#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ১৯
ঘড়ির হিসাবমতে সময়টা এখন মধ্যরাত। চৌধুরী বাড়ির দৃশ্যপট অবশ্য সে ধারণাকে বানচাল করে দিয়েছে৷ চারপাশের চোখ ধাঁধাঁনো আলোয় লোকে ভুলতে বসেছে সময় জ্ঞান। আলোর পশরা সাজিয়ে সকলে মেতে উঠেছে উৎসবে। বাড়ির অন্দরমহলের আয়তাকার আঙিনায় পাটি বিছিয়ে বসেছে সকলে। সকাল হতেই গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে৷ তারই আয়োজন চলছে মধ্যরাতে৷
একদল বসেছে হলুদের যোগাড়যন্ত্র নিয়ে৷ আরেকদল ব্যস্ত রান্নার আয়োজনে৷ এতগুলো মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা শুধু রাঁধুনির পক্ষে অসম্ভব। তাই তো সকলে মিলে বসেছে সবজি কুটতে৷
মায়ের পাশে বসেছে সাঁঝ। পেয়াজের খোসা ছাড়াতে গিয়ে চোখের জল, নাকের জল এক করে ফেলেছে। রমণীদের মধ্যে এতরাত অব্দি শুধুমাত্র সে জেগে আছে৷ বাকিরা সবাই নিজ নিজ রুমে ঘুমে কাত। রাত জাগলে পিম্পল উঠবে, চোখে নিচে কালি পড়বে, চেহারার গ্লো চলে যাবে – তাদের কতশত ভয়!
এসবের ভয় যে সাঁঝের নেই, এমনটা নয়৷ সে নিজেও সৌন্দর্য সচেতন মানুষ। কিন্তু মায়ের চোখ রাঙানিতে চুপচাপ বসে পড়েছে। তাছাড়া সুনেরাহ-র রুমে গিয়ে তার অত্যাচার সহ্য করার থেকে এখানে বসে চোখের জল ফেলানো ঢের ভালো৷
মহিলারা সবাই গল্পে মেতেছে৷ হাতের সাথে মুখও চলছে সমান তালে। কনের বাড়ির যত অন্যায়, যত অনাচার – সবকিছু নিয়ে আজ আলোচনা হবে।
উপরতলার দক্ষিণের ঘর থেকে সানান ভাইয়ের গলা শোনা গেল৷
– আম্মা, আম্মা? কই তুমি?
মূহুর্তেই নীরবতা নেমে এলো উঠোনে৷ সকলে চট করে তাকাল সানান ভাইয়ের ঘরের দিকে৷ আফসানা বিরক্ত হলেন। উঁচু কণ্ঠে জবাব দিলেন,
– নিচে কাজ করতেছি৷ আবার কি হলো তোর?
– মশা কামড়াচ্ছে। কয়েল দিয়ে যাও।
বাড়ির সবচেয়ে আরামদায়ক রুমটি দেওয়া হয়েছে সানান ভাইকে৷ তবুও সে রুমে প্রবেশ করেছে থেকে বাড়ির সবাই এক আঙ্গুলে নাচাচ্ছে৷ কখনো রুমে বালু, ঝাড়ু দিয়ে দেও৷ মাকড়সার জাল দেখা যাচ্ছে, সেটা পরিষ্কার করে দেও৷ জানালা খুলতে পারছে না, সেটা খুলে দেও। গরম লাগছে, হাত পাখা দাও৷ মশারি লাগিয়ে দেও। গরম লাগছে, মশারি তুলে ফেল৷
সানান ভাইয়ের অত্যাচারের সবার ত্রাহিত্রাহি অবস্থা।
আফসানা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– আরও রিকুয়েষ্ট করো ওকে। হাতে ধরে আটকে রাখো৷ এই ছেলের আহ্লাদ তো জানো না তোমরা। হাড়গোড় জ্বালিয়ে মারে৷ তোমাদের মেহদানদারীর শখ ঘুচিয়ে দিবে একদম৷
– আজকাল মশার উপদ্রব একটু বেশি বেড়েছে। মশা কাড়মালে কি আর ঘুম হয়? চিল্লাবে না কেনো ছেলেটা। যা তো সাঁঝ, একটা কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে আয়৷
ভাইয়ের ছেলের প্রতি একটু বেশি টান সাবার। নিজের বাড়িতে আদরের ভাতিজার একটুখানি অযত্ন তিনি মেনে নিতে পারছেন না৷ শুধু সাবা নয়, সবারই সানান ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা একটু বেশি কাজ করে৷
বংশের বড় সন্তান বলে কথা৷ সব আদর তার উপরে বর্ষিত হয়৷ যেটুকু উচ্ছিষ্ট রয়ে গেছে, তা বন্টন হয়েছে বাকি সবার মাঝে।
সাঁঝ বিরক্ত হয়ে উঠে গেল সানান ভাইয়ের রুমে। জানালা, দরজা হাঁট করে খোলা। শো শো করে নরম একটা বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। রুমের আবহাওয়ায় শীতলতা ছড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দরজা দিয়ে৷ প্রাকৃতিক বাতাসের নিকট ফ্যান, এসির কৃত্রিম বাতাস নস্যি মাত্র।
প্রশস্ত বিছানার মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে টানটান সোজা হয়ে শুয়ে আছে সানান ভাই৷ তার গলা জড়িয়ে ধরে বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে সায়রা।
পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করে কয়েলটা রেখে চলে যেতে চাইছিল সাঁঝ। কিন্তু পিছু ডাকল সানান ভাই৷
– এই সাঁঝবাতি?
চমকে গিয়ে পিছু ফিরল সাঁঝ। সানান ভাই তখনো চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সাঁঝ কোনোরকমে জবাব দিল,
– হুম।
– ক’টা বাজে?
