#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৭.
প্রাচীনকালে খাদ্যের অভাব হতো খুব। বিশেষ করে যুদ্ধ শেষে কয়েক বছর ভিষণ অভাবে কাটত সময়। তখন মানুষ খাদ্যের জন্য হিংস্র হয়ে উঠতো। খাদ্যের জন্য হ*ত্যা করা অতি প্রচলিত ঘটনা ছিল তখন। এক টুকরো শুকনো রুটির জন্য রক্ত ঝড়াতে হতো কতেক নিরিহ প্রাণকে।
তিহু কখনো এর পেছনে লজিক খুঁজে পায়নি। হ*ত্যা কেন করতে হবে? পানি খেয়ে দিন কাটালেই তো হয়!
কিন্তু আজ সে উপলব্ধি করতে পারছে। এটা সত্যিই এতো সহজ না। এই যে সে পরপর তিন গ্লাস পানি খেয়েছে। তার ক্ষুধা কোনো অংশে কমেনি। বরং অতিরিক্ত পানি খাওয়ায় বমি পাচ্ছে। গা গুলিয়ে আসছে। এই বুঝি লুটিয়ে পড়লো!
তিহু জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। তার ক্ষধার পরিমাণ মহাকাশ পেরিয়ে যাচ্ছে। তখন তো খুব করে বলেছিল তারা বাইরে খেয়ে নিবে। কিন্তু এখন কি হবে? তার বর মশাই নিশ্চয়ই রেগে আছেন? তাকেও তো খেতে দেয়নি সে। তিহুর গাল ভার হয়ে আসে। অবচেতন মন হুঁশিয়ারি জানায়, সংসার সামলানো কোনোভাবেই সহজ নয়।
‘তিহু?’
তিহু কাঁধ ঘুরিয়ে চায়। প্রোণো আপাদমস্তক ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। শরীর থেকে এখনো টুপ টাপ পানি পড়ছে। পড়নের পোশাক থেকে চুয়ে চুয়ে পানি মেঝেতে গড়াচ্ছে। তিহু বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে দ্রুত টাওয়েল এনে দেয়। কৌতুহলী হৃদয় নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘খেতে দেইনি তাই রাগ করে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছেন?’
প্রোণো প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায়। সরু হয়ে আসা চোখজোড়া হঠাৎ করেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। ঠোঁট কোণে মুচকি হাসি এঁটে বলে,
‘ঠিক ধরেছ! কিন্তু ঝাঁপ দেওয়া মাত্রই মনে পড়লো আমার একমাত্র বউটাও না খেয়ে। তাই তোমায় নিতে এলাম। চলো দুজন মিলে ঝাঁপ দিব। ইন্টারেস্টিং রাইট?
তিহু চট করে সরে দাঁড়ায়। তা দেখে প্রোণো মিটি হাসে। কিন্তু পরক্ষনেই তাকে ভরকে দিয়ে তিহু বলে,
‘এভাবেই যাব নাকি শাড়ি বদলাতে হবে?’
প্রোণো কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে থাকে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল তার বউয়ের শরীরে রক্ত বইছে নাকি নোনতা পানি!
