#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৮.
রাত ফুরিয়েছে। ভোরের আলোয় তখন উজ্জ্বল চারপাশ। পূব আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। স্নিগ্ধ সূর্যরাশি জানালার সূক্ষ্ম ফাঁকাটুকু থেকে বেরিয়ে এসেছে। তিহু তখনো ঘুমে বিভোর। তার পাশের মানুষটা কখন উঠে পড়েছে সে দিকে হয়তো তার খেয়াল ও নেই।
বেড সাইড টেবিলে পড়ে আছে ছোট্ট একটা চিরকুট। যা কলম দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। প্রান্তি বিছানায় বসে। মুখখানা ছোট করে বলে,
‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ভাবী। ভাই না করেছিল তোমায় ডাকতে। কিন্তু প্রিমাকে লাইনে পাচ্ছি না। কাল বিকেলের পর ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি।’
তিহু প্রান্তির চিন্তার কারণ বোঝে। সে পুনরায় হাই তুলে বলে,
‘চিন্তার কিছু নেই ননদী। সে ঠিক আছে।’
প্রান্তিকে নিরাশ দেখালো। প্রিমা ঠিক আছে এতটুকু সে জানে। কিন্তু সে কি মানসিক ভাবে ঠিক আছে? প্রান্তির না বলা এই কথাটুকু তিহু বুঝে নেয়। সে প্রান্তিকে আস্বস্ত করতে বলে,
‘আজ বিকেলেই প্রিমা ফিরে আসবে। তাই চিন্তা কর…’
কথার মাঝেই তিহুর খেয়াল হলো প্রোণো নেই। তার ল্যাগেজ নেই রুমে। তিহু চমকে দেয়াল ঘড়িতে তাকায়। তার বুকের ভিতরটা ডিপ ডিপ করছে। মনের কোনো এক জায়গা থেকে সে চাচ্ছিল সময় যেন বেশি না হয়। কিন্তু ভাগ্য কি সবসময় সহয় হয়? তিহুর ভাগ্য তিহুর পাশে ছিল না। প্রোণোর ফ্লাইট ছিল সাতটায়। এখন সময় সাতটা বেজে আঠারো মিনিট। তিহুর বুকটা ভার হয়ে আসে নিমিষেই। অভিমানে চোখে জমতে শুরু করে জল। কি হতো যাওয়ার আগে তাকে একবার ডাকলে?
তিহুর চোখ পড়ে ছোট্ট টেবিলের উপর। ছোট চিরকুটটা তখনো কলমের নিচে চাপা অবস্থায় পড়ে আছে। তিহু চিরকুটটা হাতে নিতে দেখতে পায় তাতে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা রয়েছে,
‘ঘুম ভাঙালাম না বউ। উঠে আমায় খুঁজে না পেয়ে অভিমান করো না কেমন? নিজের যত্ন নিও। খুব শীঘ্রই যোগাযোগ করবো। অপেক্ষায় থেকো!’
চোখে জমা হওয়া জলটুকু এবার যেন বাঁধা ভেঙে গড়িয়ে পড়তে চায়। তিহু চিরকুটটা বালিশের নিচে রেখে বিছানা থেকে নামে। বলে,
‘প্রিমা বিকেলেই ফিরবে। চিন্তা করো না। রাতে কথা হয়েছে আমার সাথে।’
চোখের জলটুকু লুকাতে সে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
তিহু যেতেই প্রান্তি তার হাতে থাকা ফোন দিয়ে প্রোণোর ফোনে ম্যাসেজ পাঠায়।
‘ভাই, ভাবী উঠেছে। মন খারাপ করেছে মনে হচ্ছে। একবার বলে গেলে ভালো হতো না?’
ম্যাসেজ সিন হয়না। অবশ্য সেটা আশাও করেনি প্রান্তি। কে জানে, এবার কতদিনের জন্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে!
