#এই_সাঝঁবাতি? পর্ব:৫
সারারাত ঘুমিয়ে সকালবেলা বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন সানান ভাই। কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে করতে বাসা-বাড়ি লেনের গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। আরাম-আয়েশের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার ছাদের দিকেও তাকাল। কিন্তু সাঁঝবাতির দেখা মিলল না।
ধৈর্যহীন সানান ভাইয়ের ফুরফুরে মেজাজের পারদ চড়চড় করে বাড়তে শুরু করলো। এই অলস মেয়ে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি নাকি? এতো বেলা পর্যন্ত কে ঘুমায়?
নাহ, মাথা গরম করলে চলবে না। আজকে সানান ভাইয়ের মন ভালো৷ কোন এক সাঁঝবাতির জন্য এই সুন্দর সকালটা সে নষ্ট করবে না৷
মুখ উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে সানান ভাই ভাবতে শুরু করলো।
গতরাতে সাঁঝবাতি নিশ্চয়ই বেশ কয়েকটা ধমক খেয়েছে। মেজ বাবার রাগান্বিত দৃষ্টির সামনে ঠোঁট উল্টে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সাঁঝবাতি।
ভাবতেই সানান ভাইয়ের মনটা আবার ভালো হয়ে গেল।
সানান ভাই চোখ খুলে তাকাল। নীল আকাশে সাদা মেঘের ছটা দেখা যাচ্ছে। নিত্যদিনকার পরিচিত দৃশ্য। তবুও সানান ভাইয়ের চোখে অপরূপ সুন্দর বোধ হলো।
তখনি ধড়াম শব্দ হলো। পাশ ফিরে তাকাল সে।নিশ্চয়ই সাঁঝবাতি ছাদে এসেছে। ওদের ছাদের মান্ধাতার আমলের লোহার মরিচা ধরা দরজাটা খুললে এমন ধড়াম শব্দ হয়। সেই শব্দে আশপাশের চারটে বাড়ির লোকজনের ঘুম ভেঙে যাওয়ার দশা৷
°
আড়মোড়া ভেঙে কপালে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিল সাঁঝ। বাসী চুলের বেণির গাঁথন থেকে অনেকগুলো চুল ছুটে গেছে৷ সকালে ফুরফুরে বাতাসে বড্ড জ্বালাছে ওগুলো৷ পানির লাইনের হাতল ঘুরিয়ে পাইপ হাতে নিয়ে ছাদের গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে৷ পাইপের অগ্রভাগ হাতের আঙ্গুল দিয়ে চিপে ধরে ছাদের কার্নিশ থেকে উঁকি দিল নিচে।
গতকাল সানান ভাইয়ের যা কাণ্ড ঘটাল, এরপর সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি৷
নিচের দিকে তাকিয়ে বাকরূদ্ধ হয়ে গেল সাঁঝ৷ বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সানান ভাই৷ মাথা উঁচু করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে৷ সাঁঝ বারবার চোখের পলক ফেলে হাত থেকে পাইপ ফেলে দিল। পানির ধারা ভাসিয়ে দিচ্ছে ছাদের মেঝে। সাঁঝের সেদিকে খেয়াল নেই। সে দু হাতে চোখ কচলে আবার নিচের দিকে তাকাল। ঠিক দেখছে তো?
সানান ভাই হচ্ছে রাতজাগা পাখি। তার ঘড়ির সাথে সাধারণ মানুষের সময় ঘড়ি মিলে না। আমাদের দিন শুরু হয় ভোরবেলা। আর সানান ভাইয়ের দিন শুরু দুপুর বারোটায়। লোকে কাজকর্ম করে দিনের বেলা। অন্যদিকে সূর্য যখন ডুবে যায় সানান ভাই তখন কাজে বসে। লোকে চা-নাস্তা খায় সন্ধ্যায়। সানান ভাই খায় রাত বারোটায়। পুরান ঢাকার রাজকুমার সানান ভাইয়ের নিজস্ব সময় ঘড়ি রয়েছে৷ যা সাধারণের সাথে তাল মিলিয়ে চলে না৷
এ নিয়ে সানান ভাই গর্ব করে বলে,
‘আমি তোদের মতো গরীব নাকি যে ঘড়ি ধরে সকালবেলা উঠে কামলা খাটতে যাব? আমার যখন ঘুম ভাঙবে তখনি সকাল হবে। সূর্যের নিয়মে আমি চলি না৷ বরং সূর্যের উচিত আমার নিয়মে চলা।’
সেই সানান ভাইয়ের আজকে সূর্যের সাথে মিতালি হলো কি করে? সাঁঝ ভেবে পেল না।
সাঁঝবাতিকে ওমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সানান ভাই বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে আদেশ দিল।
– হা করা তাকায় না থেকে তাড়াতাড়ি নিচে নাম৷
সাঁঝের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, এটা সানান ভাই। তার ধমক মিশ্রিত জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনল বলেই না বিশ্বাস হলো। না হলে ভূত-টুত ভেবে এক্ষুণি চিৎকার দিতে যাচ্ছিল।
পানির লাইনটা বন্ধ করে সাঁঝ দ্রুত নিচে নেমে এলো৷ সানান ভাইয়ের গায়ে রাতের পোশাক। একটা ক্যাটক্যাটে বাদামি রঙের ট্রাউজারের সাথে লেমন কালারের টিশার্ট পরেছে। উনাকে দেখেই সাঁঝের মুখটা তেতো স্বাদে ভরে গেল।
সেই তিতকুটে মুখ নিয়ে সাঁঝ একটু হাসার চেষ্টা করল। অভিনয় বোধহয় ভালো হয়েছে। সাঁঝের সেই হাসি মাখা মুখ দেখে সানান ভাই ভ্রুকুটি করে তাকাল।
– সকালবেলা এমন খেঁকশিয়ালের মতো হাসতেছিস কেন?
