এই সাঁঝবাতি পর্ব-০৭

0
16

#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ০৭

তিনটে কোচিং ব্যাচ আর নীলক্ষেতে একটা বইয়ের লাইব্রেরি থেকে যা আয় আসে তা দিয়ে সাদিকের পরিবার চলে। প্রতিযোগিতার এই যুগে টিকে থাকা কঠিন। কোনোরকম গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে সাদিকের লাইব্রেরিটি। আপাতত কোচিংয়ের ব্যাচ তিনটি ভরসা।
পুরনো দিনের সকল চিন্তা ভাবনাকে দূরে সরিয়ে নতুন উদ্যমে হাসি মুখে ক্লাসে প্রবেশ করেন সাদিক। যতক্ষণ বাচ্চাগুলোকে পড়ায় ততক্ষণ কোনো দুশ্চিন্তা তাঁকে ছুতে পারে না। এটাই বুঝি পছন্দনীয় প্রফেশনের পজেটিভ সাইড৷ কিন্তু সাদিকের দূর্ভাগ্য যে মিথ্যে অপবাদ মাথায় নিয়ে পছন্দের পেশাটি তাঁকে একসময় ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

সকালবেলা বাবা যতক্ষণ বাচ্চাদের পড়ায় সাঁঝের হাতে ততক্ষণ সময় থাকে ফেসবুক চালানোর। কিন্তু আজকে সাঁঝের হাতে বেশি সময় নেই। ঘুম থেকে উঠে দেখে নয়টা বাজে। সাঁঝ ভীষণ অবাক হলো। এতবেলা হলো তবুও মা তাকে ডাকতে আসেনি৷ এতক্ষণে সাঁঝের পিঠে কয়েক ঘা পড়ার কথা ছিল। অথচ আজ পরিবেশ বেশ শান্ত।

দ্রুত ফ্রেশ হতে সাঁঝ রান্নাঘরে উঁকি দিতেই স্বর্ণলতার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

– সারাদিন ঘুমায় মন ভরলে খাবারগুলা টেবিলে নিয়ে গিয়ে রাখ।

সাঁঝ ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে টেবিল গুছিয়ে, দাদীর ঘরে চায়ের কাপ পৌঁছে দিয়ে আবার ছুটল বাবাকে নাস্তার জন্য ডাকতে।

সাঁঝ বেরিয়ে যেতেই সাওদা বেগম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে এসে বসলেন ডাইনিং টেবিলে। সুরুৎ করে চায়ের কাপ থেকে চা পান করে স্বর্ণলতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে করলেন।

– দিনের বেলা মাইয়ারে ধরে মারে, রাইতের বেলায় লুকায় লুকায় আদর করে। মাইয়া ঘুমে কাইত, হেয় মাথার উপ্রে বইসা কান্দে। তোমার এই কান্দন কি মাইয়া দেখল, না শুনল? হেয় তো দেখল তোমার মাইর। মাইয়া হইছে পরের বাড়ির আমানত। যতদিন তোমার কাছে আছে তারে আদর যত্নে রাখো।
দুদিন পর মাইয়ার বিয়া দিবা। এমনে মাইর-ধর করলে মনে দুঃখ লইয়া মাইয়া যাইবো শ্বশুর বাড়ি। আর ফিররা আইবো না। মায়ের প্রতি মায়া মহব্বত না থাকলে মায়ের কাছে কেন আইবো? তখন কাইন্দা কূল পাইবা না। কইয়া রাখলাম।

স্বর্ণলতা শুনেও শুনলেন না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে কর‍তে ভাবলেন ভোরবেলার কথা। ঘুম থেকে উঠে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সাঁঝের ঘরে। বাম গালটা তখনো খানিকটা ফোলা ছিল। লালচে ভাবটুকুও কিছুটা রয়ে গেছে। স্বর্ণলতার মাতৃ হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। সাঁঝের ঘুম খুবই গভীর। ঘুমিয়ে পড়লে আর হুশ-জ্ঞান থাকে না। সেই সুযোগে মেয়ের গালে মমতার চুমু এঁকে দিয়েছিলেন স্বর্ণলতা। সাওদা বেগম কোন ফাঁকে দেখে ফেলেছেন কে জানে!

