#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৩.
আকাশে রোদ নেমেছে। সূর্যি মামা বেশ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝ আকাশে। টানা দুদিন বৃষ্টি শেষে তার আগমন বেশ জমকালো ভাবেই ঘটলো। ‘শঙ্খচুর’ বাড়ির প্রধান ফটক হা করে খোলা। এ বাড়ির প্রধান ফটক বিশেষ কারণ ছাড়া খোলা হয়না। তবে আজকের কারণটা একটু বেশিই বিশেষ। এ বাড়ির কর্তা সাহেব খানিক পূর্বে হাঁপাতে হাঁপাতে কল করে জানিয়েছেন তিনি খুব সমস্যায় পড়েছেন। বড়োসড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তার সাথে। প্রধান ফটকটা যেন খুলে রাখা হয়। তখন থেকে বাড়ির দুজন কাজের ছেলে প্রধান ফটক খুলে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চোখে লুটপাট খাচ্ছে কৌতুহল। কর্তা সাহেবের সাথে ঠিক কি ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেছে জানতে বেজায় কৌতুহল তারা।
তাদের কৌতুহল দমাতেই কিছুক্ষণের মাঝেই কয়েকজন মানুষ পাঁজা কোলে করে এনায়েত তালুকদারকে প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে নিয়ে চেয়ারে বসালেন। কাজের ছেলেগুলো দৌড়ে এলো। ব্যস্ত গলায় বললো,
‘ও আল্লাহ! চাচা সাহেবের কি হইছে? এস্টোক করছে?’
এনায়েত তালুকদারকে নিয়ে আসা লোকদের মধ্যে একজন বললো,
‘না মিয়া অত কিছু ভাবার দরকার নাই। বাজারের রাস্তায় কাঁদায় পিছলা খাইছে। বয়স হইছে না! এখন কি আর বৃষ্টি কাঁদায় একা একা চলতে পারে? পানি দিয়া গোসাল করাই মাথায় তেল পানি দিয়ে ঘুম পড়ায়ে রাখলে কালকের মধ্যেই সুস্থ।’
অপমানে এনায়েত তালুকদারের মুখ থমথমে। বাজার ভরা মানুষের সামনে তার ইজ্জত চলে গেল। তার উপর এই অধমগুলো এমনভাবে তাকে বয়স্কের উপাধি দিচ্ছে না জানি একশ পার করে ফেলছে সে!
এনায়েত সাহেব হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। থমথমে মুখ নিয়ে বললেন,
‘আমার আম্মাজানের বয়স ছিয়াশি বছর আট মাস। আমার আম্মা আমার থেকে সতেরো বছর তিন মাসের বড়। আমি এখনো দশ গ্রাম ঘুরে খেতে পারি। তোমাদের আমার বয়স নিয়ে ভাবতে হবে না। দু চার পয়সা যা লাগবে বলো দিয়ে দিচ্ছি। খুশি মনে বাড়ি যাও।’
লোকগুলোর মধ্যে একজন পুত করে পানের পিক ফেলে বড় করে হাসলেন। বললেন,
‘আমি কিন্তু আপনেরে দেইখাই বুইঝা গেছি আপনের বয়স বেশি না। তয় দুইশো টিহা কইরে দেলেই চলবো।’
এনায়েত সাহেব থমথমে মুখে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দেন। ভিজে যাওয়া ওয়ালেট দেকে দুশো টাকার তিনখানা নোট বের করে তাদের দিকে বাড়িয়ে দেন। বলেন,
‘বাজারের ব্যাগ গুলো ঘরে তুলে দিয়ে আসো। যে কয় পয়শা নিচ্ছো তা সৎ ভাবে নাও। পরকালে জবাব দিবা কি?’
‘আপনে না কইলেও এইটুকুন করতাম। পরকালের চিন্তা না কইরা এক বেলার ভাত গালে তুলবার পারি না। এ সাদ্দাম নে ব্যাগ ধর!’
