#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২৩
সানান ভাই বসে আছে একটা বিশাল ড্রয়িংরুমে। এটা শাফিন আহমেদ এর বাড়ি৷ মাথার উপর ঝুলছে একটা দানবীয় ঝাড়বাতি। দেয়াল জুড়ে পেইন্টিং। অদ্ভুত সব ছবি আঁকা। যার অর্ধেকগুলোর অর্থোদ্ধার করতে অপরাগ আজম৷ সে বিরস মুখে বসে উশখুশ করছে৷ ওরা যে সোফাটায় বসে আছে সেটাও বোধহয় খুব দামী৷ শিমুল তুলার মতো নরম। বসা মাত্র আধ হাত তলিয়ে গেছে৷
আভিজাত্যপূর্ণ এই পরিবেশে আজমের অস্থিরতা বাড়ছে তরতর করে৷ সে বসে আছে রোবটের মতোন। কোনো নড়চড় করছে না৷ মনে হচ্ছে একটু এদিকওদিক হলেই তার দ্বারা নোংরা হয়ে যাবে ঘরটা।
সানান ভাই অবশ্য এসবের তোয়াক্কা করেনি৷ পায়ের উপর পা তুলে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছে।
শাফিন আহমেদ এলেন আরও কিছুক্ষণ পর৷ সৌজন্যতা বশত সানান ভাই ও আজম উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো। শাফিন আহমেদের বয়স চল্লিশ৷ বেশ লম্বা এবং দীর্ঘদেহের অধিকারী৷ গলার স্বর মোটা এবং গম্ভীর৷ চালচলনে নেতা বিশিষ্ট একটা ভাব আছে। দেখেই মনে হয় তিনি একজন প্রতাপশালী ব্যক্তি।
– অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি৷ কিছু মনে করো না। আসলে সামনের নির্বাচন নিয়ে এত ব্যস্ত দিন কাটছে?
– সমস্যা নেই৷ অপেক্ষা করার মানসিকতা নিয়ে এসেছি। আমার অফিসে কেউ আমার সাথে দেখা করতে এলে আমিও এভাবে বসিয়ে রাখি৷ ব্যস্ততার বাহানা দেখাই। এতে নিজের মান বাড়ে৷
সানান ভাইয়ের শান্তভাবে বলা কথাগুলো শুনে বেশ হকচকিয়ে গেলেন শাফিন। ভ্রু কুচকে চেয়ে থেকে একসময় হো হো করে হেসে উঠে বললেন,
– দারুণভাবে কথা বলো তুমি৷ তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কি নাম যেন তোমার?
আজম পড়েছে বিপাকে৷ সানান ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে তাকে উত্তেজিত না হওয়ার ইশারা করে নিজেই উত্তর দিল।
– ও সানান। আমার বন্ধু।
– তুমি কে?
– আমি আজম। জাতীয় পার্টির ছেলেগুলোর সাথে আমার ঝামেলা হয়েছে। সানান এসবের মধ্যে ছিল না। ও তো ঘটনার সময় আশেপাশেও ছিল না। ওই সময় অফিসে কাজে ব্যস্ত ছিল৷ নাইন টু ফাইভের চাকরী করে যে৷
– আমার জানামতে, তোমার বন্ধু ভর দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। মধ্যরাত পর্যন্ত তোমাদের সাথে চায়ের আড্ডা দেয়।
– মাঝেমধ্যে আসে। সবসময় কাজ করলে একঘেয়েমি লাগে, তখন চলে আসে আমাদের কাছে।
এসব আলোচনা বিরক্ত লাগছে সানান ভাইয়ের। সে আজমকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– আমি মধ্যবেলা পর্যন্ত ঘুমাই অথবা সারাদিন ঘুমাই তাতে আপনার দলের কিছু এসে যাবে না। আমাদের সাথে কেন দেখা করতে চেয়েছেন সেটা বলুন। আমরা আপনার মতো ব্যস্ত না হলেও আমাদের ব্যস্ততা খুব একটা কম না।
কাজের লোক চা রেখে গেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শাফিন আহমেদ ঘুরে বসলেন সানান ভাইয়ের দিকে।
– কয়েকটা বছর ধরে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল৷ এলাকার কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি ওদের৷ উন্নয়নের নামে শুধু টাকা লুট করেছে। তোমরা ইয়ং জেনারেশন। খেয়াল করলে ধরতে পারবা, ক্ষমতায় বসে এরা কী পরিমাণ দূর্নীতি করেছে৷
– ওদের দূর্নীতির হিসাব আমাদেরকে পার্সোনালি ডেকে শোনাচ্ছেন কেনো? জনসমাবেশের আয়োজন করে সেখানে ভাষণ দিন। কাজে দিবে।
– তোমাদের বলছি, কারণ পরিবর্তন তোমাদের হাতে। ইয়ং জেনারেশন যতক্ষণ না পর্যন্ত সচেতন হচ্ছে ততক্ষণ পরিবর্তন আসবে না। তোমরা দেশের ভবিষ্যৎ। দেশের শক্তি..
