#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২৫
সাঁঝ দাঁড়িয়ে আছে রমণাপার্কের সামনে। ভয়ে তার হাঁটু কাঁপছে৷ ঝিলিক বলল,
– দাঁড়িয়ে রইলি কেনো? চল।
– তুই ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিস?
– ও না খুব জেদ করছিল। বিয়ের আগে একবার কথা বলতে চায়। না করতে পারিনি।
– আমাকে সাথে নিয়ে এলি কেনো?
– একা আসব? আমার লজ্জা করবে না বুঝি।
– নিউমার্কেটের কথা বলে রমণাপার্কে এসেছি জানতে পারলে মা আমাকে মেরে ফেলবে।
– পারমিশন নিয়ে এসেছি। তবুও এত চিন্তা করতেছিস কেনো?
– পারমিশন! মায়ের চেহারাটা তুই দেখিসনি। মাকে তুই নিজে নিউমার্কেট আসার কথা বলেছিস বলে, তোর মুখের উপর না করতে পারেনি। আমি জিজ্ঞাসা করলে সোজা না করে দিত।
– এজন্য বুদ্ধি করে তোকে জিজ্ঞাসা না করে সোজা তোর মায়ের কাছে পারমিশন চেয়েছি। এখন এতো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কেউ জানতে পারবে না আমরা রমণায় এসেছি। অযথা ভয় পাস না।
সাঁঝের ভয় কমল না। পার্কের ভেতরে প্রবেশ করে অযথা ভয়টি এবার যথাযথ পর্যায়ে চলে গেল৷ পার্কের একটি বেঞ্চে বসে আছে দুজন যুবক। একজন ঝিলিকের হবু স্বামী, ইপ্তি৷ আরেকজন ইপ্তির বন্ধু।
ইপ্তিকে দেখামাত্র ঝিলিক উচ্ছ্বসিত কিশোরীর মতো হাওয়ায় ভাসতে লাগল। তাকে দেখে মনো হলো না, এই মুহূর্তে তার মধ্যে লজ্জা বলে কোনো অনুভূতি বাকি আছে৷ সে পারলে ইপ্তির কোলে উঠে বসে থাকে৷
– কেমন আছ সাঁঝ?
– ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?
– বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কোন ব্যক্তি ভালো থাকে না বলো? আমি বিন্দাস আছি৷
ইপ্তির জবাবে জোরপূর্বক হাসল সাঁঝ। এত জোরে জোরে ওর বুক ধড়ফড় করছে তবুও কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কী আশ্চর্য!
– পরিচয় করিয়ে দেই৷ ও আমার বন্ধু মুহাব। আর এই হচ্ছে সাঁঝ। ঝিলিকের বান্ধবী।
ইপ্তির পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। মুহাব নামক ছেলেটিকে সাঁঝ অল্পবিস্তর চেনে৷ পাড়ার মোড়ে সেদিন বিশ্রীভাবে গান গেয়ে আজম ভাইয়ের হাতে মার খাওয়ার দৃশ্য সে আজও ভুলেনি।
মুহাবের মুখে প্রশস্ত হাসি দেখা গেলেও সাঁঝের চেহারা রঙহীন।
– তোমরা একটু বসো। আমরা দুজন ওদিকটায় একটু হেঁটে আসি।
একান্তে সময় কাটানোর বাহানা। কোনো সভ্য ব্যক্তির পক্ষে বাঁধা দেওয়া সম্ভব নয়। তবুও ইপ্তির কথা শুনে করুণ চোখে ঝিলিকের দিকে চাইল সাঁঝ। এমন তো কথা ছিল না। ঝিলিককে সঙ্গ দিতে আনা হয়েছে ওকে। এখন ঝিলিক নিজেই ওকে সঙ্গহীন করে রেখে চলে যাচ্ছে।
সাঁঝের পাশে এসে দাঁড়ালো ঝিলিক। কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,
– মুখটা এমন করে রেখেছিস কেনো? বেশি দূরে যাচ্ছি না। এই কাছ থেকে হেঁটে চলে আসব। বেশিক্ষণ লাগবে না। তুই ততক্ষণে মুহাব ভাইয়ার সাথে গল্প কর।
– আমাকে একটা রিক্সায় তুলে দে। আমি বাড়ি চলে যাব।
– পাগল তুই! আধাঘন্টা বস প্লিজ। আমার ফোনটা রাখ৷ কোনো সমস্যা হলে ইপ্তির নাম্বারে কল দিস৷
সাঁঝকে মাঝ দরিয়ায় একা ফেলে ঝিলিক চলে গেল। মনে মনে কান ধরে হাজারবার উঠবস করল সাঁঝ। আর কখনো বন্ধু নামক সুবিধাবাদীগুলোকে বিশ্বাস করবে না।
– তোমার নাম তাহলে সাঁঝ?
