#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব ৩১
জৈষ্ঠ্যমাসের সূচনালগ্নে আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ভারিক্কি৷ ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ সেই আলোয় ক্ষণিকে জন্য দৃশ্যমান হচ্ছে একটি বাইক। শহুরে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের দিকে। বাইকের পেছনে চিন্তিত ভঙ্গিমায় বসে আছেন বড় বাবা৷ উত্তাল আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। বোধহয় ঝড় আসবে।
– গ্রীষ্মকালে কালবৈশাখি ঝড় হবে এটাই স্বাভাবিক। এত অবাক হওয়ার কি আছে!
ভারিক্কি স্বরে জবাব এলো সামনে থেকে। বড় বাবার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। ছেলেটা কেন যেন মুখ ভার করে রেখেছে। বেশি কিছু বলছে না। স্বভাবসুলভ ঝগড়াও করছে না। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসের নির্ধারিত সীটে বসে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– একটু পরে বাস ছেড়ে দিবে। তুই অপেক্ষা করিস না। বৃষ্টি নামার আগে বাড়ি ফিরে যা। পথে কোথাও আড্ডা দিতে বসিস না আবার।
বড় বাবাকে বিদায় দিয়ে সানান ভাই বাড়ির পথে চলল। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলো ক্ষীণ। ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাতের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সানান ভাইয়ের মনে হলো, আজকের আকাশের সাথে তার মনের বেশ মিল আছে। গুমোট মনটা ক্ষণে ক্ষণে এভাবেই চিৎকার করে উঠছে৷ পার্থক্য এতোটুকু, আকাশের আর্তনাদ সকলে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তার আর্তনাদ অন্তরের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ।
স্বামীর সাথে কথা বলে নিশ্চিন্ত মনে বালিশে মাথা রাখলেন বড় মা। রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বাস ছেড়েছে৷ সানান ভাই ফিরছে বাড়ির দিকে। সদর দরজার চাবী আছে ছেলের কাছে। দরজা খুলে দেওয়ার ঝামেলায় যেতে হবে না উনাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন৷
প্রকাণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। এতো জোরে বিদ্যুৎ চমকালো যেন কাচের জানালা ভেঙে গুড়িয়ে পড়বে।
নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই পাশের ঘর থেকে কান্নার শব্দ শুনে দ্রুত বিছানা ছাড়লেন। কয়েকমাস হলো সায়রা একা ঘুমায়। দিকবিদিক কাঁপিয়ে দেওয়া শব্দে সে ভয় পেয়েছে। কান্নারত সন্তানকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। গায়ে পাতলা কাথা জড়িয়ে দিয়ে ধীর পায়ে এলেন ড্রয়িংরুমে৷ এক গ্লাস পানি পান করে কী মনে করে যেন তাকালেন ছেলের রুমের দিকে৷ দরজাটা বন্ধ৷ লক ঘুরিয়ে একটুখানি দরজার পাল্লা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন৷ এই কাজটি তিনি প্রায়ই করে থাকেন। ছেলেকে বিরক্ত না করে চুপিসারে এসে দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে যান। কখনো দেখেন, সানান ভাই পিসির সামনে বসে কাজে মগ্ন। কখনো শান্তভাবে ঘুমিয়ে থাকে বিছানায়। কখনো বা কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল স্ক্রল করে।
কিন্তু আজকের দৃশ্য ভিন্ন। এতো রাতে ছেলের রুম ফাঁকা দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন৷ মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছে৷ অথচ ছেলে বাড়ি ফিরেনি!
ছেলেকে খুঁজতে তিনি সন্তপর্ণে বাইরে চলে এলেন। সিঁড়িতে ঝুঁকে দেখলেন গ্যারেজে বাইকটি দাঁড়িয়ে আছে৷ অর্থাৎ বাড়ি ফিরেছে। তবে ছেলে গেলো কোথায়?
দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে নিজের মোবাইলটি হাতে নিলেন। কল দিয়ে দেখলেন রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হলো না। মাঝরাতে অস্থিরভাবে ড্রয়িংরুমে পায়েচারি করতে লাগলন তিনি৷ হঠাৎ দরজা খুলে আবার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। লিফট সার্ভিস বন্ধ৷ তিনি সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে অগ্রসর হলেন। ভুলে গেলেন কোমরের ব্যথার কথা।
*
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝুম ঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে৷ কী অপরুপ তার ছন্দ! মনোযোগ দিয়ে শুনলে হারিয়ে যাওয়া যায় সুরের মূর্ছনায়। মন, প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
চোখ দুটো বন্ধ করে বৃষ্টির ছন্দময় সঙ্গীত শুনছিল সানান ভাই। ছাদের দরজাটা হাট করে খোলা। এক হাতে কোমর চেপে ধরে ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। ক্রমাগত জলের ধারায় সিক্ত হয়ে শীতল হয়েছে পৃথিবী। ঠান্ডা বাতাস গায়ে ঝাপটা দিচ্ছে। তাঁর গা শিউরে উঠল।
ছাদের দুপাশে দুটো বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। বৃষ্টির কারণে সেই আলোয় ছাদ জুড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজ করছে৷ ঘোলাটে আলোয় তিনি দেখলেন, ছাদের কার্নিশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ছেলে। দীর্ঘদেহীর অবিচল পৃষ্ঠদেশ দেখে তাঁর কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো৷ গায়ের পোশাক বেয়ে চুয়ে চুয়ে জল ঝরছে৷ যেন বৃষ্টিস্নাত বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে। কতক্ষণ ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে?
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বড় মা উঁচু কণ্ঠে ছেলের নাম ধরে ডাকলেন। খুব ধীর গতিতে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে। তিনি মেজাজ দেখিয়ে বললেন,
– মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজতেছিস কেনো?
ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। যেভাবে ঘাড় ফিরিয়ে চেয়েছিল, ঠিক সেভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল। বিরক্তির সাথে এবার রাগ জন্ম নিল উনার মনে৷
– শুনতে পাচ্ছিস না আমার কথা? নিচে আয়। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
– আসতেছি। তুমি ফিরে যাও।
দীপ্ত কণ্ঠের শান্ত জবাবে উনার বুক ধক করে উঠল। ছেলের কৌতুকে কণ্ঠস্বর শুনে তিনি অভ্যস্ত। হিমশীতল এই কণ্ঠস্বরকে তিনি ভীষণ ভয় পান। আজ অনেক বছর পর ছেলের কণ্ঠে আবার একই ধরনের শান্ত, শীতল ভাব লক্ষ্য করে সারা শরীর এক মুহূর্তের জন্য জমে গেল। তিনি খুব সাবধানে পা ফেলে ধীরে ধীরে ছেলের দিকে এগোলেন। পেছন থেকে আলতো হাত রাখলেন ছেলের কাঁধে। ভেজা কাপড় ভেদ করে শীতল দেহ অনুভব করা গেল। আলতোভাবে বললেন,
– ইশ! গা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে৷ ঘরে চল সানান। দেখছিস না কীরকম ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সানান ভাই। এক পা পিছিয়ে গিয়ে পাশের ফুলের টবটা দু হাতে তুলে আছড়ে ফেলল মাটিতে। সশব্দে নিচে পড়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল মাটির টুকরো। বড় মা একলাফে দূরে সরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। সানান ভাইয়ের চোখ টকটকে লাল। চোয়াল জোড়া শক্ত। রাগে গনগন করছে মুখমণ্ডল। কিছুক্ষণ আগের শান্তভাব হুট করে যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে বলল,
– তোমাকে যেতে বলেছি না এখান থেকে? কেনো বিরক্ত করছ?
ভয়ে উনার হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। তবুও তিনি শান্ত থাকার ভরপুর চেষ্টা করলেন। শুকনো ঢোক গিলে আবারও ধীর পায়ে ছেলের নিকটে দাঁড়িয়ে গালে হাত রেখে বললেন,
– অনেকক্ষণ ধরে ভিজেছিস৷ অসুস্থ হয়ে পড়বি। নিচে চল বাবা। কেনো এমন পাগলামি করছিস?
এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে সানান ভাই তীব্র বিতৃষ্ণণা নিয়ে বলল,
– আমি কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই৷ কিছু জানো না তুমি৷ কিছু না।
তারপর হনহন করে দ্রুত পায়ে নেমে গেল নিচে। ঝুম বৃষ্টির নিচে ফাঁকা ছাদের মাঝখানে কিছুক্ষণ নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। বুক কাঁপছে দুরুদুরু। এ আবার কোন ঝড় এলো তাঁর সংসারে!
*
রাত পেরিয়ে সকাল হতেই তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা, শীতল বৃষ্টির জলে ভেজার কারণে কোমরের ব্যথাটা বাড়তে লাগল হু হু করে৷
সায়রার জন্মের সময় কোমরে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি৷ বয়স পেরিয়ে বাচ্চা জন্মদানের এমনি প্রতিদান পেয়েছেন৷ যা বাকিটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
অবশ্য তা নিয়ে আফসোস নেই। বয়স যখন চল্লিশের কোঠায় তখন হঠাৎ করে সায়রা এলো গর্ভে৷ অপরিকল্পিত গর্ভধারণে শক্তপোক্ত বড় মা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন সেদিন। ঘরে বাইশ বছরের যুবক ছেলে। ঠিক সময়ে বিয়ে দিলে তার ঘরে এতোদিন বাচ্চা চলে আসত। এই বয়সে তিনি আরেক বাচ্চা জন্ম দিতে চলেছেন। সবদিক বিবেচনা করে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা দেরী করেননি তিনি। কিন্তু বাঁধ সাধলেন বড় বাবা। স্ত্রীর সাথে যে শীতল সম্পর্ক তিনি এতোদিন যাবত বয়ে বেড়াচ্ছেন, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পেয়ে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল স্ত্রীর পায়ে লুটিয়ে পড়তেও তিনি দ্বিধা করেননি। তবুও যখন বড় মায়ের সিদ্ধান্ত বদলালো না, তখন চুপিসারে খবরটা ছেলের কানে তুলে দিলেন। সাথে এটাও বললেন, ঘরে সোমত্ত ছেলে থাকায় লজ্জায়, ইতস্ততায় বড় মা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
মায়ের থেকেও দ্বিগুণ জেদি, একগুঁয়ে ছেলে সে৷ সেই সাথে ছোট একটা ভাই অথবা বোন পাওয়ার লোভ তাকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলল। মায়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
পাড়া জুড়ে আড়ালে কম হাসাহাসি হয়নি৷ পরিবারেও ছিঃ ছিঃ রব পড়ে গিয়েছিল। লোকের কথায় পাত্তা দেওয়ার স্বভাব অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তবুও মাতৃত্বকালীন সেই সময়টায় একটু আধটু মন খারাপ হতো। যা নিমিষেই দূর হয়ে যেত ছেলের ভালোবাসা ও যত্নে৷ বাউণ্ডুলে ছেলে থেকে এক ঝটকায় যত্নশীল মায়ের মতো হয়ে গিয়েছিল সানান ভাই৷
সায়রা জন্মানোর পর বেশ কয়েকদিন বিছানায় পড়ে রইলেন বড় মা। তখনো সায়রাকে সামলানোর কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করল তাঁর এই বাউণ্ডুলে ছেলেটা।
ব্যথার ঔষধ খেয়ে রান্নাঘরে উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন তিনি৷ এই ঔষধ তাঁকে প্রত্যহ গ্রহণ করতে হয়৷ প্রতি কদমে কোমরের ব্যথাটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে৷ যেন হাড়ের সাথে হাড় ঘষা লাগছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে নাস্তা তৈরি করে সায়রাকে ডাকলেন। মা যতোই অসুস্থ হোক, সন্তানকে উপোস রাখতে পারে না৷
সায়রা বুঝদার মেয়ে। মায়ের কোমর ব্যথার কথা শুনে একটুও জ্বালাতন করল না৷ চুপচাপ খাবার খেয়ে নিল৷ বাকি খাবার ঢেকে রেখে ছেলের রুমে উঁকি দিলেন তিনি। বিছানার একপাশে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে সানান ভাই৷ কপাল কুঁচকে আছে সামান্য। মুখটা বেশ শুকনো। তিনি ধীর পায়ে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন৷ সন্দেহ গাঢ় হওয়ায় হাত রাখলেন তার কপালে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকলেন,
– সানান?
চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করতেই মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হলো৷ মুখ কুচকে চোখ জোড়া আবার বন্ধ করে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল সানান ভাই৷
– উফ! মাথা ব্যথা৷
– জ্বর এসেছে। ওমন ঠাণ্ডা পানিতে ভিজলে জ্বর আসবে না! এত বড় ছেলেকে এখনো ঝড়, বৃষ্টি থেকে আমাকেই সাবধান করে দিতে হবে৷ একটু কষ্ট করে উঠে নাস্তাটা খেয়ে নে। ঔষধ খেতে হবে।
– পরে খাব।
– নাহ৷ এখনি খেতে হবে৷ না হলে এই জ্বর আরও বাড়বে।
জ্বরের তীব্রতা সানান ভাই নিজেও আঁচ করতে পেরেছিল। ব্যথা জড়ানো শরীরটাকে বিছানা থেকে কোনোমতে তুলে নাস্তা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিল৷
দিন যত গড়াতে লাগল পরিস্থিতি তত বিগড়ে গেল। কোমরের ব্যথায় বিছানা নিলেন বড় মা। তীব্র যন্ত্রণায় চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। না সোজা হয়ে শুতে পারছেন, না বসে থাকতে পারছেন। এ এক অস্থির যন্ত্রণা।
অন্যদিকে সানান ভাইয়ের রুমের অবস্থাও প্রায় একই৷ জ্বরের তাপে শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে৷ যন্ত্রণায় মুখ ফুটে বেরিয়ে আসছে অস্ফুট আতর্নাদ।
ছোট সায়রা শিউরে বসে তার ক্ষুদ্র হাত দাদাভাইয়ের কপালে ছুয়ে দ্রুত সরিয়ে নিল। মৃদুস্বরে বলল,
– উফ! কী গলম!
সানান ভাইয়ের কিছুটা জ্ঞান তখনো অবশিষ্ট রয়েছে৷ সে চোখ বন্ধ রেখে ভারি স্বরে ডাকল,
– প্রিন্সেস?
এত ধীরে বলা কথা শুনতে কষ্ট হলো সায়রার৷ সে ঝুঁকে পড়ল দাদাভাইয়ের মুখের উপর। চিন্তিত সুরে বলল,
– তোমার কত্ত হচ্ছে?
– উহু। আমি ঠিক আছি। তুমি এখানে থেকো না। থাকলে তোমারও জ্বর হবে৷ মা কোথায়? মাকে ডেকে দেও।
– মায়ের ব্যতা৷ মা ঘুমায়।
কথা শেষ করে দ্রুত বিছানা থেকে নামল সায়রা। অনেকক্ষণ মায়ের খোঁজ নেওয়া হয় না। তার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। একবার মাকে দেখছে আরেকবার দাদাভাইকে।
পাশের ঘর থেকে ছেলের মৃদু আর্তনাদ উনার কানে আসছে ঠিকই। কিন্তু তিনি ছেলের কাছে ছুটে যেতে পারছেন না। নিজ অপারগতায় চোখ ভিজে এলো। শেষবার যখন দেখে এলেন, তখন ছেলেটার ফর্সা মুখখানা পাকা টমেটোর মতো লালচে দেখাচ্ছিল। তিনি ভেবেছিলেন কিছুক্ষণ পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ছেলের গা মুছে দিবেন। অথচ এখন নিজেই শয্যাশায়ী।
সায়রা এসে মায়ের পাশে বসল। মায়ের চোখের গড়িয়ে পরা জল যত্ন করে মুছে দিয়ে দু গালে দুটো চুমু খেল। আবেশে চোখ বন্ধ করে হাসলেন তিনি। সায়রা বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো গভীর চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,
– তোমার ব্যতা করে?