– শুনুন শাফিন সাহেব। আমরা খুব সাধারণ মানুষ। নিজের পরিবার নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছি না৷ দেশ ও দশের কথা ভাবার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই আমাদের নেই। আমাদের দিয়ে আপনার কোনো উপকার হবে না। আমি রাজনীতির কিছু বুঝি না৷ রাজনীতি নিয়ে আমার আগ্রহও নাই। এই যে আজমকে দেখছেন, সেও কোনো রাঘববোয়াল না৷ পাড়ায় ছোট একটা ক্লাব চালায়৷ আমাদের দৌড় এ পর্যন্ত-ই। বুঝতে পেরেছেন?
– যেই ছোট ক্লাবের মেম্বাররা রুলিং পার্টির ছেলেদের পথ আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তারা চাইলে অনেকদূর দৌড়াতে পারে৷
আজম বলল,
– সেরকম কোনো ইচ্ছা আমাদের নাই। জাতীয় পার্টির কয়েকটা ছেলে আমাদের পাড়ার মেয়েকে বিরক্ত করছিল। এজন্য আমরা আমাদের কর্তব্যটুকু পালন করেছি। ব্যাপারটাকে আপনি বাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখবেন না।
– আমি সেটাই তোমাদের বুঝাতে চাইছি৷ যারা ক্ষমতায় না থেকেও তোমাদের পাড়ার মেয়ে ছেলেদের বিরক্ত করে, তারা ক্ষমতায় এলে আরও কতকিছু করতে পারে একবার ভাবো। তোমরা যা করেছো এরপর ওই ছেলেগুলো চুপ করে থাকবে? নির্বাচনে জিতে গেলে তোমাদের এলাকায় তাণ্ডব চালাবে৷ নরক বানিয়ে দিবে সবার জীবন।
– সেটা আমরা দেখে নিব। এলাকায় ঝামেলা করতে এলে আমরা কাউকে ছেড়ে কথা বলব না।
– সমস্যাকে জটিল না করে সহজভাবে সমাধান করো৷ আমি তোমাদের সাহায্য করব।
আজম ভ্রু কুঁচকে সানান ভাইয়ের দিকে তাকালো। সে অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছে৷ এদিকে সন্ধি প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখান করে দিলেও এই লোক পিছু ছাড়ছে না। কনুই দিয়ে সানান ভাইয়ের বাহুতে ধাক্কা দিল আজম। দীর্ঘ মৌনব্রত শেষে সানান ভাই গম্ভীরমুখ তুলে তাকাল।
– কেন সাহায্য করতে চাইছেন? আপনার অভিসন্ধি কি?
– জনগণের সেবা করতে চাই। এলাকার উন্নয়ন করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।
– রাজনীতিবিদদের মতো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলবেন না। এই ধরনের ফাঁকা বুলি আমার একদম অপছন্দ। আমাদের কাছে কি চাইছেন সরাসরি বলুন।
– আমি চাই আসন্ন নির্বাচনে তোমরা আমাকে সাপোর্ট দিবে৷ আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাঁতিবাজার এবং লালবাগ এলাকায় তুমি পরিচিত মুখ৷ যুবকদের সাথে তোমার বেশ সখ্যতা রয়েছে৷ লোকে তোমাকে পছন্দ করে, ভরসা করে৷ তুমি যদি আমার দলকে সাপোর্ট দেও, তাহলে আমি অনায়াসে লালবাগ এলাকায় জিতে যাব। এই এলাকায় আমার ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এটা আব্দুর রহমানের দাদার এলাকা। ওরা এখানকার স্থানীয় লোক। স্বাভাবিকভাবেই বয়োজ্যেষ্ঠদের ভোট ওদের ফেভারে যাবে৷ এজন্য আমি চাইছি ইয়ং জেনারেশনের সাপোর্ট। যা তুমি আমাকে এনে দিতে পারো।
– আমি আপনাকে কেনো সাপোর্ট করবো?
– নিজের এলাকার ভালো চাও না? উন্নতি চাও না?
