এই সাঁঝবাতি পর্ব-০২

0
15

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ০২

ভোরের আলো প্রস্ফুটনকালে একটি ট্রেন খুব ধীর গতিতে এসে থামল কমলাপুর স্টেশনে। চ নং বগি থেকে বেরিয়ে এলো একজন যুবক। হাতের লাগেজটি ট্রেন থেকে টেনে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে ক্লান্ত পায়ে এক্সিটের দিকে এগিয়ে চলল। ভাড়া নিয়ে রিক্সাওয়ালার সাথে কোনোপ্রকার তর্কে না জড়িয়ে যা চাইল তাতেই সম্মতি জানিয়ে সে উঠে পড়ল রিক্সায়।

সকালের শান্ত পরিবেশ এবং নীরবতাকে ভেদ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকল রিক্সাটি। যুবকটি লম্বা শ্বাস টেনে অক্সিজেন গ্রহণ করা মাত্র পার্থক্যটি বুঝতে পারল। তার শহরের বাতাসের সাথে ঢাকা শহরের বাতাসের বিস্তর তফাৎ। এখানের বাতাস অনেক ভারী, ঘোলাটে, ধুলোময়। যুবকটির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখটাও একটু জ্বলছে।

পুরান ঢাকার চিকন গলিতে রিক্সা প্রবেশ করতে করতে সে অবশ্য এই আবহাওয়ার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিল।

কিছুক্ষণ পর বাসা বাড়ি লেনের প্রবেশ পথে থামল রিক্সাটি। সব ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে যুবকটি পা রাখল দোতলা বাড়িটির সদর দরজায়। কিন্তু দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা হলো না।

ইতিমধ্যে দরজা খুলে পিপীলিকার মতো পিল পিল করে বের হতে শুধু করেছে অসংখ্য কিশোর কিশোরী। তাদের খিলখিল হাসি, কলকল কথাবার্তা শুনে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল যুবকটি।

ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল দোতলা বাড়িটির নিচতলা। বইপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে সাদিক দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে গিয়েও যুবকটিকে দেখে থমকে গেলেন। একগাল হাসি যুবকটির দিকে এগিয়ে এসে সবিস্ময়ে বললেন,

– আরে তাশফীন যে! ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো? কখন এলে?

লাগেজ টেনে ঘড়ঘড় শব্দ তুলে তাশফীন এগিয়ে গিয়ে সালাম জানিয়ে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল।

– এই মাত্র পৌঁছালাম। আপনি কেমন আছেন খালু?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি যে আসবে সেটা তোমার খালা বলেছিল। কিন্তু আজকে আসছ তা কিন্তু বলেনি। এসো, এসো। ভেতরে এসো। পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

– নাহ খালু। সব ঠিকঠাকই ছিল।

ঘরে প্রবেশ করেই গলা উঁচু করে হাঁক ছাড়লেন সাদিক।

– স্বর্ণ? দেখো কে এসেছে। সাঁঝ, কই গেলি রে?

রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নিচু করে পায়ের নখ খুটছে মেঝেতে। স্বর্ণলতা তখনো অনবরত বকে যাচ্ছেন।

– তোর বিবেক বুদ্ধি কবে হবে সাঁঝ? সাত সকালে উঠে কোন আক্কেলে ওই বাড়িতে গেলি? শুধু গায়ে গতরে বড় হয়েছিস। আল্লাহ জানেন, একটুখানি চালাক হবি কবে।

তর্ক করা একদম পছন্দ নয় স্বর্ণলতার। এই মুহূর্তে মায়ের মুখের উপর কিছু বলা মানেই পিঠের উপর বেলনের আঘাত পড়া। তাই সাঁঝ মিনমিন করে বলল,

– বড় মা জোর করে সেমাই ধরিয়ে দিল। না করলেও তো তুমি বকতে। আমি আর কি করতাম?

– সে তুই নাস্তার সময় গিয়ে হাজির হয়েছিস বলে খাতির করে দিয়েছে। এখন এই বাটিতে আমি কি পাঠাই? খালি বাটি ফেরত পাঠানো যায়!

