তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-২৩+২৪

0
16

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৩.
তিহুর মনে হচ্ছে আজকাল সে পাক্কা গৃহিণী হয়ে উঠেছে। একদম তার মায়ের মতো। রাত জেগে বাবার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করা, সবসময় বাবার পছন্দের কালারের শাড়ি পড়া। এসব সে তার মাকে করতে দেখেছে সবসময়। তিহু তখন বেশ বিরক্ত হতো। মা কেন তার নিজের সখ বাদ দিয়ে বাবার সখের জিনিস কুড়িয়ে বেরায়? এটা তার ভালো লাগতো না। কিন্তু এখন সে বোঝে। তখনকার বিরক্ত লাগার ব্যাপারটা যে এতটা স্নিগ্ধ হয়ে উঠবে তা সে ভাবেনি কখনো।

রেমীর রুমের খাওয়ার পানি শেষ। এত রাতে সে জগে পানি নিতেই নিচে নেমেছিল। রান্নাঘরে আলো জ্বলতে দেখে এগিয়ে আসে। তিহু তখন মাংস গরম করছে।

‘ভাইয়া এসেছেন?’

তিহু রেমীকে দেখে মুচকি হাসে।

‘মাত্রই। তুমি এত রাতে উঠলে যে?’

‘জগে পানি নিতে এলাম।’

‘ওহ্।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ সবটা নিরব। তিহুর এমন পরিস্থিতি ভালো লাগছে না। কিছু একটা বলে কথা শুরু করা দরকার কিন্তু বলার মতো কোনো কিছুই মাথায় আসছে না।

‘তিহু?’

‘জ্বি।’

‘এই পরিবারটা তোমার কাছে কেমন মনে হয়?’

তিহু রেমীর কথার মানে ধরতে পারে না। সে বোকা চোখে তাকিয়ে জবাব দেয়,

‘কেমন আর? এই পরিবারের মতোই। প্রত্যেকটা পরিবারই তো আলাদা তাই না?’

‘আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে তুমি আসার পর থেকে যেমনটা দেখছো আমরা আসলে এমন ছিলাম না। আমরা অন্যসব নরমাল পরিবারের মতোই ছিলাম। কিন্তু খারাপ কিছু একটা ঘটেছে যা সবাইকে এমন করে তুলেছে।’

রেমী থামে। কিছু একটা ভেবে পুনরায় বলে,

‘কোনো বিষয়ে তোমার আনকমফরটেবল লাগলে আমায় বলিও। শুধু আমি না, তুমি এ বাড়ির যে কারো সাথেই শেয়ার করতে পারো।
এ বাড়ির প্রতিটা মানুষই ভিষণ ভালো। এখন তা মনে না হলেও একসময় তুমি ঠিক বুঝবে।’

তিহু মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। রেমীকে তার বড় বোনের মতো মনে হয়। দায়িত্ববান এবং যত্নশীল এই মানুষটা এ বাড়ির মেজ বউ। তিহু কি এভাবে দায়িত্ব নিয়ে পরিবারের হাল ধরতে পারবে? তিহু জানে না। তিহুর মনে হচ্ছে সে নিজ সম্পর্কে খুব স্বল্প জানে। এতটাই স্বল্প যে সে নিজেকে ভরসা করে উঠতে পারে না।

রেমী জগে পানি নিয়ে রুমে যাওয়ার আগে তিহুকে বলে,

‘মা কে নিয়ে কাল একটু ডাক্তারের কাছে যেও। তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’

‘আচ্ছা।’

তিহুর মুখটা হঠাৎ করেই কালো হয়ে আসে। শাশুড়ি মা কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রোণো ও একদিন বলেছিল তাকে। সে বেমালুম তা ভুলে বসেছে। এ পরিবারের দায়িত্ববান বউদের কাতারে তাকে কিছুতেই গণণা করা যায় না।

________________

তিহু খাবার নিয়ে ফিরতে ফিরতে প্রোণো বিছানায় হেলান দিয়ে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাসের শব্দ গাঢ়। এই অল্প সময়েই বেশ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে সে। তিহুর মন চাইলো না প্রোণোকে ডেকে তুলতে।
টেবিলে খাবার ঢেকে রেখে নিরবে সে প্রোণোর পাশ ঘেঁষে বসলো।

প্রোণোর ফিরে যেতে আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। যদিও এত দ্রুত ফিরে যাওয়ার কথা ছিল না তার। কিছু জরুরি কাজের জন্য প্রায় দশ দিন আগে ফিরে যেতে হচ্ছে তাকে।