– অবশ্যই চাই৷ তবে এখানে আমার কোনো ভূমিকা নাই। আপনার মতো নেতারা প্রতিবার ইলেকশনের সময় এমন অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু জিতে যাওয়ার পর সব ভুলে ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করে। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। পরিবর্তনের আশা করা মানে আশাহত হওয়া৷ এসবের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই৷ আমি খুবই ব্যস্ত মানুষ।
– আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি৷ প্রতিটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করব।
– ইলেকশনে জেতার আগে সবাই এই কথা বলে৷ পারলে এখনি কিছু করে দেখান৷
– কি করতে হবে?
ভ্রু উঁচু করে কয়েক সেকেন্ড ভাবল সানান ভাই। আজমের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা হলো দুজনার৷ এরপর দীপ্তকণ্ঠে জানালো নিজেদের শর্ত৷
– আমাদের এলাকার মোড়ে একটা ডাস্টবিন তৈরি করে দেন। ময়লা ফেলতে লোকজনের অনেক সমস্যা হয়।
– ঠিক আছে। নির্বাচনের পর সর্বপ্রথম…
– উহু। নির্বাচনের আগেই। ডাস্টবিনের কাজ সম্পন্ন করতে পারলে পুরো ক্লাব আপনাকে সাপোর্ট দিবে। সেই সাথে আপনার দলের প্রচারণাও করে দিবে।
– নির্বাচনের আগে কীভাবে সম্ভব? ফান্ড পাবো কোথায়?
– নিজের টাকায় করেন। নির্বাচনী প্রচারণার নামে জলের মতো টাকা ব্যয় না করে কিছু বাস্তব ভিত্তিক কাজে টাকা ব্যয় করুন। আমাদের দাবী আমরা জানিয়েছি, এখন আপনার বিবেচনা। ডাস্টবিনের কাজ কবে শুরু করবেন ভেবে দেখেন।
শাফিন আহমেদের উত্তরের অপেক্ষা না করে আজমকে সাথে নিয়ে সানান ভাই প্রস্থান করল। কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো বসে থাকার পর শাফিন আহমেদের চেহারায় হাসি ফুটল। তিনি খোশালু আওয়াজে ডাক দিলেন,
– শফিক?
শাফিন আহমেদের পিএ শফিক। কালো, খাটো, মোটা ধরনের একটি মানুষ। বয়স শাফিন আহমেদের তুলনায় তিন চার বছর কম হবে। তবে কাজ করে অতিদ্রুত। শাফিন আহমেদ বললেন,
– ছেলেটাকে কেমন দেখলে?
– খুবই বেয়াদব ছেলে, স্যার। মুখের উপর চ্যাটাং চ্যাটাং করে জবাব দেয়। বাপ মায়ের অতি আদরে বখে যাওয়া সন্তানেরা এমন হয়। আপনি বললে, থানার ওসির সাথে কথা বলে ওর একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।
– ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওর মধ্যে কোনো রাখঢাক নেই। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলে না। ভক্তি, শ্রদ্ধার অভিনয়ও দেখায় না। যা মনে আসে সেটাই বলে দেয়।
– জ্বী স্যার। স্পষ্টবাদী ছেলে। খুবই ভালো গুন।
– তাঁতীবাজার এলাকায় যাও। সানানের বাড়ির আশেপাশে ভালো একটা জায়গা দেখে ডাস্টবিন তৈরি করো। খেয়াল রাখবে ডাস্টবিন যেন বাড়ি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকে। যাতে বাড়ির আশেপাশে ময়লার দূর্গন্ধ না যায়। কালকে থেকেই কাজ শুরু হওয়া চাই। তুমি নিজে যাবে। অন্য কারো উপর আমি ভরসা করতে পারি না।
– জ্বী স্যার। আমি নিজে যাব। দাঁড়িয়ে থেকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করব। স্বচক্ষে কার্যসম্পাদনা করে আপনার কাছে রিপোর্ট জানাব।
*
সাঁঝের মন থেকে ভয়, অস্বস্তি মুছে যেতে বেশ সময় লাগছে৷ সে এখন আগের মতো লাফায় না। উচ্ছ্বসিত হয় না৷ আনন্দ করে না। মনমরা সাঁঝকে দেখতে ভালো লাগছে না তাশফীনের। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে এসে নিয়ম করে সাঁঝের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, লুডু খেলছে৷ সাঁঝের বাবা বাড়ি ফেরার পথে কালো টিপের পাতা, কাজল, নেইলপালিশ, মেহেদী – কিছু একটা হাতে নিয়ে ফিরছেন। কিন্তু মেয়ের মন ভালো হচ্ছে না। স্বর্ণলতাও আজকাল বেশ ছাড় দিয়েছেন মেয়েকে। তেমন একটা শাসনের ছড়ি ঘুরছে না।
আর চারটা ঘর পার করতে পারলেই সাঁঝ জিতে যেত। এই মুহুর্তে সাঁঝের গুটিটা সাপে কাটল। আফসোসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সে। তাশফীন হেসে নিজের গুটি ফেলতে গিয়ে বলল,
– তুই আজকাল ছবি তুলছিস না কেনো?