হাসি মুখটি দু’পাশে মাথা নাড়লেন তিনি। কিন্তু যখন চোখ খুললেন তখন অজান্তেই বড় বড় জলের ফোটা গাল বেয়ে গড়াতে থাকল। রাজশাহী পৌঁছে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন বড় বাবা। তারপর আর খোঁজ খবর নেই। হয়তো দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এরপর ছুটবেন মিটিং রুমে। ব্যস্ত জীবনে ফুরসত নেই।
সবই জানেন, সবই বুঝেন তিনি। তবুও বেশ অভিমান হলো। অসুস্থ অবস্থায় মন পিপাসিত হয়। যত্ন চায়। ভালোবাসা চায়। মায়ের আঁচলের মতো একটুকরো মমতা চায়। মানুষ যতই বড় হয়ে যাক না কেনো, তার এই চাওয়া কখনো শেষ হয় না।
*
সায়রাকে কোলে নিয়ে একপ্রকার ছুটে এসেছে সাঁঝ৷ বাড়ির সবকটি দরজা হাট করে খোলা। চোর এসে লুটেপুটে নিয়ে যেতে পারত। সায়রাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজা বন্ধ করল। প্রথমে বড় মায়ের রুমে গিয়ে দেখল, তিনি বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। শিউরে বসে সাঁঝ বলল,
– বড় মা, ব্যথা কি খুব বেশি? ডাক্তার ডাকব?
– লাগবে না। গতরাতে বৃষ্টির পানিতে ভিজে ঠান্ডা লেগেছে বলে ব্যথাটা বেড়েছে। ঔষধ খেয়েছি৷ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
আলমারির উপর থেকে সরিষার তেলের বোতল নিয়ে এলো সাঁঝ৷ বড় মাকে উপুড় হয়ে শুতে বলল। হালকা হাতে কোমরে তেল মালিশ করে দিয়ে মোটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল গা।
জৈষ্ঠ্যমাসের তালপাকা গরম। ঘরে এসি চলছে। তবুও কম্বলের নিচে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলেন তিনি।
সাঁঝের পায়ে পায়ে ঘুরছে সায়রা। দাদাভাইয়ের শিউরে বসে একবার বন্ধ চোখের স্থির মুখটিকে দেখে আরেকবার চিন্তিত সাঁঝের দিকে তাকায়৷ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সাঁঝ আরেকবার ডাকল,
– সানান ভাই?
সে সাড়া দিল না। বাধ্য হয়ে কপালে আলতো হাত রাখতে হলো সাঁঝকে। চুলার উপর কড়াই বসালে কয়েক সেকেন্ড পর যেমন উত্তপ্ত হয় তেমনি উত্তপ্ত সানান ভাইয়ের শরীর৷ কোমরে শাড়ির আঁচল গুজে সাঁঝ আপনমনে বলল,
– মাথায় পানি দিতে হবে। শরীর মুছে দিলে ভালো হতো।
সাঁঝের আকস্মিক প্রস্থানে অতিথিরা মনোক্ষুণ্ণ হতে পারে এমনটাই আশংকা ছিল সাঁঝের মায়ের। কিন্তু ঘটনা ঘটল তার উলটো। সাওগা বেগম পরিস্থিতি সামলে নিলেন চমৎকারভাবে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আফসোসের সুরে বললেন,
– পাশের বাড়িটা আমার বড় ছেলের। ওর কলেজের কীসের যেন মিটিং আছে। সেজন্য রাজশাহী গেছে। না হলে আপনাদের সাথে দেখা করতে আসত। ওই ছেলের ঘরে আমার দুটো নাতি, নাতনি। বড় ছেলেটাও সারাদিন অফিসে থাকে। আর মেয়েটা এখনো ছোট। বড় বউমার একটা বাচ্চা হওয়ার পর আর অনেকদিন বাচ্চাকাচ্চা হইল না। নাই মানে একদম নাই৷ এরপর বহুবছর বাদে আল্লাহ মুখ তুলে চাইল। শেষ বয়সে মেয়ে সায়রা৷ মাত্র চার বছর বয়স। মুখে তুলে খাওয়ায় দিতে হয়। মায়ের অসুখে কেমনে দৌড়ায় আসছে দেখলেন তো৷ কারো কোনো সমস্যা হইলে সবাই এবাড়িতে দৌড়ে আসে। সাঁঝ আমার বড় ভালো মেয়ে। সবার বিপদে আগে দৌড় দেয়। দেখলেন না, কীভাবে ছুটে গেল? নিজের চাচী বলে না, যে কারো বিপদে আপদে এইভাবেই ঝাপিয়ে পড়ে।
বেশ প্রসন্ন মনে অতিথিরা ফিরে গেলেন। অতি শীঘ্রই মতামত জানাবেন বলে আশ্বস্ত করে গেছেন। সাওদা বেগম বৃদ্ধ মানুষ। বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না। মেজ বৌকে ও বাড়ির খবর নিত বলে তিনি চলে গেলেন বিশ্রাম নিতে। সাঁঝের বাবাকে ছুটতে হলো লাইব্রেরিতে।
সাঁঝের মা দ্রুত পায়ে ছুটলেন মেয়ের খোঁজে। এসে দেখেন বাথরুম থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে এসেছে সাঁঝ। মা-মেয়ে মিলে সানান ভাইকে টেনে বিছানার প্রশস্ত বরাবর শুয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালা আরম্ভ হলো। মগ দিয়ে পানি তুলে মাথায় ঢালছেন সাঁঝের মা। শিউরে বসে ভেজা চুলে আলতোভাবে আঙ্গুল চালিয়ে যাচ্ছে সাঁঝ। বারবার পানি পালটে প্রায় ঘন্টাখানেক মাথায় পানি ঢালার পর সানান ভাইয়ের গায়ের তাপমাত্রা কমল।
ভেজা চুল মুছে দিয়ে সাঁঝের মা বলল,
– আমি যাই। রাতের রান্না বসাতে হবে৷ তুই এখানেই থাক। সাভিন-সাবিলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মা চলে যাওয়ার পর ঘরের চারদিক হেঁটে দেখল সাঁঝ। সবকিছু এলোমেলো। গৃহকর্ত্রী অনুপস্থিত থাকলে গৃহে তার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যায়। চারপাশ শূন্য, খাঁ খাঁ করে৷ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে বাড়ি জুড়ে।
সেই রাতদুপুরে বন্ধ জানালা খুলে দিল সে। এঁটো থালাবাসন ধুয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করল। রাতের রান্নার ঝামেলা নেই৷ ও বাড়ি থেকে মা খাবার পাঠিয়ে দিবে। বড় মায়ের রুম, সানান ভাইয়ের রুম পরিষ্কার করে পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিল। সাভিন-সাবিল আসায় চঞ্চলতা ফিরেছে সায়রার। উচ্ছ্বসিত হয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে৷
সে রাতে আফসানা কিছু খেল না। ঘুমিয়ে পড়েছে বলে সাঁঝও ডাকেনি৷ সানান ভাই প্রায় অচেতন। তাকেও খাওয়ানো গেল না। তিনজন ক্ষুদে সদস্যকে নিয়ে সাঁঝ রাতের খাবার খেয়ে নিল।
সানান ভাইয়ের ঘরে দুটো ডাবল সেট সোফা আছে। তাতেই শুয়ে পড়েছে সাভিন ও সাবিল। সাঁঝ ভাবল সায়রার রুমে গিয়ে সেও একটু ঘুমিয়ে নিবে। কিন্তু সায়রা তার দাদা ভাইকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। অগত্যা তাকে সানান ভাইয়ের পাশে শুয়ে দেওয়া হলো।
এক দু ঘন্টা বোধহয় ঘুমিয়েছে সে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ভাবল, রোগী দুজনের খোঁজ নিয়ে আসা যাক। রাত্রি তখন বারোটা। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে গেছে। বড় মায়ের রুমে গিয়ে দেখল তিনি তখনো ঘুমে। তবে ব্যথার কারণে সামান্য অস্থির দেহভঙ্গি। সাঁঝ রান্নাঘরে গেল। বয়াম ঘেটে লবণ খুঁজে বের করল। কড়াইয়ে অনেকটা লবণ ঢেলে গরম করে নিল। পাতলা সুতি কাপড়ে গরম লবণ ঢেলে তা পুটলি বেঁধে ধীরে ধীরে সেঁক দিল আফসানার কোমরে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আরামবোধ করলেন তিনি।
সাঁঝ ফিরে এলো সানান ভাইয়ের রুমে। সেখানেও রোগীর অবস্থা করুণ। মধ্যরাতে বোধহয় আকাশ বাতাস ভারি করে বিপদেরা নেমে আসে মত্তে। গাঢ় অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে আরও গাঢ় হয় অসহায়ত্ব।
এ বার সে মাথায় পানি দিল না। বরং কিছুক্ষণ পরপর কাপড় ভিজিয়ে হাত, পা, মুখ থেকে গলা, ঘাড় পর্যন্ত মুছে দিল।
*
দীর্ঘ রাত পেরিয়েছে। অবচেতন অবস্থাতেও মস্তিষ্ক সতর্ক ছিল বড় মায়ের। ভোরের আলো ফুটতেই বিছানা ছাড়লেন তিনি। শরীর বেশ ঝরঝরে। গতকালের কোমর ব্যথার লেশমাত্র নেই। ছেলের কথা স্মরণ মাত্র বাসি মুখে তিনি ছুটলেন পাশের ঘরে। ধীরে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন। এ ঘরে যে মেলা বসেছে!