খাতির না ছাই! বেশি হয়েছে বলে সাঁঝের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আফসানা। সে কথা মা কিছুতেই মানতে চায় না। নিজে চোখ বন্ধ করে আফসানার তাচ্ছিল্যতাকে উদারতা ভেবে বসে আছে অথচ বোকা বলছে সাঁঝকে। সাঁঝ মনে মনে আরও হতাশ হলো মায়ের উপর।

সাদিকের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে বিচারসভা থেকে মুক্তি পেলো সাঁঝ। ড্রয়িংরুমে তাশফীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উভয়ের মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। স্বর্ণলতা সব ভুলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আদরের ভাগ্নেটিকে।

– আজ দেখছি ট্রেন ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে। আমি ভাবলাম তোর আসতে আরও দেরী হবে।

খালাকে ছেড়ে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বিস্তর হাসল তাশফীন।

– ভাগ্য ভালো ছিল তাই এক্যুরেট টাইমে পৌঁছে গেছি।

– ভালোই হয়েছে। দ্রুত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। নাস্তা খেয়ে ঘুমাবি তারপর জমিয়ে গল্প করা যাবে। সাঁঝ, তাশফীনকে রুমটা দেখিয়ে দে।

– আরে দাঁড়াও। দাদীর সাথে দেখা করে নেই। পিচ্চি দুটোকেও দেখছি না। ওরা কোথায়?

– শয়তান দুটো বাড়িতে থাকলে বাড়ি এমন চুপচাপ থাকে! কোচিংয়ে গেছে।

– তাহলে দাদীর সাথে দেখা করে আসি।

– ফ্রেশ হয়ে তারপর যা।

– উহু। দেখা করেই যাই। আমি এতোটাও ক্লান্ত নই।

লাগেজ ওখানেই রেখে তাশফীন এগিয়ে গেল সাওদা বেগমের কক্ষের দিকে। পেছনে ছুটল সাঁঝ।

চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলেন সাওদা বেগম। তাশফীনকে দেখে পান খাওয়া কালচে দাঁতে হেসে বললেন,

– আরে ডাক্তার যে! কখন আসলি?

– মাত্র আসলাম। তুমি কেমন আছো দাদী?

– নড়বড়ে দাঁত নিয়ে বেঁচে আছি কোনোরকম।

সাওদার বেগমের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে তাশফীন পৌঁছালো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে। যেটা আদতে সাঁঝের দুই ভাইয়ের কক্ষ। বিশাল বিছানায় আরাম করে বসে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,

– তারপর তোর কি অবস্থা, বেলা?

তাশফীনের পাশে ধপ করে বসে সাঁঝ মুখ ফুলিয়ে বলল,

– অবশেষে আমাকে চোখে পড়ল তোমার?

তাশফীন সোজা হয়ে বসে সাঁঝের দিকে ঝুঁকে বলল,

– আরে বাহ! বেলা বোস রাগ করেছে নাকি?

– ফাজলামি করবে না তো ভাইয়া। তুমি আসবে শুনেছি থেকে অপেক্ষা করে আছি, অথচ তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছ না।

– আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলি নাকি তোর জিনিসপত্রের জন্য?

দু পা বিছানায় তুলে তাশফীনের মুখোমুখি হয়ে বসল সাঁঝ। অসীম আগ্রহ নিয়ে শুধালো,

– যা যা বলেছি সবগুলো এনেছো?

– জি ম্যাডাম। যেটা যেই ব্র্যান্ডের বলেছেন সেটাই নিয়ে এসেছি। ডি ফর ডেঞ্জার লিপস্টিক, মিলানি কনসিল টু ইন ওয়ান ফাউন্ডেশন, রোজ কিস ব্লাশ। কীসব ভয়ংকর নাম! মনে রাখতে গিয়ে আমার অবস্থা খারাপ।

লাগেজ থেকে লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন, ব্লাশ বের করে সাঁঝের সামনে রেখে তাশফীন বলল,

– দেখে নে, সব ঠিক আছে কিনা।

ছোট্ট শিশুর ন্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল সাঁঝ। পছন্দের ব্র্যান্ডের প্রসাধনীগুলো দু হাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে সম্মোহিতের মতো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকল। পাশে বসে সেই রোদের মতো ঝলমলে হাসি দেখে তাশফীনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বিছানার কোনাকুনি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলল,

– এই প্যাকেটে এক জোড়া ঝুমকা আছে। দেখতো পছন্দ হয় কিনা?

