তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-০৫

0
16

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.
এ মুহূর্তে যদি তিহুর মাথার উপরের কংক্রিটের ছাদ উড়ে যায় তাও তিহু অবাক হবেনা যতটা সে এত রাতে কল আসায় হয়েছে। তার উপর ফোন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ”স্বৈরাচার বর” নামখানা। তিহুর চোখে লেগে আসা ঘুম তখনই উধাও হয়ে গেছে। তবে একদিক থেকে তিহু স্বস্তি পেল। তার বর অন্তত কাপুরুষ নয়। কিভাবে সে তার বন্ধুসমাজে বলতো তার বরের কাপুরুষ হওয়ার কথা?

তিহু তার কাঁপতে থাকা হাতেই কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই সে চটপটে বলে ওঠে,

‘এত রাতে কি চাই? এটা কল করার সময় হলো?’

প্রোণো হয়তো একটু চমকালো। প্রথমেই কেউ এভাবে আচরণ করতে পারে বলে ধারণা ছিল না তার। তবে মানিয়ে নিতে খুব একটা সময় নেয় না সে। ফিরতি প্রশ্ন করে বলে,

‘রাত ছাড়া কখন তাহলে? তোমার মনে হয়না রাতটাই উপযুক্ত সময় একজন স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে কল করার?’

তিহুর গুছিয়ে রাখা কথারা যেন গলায় বিঁধে গেলো। কি সাংঘাতিক! এ লোক তো পাক্কা প্লেবয়। চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়েকে টুপ করে বিয়ে করে নিলো। দেখা, সাক্ষাৎ, যোগাযোগ সব বন্ধ করে সপ্তাহ পার করে দিয়ে এখন এসেছে কিনা উপযুক্ত সময়ের হদিস দিতে!

‘হ্যালো?’

প্রোণো ফোনের ওপাশ থেকে তিহুর উত্তরের অপেক্ষা করছে। কিন্তু তিহু উত্তর সাজাতে পারছে না। তার গোছানো কথা এলোমেলো হয়েছে মানুষটার স্পষ্ট পুরুষালী কন্ঠে। কোনো এক অদৃশ্য হাত গলা চেপে ধরে আছে তার।

‘তিহু? ঘুমিয়ে পড়েছ?’

তিহু জবাব দিলো না। শক্ত হয়ে বসে রইলো। প্রোণো খানিক অপেক্ষা করলো পরক্ষণে টুট শব্দে কল কেটে গেল।
কল কাটার পর তিহুর আক্ষেপের শেষ রইলো না। নিজের বোকামির জন্য নিজের গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পর দিতে মন চাইলো। এভাবে কেউ সুযোগ হাতছাড়া করে? এখন কাল সে কিভাবে ভার্সিটিতে যাবে?
রাগে দুঃখে তিহুর দু চোখ বুজে ঘুম আসতে চাইলো। অতিরিক্ত দুঃখ কিংবা রাগ হলে তিহুর ঘুম ভালো হয়। তার এই স্বভাবের জন্য তার বাবা কতবার যে তার ঘরের দরজা ভেঙেছে তা বলার বাইরে। বিয়ের আগের দিনও তেমনটা হলো। বিয়ে করবেনা বলে দু দফা কান্নাকাটি শেষেও যখন কোনো ফায়দা হলোনা তিহু তখন অতি শোকে পাগল প্রায়। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে নিজেকে ঘর বন্দি করলো। বেলা পেরিয়ে গেলেও যখন তিহু ঘরের দরজা খুললো না তখন কান্নার রোল পরে গেল। তিহুর মা কাঁদতে পারেন না। দু এক মিনিট কাঁদলেই ফিট হয়ে পরেন। সে আর এক বাজে অবস্থা। তিহুর কাজিনেরা সবাই দা, কোদাল যে যা পেল তা দিয়ে দরজা ভাঙল। এসব কিছুর প্রভাবও তিহুর উপর পরলো না। কারণ সে কানের মাঝে হেডফোন গুঁজে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে তখন।