প্রোণোর এভাবে ফিরে যাওয়ার নোটিস তিহু এখনো মেনে নিতে পারছে না।
তার পাশে প্রোণো থাকবে না ভাবলেই তার বুকের ভেতরটা অস্বাভাবিকভাবে মুচড়ে ওঠে।
কে জানত এই লোকটা তাকে এভাবে কষ্ট দিবে!
আগে জানলে সে কখনোই এই লোকের প্রেমে পড়ার মতো ভুল করত না।
তিহুর চোখ আবারও ভিজে আসে। সে কাঁদতে চায় না কিন্তু চোখ কি তার বাঁধ মানে?
তিহু গুটিসুটি হয়ে প্রোণোর বুকের কাছে নিজের জায়গা করে নেয়। প্রোণোর বুকে মাথা রেখে মনোযোগ দিয়ে হৃদযন্ত্রের নৃত্য শুনতে থাকে। যেন সে এই হৃদপিণ্ডের প্রতিটা শব্দ মুখস্থ করে নিচ্ছে।

‘তুমি কি আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছ, তিহু?’

তিহু সটান উঠে বসে। প্রোণো তিহুর পানে সন্দিহান দৃষ্টি ফেলে বলে,

‘তোমার আচরণ সন্দেহজনক। তুমি কি সত্যিই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলে?’

তিহু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে। সে যা করেছে তাকে কি সুযোগ নেওয়া বলে? তিহু এ ব্যাপারে নিশ্চিত না। তবে এই মুহূর্তে প্রোণোর কথাকে ইগনোর করাও সম্ভব হচ্ছে না। তাই সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বলে,

‘আমি কেবল চেক করছিলাম।’

‘কি?’

প্রোণো ভ্রু উঁচিয়ে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। তিহু ভেবে পায় না কি বলবে। আমাতা আমতা করে বলে,

‘দেখছিলাম… দেখছিলাম আপনার হার্ট ঠিক আছে কিনা।’

‘তো?….ঠিক আছে?’

প্রোণোর ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। তিহু চোখ সরিয়ে নেয়। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,

‘দেখতে পারিনি। আপনি আগেই উঠে গেছেন।’

তিহু খাবারের প্লেট এনে দেয় প্রোণোর সামনে। সাথে একটা বাটি আর পানি হাত ধোঁয়ার জন্য।

প্রোণো খাবারের প্লেটে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসে। হাত ধুয়ে তিহুকে বলে,

‘অতদূরে থাকলে খাইয়ে দিব কিভাবে? কাছে এগিয়ে আসো। এটলিস্ট খাওয়ার সময় আমি কারো সুযোগ লুটে নেই না। সো, চিল।’

তিহু প্রোণোর দিকে গরম চোখে তাকায়। তার চোখ মুখ লজ্জায় গরম হয়ে আসছে। এর থেকে বেশি হলে হয়তো শরীরে তাপমাত্রা ফারেনহাইট স্কেলের ১০৮ ডিগ্রি ক্রস করে ফেলবে।
লোকটা ইচ্ছা করে তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইছে তা বেশ ভালো করেই বুঝছে সে।
প্রতিশোধ হিসেবে খাবার গালে নেওয়ার সময় ইচ্ছাকৃত ভাবে সে প্রোণোর আঙুলে কামড় বসিয়েছে। প্রোণো কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তিহু জানে ব্যাথার পরিমাণ কম ছিলো না মোটেই।
কিন্তু তার এই কাজে তাকে পস্তাতে হয়েছে প্রচন্ড ভাবে। কারণ এর বিপরীতে প্রোণো মুচকি হেসে জবাব দিয়েছে,

‘আগে খাবার শেষ করো। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে এসবের জন্য।’

তিহু তৎক্ষণাৎ প্রোণোর থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে। লোকটা প্রচন্ড রকমের বেশরম। ভাগ্যিস পাঁচদিন বাদেই সে চলে যাচ্ছে। নয়তো এমন বেশরম মানুষের সাথে এক কামরায় থাকা জাস্ট ইম্পসিবল।

______________

সকাল সকাল তিহু হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। ঘুম থেকে উঠতে সামান্য দেরী হয়ে গেছে। খাবারটাও শেষ করতে পারেনি। কাজের মেয়েটাও আজ আসেনি। তিহু রেমীকে দেখে দুঃখী কন্ঠে বলে,

‘স্যরি গো তোমার উপর সব ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমি দ্রুত ফেরার চেষ্টা করবো।’

রেমী তখন বাসন মাজছে। তিহুর কথা অল্প হেসে বলে,

‘সমস্যা নেই তিশা আছে তো। আমরা দুজন মিলে ঠিক সামলে নিব। তুমি সাবধানে যেও।’

তিহু মাথা নখড়িয়ে শাশুড়ির রুমে উঁকি দেয়।

‘মা, হলো আপনার?’

