#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-৯ ও ১০
আকাশ ইশিকার সঙ্গে রাগ দেখালো ঝিলমিলের কাছে যাবার কারণে মা’কে কটু কথা না শোনালেও মায়ের উপরও রাগ আছে। তার মদত ছাড়া ইশিকা নিশ্চয়ই চালাকি করে কিছু করে নি। চৈতীর কাছে সবকিছু আড়াল করতে চাইলেও এক ঘরে থেকে সম্ভব হলো না। চৈতী প্রশ্ন করছে সবাইকে। আকাশ, ইশিকা, শাশুড়ী সবার কাছে জানতে চাইছে সেদিন হৃদয় কেন ওভাবে এসে আকাশকে থ্রেট দিয়ে গেল। রাহেলা বুঝতে পারলেন বিষয় টা এখন আর এড়ানো সম্ভব না। তিনি চৈতীকে নিজের ঘরে ডেকে বললেন,
“শোনো আম্মু, দুদিন পর হয়তো তুমি ঘটনা শুনবে। এই পাড়ায় থেকে তোমার কাছে কোনো কিছু লুকিয়ে তো লাভ নেই!”
চৈতী কপাল কুঁচকে তাকায়। এনাদের নাটুকে স্বভাব আছে। এখানে আসার আগে ওর আম্মু বলে দিয়েছে শাশুড়ী ভারী চালাক মহিলা। তার মিষ্টি কথায় যেন ভুলে না যায়। যার কথায় যত বেশী মিষ্টি থাকে, তার মনে বিষের পরিমাণ ততো বেশী। চৈতী প্রশ্ন করে,
“কী ঘটনা? ”
রাহেলা গুছিয়ে রাখা মিথ্যেটা সুন্দর করে বললেন।
“ইশিকার সঙ্গে পড়ে পাশের বিল্ডিং এর একটা মেয়ে। কেরানির মেয়ে পড়াশোনায় ভালো ছিলো যেমন, তেমনি ছল চাতুরীতেও সেরা৷ ইশিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এই বাড়িতে আসতে লাগলো। আকাশের কাছে পড়েছেও কয়মাস। আকাশ ভালো ব্যবহার করেছে বলে ওরা ধারণা করে নিলো আকাশ ও’কে বিয়ে করবে। ”
“আকাশও কী পছন্দ করতো ওই মেয়েকে?”
“না আম্মু। আকাশ কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাবার সময় পেতো! ও তো দিনরাত পড়তো শুধু। ঝিলমিল সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলো যে আকাশ নাকি ও’কে বিয়ে করবে। কিন্তু আমরা কিছুই জানিনা। ”
“তারপর? ”
“আকাশ তো চলে গেল সিডনিতে। আমি শুনলাম ওরা নাকি কোন ফকিরের কাছে ছুটছে আকাশ কে তাবিজ করার জন্য। শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করাব। ছোটলোকদের খপ্পর থেকে ছেলেটাকে বাঁচানো দরকার। তারপর ই তো তোমার খবর পেলাম। ”
“আকাশ ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল সিডনি গিয়ে?”
“যোগাযোগ কেন রাখবে? আকাশ তো পাত্তাই দেয় নি। ও তো বলেই রেখেছে প্রেম ভালোবাসায় জড়াবে না। মা যদি কানা, অন্ধ খুঁজে বিয়ে দেয় সেখানেই বিয়ে করবে।”
চৈতী শুকনো মুখে আচ্ছা বলল। গল্পটা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে বলে মনে হচ্ছে না। রাহেলা বললেন,
“এখন কী হইছে শোনো, আকাশের বিয়ে ঠিক হবার পর মেয়েটা একদিনেই বিয়ে করে ফেলল। তাও এই পাড়ায়, ওই হৃদয় ছেলেটাকে। বিয়ের পর কী উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে স্বামীকে। এখন তো আকাশ হৃদয় কে দেখতে পারে না।”
চৈতীকে বিভ্রান্ত দেখালো। ও প্রশ্ন করলো,
“ইশিকার বান্ধবী আছে এখনো মেয়েটা?”