– জানি না। আমার কাছে ঘড়ি নেই৷
– টেবিলে উপর আমার মোবাইল রাখা আছে।
সাঁঝ ফিরে এসে টেবিল থেকে মোবাইলটি তুলে সময় দেখে বলল,
– তিনটা দশ।
– সকাল হতে আরও দেরী! এই গরমে অতিষ্ট হয়ে গেলাম। ধুর। যাওয়ার সময় রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে যাস। এটার জন্য বেশি গরম লাগছে৷
যথাস্থানে মোবাইল রাখতে গিয়ে সাঁঝ খেয়াল করল, সানান ভাইয়ের মোবাইলের লকস্ক্রিনের ওয়ালপেপারটা অদ্ভুত৷ একটা হাতের মুঠোয় ঝুলছে একটা মেডেল৷ একদেখায় সানান ভাইয়ের হাতটা চিনে ফেলল সাঁঝ। কিন্তু মেডেলটা কীসের?
বেশ কিছুক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল। এটা ওদের স্কুলের নতুন কলেজ বিল্ডিং এর সামনে তোলা ছবি। মেডেলটাও সাঁঝ চিনে৷ সানান ভাই যখন প্রথম কলেজে ভর্তি হলো সেবার একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়েছিল। জিতেছিল সানান ভাইয়ের টিম৷ ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ সানান ভাই৷ মেডেলটা সেই ম্যাচের পুরষ্কার৷
খুবই চাঞ্চল্যকর একটা ম্যাচ ছিল। প্রতিপক্ষ দল ছিল বেশ লড়াকু। ওই দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের হারিয়ে ম্যাচ জেতার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তবুও সাঁঝ বান্ধবীদের সাথে বাজি ধরেছিল, তার ভাইয়ের দল জিতবে।
তখন সানান ভাইয়ের সাথে বেশ খাতির ছিল সাঁঝের। সেসব কথা মনে করে সাঁঝের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি দেখা গেল৷ শৈশব এত চমৎকার হয় বলেই, কিছু উঠার আগে সময়টা দ্রুত ফুরিয়ে যায়৷
বাজির কারণে ফাইনাল খেলার আগের রাতে ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাতে পারে নি সাঁঝ। সবাই বলছিল প্রতিপক্ষ অনেক নামকরা দল। প্রতিবার ওরাই ট্রফি নিয়ে যায়। এদিকে সাঁঝ বাজি লাগিয়ে বসে আছে। ভয়ে, উত্তেজনায় সেদিন মাঝরাতে সানান ভাইয়ের ঘরের সামনে হাজির হয়েছিল সাঁঝ৷ ঘুমন্ত সানান ভাই দরজা খুলে দেখে সাঁঝ দাঁড়িয়ে৷
– এত রাতে না ঘুমিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিস কেনো?
সাঁঝ ঠোঁট উল্টে করুণ সুরে জানিয়েছিল,
– টেনশন হচ্ছে সানান ভাই।
– কীসের?
– কালকে ম্যাচের।
– ম্যাচ খেলবো আমরা৷ অথচ টেনশন তোর?
– আমি আসলে বান্ধবীদের সাথে বাজি ধরেছি৷ তোমরা হেরে গেলে আমি শেষ।
– কয় টাকা বাজি ধরেছিস?
– পঞ্চাশ টাকা৷ অথচ আমার কাছে এক টাকা নাই।
– আচ্ছা ব্যাপার না। আমার দিয়ে দিব পঞ্চাশ টাকা।
– নাহ, নাহ৷ টাকাটা ব্যাপার না। বাজি হেরে গেলে স্কুলে আমার মানসম্মান থাকবে? সবাই ক্ষেপাবে আমাকে।
– হুম। তাও ঠিক। এত যেহেতু বুঝিস, তাহলে আমাদের পক্ষে বাজি ধরতে গেলি কেন?
– আমি তোমার টিমকে সাপোর্ট করবো না, এটা হতে পারে না কখনো? তুমি কত্তো ভালো খেলো! শুধু সবসময় সিরিয়াসলি খেলো না বলে মাঝেমধ্যে হেরে যাও
– তোর মনে হয় আমি ভালো খেলি? ম্যাচ জিততে পারবো?
