অচেনা অতিথি পর্ব-০২

0
14

#অচেনা_অতিথি (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

নয়নের প্রস্তাবে বেলী রাজি হয়। নয়ন প্রথমে তার গল্পটা শুনতে চায়। বেলী বলতে শুরু করে,“আমার গল্পটা বলার মতো কিছু না। ছোটবেলায় বাবা, মা হারিয়ে অনাথ হয়ে যাই। আশ্রয় হয় চাচার ঘরে। এক কথায় তার বাড়ির কাজের লোক হিসাবে বড় হই। যে কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে দুই বেলা ভাত জুটতো লবন দিয়ে। কখনো বা একটু তরকারির ঝোল পাতে পড়তো। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম চাচার নজর খারাপ। আজ তো সীমা ছাড়িয়ে ফেললো। আমি এসব কথা যখন সবাইকে বলি সবাই আমাকেই তাড়িয়ে দেয়। অতঃপর আপনার ঘরে জায়গা হয়। এটাই আমার জীবন।”

“এত সংক্ষেপ জীবন কাহিনি?”
এটা শুনে বেলী হাসে। সে হাসি মুখে বলে,“এই গল্পটা বিস্তারিত শুনতে চান? শুনে লাভ৷ সেই তো দু মুঠো ভাতের জন্য কত হাহাকার করেছি, কত লাঞ্ছনা বঞ্চনা সহ্য করেছি সেই কথা বলতে গিয়ে কান্না করে দিবো। অচেনা এক মেয়ের কান্নার সাক্ষী নাই বা হলেন।”
এই কথা শুনে নয়ন মৃদু হাসে। সে বলে,“একটু নাহয় কান্নার সাক্ষী হলাম৷ ক্ষতি কোথায়?”

নয়নের কথা শুনে বেলী নয়নের দিকে তাকায়। তার স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায় সেই অত্যাচারের দিনগুলো। যা বলতে গিয়ে সে সত্যি কান্না করে দেয়। তার কান্নারত মুখ দেখে নয়ন আস্তে এসে তার পাশে বসে। বেলী যেই মূহুর্তে উপলব্ধি করে নয়ন তার পাশে এসে বসেছে সেই মূহুর্তে ঘাবড়ে যায়। এটা দেখে নয়ন বেলীর হাতে হাত রাখে। খুব শান্ত গলায় বলে,“হোক না অচেনা। তুমি আমার অতিথি। তোমার সম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। তাই ভয় পেও না। হ্যাঁ আমি পুরুষ মানুষ। একটু অবিশ্বাসের বস্তু। তবে এই মূহুর্তে বিশ্বাস করতে পারো। কারণ আর যাই হোক কোন অসহয় মেয়ের সারাজীবনের কান্নার কারণ আমি হবো না। এত নিকৃষ্ট আমি নই।”

এই কথা শুনে বেলী নয়নের চোখে চোখ রাখে। তার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে। নয়ন ম্লান হেসে বলে,“মানুষের জীবনে কত রকমেরই তো দুঃখ থাকে। তোমার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী মানুষও রয়েছে। তাই তাদের কথা ভেবে নিজের এই চোখের পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো। হয়তো পৃথিবীর কোন প্রান্তে তোমার চেয়ে করুণ অবস্থায় কেউ একজন রয়েছে। তার ধৈর্যের কথা চিন্তা করে চোখটা মুছে নাও।”

হঠাৎ করে নয়নের এই কথাটি বেলীর ভালো লেগে যায়। সে নয়নের চোখে চোখ রেখেই থাকে। নয়ন শান্ত গলায় বলে,“কাল সকালে কোথায় যাবে?”