প্রোণো টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। দরজা আটকাবার পূর্বে বলে,
‘ কাবার্ডে একটা প্যাকেট আছে। ওখান থেকে যেটা ইচ্ছা হয় পড়ে তৈরি হয়ে নাও।’
______________
তিহুর বিশাল এক বন্ধুমহল রয়েছে। যাদের প্রত্যেকে সন্ন্যাসী মনোভবের। ভার্সিটির ক্লাসরুম তাদের দেখা পাওয়া যায় খুব কম। ঝাঁকড়া পাতা যুক্ত বট গাছের নিচে কিংবা ক্যান্টিনে খুব সহজেই তাদের খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে সবসময় বিস্তার আলোচনা চলে। আলোচনার বিষয় থাকে পাহাড় কিংবা সমুদ্র। তিহু ছিলো এই গ্রুপের প্রাণ কেন্দ্র। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তিহুর বিয়ের এতদিনেও তার বন্ধুমহলের কেউ তার খোঁজ নেয়নি। বিষয়টা অবশ্যই চিন্তার। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির ক্লাইমেক্স বুঝতে যেয়ে সেসব চিন্তির সুযোগ পায়নি তিহু। কিন্তু এই মুহূর্তে চৈতির কল পেয়ে তিহু কিছুটা চমকিত। কল রিসিভ করতেই চৈতি হৈ হৈ করে জানালো,
‘বেইব ট্যুর প্লান করা হয়েছে। সীতাকুণ্ড যাচ্ছি। যাতায়াত নিয়ে নো চিন্তা সাবের ওর ফ্যামিলি কার এবং ড্রেইভার দুটোই দিচ্ছে। কার বড় আছে সো একটু চাপাচাপি করে বসলেই চলবে। নো চিন্তা বেইব তুই ও যাচ্ছিস। তোকে কিডন্যাপ করার দুর্দান্ত বুদ্ধি দিয়েছে তুহিন। ও হ্যা নীলাও যাচ্ছে। ও এবার ওর বাড়িতে জানিয়েছে তুই নাকি হসপিটালে ভর্তি। তোর দেখাশোনার জন্য ও কিছুদিন তোর কাছে থাকবে।’
একত্রে এতগুলো কথা বলে দম নিলো চৈতি। তিহু তখন ফোন লাউডে দিয়ে প্রোণোর বলা প্যাকেট হাতে উল্টে পাল্টে দেখছে। চৈতির বলা কথা তার কানে ঠিক কতটুকু ঢুকেছে বলা যাচ্ছে না। চৈতি পুনরায় বললো,
‘তোর বুড়ো বরের হার্টে সমস্যা টমস্যা আছে নাকি?’
তিহু কপাল কুঁচকায়। সন্দিহান গলায় বলে,
‘কেন? তা দিয়ে তোর কি কাজ?’
‘না মানে তোকে কিডন্যাপ করলে যদি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়! একটু খারাপ লাগছে আরকি। বেচেরা বিয়ে করেছে কয়েকদিন হলো মাত্র।’
‘অমার হার্ট যথেষ্ট মজবুত আছে শালিকা। অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা জিরো। তবে বউ কিডন্যাপ হওয়ার শোকে পুরোপুরি ডিফেন্স মুডে চলে যেতে পারি!’
প্রোণোর কথায় তিহু চমকে পেছনে তাকায়। প্রোণো তখন ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে টি শার্ট ঠিক করতে ব্যস্ত। মানুষটাকি নিনজা নাকি? কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তিহু একদম উপলব্ধি করতে পারেনি। মোবাইল থেকে চৈতি হেসে জবাব দেয়,
‘এটা কি হুমকি ছিলো দুলা সাহেব? আমাদের তিহুর বুড়ো….’
তিহু চৈতিতে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘চিতল মাছ! অনেক মজা হয়েছে। আমার জোয়ান তাজা বরকে বুড়ো বলে ঠিক কতখানি মজা পাচ্ছিস? সেসব বাদ দিলাম। কাল ক্লাসে বসে কথা হবে কেমন? রাখছি।’
তিহু খট করে কল কেটে দিলো। তার মানইজ্জত বন্যার পানির সাথে ঘুলিয়ে দিলো মেয়েটা। তিহু প্রোণোর দিকে নরম চোখে তাকায়। কিছু বলতে নিলে প্রোণো বলে,
‘কোনো ব্যাপার না। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। বেশি দেরি করলে পুকুরের পানি শুকিয়ে যাবে! তারাতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।’
প্রোণো চলে যেতেই তিহু মুখ বাঁকায়। শেয়ালের মতো চতুর লোকটা। কেমন কাট কাট জবাব দেয়! কথার ভাঁজে সূক্ষ্ম ভাবে তিহুকে অপমান করতেও ছাড়ে না। তিহু এসব কিছু নোট করে রাখবে। লোকটা যখন সত্যিই বুড়িয়ে যাবে তখন সোধ নিবে।
প্রোণোর দেওয়া প্যাকেটে একটা শাড়ি অন্যটা সেলোয়ার কামিজ রয়েছে। হালকা গোলাপি রঙের কামিজ সেটটা বেশ সুন্দর। তিহু না চাইতেও তার বরের পছন্দের অল্প তারিফ করলো। তিহু কমিজটাই পড়লো। সাথে সুন্দর করো অল্প সাজলো। তার রূপের আগুনে গোয়েন্দা সাহেবকে না পোড়ালে ঠিক শান্তি পাচ্ছেনা সে। লোকটা যখন হা হয়ে তাকিয়ে থাকবে তিহু তখন পৈশাচিক আনন্দে তাকে সাইড কেটে হেঁটে যাবে। আহ! একেই বুঝি আত্মতৃপ্তি বলে!