“না। ইশিকা ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চলাফেরা বন্ধ করেছে।”
রাহেলা আরও কিছু সময় ব্যয় করে ঝিলমিল যে চরিত্রহীন সেটা বোঝাতে সক্ষম হলেন। চৈতী বিশ্বাসও করে ফেলল প্রায়। আকাশ কে বিয়ে করতে না পারার আক্ষেপ থেকে এই পাড়ায় আরেক বড়লোকের ছেলেকে বিয়ে করেছে লোভের কারণে চৈতীকে বিশ্বাস করিয়ে রাহেলা বেশ নিশ্চিন্তবোধও করলেন। রাহেলা ভেবেছিলেন আকাশের বিয়ের খবরে পুরো পরিবার হয়তো মেয়ে নিয়ে অন্য কোথাও যাবেন। না গেলে তিনি অন্য ব্যবস্থা নিতেন। চৈতীর কানে তখন এসব কথাবার্তা পৌছাতো না। কিন্তু একটা চালাকি করলো। ঠিকই আকাশের সামনে রয়ে গেছে। আর এমন ভাবে রয়ে গেছে যে সরানোর উপায়ও নেই। তার উপর হৃদয়ের নাটক। কিন্তু রাহেলার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার না, হৃদয় সেদিন কী বলে আকাশ কে উস্কে দিলো। একটা ছেলের নাম বলেছিল কিন্তু তিনি ভালো করে বুঝতে পারেন নি। ছেলের নাম নিলে নিক, কোনো মেয়ের নাম তো নেয় নি।
***
অনিন্দিতা আকাশ কে জিজ্ঞেস করলো,
“আবার কবে আসবে? ”
“সময় বের করতে পারলেই আসব?”
অনিন্দিতা হেসে বলল,
“আমার জন্যও সময় বের করতে হচ্ছে এখন? চৈতী আবার মনের পুরোটা জায়গা দখল করে নি তো?”
আকাশ বিরক্ত গলায় বলল,
“আরে প্যানপ্যান বাদ দাও। আসব তো বললাম। ”
অনিন্দিতা আকাশ কে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে মিস করি খুব। বেশী সময়ের জন্য না পারো দুই ঘন্টার জন্য হলেও এসো। তোমার বিয়ে হবার পর থেকে আমি শান্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে তোমার বউ আর ভাগ বসাতে দিবে না।”
আকাশ মৃদু হেসে বলল,
“বউ জানলে ভাগ বসাতে দিবে না সেটা সত্য। কিন্তু বউ জানবে না। আর তোমার জায়গা যেমন ছিলো তেমন ই থাকবে। সেই জায়গা নেবার মতো ক্ষমতা কারোর নেই। ”
অনিন্দিতা খুশি হয়। এটা শোনার অপেক্ষায় ই ছিলো যেন। আকাশ বেরিয়ে আসে সাতটা বাজার আগে। অপূর্ব আসার আগে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। ছেলেটা বড় হবার পর আকাশকে তেমন পছন্দ করে না, এমনকি আকাশের ওই বাসায় যাওয়াও তার অপছন্দ। অনিন্দিতার আর ওর সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জানে কী না সেই ব্যাপারেও ওর ধারণা নেই। তবে দেখলে বোঝা যায় যে পছন্দ করে না।
আকাশ মিঠাপুকুর লেনে ঢোকার সময় হৃদয়কে দেখলো। চোখ নামিয়ে নিলো, কে জানে হৃদয় হয়তো সকলের সামনেই কিছু একটা অপ্রীতিকর প্রশ্ন করে কী না!
