এই সাঁঝবাতি পর্ব-০১

0
16

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ০১
#অক্ষরময়ী

পুরান ঢাকার অখ্যাত বাসা বাড়ি লেন, শরতের রৌদ্রস্নাত এক সকালবেলা সরু গলির চিকন রাস্তাটির একদম শেষের বাড়িটি থেকে একটি বাইক নিয়ে এগিয়ে আসছিল সানান। গলি পেরিয়ে মেইন রোডে প্রায় উঠেই গিয়েছিল তার বাইকটি। কিন্তু বিপত্তি ঘটল তার ঠিক আগমুহূর্তে।

গলির উত্তর দিকের প্রথম বাড়িটি, যার নাম “আরাম-আয়েশ” সেটার ছাদ থেকে রিমঝিম বৃষ্টির মতো এক ঝাঁক পানি এসে ভিজিয়ে দিল সানানকে।

রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে আকস্মিক বারিধারায় হকচকিয়ে গিয়ে বারকয়েক দু চোখের পলক ঝাপটে মুহূর্তেই চোখ মেলে উপরের দিকে চাইল সানান।

দোতলা বাড়িটির শ্যাওলা পড়া ছাদের কার্নিশ থেকে চকিতে সরে গেল একটি ছায়ামূর্তি। তবুও সানানের চোখ ফাঁকি দিতে পারল না সে। জিহ্বায় কামড় দিয়ে এক চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত রেখে টুপ করে ছাদের মেঝেতে বসে আত্মগোপনকারীকে উদ্দেশ্য করে সানান তীক্ষ্ম কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,

– কোন বেয়াদব পানি ফেলল কে রে?

ছাদ থেকে কারো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। যেনো নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে সে। ততক্ষণে বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে সেটাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সানান। দু হাতে এলোমেলো চুলগুলো থেকে জলের কণিকা মুছতে মুছতে সানান ধমকে উঠল,

– আমি জানি তুই ওখানেই লুকিয়ে আছিস। এক্ষুনি বের হ বলছি।

সানানের ধমকে কাজ হলো না। ব্যক্তিটি সামান্যতম নড়াচড়া না করে ঘাপটি মেরে বসে রইল। তীব্র মেজাজ খারাপ হলো সানানের।

– তুই বের হবি নাকি আমি উপরে আসব? আমি উপরে গেলে আজকে তোর কি অবস্থা করব সেটা নিশ্চয় জানিস?

ব্যক্তিটির সারা গা কেঁপে উঠলেও টু শব্দ করল না সে। সানান মহা বিরক্ত হয়ে বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হওয়ার আগে আবার ধমকে উঠল,

– বের হবি না তুই? সাঁঝবাতি? এই সাঁঝবাতি? দাঁড়া আসতেছি আমি।

এরপর আর লুকিয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল একজন কিশোরী। ভয়ার্ত হরিণের মতো ভয় খেলা করছে তার কুচকুচে কালো চোখের তারায়। তার আতঙ্কিত ফ্যাকাশে মুখ দেখেও সামান্যতম মায়া জন্মালো না সানানের মনে। কোমরে দু হাত রেখে মুখ উঁচু করে উপরের দিকে তাকিয়ে আগের তুলনায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে সানান ধমকে উঠল,

– আমার গায়ে পানি ফেললি কেন?

কিশোরীটি শুকনো ঢোক গিলে অমিলন মুখে সানানের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,

– ইচ্ছে করি ফেলেনি, সানান ভাই। গাছে পানি দিচ্ছিলাম। ভুল করে আপনার গায়ে…

চকিতে বিরক্তি ভর করল সানানের মুখমন্ডলে। চোখ দুটো সরু করে তাকিয়ে বলল,

– থাপড়ে সব কটা দাঁত ফেলে দিব বেয়াদব। মিনমিন করে কি বলতেছিস? জোরে বল।

গায়ে জড়ানো ওড়নার এককোণ শক্ত করে মুঠোবন্দী করে কিশোরীটি বলল,

– পাইপ দিয়ে গাছে পানি দিচ্ছিলাম। আপনি যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা দেখতে পাইনি। স্যরি।

– আমার মতো ছয় ফুটের হাট্টাগাট্টা একটা ছেলেকে তুই দেখতে পাইসনি? ফাজলামি করিস আমার সাথে?