– আমার বিশ্বাস, তুমি চাইলেই জিততে পারবে।
সানান ভাই চুপ করে কী যেন ভাবছিল। ছোট্ট সাঁঝ তখন পঞ্চম শ্রেণীর চঞ্চল এক প্রজাপতি। খপ করে সানান ভাইয়ের হাত দুটো ধরে বিনীত অনুরোধ করল,
– তুমি প্লিজ কালকে একটু মনোযোগ দিয়ে খেলো। আমার মানসম্মানের ব্যাপার।
সামান্য এক বাজিখেলা নিয়ে সাঁঝের ভীতি বেশ উপভোগ করছিল সানান ভাই। গা দুলিয়ে হেসে বলেছিল,
– আচ্ছা ঠিক আছে। তোরে হারবে দিব না৷ এখন গিয়ে ঘুমা।
সাঁঝের নিকট সানান ভাই তখন সুপার হিরো৷ সকল দুশ্চিন্তা সানান ভাইয়ের পায়ে লুটিয়ে দিয়ে নাচতে নাচতে ফিরে গিয়েছিল নিজের ঘরের দিকে৷ মাঝ রাস্তায় দেখা বড় মায়ের সাথে। রাতের বেলা একা একা বাড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অপরাধে সাঁঝ বেশ ধমক খেয়েছিল সেদিন৷ বড় মা কঠোরভাবে নিষেধ করেছিল, আর কখনো যেন রাতের বেলা বাড়ির এই অংশে আসা না হয়৷ বিশেষ করে সানান ভাইয়ের রুমের দিকে।
বড় মায়ের আদেশ পুরোপুরি মেনেছে সাঁঝ। আর কখনো রাতের বেলা সানান ভাইয়ের আশেপাশে ঘেঁষেনি।
সানান ভাই তার কথা রেখেছিল৷ নিজের দলকে জিতাতে বেশ কসরত করতে হয়েছে তাকে৷ একাই পনেরো ওভার খেলে জিতে নিয়েছিল ম্যাচ। খুশিতে উচ্ছ্বসিত সাঁঝ দর্শক সারি থেকে একদৌড়ে উপস্থিত হয়েছিল মাঠে। আনন্দে ঝাপিয়ে পড়েছিল সানান ভাইয়ের উপর। সানান ভাই দু হাতে আগলে না নিলে মাঠেই চিৎপটাং হয়ে পড়ত সেদিন।
নিজের শৈশবের দুরন্তপনায় লাজুক হেসে মোবাইলটি পূর্বের স্থানে রেখে দিল সাঁঝ। তখনি চোখে পড়ল ছবিটির বামপাশে ঘাসের উপর একটি ছায়া। যদিও অস্পষ্ট, তবুও ব্যক্তিটি যে একজন নারী তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। শাড়ির আঁচলের সাথে সামান্য কিছু লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে। আর কিছু দেখা যাচ্ছে না ছবিতে৷
কে এই নারী? ছবিটি সেই সময়ের তোলা হলে সাঁঝ অনুমান করে নিতে পারত। ওই দিন সানান ভাইয়ের বান্ধবীদের মধ্যে গুটি কয়েক শাড়ি পরে এসেছিল। তাদের মধ্যে কেউ একজন হলে সাঁঝ চিনতে পারত। কিন্তু এই ছবিটি সম্প্রতি তোলা হয়েছে। এক, দু বছর আগে হয়তো। সানান ভাইয়ের পুরুষ্টু হাত, কলেজের নতুন বিল্ডিং সময়কালের সাক্ষী দিচ্ছে।
সাঁঝের হঠাৎ মনে হল সে অতিরিক্ত ভাবছে৷ সামান্য একটি ছবিকে অতিরঞ্জিত করছে। হতে পারে ছবিতে মেয়েটির উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। ভুল করে ছবির ফ্রেমে চলে এসেছে।
সাঁঝ অতিরিক্ত ভাবনাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে রুম ত্যাগ করল।
একবারও ভাবল না, সানান ভাই হয়তো ইচ্ছে করেই রহস্যময়ীকে ঠাঁই দিয়েছে নিজের জীবনে।
*
তাশফীনের ডিউটি ছিল রাতে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল ভোরের দিকে। রিক্সায় উঠে কল দিল স্বর্ণলতার নাম্বারে। কাল রাতে সাঁঝের সাথে কথা হয়নি। বিকালে বলেছিল, ও বাড়ির সবাই শপিংয়ে যাবে। ওকে সাথে নিচ্ছে না বলে মেয়েটার বেশ মন খারাপ ছিল। তাশফীন বলেছে, ওরা বাড়ি ফিরলে আবার শপিংয়ে নিয়ে যাবে ওকে। তবুও যেন মন খারাপ না করে।
স্বর্ণলতা আলু কাটছিলেন, তখনি বেজে উঠল মোবাইলটি। নোংরা হাতে মোবাইলটি ধরলেন না। সাঁঝকে বললেন,
– তাশফীন কল দিয়েছে। কি বলে দেখতো।
সাঁঝ ছুটে এসে মোবাইলটি নিয়ে জনসমাগম থেকে দূরে সরে ছাদের দিকে গেল। কালকে মার্কেটে কত কিছু হয়ে গেছে! সেসব গল্প শোনাতে হবে তাশফীন ভাইয়াকে।
স্বর্ণলতা আপনমনে কাজ করে গেলেও ব্যাপারটি সবার চোখে ভালো ঠেকল না৷ সানা বিচক্ষণ ব্যক্তি৷ মরিচের বোটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,
– তাশফীন তোমার বোনের ছেলেটা না স্বর্ণ?
– জ্বি আপা।
– আজকাল কি করছে?
– ডাক্তারি পাশ করেছে। চাকরিতে ঢুকল গতমাসে।
– বিয়েশাদি কিছু করেছে?
– এখনো করেনি। বিসিএস পরীক্ষাটা শেষ করে তারপর বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ওর মায়ের।
– তাশফীন যথেষ্ট সোমত্ত ছেলে। তোমার মেয়ের বয়সটাও ভালো না। এসময় বাচ্চাদের একটু দেখেশুনে রাখতে হয়৷ পা ফসকাতে সময় লাগে না। এভাবে যখন-তখন মোবাইল হাতে ধরায় দিবা না।
কথাগুলো বুঝতে একটু সময় লাগল স্বর্ণলতার৷ অস্বস্তি চেপে স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলেন,
– মোবাইল আমার কাছেই থাকে৷ ওকে ধরতে দেই না। আমার হাত বন্ধ দেখে..
– এখনকার কথা বলছি না। আসছি থেকে দেখতেছি সাঁঝকে। তোমার এই বোনের ছেলেটার প্রতি ওর একটু বেশি আগ্রহ। সম্পর্কে ভাইবোন হয়, কথাবার্তা বলতে সমস্যা নাই। সেটা তোমার সামনে বলুক। বাড়ি আসুক, সামনাসামনি কথা হোক। এভাবে আড়ালে আবডালে কেনো?