মোছাদ্দেফা তখনও শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত। তিহুর কথা শুনে সে মাথা উঁচু করে হতাশ গলায় বলে,

‘কত বছর ধরে শাড়ি পড়ছি, কখনো এমন হয়নি। আজ কোনো ভাবেই শাড়ি পড়াটা ঠিক হচ্ছে না।’

তিহু ফোনে সময় দেখে। দশটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি। প্রান্তিক তাদের দশটার মধ্যে উপস্থিত হতে বলেছিল।
তিহু নিরাশ গলায় বলে,

‘আজ এভাবেই থাকুক। ওটুকু কেউ খেয়াল করবে না। চলে আসুন।’

তিহু রুম থেকে দু পা বেরিয়ে আবার ফিরে আসে।

‘মা, আগের রিপোর্ট গুলো কোথায়? নিয়েছেন?’

মোছাদ্দেফার অদ্ভূত চাহনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই তার।
তিহুর এখন কাঁদতে মনে চাচ্ছে। কিন্তু সে কাঁদল না। বরং মুচকি হেসে তার‌ অসহায় শাশুড়িকে সান্তনা দিতে বললো,

‘কোনো ব্যাপার না। মেজ ভাইয়া কোনো একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নিবে। আমরা কেবল সময় মতো পৌঁছাতে পারলেই হলো।’

তিহু বের হওয়ার আগে একবার প্রোণোকে কল করল। ফোন একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো।

‘আপনি আমাদের নিতে আসবেন?’

‘শিওর বলতে পারছি না যে। তোমাদের কাজ শেষ হলে জানাও আমায়।’

‘আচ্ছা।’

তিহু কল কাটলো না। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

‘আপনি কোথায়?’

‘ধানমন্ডির আশপাশে।’

‘আচ্ছা।’

তিহু কল কেটে দেয়। কিন্তু চোখ মুখের ভাব পরিবর্তন হয়েছে। প্রোণোর খুব কাছ থেকে তিহু কোনো এক নারী কন্ঠেস্বর শুনতে পেয়েছে। যদিও এই অতি সামান্য কারণে প্রোণোকে সন্দেহ করার মতো বাচ্চা সে নয়। কিন্তু তবুও, তবুও কোথাও একটা কিছু অনুভব হচ্ছে। তিহু এই অনুভূতির নাম জানে না। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে বিরক্তিকর।

চলবে……….

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৪.
চারশত ছয় নম্বর রুমের সামনে লম্বা সিরিয়াল। দুপুরের সূর্যটাও রেগে গিয়ে তাপ ছড়াচ্ছে। কপাল গড়িয়ে গালের একপাশ ধরে নেমে যাচ্ছে ঘামের স্রোত। তিহু সামনের সিরিয়াল ভেঙে আগাতে পারছে না। বাধ্য হয়েই কল করতে হয় প্রান্তিককে।

‘ভাইয়া আমরা আপনার রুমের বাহিরে।’

ব্যস্ত থাকায় প্রান্তিক কেবল ‘ওকে’ বলে কল রেখে দেয়। মিনিট চারেক পর অল্প বয়স্ক একটা ছেলে বেরিয়ে এসে জোর গলায় বলে ওঠে,

‘ডাক্তার প্রান্তিক মাহমুদের বাড়ির লোক কারা?’

তিহু হাত উঁচু করে ইশারা করতেই ছেলেটা এগিয়ে আসে। ভদ্রতার সাথে তাদেরকে পথ দেখিয়ে অন্য এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। মুখে বলেন,

‘স্যার ব্যস্ত বলে আসতে পারেননি। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই স্যার এই ডাক্তারের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছেন। আপনারা কেবল ভিতরে যেয়ে নিজেদের পরিচয় দিবেন, তাহলেই হবে।’

তিহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বাকিটা সে নিজেই সামলে নিতে পারবে।

হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে বেলা প্রায় একটা। তিহু মোছাদ্দেফা খাতুনকে বলে,

‘মা, ঠান্ডা কিছু খাবেন?’

