#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৫.
আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। মিষ্টি আলো ছড়াচ্ছে চারপাশে। তিহু তার রুমের বারান্দায় চাদর বিছিয়েছে। আজ এখানে বসে জোসনা বিলাস করবে তারা। প্রোণো তখনো রুমে আসেনি। বাবার সাথে কথা বলছেন। তিহু একাই আকাশ পানে তাকায়। সজনে গাছের ঠিক মাথায় চাঁদ উঠেলে। প্রায় মরে যাওয়া সজনে গাছটায় হাতে গোনা পরিমাণ পাতা। এই সজনে গাছ নিয়ে লম্বা ইতিহাস রয়েছে তাদের বাড়িতে। এ গাছটায় বছর ত্রিশ হয়েছে সজনে হয়না। এই গাছটা তিহুর দাদার অনেক স্মৃতি বহন করে। তিহুর দাদা রশিদ তালুকদার ছিলেন ভিষণ ধার্মিক। তার দাদা বেঁচে থাকা কালীন সময়ে তাদের বাড়িতে আলেমদের আনাগোনা ছিল খুব। তিনি হাট বাজারে সুযোগ পেলেই ইসলামিক ইতিহাস নিয়ে বসতেন। লোকেও তাকে পছন্দ করতো। এখন থেকে ত্রিশ বছর আগে মানুষের মনে ধর্ম নিয়ে বিশাল এক অংশ কাবু ছিল। চোর হোক কিংবা পালাতক আসামি, মসজিদের সামনে থেকে যাওয়ার সময় তারাও ভদ্রলোকের বেশে হুজুরকে সালাম দিয়ে যেত। তখন ধার্মিক মানুষদের কদর ছিল খুব। রশিদ তালুকদার এলাকার মুরুব্বিদের মধ্যে বেশ সম্মানীয় একজন ছিলেন। বাড়ির এই সজনে গাছটায় তখন নতুন নতুন সজনে হতে শুরু করেছে। গাছের নতুন সজনে রশিদ তালুকদার সবাইকে অল্প করে দিলেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছর সজনে ফলতে শুরু করলো। রশিদ তালুকদার ও প্রতিবছর সবাইকে তার অল্প অংশ ভাগ করে দিত। এভাবে তালুকদারের সাথে সাথে তার গাছের সজনেও এলাকায় নাম ছড়াল। কোনো বছর সজনে দিতে দেরী হলেই হাঁটে বাজারে লোকেরা প্রশ্ন করত,
‘কি সাহেব? সইজনে পারবেন কবে? গিন্নি তো রোজ প্যাঁচাল করতে থাকে।’
রাশেদ তালুকদার গর্বিত ভঙ্গিতে হাসতো। বলতো,
‘মানুষ পাইনা তো। অত বড় গাছে উঠবার জন্য গাছে উঠবার পারে এমন লোক দরকার। আমার পোলাপাইন গুলা শিক্ষার আলো নিতে নিতে অন্ধ হইয়া গেছে। ঠিক করে হাটবার পারে না। মেরুদন্ড ব্যাকা হইয়া গেছে। গাছে উঠবো কেমনে?’
‘ঠিক কথা কইছেন। শিক্ষা দীক্ষা যখন ছিল না তখনই ভালা ছিল। আমরাও তো শিক্ষিত না, আমরা ভালা আছি না?’
….