এনায়েত সাহেব পাঞ্জাবির হাতায় চশমা মুছলেন। চশমা পুনরায় চোখে পড়তে যেয়ে তার মুখ থেকে ‘’চ’ বেরিয়ে এলো। দুদিন আগেই নিউ মার্কেট থেকে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে এনেছেন চশমাটা। আজই প্রথম পড়ে বেরিয়েছিলেন। নতুন মেয়ে জামাই আসবেন বলে নতুন পাঞ্জাবি নতুন চশমা পড়ে বাজার করতে বেরিয়ে কাঁদা পানি মেখে চশমা ভেঙে বাড়িতে ফিরলেন। তার কপালটা এমন ফুটো হলো কবে থেকে!
এনায়েত সাহেব চশমা পাঞ্জাবির বুক পকেটে রেখে বলেন,
‘আজ আমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন আছে। দুপুরে ভরপেট খেয়ে যেও।’
‘সাহেব কিছু মনে না করলে পোলাডারেও আনতাম!’
এনায়েত সাহেব চোখ মুখে স্পষ্ট বিরক্তি এনে বললেন,
‘ছেলে মেয়ে সবাইকেই নিয়ে এসো। মেয়ে আর বাদ থাকবে কেন!’
সবার মুখ আল্লাদে গদগদ হলো। কিন্তু এনায়েত সাহেব তাতে নাক কুঁচকালেন। বিরবির করে বললেন,
‘সুবিধাবাদির দল!’
_______________
তরতর করে বাড়তে থাকা রোদের তাপে ঘেমে একাকার তিহু। গায়ের ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে কোনোরকম মুখ আড়াল করেছে সে। রাস্তার পানি এখনো শুকায়নি কিন্তু রোদের তেজ দেখলে মনে হচ্ছে এ যেন জৌষ্ঠের উত্তপ্ত প্রহর। তিহুর ফর্সা মুখ খানা রক্তিম হয়ে উঠেছে। চিত্রা তা দেখে দুষ্টু গলায় বলে,
‘তোর বর মশাই কেমন মানুষ বল তো? কোথায় দিনে তিন বেলা নিয়ম করে বউয়ের নরম গালে টুপটাপ চুমু খাবে তা না করে রোদে পুড়িয়ে কয়লা বানাচ্ছে। বলি পোড়া ত্বকে কি ভিটামিন বেশি নাকি রে?’
তিহু হিসহিসিয়ে চিত্রার মুখ বন্ধ রাখতে বলে। মেয়েটার মুখের কথা আর কামানের গোলা সমান। কথা বলতে বলতে দিক হারিয়ে ফেলে। প্রোণোর সামনে কি না কি বলে ফেলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
‘বেইব বিয়ে করে তুই কেমন পানসে হয়ে গেছিস। আজকাল ক্লাসের যে ওভার আপডেট মেয়েগুলো আছেনা? ওরা ক্লাবে ট্লাবে যাচ্ছে। লাল নীল পানি খেয়ে নাচানাচি করে। ছবি তুলে তা আবার ডে দিচ্ছে সব ইংলিশ গান লাগিয়ে। বলি চলনা আমরাও একটু নাচানাচি করে আসি। তোর পানসে জীবনটা একটু রঙিন হোক!’
তিহু ঘোমটার আড়ালে চোখ রাঙায়। তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
‘তুই যে নষ্ট ফষ্ট হয়ে যাচ্ছিস তা কি তোর গোপন প্রেমিক জানে?’
চিত্রা দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,
‘গোপন প্রেমিককে আমার গোপনতা জানানো মানা। তার আর আমার সম্পর্ক প্রেমিক যুগলের থেকে শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্কের মতো বেশি। রোজ কথা বলা শুরু হয় আমি পড়তে বসেছি কিনা। কয় ঘন্টা পড়ছি। টেস্ট কেমন হচ্ছে ব্লা ব্লা ব্লা। আজ তো সীমা ছাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে বসেছে আমার টেন্সের প্রকারভেদ মনে আছে কিনা? মানে সিরিয়াসলি? আমি প্রেম করছি না পড়াশোনার জন্য ব্যক্তিগত মাস্টার হায়ার করেছি!’
চিত্রার দুঃখে তিহুর মায়া হয় খানিক। মেয়েটা সব দিক থেকে সবার থেকে এগিয়ে থাকলেও পড়াশোনার সাথে তার সম্পর্ক ভারত-পাকিস্থানের মতো। কিছুতেই এই সম্পর্কের উন্নতি হয় না। স্কুলে থাকাকালীন তিহু নিজেই চিত্রাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিল। তিন দিনের দিন কান্না করতে করতে তিহু বাড়িতে ফিরলো। ঠিক কতটা অসহায় হয়ে পড়লে শিক্ষিকা কেঁদে ফেলে!