“জানি না। হয়তো চাচার বাড়িতে গিয়ে সবার হাতেপায়ে ধরে আবার আশ্রয় নিতে হবে। আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আর আপনি নিশ্চয় অতিথি সারাজীবন রাখবেন না। আশ্রিতা সারাজীবন ঘরে রাখা যায় কিন্তু অতিথি নয়।”
বেলীর এই কথা শুনে নয়ন হাসে। সে জবাব দেয় না। নয়নের হাসি দেখে বেলী প্রসঙ্গ বদলে বলে,“আপনার জীবন গল্পটা বলুন।”

“এই তো। ধনী বাবা, মায়ের একমাত্র ছেলেরা যেভাবে বড় হয় সেভাবেই বড় হওয়া। জীবনটা খুব সুন্দর কেটেছে। একদম তোমার বিপরীত।”
এটা বলে নয়ন থেমে যায়। বেলী মনমরা গলায় বলে,“বলেন না গল্পটা। চিন্তা নাই। আপনার সুখের গল্পে এই দুঃখী মেয়েটা কষ্ট পাবে না।”
এটা শুনে নয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নয়নকে চুপ করে থাকতে দেখে বেলী অবাক হয়। সে বলে,“চুপ করে রইলেন যে?”

____
২.
বাহিরে বৃষ্টি। ঘরের মধ্যে নিরবতা। সেই নিরবতার মাঝে দুটি হৃদয় একে-অপরের মনের কথা জানান দিচ্ছে। নিরবতার মাঝেই প্রেমা এবং জারিফ গভীর ভালোবাসার সাগরে ডুব দিয়েছে। অতঃপর নিরবতা ভেঙে প্রেমা বলে,“এভাবেই সারাজীবন ভালোবাসবে তো?”

“হ্যাঁ বাসবো।”
জারিফের কথা শুনে প্রেমা মুচকি হাসে। সে মুখে হাসি ধরে রেখে বলে,“সত্যি তো?”

“এটা মিথ্যে হতে পারে বলো?
তুমি এমন একজন মানুষ তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায়। তাছাড়া ভালোবাসার প্রমাণ কতবার দিবো বলো তো? তুমিও তো একটু ভালোবাসার প্রমাণ দাও।”
এটা শুনে প্রেমা জারিফের বুকে আলতো করে মে রে বলে,“আমি ভালোবাসার প্রমাণ দেইনি?”

“আমার মতো দাওনি।”

“তোমার চেয়ে বেশি দিয়েছি।
চিন্তা করো না। আজকের এই রাতটা পার হোক। অতঃপর তুমি আমার ভালোবাসার সমস্ত প্রমাণ পেয়ে যাবে।”
এটা শুনে জারিফ হাসে। সে প্রেমার কপালে চুমু দিয়ে বলে,“আমি জানি তো তুমি আমাকে ভালোবাসো। খুব ভালোবাসো। তাই তো তোমায় নিয়ে সারাজীবন সুখের এক সংসার কাটাতে চাই।”

“চিন্তা করো না।
আমাদের সংসার সারাজীবন খুব সুখেরই হবে।”
এই কথা শেষে জারিফ এবং প্রেমা আবারও ভালোবাসার সাগরে ডুব দেয়। জারিফের ভালোবাসায় বরাবরের মতো প্রেমা মুগ্ধ হয়। তার মন সবসময় বলে,“জারিফ জীবনে না এলে আমার কখনো জানাই হতো না, ভালোবাসা এত সুন্দর। এত মধুর হতে পারে।”
পরক্ষণে সে আবার বলে,“বাবা, মা স্যরি। আমার সিদ্ধান্ত ভুল নয়। একদম ভুল নয়।”
____

“সবার জীবনে কখনো না কখনো দুঃখ আসেই।
সারাজীবন সবাই সুখী থাকতে পারে না। তাই আমার গল্পটা যে শুধু সুখের তা নয়।”
এটা বলে নয়ন আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেলী কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,“আপনার জীবনেও দুঃখ রয়েছে।”