হাট বাজারে এভাবেই কথা আগাত। চাপা পড়তো সজনের কথা। তবে যে একেবারে ভুলে যেত তেমন নয়। গল্প শেষে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মত করে বলতো,
‘সে যাই হোক। রশিদ সাহেব, আপনের গাছের সজনে গুলার স্বাদ খুব। পুরা ঢাকার বাজার খুঁইজা ওমন সজনে পাওয়া যাইবো না।’
রশিদ তালুকদার তখন হাসতে হাসতে মাথা নাড়িয়ে বলতেন,
‘সজনে পারলে কুদ্দুসরে দিয়া পাঠাই দিবানি।’
এভাবেই এই সজনে গাছ অনেকটা পরিচিত ছিল অত্র এলাকার মানুষদের মাঝে। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় তিহু জন্মের বছর দুয়েক পর। তিহুর দুঃসম্পর্কের এক ফুপু এ বাড়িতে এসে প্রেম ঘটিত কারণে এই সজনে গাছের ডালে গলায় ফাঁস দেন। নিজেদের সম্মান রক্ষায় তার এই গলায় ফাঁস দেওয়ার বিষয়টা গোপন করে গল্প বানানো হয় তাকে জ্বিন হ*ত্যা করেছে বলে। তখনকার সময়ে এমন ঘটনা অবিশ্বাস করার মতো ছিল না। মসজিদের ইমাম ও জানালেন এই গাছে সত্যিই জ্বিনদের বাস। পরিচিত সজনে গাছটা হঠাৎ করেই সবার নিকট আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। রাত করে কেউ সজনে গাছের পাশের রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করত না। অনেকে এখানে অনেক কিছু দেখেছেন বলেও প্রচলিত ছিল। যত্নের অভাবে সজনে গাছটার ফলন বন্ধ হলো। সময় পার হলো কিন্তু সজনে গাছটা আর আগের পর্যায়ে ফিরে যায়নি। বরং মিথ্যা অপবাদ নিয়ে আজও ছোট করে শ্বাস ফেলছে সে। গাছের অধিকাংশ ডাল মরে গেছে। তিহুর মায়া হয় খুব। হোক গাছ তবুও কেমন মিথ্যা কলঙ্ক নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে তাকে। তিহু তপ্ত শ্বাস ফেলে। এবার যাওয়ার আগে গাছটা কাটাবে সে। এভাবে কষ্ট নিয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে শান্তি দিবে তিহু।
‘এত গভীর ভাবে কি ভাবছো?’
প্রোণো এসে তিহুর ঠিক পেছনে বসেছে। চাঁদ তখন সজনে গাছের ডালের ফাঁকা থেকে উঁকি দিচ্ছে। তিহু তার পিঠের ভর ছাড়লো প্রোণোর বুকে। ভাঁজ করা হাঁটুতে দু হাত জড়িয়ে মলিন গলায় বললো,
‘আমার মন খারাপ হচ্ছে প্রোণো। মন ভালো করার টোটকা নেই আপনার কাছে?’
‘উহু। আমি এসব টোটকায় বিশ্বাসী নই। রাজকুমারীর গল্প শুনবে?’
‘উহু। আমি আমার রাজকুমারের গল্প শুনবো।’
‘কোথা থেকে শুরু করবো?’
‘একদম শুরু থেকে।’
‘আচ্ছা।’
প্রোণোর অতীত:
প্রোণো তখন সবে দশম শ্রেণিতে উঠেছে। তার বাবার চক বাজারে বিশাল ব্যবসা। বাজারের বড় বড় ছয়টা দোকান তার বাবার। চল্লিশ জনের মতো কর্মচারী রয়েছে। এক প্রকার কাঁচা টাকার মালিক ছিলেন তিনি। ব্যাবসার জন্য প্রায় রাতেই তার ফিরতে দেরী হতো। একদিন রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ তাদের ঘরের টেলিফোনে কল আসে। প্রোণো তখনো পড়ার টেবিলে। প্রান্তিক আর প্রিয়ম তখনো টিভি দেখছে। এটা তাদের রোজকার নিয়ম। বাবা বাড়িতে না আসা অব্দি তারা তিন ভাই ঘুমায় না। পাবেল,প্রান্তি,প্রিমা তখন অনেকটা ছোট। মুছাদ্দেফা খাতুন তখন রান্নাঘরে খাবার গরম করছেন। টেলিফোনের শব্দে তিনি রান্নাঘর থেকে প্রোণোকে ডেকে বললেন,