মেয়ের বয়স হয়েছে। এখন মেয়েকে সম্পর্কের সীমারেখা বুঝিয়ে দেওয়াটা তোমার দায়িত্ব। আমার কথায় কিছু মনে করো না৷ চোখে দৃষ্টিকটু লাগল বলে বললাম।
– নাহ আপা। আপনি ঠিকই বলছেন। আমারই ভুল। আমি খেয়াল করি নাই ব্যাপারটা৷
এই সুযোগে ফোঁড়ন কাটলেন সাবা। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন,
– তুমি নাকি সাঁঝের বিয়ের তোড়জোড় করতেছ? স্বভাব চরিত্র এমন থাকলে মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারবা? যা উড়নচণ্ডী তোমার মেয়ে! ওর চলাফেরা দেখছ, আপা? চুড়ি, দুল, টিপ, লিপস্টিক পরে সারাক্ষণ ঢলাঢলি করে বেড়ায়।
পারিবারিক সভা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন আফসানা। এদের কাউকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। একেকটা স্বার্থপর, সুযোগ-সন্ধানী। নিজের বেলা ষোলো আনা বুঝে নিবে, কিন্তু অন্যের বেলা লোভী তকমা দিতে ভুলবে না।
কাঁচা হলুদ ধুয়ে ডালাতে তুলা শেষ। ওগুলো আরফিনের ফুপুর হাতে দিয়ে আফসানা বললেন,
– ইশানা পরিপাটি হয়ে বেড়াচ্ছে না বলে ওকে বকছিলে সকালে৷ এখন আবার সাঁঝ পরিপাটি হয়ে ঘুরে বলে সেটা নিয়েও অভিযোগ করছ৷ তুমি আসলে কি চাও সেটা আগে স্থির করো, সানা। আমি ঘরে চললাম৷ কোমরের ব্যথাটা বাড়তেছে মনে হয়।
কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে আফসানা চলে গেলেন। এদিকে সানা রেগেমেগে কটমট করে তাকালেন আফসানার গমনপথে।
থমথমে পরিস্থিতি স্মিত করতে আরফিনের মা বললেন,
– মেয়ের বিয়ের জন্য কেমন ছেলে খুঁজছেন?
– ছেলের ব্যবসা বা চাকরি যে-কোনো একটা হলেই হলো। শুধু পরিবার ভালো হতে হবে৷ সাঁঝের মধ্যে এখনো একটু ছেলেমানুষি রয়ে গেছে৷ এজন্য চিন্তা হয় আরকি৷
– কত বা বয়স হলো! এখনি কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে চেয়ারে বসে সংসার সামলাতে বলছেন? বিয়ের পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। সংসার করা কেউ বাবার বাড়ি থেকে শিখে আসে না৷ আমি নিজে বিয়ের পরে দেবর-ননদের সাথে কতো বৌচি খেলেছি, জানেন? এই যে এত বড় বাড়ি, এটাতে লুকোচুরি খেলতে খেলতে সংসার করা শিখেছি। সাঁঝও শিখে যাবে। এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নাই৷
– আপনার কপাল ভালো জন্য আরফিনের বাবার মতো স্বামী পেয়েছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বুঝদার হলে সংসার করে শান্তি পাওয়া যায়। সাঁঝের কপালে যে কেমন জুটে, সেটা নিয়েই ভয়৷
– এত ভয় তবে পরিচিতের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। তাশফীন না কি যেনো নাম বললেন, ওর সাথে কিছু ভাবছেন না কেনো? আপনারই তো বোনের ছেলে।
এমন প্রস্তাবে উপস্থিত সকলে ঝট করে তাকালেন আরফিনের মায়ের দিকে। যেন বিশেষ কোনো ঝড়োবার্তা শুনল এই মাত্র। সানা তো অবাক হয়ে বলেই বসলেন,
– পাগল হয়েছ তুমি! তাশফীনদের অবস্থা জানো? ওর বাপ-দাদা জমিদারের থেকে কম কিছু না৷ ওই বংশের ছেলে আসবে সাঁঝকে নিতে! তাশফীনদের সাথে এদের কোনোভাবেই যায় না।
– খুব বড়লোক বুঝি?
– তা আর বলতে! তাশফীনের বাবা আর্মির বড় অফিসার৷ দাদা একসময় ডিসি ছিলেন৷ কত বড় বড় লোকের সাথে উঠাবসা ওদের! এমন পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করলে স্বর্ণলতা ওদের বসতে দিবে কোথায়? ওই ভাঙা বাড়িতে?
স্বর্ণলতার যে এত নামি-দামি পরিবারের সাথে উঠাবসা সেসব জানা ছিল না আরফিনের মায়ের। এরা সবাই সবসময় স্বর্ণলতাকে হেয় করে কথা বলে। আরফিনের মা ভেবেছিল, গরীব ঘর থেকে বউ এনেছে বলেই হয়তো সবাই এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। অথচ নিজের ভাইয়ের ভাঙা বাড়িতে এনে রেখেছে বামনের মেয়েকে। এখন নিজ বাড়ির দূর্দশা ভুলে প্রতিনিয়ত অপমান করে যাচ্ছে সেই বামনের মেয়েকে। কী অদ্ভুত লোক এরা!
স্বর্ণলতার এসবে অভ্যাস আছে। সাদিক চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে আশেপাশের মানুষগুলো কম কথা শুনায়নি। প্রতিনিয়ত অপমান, অভিযোগে সাদিক নিজেকে বন্দি করে নিয়েছেন নিজের গণ্ডির ভেতর৷ কারো সাথে কথা বলেন না, সখ্যতা গড়তে যান না। লাইব্রেরি ও টিউশনকে নিজের ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়ে সুখে আছেন নিজের পৃথিবীতে। কিন্তু স্বর্ণলতা নারী। সামাজিকতা রক্ষার মতো অভিশাপ নারীর কাঁধে সঁপে দেওয়া হয়েছে। তাই তাঁকে সবার সাথে মিলেমিশে চলতে হয়। চাইলেও আড়াল করতে পারেননা নিজেকে৷
– সাঁঝের সাথে তাশফীনের বিয়ে আলোচনা অনর্থক। এখনি মন্ত্রী-মিনিস্টারের ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে তাশফীনের জন্য। আমাদের সাথে ওদের আকাশ-জমিন পার্থক্য। আমি নিজের বোন বলে আমাদের ফেলতে পারে না ওর মা। তা না হলে ওদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতাটুকুও আমাদের নাই৷ বাদ দেন এসব কথা।
– আপনার ভাইয়ের ঘরে কোনো ছেলে নাই?