সাদা প্যাকেটটি খুলে একজোড়া রুপালি ঝুমকা পেল সাঁঝ।

– এগুলা আমার জন্য?

– নাহ। আমার জন্য কিনেছি। গাধা।

– কিন্তু আমি তো তোমাকে ঝুমকার কথা বলিনি।

– মার্কেটে গিয়ে পছন্দ হয়ে গেল। কিনে নিলাম তোর জন্য। ভালো লাগে নি?

– লেগেছে। খুব সুন্দর এগুলো। তোমার চয়েজ কিন্তু দারুন ভাইয়া।

– তা আর বলতে।

– আচ্ছা শোনো না।

– বল।

– মা বলছিল তুমি এখন থেকে ঢাকাতেই থাকবে। সত্যি?

– শুধু ঢাকাতে নয়, তোদের পাশের এলাকাতেই থাকব। সলিমুল্লাহ হাসপাতালে।

– জব হয়ে গেছে তোমার?

– অনেকটা সেরকমই। ওসব তুই বুঝবি না।

– সবাই এরকমভাবে বলো কেনো? না হয় আমি ছোট, সবকিছু বুঝি না। তাই বলে বুঝিয়ে বলবে না? তোমরা বুঝিয়ে দিলেই আমি বুঝে যাই।

– অনেকটা জবের মতোই। এক প্রফেসরের আন্ডারে ইন্টার্নশিপ করব। আপাতত ছয় মাস এখানে কাজ করতে পারবো। ততদিনে বিসিএস এর রেজাল্টটাও এসে যাবে। তারপর আর প্যারা নাই। এই ক’টা দিন না হয় অল্প বেতনের চাকরীই করি। কী বলিস? চলবে না?

– চলবে মানে! দৌড়াবে। তুমি ঢাকায় থাকলে আমার আর কী লাগে!

– আমার এখানে থাকলে তোর কী সুবিধা শুনি।

– তোমার সাথে ঘুরতে যাবো। আমাকে তো একাই কোথাও যেতে দেয় না। তুমি সাথে থাকলে কেউ কিছু বলবে না।

– যাহ ভাগ। আমি চাকরীবাকরী বাদ দিয়ে তোকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো? আর তোর পড়াশোনা নাই? সারাদিন ঘুরতে যাওয়া, সাজগোজ নিয়েই ব্যস্ত থাকিস।

– কলেজের ভর্তি এখনো শুরু হয়নি। সাইন্সের প্র‍্যাক্টিক্যাল এক্সাম এখনো বাকি। হাতে বিস্তর অবসর। আমার বান্ধবীরা সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমাকে দেখো বাড়িতে বন্দি হয়ে আছি।

– আম্মা ডাকলো, গেলি না। এখন নালিশ করতেছিস কেন?

– বাহ রে! আমি কি যেতে চাইনি নাকি? আম্মুও প্রায় রাজি হয়ে গেছিল। বাধ সাধলো ওই রাক্ষসটা। আব্বুকে কী যে বলল, আব্বু আর কিছুতেই যেতে দিল না। বলে, এতোটা রাস্তা একা যাওয়া যাবে না। এতো করে বললাম, তুমি ট্রেনে তুলে দেও । ওখান থেকে তাশফীন ভাইয়া এসে নিয়ে যাবে। কিছুতেই মানল না। সব ওই রাক্ষসটার কুমন্ত্রণা।

– এই রাক্ষসটা আবার কে?

– আরে সানান ভাইয়ের কথা বলছি। সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকে। জানো, আজকে সকালেও একগাদা নোংরা কাপড় ধরিয়ে দিয়েছে। সেগুলো এখন আমাকে ধুয়ে দিতে হবে।

– ওর কাপড় তুই ধুবি কেন?

