#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৫.
তিহু কল কেটে ফোন দূরে ছুঁড়ে মারে। তার প্রোণোকে কল দেওয়াটাই উচিত হয়নি। এই লোকটা একটা পাষাণ লোক। তিহু টিস্যুতে নাক মুছতে মুছতে বলে,
‘আমি সত্যিই ঐ লোকের কাছে আর ফিরে যাব না।’
‘বেশ। কোথায় যাবে?’
দরজায় প্রোণোকে দেখে চমকে যায় তিহু। দু পা পিছিয়ে বুকে ফুঁ দেয়।
‘আপনি এখানে কেন?’
তিহু এখনো নাক টানছে। প্রোণো শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,
‘বউ পালিয়েছে, খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে উঠলাম।’
তিহু চুপ থাকে। খানিক বাদে নাক টেনে বলে,
‘এমন করার জন্য সরি।
কিন্তু আপনি সবসময় এমনটাই করেন। কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন কিছু না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
নিতান্তই আমি সভ্য চিন্তা ধারার মানুষ তাই আপনায় সন্দেহ করি না।
কিন্তু, যদি করতাম?
সম্পর্কটা জটিল হয়ে উঠতো না?’
প্রোণো বরাবরের মতোই শান্ত মুখোভাব ধরে রেখে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। ধীর গলায় বললো,
‘বউয়ের অধিকার থেকে তোমায় বঞ্চিত করা হয়নি তিহু। তুমি কেন জোর গলায় জানতে চাও না আমি কোথায় যাচ্ছি? নিজের অধিকারের বিষয়ে তোমাকেও শক্ত হতে হবে। বি আ লিটিল মোর অ্যাগ্রেসিভ!’
তিহু সাথে সাথেই বলে উঠলো,
‘বেশ। তবে বলুন, মেয়েটা কে ছিলো?’
প্রশ্নে প্রোণোর চোখজোড়া সামান্য কুঁচকে এলেও কিছু সময়ের মাঝেই তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।
সে মুচকি হেসে বলে,
‘আমার সভ্য চিন্তা ধারার বউ কি আমায় সন্দেহ করছে?’
তিহু প্রোণোর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ব্যাগ থেকে টিস্যু নিতে গেলে দেখা যায় টিস্যু শেষ। তিহু বিনা বাক্যে প্রোণোর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রোণো প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দেয়। মুখে বলে,
‘চা খাবে? চলো হেঁটে আসি বাহির থেকে।’
তখন প্রায় সন্ধ্যা। পরিবেশ অস্বাভাবিক আকারে সুন্দর। শান্ত আকাশ আর নিরব পরিবেশ। মাঝে মাঝে হালকা বাতাসের ফিসফিস শব্দ। তিহু না করতে পারে না। প্রোণোকে রেখে সে একাই রুম থেকে বেরিয়ে আসে আগে। প্রোণো আসে তার পিছু পিছু।
বাড়িটার সামনে খোলা উঠান। উঠানে লোহার বেঞ্চ রয়েছে। রাহা আর নীলা সেখানে বসে চিপস খাচ্ছে। অন্যপাশে চেয়ার গোল করে পেতে চিত্রা , তুহিন, সাবের, আর তামিম গল্প করছে।
তিহু সোজা ওদের কাছে গিয়ে দাঁত চেপে বলে,
‘তোদের মধ্যে মিরজাফরটা কে?’
সবাই চুপ। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বোকা মুখ করে বসে আছে সবাই। নীলা চিপসের প্যাকেট রাহার থেকে কেড়ে নিয়ে বলে,
‘জীবন বাঁচানো ফরজ, জানিস না? আমরা তো কেবল নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছি।’
রাহা তাল মিলিয়ে বলে,
‘একদম তাই। তোর বর যেভাবে হুমকি দিচ্ছি…’
রাহা মাঝপথেই থেমে যায়। চোখ অন্যদিকে সরিয়ে এমন ভান করে যেন সে এ বিষয়ে কিছু জানে না। তিহু নিজের পেছনে প্রোণোর অস্তিত্ব টের পেতেই বুঝতে পারে রাহার আচরণের মানে। তিহু সবার দিকে ‘আই উইল সি ইউ লেটার’ টাইপের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে লোহার গেট পেরিয়ে বেরিয়ে যায়।
লম্বা ইটের রাস্তা। দু’ধারে ছোট-বড় সারি সারি গাছ। অল্প কিছু বাড়ি নজরে পড়ে। এখান থেকে মেইন রোড বেশ খানিক দূরে। তিহু হাঁটার গতি স্লো করে। প্রোণোর পাশাপাশি জায়গা করে নিয়ে হালকা করে কাশে। বলে,
‘কিছু বলার ছিলো না?’