‘বাবা ফোনটা ধরতো। দেখ কে কল করলো। আমার হাত আটকা।’
প্রোণো পড়ার টেবিলে থেকে ওঠার পূর্বেই প্রিয়ম কল ধরলো। প্রোণো আসতে আসতে কল কেটেও গেছে। প্রোণো এসে দেখে প্রিয়ম কানে টেলিফোন ধরে কান্না করছে আর হ্যালো হ্যালো করছে। প্রান্তিক পাশে বোকার মতো দাঁড়িয়ে। সে ও জানে না কি ঘটেছে। প্রোণোকে দেখা মাত্রই সে জানায় বাজার থেকে কেউ কল করেছে। তাদেরকে সদর হাসপাতালে যেতে বলেছে। তাদের বাবা নাকি হাসপাতালে ভর্তি। সে রাতে প্রোণো প্রান্তিককে নিয়ে একা রওনা দেয় হাসপাতালে। মোছাদ্দেফা যেতে চাইলেও ছোট বাচ্চাদের কথা ভেবে যেতে পারেন না। প্রোণো ভেবেছিল তার বাবার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে সেটাই হয়তো খারাপ রূপ নিয়েছে। কিন্তু তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছালো তখন তার মাথায় বিশাল আকাশটা ভেঙে পড়ল যেন। কেউ তার বাবার উপর অস্ত্র হামলা করেছে। বুকের বা পাশটায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তখনই জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার জ্ঞান আর ফেরেনি। প্রোণো যখন পৌঁছেছে তখন তার বাবার শরীর ছাদা কাপড়ে ঢাকা। প্রান্তিক জ্ঞান হারালেও প্রোণো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রোণো সেই মূহুর্তেই তার উপর অলিখিত দায়িত্বটুকু বুঝে নিয়েছিল। বাবা নেই। তাকে সবার খয়াল রাখতে হবে। সে কাঁদলে মা কে সামলাবে কে? তার ছোট ভাই বোন গুলোর কি হবে? এই শক্ত মনোবল নিয়ে সে তার বাবাকে দাফন করা পর্যন্ত চোখ থেকে একফোঁটা জল বের করলো না। দাফন শেষে সবাই যখন ফিরে গেল, প্রোণো তখন একা তার বাবার কবরের পাশে। বাবার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে চিৎকার করে প্রথমবারের মতো কাঁদলো সে। তাকে এত বড় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য অভিযোগ করলো। এত সময়ের চাপিয়ে রাখা কষ্ট টুকু অবশেষে বুক থেকে বের করতে পেরে কিছুটা হালকা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। সন্ধ্যা গড়ানোর পর ও যখন প্রোণো ফিরল না তখন সবাই প্রোণোকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে পড়লো। প্রোণোর বাবার দাফন করা হয়েছিল তাদের বাড়ির পেছনে। তাকে খুঁজে পেয়েছিল পাবেল। পাবেল তখন বেশ ছোট। প্রোণোকে ওভাবে দেখে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পূর্বে দাখা বাবার নিথর দেহ তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এজন্য প্রোণোকে ওভাবে কবরের পাশে দেখে সে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে সবাইকে জানালো বড় ভাইয়াও বাবার মতো হয়ে গেছে। সে ও বাবার মতো শুয়ে আছে। ছোট পাবেলের কথা শুনে সবাই ছুটে এসেছিল। প্রোণোকে ঘুম দেখে স্বস্তি পেয়েছিল সবাই। মোছাদ্দেফার বুকটা তখন আরো বেশী ভারী হয়ে উঠলো। তার বাচ্চাগুলো নিজেকে শক্ত রাখার জন্য কত পরিশ্রম করছে!