সবার আগে নাস্তা শেষ করে বাবার মোবাইল হাতে ঘরে ছুটে গেল সাঁঝ। গতকাল একটা ছবি আপলোড করেছিল ফেসবুকে। সেই পোস্টে কতগুলো রিয়েক্ট এসেছে কে জানে!
ফেসবুক সম্পর্কে সাঁঝ তেমন কিছু জানে না। জুবিয়া ওকে গাইডলাইন দিচ্ছে।

জুবিয়ার আদেশ, প্রোফাইল পাবলিক করা থাকলেও পোস্টের প্রাইভেসি ফ্রেন্ডস রাখতে হবে৷
যাকে তাকে ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত করা যাবে না। অনেক যাচাই বাছাই করে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করতে হবে।
নিউজফিডের সব পোস্টে রিয়েক্ট কমেন্ট করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রেও চুজি হতে হবে৷

এদিকে সাঁঝের একাউন্টে প্রায় তিন হাজার ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এসে জমা হয়ে আছে। বেচারাদের জন্যে সাঁঝের-ই কষ্ট হয়।

গতকালকের পোস্টের রিয়েক্ট চেক করতে গিয়ে সাঁঝের চক্ষুচড়ক গাছ। তার এত সুন্দর ছবিতে কে যেন হা হা রিয়েক্ট দিয়েছে। এযাবৎকালে কেউ কখনো সাঁঝের ছবি লাভ রিয়েক্ট ব্যতীত অন্য কিছু দেয়নি। আজকে হঠাৎ অন্য রিয়েক্ট তাও আবার হা হা! সাঁঝ উত্তপ্ত মস্তিষ্কে রিয়েক্টদাতাকে খুঁজতে গিয়ে আরেক ঝটকা খেল।
রিয়েক্টদাতা আর কেউ নয়, স্বয়ং সানান ভাই।
অন্য কেউ হলে, সাঁঝ এক্ষুণি তাকে ব্লক করে দিত।

জুবিয়া বলেছে, কেউ বিরক্ত করলে বেশি মানসিক চাপ না নিয়ে সোজা ব্লক করে দিতে। কিন্তু সানান ভাইকে ব্লক করা তো দূরের কথা আনফ্রেন্ড করাও সাঁঝের পক্ষে সম্ভব নয়।
বিরস মুখে সাঁঝ পরবর্তী ধাপে গেল। একগাদা নোটিফিকেশন এসে জমা হয়েছে। নাইটি নাইন প্লাস!
কীসের এতো বার্তা এসেছে কে জানে! দুরুদুরু বুকে নোটিফিকেশন অপশনে ক্লিক করে সাঁঝ আরেক ঝটকা খেল। খুব সতর্কতার সাথে সাঁঝের প্রতিটি ছবিতে খুব সময় নিয়ে, যত্ন সহকারে হা হা রিয়েক্ট দিয়েছে সানান ভাই। একটি ছবিও বাদ যায়নি৷

নিজ টাইমলাইনের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সাঁঝ। প্রতিটি পোস্টে জ্বলজ্বল করছে বিদঘুটে হাস্যকর ইমোজি।
সানান ভাইয়ের দেখাদেখি এখন অন্যরাও যদি হা হা দেওয়া শুরু করে? মনুষ্য জাতির স্বভাব-ই হচ্ছে অন্যকে অনুকরণ করা, প্রভাবিত হওয়া।

সাঁঝ এখন কি করবে ভেবে পেল না। বাধ্য হয়ে শরণাপন্ন হলো জুবিয়ার। মেসেজ পাঠাল,

“সানান ভাই আমার পোস্টে হাহা রিয়েক্ট দিয়েছে।”

“ব্লক দে।”

“সম্ভব না। রাস্তাঘাটে আটকায় পিটাবে।”

“ঘরের বাইরে বের হবি না।”

“বাড়ি চলে আসবে। আমার চৌদ্দগুষ্টির সামনে আমাকে পিটাইলেও কেউ টু শব্দ করবে না। বংশের বড় ছেলে হওয়ার সুবিধা, সাত খুন মাফ।”

“তাহলে যেটা হাহা দিয়েছে, সেই ছবি ডিলিট করে দে।”

“সবগুলোতেই দিয়েছে।”

“সব পোস্টে!”

“শুধু আমার ছবির পোস্টগুলো।”

“সে প্রায় একশতের কাছাকাছি তোর ছবি আছে ফেসবুকে।”

“জ্বি হ্যাঁ। সবগুলোতেই দিয়েছে। বাদ যায়নি কোনো শিশু।”

“কী বলিস! এত ধৈর্য সানান ভাইয়ের!”

