তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-১১+১২

0
33

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

১১.
দীর্ঘ এক বর্ষন শেষে প্রকৃতি তার বিক্ষিপ্ত হৃদয়কে শান্ত করেছে। এক ঝাঁক সাদা বক আকাশে পাল তুলে প্রকৃতির শান্ত হৃদয়কে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মাঝে মাঝেই শীতল বাতাসে দুলে উঠছে গাছপালা। তিহুর রুমের জানালাটা হা করে খুলে রাখা। সেই খোলা জানালা থেকেই ফুর ফুর করে শীতল বাতাস রুমে ডুকছে। শরীরে কাটা দিচ্ছে বাতাসের স্পর্শ। তিহু তখনো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বিছানায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। প্রকৃতির ঘটানো প্রলয়ের থেকে তার মনের প্রলয় ধ্বংস হানছে বেশি।
প্রোণো পরিবেশ শান্ত হওয়া মাত্রই বেরিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে কাউকে কিচ্ছুটি জানায়নি। তিহুর ধারণা প্রোণো আজ আর বাড়িতে ফিরবে না। এমনটা মনে হওয়ার কারণ খুব স্বাভাবিক। প্রোণো বেরিয়ে যাওয়ার সময় মুখভাব গম্ভীর করে রেখেছিল। তিহুর দিকে একবার ও না তাকিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেছে। বিষয়টায় তিহু জখম হয়েছে ঠিকই কিন্তু অপমান বোধ করেছে বেশি। তিহুর মাথায় অন্য আরো একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। মন বলছে প্রোণো ফিরে এসে কঠিন স্বরে হয়তো তাকে বলবে,

‘তিহু তুমি বাবার বাড়িতে চলে যাও। এমন ভুলবোঝাবুঝির সম্পর্ক আমি বেশিদূর আগাতে চাচ্ছি না।’

তিহু সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেমন কিছু ঘটলে সে কোনো জবাব দিবে না। কিচ্ছুটি শুনতে পায়নি এমন ভাব করে কাটিয়ে দিবে। তিহুর সাথে কি লোকটা কম অন্যায় করেছে? সেসবের যখন শাস্তি হয়নি তাহলে তিহুর একটা অন্যায়ের জন্য এত শাস্তি কেন মাথা পেতে নিবে সে?

_____________

ক্লান্ত পরিবেশ ঝিমিয়ে পড়েছে রাতের আঁধারে। ঝিমধরা সেই পরিবেশকে আলোকিত করতে মাঝ আকাশে ঝকঝকে একটা চাঁদ উঠেছে। বাড়ির সামনের লাইটটা জ্বলছে নিভছে।

প্রোণো বাড়ি ফিরেছে। তাকে দেখেই তিহু উদাস স্বরে গুনগুন করছে। এই যে একজন মানুষ এসেছে তার ঘরে তাতে তার বিন্দু আগ্রহ নেই যেন। প্রোণোকেও আগ্রহী দেখালো না। সে পোশাক পরিবর্তন করে ল্যাপ্টপ নিয়ে বিছানায় বসেছে। তিহু আড় চোখে তাকায়। গানের সুর তুলে বলে,

তুমি অন্য গ্রহের চাঁদ
আমার একলা থাকার ছাদ
তোমার ফেরার সম্ভাবনা
অমাবস্যায় জোছনা ।

‘গান গাইতে চাইলে পুরোপুরি গাও। আমায় খোঁচাতে হবে না। আমি তোমার গ্রহেই আছি।’

তিহু সাহস পায়। জানালা থেকে সরে এসে প্রোণোর মুখমুখি বসে। দু মিনিট সময় নেয় কথা গোছাতে। কিন্তু বলার সময় ঠিক এলোমেলো ভাবে বলে,

‘আপনি প্রিমাকে শাস্তি দিয়েছেন কেন?’

প্রোণো সাবলীল ভাবে জানালো,

‘অপরাধ করলে শাস্তি দিতে হয় যাতে করে দ্বিতীয় বার সেই অপরাধ করার সাহস না হয়।’

‘তাহলে তো আপনিও শাস্তির যোগ্য। নয় কি?’

‘আমার অপরাধ?’