সাঁঝ চমকে উঠল। কেমন জ্বলজ্বলে একটা হাসি মুহাবের মুখে৷ যেন বলছে, এবার বাগে পেয়েছি। বুঝবি মজা। বিড়ালকে দিয়ে গেছে শুটকি পাহারায়।
সাঁঝ উপর নিচে মাথায় দুলিয়ে সায় জানালো।
– দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।
– না ঠিক আছে।
– ভয় পাচ্ছ?
– নাহ। ভয় কেন পাব?
– ভাবছ সেদিনের অপমানের বদলা নিব।
– নাহ তো।
– তোমার এমনটাই ভাবা উচিত ছিল। এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার মতো ছেলে মনে হয় আমাকে?
সাঁঝ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
– তোমাদের এলাকায় খুব চোটপাট করেছিল না ছেলেগুলা। এখন যদি আমি কয়েকটা ছেলেকে ডেকে নিয়ে এসে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাই। ব্যাপারটা কেমন হবে? কী হলো, উত্তর দিচ্ছ না কেন?
– ভালো হবে না।
– কেন?
– আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে ঝামেলা আরও বাড়বে।
– বাহ! ভয় দেখাচ্ছ আমাকে? মুহাবকে চ্যালেঞ্জ? ঠিক আছে। তাহলে বরং বন্ধুবান্ধবকে ডেকে ঝামেলা একটু বাড়িয়ে ফেলি৷
মুহাব পকেট থেকে মোবাইল বের করল। কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে নাম্বার বের করে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কিহ? কল দিব?
রোবটের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। চকিতে কয়েকবার দুপাশ মাথা দাঁড়িয়ে না জানাল। ওকে ভয় পেতে দেখে মুহাব হো হো করে হেসে বলল,
– কান্না করতেছ নাকি?
– উহু।
– ভয়ে কাঁপতেছ। দেখে মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে৷ এখানে এসে বসো।
সাঁঝ বসল না। মাটিতে শক্ত করে পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুহাব শান্ত গলায় বলল,
– চুপচাপ এসে বসো। না হলে সত্যি তুলে নিয়ে যাব।
এরপর আর কথা থাকে না। সাঁঝ কাঠের পুতুলের মতো আদেশ পালন করল।
আকাশে সোনা রোদ খেলা করছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে উত্তাপ। কিছুক্ষণের মধ্যে চামড়া পুড়িয়ে দেওয়ার মতো রোদ পড়া শুরু করবে। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আলোর রেখা প্রবেশ করেছে। মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকিয়ে আছে মুহাব। ঠোঁট গোল করে শিস বাজাচ্ছে অনবরত।
পাশে বসে আছে সাঁঝ৷ মুহাবের দিকে চোরা চোখে তাকাচ্ছে সে। ওরনার আড়ালে ঝিলিকের মোবাইল। ডায়াল প্যাডে ঝটপট আঙ্গুলের ছোঁয়া পড়ছে। উহ! মুখস্ত নাম্বারগুলোও এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
এমন বিপদের মুহূর্তে কাকে কল দেওয়া যায়? মা? বাবা?
ঝটপট নাম্বার তুলে ডায়াল করল। দুটো রিং হওয়া মাত্র কল কেটে দিল সাঁঝ। তারপর মোবাইলটি আড়াল হতে বের করে হাতে ধরে রাখল। যেনো মুহাব টের না পায়।
চেনা-অচেনা যেকোনো নাম্বার থেকে মিসডকল এলে কল ব্যাক করা তাশফীনে স্বভাব। সামনে বসে থাকা রোগীটিকে বিদায় করে এবারও কল ব্যাক করল।
– হ্যালো, কে বলছেন?
মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠায় ভ্রু কুচকে তাকাল মুহাব। সাঁঝ দ্রুত কলটি রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ দু কদম সরে গিয়ে নিচু স্বরে জবাব দিল,
– হ্যালো।
– বেলা?
– হ্যাঁ।
– এটা কার নাম্বার?
– আমার বান্ধবীর।
– তুই এভাবে ফিসফিসিয়ে কথা বলছিস কেনো?
– একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ভাইয়া। আমি রমনাপার্কে এসেছি। এখন বাড়ি ফিরে যেতে পারছি না। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও।
– ফিরতে পাচ্ছিস না মানে?
– কোনদিক দিয়ে যে ঢুকেছি মনে নাই। চারপাশে গাছপালা। সব একই রকম লাগছে। বের হওয়ার রাস্তা চিনতে পারছি না। তুমি আসো।
– আচ্ছা আসতেছি। ভয় পাস না। কেমন?
কল কেটে বের হতে যাচ্ছিল তাশফীন। ওপাশে পিনপতন নীরবতা অস্বাভাবিক ঠেকল। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল তাশফীনের। সাবধানে ডাকল,
– বেলা?
– হুম।
– আমি কি লাইনে থাকব?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ডিএমসির এদিকেই আছি। রিক্সা নিয়ে আসতেছি। তুই কখন গিয়েছিস রমণায়?
মুহাব বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে সাঁঝের দিকে। এতক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে মেয়েটা? কি কথা বলছে? কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। সাঁঝ বলছে,
এখানে কয়েকটা কাঠবিড়ালি আছে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। মাত্র দেখলাম। সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। এত ছোট! ভালোভাবে দেখার আগেই ফুড়ুৎ।
মেয়েলি আলাপ শুনে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা৷ বেঞ্চে দু হাত ছড়িয়ে দিল। ইপ্তি হারামিটা বউ পেয়ে বন্ধুকে ভুলে গেছে৷ কখন ফিরবে সেই জানে। সময় কাটানোর জন্য একটা ভীতু পুতুল পাওয়া গিয়েছিল। সেটাও এখন ফোনকলে ব্যস্ত৷ একটা ধমক দিবে নাকি মুহাব? এই মেয়ে, ফোনে এত কীসের কথা বলো। ফোন রাখো৷
ধমকটা দেওয়া হলো না৷ তার আগেই একজন সুদর্শন ছেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। ঘামে তার শার্ট ভিজে উঠেছে। দূর থেকে হাত নাড়িয়ে ডাকছে। বেলা, এই যে এদিকে।
সাঁঝের মনে হলো সে দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মুহাবকে তোয়াক্কা না করে ছুটল তাশফীনের দিকে৷
রিক্সায় বসে আছে সাঁঝ। এখনো কূল কূল করে ঘামছে। রাস্তার পাশের দোকান থেকে লেমনেড কিনে দিয়েছে তাশফীন। স্ট্র মুখে নিয়ে কোন ধ্যানে মগ্ন হয়েছে কে জানে!
তাশফীন ডাকল,
– বেলা, লেমনেডটা খা। ভালো লাগবে।
– খাচ্ছি৷ তুমি যে ডিউটি রেখে আমাকে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছ, অফিসে বকা দিবে না?