– খেঁকশিয়াল হাসে নাকি? জানতাম না তো। বাহ! আমার হাসি এতো ইউনিক!
– ফাজলামি করিস আমার সাথে? থাপড়ায় চাপার দাঁত নড়ায় ফেলব। বেয়াদব।
– তওবা, তওবা। আপনি গুরুজন। আপনার সাথে ফাজলামি করার স্পর্ধা আমার আছে! আপনাকে তো দিনরাত সালামের উপর রাখতে হবে। মা জননীর এমনি আদেশ।
সানান ভাই এগিয়ে গিয়ে সাঁঝের লম্বা বেণিটা এক হাতে প্যাঁচিয়ে ধরে জোরে টান দিল। ব্যথায় বাঁকা হয়ে পেছনে ঝুঁকে গেল সাঁঝ। সানান ভাই দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– খুব ফটর ফটর করে কথা বলতেছিস৷ এত সাহস কই থেকে আসল, সাঁঝবাতি?
– তাশফীন ভাইয়া এসেছে। আমি কিন্তু উনার কাছে নালিশ করে দিব। আপনি যখন তখন আমাকে মারেন।
– ওরে বাবা! তোর গুরুদেব এসেছেন নাকি! তাই তো বলি, আজকে মুখে খই ফুটতেছে কেমনে!
সানান ভাই এক ঝটকা মেরে সাঁঝের বেণি ছেড়ে দিয়ে দু হাত কোমরে রেখে দাঁড়াল। সাঁঝ তখন তার শখের চুলগুলো সামলাতে ব্যস্ত।
– যা, গিয়ে তোর রক্ষাকর্তাকে বল। আমি ওকে ভয় পাই নাকি?
– ভাইয়া ঘুম থেকে উঠলেই বলব৷ কালকেও আপনার নামে নালিশ করেছি।
– তাতে আমার কি হয়েছে?
– ভাইয়া বলেছে আপনার থেকে দূরে থাকতে। আজকে আবার বলব।
– যা বল। তোর ভাইয়া আমার কী করবে দেখি।
– ভাইয়া আপনার মতো মারকুটে না। মাকে বলে আমাকে বাঁচিয়ে নিবে। আপনি কেমন রাক্ষস সেটা তো আমি বললে মা বিশ্বাস করে না৷ ভাইয়া বললে ঠিকই শুনবে৷
– আর আমি যদি মেজ মাকে গিয়ে বলি, তার এতটুকু মেয়ের এই বয়সে দুটো পাখা গজিয়েছে। ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে। সেখানে রংঢং করে ছবি পোস্ট করছে। তাহলে কেমন হবে?
সানান ভাইয়ের কথা শুনে সাঁঝ যতটা না অবাক হলো, তার থেকে বেশি রাগ হলো তার মুখের মিটিমিটি হাসি দেখে৷ শয়তান লোকটা ঠিকই খবর বের করে ফেলেছে! রাগে হিতাহিতজ্ঞান লোভ পাওয়ার দশা সাঁঝের। হাতের এক আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে উঠল।
– আপনি… আপনি বাবাকে বলেছেন আমার ফেসবুক একাউন্টের কথা?
সাঁঝের লালচে মুখখানা দেখে সানান ভাই উনার চিরচেনা হাসিটা হাসল। গা দুলিয়ে উঠে দাঁত বের করা ভূবনভোলা হাসি। যা দেখে পুরান ঢাকার অর্ধেক রমণী প্রতিনিয়ত বেহুশ হয়। সাঁঝের চোখে এই হাসিটা জঘন্য লাগে। সে রাগে রীতিমতো কাঁপতে লাগল। ওর নাজেহাল দশা দেখে বেশ আনন্দ বোধ করল সানান ভাই। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,
– তারপর? কালকে কেমন বাঁশ ডলা খেলি?
– আমি কেন বাঁশ ডলা খেতে যাব? আমার বাবা আপনার মতো রাক্ষস নাকি?