_____________
প্রোণো চলে যাওয়ার পর থেকে তিহুর জীবনের পাতা খুব দ্রুতই উল্টে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল তার সময় কাটতে চাইবে না। কিন্তু, তিহু বর্তমানে পাক্কা গৃহিণী হয়ে উঠেছে। সংসার সামলে সে নিজেকে দেওয়ার জন্য খুব অল্প সময়ই হাতে পায়। তাছাড়া প্রান্তি আর প্রিমা তো রয়েছেই। ওদের জন্য তার অবসর সময় গুলোও হয়ে ওঠে ব্যস্ততার। এভাবেই দেখতে দেখতে যেন কিভাবেই তিনটা মাস পেরিয়ে গেল। প্রোণোর সাথে তখনো কোনো যোগাযোগ নেই। তিহু রোজ রাতে ফোনের পানে চেয়ে অপেক্ষা করে। এই বুঝি কল এলো! কিন্তু পরক্ষণেই হতাশ হয়ে ক্লান্ত চোখগুলোকে বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দেয়।
অপেক্ষায় অপেক্ষায় তিহুকে আজকাল এক ভয়ংকর রোগে পেয়েছে। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে ঘুমের মাঝে তার অনুভব হয় প্রোণো এসেছে। বিছানায় বসে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার ঘুমন্ত মুখপানে।
তিহু স্পষ্ট অনুভব করে সেই তীক্ষ্ণ চাহনি। ঘুম ভেঙ্গে যায় তার।
কিন্তু, রুম জুড়ে গাঢ় নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না সে। সেসব রাতে তিহুর আর ঘুম হয়না।
বাকি রাতটুকু সে ডায়েরির পাতায় অগোছালো অনুভূতিদের জমা করে কাটায়। কখনো কখনো লিখতে লিখতে দু চোখ ভিজায়। কখনো দারুন অভিমানে প্রোণোর রেখে যাওয়া সফেদ রঙের শার্টটাকে দু হাতে আঘাত করে। সবশেষে যখন ক্লান্ত হয়ে পরে, তখন মেঝেতে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে।
মোছাদ্দেফা দুদিন তাকে মেঝেতে ঘুমাতে দেখে বকেছেন। শেষে রাগ করে বলেছেন,
‘প্রোণো ফিরলে বিচার দিব, বলবো তোর বউ যদি আমার কথা না শোনে তাহলে তোর সাথে নিয়ে যা।’
শ্বাশুড়ির কথাটা খারাপ লাগেনি তিহুর। প্রোণো তাকে নিয়ে গেলে খুব একটা খারাপ হবে না।
আজকাল তিহুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। খাবারের গন্ধ ভালো লাগে না। তিহু ভেবেছে সে তার বরের শোকে দেবদাসি হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তার শোক ঘুমকে কেড়ে নিয়েছে বহু আগেই এখন খাওয়া ও!
কিন্তু বিষয়টা শোকের না তা বুঝতে সময় লাগলো কয়েকদিন। এই তো দুপুরে, মাছ রান্না করতে গিয়ে গা গুলিয়ে আসলো। ছুটে বাথরুমে যেতেই বমি হয়ে গেল। প্রথম দিকে এটাকে স্বামী শোকের অসুস্থতা ভাবে দেখলেও বাড়ির লোকেরা এখন এটাকে অন্য কিছু ভাবছে।
রেমী তাকে রান্নাঘরের আশপাশে যেতে মানা করে দিয়েছে। তিহু সেটা চায় না। কিছু করার না থাকলে তার সময় কাটবে কিভাবে?
মোছাদ্দেফা তাই তিহুকে কাঁথা সেলাই করা শেখাচ্ছেন। দুদিন হলো তিহু তার শাশুড়ির সাথে বসে বসে কাঁথা সেলাই করা শিখছে। প্রিমা তা দেখে মজা করে বলে,
‘তোমরা যে হারে কাঁথা সেলাই করছো এ তো চার পুরুষের বাচ্চাকাচ্চারা ও শেষ করতে পারবে না। এক কাজ করি চলো, অনলাইনে সেল করে দেই। ভালো হবে না?’
