কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-১১

0
16

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১১
ঝিলমিলের বিয়ের আয়োজনে বাবা, মা কমতি রাখছেন না। যতটুকু সাধ্য তাদের তার চেয়ে বেশী প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন আগেই। তারা ধরে নিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে আকাশের সঙ্গে হবে। সেইভাবে আয়োজন করে রেখেছিলেন একটু একটু করে। এখন বিয়েটা অন্য কারো সঙ্গে হলেও মেয়ে তো তাদেরই, তাই কোনো কিছুতে কার্পণ্য করছেন না। আত্মীয় স্বজন রা আসায় ঝিলমিলদের ছোট্ট বাসাটা প্রায় ভরে উঠলো। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ জানেন না তেমন আকাশের ব্যাপার টা। শুধু ঝিলমিলের ফুপু আর ছোট মামী একই শহরে থাকেন বলে কিছুটা জানলেও এই বিষয় নিয়ে তারা আলাপ আলোচনা করছেন না। ঝিলমিল শান্ত, বাধ্য মেয়ে, ওর প্রতি কারোর রাগ, ক্ষোভ তেমন নেই। গোপনে আফসোস পর্যন্ত ব্যাপার টা সীমাবদ্ধ রেখে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

অন্যদিকে হৃদয়ের পরিবারের অধিকাংশ আত্মীয়রাই নাকউঁচু স্বভাবের। তাদের রাগ ভাঙিয়ে বিয়েতে হাজির করা হয়েছে। সকলে এলেও আলোচনা, সমালোচনায় ব্যস্ত। সেই আলোচনা অবশ্য ঝিলমিল কে ঘিরে নয়। হৃদয়ের মা জাহানারা কে নিয়ে। মুখরা স্বভাবের এই মহিলার ছেলের সঙ্গে কেন ঝিলমিলের বাবা, মা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন এক পাড়ায় থেকে সেটা ভেবে অস্থির হচ্ছেন। ঝগড়াঝাটিতে আজ পর্যন্ত জাহানারার সঙ্গে কেউ জিততে পারে নি, ছেলের বউ আসলে তো দুই মাসও টিকতে পারবে না। এসব কথাবার্তা জাহানারার কানেও যায়। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেন। না করে উপায় কী। জা, ননদ, ভাইয়ের বউয়ের বউ তারাই আলোচনা, সমালোচনা করছেন।

হৃদয়ের ছোট ভাই রিহানও এসেছে বিয়ে উপলক্ষ্যে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে একগাদা বন্ধু। রিহান একদিন দেখাও করে এলো ঝিলমিলের সঙ্গে। বয়সে ও ঝিলমিলের সমান ই। ভাবীর পূর্বপ্রেম সম্পর্কে রিহান অবগত, কিন্তু ভাইয়ের বউ হওয়ায় খুশিও হলো।

বেশ আয়োজন করে হৃদয় আর ঝিলমিলের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। মিঠাপুকুর লেনের প্রতিটি বাসায় কার্ড চলে গেছে। কার্ডের সঙ্গে এক বক্স করে মিষ্টিও। আকাশের পরিবার বাদ গেল না তাতে। আকাশ অবশ্য বেশ সমস্যায় পড়ে গেছে৷ ওদের হানিমুন প্ল্যান টা ক্যান্সেল হলো। ডেট টা পড়েছে মাসের শেষ দিকে। এদিকে বিয়ের অনুষ্ঠান মাসের শুরুতে। আকাশের একটা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করার কথা। সেখানকার ফর্মালিটি আছে কিছু। সেগুলো মাসের মাঝখানে করতে হবে। আকাশ চৈতীকে নিয়ে সাতক্ষীরায় যেতে চেয়েছিল। চৈতী কপাল কুঁচকে আকাশকে প্রশ্ন করলো,

“ঝিলমিলের বিয়ে এটেন্ড করতে চাইছ না? সেজন্য আমাকে নিয়ে সাতক্ষীরায় যেতে চাইছ?”

“ঝিলমিল উপলক্ষ্য না, আমি আসলে হৃদয়ের বিয়েতে থাকতে চাইছি না।”

“তোমাদের সমস্যা কী আসলে? আর এই অপূর্ব কে? সেদিন এই নাম করে তোমাকে কিছু বলছিল৷ ”

আকাশের কনফিডেন্স লেভেল এমনিতে ভালো। তবুও নিষিদ্ধ সম্পর্ক টা নিয়ে ভয় আছে। ও বলল,

“তেমন কিছু না।”

“তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ না তো?”