– ছবি তুলে কি করব বলো! ফেসবুকে আপলোড দিতে পারি না। গ্যালারিতে বসে ওদের কান্না আমার সহ্য হয় না। এজন্য ছবি তোলা বাদ।
– সো স্যাড। তোর ফ্যান-ফলোয়ারদের বোধহয় চোখের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে৷
– তা আর বলতে! মেসেঞ্জার জুড়ে কতশত মেসেজ। কোথায় আমি, কি করছি, আপডেট দিচ্ছি না কেনো? সবাই আতংকিত৷
– কাউকে আতংকে রাখা ঠিক না৷ দিবি মাঝেমধ্যে দু একটা আপডেট।
– তুমি জানো, আমার বিশ হাজার ফলোয়ার ছিল৷ এখন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে৷
– কী বলিস! তুই তো দেখছি রীতিমতো সেলিব্রিটি।
– শুধু এ বাড়িতে কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না। আমার কোনো কদর নাই এখানে৷ বাইরে গিয়ে দেখো, সবাই গোধূলিবেলা বলতে পাগল৷
তাশফীন উচ্চস্বরে হেসে উঠল৷ সাঁঝের গুটি আবারও চলে এসেছে শেষ লাইনে৷ এবার আর সাপে কাটল না৷ একেবারে পাঁচ উঠল। জিততে পেরে সাঁঝ বেশ আনন্দিত। এই হাসিটা কতদিন পর দেখল তাশফীন! বুক জুড়িয়ে গেল একনিমিষেই। উচ্ছ্বসিত, চঞ্চল সাঁঝকে ফিরিয়ে আনতে হলে ওকে ব্যস্ত রাখতে হবে৷ সাঁঝকে ব্যস্ত রাখতে পারে একমাত্র সাঁঝ নিজে। ড্রেসআপ, মেকআপ, জুয়েলারি, ফটোগ্রাফি – এগুলোই সাঁঝের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
– একটা কাজ করলে কেমন হয়, বেলা?
– কি কাজ?
– এস্থেটিক ছবি তোলা শুরু কর। আজকাল বেশ চলছেও এই ছবিগুলা৷
– এস্থেটিক আবার কি?
– এই ধরনের ছবিগুলোতে ফোকাস মানুষের দিকে থাকে না। যেকোনো কিছুকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে ভিজ্যুয়াল স্টাইলে তোলা ছবি হলো এস্থেটিক ফটো।
– পোর্টেট, ল্যান্ডস্কেপ অথবা এস্থেটিক – সে যাই বলো৷ ফেসবুকে আমার ছবি দেওয়া বারণ করে দিয়েছে রাক্ষসটা।
– আমি তোকে বুঝিয়ে বলছি। তোর চেহারা দেখানো নিয়ে যত প্রবলেম, তাই না?
– হুম।
– তোর ফলোয়াররা কিন্তু তোর চেহারার থেকে বেশি তোর ড্রেসিং সেন্স, জুয়েলারি, স্টাইল এসব পছন্দ করে৷ তুই পোর্টেট ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে ফেসলেস বা অ্যানোনিমাস ফটোগ্রাফি করতে পারিস৷ যেখানে মুখ বাদ দিয়ে শুধু হাতের আংটি, গলার হার, কানের দুল, শাড়ির পাড়, হাতের চুড়ি, মেহেদি এসবে ফোকাস থাকবে। ছবির মেইন থিম হবে জুয়েলারি, ড্রেসের ডিটেইলস, মেকআপ আইটেম বা অ্যাক্সেসরিজ।
আজকাল এভাবে অনেকে ছবি তুলে। এস্থেটিক ফটো, ফেসলেস শট, ডিটেইল শট, সিলুয়েট – এমন অনেক ক্যাটাগরি আছে৷
– আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। বেশ কঠিন ব্যাপার।
– কোনো কিছু কঠিন না৷ পিন্টারেস্ট নামে একটা অ্যাপ আছে। ওখানে এমন অনেক ছবি পাবি। আজকে সারাদিন তুই পিন্টারেস্টে ঘুরে ছবিগুলো দেখ। তোর আয়ত্বে চলে আসবে। এরপর ফটোগ্রাফি সেশন শুরু করব।
তাশফীন নিজের মোবাইলটা সাঁঝকে দিয়ে গেছে। কালকে সকালে হাসপাতালে যাওয়ার আগে নিয়ে যাবে। সারারাত ধরে সাঁঝ পিন্টারেস্টে ঘুরে ছবি দেখে অভিভূত হলো। এত সুন্দর, এত চমৎকার সব ছবি! চোখের আরামদায়ক ছবিগুলো দেখতে দেখতে সাঁঝের মাথায় চমৎকার সব আইডিয়া চলে এলো৷ সূর্যের আলোকে কেন্দ্র করে আলো-ছায়ার ছবি তুলবে সে।
