এই সাঁঝবাতি পর্ব-০৩

0
14

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ৩

ধানমন্ডির বারোতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের সামনে কালো রঙা গাড়ি এসে থামল ঠিক সকাল সাড়ে আটটায়। বিদেশী ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং আছে আধাঘন্টা পরেই। অফিস টাইম সকাল নয়টায় হলেও আজকের দিনে সবাইকে সাড়ে আটটার মধ্যে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

দারোয়ান দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলে গাড়িটি ভেতরে প্রবেশ করল। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সাদা শার্ট, কালো স্যুট প্যান্ট পরিহিত একজন যুবক। নাম তার জাদিদ চৌধুরি। শীতলা নামক এই বিশাল কোম্পানির সিইও সে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন যুবক, কিবরিয়া। পাঁচ বছর যাবৎ এখানে কাজ করছে কিবরিয়া। পূর্বে জাদিদের বাবার সহকারী হিসেবে কাজ করত। দুই বছর হলো বাবার স্থান দখল করেছে জাদিদ। তাই কিবরিয়াকে জাদিদের সাথে কাজ করতে হচ্ছে। খুব একটা মন্দ যাচ্ছে না দিনগুলো। শুধু সবসময় তটস্থ থাকতে হয় এই আরকি। জাদিদ ছেলেটার এখন যুবক বয়স। তেজি ঘোড়ার মতোন ছুটে চলা স্বভাব। স্যারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে কিবরিয়া। এই যে আজকেও সকালে ঘুম থেকে উঠে না খেয়ে কোনোরকম ছুটে চলে এসেছে। তবুও স্যারের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিবরিয়ার উপর তিনি ভীষণ বিরক্ত। কিবরিয়া শুকনো ঢোক গিলে জাদিদের পেছনে ছুটল লিফটের দিকে।

টপ ফ্লোরে নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে জাদিদ তাকালো ডানে অবস্থিত কাঁচঘেরা কেবিনটির দিকে। আরও কুঞ্চিত হলো কপালের ভাঁজ। কিবরিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

– সানান আসেনি এখনো?

বুক ধক করে উঠল কিবরিয়ার। গতকাল এতো করে বলার পরেও আজও কি সানান সঠিক সময়ে অফিসে আসবে না? হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে কিবরিয়া বলল,

– এসে পৌঁছায়নি এখনও। রাস্তায় আছে বোধহয়। ঢাকা শহরে আজকাল যা জ্যাম!

– মিটিংয়ের কথা জানাননি?

– জানিয়েছি স্যার। গতকাল ফোন করে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছি। আজকের মিটিং কতো জরুরি, কত ইম্পর্টেন্ট সবিস্তারে বলেছি। এত সকালে স্যারের ঘুম ভাঙে না, তাই ঠিক সাতটায় কল দিয়ে স্যারকে ডেকেও দিয়েছি।

ফাঁকা কেবিন হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে জাদিদ তাকালো কিবরিয়ার দিকে। বাম ভ্রু উঁচু করে জানতে চাইল,

– এত সকালে! সকাল সাতটা আপনার কাছে খুব সকাল বলে মনে হচ্ছে?

– না মানে স্যার, সানান স্যার তো একটু দেরীতে ঘুম থেকে উঠেন। তাই।

– কিবরিয়া সাহেব?

–জ্বি স্যার?

– আপনি আসলে কার পিএ? আমার নাকি সানানের?

– অবশ্যই আপনার।

– সানানের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাওয়া বন্ধ করুন। ওকে আমি ভালোমতো চিনি। আমার ছোটবেলার বন্ধু সে। আমরা একসাথে বড় হয়েছি। ওর সম্পর্কে আমাকে আপনার থেকে জানতে হবে না।

– জ্বি স্যার।

– তারপর আপনার স্যার আপনার ফোনকলে ঘুম থেকে উঠেছিলেন?

– না স্যার। আধাঘন্টা পরে আবার কল দিতে বলেছিল। উনার নাকি ঘুম পূরণ হয়নি। আরও আধাঘন্টা ঘুমাবেন।

– আপনি কি করলেন? আধাঘন্টা পরে আবার কল দিলেন?

