কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-০৪

0
16

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-৪

ঝিলমিল সন্ধ্যের পর ফিরলো। আসমা জিজ্ঞেস করলেন,

“কিরে কিছু কিনলি না?”

“পছন্দ হলো না মা। ”

টুটুলের জন্য বার্গার এনেছে একটা। ও বার্গার খেতে ভালোবাসে খুব। আসমা দেখলেন আজ ঝিলমিল অনেক টা স্বাভাবিক আচরণ করছে। গত পনেরো ষোলো দিন এমন ছিলো যে তার বারবার মনে হয়েছে মেয়েটা বোধহয় পাগল হয়ে যাবে।

সন্ধ্যের চা খাবার সময় চারতলার শেলি আন্টি এসেছেন। তিনি মানুষ খারাপ না, কিন্তু মেয়েলী দোষ আছে। ঝিলমিল কিংবা তার মায়ের মুখ থেকে মুখরোচক গল্পটা শুনতে চায়। আসমা খুব একটা কথা বলেন না, তবুও দরদ দেখাতে এরা এসে পড়েন একেকজন।

ঝিলমিল কে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

“এই ঝিলমিল কেমন আছিস?”

“ভালো আছি আন্টি আপনি? ”

“এতো শুকায়ে গেছিস ক্যান? হাড্ডি তো গোনা যায়। ”

ঝিলমিল জবাব দিলো না। আসমা শেলিকে চা সাধলেন না আর।

“ভাবী বাসা ছাড়তেছেন নাকি?”

আসমা জবাব দেবার আগে ঝিলমিল বলল,

“কে বলল এসব আজগুবি কথা?”

শেলি আন্টি থতমত খেলেন। উনি সঠিক খবর ই পেয়েছিলেন। বললেন,

“শুনলাম যে….

ঝিলমিল স্পষ্ট গলায় বলল,

“আমরা শুধু শুধু বাসা কেন ছাড়তে যাব? এমন তো কিছু হয় নি। আপনি কার কাছে এসব খবর পান?”

শেলি আন্টির মুখটা চুপসে গেল। ঝিলমিলের ঠাস ঠাস জবাবে তিনি বাড়তি কথা বলার সুযোগ পেলেন না। তার উপর ওনাকে চায়ের অফার না করায় সূক্ষ্ম অপমানিত বোধ করলেন। তার সামনে বসেই মা, মেয়ে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেল। উনি চলে যাবার পর ঝিলমিল মা’কে বলল,

“মা আমরা কোথাও যাব না।”

আসমা গম্ভীর গলায় বললেন,

“সিদ্ধান্ত যা নেবার নেয়া হয়েছে। কোনো নড়চড় হবে না। আমরা এই পাড়া ছাড়ব ঝিলমিল। সবসময় তোর জেদ চলবে না। ”

ঝিলমিল মায়ের সঙ্গে তর্ক করলো না। ও অপেক্ষা করছে হৃদয়ের। নয়টার দিকে ওর কল করার কথা।

সাড়ে নয়টার দিকে হৃদয়ের বাবা হারুন মোল্লা ঝিলমিল দের বাসায় এলেন। সঙ্গে তার স্ত্রী জাহানারা বেগমও আছেন। আসমা ও জাহাঙ্গীর সাহেব দুজনেই বিস্মিত। তাদের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেখা গেল। ঝিলমিলের বাবা, মা একে অপরকে দেখছেন। তারা আন্দাজ করতে পারছেন না এই অসময়ে এদের আগমনের কারণ কী হতে পারে!

ঝিলমিল নিজেও বুঝতে পারে নি যে এতোটা তাড়াতাড়ি সব ম্যানেজ করার ব্যবস্থা হৃদয় করে ফেলবে। হারুন মোল্লা জাহাঙ্গীর সাহেব কে বললেন,

“চা, টা কিছু দিয়েন না জাহাঙ্গীর ভাই। মান্নানের দোকানের মোরগ পোলাও আসতেছে। এক সাথে খাব সব।”

জাহানারা ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো দেখলেন আর আসমার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বললেন। একই পাড়ায় থাকার সুবাদে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে অনেকবার, কিন্তু বাড়িতে এই প্রথম এলেন। ঝিলমিলের সঙ্গেও কথাবার্তা বললেন একটু।

কিছুক্ষন পর বিবাহ বিষয়ক কথাবার্তা হারুন মোল্লা তুললেন। ঝিলমিলের বাবা, মা দুজনেই অবাক! মা বলে ফেললেন,

“ঝিলমিলের বিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে? ”

জাহানারা তার স্বামীর দিকে তাকালেন। জাহাঙ্গীর সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন,

“আমরা তো মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছি না। ”

ঠিক সেই সময়ে ঝিলমিল বসার ঘরে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করে জানালো,

“মা, আমার আপত্তি নেই। ”