– নাহ। একজন সিনিয়র ডক্টরের সাথে দেখা করতে ডিএমসিতে এসেছি। উনি আপাতত ব্যস্ত। আউটডোরে বসেছেন। ফ্রি হতে সময় লাগবে। এই ফাঁকে তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারব।
– ওহ। আমি যে রমণায় এসেছিলাম, আম্মুকে বলো না।
– বাড়িতে মিথ্যে বলে এসেছিস? বাবা- মায়ের কাছে মিথ্যে বলতে নেই৷ দিনশেষে ধরা পড়ে যাবি।
– আমি মিথ্যে বলিনি। ঝিলিক বলেছে। মা যদি শোনে তাহলে ওর সাথে আর মিশতে দিবে না। জানোই তো, আমার মাত্র দুটো বন্ধু।
– এমন বন্ধু থাকার থেকে না থাকাই ভালো।
– ও জানত না ইপ্তি ভাইয়ার বন্ধুটা একটা বখাটে।
– ভালোই ঝামেলা পাকিয়েছিস। খালামণি শুনলে তোকে ঘরবন্দী করে রেখে দিবে।
– দোয়া করো যেনো এসব তোমার খালামণির কানে না যায়। দুশ্চিন্তায় তার নিজের ঘুম উড়ে যাবে। সাথে আমারও ঘুম কেড়ে নিবে।
তাশফীন দোয়া করার সুযোগ পেল না। এর আগেই হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার মতো খবর চলে গেল স্বর্ণলতার কানে।
*
নিচ থেকে সানান ভাইয়ের গমগমে আওয়াজ ভেসে আসছে।
– এই সাঁঝবাতি? ওই? নিচে আয়।
ভাতঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠল সাঁঝ। এই মানুষটা তার জীবনের আতংক। সবসময় সাঁঝকে দৌড়ানির উপর রাখে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো। দরজা খোলার শব্দে সাঁঝের মায়ের ঘুম ছুটে গেছে। এই ভর দুপুরে মেয়ে ছুটছে কোথায়? কপালে ভাঁজ পড়ল তাঁর।
বাড়ির সামনে অস্থির পায়েচারি করছে সানান ভাই৷ মাথায় বাবুই পাখির মতো এলোমেলো ঝাকড়া চুল। পায়ে ঘরে পরা চপ্পল। বেশ দুশ্চিতাময় পরিবেশ। সাঁঝের আতংক আরও বাড়ল৷
ওকে দেখতে পেয়ে প্রায় এক লাফে মুখোমুখি দাঁড়াল সানান ভাই। চাপা গলায় হিসহিসিয়ে প্রশ্ন করল,
– ছেলেটা কে ছিল?
কথায় বলে, কানার মনে পড়ল জানা৷ শ্বাস আটকে গেল সাঁঝের। তবুও কোনোরকমে বলল,
– কোন ছেলে?
– নাটক করিস আমার সাথে? কোন ছেলে তুই বুঝতেছিস না? হাত উঠাতে বাধ্য করিস না আমাকে।
সাঁঝের তখন মরমর দশা। প্রায় কেঁদে দেয়৷ মাথা নিচু করে তোতলালো।
– কা..কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।
– যার সাথে সকালবেলা রমণাপার্কে বসেছিলি, আমি তার কথা বলছি। নিজের ভালো চাস তো ভালোভাবেই বলে দে ছেলেটা কে। আমি যদি খুঁজে বের করি তাহলে ওটাকে মাটিতে পুতে ফেলব।
– তুই ছেলের সাথে দেখা করতে পার্কে গেছিস?
দরজার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলেন বিস্মিত স্বর্ণলতা। উনার চোখ দুটোতে বিস্তর অবিশ্বাস। সাঁঝের মনে হলো, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা এর থেকে বেশি সহজ।
মেয়েকে মাত্রই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন তিনি। তাইতো আজকাল শাসনে ছাড় দিচ্ছিলেন সামান্য। অথচ মেয়ে কি করল? স্বাধীনতার অপব্যবহার এরা এভাবেই করে।
ঘায়েল বাঘিনীর মতে সাঁঝের দিলে তেড়ে গেলেন স্বর্ণলতা। কিন্তু নাগাল পেলেন না। সাঁঝকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে সানান ভাই৷ কঠিন কণ্ঠস্বরে ঘোষণা করলেন,
– ওর গায়ে হাত তুলবে না তুমি, মেজ মা।
– তুই ওর সাফাই গাইছিস?
– নাহ। অন্যায় করেছে, এর শাস্তি হবে৷ কথায় কথায় মারধর করা তোমার কেমন স্বভাব? ও কি এখনো বাচ্চা আছে?