সুবিশাল কক্ষটির বাসিন্দা মাত্র একজন। ফলাফল, কক্ষের বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা পড়ে থাকে। পরিত্যক্ত নগরীর মতো দেখাতো ঘরটাকে। আজ অনেকদিন পর নগরী যেন লোকে লোকারণ্য। সোফায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে দুজন।
বিছানার প্রস্থ বরাবর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সানান ভাই৷ লম্বা পা দুটির কিছু অংশ বিছানার নিচে ঝুলছে৷
একপাশে শুয়ে আছে সায়রা। অন্যপাশের হেডবোর্ডে মাথা হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে সাঁঝ।
কাছে এসে ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে দেখলেন, জ্বর নেই৷ নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। নিশ্চুপে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরেকবার সোফার দিকে তাকালেন। স্বর্ণলতা যে বুদ্ধি খাটিয়ে তার ছেলে দুটোকেও পাঠিয়ে দিয়েছে তাতে বেশ খুশি হলেন। সবার জন্য খাবার প্রস্তুত করার জন্য রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
সানান ভাইয়ের কক্ষের দক্ষিণে একটা জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে সূর্যের আলো কক্ষে প্রবেশ করে একদম মুখের উপর এসে পড়ছে। সানান ভাই ভাবল, সূর্য কি আজকাল দক্ষিণ দিকে উঠতে শুরু করেছে?
আলোর লুকোচুরিতে বিরক্ত হয়ে একসময় চোখ খুলতে বাধ্য হলো। চোখের সামনের দৃশ্য দেখে সে চমৎকৃত হলো৷ একটা ক্লান্ত মুখ চোখ বন্ধ করে তার সামনে বসে আছে। সকালের মিঠে রোদ এসে ছুয়ে দিচ্ছে তাকে। তারই হাতের লালচে চুড়ির উপর এসে পড়েছে এক ফালি রোদ। যা প্রতিফলিত হয়ে লুকোচুরি খেলছিল সানান ভাইয়ের সাথে৷
ঘুমনাশিনী সেই আলোকরেখার দিকে সানান ভাইয়ের মনোযোগ নেই। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল প্রভাত দেবীর দিকে। কী অপরূপ তার রুপের ছটা! দেহ মনের সমস্ত ক্লান্তি মিটিয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় ক্ষুধা, যন্ত্রণা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানা নেই৷ কানের কাছে রিনিকঝিনিক চুড়ির শব্দে গাঢ় ঘুমে আবার ব্যাঘাত ঘটল। বিরক্তিতে কপাল কুচকে চোখ মেললে কাউকে দেখা গেল না। পাশ ফিরে আবিষ্কার করল সায়রাকে। সে এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তারই পাশে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে ডাকছে সাঁঝ।
– সায়রা, ওঠো এবার। আর কত ঘুমাবে?
সানান ভাইয়ের কপালে সমান্তরাল ভাঁজ পড়ল। চোখ দুটো সরু করে বলল,
– সকালবেলা এভাবে চিল্লাচিল্লি করতেছিস কেন? তুই কি মোরগ?
সদ্য ঘুম থেকে উঠায় সানান ভাইয়ের কণ্ঠ ভারি ও মোটা শোনাচ্ছে। তবে সচারাচর যেমন তীক্ষ্ণ শোনায় তেমন নয়। খানিকটা সুরেলা, খানিকটা মোলায়েম। সাঁঝ থমথমে খেয়ে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
তখনি তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করল সানান ভাই৷ গায়ে এখনো গতকালের খয়েরি শাড়ি। জায়গায় জায়গায় ভাঁজ পড়েছে। কুচি এলোমেলো। ঘুম থেকে উঠায় চুলের খোঁপা এলিয়ে পড়েছে। হাতে একগোছা কাচের চুড়ি দুলে উঠল।
সাঁঝ হাত বাড়িয়ে সায়রার বাহু ছুয়েছে মাত্র। সানান ভাই কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠল,
– বিদঘুটে একটা শাড়ি পরে চোখের সামনে লাফালাফি করতেছিস কেন? ষাঁড়ের মতো লাগতেছে তোকে। লাল ষাঁড়। রঙ দেখেই চোখ জ্বলে যাচ্ছে আমার। দূর হ সামনে থেকে।
সাঁঝ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সারারাত সেবা করার পর সকালবেলা এমন রূঢ় আচরণ সে প্রত্যাশা করেনি৷ একটুখানি নমনীয়তা তার কাম্য। কেউ এতো কৃতঘ্ন হতে পারে, জানা ছিল না সাঁঝের৷
সায়রাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে সাঁঝ চলে গেল। যাওয়ার আগে অবশ্যই সাভিন-সাবিলের পিঠে একটি করে কিল বসিয়ে তাদেরও ঘুম থেকে টেনে তুলতে ভুলল না। আকস্মিক আঘাতে ওরা দুই ভাই তখনো হতভম্ব। বোনের দ্রুতগামী পায়ের সাথে তালমিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে।
রান্নাঘর থেকে বড় মায়ের ডাক সাঁঝ দৃঢ় কণ্ঠে প্রত্যাখান করল।
– বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হবো বড় মা। কাল থেকে এক কাপড়ে আছি। এভাবে খেতে পারব না।
সাঁঝ ভেবেছিল, এই যে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আসবে না রাক্ষসটার বাড়িতে। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসতেই সাভিন এসে মায়ের মোবাইলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
– সানান ভাই কল দিয়েছে৷ তোমার সাথে কথা বলবে।
টেবিলের সবাই এমনভাবে সাঁঝের দিকে চেয়ে আছে যেন সাঁঝের সামনে অমৃতের পাত্র। সেটা কতক্ষণে সাঁঝ গ্রহণ করবে তার অপেক্ষায় তাদের প্রাণ যায় যায় দশা।
মৃদুস্বরে হ্যালো বলামাত্র ওপাশ থেকে একটা কাক তার কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল।
– ফ্রেশ হওয়ার নাম করে কোন সরোবরে জলকেলি করতে নেমেছিস? এতক্ষণ লাগে ফ্রেশ হতে? আহামরি সুন্দর হলেও না হয় মানতাম যে সুন্দর মানুষের গা ধোয়াধুয়িতে অনেক সময় লাগে। তোর কীসের জন্য এত সময় লাগতেছে?