– আছে। ওরা সবাই ছোট।
– ওহ। নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা করলে মেয়েকে দেখে রাখতে পারতেন আরকি৷ নেই যেহেতু, বাইরেই দেখতে হবে। আমি আরফিনের বাবাকে বলব। ওর অনেক পরিচিত লোকজন আছে৷ একটা ভালো ছেলের খোঁজ অবশ্যই পাওয়া যাবে।
*
পূর্ব আকাশে লাল আভা ছড়িয়েছে। ধীরে ধীরে নানান রঙের ছাউনি মেলল মেঘ। একটু একটু করে উঁকি দিতে থাকল সূর্য৷ খোলা জানালা দিয়ে সেই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখছে সানান ভাই৷ সায়রা দু হাতে চোখ কচলে পিটপিট করে তাকাল৷ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস আছে ওর। এদিকে সানান ভাইয়ের রাত জাগার অভ্যাস৷ সারারাত চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকার মতো বিরক্তির কাজ আর একটাও নাই। রাত যেন অতিবাহিত হতেই চায় না।
সায়রার এলোমেলো চুলগুলো কপালের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে সানান ভাই বলল,
– ওই দেখো, সূর্য উঠছে৷
সায়রা শোয়া থেকে উঠে বসল সানান ভাইয়ের বুকের উপর। চোখ বড় বড় করে দেখল তারই মতো মিষ্টি একটা আলোর খন্ড স্থান করে নিয়েছে জানালার ওপাশে৷
রিক্সা থেকে নেমে দরজা দিয়ে ভবনের ভেতরে প্রবেশের আগে তাশফীনের নজর কাড়ল আজকের সূর্যটি। বহুদিন ঘটা করে ভোর দেখা হয়নি। আজকে কেনো যেন সূর্যটা বড্ড টানছে। পায়ে পায়ে সরে এলো তাশফীন। বাড়ির পাশে পতিত জমিটার সামনে এসে দাঁড়াল। চারপাশে ঘেরা দেওয়া শ্যাওলা পড়া দেয়ালটা কোমর সমান উঁচু। তাশফীন একলাফে দেয়ালের উপর উঠে বসল।
রূপবতী পূর্বাকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আজকের সূর্যটাকে দেখেছিস?
সাঁঝ তখন ছাদে৷ কার্নিশে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু একটু করে জন্ম নিতে দেখছিল একটি গোলকধাঁধাকে। যা পুরো জগতের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে৷
– হ্যাঁ। এত সুন্দর লাগছে দেখতে৷ ক্যামেরা থাকলে দারুণ ছবি তোলা যেত৷
কান থেকে মোবালটি সরালো তাশফীন। ক্লিক, ক্লিক করে কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে বলল,
– তোর জন্য ছবি তুলে রাখলাম। ফিরে এসে নিস৷
– ওওওওও। তুমি এতো ভালো কেনো ভাইয়া?
মোবাইলের ওপাশে তাশফীন লাজুক হাসল। বলল,
– তারপর কি হলো? তাড়াতাড়ি গল্প শেষ কর৷ ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো৷
– ওহ হ্যাঁ। ওরা তো আর ড্রেসটা ফেরত নিল না। এজন্য বাধ্য হয়ে আমি নিয়ে আসলাম। গাড়িতে উঠে ভয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি৷ কে না কে দিয়েছে, আমি কাকে জিজ্ঞাসা করব? যাকে বলল, সে যদি গিফটদাতা না হয় তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই খবর পুরো বাড়ি ছড়িয়ে দিবে৷ মায়ের কানে গেলে মা আমাকে আস্ত পুঁতে ফেলবে। বলবে, জানোয়ারের বাচ্চা। কার জামা তুলে আনছিস? যা এক্ষুণি ফেরত দিয়ে যায়৷
– খালামনির রাগ করাটা স্বাভাবিক। এভাবে কারো জিনিস নেওয়াটা ঠিক নয়।
– ওরা যে বলল, আমার নামে বিল করা হয়েছে৷ তাহলে ড্রেসটা আমার-ই হলো। তাই না?
– হুম। তাও ঠিক৷
– এখন বলো, আমি কি করব? বিয়েতে পরব?
– তোর পরতে ইচ্ছে করছে?
– খুব। আমার দামী ড্রেস নেই বলে ওরা খুব মজা নেয়। কালকে বিয়েতে সবাই ভালো ড্রেস পরবে। আমি এই ড্রেসটা পরলে আর ক্ষেপাতে পারবে না।
– তাহলে পরে ফেল৷
– ওরা যদি জানতে চায়, এটা কই পেয়েছি?
– বলবি, তুই কিনেছিস।
– মা যদি বলে কবে কিনেছি?
