#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১৩
ঝিলমিল নিজের ঘরে বসে সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পর পর ভাবছে। প্রথমে ভেবেছিলও আজও বুঝি ইশিকা একগাদা অভিযোগ নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল ওঁরা আসতে বাধ্য হয়েছে। হৃদয় সন্ধ্যে থেকে ঝিলমিল কে ক্ষ্যাপাচ্ছে। একবার বলল,
“চলো যাই তোমার জন্য কিছু শপিং করি। ওই বাসায় বেড়াতে যাবে। সেজেগুজে যাবে না। অবশ্য ওরা যদি আমাদের বাসায় ডালভাত খেতে আসে তখনও আপ্যয়নের সময় সাজগোজের একটা ব্যাপার আছে। ”
ঝিলমিল চুপচাপ হজম করছে। ঘরে এসে হৃদয় ও’কে ওভাবে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখে বলল,
“আকাশের বউকে তোমার খুব পছন্দ হয়েছে না?”
ঝিলমিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আপনি তো দেখছি আধাজল খেয়ে আমার পিছনে লাগছেন। ”
“আবার আপনি! ”
ঝিলমিল কথাটা পুনরায় বলল,
“তুমি তো দেখছি আধাজল খেয়ে আমার পিছনে লেগে আছ?”
হৃদয় ঝিলমিলের পাশে বসে গম্ভীর গলায় বলল,
“বসার ঘরে ওদের দেখে আমার যতটা মেজাজ খারাপ করা উচিত, ততোটা হয় নি। উল্টো আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়েছে তোমার উপর। ”
“কেন?”
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিলো অদৃশ্য ভুত গলা চেপে বসে আছে তোমার। ঠিক কী কারণে ভয় পাচ্ছিলে?”
“ভয় না, অস্বস্তি। ”
“অস্বস্তি বা কেন হবে? তোমাকে ইশিকার মতো একটা থার্ডক্লাশ মেয়ে এসে কেন কথা শুনিয়ে যাবে? তোমার মুখ নেই। তুমি জানো না আকাশের ব্যাপারে কিছু। ”
“আমার সাহস নেই৷ আমি ওদের মতো কাউকে আঘাত করে কিছু বলতে পারি না। মুখের উপর কিছু বলতে হলে যে মনের জোর লাগে সেটা আমার নেই। ”
হৃদয় ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল,
“আচ্ছা! আমাকে কবে যেন একদিন গুন্ডা, অভদ্র কী কী যেন বলেছিলে?”
ঝিলমিল অসহায় চোখে তাকালো। বলল,
“গুন্ডা বলি নি। ”
“মুখে বলো নি, কিন্তু তোমার হাবভাবে মনে হতো যে মনে মনে গুন্ডা বলে আমাকে গালি দিচ্ছো। ”
ঝিলমিল চোখ নামিয়ে নিলো। আসলেই সত্যি। ওই সময়ে যাবার পথে দেখা হলে ও এমন কিছুই ভাবতো।
ঝিলমিল আমতা আমতা করে বলল,
“সেরকম কিছুও না…
“আগে আজকের টপিকে কথা বলি, চৈতীকে দেখে কনফিডেন্স ব্যাপার টা শেখা প্রয়োজন। কিভাবে সে চোখে চোখ রেখে কথা বলে সামনের মানুষ কে হতভম্ব করতে পারে। ”
ঝিলমিল শক্ত গলায় বলল,
“আচ্ছা। ”
“পুরোপুরি চৈতীর মতো হবার দরকার নেই৷ আকাশদের বাড়ির কেউ সামনে পড়লে চোখ যেন নামিয়ে না নেয়া হয়। আর বললে না, মনের জোর নেই। মনের জোর বাড়াও। এরপর কেউ কথা শোনাতে এলে শক্ত গলায় যেন জবাব দিতে পারো। ”
ঝিলমিল যন্ত্রের ন্যায় বলল,
“আচ্ছা। ”
হৃদয় বুঝতে পারলো ডোজটা বেশী হয়ে যাচ্ছে, ঝিলমিল রেগে যাচ্ছে। তবুও রাগ ভাঙানোর জন্য কিছু বলল না।
***
আকাশ এর আগে এতো রাগ কখনো হয় নি, সেই রাগ যে শুধু চৈতীর একার উপর তা না, মায়ের উপরও সমান রাগ হচ্ছে। আকাশ কঠিন গলায় মা’কে প্রশ্ন করলো,
“আম্মু তুমি তো খুব বলছিলে ভালো ঘরের ভদ্র, শান্ত মেয়ে। তাহলে এখন! এখন সবকিছু উল্টো কেন হচ্ছে? ”
রাহেলা চাপা গলায় বললেন,
“আস্তে কথা বলো। শুনলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দিবে না।”
আকাশ টেবিলে রাখা নোটবুক টা ছুড়ে ফেলে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখালো৷ এতো বড় স্পর্ধা চৈতীর। আকাশের সঙ্গে প্রতিটা কথায় তর্ক তৈরী হয়, একটা কথা হজম করে না, সেসব তবুও মেনে নেয়া যায়! তাই বলে আজকের ঘটনাও মেনে নিবে!