ফজরের দিকে ঘুমাতে গেলেও অতি উত্তেজনায় ঘুম এলো না। সকালে এসে তাশফীন মোবাইল নিয়ে গেল। বলল, বিকালে এসে ছবি তুলে দিবে৷
*
সকালবেলা শফিক নামক এক ব্যক্তি এসে সানান ভাইয়ের ঘুম নষ্ট করে দিয়েছে৷ সকাল নয়টায় নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে সানান ভাইয়ের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে। দরজা খুলে দেখল একটা কালো-খাটো সাইজের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে৷
সানান ভাইকে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল,
– স্যার, আপনাকে একবার আমার সাথে নিচে যেতে হবে।
অভদ্রলোকের দাঁতগুলো এতোটাই চকচকে যে সে হাসতেই আলো এসে লাগল সানান ভাইয়ের চোখে। সানান ভাইয়ের ঘুম পুরোপুরি উবে গেল।
লোকটিকে অভদ্র বলা হয়েছে বলে, পাঠক রাগ করবেন না৷ সানান ভাইয়ের কাঁচা ঘুম ভেঙে সে যে অন্যায় করেছে তার বিপরীতে অভদ্র পদক তার প্রাপ্য।
সানান ভাই বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়ে বলল,
– নিচে কেনো যাব?
– ডাস্টবিনের উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন হয়েছে, স্যার।
– তাতে আমার কি?
– আপনি একবার গিয়ে দেখবেন। পছন্দ হলে সম্মতি দিবেন। আমরা পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাব।
অভদ্রলোকের কোনো কথা সানান ভাইয়ের পছন্দ হলো না। সে ধমক দিয়ে বলল,
– আপনাদের সেখানে ইচ্ছে সেখানে ডাস্টবিন তৈরি করুন।
– এভাবে বললে তো হয় না, স্যার। আপনার মতামত ছাড়া কীভাবে কাজ শুরু করব?
– আমার মতামতের কিছু নেই।
– স্যার একবার যদি দেখতেন।
– শুনুন, আমার মতামত হচ্ছে, আপনার যেখানে ঠিক মনে হচ্ছে সেখানেই ডাস্টবিন তৈরি করা হোক৷ আপনার যদি মনে হয় আমাদের বাড়ির সামনে ডাস্টবিন তৈরি করা উচিত৷ তবে সেটাই করুন।
উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়েও সানান ভাই থমকে দাঁড়াল। বলল,
– নাহ। ভুল বললাম। আমার বাড়ির সামনে না৷ গলির শুরুতে আরাম-আয়েশ নামে যে বাড়িটা আছে, ওটার সামনে ডাস্টবিন বসাতে পারেন। ওই বাড়িতে একটা মেয়ে আছে৷ ভর দুপুরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচতে নাচতে মোড়ের দিকে যায়৷ হাতে থাকে দুটো ময়লার পলিথিন। মাথার ঘোমটা উড়ে কোনদিকে যায়, তার হুশ থাকে না৷ হুশ থাকলেও হাত বন্ধ থাকার কারণে সে ঘোমটা তুলতে পারে না। সাপের মতো ঘাড় আঁকাবাঁকা করে ঘোমটা স্থির রাখার চেষ্টা করে৷ আপনি বলুন, ভরদুপুরে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন মোচড়ামুচড়ি করা ঠিক?
– নাহ স্যার। একদম ঠিক না৷
– তবুও সে এই কাজটি করে। বেয়াদম মেয়ে৷
ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সানান ভাই নিজের রুমে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে৷ সোজা মাথায় এসে আঘাত করছে শব্দটা। রুমে ফিরে আসার সময় রুমের দরজাটা বন্ধ করা হয়নি। রাজ্যের শব্দরা ঘরে ঢুকে পড়ছে। সানান ভাই বিরক্ত হয়ে ডাকল,
– আম্মা?