– সকালে ভুল করে উনার গায়ে পানি ফেলে দিয়েছি, তাই।

তাশফীন হো হো করে হেসে মাথার নিচে এক হাত ঠেস দিয়ে একপাশে কাত হয়ে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,

– তুই পারিসও বেলা। কেনো যাস ওকে জ্বালাতে? জানিসই তো জিততে পারবি না। উল্টো তোকেই নাকানিচুবানি খেতে হবে।

– আমি কি ইচ্ছে করে ফেলেছি নাকি? ভুল করে হয়ে গেছে। ক্ষমাও চেয়েছি। কিন্তু রাক্ষসটা মানলই না।

– আচ্ছা যা। ধুতে না পারলে আমাকে দিস। আমি হেল্প করে দিব।

– নাহ বাবা। আমার কাজ আমাকেই করতে হবে। আমি পারবো। রাক্ষসটা যদি শুনে তোমার হেল্প নিয়েছি তাহলে আরেক কান্ড করে বসবে। আর ঝামেলার দরকার নাই। তুমি শুধু বলো, আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।

– ঠিক আছে নিয়ে যাব। কোথায় যাবি বল।

সাঁঝ অতিউৎসাহে তাশফীনের গা ঘেঁষে বসল। দরজার দিকে চেয়ে দেখে নিল কেউ আসছে নাকি। তারপর ফিসফিস করে বলল,

– বসুন্ধরা সিটি।

সাঁঝের মতোই ফিসফিস করে জবাব দিল তাশফীন।

– বসুন্ধরা কেনো?

– আড়ংয়ে যাবো। আমার অনেকদিনের শখ আড়ংয়ের একটা ব্লক প্রিন্টের শাড়ি কিনব।

– আড়ংয়ে গেয়েছিস কখনো?

– উহু। জুবিয়া ফোনে শাড়ির ছবি দেখিয়েছে। আড়ংয়ের ওয়েবসাইটে। শাড়িগুলা কী সুন্দর, ভাইয়া!! সব নিয়ে নিতে মন চায়। উফ!

সাঁঝের চোখে মুখে উপচে পড়া খুশি দেখে মৃদু হাসল তাশফীন। নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল স্বর্ণলতা। তাশফীনকে এখনও ওভাবে বসে থাকতে দেখে স্বর্ণলতার চক্ষু চড়কগাছ।

– তুই এখনো ফ্রেশ হইস নি!

– এই তো যাচ্ছি খালামনি। সাঁঝের সাথে গল্প করছিলাম।

– গল্প করার অনেক সময় পাবি। আগে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নে। সাঁঝ, এখনি বের হ রুম থেকে। ওকে বিরক্ত করিস না। কতোটা পথ জার্নি করে এসেছে ছেলেটা!

নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে সাঁঝ বিছানা থেকে নামল। স্বর্ণলতা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।

– তোর হাতে এগুলা কি?

হাতটা টুপ করে ওড়নার আড়ালে নিয়ে আহত চোখে তাশফীনের দিকে তাকাল সাঁঝ। মা দেখে ফেললে আজ সাঁঝের খবর আছে। এমনিতেও মেয়ের সাজগোজের স্বভাব নিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত স্বর্ণলতা। তাশফীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– আবার কি এনেছিস তুই?

– তেমন কিছু না খালামনি। একটা লিপস্টিক আর ঝুমকা।

– আবার লিপস্টিক! তুই জানিস ওর কাছে কতোগুলো লিপস্টিক আছে? সেদিনই পাঁচটা দেখলাম।

পাঁচটা নয় মোটে দশটি লিপস্টিক আছে সাঁঝের। দুটো লিপগ্লোসও আছে। তবুও মায়ের কথায় প্রতিবাদ করে বলল,