– খেয়াল করিনি সানান ভাই। আপনমনে কাজ করছিলাম।

– কাজ করে উদ্ধার করে ফেলছিস একদম। কাজ দেখাচ্ছে আমাকে! এই, মন কই থাকে তোর? কার খেয়ালে ডুবে থাকে?

সানানের সাথে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। বরং তার প্রতিটি কথার বিপরীতে বকাঝকা দিয়ে তাকেই ধরাশায়ী করে ফেলা হবে। তাই কিশোরীটি অন্ধকার মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সানান হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,

– খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

– কী করবো?

মুখ ফুলিয়ে জানতে চাইল কিশোরীটি।

– আবার মুখে মুখে তর্ক করতেছিস! তোর কপালে আজকে ভরপুর মাইর আছে, সাঁঝবাতি। চট জলদি নিচে আয়। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।

– এখনো নাস্তা করিনি। এভাবে বাড়ি থেকে বের হলে আম্মু বকবে।

আরও কিছু বলতে গিয়েও সানানের রুদ্রমূর্তির সামনে চুপসে গেল কিশোরীটি। পানির পাইপ ওখানেই ফেলে দ্রুত পায়ে ছুটল নিচে।

°

দোতলা বাড়িটির অন্য সদস্যরা তখন নিজেদের কাজে ব্যস্ত। সবার নজর এড়িয়ে খুব সহজেই নিচতলায় এসে পায়ের গতি কমল কিশোরীটির।

নিচতলার অর্ধেক স্থান ফাঁকা। বাকি অর্ধেক জুড়ে রয়েছে একটি বিশাল কক্ষ। যেখান থেকে ভেসে আসছে একটি দরাজ কণ্ঠস্বর। লম্বাটে কক্ষটিতে দুটি দরজা। প্রথম দরজায় উঁকি দিল কিশোরীটি।

তাকে দেখে কক্ষে উপস্থিত কিশোর-কিশোরীদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল। পড়াশোনা রেখে তাদেরকে উৎসুক চোখে দরজার দিকে তাকাতে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে থেমে গেল দরাজ কণ্ঠটি। কয়েকপল নীরবে তাকিয়ে থেকে সম্মুখে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সাদিক শারাফাত নিজেও তাকালেন দরজার দিকে।

দরজায় উঁকি দেওয়া কিশোরী বালিকার স্নিগ্ধ, সতেজ মুখটি দেখে সাদিক শারাফাতের পাথরসম কঠিন মুখটি চট করে কোমল, নরম মমতায় ভরে উঠল। হাতের ধরে রাখা অষ্টম শ্রেণীর গণিত বইটি টেবিলের উপর রেখে সাদিক এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললেন,

– সাঁঝ! কিছু বলবি, মা?

সুর্যের প্রথম কিরণের মত ঝলমলে হাসি খেলে গেল সাঁঝের মুখে। বাবার মতোই নিচু স্বরে উত্তর দিল সে।

– বড় মায়ের ওখানে যাচ্ছি।

নিচতলার শেষদিকে অবস্থিত সিঁড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে সাদিক মেয়ের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললেন,

– এতো সকালে ওই বাড়িতে কেনো? তোর মা জানতে পারলে ভীষণ বকবে।

– সানান ভাই ডাকছে। না গেলে মারবে। দুদিকেই বিপদ। যত জ্বালা হয়েছে আমার। উফ!

