#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১৫
হৃদয়ের থমথমে মুখ দেখে ঝিলমিল প্রশ্ন করলো,
“কিছু সমস্যা হয়েছে?”
“তোমার এই ছেলে মেয়েগুলোর পরীক্ষা আর কতদিন চলবে? ”
ঝিলমিল ভারী অবাক হলো। হৃদয়ের কুঁচকানো কপাল আর থমথমে মুখ দেখে ভেবেছিল আকাশ কে নিয়ে আবার কোনো সমস্যা হয়েছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছিলো। ঝিলমিল ওর কাঁধে ভর দিয়ে বাইকে বসার সময় বলল,
“ওই ছেলে মেয়েগুলো আমার না, আমি ওদের পড়াই। ”
হৃদয় হেসে ফেলল। হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু খাবে?”
“খাওয়া যায়। ”
বাইকের স্পিড বাড়িয়ে ছুটলো মেইন রোডের দিকে। ঝিলমিলের চুলগুলো কপালের দু’পাশের ক্লিপে আটকে থেকেও অবাধ্য হবার জন্য হাপিত্যেশ করছে। ঝিলমিল এক হাতে চুল ঠিক করতে গেলে হৃদয় উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“তুমি ভালো করে ধরে বসো। হাত সরিয়ে নিয়েছ কেন?”
ঝিলমিল শক্ত করে ধরে বসলো। সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তিরা উড়ে চলে যাচ্ছে বাতাসের সঙ্গে। ঝিলমিল একটু একটু করে হালকা হচ্ছে। সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে গেছে পূবাকাশে। ঝিলমিল চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতে লাগলো মুহুর্ত টা।
***
রাত এগারোটা বাজতে চলল। আকাশ খেয়েদেয়ে কিছু সময় হাটার নাম করে চৈতীদের বাসা থেকে সামনের রাস্তায় এলো। কল করলো অনিন্দিতা কে। অনিন্দিতা আজ সারাদিন এই কলটার অপেক্ষায় ছিলো। কল রিসিভ করে ব্যস্ত গলায় বলল,
“কেমন আছ তুমি? ”
আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি বেঁচে আছি অনি। ”
অনিন্দিতার বুক কাঁপে। ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“আকাশ তুমি এভাবে কথা কেন বলছ?”
আকাশ অনিচ্ছাস্বত্তেও সংক্ষেপে কাল থেকে আজ অবধি সব খুলে বলল। অনিন্দিতা হতাশ গলায় বলল,
“এতো কিছু ঘটে গেছে? মনে হচ্ছে কোনো নাটকের গল্প শুনছি। ”
আকাশ রূঢ় ভঙ্গিতে বলল,
“তুমি আর আম্মু দুজনেই আসলে মানুষ চিনো না। কী বলেছিলে তোমরা? গ্রাম মফস্বলের মেয়েদের যা বুঝ দেয়া হয় তারা তাই বোঝে। আজ পর্যন্ত একটা নরমাল কথা চৈতীকে মানাতে পারি নি।”
অনিন্দিতা মন খারাপ করে বলল,
“আমি তেমনই জানতাম। থাক তুমি মন খারাপ কোরো না।”
আকাশ আক্রোশে ফেটে পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“মন খারাপ করব কেন? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার পুরো লাইফ শেষ হতে যাচ্ছে। আর আমি মন খারাপ করব? আমি তো চিল করব, ঢাকায় এসে বারে যাব, গলা ভিজিয়ে আনন্দ, ফূর্তি করব। ”
অনিন্দিতা আশ্বাসের সুরে বলল,
“আমি আছি তো নাকি। একটা না একটা উপায় ঠিক খুঁজে বের করব। তোমার লাইফ শেষ হবে না, কিছুতেই না। ”
প্রবল অন্ধকারেও এক টুকরো আলোর সন্ধান পেয়ে আকাশ নির্ভার হলো। বলল,
“আমি ভীষণ ক্লান্ত অনিন্দিতা, ঘুমাতে পারছি না, কাল রাতের পর আজ সন্ধ্যায় ভালো করে খেতে পারলাম। ”
অনিন্দিতা আঁতকে উঠে বলল,
“তোমাকে না খাওয়ায়ে রাখছে? খাও নাই ক্যান? ”
“তুমি আমার সিচুয়েশন টা বুঝতে পারছ না। আমি হয়তো বোঝাতে সক্ষম হচ্ছি না। এক গ্লাস পানি খেলেও সবাই চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। চৈতী কাঁদছে সেই অবস্থায় আমি পানি খাবার কথা ভাবছি কী করে!”
অনিন্দিতা মন খারাপ করা গলায় বলল,
“আকাশ তোমার আব্বু, আম্মু কী বলে? ”
“পুরো ডাকাত ফ্যামিলি। পাগল বানায়ে রাখছে সবাইকে। আব্বু, আম্মুকেও একটু পর পর কল করে ধমকাচ্ছে। এরা নাকি ভালো ফ্যামিলি। আম্মুর উপর রাগ হয়। কী দেখে এদের ভালো ভেবেছে। ”
“অর্থ, সম্পদ দেখে ভালো ভেবেছে। অর্থ প্রতিপত্তি এগুলোও দরকার। তারা এক হিসেবে ভুল করেন নি। ”
আকাশ চিৎকার করে বলল,
“ফোন রাখো তুমি! ”
অনিন্দিতা কিছু বলার আগেই আকাশ কল কেটে দিলো। ঘাড় ফিরাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। চৈতীর ছোট ভাই চমন দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ও জিজ্ঞেস করলো,
“কী, কিছু বলবা?”