‘নিঃসন্দেহে আমি বাবার বাড়ি থেকে নাচতে নাচতে আপনার বাড়িতে আসিনি। হঠাৎ করে পাওয়া একটা নতুন পরিবারে চট করে মানিয়ে নিতে পারিনি‌। এ পরিবারে আমার আসার কারণটা আপনি। সেখানে আপনি কি করলেন? আমায় পুরোপুরি একা ছেড়ে দিলেন। আমার হাত আঁকড়ে ধরার বদলে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিলেন। এমন একটা পরিবেশে একটা মেয়েকে মানিয়ে নিতে কতটা কষ্ট হয় জানা আছে আপনার?’

কথা বলতে বলতে তিহুর গলা ধরে আসে। এক নাগাড়ে কথা বলার দরুণ হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কিন্তু সে গন্ডগোল করে ফেলেছে। প্রোণোকে এসব বলতে চায়নি সে। সে তো চেয়েছিল প্রোণোকে সুন্দর করে বোঝাতে। কিন্তু কি করে ফেললো? তিহু প্রোণোর দিকে করুন চোখে তাকায়।

প্রোণো অবাক চোখে তাকিয়ে। সে সত্যিই এ বিষয়ে ভাবেনি। তিহুর চঞ্চলতা তাকে বুঝতে দেয়নি ভেতর থেকে সে কতটা অসহায়। নতুন পরিবার,পরিবেশ সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে তিহুর কষ্ট হচ্ছে এটা একবারও তার মাথায় আসেনি।
প্রোণো কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে রাখে। তিহুর চোখে চোখ রেখে বলে,

‘কি শাস্তি দিতে চাও? সবকিছু কবুল।’

দুপুরের ভয়ংকর রূপে দেখা প্রোণো এখন কোমল হয়েছে। এটা বুঝতে পেরে তিহু স্বস্তি পায়। মিষ্টি স্বরে বলে,

‘অপরাধ বুঝতে পেরেছেন তাই শাস্তি মাফ। তবে অনুরোধ রইলো প্রিমাকেও মাফ করার জন্য। আর নয়তো আমি হয়তো কখনো ওর চোখে তাকিয়ে আগের মতো হেসে কথা বলতে পারবো না। আমাদের সম্পর্কের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হবে। এখানে ভুলটা আমাদের উভয়ের ছিল। আশা করছি বুঝেছেন আমি বোঝাতে চাইছি।’

কথা শেষ করে তিহু হেলেদুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তার কাজ শেষ। এখন শান্তিতে এক কাপ চা খাওয়া যাবে। শ্বাশুড়ি মা টা সারাক্ষণ একা একা বসে থাকে। এখন শ্বাশুড়ির সাথে ভাব করার সময়। শ্বাশুড়ির ছেলে অর্ধেক তার হাতে এসে গেছে। বাকিটুকুর জন্য শ্বাশুড়ির সাহায্য দরকার।

____________

আজকাল হুটহাট করে বৃষ্টি নামে। ভিজিয়ে দেয় শহর, রাস্তা ঘাট। খানিক বাদেই মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় ঝকঝকে এক নীল আকাশ। বৃষ্টির শেষে সবুজ গাছপালা গুলো আরো রঙিন হয়ে হয়ে উঠে। রাস্তার ধারের গাছপালা গুলো তাদের নিজস্ব রঙ খুঁজে পায়। শহরের রাস্তা গুলো ও নিজেদের নতুন রূপে আবিষ্কার করে। এই দুর্দান্ত দিনগুলোতে ও কাজের ভার নিয়ে ছুটতে হয় চাকুরিজীবীদের।
তেমনি এক একঘেয়েমি জীবন সাকিলের। সপ্তাহের পাঁচদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা তাকে ছয়তলা ভবনের তৃতীয় তলায় বন্দী হয়ে থাকতে হয়। সেটা ঝড়, বৃষ্টি কিংবা তুফানের সময় হোক না কেন! রেহাই নেই কিছুতে।

পিচঢালা রাস্তার ভেঙে যাওয়া অংশের ফাঁকে ফাঁকে জমেছে পানি। দু একটা গাড়ি খুব দ্রুত আসা যাওয়া করায় মাঝে মাঝেই সেসব কাঁদা পানি আশপাশে ছিটে উঠছে। সাকিল নাক কুঁচকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা তার অপছন্দের একটা সিজন। এই যে চারদিকে কাঁদা পানির ছড়াছড়ি এর মাঝে আয়রণ করা সাদা শার্ট পড়ে বের হওয়া মুশকিল। অফিসে সাদা শার্ট ব্যতীত অন্য রঙের শার্ট পরে যাওয়া তার পছন্দ না। সাদার ভেতর একটা ক্লাসি ভাব রয়েছে যা অন্য রঙের মাঝে নেই। সাকিল তার আব্বাজানকে সবসময় সাদা পড়তে দেখেছে। হাট বাজার থেকে শুরু করে বিয়ে বাড়ি সব জায়গায় সে সাদা রঙের শার্ট পড়তো। সাকিল তখন কৌতুহল হয়ে বলেছিল,

‘আব্বাজান সবাই রঙিন শার্ট পড়ে আপনি পড়েন না কেন?’