তিহু আর পেছনের ইতিহাস ঘাটলো না। আপাতত তার ঘুম দরকার।

_____________

ঘন অন্ধকার একটা কামড়ায় তিহু শুয়ে আছে। চারপাশ শুনশান নিরব। মাকড়সার জ্বাল ছড়িয়ে আছে পুরো কামরা জুড়ে। তিহুর ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সে শোয়া থেকে উঠতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু একটা তাকে পেঁচিয়ে আছে। খুব শক্ত করে পেঁচিয়ে আছে। তিহু নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই পুরো শরীর হিম হয়ে আসে। মস্ত এক অজগর তাকে পেঁচিয়ে আছে। কুচকুচে কালো রঙের বিদঘুটে সাপটার চোখ দুখো চকচকে সবুজ। অন্ধকারে ও তিহু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সাপটার লকলকে জিভ। যেন শিকার পেয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে জিভ নাড়াচ্ছে। তিহুর গা গুলিয়ে আসে। সে ছটফট করে ওঠে।
ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু এ কি!
সে যে নড়তে পাড়ছে না। কিছু একটা সত্যিই তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। স্বপ্নে দেখা কুচকুচে কালো রঙের অজগরটার মতোই তাকে পেঁচিয়ে আছে। তিহুর চোখ ফেটে জল গড়ায়। সে যেন চিৎকার করে কাউকে বলতে চায় তাকে বাঁচাতে। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। ইস বাবা যদি পাশে থাকত! তিহু খুব করে সেই শক্ত বাঁধন ছাড়িয়ে বের হতে চায়। কিন্তু সে অপরাগ। এক চুলও নড়াতে পারছে না সে শক্ত বাঁধনটাকে। তিহু যখন হাল ছেড়ে নিশ্চুপ হয়ে এলো প্রায়, তখন কানে এলো,

‘উহু নড়ো না! ঘুমাতে দাও।’

তিহুর মস্তিষ্ক চট করে কন্ঠটা চিনতে পারেনা। দু মিনিট সময় নেয়। যখন বুজতে পারে তখন তার চোখ বড় হয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে,

‘এটা কি আপনি প্রোণো?’

‘হুম।’

প্রোণোর কন্ঠ ঘুম জড়ানো। তিহু একটু নড়তে চায়। কিন্তু পুনরায় বাঁধা পায়। প্রোণোর হাত এখনো তার কোমড় জড়িয়ে আছে।
তিহু পুনরায় ফিসফিস করে বলে,

‘আপনি এখানে কি করছেন?’

‘ঘুমাচ্ছি।’

সেটা তো তিহু বুজতেই পারছে। কিন্তু এই লোক এক রাতের মাঝে এখানে এসে পড়লো কিভাবে। তিহুর যতদূর মনেপড়ে সে দরজা লক করেই ঘুমিয়েছিল। তাহলে সে আসলো কিভাবে? এটা আবার কোনো জিন নয় তো? তিহু তার মায়ের মুখে শুনেছে সুন্দরী বিবাহিতা মেয়েদের দিকে জিনদের খারাপ নজর পড়ে। দেখা গেল কোনো বজ্জাত জিনের নজর পড়েছে তার উপর। এখন সে প্রোণোর কন্ঠ নকল করে তিহুকে মেরে ফেলার প্লান করছে। সর্বনাশ!
তিহু যতগুলো দোয়া জানে সব পড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রোণোর মুখের উপর ফু দেয়। ঘুমের ঘরে প্রোণো কপাল কুঁচকায়। জড়ানো গলায় বলে,

‘শান্ত হও তিহু। একটু ঘুমাও? সকাল হতে অনেক বাকি।’