হৃদয় আকাশের ব্যাপার টা আগে থেকে কিভাবে জেনেছে সেই সম্পর্কে আকাশের ধারণা নেই। এমনকি হৃদয় যে ওর পিছনে স্পাই গিরি করতে পারে এই ব্যাপারটাও ওর মাথাতে আসে নি। ঝিলমিল কে নিয়ে মারপিটের ওই ঘটনার পর দুজনের বোঝাপড়াও হয়েছিল। এরপর কখনো ঝিলমিল কিংবা ও’কে বিরক্ত করে নি। সিডনি থেকে ফেরার পর ঝিলমিলের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল পাঁচ দিন পর। ইশিকা ঝিলমিল কে বলেছিল যেন ওদের বাড়ি না আসে। ঝিলমিল আসে নি, কিন্তু কল করেছে অসংখ্যবার। এই সময়ে আকাশ নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। কিভাবে কথাগুলো ঝিলমিল কে বলবে। পাঁচ দিন পর ঝিলমিল কে কফিশপে ডাকলো। সেদিন ও উচ্ছ্বসিত হয়েছিল খুব। আকাশ অনেক দিন পর দেখা হবার কোনো উচ্ছ্বাস দেখায় নি। সরাসরি ঝিলমিল কে বলেছিল,
“আংটি টা সঙ্গে আছে? ”
ঝিলমিল বোধহয় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। জবাব দিতে সময় নিয়েছিলো। এতোদিন পর দেখা হবার পর প্রথম প্রশ্ন অন্যকিছু হতে পারতো। আকাশ বলেছিল,
“ঝিলমিল আমি বিয়ে করতে চাইছি না। কেন, কী কারণ সেগুলো বলতেও চাচ্ছি না। আমি চিরকাল নিজের মনের কথা শুনেছি। এখন আমার মনে হচ্ছে তোমার আমার ভাইব ঠিকঠাক ম্যাচ হচ্ছে না। হ্যাঁ অনেক বছর আমরা রিলেশনশিপে ছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে সামথিং মিসিং। তোমাকে বিয়ে করার কথা ভাবলে আমার প্যানিক অ্যাটাকের মতো হয়। এর বাইরে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তুমি যা খুশি ভাবতে পারো। ”
ঝিলমিল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। আকাশ আবারও বলল,
“তুমি কী আংটি টা ফেরত পাঠাবে? ওটা এমন দামী কিছু না, তবুও ফেরত পাঠালে ভালো হয়। ”
ঝিলমিল তখনও জবাব দেয় নি৷ আকাশ জবাবের অপেক্ষা না করে কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসে। সেদিন ওর তেমন খারাপ লাগে নি। সবকিছু স্বাভাবিক ই মনে হচ্ছিলো, কোনো অপরাধবোধও হয় নি। সেদিন বিকেলে ইশিকা গিয়ে আংটি নিয়ে এসেছে। ঝিলমিলের বাবা, মা এসেছিল ওদের বাসায়। ও তাদের মুখোমুখি হয় নি, বাবা মা সামলে নিয়েছিলেন।
এরপর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। সেই সঙ্গে নানান গুঞ্জন। আকাশকে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয় নি। মা বলেছিলেন সব সামলে নিবেন, নিয়েছিলেনও। চৈতীর সঙ্গে তখন প্রতিদিন কথা হয়, সাতক্ষীরায় গিয়ে দেখাও করে আসে। চৈতীর পরিবার এসে দেখে যায় ওদের। বিয়ের কথাবার্তা আগায়। একদিন অনিন্দিতার বাসায় যায়। বিয়ের পর লম্বা একটা সময় হয়তো অনিন্দিতার সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হবে না, তাই ও নিশ্চিন্তে যায়। অনিন্দিতার বাচ্চারা বাসায় নেই। ফাঁকা বাসায় ওদের সুন্দর কিছু মোমেন্টও কাটে। বিকেলে অনিন্দিতার ড্রইং রুমে বসেছিল চায়ের অপেক্ষায়। হঠাৎ ডোরবেল বাজে। কিছু খাবার অর্ডার করেছিল আকাশ নিজেই। ভাবলো ডেলিভারি ম্যান এসেছে বুঝি। দরজা খুলতেই চমকে উঠলো। ঝিলমিল ওর সামনে। ঝিলমিল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না ওর মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোলো, না আকাশের মুখ থেকে। এই মুহুর্তটাকে কিছু একটা বলে বুঝ দেয়া সম্ভব ছিলো না আকাশের জন্য। সদ্য শাওয়ার নেয়া ভেজা চুল আর শার্টলেস অবস্থায় দেখার পর অন্যকিছু ব্যখ্যা করাও সম্ভব না। আকাশ সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিলো ধরাম করে। ধাতস্থ হয়ে যখন দরজা খুলল তখন ঝিলমিল আর ওখানে ছিলো না।