সেসব ভেবে তিহু ফুস করে শ্বাস ফেলল। চিত্রকে শান্তনা দিতে বললো,
‘দেখ এক দিক থেকে কিন্তু তোর উপকার হলো। তোর ফিউচার ছানা পোনাকে তোর আর কষ্ট করে পড়াতে হবে না। তুই নিশ্চয়ই চাস না তোর ছানা পোনারাও তোর মতো ছাগল হোক! ওদের মানুষ করতে কিন্তু মাস্টার টাইপ এই লোকই যোগ্য পাত্র।’
তিহুর কথা কাজে দিলো। চিত্রা আবেগে ভেসে যেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মহামান্য প্রেমিককে কল লাগালো। রিসিভ হতেই গদগদ স্বরে বললো,
‘আপনি বলেছিলেন না বিয়ে নিয়ে আমার প্লান আছে কিনা? আমি এই মুহূর্তে প্লান করেছি আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। বিশ্বাস করুণ! আপনায় না পেলে মরে যাব টাইপ ফিলিং হচ্ছে। এড্রেস সেন্ড করছি, আপনার বাবা মা কে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসুন। বেশি দেরি করবেন না কিন্তু!’
তিহু তাজ্জব হয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। চিত্রা কথা শেষ করে হাসি হাসি মুখে তাকালো। শুধালো,
‘শোন বেইব গোপন প্রেমিকের সাথে বিয়েটাও কিন্তু গোপন ভাবেই হবে। ইউ আর নট ওয়েল কাম বেইব! বাকিদের বিয়ের ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানাবি না। হঠাৎ একদিন বর সাথে করে এনে চমকে দিব সবাইকে। আইডিয়া দারুন না?’
তিহু বুঝলো এসব আইডিয়া ফাইডিয়া কিছুই না। তিহু না জানিয়ে বিয়ে করেছে তার ই প্রতিশোধ মাত্র। তিহু তা বুঝতে পেরেও সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে গেলো। মৃদু হেসে বললো,
‘তোর জীবন, তোর খুশি। তুই যেভাবে খুশি আমিও সেভাবেই!’
এই চরম মিথ্যা কথাটা চিত্রা নির্দ্বিধায় গিলে ফেললো। তিহু তা দেখে স্বস্তি পায়। তার থেকেও স্বস্তি পায় রাস্তার ওপারে প্রোণোকে দেখে। লোকটা রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। পরনে তার ফরমাল পোশাক। স্কাই ব্লু রঙের শার্টটার হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত তোলা। হাতে সিলভার চেইনের ঘড়িটা সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। কি ভয়ংকর সুন্দর লাগছে! তিহু আপ্লুত হয়। মুগ্ধ নয় তাকিয়ে থাকে। এই যে আলতো বাতাসে তার মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল হলো না। কোমল ত্বকটা রোদের তাপে জ্বলা অনুভব করছে তাও তার নিউরণ টের পেলো না। লেগে আসা কন্ঠে আস্তে করে চিত্রাকে বলে,
‘দেখ ঐ লোকটা আমার বর!’
সে তো জানেই না চিত্রা নামক রমনী খানিক পূর্বেই বিদায় জানিয়ে হুডতোলা রিকশায় চড়ে প্রস্থান করেছে! তিহু সেটা যখন খেয়াল করলো তখন রিকশা তার চোখের সীমানা ছাড়িয়েছে।
প্রোণো রাস্তা পেরিয়ে এসে তিহুর সম্মুখে দাঁড়ায়। আলগা হাতে মাথায় ঘোমটা তুলে দেয়। চিন্তিত গলায় বলে,
‘তোমার রোদে এলার্জি আছে নাকি?’
তিহু মাথা নেড়ে বলে,
‘এলার্জি নেই কিন্তু মুখ জ্বালা করে। লাল হয়ে ওঠে।’
‘সনাস ক্রিম ইউজ করবে। অবশ্যই ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী। কোনো ডক্টর দেখিয়েছ?’