মোছাদ্দেফা না করেন। তিহু ফোন বের করে প্রোণোকে কল দেয়। কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ হয়না। তিহুর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। পরপর ছয়বার কল দেওয়ার পরও যখন কল রিসিভ হয়না তখন তার মেজাজের পারদটা দপ করে চূড়ায় উঠে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে পুনরায় কল দিতেই কল রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে প্রোণো ব্যস্ত কিন্তু শান্ত গলায় বলে,

‘দুঃখিত তিহু, আসতে পারছি না। চলে যেতে পারবে?’

তিহু দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,

‘না পারলেও কি কোনো অপশন আছে? একাই যেতে হবে তাই না?’

প্রোণো এবার মলিন স্বরে বললো,

‘স্যরি। সাবধানে যেও।’

তিহুর কেন যেন রাগ হলো খুব। এতটাই যে সে তার ধৈর্য হারালো। কোনো প্রকার জবাব না দিয়েই সে চট করে কল কেটে দেয়। ট্যাক্সি ঠিক করে চড়ে বসতেই মোছাদ্দেফা বলেন,

‘কিছু হয়েছে বউ?’

তিহু মিথ্যা হাসার চেষ্টা পর্যন্ত করলো না। না চেষ্টা করলো সে রেগে আছে এই বিষয়টিকে লুকানোর। থমথমে মুখে জবাব দিলো,

‘কিচ্ছু ঠিক নেই মা। আপনার ছেলের সাথে বোঝাপড়া বাকি রয়ে গেছে।’

মোছাদ্দেফা আর কিছু জানতে চাইলেন না। পুরোটা পথ নিরবে পার করে দিলেন। বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামলে তিহু ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মোছাদ্দেফাকে বলে,

‘মা আমি একটু বাইরে যাব এখন। ফিরতে দেরী হবে। কতটা দেরী হবে ঠিক বলতে পারছি না।’

মোছাদ্দেফা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না তিহু কোথায় বা কেন যাচ্ছে। তিনি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার দুটো নোট বের করে দিয়ে বললেন,

‘যেখানেই যাও খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করবে। প্রোণো ফিরলে আমি জানিয়ে দিব যৈ তুমি বাড়িতে নেই।’

তিহুর যে কি খুশি লাগলো। সে সাথে সাথেই মোছাদ্দেফাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘আমি এই টাকা দিয়ে নিঃসন্দেহে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করবো।’

তিহুর বাড়িতে না থাকার কথা ইতিমধ্যে সবার ভিতর চিন্তার জট পাকিয়ে দিয়েছে। প্রিমা খানিক বাদে বাদেই তিহুর নম্বরে ডায়াল করছে কিন্তু ফলাফল অপরিবর্তিত। সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রান্তি দাঁত দিয়ে নখ কেটে চলছে। রেমী পায়চারি করতে করতে বলে উঠলে,

‘এটা একটু বেশি হয়ে গেল না? মেয়েটা একবারও কি আমাদের কথা ভেবেছে?’

তিশা প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,

‘নিশ্চই বড় ভাইয়া কিছু একটা করেছে নয়তো ওমন মিষ্টি একটা মেয়ে এমন ভয়ঙ্কর কাজ কেন করবে?’

সবার এমন উত্তেজনার মধ্যে মোছাদ্দেফা সোফায় বসে চুকচুক করে চা খাচ্ছেন। তার পাশেই কাজের মেয়েটা টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে শাক কুটছে। কিছুক্ষণ পরপর বিরক্ত গলায় বলে উঠছে,

‘এই সিরিয়ালের কোনো মাতা মুন্ডু আছে? পড়লো ডাক্তারি কিন্তু হইয়া গেল উকিল! আমি অশিক্ষিত মানুষ ও তো ভালো বুজি ওগে থেইকা।’

মোছাদ্দেফা চায়ে পুনরায় চুমুক বসায়ে বললেন,

‘বুঝিস যখন, দেখিস কেন?’

‘বোঝেবেন না খালাম্মা। নেশা, নেশা। এই নেশা খুব খারাপ নেশা।’

মোছাদ্দেফা বোঝার চেষ্টাও করলো না। সে শান্ত মনে নিজের ঘরে চলে গেল। একটা লম্বা গোসল দিতে হবে। ঘামে এখনো আঠালো হয়ে আছে শরীর।

______________

তিহু তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে একটা পুরোনো বাগানবাড়িতে এসে উঠেছে। এটা তার বন্ধুমহলের পিকনিক স্পট। তিহুকে দেখতে পেয়েই দু চারটা ছেলে মেয়ে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে কোঁকড়া চুলের অধিকারী সুন্দরী মেয়েটা বলে ওঠে,

‘তোর বর তোকে একা ছাড়লো?’