____________
পাবেলকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে তিশা। আপাতত সে বসার ঘরের সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে আছে। তিহু বসার ঘরে যেতেই দেখলো সেখানে বিশাল এক সমাবেশ। তিহু এগিয়ে গিয়ে প্রিমার পাশে দাঁড়ায়। সে কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নেয় এটা সত্যিই প্রিমা কিনা।
‘কি হয়েছে এখানে?’
‘ছোট ভাইয়া অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। ছোট ভাবীকে সে আবারো দিশা বলে ডেকে ফেলছে।’
তিহু অবাক কন্ঠে বলে,
‘সেটা এত গুরুতর কিভাবে হতে পারে?’
‘কারণ ভাইয়ার এক্সের নাম দিশা। যার সাথে ভাইয়ার পুরো ছয় মাসের দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল।’
তিহু মুখ চোখা করে মাথা নাড়লো। তাহলে তো এটা ফাঁসির পর্যায়ের ক্রাইম। ছোট ভাইয়া এখনো জীবন নিয়ে সোফায় শুয়ে আছে সেটাই অনেক।
প্রোণোর গভীর গলা শোনা গেলো,
‘তিশার কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে নে। দরকার হলে পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবি। তাতেও না হলে খাওয়া বন্ধ করে দিবি।’
প্রোণোর কথায় সবাই মিটিমিটি হাসলেও পাবেল ছলছল চোখে তাকালো।
‘ভাইয়া তুমি কিভাবে এ কথা বলতে পারো? তোমার কারণে আমাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে হয়েছে। দিশা থুক্কু তিশা যদি তোমার বন্ধুর বোন না হতো আমি কিছুতেই এই বিয়ে করতাম না।’
প্রোণে এ কথার জবাবে পাবেলকে শান্ত চিত্তে বললো,
‘আর কিছু বলার থাকলে বল তিশা বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর জানা উচিত তোর মনে কি চলছে।’
পাবেলের মুখখানায় আঁধার নেমে এলো। সে অসহায় চোখে তিহুর পানে চাইলো। তিহুর মায়া হলো খুব। সে সান্তনার বাণী ছুঁড়ে বললো,
‘ছোট ভাইয়া চিন্তা করোনা এতো। আমরা মেয়েরা এতটাও জটিল না। একটু বুঝিয়ে বলবে তিশাকে দেখবে ও ঠিক বুঝবে। তবে তোমার একই ভুল বারবার করা উচিত না। পৃথিবীতে কিছু নিষিদ্ধ ভুল রয়েছে। বউকে নিজের প্রাক্তনের নামে ডাকা তার মধ্যে অন্যতম। এটা অনুচিত।’
‘সবাই আমাকেই কেন দোষ দিচ্ছ? আমি একাই কি ভুল করেছি? এই যে সে তার স্বামীর ন্যায় সম্মানিত পুরুষটিকে রুম থেকে বের করে দিল এটা অন্যায় না?’
‘অবশ্যই অন্যায়। এজন্য এরপর থেকে একে অন্যকে রুম থেকে বের করতে হলে তাকে নিজেকেও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। দুজন মিলে বটতলায় গিয়ে দুঃখ বিলাস করবে। কিংবা সদর ঘাট! ওটাও দুঃখ বিলাসের জন্য উপযুক্ত।’
পাবেল হতাশ হয়। এ পরিবারের কেউ তার আপন না। তার দুঃখটাকে কেউ সেরিয়াস ভাবে দেখছে না।
চলবে………..?
(ভুলত্রুটি মার্জনা করিবেন।)