****
ঝিলমিল ঘরে এখন প্রায় চুপচাপই থাকে। মায়ের সঙ্গে আগে সারাদিন লেপ্টে থাকলেও এখন কথা হয় হাতে গোনা কয়েকটি। ঝিলমিল খায়ও একা। সেদিনের পর টুটুলের সঙ্গেও কথা হয় নি। হৃদয় মাঝেমধ্যে আসে। সপ্তাহে এক দুইদিন জামাইকে দাওয়াত করে ভালো মন্দ খাওয়াতে ভুল করেন না মা। মেয়ের প্রতি রাগ থাকলেও জামাইয়ের সঙ্গে তার আচরণ আন্তরিক। হৃদয় একদিন তবুও প্রশ্ন করেছিল,
“তোমার বাবা, মা সম্ভবত আমাকে পছন্দ করে না তাই না?”
“না তো। এরকম কিছু না। আসলে আমার সব ঘটনায় তারা খুব আপসেট। ”
“সেটা হওয়া স্বাভাবিক। ”
ঝিলমিল যতই হৃদয়কে বুঝ দেবার জন্য বলুক কিন্তু ব্যাপার টা সত্যি। মায়ের আকাশ কে খুব পছন্দ ছিলো। তিনি নিয়মিত খোঁজ নিতেন। কতো প্রশংসা করতেন। ছেলেটা নম্র, বিনয়ী, পড়াশোনায় কতো ভালো। বড়লোকের ছেলে বলে বিগড়ে যায় নি। অথচ ঝিলমিল জানে এসবের আড়ালে আকাশের যে আসল রুপ আছে সেটাকে কোনো বিশেষনে বিশেষায়িত করা যায় না। লম্পট বললেও কম বলা হয়। স্কুলে পড়ার সময় প্রথম লম্পট শব্দটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রিনা আপা নামে একজনের কাছে ও পড়তো। তাকে জিজ্ঞেস করেছিল লম্পটের মানে কী। সে বুঝিয়েছিল এটার মানে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু। ঝিলমিল ভেবে অবাক হয় এমন একটা লম্পটের সঙ্গে ওর সম্পর্ক হয়েছিল! সুন্দর দেখতে বলে প্রেমে পড়েছিল, বয়সটা কম ছিলো অবশ্য। তবুও এতো বছরে কেন চিনতে পারলো না। কখনো ওভাবে মনেও হয় নি। চরিত্রহীন মানুষের বডি ল্যাংগুয়েজ দেখলে বোঝা যায়। চোখের দৃষ্টি, কিছু কর্মকান্ডে সেটা নজরে আসেই। ঝিলমিলের সেরকম কখনো মনে হয় নি। বোধহয় ও খুব বোকা তাই মনে হয় নি। একবার ওদের ছাদে কিছু সময় এক সঙ্গে ছিলো। আকাশ ওর অনুমতি নিয়ে চুমু খেয়েছিল। সেদিন ওই প্রশ্রয়টুকু পাবার পর আরও বেপরোয়া হয়েছে কিন্তু ঝিলমিলের তরফ থেকে সায় ছিলো না। তবে সেটাকে নোংরা মনে হয় নি কখনো। হাত ধরা, জড়িয়ে ধরার মধ্যেও নোংরা অনুভূতি অনুভব করে নি। অথচ ও যে ঝিলমিলের নিজ চোখে দেখা সত্যিকারের জানোয়ার।
ওদের দুজনের দূরত্বটা যেন হঠাৎ তৈরী হলো। হঠাৎ তৈরী হওয়া দূরত্বে যে ঝিলমিলের তেমন হাত নেই সেটা টের পেল ইশিকার কিছু একশন দেখে। ইশিকার বিয়ের সময় আকাশের মা ও’কে সবকিছু থেকেই কেমন দূরে দূরে রাখলো। বারবার সাবধান করলো তাদের আত্মীয়দের কাছে যেন না যায়। এমনকি তার কিছু আচরণে নিষ্ঠুরতাও প্রকাশ পেল। ঝিলমিল তেমন কিছু করে নি। ও ব্যাপার টা মা’কে বলেছিল অন্যভাবে। বলেছিল যে আগের মতো আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না তারা। মা এই সামান্য ব্যাপার টুকু শুনেই চিন্তায় পড়ে গেলেন। এরপরের অনেক কিছুই ঝিলমিল তাই মা’কে জানালো না। যেমন একদিন ইশিকা এসে বলেছিল, তুই সারাদিন ভাইয়াকে কল করিস কেন?