– খালামণি এত কিছু খেয়াল করবে না। বিয়ে বাডিতে এমনিতেই ব্যস্ত থাকবে।
কিন্তু সাঁঝের মন্দ ভাগ্য৷ সবার আগে সে তার মায়ের নজরেই পড়ে গেল।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২০
লাল, নীল, সবুজ রঙের বাতি জ্বলছে চারপাশে। তবলার মতোন একটা বাদ্য নিয়ে দূরে একপাশে বসে গীত গাইছে কয়েকজন নারী। তাদের ঘিরে সুরে তালে কোমর দুলিয়ে নাচছে তরুণী থেকে বৃদ্ধ। গীতের কথাগুলো বড্ড অশ্লীল, নোংরা। সবাইকে নাচতে দেখে সায়রাও দৌড়ে গিয়ে ঢুকেছিল চক্রব্যুহে। সানান ভাই দেখামাত্র ছুটে এসে সেখান থেকে সায়রাকে উদ্ধার করে নিয়ে পালিয়েছে। আপাতত তাদের কাউকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।
সাঁঝ বসেছে একটা পাটি বিছিয়ে। তাকে ঘিরে বসেছে বাড়ির মেয়েরা। চলছে মেহেদী উৎসব। অন্যদের জন্য ব্যাপারটা আনন্দের হলেও, সাঁঝের জন্য মোটেও আনন্দের নয়। এমন নয় যে মেহেদী পরাতে সাঁঝের ভালো লাগে না। এই কাজটা সে এতোদিন অতি আনন্দের নিয়ে করেছে। কিন্তু আজ একেকপর এক হাতে মেহেদী পরাতে গিয়ে প্রাণ যায় যায় দশা। কোমরে ব্যথা ধরে গেছে। হাতের আঙ্গুলগুলো প্রায় বাঁকা হয়ে গেল। এ নিয়ে অভিযোগ কিংবা বারণ করার সাধ্যি নেই সাঁঝের। এখনও অনেকে অপেক্ষারত।
সবার যখন মেহেদী পরা শেষ হলো তখন রাত প্রায় একটা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সাঁঝ খেয়াল করলো ওর পা দুটো প্রায় অবশ। অতি কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল নিজের হাতের দিকে। অভিমান হলো সবার প্রতি। ঠিক করল সে মেহেদী পরবে না। সবাই হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে আনন্দ করুক। সাঁঝ ফাঁকা হাতে বিয়ে উপভোগ করবে।
অভিমানী মন চায় নিরিবিলি স্থান। বিয়েবাড়িতে তা কোথায় পাবে? চারপাশে চেনা-অচেনা মুখগুলো গিজগিজ করছে। সুনেরাহ-র রুমের দিকে গিয়ে দেখল সেখানে হাত পা ছড়িয়ে কয়েকজন শুয়ে পড়েছে।
বাধ্য হয়ে এই মধ্যরাতে সাঁঝ গুটিগুটি পায়ে চলে গেল ছাদে। এসময় ছাদে কেউ থাকে না। কমবেশি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। যারা জেগে আছে তারা নানান কাজে ব্যস্ত। ছাদে আবছা অন্ধকার। কার্নিশ বেয়ে যে টিমটিম বাতিগুলো নিচে নেমে গেছে তাদের নরম আলো যেন অন্ধকার আরও গাঢ় করেছে।
ছাদে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা ছিল। একটায় আরাম করে বসে অন্যটার উপর পা ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের পাণে চেয়ে চোখ বন্ধ করল সাঁঝ। নিচ থেকে গানের আওয়াজ আসছে,
“কখনো ভোর কখনো মাঝরাতে
হাইওয়ে থেকে এক চিল ছাদে
প্রতি পাতা থেকে চেনা মলাটে
আমি শুধু শুধু খুঁজেছি তোমায়
রাত জাগা কত কত যে সকাল
ভেবে চলে সে কি স্বর্গ কি পাতাল?
অভাবে নাকি স্বভাবে মাতাল
আমি যে বড় খুঁজেছি আমায়।”
বিয়ে বাড়িতে সচরাচর এমন নরম সুরের গান বাজে না। আজ সারাদিন ভোজপুরি গান বাজানো হয়েছে। এখন রাত বলে এমন গানের বন্দোবস্ত। যেন আরামে সবার ঘুম চলে আসে। গানের তালে গুনগুন করতে করতে সাঁঝের চোখে ঘুম চলে এসেছে। তখনি সিগারেটের গন্ধটা নাকে ধাক্কা লাগল।
চট করে চোখ খুলে আশেপাশে তাকাল। ছাদের উত্তর-পশ্চিমের কোণে একটা আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। সাঁঝ ভূতগ্রস্থের মতো শিখার দিকে এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো মানব ছায়া।
কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্র সে আচানক ঘুরে দাঁড়ালে সাঁঝ একটা চিৎকার দিয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। এমন কিছু দেখার স্বভাবনা ছিল। তবুও ভয় পেয়ে মানব সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে বেরিয়ে এসেছে আর্তচিৎকার।
নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে সাঁঝ বলল,
– তুমি সিগারেট খাও!
ছেলেটি ইশান। সবে আটারোতে পা দিয়ে কিশোর থেকে যুবকে পরিণত হয়েছে। তার ধারণা মতে, যুবক বয়সে সিগারেট খাওয়া যায়। যদিও সতের বছর বয়সে কৌতূহলবশত বন্ধুদের সাথে বেশ কয়েকবার সিগারেট খাওয়া হয়ে গেছে। এখন নিয়মিত খাওয়া শুরু হচ্ছে।
– দেখতেই পাচ্ছিস, তোর সামনে খাচ্ছি। আবার প্রশ্ন করছিস কেনো?
– ফুপি জানে?
– এটা তোর ফুপিকে বলে খাওয়ার মতো কথা?
– ধরা পড়ার ভয় নেই তোমার?
– কীভাবে ধরা পড়ব? তুই বলে দিবি?
সাঁঝ দুপাশে মাথা দুলিয়ে না জানাল। ইশান তার সামনেই সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে সাঁঝের মুখের সামনে ধোঁয়া ছাড়ল। সাঁঝ কাশতে কাশতে ফিরে এলো নিজের জায়গায়। ইশানও এসে একটা চেয়ার টেনে ওর সামনে বসল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে একের পর এক সিগারেটে টান দিতে লাগল। অস্বস্তি জেঁকে বসল সাঁঝের মনে। আশেপাশে দৃষ্টি ফিরিয়ে একসময় সিদ্ধান্ত নিল এখান থেকে চলে যাবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই ইশান বলল,
– কোথায় যাচ্ছিস?
– নিচে।
– চুপচাপ বসে থাক।
– আমার ঘুম পাচ্ছে।
– সিগারেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবি।
– কেনো?