যে বিষ উদগীরণে ইচ্ছে সাঁঝের মনে জেগেছে সেটা মনের ভেতর দাফন করে ফেলে ভদ্রভাবে সাঁঝ বলল,
– বাড়িতে নাস্তা বানানো হয়েছে। আমি এখানেই খেতে বসেছি।
– খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে এই মুহূর্তে চলে আয়। সাথে তোর সাগরেদ দুটোকেও নিয়ে আসবি৷ মানুষ না খেয়ে উনার জন্য বসে আছে আর উনি খেতে বসেছেন৷ লজ্জা করে না তোর? কোন মহান ব্যক্তি তুই? রানী ভিক্টোরিয়া?
– আসতেছি।
কল কেটে দিয়ে বিরক্তিভরা চাহনিতে সাভিন-সাবিলের দিকে তাকালো সাঁঝ। হতাশ কণ্ঠে বলল,
– নাস্তা খেতে ডাকতেছে। চল।
নিজের উৎসাহের থেকেও মায়ের তাড়া বেশি৷ স্বর্ণলতা পারলে তখনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তিনটাকে ঘর থেকে বের করে দেন। বাধ্য হয়ে এঁটো হাতে তিনজনে খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিজের মা যখন বিভীষণের মতো আচরণ করে তখন বাইরের রাবণকে কতটুকুই বা দোষ দেওয়া যায়!
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#এই_সাঁঝবাতি? পর্ব: ৩২
একটি পরিত্যক্ত দালান, যা একদা একসময় সরাসরি ডাকঘর ছিল। যাতে একটি মাত্র কক্ষ। পাশে নামমাত্র একটি বাথরুম৷ টানা বারান্দার সামনে টিউবওয়েল বসানো। এটিই আজমের ক্লাবঘর। কক্ষের অভ্যন্তরে একটি ডেস্ক এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার৷ যেগুলোতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে কতোজন যুবক। সবারই মুখ অন্ধকার৷ চোখে হতাশা৷ পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে তাদের দীর্ঘশ্বাসে। অথচ যার জন্য তাদের এই দুঃখবিলাস সেই ব্যক্তিটি জানালার পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসে আছে নির্লিপ্ত মুখে৷
দুপুরবেলা খেয়ে-দেয়ে অলস যুবকেরা এসে বসেছিল এই কক্ষে৷ এখন সূর্য নিভুনিভু করছে৷ পাখিরা গলা ছেড়ে চিৎকার করে ঘরে ফিরছে৷ অথচ এখানে কারো মুখে কোনো কথা নেই৷ দীর্ঘ নিরবতায় বিরক্ত হয়ে একসময় আজম বলল,
– কী করবি কিছু ভেবেছিস?
প্রশ্নটা করা হয়েছে সানান ভাইকে৷ অথচ সে এমনভাবে ঘুরে তাকাল যেন গহীন আঁধার হতে ধুপ করে আলোয় পতিত হয়ে বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে।৷ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আজমের কথাগুলো মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করল৷ তারপর নির্লিপ্ত মুখে জবাব দিল,
– ভাবাভাবির কি আছে?
উত্তর শুনে অবাক হলো সকলে। সানান ভাই কখনো মুখে স্বীকার করেনি ঠিকই, কিন্তু কথা ও কাজে অনেককিছুই তারা বুঝে নিয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে পড়ে নিয়েছে অজানা অভিব্যক্তি। তবে আজ কেনো এই নির্লিপ্ততা?
সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে ভয় হয়৷ এখানে উপস্থিত সকলের মধ্যে একমাত্র আজম সরাসরি সানান ভাইয়ের সাথে কথা বলার সাহস রাখে৷ অথচ এরা দেখেছে আজমও এই বিষয়টিকে সাবধানে এড়িয়ে চলে৷
হতাশ যুবকেরা ব্যাকুল হয়ে আজমের দিকে তাকাল। আজমের চেহারায় অবশ্য কোনো উদ্বেগ দেখা গেল না৷ যেন সে সানান ভাইয়ের অনুভূতি সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডানে-বামে ঘুরে কোমরের খিল ভাঙল। আগ্রহী কণ্ঠে বলল,
– তোর পরিকল্পনাটি কি বলতো।
সানান ভাই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে সরু চোখে তাকালে আজম হড়বড় করে বলল,
– না মানে, আমাদের আগে থেকে জানা থাকলে ভালো হতো। সাদিক আঙ্কেলের সাথে সেদিন আলাপ হলো। উনার মুখে শুনলাম ছেলে পক্ষ বেশ আগ্রহী। দু এক দিনের মধ্যে সমাচার এলো বলে। ওপাশ থেকে গ্রীন সিঙনাল পাওয়া মাত্র তিনি বিয়ের আয়োজন শুরু করতে চান। মেয়ের বিয়েতে আর দেরী নয়৷ তুই ও বাড়ির ছেলে৷ তাই তোর কাছে জানতে চাইছি। আমরা কি বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার প্রিপারেশন নিব?
সকলে শ্বাস আটকে বসে রইল। আজমের বুদ্ধি আছে বটে৷ সরাসরি প্রশ্ন না করে কেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সানান ভাইয়ের মনের খবর জানতে চাইল! প্রশংসা না করে পারা যায় না। তারা উত্তরের আশায় অপলক চোখে সানান ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু সে ব্যক্তি রহস্যজনক হেসে বলল,
– তাই নাকি! বিয়ে আয়োজন হচ্ছে অথচ আমি খবর পেলাম না। বড় দুঃখজনক ব্যাপার!
সকলে আশাহত হলো। ধুর! সানান ভাইটা এমন কেনো? সে কি কোনোদিন মুখে স্বীকার করবে না? কখনো কি বলবে না নিজের মনে কথা?
সানান ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আজমের কাছে এসে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
– চল ধানমন্ডি যাই।
আজম হতভম্ব হয়ে বলল,
– এখন ধানমন্ডি কেনো?
– কাজিনের বিয়ে বলে কথা৷ বংশের বড় ছেলে হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না? ওখানে ছেলের বোন জামাইয়ের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চল খোঁজ খবর নিয়ে আসি৷
নিমরাজি আজমকে একপ্রকার জোর করে সাথে নিয়ে চলল সানান ভাই৷ বাকিরাও পিছু নিল। সানান ভাইয়ের অব্যক্ত অনুভূতির প্রতি তাদের বিশেষ আগ্রহ।
ধানমণ্ডির এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে বসে চিকেন শর্মা খেতে খেতে ওরা বিশেষ কোনো ঘটনার অপেক্ষা করল। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না।
ভরপেট খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আরেকজন যুবকের সাথে দেখা হলো৷ অচেনা যুবকটির সাথে সানান ভাই একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে এসে বলল,
– চল লেকের পাড়ে গিয়ে বসি৷
অচেনা যুবকটি উল্টোদিকে হেঁটে যাচ্ছে৷ আজম সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ভরে প্রশ্ন করল,
– ওই ছেলেটা কে?
– পরিচিত। একসময় শীতলায় জব করত।
– তুই ওকে নিজের মোবাইলটা দিয়ে দিলি কেনো?
– কয়েক ঘন্টার জন্য ধার দিলাম৷
– কেনো?