তখন সে জবাবে বলেছিল,

‘লাল হলো একটা রঙ। সে নিজ থেকেই লাল। একইভাবে নীল,হলুদ,সবুজ,কমলা, বেগুনি। কিন্তু সাদা তৈরি হয় তিনটা প্রাথমিক রঙের মিশ্রণে। তার মানে এই সাদার মাঝে আরো তিনটা রঙ রয়েছে যা কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু আমি দেখতে পাই।’

ক্লাস ফাইভে পড়া সাকিলের কাছে তার বাবার কথাগুলো বেশ কঠিন বলে মনে হয়েছিলো। তাবুও সে বিষ্ময় নিয়ে বলেছিল,

‘কিভাবে আব্বাজান?’

‘মনের চোখ দিয়ে। সাদা রঙ মোনের খোরাক মিটায়। এর মাঝে কোমলতা আছে যা প্রশান্তি দেয়। এটা প্রশান্তির প্রতিক।’

সাকিল বুঝতে না পারলেও এতটুকু বুঝতে পেরেছিল তার আব্বাজান এই রঙটাকে স্নেহ করেন খুব। তখন থেকে তার ও প্রিয় রঙ হয়ে উঠলো সাদা। যদিও তার মায়ের জন্য সবসময় সাদা পড়া সম্ভব হয়না। বাড়িতে সে কখনোই সাদা পড়েনা। তার মা পছন্দ করেন না। তার আব্বাজান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। সেদিন ও তার শরীরে সাদা রঙের একটা ফতুয়া ছিলো। কিন্তু তারা যখন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হসপিটালে পৌঁছালো তখন তার শরীরের ফতুয়াটার রং ছিল লাল। তখন থেকেই তার মা সাদা রঙটাকে অপছন্দ করেন খুব।

সাকিল প্রায় দশমিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে একইভাবে। একা রাস্তা পার হতে সাহস পায় না সে। আজ রাস্তা পার হওয়ার মতো কোনো সঙ্গী পাচ্ছেনা সে। এত বছরেও সে তার ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসছে প্রায়। সাকিল ব্যস্ত চোখে আশপাশে চাইছে। তখনি পেছন থেকে কেউ তাকে বলে,

‘সাকিল ভাই না?’

কন্ঠটা পরিচিত। সাকিল পিছু ফেরে। হালকা গোলাপি রঙের কামিজ পরিহিত গোলগাল মুখের একটা মিষ্টি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমর সমান চুলগুলোতে বেণী গাঁথা। হাতে বেরঙা ক্যানভাস। সাকিলের ঠোঁটে ছোট্ট হাসির রেখা ফুটে ওঠে। চোখের চশমা ঠেলে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘কেমন আছেন প্রান্তি? অনেক দিন বাদে দেখা হলো! আপনি অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছেন!’

প্রান্তি হাসে। বলে,

‘শিল্পীদের জীবনে সময়ের হিসেব ভিন্ন জানেন না? কখন দিন শেষে রাত নেমে যায় সেটাও আজকাল টের পাই না।’

সাকিল প্রান্তির কথায় হাসে। তা দেখে প্রান্তি কপালে ভাজ ফেলে বলে,

‘আপনি হাসতেও জানেন সাকিল ভাই? প্রিমা যে বললো আপনি অনেকটা ধূসর রঙের মতো। মলিন গোমড়া ধরণের।’

‘ধূসর রঙ মলিন কেন?’

‘কারণ সে হাসতে পারে না। তার মাঝে কোমলতা নেই। সে কঠিন ও না। অনেকটা আপনার মতো!’

সাকিল আবারো হাসে। বলে,

‘আপনি আজ একা যে? আপনার বোন কোথায়?’