সাঁঝের কথা শুনে ধপ করে নিভে গেল সানান ভাই। এই মেয়েকে মেজ বাবা কিছু বলেনি? চড় থাপ্পড় দূরের কথা, একটা ধমকও কি দেয়নি? কী আশ্চর্য! বড্ড হতাশ হল সানান ভাই। আশাহত হওয়ার রাগটা গিয়ে পড়ল সাঁঝের উপর।
কড়া চোখে তাকিয়ে রামধমক দিয়ে বলল,
– আমাকে আঙ্গুল দেখাস? সাহস খুব বেড়েছে না? আঙ্গুল ভেঙে দেব একদম। আঙ্গুল নামা।
তাশফীনের আগমনে সাঁঝ যতোই তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পাক, সাহসী হয়ে উঠুক কিন্তু সানান ভাইয়ের ধমকে যেখানে পুরো পুরান ঢাকা কেঁপে উঠে সেখানে সাঁঝ একটা অবোধ শিশু মাত্র৷
শুকনো ঢোক গিলে ঝটপট আঙ্গুল নামিয়ে মাথা নিচু করে অন্য দিকে তাকাল। সানান ভাই ফোঁস ফোঁস করে রাগান্বিত সাপের মতো কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল,
– কি বলেছে মেজ বাবা?
সাঁঝ মিনমিন করে জবাব দিল।
– আপনাকে কেন বলব?
– আছাড় খাবি একটা।
– ফেসবুকে ছবি দিতে না করেছে।
– তোর ফেসবুক আইডির নাম কি?
– গোধূলিবেলা।
সানান ভাই ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করে ফেসবুক অ্যাপ ওপেন করল।
– বাংলা না ইংরেজি ফ্রন্ট?
– বাংলা।
– এগুলোর মধ্যে কোনটা তোর একাউন্ট?
সানান ভাইয়ের বাড়িয়ে দেওয়া ফোনের স্ক্রীনে মনোযোগ দিয়ে তাকাল সাঁঝ। একদিন গোধূলি বেলায় শাড়ি পরে আরাম-আয়েশের ছাদে ছবি তুলেছিল সে। খোলা চুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাক ক্যামেরায় টাইমার অন করে পেছন থেকে ছবিটা তুলেছে। রঙিন আকাশের সামনে সাঁঝের কালো অবয়ব মিলিয়ে চমৎকার একটি ছবি উঠেছিল। সেই ছবিটি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে দেওয়া আছে সাঁঝের একাউন্টে।
খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগল না। কিন্তু সাঁঝ সেটা সানান ভাইকে দেখিয়ে না দিয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল,
– আপনি আমার একাউন্ট দিয়ে কি করবেন?
সানান ভাই শান্তস্বরে শুধু বলল,
– কোনটা?
এরপর আর কথা থাকে না। এবার দেখিয়ে না দিলে সকালবেলা চড় খেয়ে পেট ভরাতে হবে। সাঁঝ মুখ ফুলিয়ে নিজের একাউন্ট দেখিয়ে দিল।
চট করে ফোনের স্ক্রীনটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে সানান ভাই বলল,
– ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি। রুমে এগিয়ে এক্ষুণি একসেপ্ট করবি। এক মিনিট দেরী হলে একটা থাপ্পড়।
সাঁঝ বিস্ফারিত চোখে সানান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সানান ভাইকে ফ্রেন্ড লিস্টে নেওয়া মানে আস্ত গোয়েন্দাকে কাঁধে নিয়ে চলাচল করা।
এদিকে মানা করার উপায়ও নেই। ফ্রেন্ডলিস্টে এড না করলে সানান ভাইয়ের ইগোতে লাগবে। সেটার শাস্তি হবে আরও ভয়াবহ।
সাঁঝ হতাশার শ্বাস ফেলল। কোন কুক্ষণে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছিল সে? আর কে সেই বান্দা যে সানান ভাইয়ের কানে এই খবর পৌঁছে দিয়েছে?
তাকে একবার সামনে পেলে ড্রেনের পানিতে দুটা চুবানি দিবে সাঁঝ।
আহা! সাঁঝের শখের ফেসবুক একাউন্টটা! এখন ফেসবুকে একটা নিঃশ্বাস ফেলেও শান্তি পাওয়া যাবে না।
সাঁঝবাতির অন্ধকার মুখখানা দেখে সানান ভাইয়ের মনটা আবারও ফুরফুরে হয়ে গেল। সাঁঝবাতিকে আরেকটুখানি চিন্তায় ফেলে দিতে বলল,
– এবার দেখি তুই ফেসবুক কি কি করিস। মেজ বাবার কথা শুনে ভালো মেয়েটি হয়ে যাচ্ছিস নাকি বাঁদরামি চালিয়ে যাচ্ছিস – সবই দেখা যাবে।
ট্রাউজারের পকেটে ফোনটা পুরে সানান ভাই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। এবার শান্তিতে একটু ঘুমানো যাবে।
অন্যদিকে সাঁঝের ইচ্ছে হলো, অদ্ভুত পোশাক পরা এই মানুষটিকে জ্বা*লিয়ে দিতে৷ দাউদাউ করে সে জ্ব*লবে আর সাঁঝ দাঁড়িয়ে দেখবে সেই অপরূপ দৃশ্য। আহা! ভাবতেই শান্তি লাগছে।
চলবে..
#অক্ষরময়ী