#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৮.
তিহুর মনে আজকাল ছলাত ছলাত করে প্রেম বইছে। দুনিয়ার এত পুরুষের মাঝেও তিহুর চোখ মন সব আটকে আছে প্রোণো নামক মানুষটার প্রতি। তিহু উপলব্দি করে এই শরতের সকালের মিষ্টি পরিবেশের থেকেও সে তার পাশে বসে থাকা তামাটে বর্ণের পুরুষটিকে উপলব্দি করছে খুব। প্রকৃতি প্রেমী তিহু তার প্রকৃতি প্রেম থেকে বেরিয়ে মানবপ্রেমে মজেছে। প্রকৃতি তাতে একটু অসন্তোষ হলো বোধহয়। মন খারাপের মেঘেদের ডেকে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে তার অসন্তোষ প্রকাশ করলো। রিকশায় বসা অবস্থায় টুপটাপ বৃষ্টির ফোটায় ভিজে যেতে লাগলো দুই সদ্য প্রস্ফুটিত প্রেমিক পদ্ম।
‘হুড তুলে দেই?’
প্রোণোর কথা তিহু ঘাড় ফিরিয়ে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। সে ভিজতে চায়। প্রকৃতির দেওয়া অতি সামান্য এই শাস্তি মাথা পেতে নিতে চায়। প্রকৃতিদেবের চোখে চোখ রেখে বলতে চায় ‘আমি আমার জন্য এই পুরুষটির বিপক্ষে প্রেম ঘোষণা করেছি। তোমার যত শাস্তি দেওয়ার দিতে পার। আমি আমার কথা থেকে পিছুপা হব না।’
‘ঠান্ডা লেগে যাবে তিহু। আমরা অন্য কোনো সময় ভিজবো?’
প্রোণোর কন্ঠস্বর নরম। সে আদুরে ভাবে তিহুকে মানানোর চেষ্টা করছে। তিহুর ঠোঁট কোণে হাসি খেলা করে। প্রোণোর চোখে তাকিয়ে গভীর কন্ঠে বলে,
‘আমি যদি আপনার কথা শুনি তাহলে কি আমায় ভালোবাসবেন?’
প্রোণোর টানটান ভ্রুদ্বয় কোমল হয়ে এলো বুঝি। চোখের কোমল দৃষ্টি বিষ্ময়ে পরিণত হয়েছে। সে এই মেয়েটাকে চঞ্চল, গোছালো, বুদ্ধিমতী হিসেবে দেখেছে। এই মেয়েটার এমন কোমল আবেগী একটা রূপ থাকতে পারে বলে কল্পনা করেনি সে। ভালোবাসা বলতে ঠিক কি চাইছে তিহু তার কাছ থেকে? ভালোবাসার সঠিক সংজ্ঞা তার জানা নেই তবে সে তিহুকে চিন্তামুক্ত সুন্দর একটা জীবন দিতে পারবে। এক মিনিট! সে কি সত্যিই চিন্তামুক্ত জীবন দিতে পারবে?
প্রোণো তার বাবা মায়ের মাঝে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক দেখেছে। অন্যান্য পরিবারের মতো তার বাবা মায়ের মাঝে কখনো টুকিটাকি বিষয়ে ঝগড়া হয়নি। বাবা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই যেন তার মা বুঝে ফেলত সে কি চাইছে। তার বাবা বলার আগেই তার মা রোজ সকালে শার্ট আয়রন করে বিছানায় গুছিয়ে রাখতেন। অফিস থেকে আসার সময় হলে পানির গ্লাস হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
তাদের ভিতর কি ভালোবাসা ছিলো? প্রোণোর ঠিক জানা নেই। তার বাবা কখনো তার মাকে খুশি করতে গোলাপ আনেননি। না এনেছেন কোনো দামি উপহার। তার বাবি মাসের শুরুতে হলুদ রঙের খামে কিছু পরিমাণ টাকা রেখে সেটা তার মায়ের বালিশের উপর রেখে দিতেন। খামের গায়ে গোটা অক্ষরে তার মায়ের নাম লেখা থাকতো। মায়ের প্রয়োজনীয় জিনিস মা নিজেই কিনে নিত।
প্রোণো তার বাবা মা কে কখনো একই রিকশায় করে বেড়াতে দেখেনি। তবে প্রতি শুক্রবার এলে তার মায়ের অর্ধেক কাজ তার বাবা করে দিতেন। রান্নার কাজে টুকটাক সাহায্য করতেন।
প্রোণো সঠিক বলতে পারবে না সংসার করতে দায়িত্ব প্রয়োজন নাকি ভালোবাসা।
‘আমি কি অনেক কঠিন কিছু চেয়ে ফেললাম গোয়েন্দা সাহেব?’
প্রোণোর হুশ ফেরে। বৃষ্টির ফোঁটায় তিহু তখন কাক ভেজা। তার নিজের শরীরের শার্টটাও গায়ের সাথে এঁটে গেছে ভিজে। তিহুর ভিজে যাওয়া কোমল মুখটার দিকে তাকিয়ে প্রোণো উদাস হলো। সোজা তাকিয়ে উদাস গলায় বললো,
‘ভালোবাসার সংজ্ঞা কি তিহু?’