প্রোণো ওর ফোন বের করে তিহুকে একটা ছবি দেখায়। সেখানে প্রোণোর সাথে অপরিচিত দুজনকে দেখা যাচ্ছে। যাদের একজন ছেলে এবং অন্যজন মেয়ে। প্রোণো বলে,
‘যেই ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছ ও আমার বন্ধু নাদিম। মেয়েটা ওর হবু বউ। ওদের প্রেমের বয়স যুগ পেরিয়েছে। সেই স্কুল লাইফ থেকে প্রেম ওদের। মেয়েটা আমাদের জুনিয়র। কিন্তু এত বছরে আমাদের সার্কেলের একজন হয়ে উঠেছে। গত দু’সপ্তাহ ধরে কিছু সমস্যা হচ্ছে ওদের ভিতর। মেয়ের বয়স হয়েছে, বাড়ি থেকে বিয়ের প্রেশার দিচ্ছে। এদিকে নাদিমের আরো কিছুদিন সময় দরকার। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে দু মাসও হয়নি। এই মুহূর্তে হাতে যথেষ্ট টাকা নেই। ব্লা ব্লা।
আজ মেয়েটা ওর বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে। জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছে পরিবার তাই। সাড়ে চার ঘন্টার মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। নাদিমকে কলে না পেয়ে আমায় কল করে। অমন পরিস্থিতিতে সবটা জানিয়ে বের হওয়ার কথা মাথায় আসেনি।’
তিহু ছোট করে শ্বাস ফেলে। তবে তার এখন অনেকটা হালকা লাগছে। ছোট্ট এই বোঝাপড়াটা সত্যিই জরুরি।
‘স্যরি।’
প্রোণোর বলা এই ছোট্ট শব্দটা তিহুর মুখে হাসি ফিরিয়ে আনে। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,
‘জায়গাটা সুন্দর না? এমন একটা জায়গায় বাড়ি করবেন। আপনি অবসর নেওয়ার পর আমরা দুজন সেখানে থাকব।’
প্রোণো তিহুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে। ছোট ছোট পায়ে চলতে চলতে বলে,
‘যা চাইবে!’
মোছাদ্দেফা বহুদিন পর রান্নাঘরে পা রেখেছে। তবে আজ তার মন খুব ভালো। ভালো থাকবে না ই বা কেন? ছেলে-মেয়েগুলো যে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক আচরণ করছে তার সাথে!
রেমী তাকে রান্নাঘরে দেখে বলে,
‘মা, কিছু লাগবে?’
‘নাস্তা বানাবে না?’
‘এই তো এখনই বানাচ্ছি।’
‘তুমি ঘরে যেয়ে বিশ্রাম কর। আমি বানাচ্ছি।’
রেমী মানা করতে যেয়েও করে না। মোছাদ্দেফাকে খুশি লাগছে। সে তা নষ্ট করতে চাইল না। মুচকি হেসে বলল,
‘কিছু দরকার হলে বলবেন। আমি ড্রয়িংয়ে আছি।’
.
.
প্রিমার আজ হঠাৎ করেই ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে। তাদের বাড়ি রেখে খানিকটা পথ হাঁটলেই ফুচকার দোকান। প্রান্তিকে দু-চারবার বলার পরও সে যেতে রাজি হয়নি। প্রিমা একাই ফোন হাতে ফুচকা খেতে বেরিয়ে পড়েছে।
নিচে নামতেই তার সাথে দেখা হয়েছে আলেয়ার সাথে। মার্কেট থেকে ফিরেছেন হয়তো। প্রিমা ভদ্রতার সাথে হেসে সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো। সাকিলের প্রতি তার ভালোলাগা কাজ করলেও তার মা কে প্রিমা সবসময় এড়িয়ে চলে। কোনো এক কারণে আলেয়া তাকে পছন্দ করেন না। মুখে না বললেও প্রিমা তার চোখ দেখেই বলে দিতে পারে।
‘এই সন্ধ্যা বেলায় কোথায় যাও?’
না চাইতেও প্রিমাকে আলেয়ার মুখোমুখি হতে হয়। সে সহজ ভঙ্গিতে বলে,
‘সামনে যাচ্ছি। ফুচকা খেতে।’
‘একা কেন? তোমার বুনটা কোই?’