ঝিলমিল অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“কই সারাদিন তো কল করি না। ওই রাতে যা একটু কথা হয়। ”
“এতো কথাও বলা লাগে! ভাইয়া কী ঘুরতে গেছে ওখানে? কতো পড়া চিন্তা করতে পারিস? এতো খাটুনি চোখে পড়ে না?”
ঝিলমিল লজ্জায় মাথানিচু করেছিল। ইশিকার সামনেও যে লজ্জায় কখনো ওর মাথানিচু হবে সেটা ভাবে নি।
এরপরের আরেকটা ঘটনা ছিলো আকাশের পার্সেল পাঠানো নিয়ে। আকাশ তার পরিচিত একজনের কাছে একটা বড় পার্সেল পাঠিয়েছিল বাসার সবার জন্য। ঝিলমিল ভেবেছিল সেই পার্সেলে ওর জন্যও কিছু থাকবে। কিন্তু ওর জন্য কিছু এলো না। এমনকি ইশিকা স্বর্নাকে চকলেট, পারফিউম দিলো কিন্তু ও’কে কিছু দিলো না। আসমা এই ব্যাপারে মেয়েকে প্রশ্ন করে বুঝলেন যে কিছু একটা ঝামেলা চলছে। আকাশকে প্রশ্ন করতে লজ্জা লাগলো। ততোদিনে আকাশও এর প্রায় কথায় বিরক্ত হচ্ছে। স্বাভাবিক কথাবার্তায় রেগে গিয়ে কল কেটে দিচ্ছে। ঝিলমিল এই মানসিক কষ্ট গুলো একা সামলেছে। কাউকে বলতেও পারতো না। কী বলবে, কিভাবে বলবে সেটা ভেবেই পিছিয়ে যেত। যারা আকাশের কথা জানে তারা ভাবে ওদের সুন্দর একটা বন্ডিং৷ এক আত্মা দুই প্রাণ টাইপের ভালোবাসা৷ সিনেমার নায়করা নায়িকাকে নিয়ে যেমন পজেসিভ হয় আকাশ তেমন প্রেমিক। অথচ এমনও হয়েছে যে টানা দশ বারো দিন ঝিলমিল বিরক্তিহীন ভাবে কল, মেসেজ করলেও আকাশের তরফ থেকে জবাব আসে নি। ঝিলমিল দিশেহারা হয়ে রাতে ঘরে পায়চারি করতো।
কফিশপে আংটি ফেরত চাওয়ার ব্যাপার টা ঝিলমিলের ভাবনার বাইরে ছিলো। এড়িয়ে চলা, সবার রুক্ষ আচরণ দেখে ওর মনে হয়েছিল আকাশ বিয়ের আগে ও’কে কঠিন কিছু শর্ত দিবে। সেজন্য হয়তো সবার এতো কঠিন আচরণ। পুরো ব্যাপারটায় ঝিলমিল স্তব্ধ হয়েছে, কেঁদেছে এমনকি ভেঙেও পড়েছে। পরক্ষণেই ভাবতে শুরু করে দিতো কেন এমন করলো ওর সঙ্গে! আকাশের জীবনে নতুন কেউ কী এসেছে তবে! সেটাই হবে বোধহয়! অনেক দিন ধরেই তো ও’কে এড়িয়ে চলছিল। নিশ্চয়ই বেটার অপশন পেয়েছে।