– জ্বি স্যার।

– চমৎকার।

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাদিদ নিজের কেবিনের দিকে গেল। এক কাপের চায়ের ফরমায়েশ করে বিরস মুখে অপেক্ষা করতে লাগল সানানের।

সানান এলো আরও এক ঘন্টা পর। নিজের কেবিনে না গিয়ে সোজা ঢুকল জাদিদের কেবিনে। দরজায় নক করা, অনুমতির অপেক্ষা করার মতো ঝামেলায় সানান কখনো জড়ায় না। দরজা খুলে ধুপধাপ পায়ে হেঁটে গিয়ে বসল জাদিদের ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে। জাদিদ তখনো পাথুরে চেহারা সমেত চেয়ারে বসে আছে। সানান একপলক তার বিরস মুখখানা দেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিবরিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

– কি খবর কিবরিয়া সাহেব?

– আলহামদুলিল্লাহ। সবকিছু ভালো চলছে স্যার।

গদগদ ভঙ্গিতে সানানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর কিবরিয়ার খেয়াল হলো, অফিসের পরিবেশ এই মুহূর্তে উত্তপ্ত। জাদিদ স্যারের মেজাজ লাভার ন্যায় টগবগ করে ফুটছে। চুপচাপ বসে আছেন দেখে বুঝা যাচ্ছে না। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কিবরিয়া বলল,

– না মানে সব ঠিক নেই স্যার। বিরাট সমস্যা বেঁধে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট এসে বসে আছেন। সকাল নয়টায় মিটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল। অফিসের সবাই এসে উপস্থিত হলেও আপনি সময় মতো উপস্থিত হতে পারেননি বলে মিটিং শুরু করা গেল না। এই নিয়ে অফিসের অনেকে আপনার প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন।

চেয়ারের পেছনে একহাত ছড়িয়ে দিয়ে একপাশে বাঁকা হয়ে বসে সানান বলল,

– এতে সমস্যার কি আছে কিবরিয়া সাহেব? আপনার বসকে বলে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দিন। তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

কিবরিয়া জিভে কামড় দিয়ে একনজর জাদিদের দিকে তাকাল। সে এখনো ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে। চোখে মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। কিবরিয়া তার শুকনো গলা ভিজিয়ে নিয়ে সরল স্বীকারোক্তি করল,

– এটা কী করে সম্ভব স্যার? আপনার মতো ইন্টেলিজেন্ট মানুষ এই অফিসে আর একটিও নেই। আপনাকে বাদ দেওয়া মানে কোম্পানির বড় লস।

কিবরিয়ার কথায় সানান অত্যন্ত খুশি হলো। পুলকিত চিত্তে জানতে চাইল,

– তা আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট কোথায়? আছেন নাকি চলে গেছেন?

– আছেন। চা নাস্তা দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

– আপনাদের চা নাস্তা কি শুধু বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্টের জন্য? আমাদের মতো সামান্য কর্মচারির কপালে এককাপ চা জুটবে না?

কিবরিয়া হন্তদন্ত হয়ে চায়ের জন্য ছুটতেই চাইছিল। বাঁধ সাধল জাদিদ। ল্যাপটপের শাটার নামিয়ে সরাসরি তাকাল সানানের দিকে। বলল,

– আপনি বললে শুধু চা কেনো, বিরিয়ানির ব্যবস্থাও করা হবে।

জাদিদের গম্ভীর মুখ, শান্ত চোখের দৃষ্টি দেখে সানান তার বিখ্যাত হাসিটি হাসল। গা দুলিয়ে চিরল দাঁতের নিঃশব্দের হাসি। যা দেখে জাদিদের মেজাজ আরও খারাপ হলো। কটমট করে চেয়ে ধমকে উঠল জাদিদ।

– শালা হাসতেছিস কেন? দাঁত কেলানো বন্ধ কর।

সানান তার হাসি থামালো না। বরং টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল,