‘ও ব্যস্ত। ওর জন্য পার্সেল আনব।’
উত্তরে আলেয়া খুব একটা খুশি হলো না। কিন্তু হেসে বললো,
‘দোকানে যেতে হবে না। আমার বাসায় আসো। আমি তোমাকে ফুচকা খাওয়াবো। ফুচকা খেতে খেতে কিছু গল্পও করা যাবে।’
প্রিমা মনে সন্দেহের দানা বুনছে। এত বছরে সে যতটুকু এই মহিলাকে চেনে তাতে করে এমন ব্যবহার মোটেও আশা করা যায় না। প্রিমা তৎক্ষণাৎ আলেয়ার ইনভিটেশন রিজেক্ট করে বলে,
‘সেটা তো অবশ্যই ভালো হয় তবে আজ না আন্টি। অন্য কখনো আসবো।’
কিন্তু আলেয়াও হাল ছাড়লো না। এক প্রকার টেনে নিয়ে গেল তাকে।
প্রিমাকে বসতে দেওয়া হয়েছে ডাইনিংয়ে। আলেয়া তাকে নানা কথা বলতে বলতে ফুচকা ভাঁজছে।
প্রিমা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। এখানে তার আনকমফরটেবল লাগছে।
‘আমার সাকিলের জন্য তো মেয়ে দেখেছি। জানো নাকি?’
প্রিমা অপ্রস্তুত হাসে। বলে,
‘আপনি না জানালে জানতাম না।’
‘সে কি কথা? সাকিল বলেনি?’
প্রিমা এতক্ষণে আলেয়ার মতলব বুঝতে পেরেছে। আলেয়া তার এবং সাকিলের মাঝে কোনো রকম সম্পর্ক আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাচ্ছে। সে এবার কিছুটা সহজ হয়। বলে,
‘কাল ও সাকিল ভাইয়ের সাথে কথা হলো। কিন্তু কিছু বললো না যে! তার মেয়ে পছন্দ হয়নি?’
প্রিমার পাল্টা জবাবে আলেয়া কিছুটা দমলেও চুপ থাকলো না।
‘পছন্দ হবে না কেন? মেয়ের যেমন রূপ তেমন গুণ। আমি তো ও বাড়িতে হ্যাঁ বলে দিয়েছি।’
‘তাহলেতো বেশ। খুব শীঘ্রই দাওয়াত পাচ্ছি।’
‘হ্যাঁ। তা পাচ্ছ। তোমরা দুই বুন আমার মেয়ের মতো। তোমাদের রেখে তো এমনিতেই অনুষ্ঠান করতাম না। তারপরও অগ্রিম দাওয়াত থাকলো।’
প্রিমা মাথা নাড়িয়ে হাসে।
সাকিল অফিস থেকে ফিরেছে খানিক বাদেই। প্রিমা তখনো তাদের বাসায়। হেসে হেসে আলেয়ার সাথে কথা বলছে। প্রিমাকে দেখে সাকিল থমকে যায়। বিশেষ করে তার মায়ের সাথে হেসে কথা বলার বিষয়টা তাকে বেশি অবাক করে।
‘এসেছিস?’
আলেয়ার কথায় প্রিমাও দরজার দিকে তাকায়। সাকিল অপ্রস্তুত হেসে বলে,
‘বাসায় অতিথি যে!’
আলেয়া কিছু বলার পূর্বেই প্রিমা বলে ওঠে,
‘আপনার বিয়ের ইনভাইট দিতে আন্টি আমায় নিয়ে আসলেন। বিয়ে করছেন বুঝি?’