বাবা হারানোর এই ধকল শেষ হতে না হতেই আরো এক সমস্যা হাজির হলো। প্রোণোর বাবার ব্যবসা সব প্রোণোর একমাত্র চাচা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। মুছাদ্দফা এ বিষয়ে রাজি না। সে নিজে ব্যাবসা দেখা শুনা করবে জানালেও প্রোণোর চাচার সাথে পারলো না। মুছাদ্দেফা ঘরোয়া মেয়ে মানুষ। এসময়ে কেমন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বুঝে উঠতে পারলো না। না পেরে সাহায্য চাইল বড় ভাইয়ের কাছে। কথায় আছে, হাতি কাঁদায় পড়লে পিঁপড়াও লাথি মারে। যে বড় ভাই তাকে মাথায় করে রাখত সে সাহায্যর নামে যা করলো তা ছিল মুছাদ্দেফার জন্য অবিশ্বাস্য। ব্যাবসা ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে সে চুক্তি করলো মাসিক চলার খরচের। লাখ টাকার ব্যাবসার বদলে মুছাদ্দেফা পেল মাসিক বিশ হাজার টাকা। এতবড় প্রতারণার শিকার হয়েও মুছাদ্দেফা চুপ করে রইলো। তার স্বামীর হত্যাকারীকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই মুহূর্তে সে আর বেশি শত্রুর সম্মুখীন হতে পারবে না। বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে হবে তো! মুছাদ্দেফা মেনে নিল কিন্তু আবদার করলো তার স্বামীর হত্যাকারীকে খোঁজার জন্য। তার আবদার মেনে নিলেও আর কোনো খোঁজ মেলেনি। মুছাদ্দেফা নিরবে মেনে নিয়েছে। এই একটা জিনিসই সে পারে কেবল তা হলো মেনে নেওয়া। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। রূপার চামচ মুখে জন্মালেও প্রোণোদের জীবন আর আগের মতো রইলো না। হিসাব করে খরচ করা। এক মাসের বাজার পরের মাসের জন্য সাশ্রয় করা। না জানি কবে এই বিশ হাজার টাকা আসাও বন্ধ হয়ে যায় এই আশঙ্কায় মোছাদ্দেফা নিজেও গার্মেন্টসে কাজ নেয়। তবে তা ছেলে মেয়েদের আড়ালে। তার এই কাজের কথা ছেলে মেয়েরা জানত না। তবে সে অবাক হতো তার বাচ্চাদের অগ্রগতি দেখে। তাদের সামনে এক বেলা খাবার না দিলেও তারা তাদের ক্ষুধার কথা জানিয়ে অভিযোগ করতো না। সে বেশি অবাক হতো প্রোণোকে দেখে। যে ছেলে ক্ষুধা সহ্য করতে পারত না সে কেবল দুপুরে এক বেলা ভাত খেত। রাতে তার ভাগের ভাত ভাইবোনদের ভাগ করে দিত যাতে ওদের পেট ভরা থাকে। সকালে তো কেবল এক টুকরো করে রুটি হবে সবার ভাগে।
চলবে……..
#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৬.
অভাবের এই সংসার নিয়ে কারো আপত্তি ছিলো না বরং সবাই নিজেকে গড়তে মরিয়া হয়ে পড়েছিল। একবেলা খেলে পরের বেলার কথা যেন ভাবতে না হয় সেই সুদিনের অপেক্ষায় ছিল তারা। প্রোণো কলেজে ওঠার পর থেকেই টিউশনের মাধ্যমে নিজের খরচ বহন করতো। পরবর্তীতে ঢাবিতে চান্স পাওয়ার পর ভাইবোনদের খরচটাও সে চালাতে শুরু করলো। পরিস্থিতি তখন থেকেই আস্তে আস্তে করে আবারো পূর্বের ন্যায় ফিরতে শুরু করলো। প্রোণোদের জন্য বরাদ্দ টাকা টুকু প্রোণো নিতে অস্বীকার করলো। তার মতে তার বাবার ব্যবসা সে ফিরিয়ে আনবে। এতদিন তার ক্ষমতা ছিল না তাই সে সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু আর কত? প্রোণো দু বছরের মাথায় নিজেদের ব্যাবসা আইনের মাধ্যমে নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। এরপর থেকে সবটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রোণোর বিয়ের সপ্তাহ খানেক পূর্বে প্রোণো জানতে পারে মোছাদ্দেফা খাতুন প্রোণোর বাবার রেখে যাওয়া এই বাড়িটা প্রোণোর চাচাদের নামে লিখে দিয়েছেন। বাবার রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিটুকু এভাবে অপাত্রে দানের জন্য মূলত তারা তাদের মায়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রাস্তার কুকুরকে দিলেও তাদের আপত্তি ছিলো না। কিন্তু সরল মোছাদ্দেফা বলেছেন,
‘ঠকাক আর যাই করুক, তাদের দেওয়া ঐ অল্প টাকার জোরেই তো বেঁচে ছিলাম।’
মোছাদ্দেফা ঐ বেইমানদের প্রতি নরম হলেও তারা কিন্তু নরম হলো না। বাড়ি তাদের নামে লিখে দেওয়ার দুদিন বাদেই ছয় মাসের মাঝে বাড়ি ফাঁকা করার নোটিশ পাঠিয়েছে। মোছাদ্দেফা খাতুন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেন। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাবেন কিভাবে সে? ব্যাবসা ফিরে পাওয়ার পর তাদের সংসার আরো স্বচ্ছল হলেও প্রোণোর চাচাদের পরিণতি ছিল খারাপ। তাদের পুরো সংসার ঐ ব্যাবসার উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রোণোর চাচার তিন ছেলে মেয়ে। মেয়ে দুটোর বিয়ের বয়স হয়েছে। সব মিলিয়ে মোছাদ্দেফা খাতুন কেমন অপরাধ বোধ করছিলেন। কিন্তু তারা যে উপকারের ফল জুতা মেরে দিবে তা কে জানতো!