“বিটলামি করার জন্য উনার ধৈর্যের কমতি নাই। সারারাত ধরে এগুলাই করছে। রাত দুইটা, তিনটার দিকে নোটিফিকেশন আসছে। মানুষের কাজ না থাকলে মানুষ এসব করে। অথচ এই সানান ভাইয়ের প্রশংসার জন্য কোথাও কান পাতা যায় না। সানান এই, সানান সেই৷ এটা করছে, সেটা করছে। তোমরা কি করছ জীবনে? সানানের মতো হও, সানানের মতো পড়ো, রেজাল্ট করো। উফ! জীবনটা তেজপাতা বানায় দিছে এই সানান ভাই।”

“অথচ ভেতরে ভেতরে এমন শয়তানি। তোর বাড়ির লোকজনকে ধরে ধরে এখন এসব দেখানো উচিত।”

“লাভ নাই৷ তারা সানান ভাইয়ের অন্ধ ভক্ত। উনারই সাপোর্ট নিয়ে বলবে, ফেসবুকে ছবি দিয়েছ কেন? এখনি ডিলিট করো।”

“সে তোর এখন ডিলিট করতেই হবে।”

“সব ডিলিট করে দিলে থাকবে কি? আর কোনো অপশন নাই?”

“অনেক অপশন আছে। আনফ্রেন্ড করে দে, ব্লক দে। না হলে যেমনে আছে ওমনেই থাকতে দে। হা হা রিয়েক্ট দেখা যাচ্ছে যাক।”

“নাহ। নাহ। ওভাবে রাখা যাবে না। আইডির দিকে তাকালে নিজেকে কেমন জোকার লাগতেছে।”

“তাহলে ডিলিট দেওয়া ছাড়া উপায় নাই৷ প্রাইভেসি অনলি মি করেও রাখতে পারিস।”

এত ধৈর্য সাঁঝের নেই। বুকে পাথর চেপে সবগুলো ছবি ডিলিট করে দিল। কাজ শেষে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতেও পারল না। তার আগেই মায়ের বকুনি শুনতে হলো। মোবাইলে এতক্ষণ ধরে কি করতেছিল সে? জুবিয়ার বাহানা দিয়েও লাভ হলো না। স্বর্ণলতার বুকে সন্দেহের তীর ভালোভাবেই গেঁথে গেল।

রাত জাগা সানান ভাইয়ের কাছে পানির মতো সোজা একটা কাজ। বরং রাতে ঘুমানোটাই এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। ডিজাইনের জন্য যতসব ইউনিক আইডিয়া মাথায় আসে রাতের বেলা। এজন্য রাত জেগে ডিজাইনের কাজ করে৷ কিন্তু গতকাল রাত জাগলেও ডিজাইনের কাজ করেনি৷ সারারাত ধরে সাঁঝের আইডি ঘেটেছে৷ আইডির সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত যা এক্টিভিটিস ছিল সবগুলো চেক করে তবেই ঘুমাতে গিয়েছিল। হা হা রিয়েক্ট দেওয়ার পর এত ভালো ঘুম আসবে জানলে সানান ভাই আরও কয়েকটা পোস্টে হাহা রিয়েক্ট দিত৷

দুপুর পর্যন্ত গভীর একটা ঘুম দিয়ে সানান ভাই যখন ঘুম থেকে উঠল তখন বাড়ির সকলে খেতে বসেছে৷ কাজের মেয়েটার থেকে কফির মগটা নিয়ে সানান ভাই গিয়ে বসল টেবিলে।

ছেলের এই অনিয়মের জীবন মোটেও পছন্দ করেননা সাবির শারাফাত। কিন্তু স্ত্রীর কারণে কিছু বলতেও পারেননা। বেলা দুইটায় ছেলেকে হেলেদুলে বেডরুম থেকে বের হতে দেখে সাবির বিরক্ত চোখে একপলক তাকিয়ে নিজের প্লেটে মনোযোগ দিলেন।

বাবার বিরক্তি একপলকে পড়ে ফেলল সানান ভাই। আরেকটু বিরক্ত করার সুযোগ সে ছাড়ল না৷

– কী ব্যাপার? আজকে তুমি স্কুলে যাওনি?

সাবির বললেন,

– ছুটি নিয়েছি।

– কেন?