– কত বড় হয়েছে, আমিও দেখি। তুই সর সামনে থেকে।
– রাস্তাঘাটে সীন ক্রিয়েট করো না। মানুষজন দেখছে।
সারাক্ষণ লোকের ভয়ে তটস্থ থাকে সাঁঝের মা। এই মুহুর্তে তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটল না। নিজেকে ধাতস্থ করে শান্ত গলায় বললেন,
– সাঁঝ ঘরে আয়৷
মায়ের গমনপথে তাকিয়ে হঠাৎ করে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করল সাঁঝ। আজকে ওর কপালে কি আছে, ও নিজেও আন্দাজ করতে পারছে না।
কান্নার আওয়াজে ফিরে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল সানান ভাই। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
– তুই কাঁদছিস কেন? কান্না বন্ধ কর। এক্ষুণি কান্না বন্ধ।
সাঁঝের কান্না থামল না। উলটো হেঁচকি উঠে একাকার অবস্থা। এদিকে সানান ভাইয়ের অবস্থা আরও শোচনীয়। চোখের সামনে কেউ এভাবে কাঁদলে কি করা উচিত তাই ভেবে কূল পাচ্ছে না।
– কী আজব! কাঁদতে হবে কেনো? কেউ মেরেছে তোকে? মারেনি তো।
– মা ভীষণ রেগেছে৷ ঘরে গেলে মারবে আমাকে।
আড়ালে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ক্ষণিক সময়ের জন্য সানান ভাই চোখ বন্ধ করল। ধীমে আওয়াজে বলল,
– কেউ মারবে না তোকে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাঁঝকে কাঁদতে দেখে পলক ফেলতেও ভুলে গেছে তাশফীন। রিক্সা থেকে একপ্রকার লাফিয়ে নেমে চিন্তিত সুরে বলল,
– কাঁদছিস কেনো বেলা?
সাঁঝ করুণ চোখে তাকাল। এমন চাহনির পেছনে লুকানো অসহায়ত্ব তাশফীন বুঝে। অবাক হয়ে তাকাল সানান ভাইয়ের দিকে।
– কী বলেছো তুমি ওকে? এভাবে কাঁদছে কেনো?
অযাচিত আগন্তুকের উপস্থিতিতে সানান ভাইয়ের মুখের নকশা বদলেছে অনেক আগেই। এবার ভ্রু কুচকে গেল। টেনে টেনে বলল,
– আমার কথার এতো প্রভাব! জানতাম না তো।
হেয়ালি কথায় সময় নষ্ট করল না তাশফীন। সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলল,
– কাঁদিস না। কী হয়েছে আমাকে বল।
– এসেছে তোর রক্ষাকর্তা। গলায় ঝুলে পড়।
অতিরিক্ত আহ্লাদে বিরক্ত হলো সানান ভাই। মুখ কুচকে সেখান থেকে বিদায় নিল। আর কিছুক্ষণ থাকলে কারো হাত ভাঙার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। ডাক্তার মানুষের আবার হাত দুটোই সবচেয়ে জরুরি কিনা।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ২৬
খোলা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন জাহানারা। চ্যাপ্টা থালায় ছড়ানো চাল। তিনি খুব সতর্কতার সাথে চাল থেকে পাথর খুঁজে বের করছেন৷ পাশে আরও দুজন মহিলা কুলোয় চাল ঝাড়ছেন। জাহানারা কিছুক্ষণ পরপর তাড়া দিচ্ছেন।
– তাড়াতাড়ি হাত চালাও। এখনো কত কাজ বাকি! একা মানুষ আমি৷ কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব।
পাশের বাড়ির বুলুর মা বললেন,
– বিয়ের আর কয়দিন বাকি, ভাবি?
– সামনের শুক্রবার বিয়ে। মোটে পাঁচটা দিন আছে। দেখতে দেখতে চলে যাবে। তোমরা এদিকটা দেখো৷ আমাকে আবার রান্না বসাতে হবে। মেয়েটার আক্কেল দেখো৷ সেই যে মার্কেট থেকে এসে ঘরে ঢুকছে! আর কোনো পাশে তাকায় না৷ হাতে হাতে রান্নার কাজগুলো এগিয়ে দিলে আমি এদিকটা সামলাতে পারতাম না?