তিহু প্রোণোর উদাস মুখখানার দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়,
‘আমার জানা নেই। ভালোবাসতে সংজ্ঞা জানা কি জরুরী?’
তিহুর কন্ঠটাও কি উদাস ঠেকলো? প্রোণো আড় চোখে তাকালো। বৃষ্টির পানিতে তিহুর চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। তবুও কি ভিষণ সুন্দর লাগছে! আচ্ছা সুন্দরের কি কোনো সংজ্ঞা আছে? নাকি সৌন্দর্যটা আমাদের আবেগ? প্রোণো আপাতত সে বিষয়ে ভাবতে চাইছে না। সে পুনরায় তিহুতে দৃষ্টি ঘুরায়। বলে,
‘ওয়াটার প্রুফ কাজল লাগাবে তিহু। কাজল লেপ্টে গেলে তোমায় ভূতের মতো লাগে।’
তিহু জবাব দেয়না। নিশ্চল চোখে অন্যদিক মুখ ঘুরিয়ে থাকে। প্রোণো আহত হয়। সে কি মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেললো? ঠিক কোন কথায় কষ্ট পেয়েছে তিহু?
_____________
তিহু মল থেকেই পোশাক পরিবর্তন করে নিয়েছে। তার দু হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। প্রোণো আপাতত নিজের গেটআপ চেঞ্জ করতে চেঞ্জিং রুমে গেছে। তিহুর পেটে আনুমানিক দুশো ইদুর ছোটাছুটি করছে। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টিতে না ভিজলে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো না। শুরুতেই ব্রেকফাস্ট সেরে তারা শপিং করতে ঢুকতে পারতো।
‘ঠিক ঠাক?’
প্রোণোর দিকে একবার তাকিয়ে তিহু ব্যস্ত গলায় বলে,
‘আপনি যদি মলের সামনের ভ্যানে বিক্রি করা ছেড়া ফাটা পোশাক পড়েন তাহলেও আপনাকে রাজকুমারের মতো লাগবে। এখন চলুন পেট পুজোটা সেরে আসি?’
‘যেতে লাগো। আমি বিল পে করে আসছি।’
প্রোণোর বলতে দেরী হলেও তিহুর উল্টো দিকে পা বাড়াতে দেরী হয়নি। আজ সে কয়েকজন খাদকের খাবার একা গিলে নিতে পারবে।
অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর কথাটার মতোই অতি ক্ষুধায় তিহু কিছুই খেতে পারলো না। দু এক চামচ পাস্তা খেতেই মনে হচ্ছে ক্ষুধা মরে গেছে। ওদিকে প্রোণো একাধারে তাড়া দিচ্ছে,
‘খাবার শেষ করো তিহু। অপচয়কারী আল্লাহর পছন্দ নন।’
‘পার্সেল নিয়ে যাই? বাসায় যেয়ে খাব।’
‘আমার যথেষ্ট টাকা আছে। তোমায় আর এক প্লেট পাস্তা কিনে দেওয়ার ক্ষমতা আছে আমার। এটা শেষ করো। আমি পার্সেলের ব্যবস্তা করছি।’
তিহু কাঁদো কাঁদো ফেস করে পাস্তা তুলে গালে দিল। তার বর সাহেব আসল সমস্যা তো বুঝলোই না উল্টো টাকার গরম দেখিয়ে চলে গেল!
প্রোণো বাড়ির সকলের জন্য পাস্তা নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে সকলকে খুশি দেখালেও তিহু খুশি হতে পারলো না। কারণ প্রোণো সবাইকে বলেছে তিহুর সি ফুড পাস্তা এতই পছন্দ হয়েছে সে না খেয়ে বসেছিল পার্সেল এনে খাবে বলে। প্রোণোর উক্ত কথায় এক মিনিটের একটা হাসির ঝড় বয়ে গেছে বাড়ির উপর থেকে। তিহু তখন থেকেই রুমে গুমোট মুখ করে বসে আছে। তার এমন বুদ্ধের ন্যায় বরটার গোয়ান্দা হওয়ার পেছনের রহস্য খুঁজে পাচ্ছে না সে। ঘুস দিয়েছিল নাকি?
প্রোণোকে সকালের পর বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। তিহু পারলে হারিকেন জ্বালিয়ে প্রতিটা খাটের তলায় ও তাকে খুঁজে আসে। কিন্তু প্রিমা তাকে মাঝপথে থামিয়ে জানিয়েছে,
‘তোমার বর কয়েক ঘন্টার জন্য নিরুদ্দেশ হয়েছেন ভাবী। দিনের আলো ফুরাবার আগে তাকে পাওয়া যাবে না।’
তিহু সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘এমনটা আগেও করেছে নাকি এটাই প্রথম?’