– বেচারা কখনো আইফোন ইউজ করেনি৷ তাই দিলাম। কিছুক্ষণ আইফোন ইউজ করে দেখুক। ফিল নিক।
সানান ভাইয়ের হেয়ালি কথাবার্তায় সকলে অবাক হলেও বাক্যব্যয় করল না। রাতের ব্যস্ত শহরের বুকে ছুটে চলল ছয়টি বাইক।
*
পরদিন সন্ধ্যায় বারান্দার মেঝেতে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছিল সাঁঝ। সেইসাথে গুনগুন করে গান গাইছে। কোথা থেকে দস্যুর মতো ছুটে এলো সাবিল। পাগলা হাওয়ার মতো এসে হড়বড় করে বলল,
– মা তোমাকে ডাকছে।
আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠেছে সাঁঝ৷ হাত কেঁপে আলতা ঘেটে গেছে। পায়ের মাঝখানে যে বৃত্তটি সে আঁকছিল সেটি ডিম্বাকার আকৃতির হয়ে গেল। সাঁঝ বিরক্ত ভরে সাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
– পরে যাচ্ছি।
– পরে নয়। এক্ষুণি যেতে বলল।
সাঁঝ বিরক্ত হয়ে আলতার বাটি সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো। ডাইনিং টেবিলে বসে সবজি কুটছিলেন সাঁঝের মা। মেয়েকে দেখে বললেন,
– বড় ভাবি তোকে ডেকে পাঠিয়েছে।
– কেনো?
– জানি না। শুধু বলল, ফ্রি থাকলে তোকে যেন পাঠিয়ে দেই।
– আমি ব্যস্ত৷
– কি এমন মহাকার্য করছ তুমি শুনি।
– পরে যাই।
– এক্ষুণি, একমুহূর্তে যাবি৷ বেয়াদব মেয়ে, মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছে।
সাঁঝ মুখ কুচকে রওনা দিল। সে যদি প্রথমবারেই বলত, ঠিক আছে যাচ্ছি। তাহলে মা এমন ধরে-বেঁধে এক্ষুণি পাঠিয়ে দিত না। ভুলটা সাঁঝেরই। সে জানে, মায়ের বিরোধিতা করলে তাঁর জেদ বেড়ে যায়।
এ বাড়ি এসে শোনা গেল, বড় মায়ের সুপুত্রের শখ হয়েছে তালের ক্ষীর দিয়ে রুটি খাবে৷ অনেক খুঁজে কোন বন্ধুর বাড়ি থেকে গাছপাকা তাল নিয়ে এসেছে৷ চালের আটাও কেনা হয়েছে। কিন্তু ক্ষীর বানাতে অনেকক্ষণ চুলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেটি বড় মায়ের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তবুও তিনি ছেলের সাধ পূরণের উদ্যোগ নিয়েছেন৷ কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল সানান ভাই৷ বলল,
– দু দিন আগেই কোমর ব্যথা থেকে উঠলে। এখন আবার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে৷ তার থেকে ভালো ও বাড়ি থেকে কাউকে আসতে বলো৷ তোমাকে হেল্প করে দিক।
তাই ডাক পড়েছে সাঁঝের৷ রান্নাঘরে পাকা তাল, নারকেল, চালের আটা সহ সকল সরঞ্জাম সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা৷ কোমরে ওড়না বেঁধে চুলগুলো খোঁপা করে নিল সে। পাকা তাল দুটো দু হাতে চেপে দু ভাগ করতে করতে বিড়বিড় করল,
– ও বাড়ি থেকে কাউকে আসতে বলো৷ ইশ! ঢং কতো। যেন ও বাড়ির লোকজনের কাজকর্ম নেই। সারাদিন অন্যের সাহায্য করার বাসনায় বসে বসে জাবর কাটে৷ ঠিকই জানে, মা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত৷ দাদী অসুস্থ। আর বাকি রইল কে? অবশ্যই কপালপোড়া সাঁঝ৷ দেখেছে এই আমাকেই। দুদণ্ড বসে থাকতে দেখলেই কোনো না কোনো কাজে লাগিয়ে দিবে। হিংসুটে রাক্ষস একটা৷ খাওয়ার এতো শখ তো নিজে বানিয়ে খেতে পারে না?
– একা একা কি বলতেছিস?
তালের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে আপনমনে বিড়বিড় করছিল সাঁঝ। কখন সানান ভাই এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। আকস্মিক কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে বলল,
– কই কী বলতেছি! কিছু না তো।
সানান ভাই কেমন সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে তাকে পরখ করতে লাগল। মাথার চুল থেকে ধীরে ধীরে ক্রমশ নিচের দিকে যেতে লাগল সেই নিরীক্ষণ দৃষ্টি। তারপর থামল পায়ের পাতায়৷ ভ্রু দুটো কি একটু উঁচু হলো? হ্যাঁ, হলোই তো। ঠোঁটের কোণেও একটা বক্রহাসি ফুটে উঠতে উঠতে মিলিয়ে গেল। কিন্তু মিলিয়ে যাওয়ার আগে সাঁঝ ঠিকই খেয়াল করেছে। সেও চকিত তাকাল নিজের পায়ের দিকে। একপায়ে জ্বলজ্বল করছে রাঙা আলতা। অন্য পা খালি৷ এ পায়ে আলতা দেওয়ার সময় পায়নি সে। তার আগেই মা ঘর থেকে বার করে দিয়েছে৷ লজ্জিত সাঁঝ কুণ্ঠায় আড়ষ্ট হয়ে ফ্যাকাশে পায়ের উপর আলতা রাঙা পা রেখে তা আড়াল করার চেষ্টা করল। নত মুখ তুলে তাকাল সানান ভাইয়ের দিকে৷
ওর কম্পিত চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করল সানান ভাই।
আশ্চর্য হলো সাঁঝ৷ রান্নাঘরে কীসের জন্য এসেছিল সেটা না বলে এভাবে চলে গেল কেনো? আজব!
কাজের শুরুতে মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল সাঁঝ৷ কিন্তু ক্রমশ কাজের মধ্যে ডুবে গেল৷ দুটো তাল থেকে অনেকখানি রস পাওয়া গেছে। ক্ষীরের পাশাপাশি আরও কয়েকপদের আয়োজন করল সে৷ আলাদা করে তালের রস জ্বাল করল। দু প্রকার পিঠাও বানালো। অবশ্য সব কাজ একা হাতে করতে হয়নি৷ বড় মা যথাসাধ্য সাহায্য করলেন। তিনি রান্নাঘরে আসেননি ঠিকই কিন্তু ডাইনিং টেবিলে বসে রুটি বানিয়ে দিলেন। নারকেল কুরনি করে দিলেন।
ডাইনিং টেবিল থেকে রুটি আনতে গিয়ে সাঁঝ দেখল নিজের কক্ষ ছেড়ে ড্রয়িংরুমে আসন পেতেছে সানান ভাই। সোফায় আধশোয়া হয়ে টেলিভিশন দেখছে। তার বুকের উপর যথারীতি শুয়ে আছে সায়রা। টুকটুক করে দাদাভাইয়ের সাথে গল্প করছে। সাঁঝ বড্ড অবাক হলো। ভাবল, রাক্ষসটার কী কাজকর্ম কিছু নেই? আজকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও যায়নি। ক্ষীর খাওয়ার জন্য একেবারে প্রাণ যায় যায় দশা।
সে রাত্রে বাড়ি ফেরা হলো না সাঁঝের৷ কাজকর্ম শেষ হতে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। তবুও সে বড় মাকে বলেছিল বাড়ি ফেরার কথা৷ তিনি রাজি ছিলেন৷ বললেন,
– সাথে করে কয়েকটা পিঠা বাড়িতে নিয়ে যা।
ক্ষীর, তালের রসের সাথে পিঠা প্যাকেট করে সাঁঝের হাতে তুলে দিয়ে তিনি নিজে সাঁঝকে এগিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। কিন্তু সেখানেও রাক্ষসটা এসে বাগড়া দিল। ভরপুর খেয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– এত রাতে বাড়ি ফেরার কি দরকার? সায়রার সাথে ঘুমাতে বলো ওকে৷
সাঁঝ তড়াৎ করে লাফিয়ে উঠে বলল,
– নাহ, নাহ৷ আমি বাড়ি যাব। এত রাত কোথায়? সবে মাত্র এগারোটা বাজে। বেশি দূরে তো যাব না। দু কদম হাঁটলেই বাড়ি।
– বাড়ি ফেরার জন্য এত উতলা হয়েছিস কেন? কি ফেলে এসেছিস বাড়িতে?