‘উহু।’
‘আচ্ছা কাল যাবে। মা কে সাথে করে নিয়ে যাবে। আমি সিরিয়াল দিয়ে রাখবোনি।’
‘আচ্ছা।’
প্রোণো তিহুকে আগলে ধরে দাঁড়ায়। তিহু তা দেখে মুচকি হাসে। আড় চোখে তার বাবার চাপে পেয়ে যাওয়া সুদর্শন বরটাকে দেখে। মানুষটা প্রতিটা অ্যাঙ্গেল থেকে সুদর্শন। কিন্তু কথা হচ্ছে লোকটা তার পোশাক চেঞ্জ করলো কখন?
চলবে………?
#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৪.
ঢাকার সড়ক গুলো সর্বদা ব্যস্ত। দশ মিনিটের পথকেও বিশাল মনে হয়। জ্যামে আটকে থাকা সময়টুকুও দীর্ঘ। তিহু গরমে হাঁসফাঁস করছে। তারা ছোট এক রাস্তার মোড়ে জ্যামে আটকে গেছে। গাড়ি আসা যাওয়ার জন্য একটা মাত্র লেন থাকায় এই সমস্যা। প্রোণো রিকশা থেকে নেমে তিহুর জন্য আইসক্রিম কিনে এনেছে। তিহু আইসক্রিম খেতে খেতে বলে,
‘আমরা এতদূর কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমার শ্বশুর বাড়িতে।’
‘আপনার শ্বশুর বাড়ি?’
তিহু চোখে প্রশ্ন ঝুলিয়ে তাকায়। প্রোণো মজা করছে বলে মনে হয় না। তার দৃষ্টি সরল। তিহু আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। বিয়ের পর বাবার বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি তার। তার বাবা অবশ্য তাকে কখনো যেতে বলেনি। তিহুর তাই কিছুটা অভিমান হয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে কখনো নিজ থেকে বাবার বাড়িতে যেতে চাইবে না। তবে প্রোণো নিয়ে গেলে তখনও সে যাবে না তা তো সে বলেনি!
‘এই বর! শুনুন না? বলছি আজ হঠাৎ আপনার শ্বশুর বাড়ি কেন?’
‘শ্বশুর দাওয়াত করেছেন। জামাই হিসেবে শশুরের দাওয়াত রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।’
তিহু মুখ ফুলায়। বলে,
‘আপনার দাওয়াত রক্ষা করতে হলে আপনি যাবেন, আমার নিচ্ছেন কেন?’
প্রোণো তিহুর ফোলা গালে আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। মুচকি হেসে বলে,
‘তুমি আমি মিলেইতো আমরা এক সত্ত্বা তাইনা? সেই সূত্রানুযায়ী আমায় দাওয়াত দেওয়া মানেই তোমার দাওয়াত।’
তিহু তার বরের বিচক্ষণতায় হার স্বীকার করে। তবে এই হারে সে অসন্তুষ্ট নয়। বরং ভালোলাগার আবেশে ঘুম ঘুম পাচ্ছে তার। প্রোনোকে আজকাল তিহুর ঘুমের ওষুধের মত মনে হয়। লোকটার আশপাশে থাকলেই ঘুম ঘুম পায়। তার শরীরের কড়া গন্ধ নাকে এলেই তার হাত পা অসাড় হয়ে আসে। ঝিমিয়ে পড়ে তার শরীর। এত দুর্বল সে মানুষটার প্রতি!
তিহু লজ্জা পায় প্রোণোকে তার এই দুর্বলতার কথা জানাতে। আবার কিছুটা ভয়। প্রোণোও কি এমনটা অনুভব করে নাকি সে একাই? সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তিহুর এই চিন্তা ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় টুক করে প্রোণোকে প্রশ্নটা করেই বসতে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু পরক্ষনে তার নাক উঁচু স্বভাবের স্বত্ত্বা তাকে বলে সে নারী হয়ে কেন তার স্বামীকে প্রেমের প্রস্তাব রাখবে? প্রেমে পড়াটা তো পুরুষ মানুষের কাজ। আর তার কাজ তো সেই প্রেমে মায়া বাড়ানো।
তিহু প্রোণোর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে। উদাস স্বরে বলে,
‘বলুন প্রোণো, আপনি কি খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবেন।’
‘কেন? অলরেডি মিস করছো?’