কোনো জবাব এলো না। সায়রার রুমে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছেন বড় মা। তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। ঠকঠক শব্দ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। কানের উপর বালিশ দিয়েও শব্দরোধ করা যাচ্ছে না। অতিষ্ঠ হয়ে সানান ভাই বিছানা ছাড়ল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ৷ পরনে সবুজ রঙের একটা শাড়ি। সানান ভাইয়ের বুক ধক করে উঠল। একটা হার্টবিট বোধ মিস হয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করছে। হৃদপিণ্ড স্বাভাবিক গতিতে ফিরে না আসা পর্যন্ত এই ধড়ফড়ানি চলবে।
সাঁঝের মুখে লেপ্টে আছে চমৎকার হাসি। রাগে সানান ভাইয়ের গা জ্বলছে। ধমক দিয়ে বলল,
– কলাগাছের মতো দাঁড়ায় আছিস কেন? কি হইছে?
– আপনাদের ছাদের চাবিটা দেন। সারাক্ষণ তালা লাগিয়ে রাখেন কেনো? কি এমন গুপ্তধন লুকানো আছে ছাদে?
– ছাদে বাইরের লোক প্রবেশ নিষিদ্ধ। চাবি দেওয়া যাবে না।
– আমাকে না দেন, আপনাদের ভাড়াটে কে তো দিবেন। তাশফীন ভাইয়া ছাদে যাবে।
– ছাদে ওর কি দরকার?
– আমরা ছবি তুলব।
সানান ভাই কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
সাঁঝ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ-না কিছু না বলে এভাবে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল? অসভ্য লোক একটা।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২৪
জরুরি সব মিটিংয়ে সানান ভাই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটায়। তাই অফিসে কোনো জরুরি মিটিং এরেঞ্জ করা হলে জাদিদ ভীষণ ভয়ে থাকে। না জানি আজকে তার উড়নচণ্ডী বন্ধুটি নতুন কোন কান্ড ঘটায়।
একবার ভিয়েতনামের বিখ্যাত ফুড কোম্পানি থেকে দুজন ব্যক্তি এলেন। তারা শীতলার সাথে কোলাবেরেশনে কাজ করতে চায়। শীতলার ফুড কোয়ালিটি চেক করতে বাংলাদেশে এসেছেন। এই নিয়ে অফিসের সবাই ভীষণ এক্সাইটেড। বিদেশী বড় কোম্পানির সাথে জুড়তে যাচ্ছে শীতলা। কম বড় ব্যাপার?
ক্লিনিং স্টাফ থেকে শুরু করে গেটের ওয়াচম্যান – সবাই তটস্থ। এইচআর থেকে একটু পর পর লোক আসছে। সবাই ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, কারো পোশাক কুঁচকে গেছে নাকি, ফ্লোরে ময়লা পড়েছে কিনা – সব চেক করা হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
হাঁটাচলার সময় একটা মেয়ের মাথা থেকে বোধহয় চুল পড়েছিল ফ্লোরে। চুলটা মেয়েরই এ ব্যাপারে এইচআর নিশ্চিত হয়েছে চুলের দৈর্ঘ্য দেখে। এক হাত লম্বা চুল ছেলের হতে পারে না। সুতরাং মেয়েরই মাথার চুল ধরে নেওয়া হলো।
এইচআর থেকে একজন এসে সেই চুল দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অফিসের প্রত্যক নারীর উপর নির্দেশ জারি করা হলো। চুল খোঁপা বাঁধতে হবে। কোনো বাক্যব্যয় না করে তৎক্ষণাৎ সবাই খোঁপা বেঁধে ফেলল। এতটাই সিরিয়াস মোমেন্ট ছিল সেটা।
এমন সময় সানান ভাই গেলেন অফিসে। তাকে দেখে কিবরিয়ার কাশি উঠে গেল। সানান ভাইয়ের পরনে ত্রি-কোয়াটার প্যান্ট, ওভারসাইজ টি শার্ট, কানে লাল একটা হেডফোন। দু হাতে ফোন ধরে স্ক্রলিং করতে করতে জাদিদের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল। কিবরিয়া দৌড়ে গিয়ে পথ আটকালো। ধাক্কা লাগার আগমুহূর্তে সরে গেল সানান ভাই।
– কি অবস্থা কিবরিয়া সাহেব? এত ছোটাছুটি করছেন কেন? খুব তাড়ায় আছেন মনে হচ্ছে।
– জ্বী স্যার। পরিস্থিতিটাই ছোটাছুটি করার মতো।
– কেন? আপনার স্যারের বিয়ে লেগেছে নাকি?
– কী যে বলেন স্যার! স্যারের বিয়ে হবে আর আপনি দাওয়াত পাবেন না, তা কি করে হয়!
– তাহলে ছুটছেন কেনো?
– ভিয়েতনাম নাম থেকে ইম্পর্টেন্ট ক্লায়েন্ট আসছে। তারই শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি চলছে।
– ওহ আচ্ছা।
– স্যার আপনি কি কিছুক্ষণ আছেন নাকি এখনি চলে যাবেন?