চৈতীর প্রশ্নগুলো জেরার মতো। ও ধরেই নিয়েছে ঝিলমিল আর আকাশের ব্যাপার টা যেভাবে ওর কাছে প্রেজেন্ট করা হচ্ছে সেভাবে হয়তো না৷ ঘটনা অন্যকিছুও হতে পারে। রাহেলা, ইশিকা যতই মিষ্টি করে ওর কাছে ঝিলমিলের নেতিবাচক ব্যাপার গুলো তুলে ধরে ওর সন্দেহ ততো ঘনীভুত হয়। চৈতী আকাশের ব্যাপারে একটু বেশী খবরদারি করে৷ একদিন দুপুরে বেরিয়ে গেল কাজের কথা বলে অথচ সন্ধ্যা অবধি আকাশ কোনো কল রিসিভ করলো না৷ ব্যাপার টা তুলতেই আকাশ বলল,

“আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম৷ ফোন পিক করার মতো সময় পাই নি৷ ”

“এতো টা ব্যস্ত! কল রিসিভ করে বলতে তো পারতে সেটা। ”

আকাশ রেগে যায়৷ বলে,

“তুমি আমাকে সন্দেহ করছ?”

“সন্দেহ! না তো, আমি বলছি যে আমার ফোনকল টাও গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। ”

আকাশ আত্মপক্ষ সমর্থন করে মেনে নেয় যে তার ভুল হয়েছে। এরপর সে এমন করবে না। চৈতী খানিকটা শান্ত হয়। আকাশ সতর্ক হয়, মায়ের ধারণা ভুল। চৈতী খুব শক্ত ধরনের মেয়ে। বয়স কম হলেও তাকে কোনো কিছু বলে ম্যানেজ করা সম্ভব না। প্রতিটি কথায় লেজ খুঁজে বের করে। সেই সঙ্গে তার অনেক ব্যাপার আছে যেগুলোর সঙ্গে আকাশের অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে।

***
বিয়ের দিন চলে এলো দেখতে দেখতে। ঝিলমিল বিয়ের প্রতিটি ইভেন্টে স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো। হৃদয়ের কাজিন রা ও’কে নিয়ে বেশ মাতামাতি, হৈ হুল্লোড় করলো। বিয়ের আগের দিন রাতে মা আড়ালে ডেকে ঝিলমিল কে প্রশ্ন করলেন,

“তুই সেদিন যা বলেছিস সেটা কী সত্যি? ”

“তোমার মিথ্যে কেন মনে হচ্ছে? ”

আসমা দ্বিধায় পড়ে যায়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আকাশ কে দেখে ভদ্র মনে হয়। অবশ্য ভদ্রতা অনেক সময় মুখোশও হয় কিছু মানুষের। তবে সেরকম কিছু হয়ে থাকলে ঝিলমিল এর জন্য ভালো হলো।

“তুই আগে কেন বললি না? আর হৃদয়কে কেন বিয়ে করতে হলো? ”

“মা আমাদের ক্লাশে সুমাইয়া নামে একটা মেয়ে ছিলো মনে আছে? যাকে ইশিকা সবসময় ক্ষ্যাপাতো। একবার মেয়েটা জবাব দেয়ায় স্কুলের সিড়ি থেকে সুমাইয়াকে ধাক্কা দিলো ইশিকা। হেডস্যার ইশিকার বাবা, মা’কে ডাকলেন। ঘটনাটা যাচাই করে যখন জানা গেল ইশিকা দোষী আর ও অনেক দিন ধরে সুমাইয়াকে বুলিং করছে তখন কিন্তু ওর বাবা, মা ও’কে শাসন করলেন না। সুমাইয়া স্কুল ছাড়লো সেই বছর। বছরের মাঝামাঝি সুমাইয়াকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করলো। ইশিকা সেই ব্যাপার নিয়ে খুব খুশি ছিলো, ওদের কতো পাওয়ার সেটা মুখে না বললেও বিভিন্ন উপায়ে বুঝাতে লাগলো। আমি মিঠাপুকুর লেন ছাড়লেও সেই একই ব্যাপার ঘটতো। কোনো খেলায় আমি নামিনি, কিন্তু এই পাড়ায় থেকেই ওদের পরিনতি দেখতে চাই। ”

“তাই বলে নিজের সঙ্গেই জুয়া খেলবি?”

ঝিলমিল একটু থেমে বলল,

“জুয়া খেলি নি মা। হৃদয় আকাশের চেয়ে অনেক ভালো। আমি ওর সঙ্গে ভালো থাকব। ”

আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

“এখন এসব বলে লাভ নেই জানি। তবুও আমার চিন্তা হয়, ওদের পরিবারে তুই মানিয়ে নিতে পারিস কী না!”