‘প্রশ্নই আসে না।’
প্রোণো হাসে। বলে,
‘আমার কাঁধে মাথা রেখেও সত্যি বলতে ভয় পাচ্ছ তিহু? তুমি নারী ভিষণ দুর্বল! বাঘের অর্ধাঙ্গিনীকে বাঘিনী হতে হয়। সিংহের অর্ধাঙ্গিনী কে সিংহী হতে হয়। তুমি কোনটা?’
তিহু ফিচেল হাসে। বলে,
‘আমি প্যাঁচার অর্ধাঙ্গিনী পেঁচি!’
______________
বাড়িতে ফেরার পর থেকেই তিহু কিছুটা অপরাধ বোধে ভুগছে। এতদিন পর বাড়িতে ফেরার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাচ্ছে সেই অপরাধ বোধের কারণে। সে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। তা দেখে সোহেলি বেগম হাতের খুন্তা দিয়ে তিহুর মাথায় টুপ করে আঘাত করলেন। ধমকে বললেন,
‘এসব খারাপ অভ্যাস এখনো যায়নি তোর? আর কবে বড় হবি বল তো? মানুষজন কি ভাববে? আমাদের কথা বাদ দে, প্রোণোর কথা ভাব! ও দেখলেই বা কি ভাববে? ভাববে আমাদের ঘরের অপ্রয়োজনীয় গাধাটা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি!’
তিহু এসব কথায় কান দিলো না। বরং সে সোহেলির হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
‘মা দেখোনা আমি নাচতে নাচতে তো চলে এলাম কিন্তু ওবাড়ির কাউকে জানিয়ে আসিনি। এটা কেমন হয়ে গেলো না?’
সোহেলি বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত হন। চুলার ভাজি নাড়তে নাড়তে বলেন,
‘তা তো অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। তুমি ও বাড়ির বড় বউ। পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব অনেক বেশি। এসব দায়িত্ব তোমায় বুঝে নিতে হবে। নয়তো সম্পর্কে ভাঙন ধরবে।’
তিহুর মুখখানা ছোট হয়ে আসে। সে ভার মুখ নিয়ে রুমে ফিরে আসে। কিন্তু প্রোণো রুমে নেই। তিহু তার রুমের বারান্দা থেকে উঁকি দেয়। প্রোণো বাহিরে চেয়ার পেতে বসা। তার সাথে আরো অনেকে আছে। বাবা,বড় চাচা, তিন দুলাভাই, দুই ভাই। মোট কথা ছোটখাটো এক সমাবেশ বসেছে নিচে।
তিহু পুনরায় রুমে ফিরে আসে। সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আলাদা রকম প্রশান্তি ভর করে। দু চোখ বুজে আসতে চায়। সেই পরিচিত বিছানা। পরিচিত আসবাব। কি অন্যরকম টান! তিহু এসব ছেড়ে গেছে মাত্র দশদিন কিন্তু মনে হচ্ছে কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে।
খোলা বারান্দা থেকে রোদ আসছে। ঘুমন্ত তিহুর চোখে সে রোদের আলো পড়ায় সে চোখমুখে কুঁচকে নিচ্ছে। কেউ একজন তিহুর শান্তির ঘুমের উপর কুনজর দিয়েছে। তিহু চরম বিরক্ত নিয়ে পিটপিট করে তাকায়। মুখের সামনে প্রোণোর মুখ দেখে চমকে ওঠে। দু একবার চোখের পলক ঝাঁপটে বলে,
‘কি দেখছেন এভাবে?’
‘তোমায় ঘুমালে ফানি লাগে। সেটাই দেখছিলাম।’
তিহু আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। প্রোণো সোজা দাঁড়িয়ে বলে,
‘সবাই খেতে ডাকছে। তোমার বাড়িতে কোথায় তুমি আমায় খেতে নিয়ে যাবে সেখানে আমি তোমায় ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছি খেতে! ফ্রেশ হয়ে নাও দ্রুত।’
তিহু ঘড়িতে সময় দেখে। তিনটা বেজে পনেরো মিনিট। সে প্রায় এক ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। তিহু বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যেতে যেয়েও থেমে যায়। প্রোণো তা দেখে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায় কি সমস্যা।
‘আমাদের এখানে আসার কথা বাড়িতে জানিয়েছেন?’