– এই কয়দিন ঝিলিককে রান্নাঘরে ঢুকতে দিও না৷ নতুন বউয়ের কাটাকুটি করতে নাই।
– ওসব আমি ওরে দিয়ে করাই নাকি! কী যে বলো না তুমি বুলুর মা। কড়াইয়ে একটু খুন্তি নাড়লেই হলো৷
– দরজায় শব্দ হচ্ছে৷ কে যেনো আসছে।
– তোমরা তাড়াতাড়ি হাত চালাও। আমি দেখতেছি৷
দরজা খুলে এসময় সাবিলকে দেখে বিরক্ত হলেন জাহানারা। বললেন,
– কি চাই?
সাবিলের মুখ ভার। থমথমে কণ্ঠে জবাব দিল,
– ঝিলিক আপু কোথায়?
– ওরে কি দরকার?
– মা ডাকতেছে।
– এখন যেতে পারবে না৷ ঘুমাচ্ছে৷
– ডেকে দেন৷ মা খুব রেগে আছে।
– তোর মা রেগে আছে তো আমার কি? আমার মেয়ের কাছে সে কি চায়?
– ঝিলিক আপু জানে৷ আমি জানি না।
বুলুর মা তার দু কান, দু চোখ দরজার দিকে রেখে কাজ করতেছেন। এই মহিলার স্বভাব খারাপ। রেডিওর মতো খবর প্রচার করতে তাঁর জুরি নাই৷ যেকোনো ঘটনা বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলতে পছন্দ করেন। জাহানারা কথা বাড়ালেন না। সাবিলকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। বুলুর মা উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন,
– ও ভাবি? সাঁঝের মা ঝিলিকের কাছে কি চায়?
– সে কি আবার চাইবে! সাঁঝ ডাকছে মনে হয়৷ দুই বান্ধবীতে কতো কথা থাকে! তুমি নিজের কাজ করো৷
দুপুরবেলা ভরপেট খেয়ে বাড়ি ফিরেছে ঝিলিক। সাঁঝ ওভাবে না বল চলে আসায় ভালোই হয়েছে৷ ইপ্তির সাথে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানো গেছে। সাঁঝ থাকলে বারবার বাড়ি ফেরার তাড়া দিত। রিক্সা নিয়ে শহরের অর্ধেকটা ঘুরে ফেলেছে ওরা৷ ইপ্তি বলেছে বাকিটুকু বিয়ের পর ঘুরবে৷
মায়ের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল ঝিলিকের। বিরক্ত হয়ে ঘুমকাতুরে স্বরে বলল,
– কি হয়েছে?
– সাঁঝের মা ডাকতেছে।
– কেন?
– আমি কি করে জানব? যা গিয়ে দেখ।
রংচটা সোফার কুশন কোলে নিয়ে বসে আছে ঝিলিক। সোজা অপরপাশে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখছে সাঁঝের মা। ঝিলিক শুকনো ঢোক গিলে পাশে বসে থাকা সাঁঝের দিকে তাকাল। তার মুখও অন্ধকারাচ্ছন্ন। ওড়না নিচে দুই বান্ধবী শক্ত করে একে অপরের হাত চেপে ধরে বসে আছে। সাঁঝের মাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। ঝড় আসার আগমুহূর্তের মতোন থমথমে পরিবেশ। পরিবেশকে আরও ভারি করে তুলে সাঁঝের মা বলল,
– নিউমার্কেটের নাম করে রমণাপার্কে গিয়েছিলে তোমরা?
ঝিলিক একপলক তাকাল সাঁঝের দিকে৷ এই বাড়িতে কি ঘটেছে সে জানে না৷ তবে পরিস্থিতি বলছে বেশ বড়সড় ঝামেলা বেঁধেছে। আপাতত সত্য বলা ছাড়া উপায় নাই৷ মিথ্যে বলতে গিয় কোথাকার কথা কোথায় লেগে যাবে কে জানে!
– স্যরি আন্টি।
– রমণায় কেন গিয়েছ?
– ইপ্তির সাথে দেখা করতে।
– ইপ্তি কে?
– যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে।
– বাহ! বিয়ের আগেই ঢলাঢলি শুরু হয়ে গিয়েছে!