– কেন?
– না মানে আফিসে আজকে সবাইকে জরুরি ভিত্তিতে ড্রেস কোড ফলো করতে বলা হয়েছে।
– আপনি বলতে চাইছেন, এই ড্রেস পরার কারণে আমাকে এখন অফিস থেকে বের করে দেওয়া হবে?
– না স্যার। আপনি কতক্ষণ থাকবেন সেটা জানা থাকলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।
– কি ব্যবস্থা নিবেন?
– জানি না স্যার। জাদিদ স্যারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।
– আপনার স্যারের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে আসুন। আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করছি।
কিবরিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল জাদিদের খোঁজে। তাকে পাওয়া গেল না। সে এয়ারপোর্ট গিয়েছে। অতিথিকে নিজে অভ্যর্থনা জানাবে।
ফোনকলেও জাদিদকে রিচ করা গেল না। এদিকে দুশ্চিন্তায় কিবরিয়ার পেট গুড়গুড় করা শুরু করে দিয়েছে। মেইনগেটের সামনে হাঁটাহাঁটি করে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাদিদের সাথে তার দেখা হলো না। পেটের সমস্যাটা বাড়ার কারণে জরুরি ভিত্তিতে তাকে টয়লেটে ছুটতে হলো।
ক্লায়েন্টকে অফিস ঘুরানোর পর বিশ্রামের জন্য তাদের নিজের কেবিনে নিয়ে গেল জাদিদ। সেখানে সোফার উপর শুয়ে আছে সানান ভাই। সোফার হাতলে ছড়িয়ে রেখেছে দু পা। মোবাইলে কোনো এক ফানি ভিডিও দেখে সোফার উপর গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে। গায়ের পোশাকের বর্ণনা নতুন করে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই নিশ্চয়ই?
এমন দৃশ্য দেখে জাদিদ আহাম্মক বনে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিদের চোখে মুখে বিস্ময়।
পাছায় ভেজা হাত মুছতে মুছতে কিবরিয়া দৌড়ে এসে দেখে দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। শুষ্ক মুখে চটজলদি গিয়ে সানান ভাইয়ের কান থেকে হেডফোন খুলে নেওয়ায় সানান ভাইয়ের হুঁশ ফিরল। শোয়া থেকে উঠে বসে হাত নেড়ে হাই জানাল সবাইকে।
মাথায় এলোমেলো কোকড়া চুল, সাদা ঢোলাঢালা টি শার্ট, কালো ত্রি-কোয়াটার প্যান্ট, মাথায় শোভা পাচ্ছে লাল হেডফোন। এমন অদ্ভুত যুবককে দেখে অতিথি দুজন প্রাথমিক অবস্থায় হতভম্ব হয়ে গেলেও পরবর্তীতে সানান ভাইয়ের সাথে তাদের ভাব জমে গিয়েছিল। পরের মাসেই শীতলার সাথে ভিয়েতনামের কোম্পানিটির কোলাবেরেশন শুরু হয়। যা আজ পর্যন্ত চলছে।
আজকে একটা কেমিক্যাল কোম্পানির সাথে মিটিং আছে। শীতলার নতুন পানীয়ের গুণগত মান পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই কোম্পানিটিকে। তারা আজ প্রাথমিক নির্দেশনা দিবেন।
সানান ভাই মার্কেটিং ডিপার্টেমেন্টে একজন সিনিয়র ডিজাইনার। এই মিটিংয়ে তার কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও জাদিদ তাকে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। জাদিদের বাবা জরুরি কাজে অন্য দেশে অবস্থান করছেন। জাদিদ একা পড়ে গেছে। এই মুহূর্তে বন্ধু পাশে থাকলে সে ভরসা পাবে।
কিন্তু তার বন্ধু এই মুহূর্তে টেবিলে মাথা রেখে নিদ্রারত অবস্থায় রয়েছে। কনফারেন্স রুমে প্রয়োজনীয় সকল ব্যক্তি উপস্থিত। শুধু মাত্র কেমিক্যাল কোম্পানির পক্ষ থেকে অফিসারদের টিমটা এলেই মিটিং শুরু হবে। জাদিদ আরেকবার ফাইলটা চেক দেওয়ার আগে সানান ভাইয়ের বাহুতে ধাক্কা দিল।
সানান ভাই বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল,
– বিরক্ত করিস না, বাল।
রুমের সবারই অবাক হওয়ার কথা। কিন্তু কেউ অবাক হলো না। সানান ভাইয়ের আচরণ সম্পর্কে তারা সবাই জানে। সানান ভাই পুরান ঢাকার ছেলে। উঠতে বসতে গালি দেওয়া তার স্বভাব। সালাম দেওয়ার আগেই তার মুখে গালি চলে আসে। গল্পে ভদ্রতা বজায় রাখতে হয় বলে সানান ভাইয়ের সেইসকল গালি এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে না। সে যে সকল গালি উচ্চারণ করে তা শুনলে পাঠককূলের হেঁচকি উঠে যেত।
– রাতে ঘুমাইস নাই তুই? সারারাত জেগে চোর পাহারা দিছিস?