তিহু শান্ত হয়। তার সকল সন্দেহ আপাতত দূর হয়েছে। তবে তার ঘুম আসলো না। সে তার কোমরে পেঁচিয়ে থাকা প্রোণোর সুগঠিত পুরুষালি হাতে আঁকিবুঁকি করে। রাতের নিস্তব্ধতায় প্রোণোর নিঃশ্বাসের শব্দ তার কানে বাড়ি খাচ্ছে। তিহু অনুভব করে এই মানুষটার এত কাছে থাকতে তার অস্বস্তি হচ্ছে না। তার গভীর ছোঁয়া ও খারাপ লাগছে না। তিহুর কেমন অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে। সে এই অনুভূতির একটা নাম দেওয়ার চেষ্টা করে। ঠিক কি নাম দেওয়া যায়?

____________

তিহুর সকালে ঘুম ভাঙে সকিনার ডাকে। এ বাড়িতে আসার পর তিহুকে মোবাইলের এলার্মের অপেক্ষা করতে হয় না। রোজ সময় করে সকিনা এসে তার ঘুম ভাঙায়। তিহু ভেবেছে এই উপলক্ষে সকিনাকে একটা উপহার দিবে। লাল রঙের একটা বাঁশি। সকিনার লাল রং পছন্দ। বাঁশি উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এরপর থেকে সকিনা তার ভাঙা গলা ব্যবহার না করে বাঁশি বাজিয়েই তিহুকে ঘুম থেকে তুলতে পারবে। এতে দু পক্ষেরই সুবিধা। তিহুর কানের হেফাজত হবে আর সকিনার গলার।

তিহু ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে যেতেই খেয়াল করলো রুমে প্রোণো নেই। তিহু ওয়াস রুমে উঁকি দেয়। সেখানেও তার উপস্থিতি নেই। রুমের এক কোনে তার ল্যাগেজ রাখা।
তিহু ফ্রেশ হয়ে এসে প্রোণোর ল্যাগেজ থেকে একটা একটা করে সবকিছু নামিয়ে সুন্দর করে কাবার্ডে সাজিয়ে রাখে।
তার বরের বদনখানা এখনো দেখা হয়নি তার। তিহু এ ব্যাপারে অনেক বেশি এক্সাইটমেন্ট ফিল করছে। কেমন একটা থ্রিলিং ভাইব পাচ্ছে সে। তার বর দেখতে হিরো আলম টাইপ হলেও তার আপত্তি নেই। মানুষটার কন্ঠস্বর আকর্ষণীয়। এজন্য তাকে পুরো পাশ মার্ক দিয়ে দেওয়া যায়।

তিহু রুম থেকে বেরিয়ে যখন ডায়নিং এ গেল তখন তার পা রিতিমত থেমে গেল। তার মাথায় এলোনা আজ কোনো উৎসব কিনা। তাকে তো এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি! বিশাল ডায়নিং জুড়ে পরিবারের সকলে বসে আছে। অধিকাংশ অপরিচিত মুখ। রান্নাঘর থেকে রেমীর ব্যস্ত গলা শোনা যাচ্ছে। প্রান্তিকেও টেবিলে দেখতে পেল তিহু। তার পাশাপাশি চেয়ারে রয়েছে সুদর্শন চার জন পুরুষ। প্রান্তি হেসে হেসে তাদের সাথে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। তিহু লজ্জা পেল এটা ভেবে যে ঐই চারজন পুরুষের একজন স্বয়ং তার বর কিন্তু সে জানে না ব্যক্তিটা কে।
তিহুর কাছে এই মুহূর্তটাকে তার জীবনের চরম অস্বস্তিকর মুহূর্ত বলে মনে হচ্ছে। সে কি একবার চুপে চুপে প্রান্তিকে জিজ্ঞাস করবে,’’মেয়ে? তোমার ভাই ওরফে আমার বর! কোনটা?”

চলবে………..?

(ভুলত্রুটি মার্জনা করিবেন!)