“কার সাথে চিল্লাইছেন? ”
“আমার আম্মুর সাথে। কোনো সমস্যা? ”
“না। বাড়ি আসেন, আপু আপনারে খোঁজে। ”
“আচ্ছা। ”
আকাশ যেতে যেতে দেখলো অনিন্দিতা টেক্সট করেছে। লিখেছে,
“মাথা ঠান্ডা রাখো আর কল হিস্ট্রি ডিলিট করে দাও। রেগে ডিসিশন নেয়া যাবে না। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে অতি শিগগিরই। ”
আকাশ সঙ্গে সঙ্গে চ্যাট হিস্ট্রি, কল হিস্ট্রি ডিলিট করে দিলো। ওর ভাগ্য এখনো ভালো, চৈতীর হাত ফোন পর্যন্ত আসে নি। আসলে তো ফেসে যেত! প্রতি সপ্তাহে ফোনের সবকিছু ক্লিন করে ও, এখন মনে হচ্ছে আরেকটা ফোন রাখতে হবে। ”
***
অনিন্দিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অপূর্ব পড়ার টেবিল থেকে উঠে কখন যে ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায় নি। হঠাৎ পিছনে ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলেও সামলে নিয়ে বলল,
“কিছু বলবি বাবু?”
অপূর্ব গম্ভীর গলায় বলল,
“তুমি কার সাথে কথা বলছিলে মা?”
“তোমার রিতা আন্টির সঙ্গে। কেন বাবু?”
অপূর্ব’র চোখে রাগের পরিবর্তে এখন হতাশা। ভাঙা গলায় বলল,
“মা তুমি বাবাকে কথা দিয়েছিলে… তারপরও আবার ওই লোকটাকে কল করছ?”
“তুমি পড়তে যাও বাবু। ”
“মা আমি কালিম্পং যাব না। আমাকে দূরে পাঠানোর জন্য কিছু করলে….
অনিন্দিতা কঠিন গলায় বলল,
“অপূর্ব! ”
অপূর্ব চোখ নামিয়ে নিলো। অনিন্দিতা একই রকম কঠিন স্বরে বলল,
“যাও তুমি। ”
অপূর্ব চলে গেল। অনিন্দিতার চিন্তার শেষ নেই। ছেলেটা বড় হবার পর অনেক কিছু মানতে চাইছে না। আকাশ কে আগে পছন্দ করলেও এখন করে না, আকাশ সেটা বুঝতে পারলেও অনিন্দিতা ছেলের ব্যাপারে কিছু বলে নি।
এই ছেলেটা একদিন অসময়ে বাসায় এসে মায়ের বেডরুমে তার পুরোনো টিচারকে দেখে সহজভাবে নেয় নি। মা’কে কিছু জিজ্ঞেস না করেই বাবাকে কল করে সব বলেছে। অনিন্দিতা সেইবার অনেক কষ্ট করে সব ম্যানেজ করেছিল। এরপর সতর্ক হয়েছে সব জায়গায়। কেয়ারটেকার, দারোয়ান, ম্যানেজার, সবাইকে দলে রাখতে নোট গুনতে হয়েছে। এভাবে কতদিন! তাই ভাবছে ছেলেকে পড়ার জন্য অন্য জায়গায় পাঠাবে।
****
আকাশ ঘরে ঢুকতেই একে একে সবার জেরার মুখে পড়লো। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ঘরে এসে চৈতীকে জিজ্ঞেস করলো,
“আমি কী এখন ঘুমাতে পারি?”
চৈতী অভিমানী গলায় বলল,
“আমি কী মানা করছি?”
আকাশ শুয়ে পড়লো আর কোনো কথা খরচ না করেই। একটু তন্দ্রাভাব এসেছে এরমধ্যে চৈতীর কান্নার শব্দ কানে এলো। লাফিয়ে উঠে বসলো।
“চৈতী আবার কী হইছে? ”
“যা হইছে তা কী কম!”
চৈতী নাক টেনে জবাব দিলো। আকাশ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। ভুল করেও কখনো মনে হয় নি যে এক ফোঁটা ঘুমানোর জন্য ওর এতো কাতর হতে হবে। আকাশ আজ চৈতীর বাড়ির সবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। মৌখিক কথাও দিয়েছে যে আর আঘাত করে চৈতীর সাথে কথা বলবে না। এরপর আর কী করতে পারে!
আকাশ জিজ্ঞেস করলো,
“আমি এখন কী করব চৈতী? কী করলে তোমরা শান্ত হবে? ”
“তুমি কেন আমাকে মিথ্যে বললে? কেন ঝিলমিলের সাথে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করলে?”