– এটা আলাদা শেডের।

– কীসের আলাদা শেড, হুম? একটা মানুষের কয়টা লিপস্টিক লাগে? লিপস্টিক লাগবেই বা কেনো? সারা বছর একটা তিব্বত মেরিল দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা। আর উনার লিপস্টিক দিতে হবে। তাও আবার একটা না, হাজারটা শেড লাগবে। এই বয়সেই ডান গজিয়েছে না? বলছি তোর বাপকে। এখনি মেয়েকে শাসন না করলে মানসম্মান ডুবতে সময় লাগবে না। এখনি লাগাম টেনে ধরুক।

এতোক্ষণের হাসি আনন্দ মলিন হতে সময় লাগল না। সকল উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা হারিয়ে গিয়ে চোখে টলটল করতে শুরু করল স্বচ্ছ জল। সাঁঝের সাজগোজ নিয়ে কথা উঠলেই মা এভাবে কথা শোনায়। ভালো লাগে না সাঁঝের। তবুও খুব একটা মন খারাপ করে না সাঁঝ। মা হয়, বলতেই পারে। শাসন করতেই পারে। দাদী বলে, সাঁঝের ভালোর জন্যেই মা বকাবকি করে, শাসন করে। সাঁঝ এখনো ছোট। এই সময়টা ভালো না। তাই এই সময় বাচ্চাদের কড়া শাসনে রাখতে হয়। সাঁঝ মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাশফীনের সামনে এভাবে কথা শোনানোর কারণে সাঁঝের খুব মন খারাপ হলো।

তাশফীন বোধহয় বুঝতে পারল ব্যাপারটা। ঝট করে বিছানা থেকে নেমে বলল,

– ওকে বকো না খালামনি। ও চায়নি কিছুই। আমি নিজেই নিয়ে এসেছি। মার্কেটে গিয়ে মনে হলো সবার জন্য কিছু কিনি। সাঁঝ তো সাজগোজ করতে পছন্দ করে, সেজন্য এগুলো নিয়েছি।

– সেজন্য আমি রাগ করছি না তাশফীন। এই মেয়ের কাহিনী তুই জানিস না। ওর ঘরের ড্রেসিং টেবিলে গিয়ে দেখ। ফাউন্ডেশন, কনসিলার, প্রাইমার, ব্লাশ, হাইলাইটার, আইলাইনার, মাশকারা, কাজল, লিপস্টিক, লিপগ্লোস, মেক রিমোভার, ক্লিনজার, ব্রাশ, আরও যে কত কী! সবগুলার নামও জানি না আমি। হাজার হাজার টাকা নষ্ট করে এই আলতু ফালতু জিনিসের পেছনে। কোনো দরকার আছে এগুলার?

– বাদ দেও খালামনি। ওর ভালো লাগে, সাজগোজ করে। খারাপ কিছু তো করে না। এই বয়সে এরকম টুকটাক সাজগোজের শখ সব মেয়েরই থাকে। আর মেয়েরা না সাজলে কে সাজবে? আমরা ছেলেরা সাজব?

– এতো শখ পুষার সামর্থ্য আছে ওর বাপের? স্কুলের বেতন, টিউশন থেকে কোনোরকম সংসার চলছে। এর মধ্যে নবাব নন্দিনীর শখের শেষ নাই। ওর বাপও মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে নাচে। যতো জ্বালা হয়েছে আমার।

মুহূর্তেই বদলে গেল ঘরের পরিবেশ। তিনটে মানুষের মুখে কোনো কথা ফুটল না। একনাগাড়ে কথা বলার পর স্বর্ণলতার হঠাৎ খেয়াল হলো, তাশফীন মাত্রই এলো। আর তিনি তার সামনে সংসারের অভাব অনটনের অভিযোগ নিয়ে বসেছেন। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

– তুই যা। ফ্রেশ হয়ে নে। সাঁঝ, আমার সাথে আয়। তোর আব্বু নাস্তা খেতে বসেছে।

সাঁঝ সেই যে মাথা নিচু করেছে আর মাথা উঁচু করে তাকাল না। ওভাবেই গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ওর গমনপথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাশফীন। সিদ্ধান্ত নিল, প্রথম উইকেন্ডেই সাঁঝকে নিয়ে বসুন্ধরা যাবে।

চলবে..
#অক্ষরময়ী