– যতই চেষ্টা করো বন্ধু, আমাদের পুরান ঢাকার বিরিয়ানিকে বিট করতে পারবা না। আমি পুরান ঢাকার বাসিন্দা। তোমাদের ধানমন্ডির চকচকে রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি আমার হজম হবে না। ঘুপচি হোটেলের বিরিয়ানিতেই আমার শান্তি। লুঙ্গি পরে চেয়ারের উপর এক পা তুলে আরাম করে বসে বিরিয়ানি খাওয়ায় যে তৃপ্তি, সেটা দুনিয়ার আর কোথাও পাবা না।

জাদিদ ঘাড় ফিরিয়ে কিবরিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

– কিবরিয়া সাবেব, আপনি গিয়ে মিটিং শুরু করার ব্যবস্থা করুন। আর লাঞ্চে যে বিরিয়ানির অর্ডার করা হয়েছে। সেখান থেকে একটা বিরিয়ানির অর্ডার ক্যান্সেল করে দিবেন। আপনার সানান স্যার পুরান ঢাকার বিরিয়ানি ছাড়া অন্য বিরিয়ানি খায় না। সে আজকে দুপুরে উপোস থাকবে।

কিবরিয়া ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রথম আদেশ পালন করলেও দ্বিতীয় আদেশ সে পালন করবে না। সানান স্যার উপোস করবে আর অফিসের সবাই বিরিয়ানি খাবে, এটা হতে পারে না। সানান স্যার চাইলে কিবরিয়া নিজের বিরিয়ানির প্যাকেটটিও স্যারকে দিয়ে দিতে পারে। স্যার কতো ভালো! অফিসে এলেই কিবরিয়ার খোঁজ নেয়। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলে। এমন একটি মানুষকে কিবরিয়া না খাইয়ে রাখতে পারে!

কিরবিয়া বের হয়ে যেতেই জাদিদের চায়ের কাপটা নিজের দিকে টেনে নিল সানান। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

– এত সকালে মিটিং কে রাখে, বাল?

– নয়টা কোনোভাবে খুব সকালের পর্যায়ে পড়ে না। আমরা সবাই রোজ নয়টায় অফিসে আসি।

– তোদের ঘুম আসে না, তোরা সকালে উঠিস। আমার বারোটা পর্যন্ত ঘুমাইতে হয়। না হলে মাথা কাজ করে না। তাই আমার জন্য সকাল শুরু হয় বারোটায়। সহজ হিসাব। বুঝছ, মামা?

– আমি বলে তোকে সহ্য করতেছি। অন্য কেউ হলে কবেই তোর চাকরি নট করে দিত।

– তুমি বলে চাকরিটা করতেছি, মামা। অন্য কেউ হইলে এই বালের চাকরি আমি করতাম না। ঘুম বাদ দিয়ে কামলা খাটো। কোন বাইঞ্চোত এই বালের নিয়ম বানাইছে?

– ভাষা ঠিক কর হারামি। এটা অফিস।

– এই জন্যে এই বালছালের অফিস আমার ভালো লাগে না।

সানানের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। ওর যা মন চায় সেটাই করে। যখন যেভাবে চলতে মন চায় সেভাবে চলে। তবুও জাদিদ তাকে সহ্য করে যাচ্ছে। শুধু বন্ধু বলে নয়, সানান সত্যিই মেধাবি। নিজ যোগ্যতায় শীতলার মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের চিফ ডিজাইনারের জায়গা দখল করে রেখেছে বছরখানেক ধরে। নাহ, বাঁধাধরা নিয়ম মেনে সে অফিসে আসে না। যখন মন চায় অফিসে আসে। রোজ আসেও না। কোনদিন আসবে না সেটাও অফিসে জানায় না। ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, আজকে অফিস থেকে ঘুরে আসি। চোখ ডলতে ডলতে চলে আসে ধানমন্ডি। হাস্যকর হলেও এটা সত্যি যে, সানানের কেবিনে ব্রাশ, টুথপেস্ট, তোয়ালে পর্যন্ত রাখা আছে। মাঝেমধ্যে এসে এখানেই ফ্রেশ হয়।