“হ্যাঁ।”
এটা বলে নয়ন তার গল্প বলতে শুরু করে৷ নয়ন ব্যক্তি জীবনে খুব সুখীই ছিলো। পড়ালেখা শেষে বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। তাদের অফিসের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে সে। অতঃপর বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের চার বছরেও তাদের কোন বাচ্চা হচ্ছিলো না। এখান থেকে ঝামেলার শুরু। তার সুখের জীবনটা শেষ হতে শুরু করে। সে নিজের স্ত্রীকে এতটাই ভালোবাসে যে তাকে ছাড়া তার পৃথিবী শূন্য মনে হয়। তার স্ত্রী এই দেশ ছেড়ে বিদেশে স্যাটেল হতে চায়নি। তার খুশির জন্য বাবা, মায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় নয়নের। তার বাবা, মা চেয়েছিলো এখানের সব বিক্রি করে বিদেশেই স্যাটেল হয়ে যাবে। কিন্তু নয়ন যায়নি৷ তবে সে বাবা, মাকেও দেশে আটকে রাখেনি। তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও তার বাবা, মা তাকে ছাড়া একা থাকতে চাইছিলো না। কিন্তু নয়নকে যে এখানেই থাকতে হতো। তার স্ত্রীর খুশির জন্য। নয়ন নিজের স্ত্রীর খুশির জন্য সব করেছে। শুধুমাত্র ভালোবাসে বলে। সেই স্ত্রীর সঙ্গে এখন বনিবনা হচ্ছে না তার। সবসময় ঝগড়া হয়। অথচ নয়ন এটা চায়নি। সে তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে। প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। পরিশেষে…।

এতটা বলতে গিয়ে নয়ন থেমে যায়। বেলী নরম গলায় বলে,“আপনাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। বুঝলাম। সেজন্যই খুব দুঃখী এবং চিন্তিত লাগছে আপনাকে?”
নয়ন এটা শুনে চুপ করে যায়। সে জবাব দেয় না। বেলীও চুপ করে যায়। অতঃপর নিরবতা ভেঙে নয়নই বলে,“আমি বিচ্ছেদ চাই না। আর আশা করি আমার স্ত্রীও চায় না। সে আমার উপর রেগে আছে জানি। কিন্তু কাল যদি আমি তাকে গিয়ে নিয়ে আসি তবে সে সব ভুলে আবার আমায় আপন করে নিবে। আর আমি এটাই চাই। আমাদের মাঝের সব দূরত্ব শেষ করতে। সেটা নিয়েই চিন্তিত। আসলে কিভাবে মান ভাঙাবো সেটা নিয়ে ভাবছিলাম।”

“ওহ আচ্ছা।”
এটা বলে বেলী চুপ হয়ে যায়। বেলীর নিরবতা দেখে নয়ন তার ফোনের দিকে তাকায়। ফোনে কোন নেটওয়ার্ক না দেখে হতাশ হয়। এমন সময় সে বেলীর দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। বেলীর বুক থেকে আঁচলটা নিচে পড়ে যায়। সেটা দেখেই সে হতভম্ব হয়েছে। বেলী অবশ্য এখনো লক্ষ্য করেনি। সে ভাবুক হয়ে বসে আছে। এটা দেখে নয়ন শান্ত গলায় বলে,“কাপড়টা ঠিক করো।”

বেলী হতচকিয়ে যায়। সে নয়নের কথার ভাবার্থ বুঝে নিজের দিকে লক্ষ্য করে তৎক্ষনাৎ বুকের আঁচলটি তুলে কিছুটা দূরে সরে যায়। বেলীর এমন কান্ড দেখে নয়ন বলে,“এত ভয় পেতে হবে না। প্রথমত আমি বিবাহিত, দ্বিতীয় তুমি আমার অতিথি। তাই ভয় নেই। তবে হ্যাঁ সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো। তুমি একজন মেয়ে। নিজের পোশাকের নিয়ন্ত্রণ নিজেকেই রাখতে হবে। কারণ এই সমাজে নারীর সম্মান অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
এটা শুনে বেলী যে কথাটি বলে তা শোনার জন্য নয়ন প্রস্তুত ছিলো না। বেলী বলে….


চলবে,