আসমা মেয়ের দিকে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছেন। নিজের কানে শোনা স্বত্তেও কথাটা এতো অবিশ্বাস্য ঠেকছিল তার কাছে। ঝিলমিলের বাবাও ভীষণ অপ্রস্তুত হলেন। এদের সামনে মেয়েকে কিছু বলতেও পারছেন না।

হারুন মোল্লা উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন,

“ওই দেখেন, মেয়ের আপত্তি নাই। ছেলেও রাজি। এখন শুধু আয়োজনের দরকার। ”

আসমা শান্ত গলায় বললেন,

“আমরা একটু ভেবে জানাব। ”

জাহানারা গম্ভীর গলায় বলল,

“আর কী ভাববেন? মেয়ের মত তো শুনলেন।”

আসমা রেগে তাকালেন ঝিলমিলের দিকে। হারুন মোল্লা বললেন,

“না, না ঠিক আছে। পারিবারিক বিষয় আছে এখানে, কথাবার্তা বলুক।”

তারা খেয়েদেয়ে সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে গেল। তারা যেতেই আসমা ঝিলমিলের কাছে গিয়ে আবারও কষে এক থাপ্পড় মারলেন। বাবা ঝিলমিল কে বললেন,

“তুই কী জানতি ওনারা আসবেন? ”

ঝিলমিল চোখ তুলে তাকালো না। শান্ত গলায় জানালো,

“বাবা আমি এই মিঠাপুকুর লেনে থাকব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করো। ”

কথাটা বলেই ঝিলমিল নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। এই কদিনে এতো কান্নাকাটি করেছে, এখন যেন চোখের পানিও ফুরিয়ে গেছে। ভীষণ কষ্ট, তবুও কাঁদতে পারছে না।

***
যেদিন আকাশের বিয়ে চৈতীর সঙ্গে হলো, সেদিন রাতে ঝিলমিলের বিয়েটাও হৃদয়ের সঙ্গে হয়ে গেল। খুব অল্প সময়ে যতটুকু গুছিয়ে করা গেছে। হারুন মোল্লা জানালেন মাস খানেকের মধ্যে বড় আয়োজন করে তিনি অনুষ্ঠান করে বউকে ঘরে তুলবেন। পারিবারিক অবস্থানে হৃদয়রাও কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু হৃদয় আড্ডাবাজি ছাড়া কিছু করে না বলে আসমা ও জাহাঙ্গীর সাহেবের যত আপত্তি। আসমা মেনেই নিতে পারছেন না যে তার মেয়ে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করবে। আকাশের ব্যাপার টা মেনে নেবার কারণ ছিলো ছেলেটা ভদ্র, শিক্ষিত, ভালো। পরিবারও সামাজিক। হৃদয়ের বাবা, মা দুজনেই অসামাজিক ধরনের। একই পাড়ায় থাকার দরুন সবকিছুই তারা দেখেছে। তবুও মেয়ের তীব্র জেদের কাছে হার মানতে হলো। আসমা জানিয়ে দিলেন, ঝিলমিল কখনো তাদের কাছে বিপদে পড়ে আসতে পারবে না। তাদের অমতে যে জীবন বেছে নিয়েছে সেখানে যদি অসুখীও হয় তবুও যেন কখনো তাদের কাছে এসে সহানুভূতি না চায়।

জাহাঙ্গীর সাহেব মর্মাহত হলেন। আকাশের বেইমানিতে তিনি মেয়েকে কিছু বলেন নি। মেয়ের কী দোষ ছিলো, নাকি দোষ ছিলো না সেসব নিয়েও ভাবেন নি। তবে এখনকার ঘটনায় খুব দু:খ পেলেন।

বিয়ের পর হৃদয় ঝিলমিলের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। ঝিলমিল তখন নিজের ঘরে ছিলো। বিয়ে উপলক্ষ্যে ঢাকায় থাকা আত্মীয়দের মধ্যে শুধু ফুপু আর তার মেয়েরা আসতে পেরেছে। কাজিন রা ঝিলমিল কে ঘিরে বসেছিল। হৃদয় টুটুলের সঙ্গে ঘরে এলো। এসে ঝিলমিলের উদ্দেশ্যে বলল,

“তোমার সঙ্গে কথা আছে একটু। ”

ঝিলমিল বোনেদের চলে যেতে বলল। হৃদয় এক হাত দূরত্বে বসে ঠান্ডা গলায় বলল,

“আব্বা চাইছেন বড় অনুষ্ঠান করতে। সে যেমন চাইছে তেমনই হোক ব্যাপার টা। তুমি এখানে অন্যকিছু আবদার করবে না। ”

ঝিলমিল নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“আচ্ছা।”

হৃদয় একটু আমতা আমতা করে বলল,

“আর আমার দুটো শর্ত আছে ঝিলমিল। ”

ঝিলমিল জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।

“তুমি আমার বাড়িতে যখন পা রাখবে তখন থেকে আকাশের নাম টা ভুলে যাবে। এই পাড়ায় তোমাদের দুজনের দেখা হবে, কিন্তু আমি চাই না তুমি ওর সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলো। একটা শব্দও খরচ করতে পারবে না। এমনকি আকাশ কে ভেবে আমার বাড়িতে বসে তার জন্য চোখের জলও ফেলতে পারবে না। ”

“দ্বিতীয় শর্ত?”