– এমনি।
সাঁঝ আবার বসে পড়ল। মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইল কোলের দিকে। সিঁড়ি ঘরের দিক থেকে পায়ের শব্দ আসছে। ধক করে উঠল সাঁঝের বুক। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কে যেন আসছে!
ইশান নির্বিকার চিত্তে জবাব দিল,
– যা গিয়ে দেখ কে আসছে।
সেদিন তাশফীনের সাথে কথা বলার পর মায়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, সাঁঝ যেন এ বাড়ির ছাদে না উঠে। একলা কোথাও না যায়। সবসময় মায়ের আশেপাশে থাকে। এখন মা যদি জানতে পারে, মধ্যরাতে সাঁঝ ছাদে উঠেছে। তার সাথে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে, তবে পি/টিয়ে পিঠের ছাল তুলে নিবে। ইশান ভয় না পেলেও, সাঁঝের গলা শুকিয়ে এলো।
দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে গিয়ে অন্ধকারে তেমন কিছু দেখতে পেল না। তবুও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল। সিঁড়ি বেয়ে দীর্ঘদেহী মানুষটি দ্রুত উঠে এলো ছাদে। আবছা অন্ধকারে তাকে চিনতে পেয়ে সাঁঝ দ্রুত দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
সানান ভাই সরু চোখে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
– তুই এখানে কি করছিস?
এমন গলার স্বরে সাঁঝের কেঁপে উঠার কথা। কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে সানান ভাই নিশ্চিতভাবে রেগে আছে। কিন্তু সাঁঝ ইতিমধ্যে কাঁপছে, নতুন করে আর কি কেঁপে উঠবে? কোনো রকমে জবাব দিল,
– হাওয়া খেতে এসেছি।
– এই মধ্যরাতে?
সানান ভাই সন্দিহান দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল। ছাদের কোথাও কাউকে দেখা গেল না। ইশান বোধহয় নিচে নেমে গেছে। বাড়িটি আয়তাকার হওয়ায় চারপাশে চারটি সিঁড়ি আছে। সুযোগ বুঝে সাঁঝকে বিপদের মুখে ফেলে, নিজে কোনো একটা সিঁড়ি দিয়ে কেটে পড়েছে।
বাড়িতে অচেনা মানুষজনের আনাগোনা বেড়েছে। আরফিনের বন্ধুরা এসেছে আজ সন্ধ্যায়। এত বড় বাড়িতে কে কোথায় ঘুরছে নজর রাখা যাচ্ছে না। এমন সময় এই মেয়ে একলা ছাদে ঘুরছে।
সানান ভাই ধীর পায়ে আগাচ্ছে বুঝতে পেরে সাঁঝ আরও ছাদ ঘেঁষে দাঁড়াল। পেছনে দেয়াল থাকায় খুব একটা সুবিধা পেল না। দীর্ঘদেহী মানুষটা এত কাছে আগে কখনো এসে দাঁড়ায়নি। সাঁঝ খেয়াল করল উচ্চতায় সে সানান ভাইয়ের বুক বরাবর। সরাসরি তাকানো যাচ্ছে না। সানান ভাই মাথা নিচু করে সাঁঝের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এখানে তোকে তুলে একটা আছাড় মারলেও নিচে কেউ টের পাবে না জানিস?
এমন অবাক করা কথা সাঁঝ আগেও শুনেছে। মুখে মুখে এমন অনেক আছাড়, চড় প্রায়শই দিয়ে আসছে সানান ভাই। সবই তার ফাঁকা বুলি। তবুও এসব কথা শুনে সাঁঝ ভয় পায়। সানান ভাইয়ের ঠিক নেই। চেহারাটা এমন যে দেখলেই মনে হয়, এই বুঝি হাত উঠিয়ে মারল এক চড়। স্বভাবটাও তো ধরপাকড় মতোন।
আজ ফ্যাকাশে আঁধারে সাঁঝ একটু বেশী ভয় পেল। ছাদে এখনো সিগারেটের গন্ধ ঘুরছে। সানান ভাই রেগে আছে বলে হয়তো খেয়াল করেনি। সাঁঝ মনে মনে প্রার্থনা করল, খোদা এ যাত্রায় বাঁচিয়ে নেও। কিছুটা সাহস সঞ্চার করে এক নিঃশ্বাসে হড়বড়িয়ে বলল,
– আমি নিচে যাই। মা বোধহয় খুঁজছে।
তড়িঘড়ি করে পালাতে চাইল। কিন্তু সামনে এখনো সানান ভাই দাঁড়িয়ে আছে। একচুলও নড়ল না। দেয়ালের সাথে ঘেঁষে সমান্তরাল বরাবর দু পা এগিয়ে সাঁঝ ছুটল সিঁড়ির দিকে। লম্বা বেণুনি ধরে এক ঝটকায় ওকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনল সানান ভাই।
হতভম্ব সাঁঝ ঘটনার আকস্মিকতায় চুলে টান পাওয়ার ব্যথাও ভুলে গেল। এমন অসভ্যতা সানান ভাই আগে কখনো করেনি। সে অবাক হয়ে তাকাল সানান ভাইয়ের দিকে। রাগান্বিত মুখশ্রী থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। পলকহীন চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা গেল না। সাঁঝ চোখ নামিয়ে নিল।
– আমি যেতে বলেছি তোকে?
সাঁঝ দুপাশে মাথা দুলিয়ে না জানালো। সানান ভাইয়ের হাতে তখনো সাঁঝের বেণুনি। হাতের তালুতে প্যাঁচাচ্ছে আবার প্যাঁচ ছাড়ছে।
– সেদিন মোড়ে ছেলেগুলো তোকে কি বলেছে?