মেয়ের বিপদের সংবাদ শুনে সাদিক শারাফাতের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা গেল। চঞ্চল চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

– দৌড় মেরে যাবি, নাস্তার ডাক পড়ার আগেই দৌড় মেরে চলে আসবি।

– আচ্ছা।

আবার ছুটতে শুরু করল সাঁঝ। লোহার দরজাটি পেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই নজরে এলো অস্থির চিত্তের সানান। রাস্তায় এলোমেলো পায়েচারি করছে সে। সাঁঝকে দেখে একপ্রকার খেকিয়ে উঠল।

– ছাদ থেকে নামতে এতোক্ষণ সময় লাগে? ময়দার ডিব্বা নিয়ে ময়দা মাখতে বসে গিয়েছিলি নাকি?

সানানের কথা শুনে সাঁঝের মন থেকে ভয়টা উড়ে গিয়ে জন্ম নিল রাগ। মেকআপ নিয়ে কেউ কিছু বললে ওর সহ্য হয় না। অথচ সানান ভাই প্রতিনিয়ত ওর সাজসজ্জা নিয়ে বিদ্রুপ করে কথা বলে। বিশেষ করে মেকআপ নিয়ে। একদম সহ্য হয় না সাঁঝের। অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত। কিন্তু সানান ভাইকে কিছু বলা যাবে না। কিছু বললেই রাক্ষসের মতো বিশাল হাতটা এখনি এসে পড়বে সাঁঝের গালে। তাই মনের রাগটা মনের ভেতর দাফন করে ফেলে সাঁঝ বলল,

– মেকআপের সাথে ময়দার তুলনা করবেন না। মেকআপ অনেক দামী প্রোডাক্ট।

সানান চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলল,

– ওমা! তাই নাকি! তা কত দাম তোর এই আটা-ময়দার?

সাঁঝ বাঁকা চোখে তীব্র বিরক্ত নিয়ে তাকালে সানান ঝট করে মুখটা গম্ভীর করে ধমক দিল।

– আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস তুই! এত বড় সাহস! চোখ নামা। এখনি নামা।

সাঁঝ চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল,

– একেকটা প্রোডাক্টের দাম হাজার হাজার টাকা।

– সে আমার এই হুডিটার দামও হাজার টাকা। যেটা তুই একটু আগে বৃষ্টি নামিয়ে ভিজিয়ে দিলি।

সাঁঝ আড়চোখে একবার সানানের গায়ের হলুদ হুডিটা দেখে নিয়ে মুখ কুঁচকে আবারও মাটির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এই মানুষটার ফ্যাশন সেন্স এতো জঘন্য! দেখলেই বমি পায় সাঁঝের। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। সানান ভাই নিজেকে এই বাসা বাড়ি লেনের রাজকুমার ভাবেন। শুধু বাসা বাড়ি লেনের কথা বলছি কেন! সানান ভাই তো পুরো পুরান ঢাকায় জনপ্রিয় মানুষ। সে হিসেবে নিজেকে বোধহয় পুরো পুরান ঢাকার রাজকুমার কল্পনা করেন তিনি।

– এই সাঁঝবাতি? কথা কানে যাচ্ছে না?

কল্পনার রাজ্য থেকে ধপ করে বাস্তবে পদার্পণ করল সাঁঝ। মুখখানা কুঁচকে বলল,

– আমার নাম সাঁঝবেলা।

– তাই নাকি! আমি তো জানতাম তোর নাম সাঁঝবাতি।

সানানের ব্যঙ্গাত্মক সুরে সাঁঝের মিষ্টি সকালটা তেতো হয়ে গেল। ঝগড়ুটে মানুষটার সাথে কথা বাড়িয়ে মেজাজ বিগড়ানোর চেষ্টা না করে চুপ থাকাই শ্রেয় থাকা মনে হলো।

– সকালবেলা এইসব আলতু ফালতু কাজ করার আগে তোর ভাবার উচিত ছিল যে, এই সময় মানুষজন পরিপাটি হয়ে নিজেদের কাজে যায়। তুই ছাদে উঠে বৃষ্টির বর্ষণ করে তাদের শুভযাত্রা নষ্ট করার তালবাহানা শুরু করেছিস! আহাম্মক।

গালাগালির সাথে তালমিলিয়ে সাঁঝের মাথায় চাটি পড়ল একটা। ব্যথাপ্রাপ্ত স্থানে হাত বুলিয়ে সাঁঝ আবারও দুঃখ প্রকাশ করে বলল,