‘প্রিমা? বড় ভাইয়ার উপর অভিমান করে নিজেকে ঘর বন্দি করেছে। তাই আমাকে একাই ভার্সিটিতে যেতে হয়েছে।’

‘আপনার বোন অভিমান ও করতে পারে বুঝি!’

এ কথার জবাব দেয় না প্রান্তি। সে সোজা হেঁটে রাস্তা পার হয়। তার সাথে সাথে পা মিলিয়ে সাকিল ও ওপাড়ে যায়। প্রান্তি সাকিলের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আপনি কিভাবে যাবেন? আমি রিকশা নিব।’

‘আমিও রিকশা নিব। আপনায় আগে তুলে দেই?’

প্রান্তি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায়। সাকিল মুচকি হাসে। রিকশা ঠিক করে প্রান্তিকে তুলে দেয়। অপলক চোখে প্রান্তিকে যেতে দেখে সে। এই মেয়েটা ভিষণ মায়াবী। কোনো এক অজানা কারণে এই মেয়েটার আশপাশে থাকতে তার ভালো লাগে। এরা দু বোন দেখতে এক রকম হলেও দুজনের স্বভাবে তাদের অমিল অনেক। প্রিমা মেয়েটা বুদ্ধিমতী। কথা বলার ধরণ ধারালো। প্রতিটা কথা অপর ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করবে। অন্যদিকে এই মেয়েটা ভিষণ কোমল। নরম কন্ঠে কথা বলবে। আর? আর? আর জানা নেই ঠিক কি অমিল আছে তাদের। তবুও! তবুও যেন কোথাও একটা ভালোলাগার সুর রয়েছে।

চলবে…….?

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.
বাগানের সবথেকে সুন্দর ফুলটা চুরি হয়েছে। এক ছোট্ট পবিত্র প্রাণ তিহুর চোখের সামনে থেকে ফুলটা ছিনিয়ে নিয়েছে। ছোট ছোট হাত দিয়ে ফুলটা নেড়ে চেড়ে দেখে চোখের বড় বড় পাপড়ি নাড়িয়ে আদো গলায় প্রাণটা বললো,

‘সুন্দুর।’

তিহু তার থেকেও উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে ওঠে,

‘একদম আমার মতো! নাহ?’

বাচ্চাটার তিহুর কথা পছন্দ হলো না বোধহয়। সে চোখ মুখ কুঁচকে তার মায়ের দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছোট কন্ঠে বলে উঠলো,

‘কোলে!’

বাচ্চাটার মা হেসে তিহুকে বললো,

‘ও অপরিচিত মানুষ খুব একটা পছন্দ করে না। আপনায় কখনো দেখেনিতো তাই এমন করছে।’

তিহুও ফিচেল হাসলো। তার সখের ফুলটা বৃথা চেষ্টায় ব্যায় হলো! বাচ্চা কাচ্চা তার কাছে বিড়াল ছানার মতো লাগে। ভিষণ আদুরে। দেখলেই মন চায় গাল দুটো আলতো করে টেনে দিতে। কিন্তু যখন বাচ্চারা পটি দেখার মতো করে তাকে এড়িয়ে যায় তখন মন চায় হুমকি ধামকি দিয়ে বসিয়ে রাখতে। এই যেমন এখন তার বলতে সখ জাগছে,
‘কোলে আয় নয়তো ঘর ভাড়া দু হাজার বাড়িয়ে দেব!’
বাড়িয়ালার বড় বৌ হওয়ার সুবাদে এতটুকু হুমকি তো দেওয়াই যায়!
তিহু তার মনের কালো চিন্তাকে প্রশ্রয় দিল না। বরং হেসে বললো,

‘বয়স কত ওর?’

‘চার বছর। বয়স হিসেবে ও কথা খুব কম বলে। ওর বাবাও এমন।’

তিহু তৎক্ষণাৎ তার নিজের ভবিষ্যৎ বাচ্চার কথা ভেবে চিন্তিত হলো। বাপ ছেলে যদি এক রকম হয় তিহু হয়তো বাধ্য হয়েই ঘর বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে উঠবে।
প্রোণো তাদের কথার মাঝেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ক্যাজুয়াল পোশাকে তাকে সবসময়ের মতোই দুর্দান্ত লাগছে। তিহু বরাবরের মতোই মুগ্ধ হয়। চাপা গলায় প্রোণোকে বলে,

‘আমি আপনার জীবনে এলাম বলেই আপনার সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত দুধাপ করে আগাচ্ছে। আপনি খুশি তো?’