সানান ভাই এমন সন্দেহভাজন চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলেন যে বড় মা, বড় বাবা সবাই কৌতুহল নিয়ে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে রইল। এতোগুলো সূক্ষ্ম চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সাঁঝ হার মানতে বাধ্য হলো৷ খাবার প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে গুটিগুটি পায়ে সায়রার রুমের দিকে চলে গেল। অবশ্য যেতে যেতে সানান ভাইয়ের পিণ্ডি চটকাতে ভুলল না। কেনো ওকে এভাবে আটকে রাখছে এ বাড়িতে?
*
রাতের বেলা ঘুমানোর সময় প্রতিটি ব্যক্তির প্রত্যাশা থাকে সুন্দর একটি সকালের৷ সাঁঝও এমনি একটি সকালের আশা নিয়ে ঘুম থেকে উঠেছিল। কিন্তু কে জানত নরক স্বরূপ একটি দিন তার জন্য অপেক্ষা করছে৷ যদি সে জানত তবে কখনোই চাইত না এ রাতের ভোর হোক। প্রশান্তির চিরদীর্ঘ ঘুম বরণ করে নিত সে৷
ঘুম থেকে উঠে বাড়ির দিকে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু গতরাতের হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পর ঘুম ভাঙতে দেরী হয়ে গেল। রুম থেকে বেরিয়ে দেখল সকলে নাস্তার টেবিলে হাজির৷ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আজকে সানান ভাইকেও খাবার টেবিলে দেখা যাচ্ছে৷ যাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকেছিল সকলে।
বড় বাবার আদেশে সাঁঝকে নাস্তার টেবিলে বসতে হলো৷ সবে একটা রুটি ছিড়ে মুখে দিয়েছে, একপ্রকার ছুটে এলো সাবিল। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
– আপুকে মা ডাকছে৷
বড় বাবা অবশ্য তার পাংশুটে মুখখানা খেয়াল করেননি৷ তিনি হাসিমুখে বললেন,
– আয় নাস্তা কর আমাদের সাথে৷
– আমি খেয়ে এসেছি বড় বাবা। মা আপুকে এক্ষুণি যেতে বলছে।
বড় মা বুদ্ধিমতী নারী৷ কথা শুনে কঠিন চোখে সাঁঝের দিকে তাকালেন। যেন প্রশ্ন করছেন, আবার কোন কীর্তি করেছিস তুই? সানান ভাই অবশ্য নির্লিপ্ত মুখে নাস্তা খেতে খেতে বলল,
– দেখছিস না, নাস্তা খাচ্ছে৷ খাবার শেষ করে যাবে। তুই বস।
সাঁঝ প্রত্যুৎপন্নমতি নয়। পরিস্থিতি বুঝতে তার একটুখানি বেশি সময় লাগে৷ এতক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– আমি বরং যাই৷ খুব জরুরি দরকার মনে হচ্ছে।
সকলে মাথা তুলে সাঁঝের ফ্যাকাশে মুখটির দিকে তাকালেও সানান ভাই খাবারের প্লেটে নজর রেখে বলল,
– খাবার শেষ করে যা।
কি খেয়েছে, কতটুকু খেয়েছে সাঁঝের জানা নেই। একটা অজানা ভয় তার সারা শরীর অবশ করে দিচ্ছে৷ সে জানে না, তার দ্বারা আবার কি ভুল সংঘটিত হয়েছে৷ তবে মা যে ভীষণ ক্ষেপে আছে সেই সম্পর্কে সন্দেহ নেই৷ না হলে বড় মায়ের বাড়ি থেকে তাকে এভাবে ডেকে পাঠাবে না।
খাবার শেষে বাড়ি উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় আরেক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। ওদের সাথে সানান ভাইও এলো এ বাড়িতে৷ ট্রাউজারের পকেটে দু হাত গুজে দুলেদুলে হাঁটছিল সাঁঝের পেছনে। সাঁঝ এতকিছু খেয়াল করেনি৷ সে দ্রুত পায়ে বাড়িতে এসে দেখল এত সকালে বাড়িতে সভা বসেছে। সভায় উপস্থিত বাবা, মা, দাদী এবং তাশফীন ভাইয়া। পাশের ঘর থেকে উঁকি দিচ্ছে সাভিন৷ সে বুদ্ধিমান ছেলে। পরিস্থিতি বুঝে আগেই কেটে পড়েছে৷
সাঁঝ এসে দাঁড়ানো মাত্র স্বর্ণলতা একপ্রকার ছুটে এসে খপ করে ওর বাহু চেপে ধরে বললেন,
– ফেসবুক একাউন্ট আছে তোর? কি করিস তুই ফেসবুকে? কবে করেছিস এসব? বল কি কি অপকর্ম করেছিস এতোদিনে? চুপ করে আছি কেন মুখপুড়ি?
হতভম্ব সাঁঝ কথা হারিয়েছে৷ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে শুধু। মায়ের মুখটা রক্তবর্ণ। রাগে, ক্ষোভে রীতিমতো কাঁপছে৷ প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে এক হাতে সাঁঝের এলো খোঁপাটা চেপে ধরে অন্য হাত তুলেছেন প্রহারের উদ্দ্যেশ্যে।
এমন দৃশ্য দেখে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সানান ভাইয়ের শরীরটা একবার নড়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে গেল। এক পা সামনে বাড়িয়ে ছিল। কিন্তু সোফা উঠে থেকে দ্রুত ছুটে এসেছে তাশফীন। স্বর্ণলতার হাত থেকে সাঁঝকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের দেহের আড়ালে ঠাঁই দিয়েছে৷
বাড়ানো পা ফিরিয়ে নিল সানান ভাই৷ পকেটে হাত গুজে শক্ত মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দেখল সম্মুখ দৃশ্যপট।
সাঁঝের এলোমেলো চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাশফীনের শার্ট আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে৷ ওকে আলতো হাতে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল তাশফীন৷ মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লেন সাঁঝের মা।
আহত হৃদয়ের কষ্টরা নোনাজল হয়ে ঝরতে লাগল।
সানান ভাই দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তিভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
– কি হয়েছে?
মুখ অন্ধকার করে মাথায় হাত রেখে বসে ছিলেন সাঁঝের বাবা৷ প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে তাকালেন না৷ ভারি কণ্ঠে উত্তর দিলেন। যেন কথা বলতে উনার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে৷
– গতরাতে তোফায়েলের বাড়ি থেকে কল এসেছিল৷ উনারা না করে দিয়েছে।
সাঁঝ অবাক চোখে বাবার দিকে তাকাল। সানান ভাই অবশ্য নির্লিপ্ত৷ বেপরোয়াভাবে জবাব দিল।
– না করে দিয়েছে তো কি হয়েছে? এজন্য ওকে মারধর করার করা হচ্ছে কেন, বুঝতেছি না।
– কারণ ওর দোষে এত ভালো একটা ঘর ফিরে গেছে।
প্রচণ্ড রোষ নিয়ে জবাব দিল সাঁঝের মা৷
– কি করেছি আমি? আমাকে বকছ কেনো?