– বিশেষ কোনো কারণ নেই।

– ক্ষমতার অপব্যবহার। এভাবে কাজে ফাঁকি দেওয়া ঠিক না।

– একটা মানুষ বছরে ৩৬৫ দিন কাজ করলে তার দু এক দিন রেস্টের প্রয়োজন হয়। এজন্য এক, দুটো ছুটি সে নিতেই পারে। নাইন টু ফাইভের জব করতে কী পরিমাণ পরিশ্রম হয়, সেটা তুমি কি করে বুঝবে। কখনো চাকরি করলে সেদিন বুঝতে পারবে।

– এক্সকিউজ মি? আমিও জব করি।

– জব করো না কি করো সেটা তুমি ভালো জানো৷ কোন জবে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটানো যায় সে সম্পর্কে আমার আইডিয়া নেই।

– তুমি আসলে জেলাস। আমি দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়েও জব কন্টিনিউ করছি, সেটা দেখে তোমার হিংসে হচ্ছে।

– এরকম ফাঁকিবাজির জব আমার দরকার নেই। আমি স্বচ্ছভাবে পরিশ্রম করে পারিশ্রমিক নেওয়া প্রেফার করি।

– আমি কি এইচআরের গলায় ছু রি ধরে পারিশ্রমিক নেই?

– ধরতেও পারো। তোমার ভরসা নেই।

সানান ভাই ঠাস করে কফির মগটা টেবিলে রেখে তর্কযু/দ্ধে পূর্ণ অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিল। বাধ সাধল আফসানা। তিনি এতক্ষণ সায়রাকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন বলে বাবা-ছেলের মাঝখানে কিছু বলেননি৷ জল অনেকদূর গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে সায়রার মুখ মুছে দিয়ে বললেন,

– বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। মা এখনি আসছি।

সায়রা তার ছোট চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে নামল। দুলে উঠল তার মাথা ভর্তি কালো কুচকুচে রেশমি চুলগুলো। সাঁঝের পর এই বংশে এমন রেশমি কালো চুলের অধিকারী একমাত্র সায়রা। সানান হাত বাড়িয়ে সায়রার ঘাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা রেশমি চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। সায়রা বিরক্তিতে নাক মুখ কুচকে তার ছোট ছোট হাত দুটি দিয়ে মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে সানানের দিকে রাগী চোখে তাকাল। গোল গোল চোখে শিশুসুলভ রাগ ভারী মিষ্টি দেখায়। ক্ষণপূর্বের রাগ ভুলে সানান ভাই হেসে ফেলল।

সায়রা চলে যেতে একটি প্লেটে খাবার তুলে সানানের দিকে এগিয়ে দিল আফসানা। অন্য একটি প্লেটে নিজের জন্য খাবার তুলে বললেন,

– খেতে বসেও তোমাদের ঝগড়া করতে হবে?

মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে সাবির বললেন,

– আমরা যাস্ট কথা বলছিলাম। নর্মাল কনভারসেশন।

– তোমাদের নর্মাল কনভারসেশন এত টেনসড ইনভায়রনমেন্ট তৈরি করলে সত্যিকার ঝগড়ার সময় ইনভায়রনমেন্ট কেমন হবে ভেবেই আমার ভয় হচ্ছে।

ভয়ের কথা বললেও আফসানার মুখে কোনো ভয় দেখা গেল না। বরং তিনি যে বাবা-ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে বেজায় বিরক্ত তা উনার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

সানান ভাই এত তাড়াতাড়ি ভারী খাবার খায় না। কিন্তু মা তুলে দিয়েছে বলে না করতে পারল না৷ প্লেট টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল।

আফসানা হঠাৎ বললেন,

– তোর সাথে আমার কথা আছে সানান।

– হ্যাঁ বলো।

– গতকালকে স্বর্ণলতা এসেছিল। ওর বোনের ছেলে নাকি বাসা ভাড়া খুঁজছে। আমাদের ফ্ল্যাট ফাঁকা আছে কিনা জানতে চাচ্ছিল।

সানান ভাই খাওয়া থামিয়ে উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,

– বোনের কোন ছেলেটা? নাম কি?

– তাশফীন।

– অসম্ভব। তুমি হ্যাঁ বলে দাওনি তো আবার?

– এখনো কিছু বলিনি৷

– না করে দেও। বলো যে কোনো ইউনিট ফাঁকা নেই।

– কিন্তু পাঁচতলার বি ইউনিকটা দুই মাস ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। ও উঠলে কী সমস্যা?

– আর কয়েকদিন অপেক্ষা করো এমনিতেই ভাড়াটে পাওয়া যাবে। কেউ না উঠলে ওটা ওভাবে ফাঁকা পড়ে থাক। তবুও ওই ছেলেকে ভাড়া দিব না৷

– কি সমস্যা?