সাকিলের মনে হলো তাকে পাহাড়ের শেষ সীমানায় দাঁড় করিয়ে প্রশ্নটা করা হচ্ছে। অস্বস্তিতে তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আলেয়া তীর্যক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সাকিল সহজ হতে খানিক হাসে। বলে,
‘বয়স হয়েছে। আর কতদিন এভাবে চলবে? বিয়ে তো করতেই হতো।’
প্রিমা ইমপ্রেসড। সে ভাবেনি সাকিল এত সাবলীল ভাবে জবাব দিতে পারবে। আবার কোনো এক কারণে প্রিমার ভালো লাগছে। লোকটা আজ অন্তত কনফিউজড হয়ে কোনো উত্তর দিচ্ছে না। হয়তো সে সত্যিই তার জন্য কাউকে খুঁজে পেয়েছে। যাকে নিয়ে ভাবতে বা উত্তর দিতে তাকে কনফিউজড হতে হয় না।
প্রিমা ঠোঁটে হাসি টেনে আলতো স্বরে বলে,
‘শুভ কামনা ভাইয়া।’
সাকিল চমকে তাকায়। প্রিমা হাসছে। কিন্তু সত্যিই কি হাসছে? প্রিমার চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি। চোখ দুটো যেন ব্যথায় কাতর। প্রসারিত ঠোঁট জোড়াও তিরতির করে কাঁপছে। সাকিল লম্বা পা ফেলে চলে যায় নিজ রুমে। কিসের একটা চাপা অনুভূতি তার গলা টিপে ধরেছে। সে কি ভুল করেছে? কোনো ক্ষমার অযোগ্য ভুল?
চলবে……..
#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৬.
বাহিরে আঁধার নেমেছে। ঝি ঝি পোকার ডাকে ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ। রোড লাইটটাও থেমে থেমে জ্বলে উঠছে। তিহু খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে দূরের তালগাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ সেভাবে তাকিয়ে থাকার পর বলে উঠলো,
‘প্রোণো, কখনো শুনেছেন তাল গাছে এক বুড়ি থাকে? যার এক পা বিশাল লম্বা। কাউকে দেখলেই বলে, পা টা টিপে দিবি?’
প্রোণো টিস্যুতে মুখ মুছে বলে,
‘আমার বাড়ির আশপাশে তাল গাছ ছিলো না। তাই আমায় পা টিপে দেওয়ার জন্য বলারও সুযোগ পায়নি বুড়ি।’
তিহু নাক কুঁচকায়। জানালায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘এভাবে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বাড়িতে।’
‘আজ রাতটা এখানে থেকে যাই?’
তিহুর কথায় প্রোণো এক ভ্রু তুলে বলে উঠলো,
‘তোমায় কে নিচ্ছে? আমি একা ফিরে যাচ্ছি।’
এমন জবাব কল্পনা করেনি তিহু। প্রোণো স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেও তিহুর মনে হচ্ছে প্রোণো রেগে আছে এখনো, তাই সে তিহুকে রেখেই চলে যেতে চাচ্ছে।
‘আমি কিভাবে ফিরব তাহলে?’
‘যেভাবে এসেছ।’
প্রোণোর সহজ উত্তর তিহুর ভালো লাগলো না। কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজেও পাচ্ছে না সে। চুপ করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। মনের ভেতরের থেমে যাওয়া ঝড় আবারো নতুন করে বইতে শুরু করেছে।
প্রোণো আয়নায় এক পলক তাকিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তিহু তখনো নিষ্পলক তাকিয়ে তার পানে। প্রোণো বোঝে, মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে টুপ করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
‘ইনজয় করো। কাল এসে নিয়ে যাব তোমায়।’
তিহু মুখ তুলে চায়। ভেজা গলায় বলে,
‘আজ কেন নয়?’
‘এতদিন পর বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছ। এই সুযোগটুকু কিভাবে কেড়ে নেই? মাঝে মাঝে সংসার, দায়িত্ব সব থেকে কিছুটা বিরতি নেওয়া দরকার। টেক ইট ইজি, ওকে?’
তিহু কি বুঝেছে তা প্রোণো জানে না। তবে প্রোণো এক পা সরে দাঁড়াতেই তিহু রুম থেকে বের হতে হতে বলে ওঠে,
‘আপনি নিচে যান, আমি সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসছি।’
প্রোণো তিহুর যাওয়ার পথে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা বোধগম্য হতেই সে ঠোঁট চেপে হেসে ওঠে।
_____________
সাকিলে ফোনে অনাকাঙ্ক্ষিত এক কল এসেছে। গত বিশ মিনিট সে ফোন হাতে পাথরের ন্যায় বসে আছে। তার মনে হচ্ছে তার জীবনের চাকা তাকে আড়ালে রেখে একা একা ছুটে চলেছে। কোনো কিছুই তার ভাবনা মতো হচ্ছে না। যেন তার জীবনের প্রতি কোনো কন্ট্রোল নেই তার। বরং তার জীবনের রিমোটটা অন্যকারো হাতে চলে গিয়েছে।
সাকিল রুম অন্ধকারে করে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে। মাথা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করে। খানিক সময় বাদে কলদাতা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে কল করে সে। ওপাশের মানুষটা হয়তো তার অপেক্ষাই করছিল। কল বেজে উঠতেই রিসিভ হয়।
‘সিদ্ধান্ত নিলেন সাকিল সাহেব?’