আকাশের বিয়ের কথাবার্তা সব কানে এসেছিল ওর। পাশাপাশি বাড়ি হলে যা হয়। লুকিয়ে রাখা যায় না। বড়লোক বাড়ির একমাত্র মেয়ে। বাবা, মা খুব মন ছোট করে থাকেন। তাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। ঘরে এসে সবাই প্রশ্ন করে অতিষ্ট করে ফেলেন। চায়ের দোকান, খেলার মাঠে সব জায়গায় বাবা, ভাইকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ঝিলমিল তখনও ভেবে কষ্ট পায় যে শুধুমাত্র সোশ্যাল স্ট্যাটাস এর জন্য আকাশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রচন্ড দু:খের সঙ্গে ঘৃনাবোধ তখনও তৈরী হয় নি।
একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আনাস ভাইয়ের দোকানে হৃদয় নজরে আসতেই ওর স্মৃতিতে পুরোনো একটা কথা জেগে উঠলো। হৃদয় ও’কে বলেছিল, আকাশ সম্পর্কে খোঁজ নিতে। হৃদয় সেদিন ওর কাছে গুরুত্বহীন একজন, আর আকাশ গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিলো। তাই হৃদয়ের কথায় পাত্তা দেবার দরকার মনে করে নি। কিন্তু এখন আকাশের কাছে ও গুরুত্বহীন একজনে পরিনত হয়েছে। তাই জানার আগ্রহটা বেড়ে গেল। ঝিলমিল সেদিন ই হৃদয়ের ফোন নাম্বার টা সংগ্রহ করলো দোতলার নাইমের কাছ থেকে। হৃদয় প্রথমে জানালো সে কিছুই বলবে না। ঝিলমিল যেন নিজে খুঁজে বের করে। যেহেতু ঝিলমিলের সঙ্গে আকাশের বিয়ে হচ্ছে না, সেহেতু খেটেখুটে পড়ে জানলেও চলবে। কিন্তু ঝিলমিলও নাছোড়বান্দা। শেষমেস হৃদয় জানালো সে মুখে কিছু বলবে না। প্রমাণ দিবে।
এক শুক্রবারের ঘটনা। দুপুরবেলা হৃদয় কল করে বলল একতা হাউজিং এ থাকতে। ঝিলমিল সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল কাউকে কিছু না বলে। একতা হাউজিং এ গিয়ে দেখলো হৃদয় আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ঝিলমিল জিজ্ঞেস করেছিল,
“এখানে ডাকলেন যে?”
“তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবার চান্স আছে। ”
ঝিলমিলের হৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ভয়। একদিকে ওর জানার আগ্রহ প্রবল, অন্যদিকে মন বলছে কিছু সত্যি জানতে নেই।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর আকাশ কে দেখা গেল ছত্রিশ নাম্বার বিল্ডিং এ ডুকতে। চার নাম্বার রোডের পাশে ছোট একটা সরু গলি, সেখানে ওরা দাঁড়িয়ে। স্পষ্ট সব দেখা যায়। আকাশ লিফটে ঢুকে যেতেই ঝিলমিল জিজ্ঞেস করেছিল,
“এখানে কে থাকে?”