‘তাই? আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো বিয়ের পর আমি বয়সের আগেই বুড়িয়ে যাচ্ছি!’

কথার পেছনের করা সুক্ষ্ম অপমান তিহু টের পেলেও কিছু বললো না। মানুষের সামনে জবাব দিয়ে সে তার দুর্বলতা অন্যকে দেখাতে চায় না।

___________

প্রোণো তিহুকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বারবার করে বলে গেছে,

‘ক্লাস শেষ হলে আমায় কল করবে। আমি নিতে আসবো। আশপাশেই আছি আমি।’

পরপর দুটো ক্লাস করে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ক্যান্টিনে উঁকি দেয় তিহু। বন্ধুমহলের একটা প্রাণীকেও আজ ক্লাসে পায়নি সে। কোথায় এতদিন বাদে তিহু ক্লাসে আসায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জানাবে তা না করে সবগুলো কোন কোনা কুঞ্চিতে ঢুকে বসে আছে।
ক্যান্টিনে মানুষের ভীড় অনেক। ত্রানের জন্য যেমন লাইন পড়ে ঠিক তেমন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে খাবার নেওয়ার জন্য সকলে। ক্যান্টিনের সিঙাড়া টা তিহুর ভিষণ পছন্দের। কিন্তু এতসব মানুষ ঠেলে, পনেরো বিশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে দশ টাকার সিঙাড়া খাওয়ার রুচি হয় না তার।
চিত্রার ধৈর্য ভিষণ। ক্লাস না করে ফুরফুরে মেজাজে সিঙাড়া কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তিহু সবসময় চিত্রার কেনা সিঙাড়ায় ভাগ বসায়। একজনের খাবারের উপর সবথেকে বেশি হক থাকে তার বন্ধুদের। এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে চিত্রার সিঙাড়ায় কম বেশি সবাই তাদের ভাগ বসিয়ে নেয়।
তবে আজ তাদের কেউ ক্যান্টিনে নেই। তিহু পুনরায় উল্টোপথে পা বাড়ায়। যেতে যেতে চিত্রার ফোনে কল দেয়। কিন্তু চিত্রা তার কল রিসিভ করে না। তিহুর অভিমান হয় ভিষণ। সবাই তাকে কিভাবে ভুলে গেল!

তিহুর অতি পরিচিত বটতলাটাও আজ ফাঁকা পড়ে আছে। আশপাশে পানি জমেছে। কাজেই এখানে মানুষের আনাগোনা কম। তিহু পানি ডিঙিয়ে বটতলায় পা ঝুলিয়ে বসে। জুতো খুলে পাশে রাখে। ঘাসের নরম ডগা তার পায়ের তলায় আচর কাটে। সাথে সাথেই শরীর শির শির করে ওঠে। অদ্ভূত ভালো লাগা ছেয়ে যায়। তিহু চোখ বন্ধ করে নরম ঘাসেদের দুষ্টুমি অনুভব করে। তিহুর মন বলে বন্ধু হীন অলস এই মুহূর্তটাও খারাপ না।

‘মন ভালা না রে তোর
পিরিত ভালা না রে বন্ধু।।
তোর প্রেমে পাগল হইয়া হইলাম কুলহার।’

হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত লিরিক্স শুনে তিহু চমকে চোখ খোলে। চোখ খুলতেই তিহু নাক কুঁচকায়। চিত্রা তার মুখের সামনে দশ পাটি দাঁত খুলে বসে আছে। পাশেই তুহিন গিটারে টুংটাং করে সুর তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাবেরের গানের সাথে তাল মিলাতে পারছে না। নীলা কিছুটা দূরে নাক কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্ত গলায় বলছে,

‘এই পানি কাঁদার মধ্যে কি করিস তোরা? ভালো জায়গা চোখে পড়ে না? ছিঃ! আমি এর মধ্যে আসতে পারবো না।

নীলার কথার উত্তরে সাবের বলে,

‘বন্যেরা বনে সুন্দর আর নীলাচল কাঁদায়! কাঁদা একবার মুখে মেখেই দেখ না! তোর রূপের ঝলকে ক্যাম্পাস ঝকঝক করবে।’

তিহু সবার দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে ওঠে,

‘তোরা এখানে কেন? একা কি ভিষণ সুন্দর প্রকৃতি ফিল করছিলাম। দিলি তো সব পন্ড করে! কি চাই ঝটপট বলে বিদায় হ।’

‘ওয়েট ওয়েট বেইব! এত তাড়াহুড়ো কিসের হুহ! সুন্দর জামাই পেয়ে এভাবে পাল্টি মারলে কেমনে চলবে?’