সাকিল দু আঙ্গুল কপালে চেপে রেখে জবাব দেয়।
‘ভাবছি।’
ওপাশ থেকে রিনরিনে কন্ঠের হাসি শোনা যায়। কলি হাসতে হাসতে বলে,
‘বেশি ভাববেন না সাকিল সাহেব। শরীর খারাপ করবে। আপনি চাইলে কিন্তু আমি আপনার সমস্যাটা সমাধান করে দিতে পারি।’
সাকিলের এমন দায়সারা কথা ভালো লাগছে না। কলি পুরোপুরি ভাবে তার মজা নিচ্ছে।
‘কলি?’
‘বলুন সাকিল সাহেব।’
‘আপনি কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাচ্ছেন?’
‘কোনো সন্দেহ?’
সাকিল ফুস করে শ্বাস ফেলে। বলে,
‘আপনার প্রতিটা শব্দই আমার কাছে সন্দেহের। কেন চাচ্ছেন আমায় বিয়ে করতে?’
‘কারণ আপনি বোকা।’
প্রশ্নটা সাকিল কৌতুহল থেকে করলেও উত্তরটা কাঙ্খিত ছিল না। সাকিল ভাষা হারায়। সামান্য অপমান বোধও হয়। তাকে চুপ করে যেতে দেখে ওপাশ থেকে কলি আবারও হেসে ওঠে। বলে,
‘সাকিল সাহেব! আর ভাববেন না। আপনি না চাইলেও আমি আপনার বউ হতে রাজি আছি। এখন থেকে ঠিক সাতদিন পর আমায় পুরোপুরি ভাবে আপনার করে নিয়ে যেতে ভুলবেন না। কেমন? আপনার পুরনো প্রেমিকাদের সাথে এই সামান্য সময়ে সবটা চুকিয়ে নেন। বেস্ট ওফ লাক।’
কলি কল কাটার আগেই সাকিল ফোন রেখে দেয়। ঘন্টাখানেক আগে যখন কলি কল করে জানিয়েছিল যে সাকিলের মা বিয়েতে হ্যাঁ জানিয়েছে, সাকিলের হঠাৎ করেই পুরো দুনিয়া আঁধার হয়ে এসেছিল। সন্ধ্যায় প্রিমাকে ওভাবে দেখার পর থেকে এমনিতেই তার দিন দুনিয়া ওলাটপালাট হয়ে গিয়েছিল। সাকিল কেন যেন চেয়েও তার মায়ের উপর রাগ করতে পারছিল না। তার কেবল নিজেকে অসহায় লাগছিলো।
কলি হয়তো তার পরিস্থিতি বুঝেছিল। তাইতো সাকিল কিছু বলার আগেই বলেছিল,
‘আপনাকে এক ঘন্টা সময় দিচ্ছি সাকিল সাহেব। এই ঘন্টার মাঝে আমি আপনার মতামত জানতে চাই। আপনার সিদ্ধান্তটাই আমাদের জন্য চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’
কলির দেওয়া এক ঘন্টা সাকিল ভেবেছে। বারবার ভেবেছে। কিন্তু সে কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। সে খুঁজে পায়নি সে কি চায়।
সে কলিকে নিয়েও ভেবেছে। ফলাফল খুব একটা ভিন্ন নয়। সাকিল সেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছে প্রিমা বা প্রান্তি কেউই তার ভালোবাসা নয় বরং ভালোলাগা। সে যাকে ভালোবাসে তার হয়তো এই পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্ব নেই। সে এমন এক চরিত্র যে প্রান্তির কোমলতা আর প্রিমার তীক্ষ্ণ, কঠোর চরিত্র নিয়ে তৈরি। সাকিল চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সে সত্যিই আর ভাবতে চায় না।
‘ভাইয়া খেতে আসো।’
সাকিল উঠে সোজা খাবার ঘরে চলে যায়। চেয়ার টেনে বসতেই আলেয়া আড় চোখে চেয়ে বলেন,
‘কিছু হইছে খোকা?’
‘না।’
আলেয়া প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেন,
‘ওবাড়ি থেকে কল করেছিল। আমি কোনো ভনিতা ছাড়াই রাজি হয়ে গেছি বিয়ের জন্য।’
‘ভালো করেছেন।’
আলেয়া খালি গলায় বিসম খেলেন। সাকিলের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাবিহাকে বললেন,
‘কি বললো ও?’