‘না তো!’
তিহুর মেজাজ সাথে সাথে আকাশ উঠে গেল যেন। সে পারেনা রাগে কেঁদে ফেলে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠায় মুখমণ্ডল ফুলে আছে। সেই ফোলা মুখের রাগী তিহুকে উপন্যাসের পাতায় লেখা লেখকের মায়াবতী নারীর প্রাণবন্ত রূপ বলে মনে হলো প্রোণোর। তিহু সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেললো। হঠাৎ ঘটা ঘটনায় প্রোণো চমকিত। বিষ্মিত চোখে চেয়ে মায়াবতী নারীর রূপের পরপর বদল দেখলো। সে ঠাওর করতে পারলো না ঠিক কি থেকে কি হয়েছে। তার দৃষ্টি থমকে আছে। মস্তিষ্ক হয়তো বিষয়বস্তু বোঝার তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
‘তিহু কিছু হয়েছে? না মানে আমি কিছু করেছি?’
প্রোণোর কথা ফসলে যাচ্ছে। সে নিজেও জানে না এই মুহূর্তে তার ঠিক কি বলা উচিত। তাকে বিভ্রান্ত মনে হলো। প্রান্তি ভেজা চোখে ভাঙা গলায় বললো,
‘আপনি কি আমায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্লান করেছেন প্রোণো?’
প্রোণো বিস্ময়ের চূড়ায় গিয়ে বললো,
‘তা কেন করতে যাব আমি?’
‘তাহলে এসব ষড়যন্ত্র করে আপনি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন?’
প্রোণো পারে না নিজের মাথা দেয়ালে ঠোকে। সে কখন আর কিভাবেই বা ষড়যন্ত্র করলো! আশ্চর্য! প্রোণো বড় করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। তিহুর হাত টেনে নিয়ে বিছানায় বসায়। নিজে হাঁটু মুড়ে তিহুর সামনে বসে। আলতো গলায় বলে,
‘কেঁদো না তিহু। আমায় বুঝিয়ে বলো! ট্রাস্ট মি! আমি কোনো রকম ষড়যন্ত্র বলো কিংবা দুর্নীতি বলো কোনোটাই করছি না। আর তোমায় বা কেন বের করে দিব? তুমি না আমার বউ!’
তিহু কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেলেছে। প্রোণো দ্রুত হাতে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পিঠে মালিশ করে দিতে দিতে বলে,
‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? সব ঠিক আছে তিহু। এই দেখো আমি এখানে আছি!’
প্রোণোর উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আচরণ দেখে তিহু শান্ত হলো খানিক। কিছুটা হময় নিয়ে বললো,
‘আপনাদের ভিতর কি চলছে কিছু জানিনা আমি প্রোণো। আপনারা নিজ থেকে না বললে আমি জানতেও চাইনা। কিন্তু আপনার মা এখন আমার ও মা। তাকে না বলে আমি কিভাবে বাবার বাড়িতে চলে আসতে পারি? এখন হয়তো আপনি আছেন সব ঠিক থাকবে কিন্তু আপনি চলে গেলে? তখন? মায়ের সাথের আমার সম্পর্কটা কি আগের মতো থাকবে? আপনি স্বার্থপরের মতো আচরণ করছেন আসার পর থেকে। আমার কথা কেন ভাবছেন না?’
তিহুর কনসার্ন বুঝতে পেরে প্রোণো আলতো করে তিহুর দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে। আলতো করে দু হাতে পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
‘তুমি ভিষণ লক্ষী তিহু। মা বোধহয় এজন্যই তোমায় এত পছন্দ করেছেন। তোমায় প্রথম যেদিন মা দেখে গেলেন! বাড়িতে ফিরে কেঁদে ফেললেন। তোমার ভিতর নাকি সে তার মায়ের প্রতিফলন দেখতে পায়। আমার নানুমনিও ভিষণ লক্ষী ধরণের বউ ছিলেন নাকি!’