বন্ধুর এই অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করে নেয় জাদিদ। সানান তার মেধার খাতিরে এই সুযোগ সুবিধা পায় এমনটা নয়। এইটুকু অনাচার বন্ধুত্বের খাতিরে সহ্য করে নেয় জাদিদ। শীতলার চেয়ারম্যান, জাদিদের বাবা জায়েদ চৌধুরি অগণিতবার জাদিদকে বলেছেন, সানানকে অফিস থেকে বের করে দিতে। কিন্তু জাদিদ এ ব্যাপারে বাবার কথা গ্রাহ্য করেনি। এই নিয়ে বাবা-ছেলের মাঝে বিস্তর বিরোধ ঘটে গেলেও জাদিদ তার সিদ্ধান্তে অটল। বন্ধুকে সে কোনোভাবেই ছাড়তে রাজি নয়। একঘেয়েমি জীবনে আপন বলতে এই বন্ধুটাই তো আছে তার। এইটুকু সে ধরে রাখতে চায়।

সানানের চা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো জাদিদ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

– মাথা কাজ করা শুরু করলে মিটিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া যাক।

ঝট করে দাঁড়িয়ে তাড়া দিয়ে সানান বলল,

– হ্যাঁ। চল যাওয়া যাক। যত দ্রুত মিটিং শেষ হবে তত দ্রুত এখান থেকে মুক্তি মিলবে। অফিস আসলেই আমার নিজেকে খামারের গরু মনে হয়। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ম্যা ম্যা করাই যাদের একমাত্র কাজ।

সানানের কথায় মনোযোগ নেই জাদিদের। সে সানানকে উপর থেকে নিচ পর্যবেক্ষণ করে বলল,

– তুই এভাবে মিটিং এটেন্ট করবি?

সানান অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকাল। এভাবে বলতে কি বুঝাচ্ছে জাদিদ? তার পোশাকে কি সমস্যা? সরু চোখে জাদিদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

– ওভাবে তাকায় আছিস কেন? আসার সময় সাঁঝবাতিও এমন একটা লুক দিল। সমস্যা কি তোদের? আমারে হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে, তোদের সহ্য হচ্ছে না?

জাদিদ তার চোখ দুটো কপালে তুলে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

– হ্যান্ডসাম! আয়নায় দেখেছিস নিজেকে? জোকারের মত লাগছে। তোর ওই কাজিনের থেকে কিছু ফ্যাশন সেন্স শিখে নিতে পারিস। শি ইজ গুড এড ফ্যাশন।

সানানের সরু চোখ দুটো আরও সরু হলো। জাদিদের দিকে ঝুঁকে পড়ে সন্দেহজনক দৃষ্টি ছুড়ে বলল,

– সাঁঝবাতির ফ্যাশন সেন্সের এত খবর তুমি কেন রাখো বন্ধু? কেমনে রাখো? মতলব কি তোমার?

সানানের চওড়া বুকে একহাতে ধাক্কা দিয়ে জাদিদ বলল,

– ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে, ডে দেয়। সেখানে দেখি। ফ্রেন্ডলিস্টে এড আছে আমার সাথে। মতলবের কথা জানতে চাইলে, শোনো বন্ধু। তোমার কাজিন দেখতে সুন্দর আছে মাশাআল্লাহ। আমার সাথে সেন্টিং করায় দিলে মাইন্ড করবো না।

সানানের উত্তরের অপেক্ষা না করে জাদিদ বেরিয়ে গেল। দশটা বাজতে চলেছে। সময়ের হেরফের ভীষণ অপছন্দ জাদিদের। বন্ধুত্বের খাতিরে কতকিছু যে সহ্য করতে হচ্ছে!

– তোর ফেসবুক একাউন্টও আছে সাঁঝবাতি! এতটা অবনতি! ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে তো।

মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে জাদিদের পিছু নিল সানান।

চলবে…
#অক্ষরময়ী