আকাশ আক্রোশে ফেটে পড়ে। বলে,
“আমি এসব মানব না। যা খুশি তাই করতে পারবে না ও। ”
ইশিকাও সায় দিলো। বলল,
” মানা উচিতও না। লাগামটা টেনে না ধরলে আরও উড়বে। বিয়ের একবছর হয়ে গেছে, তবুও স্বামী শাশুড়ীকে না জিজ্ঞেস করে কিছু করি না। ”
রাহেলা দু:খিত গলায় বললেন,
“খুব বেয়াদবী করলো। আমি তো খুব কষ্ট পাইছি।”
আকাশ বলল,
“তোমরা আস্কারা দিলেও আমি ও’কে কিছুতেই আস্কারা দিচ্ছি না। এখনই কথা বলব। ”
***
চৈতী নিজের ঘরে বসে আছে। হাতে মোবাইল। রাতে কিছু খায় নি, ওর আসলে খুব মেজাজ খারাপ। বাসার পরিস্থিতি যে ওর অনুকুলে নেই সেটা বুঝতে পেরেও তেমন চিন্তা হচ্ছে না। এতো রাত হয়ে গেল, অথচ আকাশের এখনো ঘরে আসার খবর নেই, সেটা দেখেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। প্রায় বারোটা বাজতে চলল ঘড়িতে।
আকাশ ঘরে ঢুকলো ঝড়ের গতিতে। ফোন টা ছুড়ে মারলো বিছানায়। চৈতী স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কী হলো?”
আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“খুব দরকার ছিলো আজকের নাটক টা করার?”
চৈতী ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,
“নাটক কখন করলাম? আর তুমি হাইপার কেন হচ্ছো?”
“চৈতী লিসেন, বেশী পাকামি করবে না। বেশী পাকামি আমার পছন্দ না।”
“আমি পাকামি করছি?”
“আম্মুর কথা না শুনে তুমি ওই বাসায় কেন গেছ? ফাজলামির একটা লিমিট থাকে, তুমি সেই লিমিট ক্রস করে ফেলেছ আজ। ”
আকাশ চৈতীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চৈতী তখনই ওর বাড়িতে কল করে, বাবা চাচাদের অস্থির করে ফেলল। তারা সমানে কল করে অস্থির করে ফেললেন আকাশ, রাহেলা আর তালুকদার সাহেব কে। রাহেলা এসে চৈতীকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করলেন কিন্তু ও শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। এদিকে বাপ, চাচারা তক্ষুনি রওনা হয়ে গেলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। পরিবারের সকলে পড়লেন বিপাকে। সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িতে শুরু হয়ে যাবে আরেক ঝড় তুফান। সেটা ভেবে চিন্তায় সকলের ঘুম হারাম হয়ে গেল।
***
ঝিলমিল খাটের এক কোনায় শুয়েছে। হৃদয় ওর গায়ে একটা হাত রাখলো। জিজ্ঞেস করলো,
“রেগে আছ তুমি? ”
“না। ”
হৃদয় ঝিলমিল কে কাছে টানলো। ঝিলমিল প্রত্যাখ্যান করতে পারলো না, যতবারই হৃদয় ও’কে কাছে টানে ও দূরে থাকতে পারে না। যা কিছু হচ্ছে সেখানে জোরপূর্বক কিছু হয় নি, ঝিলমিলের সায় ছিলো অবশ্যই। ব্যাপার টা ন্যাচারালি ঘটেছে। হৃদয় ঝিলমিলের কানের কাছের চুলগুলো সরিয়ে বলল,
“আচ্ছা সরি। ”
ঝিলমিল জবাব দিলো না। নীরবে হাসলো। অন্ধকার ঘরে সেই হাসি হৃদয়ের দেখার কথা না, তবুও অনুভব করলো যেন। হৃদয় বলল,
“যদি এখনো রেগে থাকো তাহলে আমাকে একটা চুমু দাও।”
ঝিলমিল খুব লজ্জা পেল। সবকিছু যেন খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এতো জলদি ওদের বোঝাপড়াটা হয়ে গেল যে ঝিলমিল মাঝেমধ্যে ভুলেই যায় যে কোন পরিস্থিতি আর কিভাবে ওদের বিয়ে হয়েছিল।
হৃদয় আরেকটু কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল,
“তার মানে তুমি রেগে আছ?”
ঝিলমিল আস্তে করে বলল,
“আর কতদিন পাড়ার দোকানে আড্ডা দিয়ে বেড়াবে?”
হৃদয় কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এই সময়ে টিপিক্যাল বউয়ের মতো প্রশ্ন করার দরকার ছিলো? ”
ঝিলমিল নি:শব্দে হাসলো। হৃদয় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ঝিলমিল কে। হাড়গোড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। ঝিলমিল চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষনের মধ্যেই রঙধনুর সাত রঙ দেখতে পাবে।
***
সকাল নয়টা। মিঠাপুকুর লেনের তালুকদার বাড়িতে কাজ করে মাজেদা খালা। সকালে তার এই বাসায় অনেক কাজ, কিন্তু আজ ফিরে যেতে হচ্ছে। নিচতলায় থাকে প্রফেসরের সাহেবের বউ৷ কাল রাতে সে দোতলায় ভাঙচুরের শব্দ পেয়েছে মাঝরাতে। এমনিতে এই বাসায় তেমন ঝামেলা নেই। কিন্তু কাল রাতে কী এমন ঘটেছে সেটা জানবার খুব আগ্রহ প্রফেসর সাহেবের বউয়ের। তিনি মাজেদাকে ডাকলেন,
“কী ব্যাপার মাজেদা, কই যাও সকাল সকাল? ”
“এই বাসায় তো কাজ নাই আজকে। ”
“কেন? কই যাইতেছে সবাই? ”
“জানিনা কী হইছে। আর যাবে কই? মেহমান আসছে এই সকালে। নতুন বউয়ের বাড়ি থেকে ছয়জন। ”
প্রফেসরের বউ সেটা জানে। গেট খুলে যখন ঢুকেছে তখন তিনি জানালা থেকে দেখেছে। তখনই আঁচ করেছিল যে নতুন বউকে ঘিরেই কিছু ঝামেলা হয়েছে।
তিনি বিস্তারিত শোনার জন্য মাজেদাকে ঘরে ডাকলেন। রুটি খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ঘটনা শুনলেন। প্রফেসর সাহেবের বউ এমনিতে কারো সাত, পাঁচে থাকেন না। কিন্তু সব ঘরের হাড়ির খবর তার কাছে আছে। দিন কয়েক আগে রাহেলা দুপুরবেলা বেরিয়ে যাবার পর তিনি গিয়েছিলেন চৈতীর কাছে গল্প করতে। মেয়েটা মিশুক না তেমন। তাই কথাবার্তা আগায় নি। তবে মাজেদার কাছ থেকে খবর পেলেন যে ঝিলমিলের ব্যাপারে সবকিছু জেনে খুব অশান্তি করছে চৈতী।
মাজেদা চলে গেল আরেক বাসার কাজে। অনেক বছর ধরে সে এই বাসায় আছে। রাহেলার ব্যবহার কাজের লোকেদের সাথে যাচ্ছেতাই। কাজ মনমতো না হলেই মেজাজ দেখান খুব। তবুও ভালো টাকা পাওয়া যায় বলে কাজ করে। কোরবানির সময়ে মাংস, ঈদে দুটো ভালো শাড়ির লোভেও কাজ ছাড়ার কথা ভাবে না। তাছাড়া প্রায়ই বেঁচে যাওয়া খাবার বাসার জন্য নিতে পারে। অনেক ভালো খাবার থাকে এদের প্রতিবেলায়। তবে মাজেদা একটা গাদ্দারি কাজ করেছে। চৈতীর কাছ থেকে এক জোড়া কানের দুল নিয়ে ঝিলমিলের সঙ্গে আকাশের সম্পর্কের কথা গড়গড় করে বলে দিয়েছে। চৈতী ফুসলিয়ে কাজ টা করতে বাধ্য করলেও তিনি দুলের লোভ ছাড়তে পারেন নি। এটা এমন কোনো অন্যায় না, গরীব মানুষের লোভ থাকতেই পারে। খু*ন খারাবি তো করে নি। চৈতী অবশ্য আল্লাহর কিরা করেছে, এই কথা কাউকে জানাবে না৷ কিন্তু মাজেদার মনোকষ্ট অন্য জায়গায়। কানের দুল জোড়া নিয়ে হাসিবের বাপ কে দেখিয়েছিল। তিনিও খুশি ছিলো। পরশু দিন গয়নার দোকানে নিয়ে গিয়ে পরখ করে ফিরে জানালেন ওটা সোনার না, রুপার উপর সোনার জল করা৷ বড়বাড়ির মেয়ে, বউ হলেও চৈতীর মন খুব ছোট। আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন মাজেদা। বেইমানীর বিচার তিনি করবেন।
চলবে…..