– ভুল হয়ে গেছে। স্যরি।

– তোর স্যরি দিয়ে আমি কি করব? আমার অফিসযাত্রা শুভ হয়ে যাবে? তোর মতো আপদের চেহারা দেখেছি মানে ধরে নে, আমার সারাটা দিন আজকে গোল্লায় গেল।

অপমান গায়ে না মেখে সাঁঝ অবাক চোখে তাকিয়ে সানানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,

– আপনি এভাবে অফিস যাচ্ছেন?

হলুদ হুডি, কালো ট্রাউজার, সাদা কমলা রঙের স্নিকার্স পরিহিত সানান নিজের দিকে তাকিয়ে অসামাঞ্জস্য কিছু খুঁজে পেল না। সরু চোখে সাঁঝের কুঁচকানো মুখটি পর্যবেক্ষণ করে ওর মাথায় আরেকটি চাটি মেরে বলল,

– ওমন ড্যাবড্যাব করে তাকায় আছিস কেন? আমার পোশাকে কি সমস্যা?

সাঁঝ সে প্রসঙ্গে না গিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,

– স্যরি তো বলেছি। আর কি করতে হবে বলুন।

সানানের মাথা ভর্তি মাঝারি দৈর্ঘ্যের ঈষৎ কোঁকড়ানো চুল। বাবুই পাখির বাসার মতো এলোমেলো হয়ে আছে। চওড়া কপালসহ কান দুটো ঢেকে রাখা কুচকুচে চুলগুলো দেখে সাঁঝের মনে হলো, ঘুম থেকে উঠে কোনোরকম হুডি গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সানান। অথচ তখন থেকে পরিপাটি হয়ে অফিস যাত্রার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে তাকে।

সানান তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ আরও গাঢ় করে গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল,

– মাত্রই কালকে ধুয়ে রাখা হুডিটা তুই নোংরা করে দিলি। এখন এটা তুই পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে সুন্দরমতো ভাঁজ করে আমার আলমারিতে তুলে রেখে আসবি।

সাঁঝ জানে এই নিয়ে তর্ক করে কোনো লাভ হবে না। সামান্যতম অপরাধের এমন অদ্ভুত শাস্তি ভোগ করে সে অভ্যস্ত। তাই কোনোপ্রকার প্রতিবাদ না করে হাত বাড়িয়ে বলল,

– দেন। ধুয়ে দিচ্ছি। আজকে ভালোই রোদ উঠেছে। তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।

সাঁঝের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সানান। কি ভুল করেছে বুঝতে না পেরে সাঁঝ বলল,

– কী হলো? দিন।

সানান দু হাতে বুক ঢেকে বলল,

– তুই কী আমার ইজ্জত লুট করার পায়তারা করতেছিস, সাঁঝবাতি? তোর মতিগতি কিন্তু আমার সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না।

বিস্ময়ে সাঁঝের মুখটা সম্পূর্ণ হা হয়ে গেল। সে কী এমন বলল যার বিপরীতে সানান এমন একটা অশ্লীল অপবাদ দিল তাকে! ভেবে পেল না সাঁঝ। তাকে বিপত্তি থেকে উদ্ধার করল সানান নিজেই। বলল,

– এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি গায়ের কাপড় খুলে তোর হাতে ধরিয়ে দিব? বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে তোর? এই বুদ্ধি নিয়ে কলেজে ভর্তি হবি?