হৃদয় স্বাভাবিক গলায় বলেছিল,
“অপূর্বকে চেন তুমি? ”
“অপূর্ব? ”
“আকাশের স্টুডেন্ট। ”
ঝিলমিলের মনে পড়ে গেল। একবার এসেছিল আকাশের জন্মদিনে। অপূর্ব ওর মা আর ছোট বোন। বাচ্চা দুটো খুব মিষ্টি। ঝিলমিল হা করে তাকিয়ে রইলো। হৃদয় বলল,
“এটা অপূর্বদের বাসা। আজ অপূর্বরা দুই ভাই বোন ওদের রিলেটিভ এর বাসায় গেছে সকালে। তুমি যদি বুদ্ধিমতি হয়ে থাকো তাহলে আমাকে আর বিষয় টা ব্যখ্যা করতে হবে না।”
হৃদয়ের কথা না বোঝার মতো বোকা ঝিলমিল না। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। এতদিনের চেনা একটা মানুষকে নিয়ে এভাবে কিছু ভাবতে কষ্ট হয়। হতেই পারে হৃদয় মনগড়া কিছু কাহিনী বানাচ্ছে। ঝিলমিল কে ওভাবে হতবুদ্ধি হতে দেখে হৃদয় বলল,
“বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো?”
“কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে? ”
ঝিলমিলের কঠিন গলা শুনে হৃদয় হেসে ফেলল। বলল,
“শোনো আকাশ কে আমি সিলেবাসের বাইরে রাখি৷ প্রমাণ রাখার তাই প্রশ্নই আসে না। তুমি জেদ করেছ বলে এসেছি। তবে প্রমাণ দিতে সমস্যা নেই, কিন্তু তুমি সেটা নিতে পারলেই হয়। ”
ঝিলমিল দৃঢ় গলায় বলল,
“পারব। ”
হৃদয় ও’কে ওখানে রেখে গেটে থাকা সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গেল। ফিরে এলো অল্প সময়েই। ঝিলমিল কে বলল,
“এক ঘন্টা পর তুমি গেট থেকে ঢুকবে। এন্ট্রি খাতায় নিজের নাম, ফোন নাম্বার সঠিক লিখবে না। কোন ফ্ল্যাটে যাবে সেই জায়গাটাও ফাঁকা রাখবে। এরপর লিফটে ঢুকে যাবে। এফ সিক্স ফ্ল্যাটে কলিংবেল বাজাবে। এরপর সেখান থেকে স্মার্টলি বেরিয়ে আসার দায়িত্ব তোমার। কোনো ঝামেলা করবে না। ঝামেলা করেছ মানে ফেঁসে গেছ।”
ঝিলমিল নীরবে সব শুনলো।
“বুঝেছ তুমি? রিস্ক আছে কিন্তু। ”
“আমি পারব।”
ঝিলমিল হৃদয়ের কথামতো গেল। এফ সিক্স ফ্ল্যাটে যখন বেল বাজাচ্ছিল তখন ওর হার্টবিট বেড়ে গেছিলো। সেই সঙ্গে নি:শ্বাসও যেন থেমে গেছিল। এরপর সেই মুহুর্ত! কিছু সময়, বোধহয় এক মিনিট হবে। ধরাম করে দরজাটা বন্ধ হতেই হৃদয় ওর হাত ধরে টেনে লিফটে ঢোকালো।
এরপরের কিছু সময় ঝিলমিলের জীবনে সবচেয়ে বাজে সময় ছিলো। গেট থেকে বেরিয়ে হৃদয় ও’কে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে এলো খেলার মাঠের দিকে। ঝিলমিল রিকশা থেকে নেমে সেখানেই বসে পড়লো। এতো কষ্টের দিন জীবনে আর আসে নি ওর। হৃদয় শান্তভাবে রিকশাভাড়া মিটিয়ে পানি কিনে আনলো। ঝিলমিল পানি খেল না। শব্দ করে কাঁদলো। হৃদয় ও’কে সান্ত্বনাও দিলো না। অনেকক্ষন কেঁদে যখন শান্ত হলো তখন বলল,
“এখন কী করবে? ”
ঝিলমিল জবাব দেয় নি। হৃদয় আবারও বলল,