বর্তমান:
সবটা শোনার পর তিহু বুঝে আসলে কেউই মুছাদ্দেফা খাতুনের সাথে রেগে নেই। এটা তাদের অভিমান। এতটা বছর কষ্ট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আসা হৃদয়ের অভিমান। ঐ ছোট রংচটা বাড়িটা তাদের জন্য কেবল বাড়ি নয় বরং তাদের বাবার সাথে কাটানো কিছু ঝাঁপসা হয়ে আসা স্মৃতি যা রক্ষিত হয়ে আছে বাড়ির সব আনাচে কানাচে, দেয়ালে। হঠাৎ একটা প্রশ্ন এসে দেয় তিহুর মনে। সে প্রোণোর দিকে গভীর চোখে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘বাবাকে কারা হ*ত্যা করেছিল?’
প্রোণো এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। নিরব থাকে। তার নিরবতা জানান দিচ্ছে এ বিষয়ে সে কথা আগাতে চায় না। তিহু বুঝতে পারে। খানিক বাদে বলে,
‘মা জানেন?’
‘হুম।’
‘তিনি মাফ করে দিলেন?’
‘হুম।’
‘কেন?’
‘বয়স কম ছিলো। ভুল করে ফেলেছে তাই।’
‘আপনাদের থেকে তো ছোট না!’
প্রোণো নিরব থাকে। তিহু পুনরায় বলে,
‘আপনি মেনে নিলেন?’
‘উপায় ছিল না। মায়ের জায়গায় বাবা হলে সে ও একই কথা বলতো।’
রাগে তিহুর শরীর কেঁপে ওঠে। সে রাগ সামলাতে না পেরে বলে,
‘আপনি কিভাবে এ কথা বলতে পারেন? একজন আসামি পৃথিবীর বুকে প্রাণ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। আপনি তা জেনেও চোখে পট্টি বেঁধে আছেন!’
প্রোণো তখনো নিরব। কেবল তার মুখ থেকে আসা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিহু চাঁদের আলোয় প্রোণোর মুখ খানা দেখে। প্রোণো শান্ত হয়ে বসে আছে। কিন্তু তিহু জানে এই শান্তর মাঝে মানুষটা ভিষণ রকম ছটফট করছে। তিহু প্রোণোর বুকে মাথা ঠেকায়। তার আরো কিছু জানতে ইচ্ছা হচ্ছে।
‘কবে জানতে পেরেছেন আপনি?’
‘মাস খানেক আগে।’
‘এত সময় পর?’
‘এত বছর আগের ঘটনার সূত্র খোঁজা কঠিন ছিল। দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার ছিল।’
‘কি করবেন ভেবেছেন?’
‘মায়ের কথায় বাবার বিষয়ে শাস্তি না দিলেও অন্য পথ খুঁজছি। যে একবার অন্যায় করে সে বারবার অন্যায় করতে থাকে। অন্যায়টা তখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ও অভ্যাস হয়েছে। আজ না হয় কাল ঠিক খুঁজে পাব।’
তিহু আর কোনো প্রশ্ন করে না। সে সরল চোখে আকাশ পানে চায়। আকাশের চাঁদটা তখন মেঘের বুকে মুখ লুকাতে ব্যস্ত। তিহু সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়। রাজকুমারের গল্প এতটা তিক্ত কিভাবে হতে পারে? ছোট বেলা থেকে শোনা রাজকুমারের গল্পে রাজকুমারে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। তার বিশাল এক সৈন্যের দল থাকে তাকে রক্ষা করতে। তবে বাস্তবের রাজকুমার ভিষণ একা। তিহু ঘাড় ঘুরিয়ে প্রোণোর দিকে চায়। মিষ্টি করে হেসে বলে,
‘আপনি কিন্তু এখন আর একা নেই প্রোণো।’
____________
পরাটা আর মাংস কষার ঘ্রাণে ঘুম ভাঙল সাকিলের। কাল রাতে বেশ দেরি করে বিছানায় গেছে। কাজেই শরীরটা বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইছে না। তার আবার বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। সাকিল কিছুটা সময় নিয়ে উঠে বসে। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখে তার মা বোন কিছু নিয়ে আলাপ করছে। সাকিল ডায়নিং এর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,
‘কি আলোচনা করছো? আমাকেও বলো।’
সাবিহা সাকিলের সামনে খাবার এগিয়ে দেয়। বলে,
‘খালামনি কল করেছিল। তার ভাসুরের মেয়ের কথা মনে আছে তোমার?’