সাঁঝ থমথমে খেয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। সে কী করে জানবে সানান হুডির নিচে কিছু পরেনি! সে তো কথার কথা বলেছে।

সানান তাড়া দিয়ে বলল,

– তাড়াতাড়ি চল। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।

দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সানান। ওর পিছু আবারও ছুটল সাঁঝ।

°

“আরাম আয়েশ” নামক বাড়িটির পরে আরেকটি দোতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একই ডিজাইনের বাড়িটি সাঁঝের ছোট চাচা সাজিদ শারাফাতের। তারপরের আরেকটি প্লট ফাঁকা পড়ে আছে। দেয়াল ঘেরা জায়গাটিতে ঘন সবুজ ঘাসের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নারকেল গাছ। দরজাবিহীন ঘেরার দিকে তাকাতেই নজরে এলো সদ্য ফোটা কাঠমল্লিকাগুলো। সকালের মিষ্টি রোদে খিলখিলিয়ে হাসছে তারা।

দ্রুত পায়ে জায়গাটি পেরিয়ে গেল ওরা। এরপরের বাড়িটিই সানানদের। এর সাথেই শেষ হয়েছে ছোট্ট বাসা বাড়ি লেন।

অন্য দুই ভাইয়ের বাড়ি দুটো দোতলা হলেও সানানদের বাড়িটি পাঁচতলা বিশিষ্ট। স্টিলের তৈরি বিশাল দরজাটি পেরিয়ে ভেতরের ঢুকতেই বরাবরের মতোই বুক ধক করে উঠল সাঁঝের। মনে মনে প্রার্থনা করল, মায়ের মতোই যেন রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকে আফসানা পারভীন।

নিচতলার পার্কিং পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে কাঠের রাজকীয় দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল সানান। কোনোদিকে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে পৌঁছে গেল।

পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ড্রয়িংরুমেই দাঁড়িয়ে রইল সাঁঝ। কান পেতে শুনল, সায়রার ঘর থেকে আফসানার গলার স্বর ভেসে আসছে। উনি ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই এখান থেকে পালাতে পারলেই বেঁচে যায় সাঁঝ। কিন্তু তার সমস্ত সতর্কতায় জল ঢেলে নিজের রুম থেকে সানানের উচ্চস্বরে ডাক ভেসে এলো,

– এই সাঁঝবাতি?

ঈষৎ কেঁপে উঠে সাঁঝ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল সায়রার রুম থেকে তৎক্ষণাৎ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন আফসানা। থমথমে মুখে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– তুই এতো সকালে এখানে?

আফসানার মুখে ভেসে উঠা বিতৃষ্ণা সাঁঝের চোখ এড়ালো না। শুকনো ঢোক গিলে জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই ওপাশ থেকে আবারও সানানের কণ্ঠ শোনা গেল।

– সানান ভাই ডাকল।

কোনোরকমে জবাব দিয়ে সানানের ঘরের দিকে ছুটল সাঁঝ। আফসানা দেখলেন, তার যুবক ছেলের ঘরে প্রবেশের আগে সামান্য জড়সড় হয়ে গেল সাঁঝ। আফসানা আর দাঁড়ালেন না। মেয়েটার স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। এখনো চুল বেঁধে দেওয়া বাকি।

এলোমেলো ঘরের একদিকে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে ডিম্বাকৃতি আয়নাটা। তার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে আঙ্গুল চালিয়ে সেগুলো আরও এলোমেলো করছে সানান। সাঁঝ এসে দরজায় দাঁড়াতেই আড়চোখে চেয়ে বলল,

– আলমারিতে হুডি রাখা আছে। পরিষ্কার দেখে একটা বের করে দে। কুইক।

সাঁঝ গুটিগুটি পায়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করল। ওর এ বাড়িতে আসাটা পছন্দ করে না সাঁঝের মা স্বর্ণলতা। আফসানার ব্যবহারের কারণে সাঁঝ নিজেও আসতে চায় না। তবুও আসতে হয়। চাইলেই কি নিজের পরিবারকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?

সানানের আলমারি খুলে একগাদা কাপড়ের দলা দেখতে পেল সাঁঝ। যেগুলো পরিধান করার অযোগ্য। এলোমেলো কাপড়গুলো থেকে একটি ধূসর রঙা হুডি টেনে বের করে নাকের কাছাকাছি আনতেই সাঁঝের গা গুলিয়ে উঠল। ঘামের প্রকট গন্ধ। বাসি কাপড় আলমারিতে তুলে রাখে কে?