এরা মা-ছেলে সংসারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়। সাবির শারাফাতকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেন না। এমনটা নয় যে এতে সাবিরের রাগ হন বা অপমানিত বোধ করেন। বরং তিনি এসব সাংসারিক ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পারলেও বেশি খুশি হন। কিন্তু আজকের আলোচনায় অংশ নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলেন না। বাঁকা হেসে বললেন,

– বুঝতে পারছ না, আফসানা? তাশফীনকে তোমার ছেলের পছন্দ নয়। তাই ভাড়া দিতে চাইছে না।

সানান ভাই চোয়াল শক্ত করে বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

– ঠিক বলেছ। ওই ছেলেটাকে আমার একদক সহ্য হয় না।

আফসানা বেজায় অবাক হয়ে শুধালেন,

– কেন?

সাবির ফের বাগড়া দিলেন।

– হিংসা, বুঝলে? সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও তাশফীনকে দেখো লাইফে কতটা এগিয়ে আছে। মেডিকেলে পড়েছে।

সানান ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

– ডেন্টালে। তাও আবার প্রাইভেট ইন্সটিটিউট থেকে।

– সে যাই হোক। পাশ করামাত্র চাকরিতেও জয়েন করেছে। শুনেছি বিসিএসটাও এবার হয়ে যাবে। খুবই ডিসেন্ড, ডিসিপ্লিনড একটা ছেলে। ওর উন্নতি দেখে তোমার ছেলের জ্বলতেছে।

– আমার এতো আজাইরা সময় নাই যে কারো দিকে তাকাইতে যাব। উন্নতি দেখে জেলাস হওয়া তো দূরের কথা। আর চাকরি আমিও করি৷ ওর থেকে আমার আয় বেশি।

– তাশফীন একটা সম্মানজনক পেশায় আছে। ডিসিপ্লিনড, হেলথি লাইফ লিড করে। তোমার মতো সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায় না। লাঞ্চ আওয়ারে কফির কাপ নিয়ে বসে না। নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেছ কখনো? গুহা থেকে বেরিয়ে আসা কোনো আদিম যুগের মানুষের মতো দেখাচ্ছে তোমাকে। এলোমেলো চুল, এলোমেলো পোশাক। হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি পরে ঘুরতেছ। জোকারের মতো দেখাচ্ছে। কয়েকদিন পর চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল দেখা দিলেও অবাক হবো না।

সানান ভাই মায়ের দিকে তাকিয়ে নালিশ করে বলল,

– তোমার জামাই কিন্তু বেশি বেশি বলতেছে আজকে।

সাবির সেসব কথা শুনলেন না। প্রায় মাসখানেক পর আজ ছেলের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। রোজ সকালে যখ৷ স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান তখন সানান ভাই ঘুমে। রাতে তিনি বাড়ি ফিরেন, সানান ভাই যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে৷ তিনি ঘুমাতে যাওয়ার পর সানান ভাই বাড়ি ফিরে৷ ফলাফল, একজন আরেকজনের সম্মুখীন হয়না অনেকদিন। তাই আজকে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে ভুললেন না সাবির।

– কখন ঘুমাও, কখন উঠো, কখন অফিস যাও, কখন কাজ করো – তার কোনো ঠিক নেই। লাইফে কোনো প্রোপার রুটিন আছে তোমার? এটাকে তুমি জীবন বলো? এভাবে জীবন কাটাবে?
এটা কোনো সুস্থ মানুষের লাইফস্টাইল হতে পারে না। এককালে এলাকার সবচেয়ে ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলে তুমি। আমাদের বংশের গর্ব ছিলে। অথচ এখন দেখো নিজেকে কোথায় নামিয়ে এনেছো। ইউ আর নট অ্যা বয় ইনিমোর। ইউ আর অ্যা গ্রোনআপ ম্যান। সো বিহেইভ লাইক অ্যা ম্যান। ফিক্সড ইয়োর গোল৷ এন্ড ওয়ার্ক অন ইট। বয়স থেমে নেই। ছাব্বিশ ছাড়িয়ে সাতাশে পা দিয়েছ। কয়েকদিন বিয়েশাদি করবে, বাচ্চার বাবা হবে৷ তখন কি করবে?

সাবির নিজের বক্তব্য শেষ করে রেগেমেগে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। সানান ভাই ঘাড় ফিরিয়ে বাবার অগ্নিমূর্তিকে বেসিনে হাত ধুয়ে ঘরের দিকে যেতে দেখল। সামনে ফিরে চোখ দুটো সরু করে তাকিয়ে মাকে বলল,

– ওই ছেলেকে আমি কিছুতেই আমাদের ফ্ল্যাটে উঠতে দিব না। জীবনেও না। তুমি আজকেই না করে দেও৷ ডিসেন্ট এন্ড ডিসিপ্লিনড! মাই ফুট।

চলবে..
#অক্ষরময়ী