সাকিলের যে মনে নেই এমন না। মনে আছে। ব্রেনলেস একটা মেয়ে কলি। নিয়ম শৃঙ্খলার বাইরে বড় হওয়া দুলালি। বছর তিন আগে দেখেছিল শেষবার। সে তার খালামনির জন্য রসের পিঠা নিয়ে গিয়েছিল। খালামনির রসের পিঠা পছন্দ। কিন্তু অসুস্থতার জন্য নিজ হাতে বানাতে পারেন না। কলি ও তখন ও বাড়িতেই ছিল। তখন মেয়েটা বোধহয় কলেজে পড়ে। সাকিল মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পায়নি। হাফ প্যান্ট আর ঢোলা গেঞ্জি পরা মেয়েটাকে দেখে লজ্জায় চোখ আপনাআপনি নিচে নেমে এসেছিল তার। কিন্তু মেয়েটার এ বিষয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তখন থেকেই মেয়েটাকে এড়িয়ে চলে সে। এসব মেয়ে আসলে মেয়ে না বরং জলজ্যান্ত জাহান্নাম।
‘না নেই। কেন?’
সাবিহা বেশ ঝলমলে মুখ করে বললো,
‘খালামনি আমাদের কলি আপুর জন্য প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলেছেন। খালামনি নাকি প্রস্তাব রেখেছিল কিন্তু তারা বলেছে আমাদের যেতে।’
সাকিল খাওয়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকায়।
‘কিসের প্রস্তাব?’
‘কিসের আবার? বিয়ের অবশ্যই।’
‘কার বিয়ের?’
‘তোমার।’
সাকিলের চোয়াল খুলে আসার পর্যায়ে। সে কোনো রকম পানি খেয়ে বলে,
‘মা এসব কি? খালামনি কেন ওমন মেয়ের সাথে আমার বিয়ের তোরজোর করছে?’
আলেয়া ছেলের কথায় তেমন গুরুত্ব দিলেন না। বললেন,
‘তোর সাথে মানাবে বলেই করছেন। আজ অফিসে ছুটি নে। আজই যাব আমরা।’
সাকিল সাথে সাথেই বিরোধীতা করে ওঠে।
‘মা আমার মত নেওয়ার কি প্রয়োজন নেই তোমার? বিয়ের মতো বিষয়ে আমার মত দরকার নেই?’
আলেয়া ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন,
‘দরকার আছে। কিন্তু মেয়ে দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। দেখে আসতে সমস্যা কোথায়? তোর খালামনিকেও দেখে আসা হবে।’
সাকিল জানে তার মা কে বলে কিছু হবেনা। খুব একগুঁয়ে স্বভাবের তার মা। তবুও শেষ চেষ্টা করতে বললো,
‘আমি চাকরি করি। সোজা কথায় বলতে অন্যের গোলামি। চাইলেই যখন তখন ছুটি নিতে পারি না।’
‘চাকরি ছেড়ে দে। গ্রামে চল। জমিতে ধান,ডাল চাষ করবি ও দিয়ে জীবন কেটে যাবে।’
সাকিল হাল ছাড়লো। এই ঘরে প্রিমার মতো বুদ্ধিমতী কাউকে নিজের দলে দরকার তার। প্রিমার মতো কারো অভাব খুব করে অনুভব করছে সে।
চলবে……