মুখ বিকৃত করে সানানের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। সানান ধমকে উঠল তখনি,

– কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি দে এদিকে। একটা হুডি বের করতে এতোক্ষণ লাগে?

– এটা নোংরা।

কাচুমাচু ভাবে জবাব দিল সাঁঝ। সানান তাড়া দিয়ে বলল,

– দাঁড়িয়ে না থেকে বাকিগুলা দেখ না, বাপ। দেরী হইতেছে আমার।

সাঁঝ বেজার মুখে হুডিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে এবার একটি কালো হুডি টেনে বের করল। নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকে দেখল এটাতেও গন্ধ। তবে ঘামের উৎকট গন্ধ নয়। সানানের গায়ের গন্ধ। যেটা কাছাকাছি দাঁড়ালে নাকে ধাক্কা লাগে। হুডিটা একদিন পরেছে বোধহয়। তবুও এভাবে বাসি কাপড় কে আলমারিতে তুলে রাখে?

হুডিটা আলমারিতে রেখে দেওয়ার আগেই সানান এসে সেটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

– একটা হুডি খুঁজতে সারাদিন লাগে! অকর্মা। খালি পারে সাজগোজ করতে। যা বের হ রুম থেকে। জামা পাল্টাবো।

এক পা দু পা করে স্থান ত্যাগ করার আগে সাঁঝ ইতস্তত করে বলল,

– বাসি কাপড়। ঘামের গন্ধ। এটা পরেই অফিসে যাবেন?

– পারফিউম দিয়ে নিব।

জবাব দিয়ে চট করে গায়ের হুডিটার নিচের অংশ টেনে তুলতে শুরু করল সানান। নগ্ন উদর চোখে পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সাঁঝ।

খানিকবাদেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সানান। দু হাতে এলোমেলো উশকোখুশকো চুলগুলো গুছিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করতে করতে চলে গেল বাইরে। অবশ্য সাঁঝকে পেরিয়ে যাওয়ার আগে আদেশ করতে ভুলল না।

– ময়লা হুডিগুলো আলমারি থেকে বের করে নিয়ে যা। ধুয়ে দিয়ে আজকেই ফেরত দিয়ে যাবি। আর শোন, ওই ড্রয়ারে কোনো শার্ট পেলে খবরদার হাত লাগাবি না। যদিও ওখানে শার্ট থাকার কথা না। তবুও বলে রাখলাম।

সানান চলে গেলেও আনমনে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে সানানের রুমের দিকে গেল সাঁঝ। আলমারি থেকে ময়লা হুডিগুলো বের করে তাকালো পাশেই সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের তৈরি তুলনামূলক ছোট আলমারিটির দিকে। যেখানে বাক্সবন্দী করে রাখা আছে সানানের সবচেয়ে পছন্দের পোশাকগুলো। যা কারো ছুঁয়ে দেখা বারণ।

সাঁঝ ভেবে পায় না, একটা মানুষ সামান্য টি-শার্ট, শার্ট নিয়ে এতোটা পজেসিভ হয় কী করে!!

হুডিগুলো দু হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে যেতে চাইল সাঁঝ। পেছন থেকে শোনা গেল আফসানার কণ্ঠস্বর।

– সেমাইয়ের বাটিটা নিয়ে যা, সাঁঝ। শখ করে রান্না করলাম, একজনও মুখে তুলল না। তুই নিয়ে যা, খাবার নষ্ট করা ঠিক না।

আফসানার উচ্ছিষ্ট খাবার কখনোই বাড়িতে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না সাঁঝের। কিন্তু মুখের উপর না করতেও পারে না। মা যদি একবার শুনে সে বড় মায়ের মুখের উপর কথা বলেছে, তবে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবে।

বড়দের প্রতি সদা সম্মান প্রদর্শন এর আদেশের সামনে বরাবরের মতো হেরে গেল সাঁঝের আত্মসম্মান। মুখটা অন্ধকার করে এক হাতে সেমাইয়ের বাটিটি নিয়ে সে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

চলবে..