তিহু কান্না বন্ধ করে প্রোণোর কথায় মনোযোগ দিলো। উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘নানুমনির সাথে দেখা করাবেন না?’
‘অবশ্যই! তুমি আমি মিলে একদিন তার কবর জিয়ারত করে আসবো।’
তিহু বুঝলো তিনি আর বেঁচে নেই। খানি মন খারাপ হলো। মানুষটার কথা শুনে সত্যিই তাকে ভিষণ দেখার সখ হয়েছিল তার।
‘তিহু?’
‘হুম?’
‘মায়ের সাথে কথা বলবে?’
তিহু প্রশ্ন বোধক চোখে তাকায়। প্রোণো বলে,
‘তোমায় কেউ ভুল বুঝবে না পাগলী। তোমার বর এতটাও দায়িত্বহীন নয়! আমি সবাইকে জানিয়ে এসেছি। সকিনা মা কে জানিয়েছে। তিনি জানেন আজ আমরা এখানে আসবো। কেবল তুমিই জানতে না। আমি তোমায় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।’
তিহুর মন হালকা হয় খানিক। তবুও কোথাও একটা জড়তা রয়ে যায় যেন। তিহু খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে বলে,
‘একটা কথা বলি?’
‘মায়ের ব্যাপারে এখন কিছু জানতে চেও না তিহু। রাতে বলবো। ফ্রেশ হয়ে এসো জলদি। সবাই অপেক্ষা করছেন।’
কিছু না বলতেই প্রোণো বুঝে ফেলবে ভাবেনি তিহু। কিন্তু প্রোণো বলেছে রাতে জানাবে এতেই সে ভিষণ খুশি। সে বেশ ফুরফুরে হয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। প্রোণো তাকে দেখে হাসে। মেয়েটা এত চঞ্চল! ভিষণ লক্ষীও!
_________________
ছাদে এক রঙিন ফুলগাছের টব এনেছে সাকিল। রোজ নিয়ম করে সে তাতে পানি দিচ্ছে। গাছটার দাম নিয়েছে পাঁচশ টাকা। অফিস থেকে ফেরার পথে ফুটপাতে বসে এক মহিলা গাছ বিক্রি করছিলো। টবটার গায়ে নাম লেখা ছিলো, “রোজভেলি”। সাকিল রোজভেলির গাছ না চিনলেও ফুলটা চেনে। গোলাপের মতো চোখ ঝলসানো রূপ না হলেও বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে এই ফুলের জুরি নেই। এটাকে অনেকে বাগানবিলাস হিসেবেও চেনে। বাড়ির গেটের আঙিনায় রোজভেলি গাছ শোভা পায় খুব। এক সময় অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা কেবল এই গাছ কিনতো। এখন অবশ্য চলতি পথে অনেক বাড়ির আঙিনাতেই রোজভেলি দেখা যায়।
দোকানির মতে কিছুদিনের মধ্যেই গাছে ফুলের কলি আসতে শুরু করবে। কিন্তু সাকিল গাছটা কিনেছে দু মাস পেরিয়েছে। তার থেকে দু হাত লম্বা গাছটায় কলি আসার নাম নেই। এ ব্যাপারে সে খানিকটা চিন্তিত।
‘সাকিল ভাই?’
সাকিল পেছনে তাকায়। ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো প্রিমা। হাতে আধখোলা এক উপন্যাসের বই। তবে তার চোখ জোড়া হাসি হাসি ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাকিল ঢোক গেলে। এই মেয়েটার মাঝে সে অদ্ভূত কিছু অনুভব করে। যা তাকে স্বস্তি পেতে দেয় না।
সাকিল তার এই অস্বস্তি লুকাতেই প্রথমে বলে ওঠে,
‘আপনি উপন্যাস পড়েন বুঝি?’
‘নয় কেন? আমি সাহিত্যের মানুষ। পড়াশোনা করছিস সাহিত্য নিয়ে। মাঝেসাজে সাহিত্য রচনাও করছি। সাহিত্য হচ্ছে আমার গোপন প্রেমিক।’
সাকিল ঘুরে ঘুরে গাছ পর্যবেক্ষণ করতে করতে সামান্য হাসলো। বললো,
‘আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন প্রিমা।’
‘আপনার অপছন্দ বুঝি?’