“ঠিক পারব। আমার মনে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় দু:খটা পেয়ে গেছি। বড়টা যেমন সামলে নিতে পেরেছি, ছোট ছোট দু:খ যা আসবে সেগুলোও সামলে নিতে পারব। ”

আসমার চোখ জলে ভরে যায়। তার কাছে মনে হয় মেয়েটা পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে। যে ঘটনাটা ওর সঙ্গে ঘটেছে সেটা না চাইতেও সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। ঝিলমিল মা’কে অনুরোধের সুরে বলল,

“মা একটা অনুরোধ, হৃদয়কে কখনো তোমরা অসম্মান কোরো না। ওর পরিবার নিয়ে, ও’কে নিয়ে তোমাদের ভাবনা যেমন ই হোক কখনো ও’কে অসম্মানিত কোরো না।”

আসমা মেয়েকে কথা দিলেন। বিদায়বেলায় তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেনও খুব। টুটুলও বোনকে ধরে কাঁদলো। সেই ঘটনার পর ঝিলমিল ওর সঙ্গে আর কথা বলে নি। আপু এতো দু:খ পাবে ব্যাপার টা ও বুঝতে পারে নি। ঝিলমিল খুব স্বাভাবিক ছিলো। মা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের শান্ত করে শ্বশুর বাড়িতে গেছে। ও বেশী কিছু ভাবছেও না৷ ভালো থাকবে নাকি খারাপ থাকবে এসব ভাবনার বাইরে একটা কথাই সত্যি যে ও হৃদয়ের সঙ্গে থাকবে, মিঠাপুকুর লেনেই থাকবে।

***
আকাশ নিজের ঘরে বসেই সানাইয়ের সুর শুনলো। যেমন একদিন ঝিলমিল শুনেছিল। দুজনের অনুভূতিতে বিস্তর তফাৎ। আকাশ জানে ও হেরে গেছে। ঝিলমিল, হৃদয় চুপ থেকেও জিতে গেছে। ভুল কিংবা অন্যায় এর হিসাব নিকাশ না করলেও আকাশ বুঝতে পারছে যে ও ঝিলমিলের কাছে করুনার পাত্র।

***
শ্বশুর বাড়িতে এটা ঝিলমিলের প্রথম রাত। বেশ কয়েকদিনের আনন্দ, হৈ হুল্লোড় এর পর ভীষণ ক্লান্ত। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই ঘুমের রাজ্যে চলে যাবে মুহুর্তেই। ঝিলমিল অপেক্ষা করছে হৃদয়ের। লাল রঙের একটা সিল্কের শাড়ি পরেছে হৃদয়ের কাজিন লুনা আপুর কথায়। তিনি জানালেন হৃদয়ের পছন্দের রঙ লাল। তাই বিয়েতে সব জিনিস লাল রঙের ই বেশী কেনা হয়েছে। ঝিলমিল শাওয়ার নিলো। সাজগোজ ধুয়ে ফেলার কারণে লুনা আপু খুব আক্ষেপ করলেন,

“আহারে আমার ভাইটা তো ভালো করে দেখতেই পারলো না।”

ঝিলমিল জবাবে স্মিত হাসলো। আর কী দেখবে! সারাদিন তো একটু পর পর ও’কে দেখেছে। হৃদয় এলো একটু দেরি করে। এসেই ঝিলমিল কে প্রশ্ন করলো,

“তোমার খাওয়া হয়েছে?”

“হ্যাঁ। ”

“ভালো করে খেয়েছিলে?”

ঝিলমিল মৃদু হেসে বলল,

“হ্যাঁ। আপনার মা জোর করে খাওয়ালো। ”

“আচ্ছা। মা’কে মা বলে ডেকো। তাকে আবার হৃদয়ের মা সম্বোধনে ডেকো না৷ ক্ষেপে যাবে কিন্তু। ”

ঝিলমিল হেসে ফেলল। হৃদয়ের সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বলার মতো একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে এখন। ঝিলমিল সবার থেকে নীরবে দূরত্ব টেনে নিয়েছিল স্বেচ্ছায়। তখন কেবল হৃদয়ই ছিলো যার সঙ্গে একটা, দুটো কথা বলে শান্তি পেতো। সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মুহুর্তে হৃদয়। যার কাছে রাখঢাক নেই, কোনো কিছু নিয়ে জাজ করে ঝিলমিল কে বিব্রত করবে। অহেতুক প্রশ্ন করে আন্ডার কনফিডেন্ট ফিল করাবে না৷ হৃদয়ও খুব কেয়ারিং৷ যখনই ঝিলমিলের কোথাও যাবার থাকতো ও বাইকে করে পৌছে দিতো৷

হৃদয় ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লো। ঝিলমিল আগেই শুয়ে পড়েছিল। এর আগেও বেশ কয়েকবার ওরা বেড শেয়ার করেছে। দুজন দুইপাশে ঘুমিয়েছে। ঘুমের মধ্যেও কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি। আজ হৃদয় ঝিলমিলের কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টানলো। ঝিলমিল নি:শ্বাস বন্ধ করে ফেলল, তবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো না। হৃদয় কপালের পাশের চুল সরিয়ে চুমু খেল। ঝিলমিল চোখ বন্ধ রাখলো। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। হৃদয় প্রশ্রয় পেয়ে চুমুর ঝড় আরম্ভ করলো। ঝিলমিল শক্ত করে খামচে ধরলো টিশার্টের কলার।

চলবে…..