তিহু ও প্রতিউত্তরে বলে,
‘তুমি বিয়ে করে নেও না ননদী। তাহলে আর বিক্রি করার প্রয়োজন পরবে না।’
প্রিমা উত্তরে লাজুক হাসে। বলে,
‘তুমি ছেলে খুঁজে দিলে আমার বিয়েতে আপত্তি নেই। তোমার কাঁথার সামান্য ভাগ নিতে হেল্প করতেই পারি।’
তিহু চোখ বড়বড় করে তাকায়। প্রিমা শব্দ করে হেসে ওঠে। এ কয়মাসে সাকিল নামক বিভীষিকা থেকে নিজেকে পুরোপুরি ভাবে ছাড়িয়ে নিয়েছে সে। গতমাসে সাকিলরা বাসা পাল্টেছে। তবে তিহুর মনে হয়েছে সাকিল ছেলেটাও তার জীবন আজ বা কাল একদিন ঠিক গুছিয়ে নিবে। কলি মেয়েটা চতুর। নিজের সংসার আয়ত্তে আনা তার পক্ষে খুব একটা কষ্টকর হবে না। তবে এতকিছুর মাঝে যাকে নিয়ে তিহুর খুব চিন্তা হত সে হচ্ছে প্রিমা।
মেয়েটা কেমন চুপ হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ করে এসবের সাথে মানিয়ে নিতে খানিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। প্রিমাকে সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে দেখে সত্যিই ভালো লাগছে তার।
তিহু মুখ ফুলায়। রাগের ভান করে বলে,
‘তোমরা দেখি বোনেরা ঘসেটি বেগমের মতো। মায়া-দয়া নেই। পাষাণ স্বভাবের। তোমার ভাইটা না বলেই হাওয়া হয়ে গেল। আজ অবদি বউয়ের খোঁজ পর্যন্ত নিল না। যেন বিয়ে করে দায় সেরে ফেলেছে। অন্যদিকে তুমি ননদী ও আমাকে একা ফেলে রেখে পালাবার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছ। একটু কি মায়া নেই তোমাদের?’
তিহুর কথায় ভঙ্গি পরিবর্তন হতে দেখে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে হেসে ওঠে প্রিমা। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়। প্রান্তি ঝমক দিয়ে বলে,
‘চুপ করবি? আমি এখানে কিছু একটা করার চেষ্টায় আছি।’
প্রান্তি তার পোক্ত হাতে তিহুর কাঁথা সেলাই করার দৃশ্যটা ক্যানভাসে বন্দি করার চেষ্টায় আছে। রঙ তুলিতে আঁকা সে ছবিখানায় তিহুকে প্রচন্ড প্রাণোচ্ছল লাগছে। এ যেন সেই পুরোনো তিহু যে উজ্জ্বল মুখে ছুটে বেড়াত কোনো বাঁধা না মেনে।
_____________
জানালায় কিছু চাল ছড়িয়ে দিয়ে পর্দার আড়ালে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে বসে আছে তিহু। দূরের ডালটায় দুটো নাম না জানা পাখি বসে আছে। চেষ্টা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিগত দশ মিনিট ধরে সে এভাবেই চাল দিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের আগমনের জন্য। কিন্তু কয়ের মিনিট পার হলেও তারা আসলো না। বরং উড়াল দিলো আরো দূরের কোনো এক ডালের ঠিকানায়।
তিহুর পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। ফুস করে শ্বাস ফেলে কাউকে বলে,
‘দেখলি? আমাদের মা ছেলেকে কেউ দাম দেয় না। যেখানে তোর বাপটাই দাম দেয়না সেখানে ঐ ছোট্ট পাখিটা কিভাবে দিবে?’
কোনো জবাব না এলেও তিহু এক নিরব জবাব কল্পনা করে নেয়। মুখ ভার করে বলে,
‘আমি তোর বাপকে দোষারোপ করছি না সোনা। তোর বাপ সত্যিই একজন খারাপ মানুষ। এভাবে কে বউ ফেলে চলে যায়? আমার কথা বাদ। তোর কথা একবারও ভেবেছে সে?’