চিত্রার কথায় সুর মেলায় তুহিন।

‘কিরে ঘষেটি তুই না বললি তোর জামাই বুইড়া! এখন তড়তাজা হলিউড স্টার বের হলো কোথা থেকে?’

সাথে সাথেই পাশ থেকে সাবের বললো,

‘আমাদের অন্তত সত্যিটা বলতে পারতি। আমরা তো আর তোর জামাই নিয়া ভাগতাম না। হুদাই তোর ভবিষ্যতের জন্য আহাজারি করলাম!’

তিহু চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে,

‘কেন করেছিস? আমি করতে বলেছিলাম? তাছাড়া আমার হলিউড স্টার জামাইর খোঁজ কোথায় পেলি?’

সবার মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটলো। তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

‘শুধু খোঁজ না আরো অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলছি। রাহা আর তামিমকে আসতে দে তাহলেই বুঝবি।’

তিহু এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এখন দুজনের অনুপস্থিত টের পেলো। সন্দিহান গলায় বললো,

‘কি পাকাচ্ছিস তোরা সত্যি বল তো!’

‘ভুনা খিচুড়ি! তিহুর জামাই স্পেশাল ভুনা খিচুড়ি।’

তিহু বুঝলো এভাবে জবাব পাওয়া যাবে না। তাকে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
রাহা আর তামিম এল খানিক বাদে। তাদের দুহাত ভরা মিষ্টির প্যাকেট। এত মিষ্টি দেখে তিহু পুনরায় কপাল কুঁচকায়। সে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই চিত্রা একটা মিষ্টি বের করে তিহুর গালের সামনে ধরে বলে,

‘নে তোর বিয়ের মিষ্টি খা। তোর জামাইর টাকায় কেনা মিষ্টি তুই না খেলে হয়!’

রাহা তিহুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলে,

‘প্রেম না করে সরাসরি বিয়ে করেই কিন্তু জিতে গেছিস। দুলা পছন্দ হইছে খুব। দেবর আছে নাকি?’

তিহু রাহার কথাকে উপেক্ষা করলো। চিত্রাকে বললো,

‘প্রোণোর সাথে দেখা হইছে তোদের?’

সাথে সাথেই সবাই একসাথে চিৎকার করে বলে ওঠে,

‘আচ্ছা! প্রোণোওও !’

তিহু হতাশ হয়। এদের থেকে কিছু জানতে চাওয়া বিপদ। উত্তর দিবে না বরং তাকে নিয়ে মজায় মেতে উঠবে। তামিম মিষ্টি গালে পুরে চিবাতে চিবাতে বললো,

‘বুঝছোস তোর বড়লোক জামাইর পকেট কাটছি আজকে। সবগুলো কাচ্চি খাইছি। আর ক্লাসের সবার জন্য মিষ্টি নিয়া আসছি। ভাবছিলাম পকেটের সব টাকা খরচ করায়ে ফকির বানায়ে ছাড়বো। কিন্তু পরে দেখি ব্যাটায় ক্রেডিট কার্ড ইউজার।’

‘তোরা ওনাকে চিনলি কিভাবে?’

‘কেন তোরে না নামায়ে দিয়ে গেছে। দেইখাই বুইজা গেছি। পরে সূক্ষ্ম ভাবে তাকে ফলো করছি। তাকে চমকে দিতে হঠাৎ সবাই সামনে যেয়ে দাঁড়াইছি। কিন্তু ব্যাটার বুকের পাটা অনেক। এতজনকে তার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে ভয় তো পায়নি উল্টো চোখ কুঁচকে বলছে,’কোনো সমস্যা? আমার হাতে সময় কম। কিছু বলার থাকলে দু মিনিট সময় দিচ্ছি। কথা শেষ করো কুইক!’
তারে ভয় দিতে যেয়ে আমারাই আতঙ্কে পড়ে গেছি ভাই! এই ব্যাটার সাথে সংসার করতেছিস তাই তোকে সবার পক্ষ থেকে সালাম।’

চলবে……?