– কোথায় কোন ছবি তুলে বেড়িয়েছিস আবার মুখে বড় বড় কথা৷ তোর জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব আমি। নষ্টা মেয়ে মানুষ কোথাকার।
মত্ত হাতির মতো মেয়ের দিকে ছুটে গেলেন স্বর্ণলতা। তাশফীন এগিয়ে এসে উনাকে দু হাতে আগলে নিয়ে থামাল।
– তুমি শান্ত হও খালামণি৷ বিয়েতে এসব খুবই নর্মাল ব্যাপার। তুমি অযথা এত রিয়েক্ট করছ৷ এরেঞ্জ ম্যারেজে এমনি হয়৷ ছেলেপক্ষ আসবে, দেখবে, রিজেক্ট করবে। তাই বলে তুমি প্রতিবার মেয়েকে ধরে মারবে নাকি?
– তুই এখনো ভাবছিস এই মেয়ের বিয়ে হবে? কে বিয়ে করবে ওকে? রংঢং করে ছবি তুলে নেটে ছেড়ে দিয়েছে৷ কত লোকে দেখেছে কে জানে! এই লোকটাকে হাজারবার বারণ করেছিলাম। মেয়ের হাতে মোবাইল দিও না। মেয়ে এখনো ছোটো। কখন কোন অকাজ করে বসে। কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি। আহ্লাদ করে মেয়ে মানুষ করেছে। এখন মজা বুঝুক। ঘরে বসিয়ে রাখুক মেয়েকে। আমি আর কিচ্ছুটি বলব না।
মায়ের আহাজারির থেকেও বাবার অপরাধী চেহারাটা সাঁঝকে বড্ড পোড়ালো। সে ঠোঁট ভেল্টে কান্না করতে করতে নিজের রুমে ঢুকে দোর দিল।
আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে তাশফীন উঠে দাঁড়াল। প্রস্থানের আগে স্বর্ণলতাকে বলল,
– ওকে গালাগালি করো না। তোমার থেকেও কষ্ট বেশি বেলা পাচ্ছে। ছেলেপক্ষ ওকে রিজেক্ট করেছে৷ একটা মেয়ের পক্ষে এটা কতো অসম্মানজনক সেটা তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। আমি এখন যাই। রাতে আবার আসব।
সানান ভাই অবশ্য বিনাবাক্য ব্যয়ে প্রস্থান করল। বাড়ি না ফিরে মোড়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। আজমকে কল দিয়ে তার শান্তির ঘুম নষ্ট করে দিয়ে চায়ের দাওয়াত দিল। নিদ্রাহীন আজমের চোখ দুটো লাল। বিরস মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
– এত সকালে কি মনে করে ঘুম থেকে উঠেছিস?
– ঘুমাইনি তাই ঘুম থেকে উঠার প্রশ্ন আসছে না।
– কী উপলক্ষে এই নির্ঘুম রাত্রিযাপন?
– দুঃখে, কষ্টে, অপমানে। আমাদের বংশের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে সেটা আমাদের সবার জন্যে অপমানের, তাই না?
আজমের ঘুম ততক্ষণে উড়ে গেছে। মার্বেলের মতো গোলাকার চক্ষু দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম৷ বিস্মিত হয়ে বলল,
– ভেঙে গেল মানে? কী করে ভাঙলি?
সানান ভাই ততোধিক বিস্ময় নিয়ে বলল,
– ভাঙলি মানে? আমি কেন বিয়ে ভাঙতে যাব? আশ্চর্য!
আজমের বিশ্বাস হলো না। সে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে সানান ভাই আত্মপক্ষে সাফাই দিল।
– কালকে আমি সারাক্ষণ তোর সাথে ছিলাম। আমদোর পুরো গ্যাং লেকের পাড়ে বসে ছিল৷ বিয়ে পণ্ড করায় আমাদের কারো কোনো হাত নেই। আছে বল?
– নাহ। একদম নেই। কিন্তু কীভাবে কি হলো সেটা ভাবছি।
চিন্তিত আজমকে এড়িয়ে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিল সানান ভাই। পা দোলাতে দোলাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– ছেলেটাকে বোধহয় সাঁঝবাতির খুব পছন্দ হয়েছিল৷ বিয়ে ভাঙায় বেচারি খুব কষ্ট পেয়েছে। ঠোঁট ভেল্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখলাম। একবারের দেখায় ভালোটালো বেসে ফেলেনি তো, মামা?
আজম রুষ্ট চোখে সানান ভাইয়ের তাকিয়ে রুঢ়ভাবে বলল,
– বাসলেও বাসতে পারে। তাতে তোর কি?
– হুম। সেটাও অবশ্য ঠিক। আমার কি!
*
তোফায়েলের ছুটির এখনো এক সপ্তাহ বাকি। অথচ সকালবেলা সে ব্যাগ গুছাতে শুরু করেছে৷ তা দেখে তোফায়েলের মা কষ্ট পেলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। তোফায়েলের বোন দুজন ভাইকে মানানোর চেষ্টা করছে।
– এখনো ছুটি শেষ হয়নি৷ আর কয়েকটা দিন থেকে যা।
– এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকব না। তোমরাই থাকো। পারলে তোমাদের জামাইকেও নিয়ে এসো।
– এই বাড়িতে থাকতে না চাইলে আমার সাথে চল। কয়েকদিন ঘুরে আয়। ভালো লাগবে।
– তোমাদের কাউকে আর ভালো লাগছে না।
– একটা সামান্য মেয়ের জন্য তুই আমাদের সাথে এমন আচরণ করছিস?
তোফায়েলের মা তীব্র ঘৃণা নিয়ে বললেন,
– সামান্য মেয়ে বলছিস কেনো? যে মেয়েকে একবার দেখে তোর ভাই পাগল হয়ে যায় সে মেয়ে কোনো সামান্য মেয়ে হতেই পারে না। ও বড় মায়াবিনী। ছেলে আমার না মানছে মা, না মানছে বোন। যে মেয়ে বিয়ের আগেই আমার ছেলের মাথা খারাপ করে দিয়েছে, তার সাথে বিয়ে হলে এই ছেলের কি হাল হবে ভেবে দেখ৷
– গতকাল পর্যন্ত তুমি সাঁঝের গুনগান গাইছিলে৷ আর আজকেই ও মায়াবিনী হয়ে গেল? বাহ! চমৎকার তোমাদের বিচারব্যবস্থা।
– তোফায়েল, মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছিস কেনো?
– কেনো বলব না? তোমরা কেউ আমার পছন্দকে গুরুত্ব দিচ্ছ না। কোথাকার কোন লোকের কথা শুনে বিয়ে ভেঙে দিলে।
– কোথাকার কোন লোক নয়। ছেলেটা তোর দুলাভাইয়ের পরিচিত। আর ছবিগুলো মিথ্যে নয়৷ ওই ছেলের ফোনে স্ক্রিনশট ছিল৷ মেয়েটার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করা ছবি উনি নিজের চোখে দেখেছেন। এখন কি বলবি তোর দুলাভাই মিথ্যে কথা বলতেছে?
– ফেসবুকে ছবি দিয়েছে তো কি হয়েছে? এখন সবাই কমবেশি নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে।
– আমাদের বাড়ির মেয়ে-বউরা এমন নয়। সেটা ভুলে যাস না। একটা পরিচিত ছেলের মোবাইলে তোর বউয়ের ছবি আছে, ব্যাপারটা তোর ভালো লাগবে?
তোফায়েল মিনমিন করে বলল,
– বিয়ের পর আমি ওকে বারণ করে দিব।
– আমরা তোর জন্য এর থেকে সুন্দর মেয়ে খুঁজে আনব৷ সবে মেয়ে দেখা শুরু হলো। এক্ষুণি এতো উতলা হলে চলে!
তোফায়েলের খুব বলতে ইচ্ছে হলো, আমার ওকেই লাগবে আপা।
কিন্তু মা-বোনের সামনে এতোটা নির্লজ্জ সে হতে পারল না। শুধু ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বলল,
– ভালো লাগছে না আপা। কয়েকটা দিন ঘুরে আসি। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসব।
চলবে..
#অক্ষরময়ী