অপমানে নীল হয়ে গেল ঝিলিকের মুখ। মায়ের আচরণে বড্ড অপ্রস্তুত হলো সাঁঝ। বলল,
– মা, এভাবে বলছ কেন? নিজের জামাইয়ের সাথেই তো দেখা করতে গিয়েছে।
– তুই চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। বিয়ে না হতেই জামাই। সাঁঝের সাথে ছেলেটা কে ছিল, ঝিলিক?
– ওর সাথে কোনো ছেলে ছিল না আন্টি।
– একদম মিথ্যা কথা বলবে না। পার্কের বেঞ্চে একটা ছেলের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল ও। সানানের বন্ধুরা দেখেছে। দুই বান্ধবী মিলে বুদ্ধি করে প্রেম করতে গিয়েছো। এত সাহস বেড়েছে তোমাদের! আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলো। নিউমার্কেটে যাচ্ছি মার্কেট করতে৷ এই তোমাদের মার্কেট করার নমুনা?
– স্যরি আন্টি।
– ইপ্তিকে তুমি আগে থেকে চিনতে? তোমাদের প্রেম ছিল?
ঝিলিক ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে রাগান্বিত স্বর্ণলতাকে দেখল। ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল।
– আম্মুকে বলবেন না প্লিজ। আমাদের আগে থেকে চেনাজানা ছিল জানলে বিয়ে ভেঙে দিবে। প্লিজ আন্টি৷
– তুমি প্রেম করেছো ভালো কথা। সেটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু বান্ধবীর জন্যেও ছেলে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব তোমাকে কে দিয়েছে? নিজে নষ্টামি করবা সাথে আমার মেয়েকেও নষ্ট করবা তা তো আমি হতে দেব না।
– আমি সাঁঝকে কোনো ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেইনি আন্টি। ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড নাই। আপনারা যার কথা বলছেন, সেটা ইপ্তির বন্ধু। ওরা একসাথে এসেছিল।
– শোনো ঝিলিক। তুমি আমার মেয়ের সাথে আর মিশবা না। বিয়ের করতেছ ভালো কথা। স্বামীর বাড়ি যাও। মন দিয়ে সংসার করো। আজকের পর থেকে তোমাকে যেন সাঁঝের আশেপাশে না দেখি।
সাঁঝ মাথা নিচু করে কান্না করতেছে। ঝিলিক রাগ করে তখনি ঝট করে উঠে দাঁড়াল। জোরপূর্বক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুমদাম লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল। সাঁঝের সাথে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সে মরে যাচ্ছে না সে। ওর কি বন্ধুর অভাব পড়েছে? নেহাৎ একই পাড়ায় থাকে বলে একসাথে স্কুল যাওয়া আসা করত। সাঁঝের মা মহিলাটা একটা অহংকারী মহিলা। যেন সে একাই সম্মানি ব্যক্তি। বাকি সবাই চোর, ডাকাত, পাপিষ্ঠ।
ঝিলিক ঠিক করল, বিয়েতে সব বন্ধুদের ডাকবে। কিন্তু সাঁঝকে নিমন্ত্রণ করবে না। সবার সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করবে। যাতে ছবি দেখে আফসোসে আধমরা হয়ে যায় এই মেয়ে।
মেয়েকে এতো রেগে ফিরতে দেখে জাহানারা নিজের কাজ ফেলে ছুটলেন মেয়ের ঘরে৷
– কি বলল সাঁঝের মা? কেনো ডেকেছে তোকে?
বিছানায় বসে রাগে ফুসছে ঝিলিক। দাঁতের সাথে দাঁত লেগে কটমট শব্দ হচ্ছে। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
– নিজের মেয়েকে কোন ছেলের সাথে পার্কে বসে ছিল সেটা আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেছে। কেন? আমি কি তার মেয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে বসে আছি? নিজের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে পারতেছে না? ফালতু মহিলা একটা।
– কত বড় সাহস বেডির! তুই কিছু কইলি না? চুপচাপ চলে আসলি!
– বাদ দেও তো মা। উনার সাথে কথা বাড়ানো মানে নিজের সময় নষ্ট।
– কীসের সময় নষ্ট? আমার মেয়েকে হেনস্তা করে কোন সাহসে? নিজের মেয়ে নষ্টামি করবে আর আমাকে মেয়েকে ডেকে নিয়ে গিয়ে থ্রেট করবে? আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিব? এত সাহস ও পায় কই থেকে?