সানান ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল জাদিদ। চোখ দুটো বন্ধ রেখেই জবাব এলো অপরপক্ষ হতে।
– তোর ভাবীর সাথে হা-ডুডু খেলছি। কেমনে খেলে দেখায় দিতে পারতাম, কিন্তু তুই অবিবাহিত ছেলে। এসব খেলা তোকে শেখানো যাবে না।
জাদিদ থমথমে খেয়ে সরে এসে সোজা হয়ে বসল। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
– উঠে ভদ্র হয়ে বস।
– ক্লায়েন্ট আসলে ডাক দিস। এখানে বসে তোদের আমসত্ত্বের মতো চেহারা না দেখে ঘুমানো ঢের ভালো।
মিটিং শুরু হয় বিনা বিঘ্নে। যদিও সানান ভাই বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। তার চেয়ারের ঠিক বিপরীত দিকে বসে একজন অফিসার ইথিলিন গ্লাইকলের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন। গালে হাত দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে সানান ভাই। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ পরপর লম্বা হাই তুলছে।
অন্যরা সবাই মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল, এমন সময় বিকট শব্দে টুং আওয়াজ করে উঠল সানান ভাইয়ের মোবাইল। সবাই চমকে উঠলেও সানান ভাই চমকাল না। বিনা প্রতিক্রিয়ায় টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা তুলে মেসেজটা দেখে একপ্রকার হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলে।
উপস্থিত সকলে আরেকদফা অবাক হলো। জাদিদ দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। আজকে একটা অঘটন না ঘটলেই হয়।
শ্যাওলা পড়া একটা ছাদে পা মুড়ে বসে আছে সাঁঝ। সবুজ রঙা শাড়িটা ছাদের মেঝেতে ছড়ানো। খোলা চুল পিঠ ছাপিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কানে শোভা পাচ্ছে কাঠগোলাপ। মাথার উপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। বর্ষাকালে এমন স্বচ্ছ আকাশ কোথায় পেল সে এক রহস্য বটে। একটি হাত ক্যামেরার দিকে বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে মুখ দেখা যাচ্ছে না। মুখ দেখা না গেলে কি হবে? সাঁঝের ছায়া দেখেও চিনতে পারে সানান ভাই। এখানে শরীরের প্রতিটি অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সানান ভাইয়ের বুকের ধড়ফড়ানি এখনো থামেনি । এরমধ্যে আরও দুটো ছবি এলো মেসেঞ্জারে। সানান ভাই কম্পিত হস্তে লিখল,
– তোকে বারণ করেছি না?
— কি?
— ছবি পাঠানো বারণ ছিল।
– ছবিগুলো ভালোভাবে দেখুন।
– তুই কি আমার হাতে মরতে চাস, সাঁঝবাতি? ছাড় দিচ্ছি বলে বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছিস। একবার যদি ধরি, আফসোস করে কূল পাবি না।
– বকছেন কেনো? ছবিগুলো দিলাম চেক করতে। এগুলোতে মুখ দেখা যাচ্ছে না। ফেসবুকে আপলোড দেই?
– যা ইচ্ছে কর। শুধু আমার মেসেঞ্জারে যেন আর কোনো ছবি না আসে।
– আর পাঠাব না। প্রমিস।
সাঁঝ তার ওয়াদা রেখেছিল। আর কখনো সানান ভাইয়ের মেসেঞ্জারে ছবি পাঠায়নি।
চেয়ারে বসে উশখুশ করছে সানান ভাই। তার দিকে হেলে এসে জাদিদ বলল,
– কী মামা? গরম লাগতেছে? এসির তাপমাত্রা কমায় দিতে বলব?
বিপরীতে সানান ভাই কটমট করে তাকালে জাদিদ মুখ টিপে হাসল। কিবরিয়াকে বলল,
– কিবরিয়া সাহেব, আপনার স্যারকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল এনে দেন। পানি যেন বরফশীতল হয়। বন্ধু আমার হটাৎ করে মাত্রাতিরিক্ত হট ফিল করতেছে।
চলবে..
#অক্ষরময়ী