‘বলেছে ও বিয়েতে রাজি।’
আলেয়া বেগমের চোখে পানি চলে এসেছে। সে তার খুশির পরিমাণ বোঝাতে না পারলেও আলতো হেসে বললেন,
‘আপার উপর রাগ করছিস খোকা? তোর মত না থাকলে বল। আমি কথা বলবো ওদের সাথে।’
সাকিল খাওয়া থামায়। কিছুটা রেগে বলে ওঠে,
‘আম্মা, আমার কোনো কথা কেন আপি শোনেন না বলবেন? যখন রাজি ছিলাম না তখন ও বারবার একই বিষয় নিয়ে বিরক্ত করেছেন। এখন রাজি হয়েছি এখন এটাও আপনার জন্য সমস্যার হয়ে দাঁড়াইছে। আপনি কি চাচ্ছেন?’
আলেয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। সাকিল কখনো এভাবে কথা বলেনি তার সাথে। এটাই হয়তো প্রথম। তবে সে আজ আর কিছু বলে না। কোনো অভিযোগ ছাড়াই সাবিহাকে খাবার দিয়ে সে নিজের ঘরে চলে যায়। ঘরে যেতেই তার মন ভালো হয়ে যায়। ফোন হাতে ভাই বোনকে কল করে সুখবর দিতে শুরু করে। সামনের সপ্তাহেই ছোটখাটো আয়োজনের মাধ্যমে বউ ঘরে তুলছেন সে।
_________________
আজকের ডিনার টেবিলটা অদ্ভূতভাবে পরিপূর্ণ লাগছে। মোছাদ্দেফা অনেকদিন বাদে সবার সাথে খেতে বসেছেন। তিহু এই আনন্দে কখন থেকে ছোটাছুটি করে কাজ করছে। ওকে কেউ বাঁধা দিচ্ছে না। এ বাড়িতে আসার পর এ বাড়ির আসল সৌন্দর্যটা ও উপভোগ করার সুযোগ পায়নি। রেমী হাসতে হাসতে বলে,
‘আজ বড় ভাবীই তাহলে সার্ভ করুক।’
তিশাও তাল দিল। প্রিমা তখনো নিচে নামেনি। তিহু প্রান্তিকে বলে,
‘তোমার টুইন কোথায়?’
‘ঘর আটকে বসে আছে।’
রেমী বলে,
‘কেন? ঝগড়া করেছ দুজন?’
প্রান্তি মাথা নাড়িয়ে না করে।
তিহু বলে,
‘তোমরা বসে পড়। আমি ননদীকে নিয়ে আসছি।’
প্রিমার রুম অন্ধকার। তিহু রুমে ঢুকে বাতি জ্বালায়। আলো জ্বলতেই রুমের বেহাল অবস্থা নজরে আসে। যেন ছোট খাটো কোনো সুনামি বয়ে গেছে এ ঘরে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে প্রিমা। তিহু তার দিকে দু আগাতেই প্রিমা বলে,
‘ভাবী, আমি খাব না। বাতি বন্ধ অরে নিচে যাও তুমি।’
প্রিমার কন্ঠস্বর ভারী। যেন অনেক কেঁদেছে সে। তিহু বাতি নিভিয়ে দেয়। কিন্তু সে যায় না। ধীরে এসে বিছানায় বসে। আলতো গলায় বলে,
‘মা আজ সবার সাথে খেতে বসেছেন। তোমায় ছাড়া কতটা অপূর্ণ লাগছে টেবিলটা জানো?’
প্রিমা জবাব দেয় না। তিহু কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
‘ছাদে যাবে? চাঁদ উঠেছে আজ। তুমি তোমার মন খারাপের কথা আমায় না বললে। চাঁদকে বলতে তো দায় নেই। যাবে?’
প্রিমা ভেজা গলায় বলে,
‘তুমি কাউকে ভালোবেসেছ ভাবী?’
‘বেসেছিতো। তোমার ভাইয়াকে।’
প্রিমা শোয়া থেকে উঠে বসে। বলে,
‘সাকিল ভাই বিয়ে করছেন। এটা কি মেনে নেওয়ার বলো? আমি কি সুন্দর নই ভাবী? মেয়েটা তাহলে আমি না হয়ে অন্য কেউ কেন?’
চলবে….