কথা বলতে বলতেই গলার স্বর মলিন হয়ে আসে তার। নিচু গলায় বলে,
‘তোর কথা তো সে বোধহয় জানেও না। সে যখন ফিরবে তুই হয়তো তখন অনেক বড় হয়ে যাবি। তাকে বাবা বলে ডাক দিলেই দেখবি সে জ্ঞান হারিয়েছে।’
বিষয়টা তিহু সত্যিই ভেবে দেখেছে। প্রোণো যদি আর দুই পাঁচ বছর পর ফেরে ততদিনে তাদের বাচ্চাটা বড় হয়ে যাবে। প্রোণোকি তাকে দেখে চমকে যাবে না? হয়তো উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে কোনো সিন তৈরি করতে পারে। তিহু তখন কি করবে? রাগ করবে নাকি অভিমান?তিহুর মনে হয় সে এ দুটোর কোনোটাই করবে না। বরং প্রোণোর চিন্তিত মুখ, ঘাবড়ে যাওয়া চোখ দেখে হাসিতে ফেটে পরবে। হাসতে হাসতে সে মেঝেতে গড়াগড়ি খাবে।
তিহু আবারো একবার তার ফোন চেক করে। কোনো কল আসেনি। সে ফোনটা পূর্বের অবস্থায় রেখে দিয়ে বলে,
‘আজ থেকে আমিও আর অপেক্ষা করবো না। একদমই না।’
তিহু বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ে। সময়ের সাথে সাথে তার ঘুমের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। কোনো কাজ ছাড়াই তার নিজেকে সর্বক্ষণ ক্লান্ত লাগে। বিছানায় পিঠ ঠেকানোর সাথে সাথেই ঘুম জড়িয়ে নেয়।
তাছাড়া তার শরীরটাও এখন আগের থেকে কিছুটা স্বাস্থ্যবান বলে মনে হয়। মুখখানা খানিকটা গোল রসগোল্লার আকার ধারণ করেছে। পেট খুব একটা না ফুললেও স্বাভাবিকের তুলনায় অল্প বড় হয়েছে। হাঁটতে ইচ্ছা হয়না। খাবার তার রুমেই দিয়ে যায় রেমী।
তিহুর রুমে টেলিভিশন ছিলো না। প্রান্তিক কিছুদিন আগে টেলিভিশন সেট করে দিয়েছে। একা একা খুব একটা খারাপ লাগে না তার।
তিহুর আজ ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে। সাধারণত সে দুপুরে এতটা ঘুমায় না। বিকেলের দিকে তার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে। কাজেই ঘুম থেকে উঠে হাল্কা খাবার খেতে হয় তাকে। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙলো রাত করে।
তিহু নড়াচড়া করতে পারছে না। শরীরে প্রচন্ড ভার অনুভব হচ্ছে। দু একবার চেষ্টা করতেই কেউ বলে উঠলো,
‘ক্ষুধা লেগেছে? খাবে কিছু?’
চেনা কন্ঠস্বর। তিহুর মনে পরে সেই প্রথম দিনের কথা। এভাবেই প্রোণোকে প্রথম দেখেছিল সে। তিহুর থমকে যাওয়া হৃদস্পন্দন আবারো চলতে শুরু করে তীব্রগতিতে। সে টলমলে চোখে মাথা নোয়ায়। কপাল ঠেকায় প্রোণোর বুকে। ফিসফিস গলায় বলে,
‘এত দেরী কেন করলেন প্রোণো? আমি অপেক্ষা করেছি। অনেক অপেক্ষা করেছি। প্রতিটা মুহূর্ত আপনার অপেক্ষা করেছি। কেন আগে আসলেন না?’
প্রোণোর হাতের বাঁধন জোরালো হয়। সে তিহুর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘আগে এলে কি তোমায় অপেক্ষা করতে দেখতে পেতাম? অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় তিহু। আজকের এই মুহূর্তের মতো মিষ্টি।’
তিহুর অনুভব হলো এটা সত্যিই এক উষ্ণ, মিষ্টি অনুভূতি। অনেকটা সূর্যাস্তের রক্তিম লাল সেই আকাশের মতো। সুন্দর, মিষ্টি আর ভালোবাসায় পূর্ণ এক অনুভূতি।
|সমাপ্ত|