রয়োজনীয় বই রাখার ব্যবস্থা করা। ড্রেসিং টেবিল পুরোটাই হয়তো তার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রুমের মালিক না থাকায় বিছানাটাও আপাতত তার একার। আর রয়েছে একটা বিন ব্যাগ। আপাতত সেটাও তিহুর আয়ত্তে।
তিহু বর্তমানে রুমের দরজায় খিল এঁটে তদন্তে নেমেছে। আজ সকালে সে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। নাস্তা রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে এসেছে। আপাতত দু এক ঘন্টা সে ফ্রি। এই সময়টুকুর মাঝেই তাকে তল্লাশি চালাতে হবে। রুমের সব ড্রয়ার থেকে শুরু করে কাপড় চোপড় ফাইল পত্র সব কিছুতেই তার তল্লাশি চালানো হয়ে গেছে। এত তল্লাশির পরও সে কোথাও তার তার বর নামক কলা গাছটার কোনো ছবি খুঁজে পায়নি। তবে তার তল্লাশি একেবারে বেফলে যায়নি। সে অবশেষে তার বরের নাম খানা জানতে পেরেছে। নিষ্প্রদীপ হাসান প্রোণো।
তিহু যে তার বরের সম্পর্কে জানতে খুব ইচ্ছুক এমনটা মোটেই নয়। ঐ ব্যক্তির প্রতি তার কোনো টান মোহাব্বত নেই। লোকটার আত্মার শান্তি কামনা করার জন্য হলেও তার নামখানা জানা জরুরী ছিলো। কেবল তাই সে এত কষ্ট করেছে। এখানে অন্যকিছু ভাবার কোনো কারণ নেই।
তিহুর হাতে থাকা ফাইলে প্রোণোর একাডেমিকাল সকল সার্টিফিকেট যত্ন করে রাখা। তিহু বর্তমানে সেগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
লোকটার জন্ম উনিশশো একানব্বইয়ে। হিসেব করলে এখন তার বয়স দাঁড়ায় তেত্রিশ বছর। তিহুর মনটাই খারাপ হয়ে যায়। সে তার সকল বন্ধুবান্ধবদের জানিয়েছে তার বরের বয়স কম হলেও পঁয়তাল্লিশ হবে। চুল দাড়ি সাদা হওয়ার পথে। খুব বেশিদিন বাঁচবে না। বেশি হলে পাঁচ বছর! তারপর সে সংসার ধর্ম বাদ দিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। এসব সংসার ধর্ম তাকে দিয়ে হবেনা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পনেরো বছরেও তার সন্ন্যাসী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না।
চলবে……?