‘ছাড়বে কেন? আমি ছুটে এসেছি।’

তিহুর কথায় ছেলেমেয়েগুলো উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তিহুও হাসিতে যোগ দেয়। তাগাদ দিয়ে বলে,

‘আজকের মেনু কি?’

কোঁকড়া চুলের অধিকারী মেয়েটা কাউকে কল দিতে দিতে বললো,

‘তুহিন আর সাবের খাবার আনতে গেছে। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আনলেই দেখিস।’

তিহু দোতালা দালানের দোতালার একটা রুম নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। রুমে ঢুকেই সটান শুয়ে পড়ে। তার চিন্তা আর আনন্দে ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে বাড়ির মানুষদের জন্য। কে কি ভাবছে তা সে জানতে না পারলেও একটু অপরাধবোধ কাজ করছে। তবে শান্তি লাগার বিষয় এই যে তার বরটা এবার থেকে শিওর সুধরে যাবে। বউকে না বলে হুটহাট গায়েব হয়ে যাওয়ার এই রোগটা অবশ্যই সারিয়ে তোলা উচিত। তার থেকেও বড় বিষয় এই যে, তাকে থাকা খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হচ্ছে না। ভাগ্যিস কাল নীলা কল করেছিল!

তিহুর ঘুম ভাঙ্গে বিকেলের দিকে। শরীরটা তখনও বিছানা ছেড়ে নামতে চাইছে না। কিন্তু পেটের টানে বিছানায় শুয়ে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। তিহু ঢুলতে ঢুলতে নিচে নামে। রাহা চেয়ারে পা তুলে বসে নখ কাটছে। তিহু হাই তুলে বলে,

‘বাকিরা কোথায়?’

‘ছেলেগুলো বাহিরে গেছে। নীলা আর চিত্রা ছাদে। তেঁতুল দিয়ে শশা মাখাচ্ছে। খাবি?’

তিহু নাক কুঁচকায়। বলে,

‘আমি ভাত খাব। কি আছে?’

‘সাদা ভাত আর সাত রকম ভর্তা।’

তিহুর মেজাজটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে যায়। বলে,

‘পিকনিকে এসে কোন গরু সাদা ভাত আর ভর্তা খায়?’

মুখে তা বললেও ভর্তা দিয়েই অনেকটা ভাত খেল তিহু। খাওয়া শেষে ছাদে যেয়ে কিছুক্ষণ সবার সাথে গল্প করে আবারো রুমে চলে আসে। ভালো লাগছে না তার। এই যে এত সুন্দর নিরব পরিবেশ, বন্ধুরা সব মিলিয়েও তার ভালো লাগছে না। তিহু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ফোন চালু করে কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়াই প্রোণোর নম্বরে কল করে।
প্রোণো কল ধরছে না। তিহুর অভিমান হয় খুব। একসময় চোখের কোনে জল জমতে শুরু করে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে আবারো কল দেয়। এবার কলটা রিসিভ হয়। রিসিভ হলেও ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না।
তিহুর অভিমানের পাল্লা ভারী হয়। লোকটা কি এখনো তিহুর গায়েব হওয়ার খোঁজ পায়নি?

তিহু দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে রাখে। খানিক বাদে বলে,

‘আপনি আমায় খুঁজবেন না?’

ওপাশ থেকে প্রোণো অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলে,

‘সেটা কি জরুরী?’

জরুরী নয়? তিহুর প্রশ্ন করতে মন চায়। কিন্তু করে না। তার এবার সত্যিই ভিষণ কান্না পাচ্ছে। সে প্রায় কান্না করেই বলে ওঠে,

‘আমাকে খুঁজতে আসতে হবেনা। আমি এভাবেই কোথাও একটা চলে যাব।’

তিহু কল কেটে ফোন দূরে চেলে মারে। তার প্রোণোকে কল দেওয়াটাই উচিত হয়নি। এই লোকটা একটা পাষাণ লোক। তিহু টিস্যুতে‌নাক মুছতে মুছতে বলে,

‘আমি সত্যিই ঐ লোকের কাছে আর ফিরে যাব না।’

চলবে………..