‘আমার অপছন্দে কি আসবে যাবে?’
‘সে জেনে লাভ নেই। কেবল বলুন আপনার কেমন মেয়ে পছন্দ।’
সাকিল পানির মগ হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,
‘আমার পছন্দের কথাটা গোপন প্রিমা। ওটা প্রকাশে আনা যাবেনা। আমি নিচে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।’
প্রিমার হাসি মিলিয়ে গেল।
‘আমায় দেখলেই পালাই পালাই করেন কেন সাকিল ভাই?’
‘কারণ আপনি ভয়ংকর!’
কথাটা বলে সাকিল থামলো। একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেল না কথাটা? এমনটা বলা কি তার উচিত হয়েছে? আজকাল তার জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে বোধ হয়! সাকিল পিছন ঘুরে প্রিমার দিকে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
‘আপনি ভয়ংকর সুন্দরী প্রিমা। সুন্দরীদের আশপাশে জীন থাকে সবসময়। আমি এসব জীন ভূতে ভয় পাই। তাই সুন্দরীদের থেকে দূরত্ব রেখে চলি।’
কথা শেষ করে সাকিল বড় বড় পা ফেলে নিচে নেমে এলো। ঘরে ঢুকে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। পরিস্থিতি কিছুটা হলেও হয়তো স্বাভাবিক করতে পেরেছে সে!
প্রিমা সাকিলের যাওয়ার পানে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। অভিযোগে ধরে আসা গলায় শুধায়,
‘প্রান্তি কি সুন্দরী নয় সাকিল ভাই? আমরা তো একই!’
প্রিমা তপ্ত শ্বাস ফেলে। আজকাল তার প্রান্তির উপর হিংসা হয় খুব। সাকিল ভাই কেমন প্রাণখুলে কথা বলে প্রান্তির সাথে! তাকে দেখতেও সুন্দর লাগে। কি চমৎকার করে হাসে! কিন্তু তার সাথে দেখা হলেই লোকটা কেমন চুপসে যায়। তার সমস্ত হাসি মলিনতায় ছেয়ে যায়। পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব ভিষণ পোড়ায় আজকাল তাকে। এই যে আজকাল সে পড়ায় মন বসাতে পারছে না কেবল ঐ বোকা লোকটার জন্য এর দায় কি সে নিতে রাজি হবে? হয়তো না। চোখ মুখ গোমড়া করে বলবে,
‘আপনার দায় আমার কাঁধে চাপিয়ে নিজেকে ভন্ড প্রমাণ করছেন কেন প্রিমা?’
তখন প্রিমা কি জবাব দিবে? কিছুই না। প্রিমা ঐ মানুষটার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে কিচ্ছুটি বলতে পারে না। তার শব্দ ভান্ডারের সকল শব্দ দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে তখন।
প্রিমা ক্লান্ত আকাশের পানে চায়। ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ছে আকাশে। সবার মাঝে নিজেদের বাড়ি ফেরার তারা। সূর্যটাও নিজেকে আড়াল করেছে। ঝিমিয়ে পড়া আকাশ দেখতে দেখতেই প্রিমা সাকিলের গাছটার কাছে এলো। গাছটা প্রিমার চেনা। এটা একটা বুনো গাছ। প্রিমা যখন ছোট বেলায় নানু বাড়িতে যেত তখন তার নানু বাড়ির বিস্তার বাগানে এসব গাছ দেখেছে সে। তার নানুর বাগানের সখ ছিলো ভিষণ। তার বাগান ভর্তি ছিলো দেশি-বিদেশি ফুল, ফল সবজির গাছ। আর ছিলো কিছু বুনো গাছ। যা নিজ থেকেই সারি ধরে জন্মায়। বছরে একবার বাগানের এসব বুনো গাছ পরিস্কার করা হতো। মালির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে প্রিমা আর প্রান্তি এসব গাছ তুলতো। কত শত স্মৃতি রয়ে গেছে! কিন্তু তার নানুটাই আর নেই।
কিন্তু এই বোকা লোকটা এই বুনো গাছ এত যত্ন নিয়ে বড় করছে কেন? প্রিমা চোখ মুখ কুঁচকে বিরবির করে,
‘অদ্ভূত সব সখ!’
চলবে…..?