‘প্রতিবার ছুটিতে এলেই এমনটা করে ভাইয়া। মূলত সে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যায়। ভাইয়া বাদে ভাইয়ার সকল বন্ধুরাই ব্যবসায়ী। কাজেই তারা চাইলেই সময় বের করতে পারে যেটা ভাইয়া পারে না। তাই ভাইয়া ছুটিতে এলেই সবাই একত্র হয়। আড্ডা দেয়। কখনো দুই তিন দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তবে এবার যেহেতু তুমি আছো তাই সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরবে বলে মনে হচ্ছে।’
‘কেন মনে হচ্ছে?’
প্রিমা হাসে। বলে,
‘আমার দারুণ সেন্সুয়াল পাওয়ার আছে বুঝলে। আমি মানুষের মুখ দেখলেই চট করে বলে দিতে পারি তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। এই যেমন এই মূহুর্তে তুমি খুব করে জানতে চাইছ ভাইয়ার বন্ধুমহলে কোনো মেয়ে আছে কিনা কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা পাচ্ছ!’
তিহু সত্যিই লজ্জা পেল। প্রিমা থেকে চোখ সরিয়ে কথা এড়িয়ে যেতে চাইলো। প্রিমা তাতে যেন বেশি মজা পেল। সে হাসতে হাসতে বললো,
‘ভাইয়ার বন্ধুমহলে একজন নয় দু দুজন মেয়ে রয়েছে। দুজনই ভিষণ সুন্দরী। তার থেকে বড় কথা দুজনেই সাবলম্বী। ভাইয়ার আবার সাবলম্বী সুন্দরী মেয়ে বেশি পছন্দ কিনা!’
প্রিমা শিষ বাজাতে বাজাতে উপরে উঠতে নেয়। তখন একজন ভাড়াটিয়া ছুটতে ছুটতে এসে জানায়,
‘আমাদের বাথরুমের কলটা ভেঙে গেছে। মিস্ত্রী ডাকেন। ঠিক না করলে গোসল করবো কোথায়?’
প্রিমা খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো,
‘মিস্ত্রী লাগবে না আমি ঠিক করে দিচ্ছি চলুন।’
প্রিমা নিচে নেমে গেল। রেখে গেলো একরাশ চিন্তায় জর্জরিত তিহুকে। প্রোণো তাকে কিছু না বলে চলে গেল কেন? সে কি তিহুর আড়ালে অন্য মেয়েদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে? তিহুর মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। লোকটা তাকে ভালো না বাসুক চিট করার চিন্তা করলো কিভাবে?
তিহু তৎক্ষণাৎ প্রোণোর নম্বরে কল লাগালো। ফোন হয়তো হাতেই ছিল তাই দু বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো।
‘হ্যা তিহু বলো।’
‘কোথায় আপনি?’
‘আমি মিরপুরের ১ এর দিকে আছি। দুঃখিত তিহু, দুপুরে ফিরতে পারছি না।’
‘আপনার সাথে আর কে আছে?’
‘আমার কিছু ফেন্ডস।’
‘আচ্ছা।’
তিহু খট করে কল কেটে দিলো। তারমানে প্রিমা যা বলেছে সব সত্যি। প্রোণো সত্যিই তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে। সেখানে রূপবতী দুজন কালসাপ ও রয়েছে!
___________
‘সাকিল ভাই শুনলাম আপনাদের বাথরুমের কল ভেঙে গেছে?’
সাকিল লুঙ্গি পড়া অবস্থায় বাথরুমে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছিলো। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল। মা কে নিয়ে ডাক্তার চেম্বারে যাবে। ডাক্তার চেম্বারে বসেন দুপুর তিনটার পর থেকে। এখন ঘড়িতে দেড়টা। গোসল করতে এসে পানির কল ঘুরাতেই তা খুলে হাতে চলে এসেছে। ভয়ংকর এক পানির ঝাপ্টা খেয়ে পানির মেইন লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। মা কে পাঠিয়েছিল বাড়িওয়ালাকে এ কথা জানাতে। পানির কল লাগানোর মতো ব্যাসিক কাজটা সাকিল জানে না। উদোম শরীর নিয়ে সে বাথরুমেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু মিস্ত্রীর পরিবর্তে বাড়িওয়ালার মেয়েকে সে আশা করেনি। তাছাড়া এই মেয়েটাকে দেখলেই ভয়ে তার বুক ধুকপুক করে। কেমন একটা রহস্যের ভাব আছে এর মাঝে।
‘শরীরে কিছু জড়ান সাকিল ভাই। এমন উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে থাকাটা লজ্জার।’
প্রিমাকে দেখে মনে হলো না সে লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা পেলে কেউ সরাসরি চোখে তাকাতে পারে না। কিন্তু প্রিমা তাকিয়ে আছে। সাকিল লজ্জা পেল। সে চোখ ঘুরিয়ে শরীরে গামছা পেঁচালো। থমথমে মুখে বললো,
‘কল আমি লাগাতে পারব। আপনি যেতে পারেন।’
চলবে………
(ভুল ত্রুটি মার্জনা করিবেন।)