“তুমি এই ব্যাপার টা কাউকে জানাবে না ঝিলমিল। নিজের ফ্যামিলিকে জানাতে পারো তবে তাদের বলবে মুখ বন্ধ রাখতে। আকাশ তালুকদারের কিছু হবে না, উল্টো তার পরিবার তোমাকে কোনো না কোনোভাবে হেনস্তা করবে। এই সম্পর্ক অনেক বছরের পুরোনো। অপূর্ব’র মা সবকিছু এমন ভাবে ফিক্সড করে রেখেছে যে তার বিপক্ষে কেউ একটা কথাও বলবে না। আকাশ ওই বিল্ডিংয়ে ঢুকে এন্ট্রি খাতায় কিছু লিখে না, মানে প্রমাণ পর্যন্ত নেই। বিল্ডিং এর সিকিউরিটি গার্ড থেকে কেয়ারটেকার, ম্যানেজার সব তার দলের লোক। আর মিঠাপুকুর লেনে আকাশ খুব ভালো ছেলে। কেউ এই কথা বিশ্বাস করবে না, বরং ভাববে তোমার সঙ্গে বিয়ে না হওয়ায় এসব এলিগেশন আনছ। তোমার পরিবারও কিন্তু আজমল তালুকদারের সঙ্গে লড়াই করার মতো সক্ষম না।”
ঝিলমিল ফুপিয়ে কেঁদে গেছে শুধু। হৃদয় বলেছিল,
“বাড়িতে গিয়ে আরও কিছুদিন কাঁদো। কিন্তু নিজের ক্ষতি কোরো না। ”
হৃদয় এরপর রিকশা ঠিক করে দেয় ঝিলমিল কে। মিঠাপুকুর লেনে আসা অবধি সারা রাস্তা ঝিলমিল শুধু কেঁদেই গেছে।
এরপর কতোকিছু ঘটে গেল। ওদের বাসায় আকাশের বিয়ের কার্ড এসেছে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে গান বাজনা, হৈ হুল্লোড় কতো আয়োজন। আর ঝিলমিলের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠেছে সেই দৃশ্যটা। অন্য কারো নামে সানাই বাজা, দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ঝিলমিলের মনে হতে থাকে এই সানাইয়ের সুর তো ওর জন্য বাজার কথা ছিলো। মুহুর্তেই মনে পড়ে যায় সেই দৃশ্যটা। এতো মিষ্টি সানাইয়ের সুর ওর কাছে বিষের মতো লাগে। সত্যিই তো তীব্র বিষ! অন্য কারোর নামে বেজে চলা সুরেও যে বিষের ছড়াছড়ি। বাবার থমথমে মুখ, মায়ের ব্যথাতুর চেহারা, ভাইয়ের বিরক্ত হওয়া দেখেও ঝিলমিল সাহস করে সত্যিটা বলতে পারে নি। অনেক সাহস দরকার ওর, কিন্তু সেটা তখন ছিলো না। হৃদয় ঠিকই বলে, ও কিছু করতে পারবে না আকাশের। এতো বড় প্রতারণা যে করতে পারে, সে নিজেকে বাঁচাতে অনেক মিথ্যের আশ্রয় নিতে পারবে। বাবা, মা, ভাই আরও একবার ছোট হবে সকলের কাছে।
ঝিলমিল ভুল আর অন্যায়ের হিসাবে আটকে যায়। কোনটা ভুল ছিলো ওর! বিশ্বাস করা ভুল ছিলো নাকি ভালোবাসা ভুল ছিলো।
ঝিলমিল আজ অনেক দিন পর সাহস সঞ্চার করে মা’কে বলল,
“মা তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি মন ছোট করে থাকো এজন্য বলছি। আকাশের এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। প্রেমের সম্পর্ক নয় সেটা। ওই যে একবার ওর জন্মদিনে দুটো বাচ্চা নিয়ে যে মহিলা এসেছিল! ও যখন সেই বাসায় যায় তখন বাচ্চারা বাসায় থাকে না। আমাকে বিয়ে না করার কারণ খুব সম্ভবত এটাই। আমাদের অবস্থান ওর কাছে অতো ম্যাটার করে না। ”
আসমা অবিশ্বাস্য চোখে মেয়েকে দেখছিলেন।
চলবে….