– আজ বাদে কাল বিয়ে। এই সময় তুমি যাবা উনার সাথে ঝগড়া করতে? সেই খবর আমার শ্বশুরবাড়িতে গেলে নানান কথা হবে।
জাহানারা গুটিয়ে গেলেন৷ অস্থির ভাবে পায়েচারি করতে বললেন,
– ওই মেয়ের সাথে খবরদার কোনো কথাবার্তা বলবি না। বিয়েটা শেষ হোক, তারপর আমি স্বর্ণলতাকে দেখতেছি।
পুরো ব্যাপারটা ঘটল বুলুর মায়ের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে৷ তবুও পাড়ায় খবর প্রচার হতে সময় লাগল না। নিজের মেয়েকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা স্বর্ণলতার মুখ পুড়েছে। পুড়িয়েছে তারই মেয়ে। পার্কে গিয়েছে কোন ছেলের সাথে।
এঘর থেকে ওঘরে কথা প্রচারিত হতে হতে আরও মশলা যুক্ত হলো। আজমের মায়ের কাছে যতক্ষণে খবর পৌঁছেছে ততক্ষণে সত্য আর সত্যটি নেই। রূপকথার গল্পে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। তিনি হন্তদন্ত পায়ের ছেলের ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে ডেকে তুলে বললেন,
– হ্যাঁ রে আজম, তোর বন্ধুর বোনটা নাকি রমণায় কোন ছেলের সাথে ধরা পড়ছে?
অসময়ে ঘুম থেকে জেগে তোলায় আজম প্রচুর বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু মায়ের কথা শুনে একমুহূর্তে ঘুম উড়ে গেল। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলল,
– কীসব ফালতু কথা। কার কাছে পাও এসব খবর?
– রামিনের মা বলল। আর কতকিছু শুনলাম! ছিঃ ছিঃ!
– কি শুনছ?
– তোকে বলা যাবে না।
– আর বলো তো। ঘুম থেকে তুলে ঢং করবা না।
আজমের মা এদিক ওদিক তাকিয়ে দৃষ্টি লুকালেন। এসব কথা ছেলের সামনে বলা যায়! আজকালকার মেয়েছেলেরা এতো নির্লজ্জ হয়েছে বলে তিনি তো নিজের লজ্জা খোয়াতে পারেন না। তবুও একসময় ইতস্ততভাবে বললেন,
– পার্কের ভেতরের দিকে জঙ্গলের মধ্যে বসে ছিল দুজনে। ছেলেটা ছিল বেঞ্চে বসে। আর সাঁঝ নাকি ওর কোলে বসে ছিল। ছেলেটার প্যান্ট খোলা৷ পায়ের কাছে পড়ে ছিল।
হতভম্ব আজমকে বসিয়ে রেখে ওর মা দ্রুত ঘর ত্যাগ করল। রাগে আজমের গা কাঁপছে। সামান্য একটা ঘটনাকে এরা কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে!
বিছানা ছেড়ে উঠল আজম। গ্রুপে মেসেজ দিয়ে সবাইকে বলল জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে। হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় মাকে ডেকে বলল,
– আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরী হবে। আর শোনো, সাঁঝের ব্যাপারে কেউ গসিপ করতে আসলে ধমক দিয়ে বিদায় করে দিবা। সাঁঝকে তুমি চিনো না? ছোট থেকে আমাদের চোখের সামনে বড় হইল মেয়েটা। ওরকম মেয়ে মনে হয় ওকে? মাটির দিকে চোখ রেখে রাস্তায় চলাফেরা করে। ও গিয়ে ছেলের কোলে বসে থাকবে? পাগল পেয়েছো ওকে? এসব মানুষের বানানো কথা৷ ঝিলিকের সাথে পার্কে গিয়েছিল ঘুরতে। সেটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। লোকে কথা বানানোর সময় আকাশ পাতাল এক করে ফেলে। এসবে কান দিবা না।
চলবে..
#অক্ষরময়ী