হৃদয় দ্বিতীয় শর্তের কথা বলতে যেন একটু অপ্রস্তুত হচ্ছে।

“আম্মা যা বলুক, তুমি কখনো তার সঙ্গে ঝগড়া করবে না। ”

ঝিলমিল যন্ত্রের মতো বলল,

“আচ্ছা।”

হৃদয় একটু বিস্মিত হলো যেন। ঝিলমিল কে বিয়ের অল্প সাজে ভালো লাগছে। একদিনের মধ্যে বিয়ের বাজার করেছে। শাড়িটাও তেমন গর্জিয়াস হয় নি। একটা মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি। তবুও বউসাজে খুব মিষ্টি লাগছে।

ঝিলমিলের ফুপু চেয়েছিলেন হৃদয় রাতটা থাকুক। কিন্তু ও রাজি হলো না, চলে গেল। ফুপু এসে ঝিলমিল কে বলল,

“তুই বললে থাকতো। কাল কল করে আসতে বলিস। বিয়ের পর জামাইকে দূরে দূরে রাখতে হয় না।”

ঝিলমিলের বাবা, মা যতটুকু আন্তরিকতা দেখানোর দরকার সেটুকু ঠিকঠাক ভাবে দেখিয়েছেন। নিয়তিতে যখন এটা লেখা ছিলো না মেনেই বা কী উপায়!

***
চৈতীকে নিয়ে ঢাকায় আসার পর আকাশ আর ইশিকা চলে গেল পার্লারে। চৈতী ব্রাইডাল সাজ নিবে। সাজগোজের ব্যাপারে খুব সতর্ক। এমনকি প্রথম রাতে ওদের রোমান্টিক কোনো মোমেন্ট তৈরী হলো না, চৈতীর ভালো ঘুমের প্রয়োজন তাই। ভালো ঘুম না হলে চোখ ছোট লাগবে, সাজটা ভালো হবে না।

আকাশ অপেক্ষা করছে ধৈর্য্য ধরে। বাকীরা চলে গেছে সবাই। বধূবরণ এর ফর্মালিটি আছে কিছু। আকাশের বেশ ভালো লেগেছে চৈতীকে। একটু ডমেনেটিং স্বভাবের হলেও বেশ ভালো। তাছাড়া ওদের পরিবারকেও পছন্দ হয়েছে খুব। বন্ধুরা আকাশ কে বাহবা দিচ্ছে। সুন্দর বউ, বড়লোক শ্বশুরবাড়ি।একদম পারফেক্ট লাইফ।

বড় হবার একটা সুবিধা আছে। আবেগ কে কন্ট্রোল করা যায়। অল্প বয়সে যেটা সম্ভব হয় না, সেটা এখন সম্ভব হয়েছে। একদিন রাগে, জেদে ঝিলমিল কে নিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে মারপিট হয়েছিল। কী একটা বোকামি করেছিল সেদিন! ওই ঘটনা না ঘটলে ঝিলমিলের ব্যাপার টা পাড়াশুদ্ধ লোক জানতো না। কিছু অপ্রীতিকর প্রশ্ন ও’কে শুনতে হয়, সেগুলোর জবাবে একটা কিছু বানিয়ে বললেও প্রশ্নটা শুনতে খারাপ লাগে। চৈতীও নিশ্চয়ই শুনবে। ঝিলমিল রা নাকি এই পাড়া ছাড়বে। জলদি ছাড়ুক, দুজনের জন্যই সেটা ভালো হয়। ঝিলমিল চামচিকা টাইপের মেয়ে। আকাশের ক্ষতি করার কিংবা ওর ম্যারিড লাইফে ঝামেলা করার মতো মেয়ে না, তবুও সামনাসামনি দেখা হওয়া বিরক্তিকর।

আকাশ যা কখনো কল্পনায় ভুল করেও ভাবে নি তাই ঘটলো যেন এবার। হিসাব নিকাশে গড়মিল হয়ে গেল। মিঠাপুকুর লেনে নবপরিনিতা কে নিয়ে পা রাখার পরই ওর কানে এলো ঝিলমিলের বিয়ের ব্যাপার টা। তাও আবার হৃদয়ের সঙ্গে! আকাশ মুহুর্তেই ব্লাঙ্ক হয়ে যায়। ঝিলমিল ওর থেকে দূরে নয়, ওর সামনেই থাকবে। এক গলি পরেই, না চাইতেও দেখা হয়ে যাবে।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা