কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-১৪

0
15

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১৪
আকাশ দের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছেন চৈতীর মামা, বাবা, দুই চাচা, চাচী, মা আর দুই ভাই। এতজন মানুষ রাতে মেয়ের কান্না শুনে দেরি না করে রওনা হয়েছেন। একমাত্র মেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সকলের নয়ন মনি। আকাশের হাতে তুলে দেবার সময় বাপ, চাচারা গম্ভীর গলায় বলেছিলেন কোনো অবস্থাতেই তাদের মেয়ে যেন কষ্ট না পায়। খুব স্বাভাবিক একটা কথা। মেয়ের বিয়ের সময় বাড়ির লোক বরের বাড়ির সবাইকে এমন সৌজন্যমূলক কথা বলে। কিন্তু আজ যখন আকাশের কানে সেদিনের কথাটা বাজে তখন সূক্ষ্ম অনুভূতি বলে ওটা শুধু সৌজন্যমূলক কথা নয়, সাইলেন্ট থ্রেটও ছিলো বটে।

আকাশ দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। আসামী তো সে, ভিক্টিম মানে চৈতী মা’কে জড়িয়ে ধরে ব্যকুল হয়ে কাঁদছে। চাচী একটা হাত মেয়ের মাথার উপরে রেখে কড়া গলায় প্রশ্ন করছেন শাশুড়ীকে। রাহেলা ঠান্ডা গলায় বোঝানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু চৈতীর চাচীর গলা নমনীয় হবার নাম নেই। ইশিকা রান্নাঘরে গেল, কাজের লোকদের বিদায় করে দেয়ায় ওর দায়িত্ব পড়লো নাশতা বানানোর জন্য। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করে প্লেটে গুছিয়ে দিচ্ছে সেই সঙ্গে কানখাড়া করে শুনছে ড্রইং রুমের নাটক।

চৈতীর ভাই ধমকের সুরে বলল,

“কান্না থামিয়ে বল তোর সাথে কী করছে? ”

তালুকদার সাহেব প্রশ্ন করলেন,

“কী করছে মানে কী? এগুলো কেমন ধরনের প্রশ্ন বাবা? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হয় না?”

চৈতীর চাচা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বললেন,

“না না কিসের মনোমালিন্য! কতদিন হইছে বিয়ের? এর মধ্যে মনোমালিন্য কেন হবে? ”

রাহেলা মধুমিশ্রিত মিষ্টি গলায় বললেন,

“ভাইসাহেব শান্ত হন। চৈতী আম্মু তুমিও শান্ত হও। কিছু খেয়ে নাও। ”

চৈতীর বাবা বললেন,

“শান্ত থাকতে পারতেছে না দেখেই তো কাঁদতেছে। ”

রাহেলা পড়েছেন বিপাকে। তিনি পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না। সেই সময়ে ইশিকা খাবার নিয়ে এসে এক ধমক খেল চৈতীর চাচার কাছে। তিনি বললেন,

“আপনারা ফাজলামি পাইছেন? মাইয়া কানতেছে এরমধ্যে খাবারের ঢং করতেছেন?”

চৈতী কান্না থামিয়ে জানালো সে এই বাড়িতে থাকতে চায় না। সবাই খুব খারাপ ব্যবহার করছে। ও এখনই বাড়ি যাবে।

চৈতীর কথা শুনে ইশিকা, রাহেলা তালুকদার সাহেব অস্থির বোধ করলেও আকাশের কোনো ভাবান্তর হলো না। চৈতী সবার সামনেই ঘটনা খুলে বলল। আকাশ ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে সেটাও বলল। রাহেলা মাঝখানে বেশ কয়েকবার আম্মু আম্মু করে কিছু বলতে চাইলেও চৈতীর চাচা এক ধমক দিয়ে বলল,

“থামেন আপনি। ভালো মানুষ অন্য জায়গায় সাজেন।”

রাহেলা স্তব্ধ হলো চাচার ব্যবহারে। চৈতী ঝিলমিলের ব্যাপারে সবকিছু বলল সেই সঙ্গে ও’কে কিভাবে সবাই মিথ্যে বলেছে সেটাও উপস্থাপন করলো। স্বাভাবিক ভাবেই চৈতীর পরিবার হম্বিতম্বি করলেন আকাশের সাথে। এক পর্যায়ে চৈতীর মামা যিনি পুরো ঘটনায় চুপ থেকে বললেন,

“না মানে বুঝলাম না এতো সাহস কিভাবে হয় জামাইর? মেয়ের উপর রাগ দেখায়। বিয়েতে কী এমন জিনিস নাই যেটা দেয়া হয় নাই?”

আকাশ লজ্জিত বোধ করলো। রাহেলা বললেন,

“এসব কী বলেন!”

“বলবই তো, গাড়ি, টাকা সব দেয়া হইছে তারপরও মেয়ের সঙ্গে ধমকানো!”

তালুকদার সাহেব রাগী মানুষ। কিন্তু এখানে নিজের রাগী রুপ দেখাতে পারছেন না। তার বাসায় এসে বিয়েতে দেয়া জিনিসপত্র নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে। এ কেমন আত্মীয়।

চৈতী ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আকাশ স্বস্তি পেল। ও এক ফাঁকে অনিন্দিতাকে টেক্সট করলো, যে আজ ও যাবে। অনিন্দিতাও খুশি মনে রিপ্লাই দিলো। কিন্তু ওর পরিকল্পনায় ছাই দিলো চৈতীর চাচী। তিনি বললেন,

“আকাশ তুমিও চলো।”

আকাশ অবাক গলায় বলল,

“আমি!”

“ক্যান বউয়ের সাথে যাইতে কী সমস্যা? চৈতী কী সারাজীবন এর জন্য যাইতেছে যে একা যাবে? তুমিও যাবা।”

আকাশ মায়ের দিকে তাকালো। রাহেলা বললেন,

“হ্যাঁ আব্বু যাও। চৈতীকে একটু সময় দিও। তুমি ভুল করছ না?”

আকাশ রাগী চোখে মা’কে দেখলো। আজকের ঘটনায় স্পষ্ট বুঝলো সামনের দিনগুলোতে ওর কপালে আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। সাথে করে নিয়ে গিয়ে আরও নানান কথা শোনাবে সবাই মিলে। অনিচ্ছায় আকাশকেও মেনে নিতে হলো। অনিন্দিতাকে আবারও মেসেজ দিয়ে জানালো যে আজ যেতে পারবে না।

***
ঝিলমিল আজ ইউনিভার্সিটিতে যাবে। জাহানারা ও’কে গরম রুটি দিলেন। সঙ্গে ডিম, আলুভাজি। ঝিলমিল আস্তেধীরে খাচ্ছে। সকালের খাবারটা ওর ভালো করে খাওয়া হয় না। অল্প খেলেই কেমন পেট ভরা লাগে। জাহানারা ব্যাপার টা খেয়াল করেছেন। তিনি আজ জানতে চাইলেন,

“তুমি এতো কম খাও ক্যান? রান্না মজা হয় না?”

“না আম্মা। আমি এমনিই কম খাই। ”

“আরেকটু খাও, এতো কম খাইয়া কিভাবে সারাদিন থাকবা? একটা বক্সে খাবার দিয়া দেব?”

“না লাগবে না। ক্ষিদে পেলে ক্যান্টিনের খাবার খাব।”

জাহানারা এরপর কিছুক্ষন জ্ঞান দিলেন। বাইরের খাবার বাসী তেলে ভাজা হয়, ওগুলো খেলে শরীর ঠিক থাকে না। ঝিলমিল হাসিমুখে সব শুনলো। শাশুড়ী এখন পর্যন্ত ও’কে আদরই করছেন। ওনাকে বেশ কয়েকবার পাড়ায় ঝগড়া করতে ও দেখেছে। তবে সেই মানুষ ওর সঙ্গে একদম অন্য রকমের। এমন থাকুক সবসময়। অবশ্য উনি যদি বকাঝকাও করেন কখনো ও কিছু বলতে পারবে না। কারোর কথার পিঠে কথা বলার অভ্যাস ওর নেই। জাহানারা ও’র কাছে জানতে চাইলেন কালকের ঘটনায় রেগে আছে কী না৷ রেগে যেন না থাকে, একজন বাড়ি এসে বউ দেখতে চাইলে সে কিভাবে না করতে পারে। ঝিলমিল তাকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে পড়লো। আজ হৃদয়কে দেখা যাচ্ছে না। সকালে একটু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। ঝিলমিল জানতে চায় নি কোথায় গেছে।

***
লাইব্রেরীতে গিয়ে স্বর্নার সঙ্গে দেখা হলো। ঝিলমিল প্রথম লেকচারটা মিস করেছে। স্বর্না বলল,

“বিয়ে যেমন ই হোক, তুই কিন্তু এই কদিনে ভালোই সুন্দর হইছিস। ”

ঝিলমিল হেসে বলল,

“যেমন হোক মানে কী? তুই খাবার পাস নি বিয়েতে?”

স্বর্না হাসতে হাসতে বলল,

“জানিস ইশিকা আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে ফেসবুকে। তোর বিয়ের ছবিগুলো দিয়েছিলাম। ”

ঝিলমিল মন খারাপ করা গলায় বলল,

“ওর কথা আর আমাকে বলিস না তো। শুনতে ইচ্ছে করে না।”

“হ্যাঁ ওদের ভুলে যা। তুই ভালো থাক। ”

ঝিলমিল হাসলো। মাঝেমধ্যে ওর স্বর্নাকে আকাশের কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু থেমে যায়, কেন থামে সেটা জানেনা।

ইউনিভার্সিটি তে থাকা অবস্থায় মায়ের কল পেল ঝিলমিল। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“তুই বাইরে? ”

“হ্যাঁ মা ইউনিভার্সিটিতে। ”

“কাল নাকি ইশিকা আর ওর মা গিয়েছিল ওই বাড়িতে।”

“হ্যাঁ। কার কাছে শুনলে?”

“প্রফেসর সাহেবের বউ আসছিলেন কথা নিতে। আকাশের বউও গিয়েছিল নাকি?”

“হ্যাঁ। ”

“কিছু ঝামেলা হয়েছে।”

“ঝামেলা কিছু হলে তো শুনতে পারতে। ”

আসমা একটু থেমে বলেন,

“সব কথা বলিস না তো তুই। কতো কথা চেপে যাস।”

মায়ের কথায় দীর্ঘশ্বাসের আভাস পেল ঝিলমিল। সত্যিই কতো কিছু লুকিয়েছে মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু সেটার দরকার ছিলো, অহেতুক কষ্ট টেনশন দিতে চায় নি।

“কিছু হয় নি। হলেও হৃদয় কাউকে ছেড়ে দিতো না।”

আসমা স্বস্তি পেলেন। এটা ঠিক, হৃদয় আছে ও’কে আগলে রাখার জন্য।

“কাল একবার আয় তোরা। আমি হৃদয়কেও কল করে বলব।”

“আচ্ছা।”

“আর শোন, টুটুলের সঙ্গে রেগে থাকিস না। ছেলেমানুষ রাগ সামলাতে পারে নি, ওর সঙ্গে কথা বলিস।”

ঝিলমিল আচ্ছা বলে কল কাটলো। টুটুলের সঙ্গে সেদিনের পর ও ভালো করে কথা বলে নি। বিয়ের সময়ে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলেছে। বাসার সবার প্রতি ওর চাপা অভিমান আছে, সেগুলো হয়তো কখনো যাবেও না। সময়টা চলে গেলেও তিক্ত কথার দাগগুলো মনে ঠিকই থেকে যায়।

***
হৃদয় বাসায় ফিরলো বিকেলে। ঝিলমিল তখনও আসে নি। ওখান থেকে টিউশনে যাবে। জাহানারা হৃদয়কে খেতে দিয়ে আকাশদের বাড়ির খবর দিলেন। হৃদয় শুনলো চুপচাপ। মা আগ্রহ করে বলছেন বলে ও বারণ করলো না। তবে মা’কেও একটা কথা বলে দিতে হবে, এই বাড়িতে আকাশদের প্রসঙ্গে আলোচনা বন্ধ করতে হবে। তার যদি শুনতে ইচ্ছে হয় তবে শুনে যেন চুপচাপ থাকে। খাওয়া শেষ করে হৃদয় ঘরে এসে বিছানায় খানিকক্ষণ গড়াগড়ি খেল, টিভি দেখলো। ঝিলমিল কে কল করলো। ঝিলমিল কল কেটে মেসেজে লিখলো ফ্রী হয়ে কল দিবে। বিয়ের আগে এই ঘরে শুয়ে বসে, কাজ না করেও ওর কতো সময় কেটেছে। এতো ফাঁকা অনুভূতি কখনো হয় নি। আজ গিয়েছিল এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। নতুন একটা ইলেক্ট্রনিক শোরুম খোলার কথা ভাবছে। সেটা নিয়ে ছোটাছুটি করতে হলো। বেশ ক্লান্তি অনুভব করছে কিন্তু একটু রেস্ট নিতে পারছে না। ঝিলমিল কখন আসবে! সেই সকালে দেখে গিয়েছিল, সারাদিনে একবারও দেখে নি।

হৃদয় বেরিয়ে গেল বাইক নিয়ে। আজ থেকে দুই মাস আগেও এমন বিকেল ও আড্ডা দিয়ে কিংবা টিভি দেখে কাটিয়েছে। তখনও ওর মনে হয় নি দুইমাস বাদে ও ঝিলমিলের ডেস্পারেট হাজবেন্ড হবে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ওর মনে পড়লো এখন তো বসন্তকাল চলছে। এবারের বসন্তটা একদম রাঙিয়ে দিয়ে গেল ও’কে।

চলবে….