সাঁঝ সরু চোখে তাকাল। কোন ছেলে, কোন মোড়? কিছুক্ষণ সময় লাগল বুঝতে। তারপর যখন মনে পড়ল তখন আরেকবার তিক্ত হয়ে এলো মুখ। বলল,
– কিছু বলেনি।
সানান ভাই শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকেই এক পা পিছিয়ে গেল। বুক ভরে শ্বাস নিল সাঁঝ। ওর মুখের দিকে সূক্ষ্ণ নজর রেখে সানান ভাই বলল,
– পুরান ঢাকায় একটা নতুন পাখি ঢুকলেও আমার কাছে খবর চলে আসে। আর তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলার সাহস দেখাচ্ছিস, সাঁঝবাতি?
সাঁঝ নিজের কথায় অটল রইল। সেদিনের ঘটনা মনে পড়ায় লজ্জায়, অস্বস্তিতে নিচু হয়েছে মাথা। পায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
– আমাকে কিছু বলেনি। বাজেভাবে গান গেয়েছে আর শিস বাজিয়েছে।
কথা গিয়ে বলতে গিয়ে গলা বুঝে আসছিল সাঁঝের। অন্যায় করে ছেলেরা আর লজ্জায় মাথা নিচু হয় মেয়েদের। অস্বস্তিতে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে।
সানান ভাই অনেকক্ষণ কিছু বলল না। শুধু নীরবে দেখে গেল। সাঁঝ বুঝতে পারছে না, এই ঘটনায় তার দোষ কতটুকু। দোষ না করলে সানান ভাই নিশ্চয়ই তাকে এতো রাগ দেখাতো না। সে মাথা নিচু করেই বলল,
– স্যরি। আর একলা বের হবো না।
সানান ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে একসময় জলদগম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দিল,
– নিচে যা। আমার রুমে সায়রা ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে নিজেকে একলা দেখলে ও ভয় পাবে।
কালবিলম্ব করল না সাঁঝ। ছাড়া পেয়ে একছুটে চলে গেল সানান ভাইয়ের ঘরে। সায়রার পাশে গুটিসুটি হয়ে শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে গেল।
*
সানান ভাই অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে আজমের সাথে বিস্তর রাগারাগি হয়েছে। আজম বলছে, ব্যাপারটা সে সামলে নিয়েছে। ওই দলের ছেলেদের আর পাড়ায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যদিও ওরা কয়েকবার চেষ্টা করেছে, গায়ের জোর দেখিয়েছে। তবুও ক্লাবের ছেলেরা অনুমতি দেয়নি।
সানান ভাই আজমের উপর ক্ষেপে আছে অন্য কারণে। এত বড় একটা ঘটনা তাকে আজকে জানানো হলো কেনো?
আজম যতটা হেয়ালি করছে, ব্যাপার আসলে এত ছোট নয়। জল অনেকদূর গড়িয়েছে।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। হোক সেটা উপ-নির্বাচন। তবুও প্রতিটি দলের কাছে এটি সুবর্ণ সুযোগ।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিল দেওয়ান রহমান। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মা/রা যাওয়ার কারণে অসময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উপ-নির্বাচন। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচন লড়ছে দেওয়ান রহমানের ছেলে আব্দুর রহমান।
সেদিনের ছেলেগুলো আব্দুর রহমানের দলের। একটা পাড়াতে প্রচারণা না করা আব্দুর রহমানের পক্ষে অনেক ক্ষতিকর। সেই সাথে নিজের ইমেজ রক্ষার একটা ব্যাপার আছে। পার্টির ছেলেদের এমন অপমানে পার্টির লিডার নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।
তাঁতিবাজারে জাতীয় পার্টি প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রাজনীতি পাড়ায় ইতিমধ্যে দা/বানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সানান ভাই এসবের কিছু জানত না। রাজনীতি বিষয়ে তার আগ্রহ নিতান্তই। পুরোদস্তুর রাজনীতিবীদ আজম। ওকে সাহায্যের জন্য সানান ভাইকেও এসবের সাথে জড়াতে হয়েছে। তবুও সেটা আড়াল থেকে। কাগজ কলমে কোথাও সানান ভাইয়ের উল্লেখ নেই।
অদ্ভুদভাবে আজ সন্ধ্যায় সানান ভাইয়ের মোবাইলে কল এসেছে শাফিন আহমেদ নামক একজন রাজনীতিবীদের। যিনি উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে লড়ছেন। শাফিন আহমেদ সানান ভাই ও আজমের সাথে দেখা করার বাসনা প্রকাশ করেছেন।
হঠাৎ এমন প্রস্তাবে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে সানান ভাই। আজমকে বিষয়টি জানাতেই সে নিজেও উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করল।
– আব্দুর রহমানের ছেলেদের সাথে আমাদের ঝামেলা চলছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছে শাফিন আহমেদ। এজন্য তোকে ডেকেছে।
এদিকে ঝামেলা বিষয়ক কোনো তথ্য নেই সানান ভাইয়ের কাছে। আজম যখন বিস্তারিত জানাল, সানান ভাইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
এমনিতেই রাজনীতি বিষয়টা সানান ভাইয়ের আগ্রহের বাইরে। রাজনীতিবিদরা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। এরা সবাই স্বার্থপর। নিজের প্রয়োজনে যে কাউকে ব/লি দিতে কখনো দ্বিধা করে না। আজ নিজের লাভের জন্য সানান ভাইকে ডেকে দুটো ভালো কথা বলবে। কালকে প্রয়োজন ফুরালে লাথি মা/রার আগে দু’বার ভাববে না।
এ জগতে সবাই স্বার্থপর। মানুষের স্বার্থপরতার সাথে ডিল করার অভ্যাস আছে সানান ভাইয়ের। সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। কিন্তু এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পড়ে গেছে সাঁঝ। যা সানান ভাইয়ের পছন্দ হচ্ছে না।
চলবে…
#অক্ষরময়ী