“আমার ভুল হয়েছে। ”
“তুমি, তোমার মা, বোন একেকটা মিথ্যুক। এদের সঙ্গে থাকতে হবে আমার! ”
আকাশ চুপ করে রইলো। চৈতী বলল,
“শোনো আমি তোমাকে নিয়ে খুব পজেসিভ। ”
“ঝিলমিলের তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই না! আমার কন্টাক্ট লিস্টে ওর নাম্বার টা পর্যন্ত নেই। ”
“তোমাদের সম্পর্ক টা কতদূর এগিয়েছিল? কতটা গভীর ছিলো? ”
আকাশ হতাশ চোখে তাকালো। বলল,
“আমার তরফ থেকে যা কিছু ছিলো সেটা শর্ট টাইমের। আমি ওর মতলব বুঝতে পেরে ভদ্র মানুষের মতো পিছিয়ে গেছি। ”
চৈতী বাঘের ন্যায় গর্জন করে উঠলো। বেডসাইডে একটা ফুলদানি ছিলো সেটা হাতে নিয়ে বলল,
“এটা দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব তোর কু*ত্তার বাচ্চা। তুই সিডনি যাবার আগে আংটি দিয়া গেছস। হৃদয়ের সাথে তোর মারামারি হইছে ঝিলমিল কে নিয়া। অথচ আমার সাথে সিডনিতে থাকতে যখন কথা বলতি তখন বলছ কোনো মেয়ের সাথে প্রেম ছিলো না। ”
আকাশ স্থির চোখে তাকিয়ে আছে ফুলদানির দিকে। ওটা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে ও’কে নিস্তার দিক এই ঝামেলা থেকে। চৈতী মেঘস্বরে বলল,
“বাটপার! পুরো গুষ্টি বাটপার। বাটপারি ছুটায়ে দেব আমি। ”
আকাশের চোখ জ্বলছে এখন রীতিমতো। একটু আগে ও’কে ভয়ংকর একটা গালি দিলো, তুই তোকারি পর্যন্ত করলো। সেসবের মিশ্র অনুভূতিতে জর্জরিত হয়ে আছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মা আর অনিন্দিতার উপর।
***
সকালের মৃদু রোদ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকলো। সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। হৃদয় জানালাটা খুলে দিলো। উষ্ণ রোদে ঝিলমিলের মুখে পড়তেই কপালে ভাজ পড়লো। ঝিলমিল একটা হাত চোখের উপর দিয়ে রোদটা আড়াল করার চেষ্টা করে বলল,
“আমি আরেকটু ঘুমাব। ”
হৃদয় মৃদু হেসে কপালে হাত রাখতে গিয়ে দেখলো ঝিলমিলের গা গরম। জ্বরে রীতিমতো গা পুড়ে যাচ্ছে। সারা সকাল, দুপুর মাথায় পানি ঢালল, জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামানোর চেষ্টা করলো। মাঝখানে অল্প একটু খাইয়ে প্যারাসিটামল দিয়েছিল। দুপুরেও জ্বর তেমন কমছে না দেখে ডাক্তারও আনালো। হৃদয়ের বাবা, মা’ও সমানে চিন্তা করে যাচ্ছেন।
আজ ওদের ঝিলমিল দের বাসায় যাবার কথা, আসমা কল করলে হৃদয় জানালো যে ঝিলমিলের জ্বর। আসমা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
“হঠাৎ জ্বর? ঠান্ডা লেগেছে? ”
“হ্যাঁ। ”
“ওর অসুখ বিসুখ সাড়তে সময় লাগে। ”
হৃদয় এই কথা শুনে আরও বেশী অস্থির হলো।
ঝিলমিল ঘোরের মধ্যেও টের পেল হৃদয়ের অস্থির হওয়া। মা, বাবা এসেছিলেন ও’কে দেখতে। মা অনেকটা সময় গালে, কপালে ছুঁয়ে দিয়েছেন। শাশুড়ী খাওয়া নিয়ে মা’কে অনেক অভিযোগ করলেন। ঝিলমিল খুব কম খায়, হাবিজাবিও বেশী খায় না। জ্বর হলে কী খেতে পারে সেটাও জানতে চাইলেন। হৃদয় সারারাত জেগে থাকে, বিরক্তিহীন ভাবে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, গ্লুকোজ, পানি খাইয়ে দেয়।
একই সময়ে বিয়ে হওয়া দুটো মেয়ের জীবন দুই রকম। অর্থ বিত্ত, প্রভাব প্রতিপত্তির মধ্যে বড় হওয়া চৈতী মানসিক ভাবে নিজে বিপর্যস্ত হবার পাশাপাশি সবাইকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আকাশের মা ছেলের জীবনের অস্থির এই সময়কে ভেবে ভয়ে কেঁপে ওঠেন। তিনি ভেবেছিলেন তার সন্তান এখানেই সবচেয়ে ভালো থাকবেন। কিন্তু এখন ভালোটা দিতে গিয়ে অনেক কিছু না হারিয়ে ফেলেন! কে কতটুকু ভালো থাকবে সেটার হিসেব করেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। টাকা, পয়সা, প্রভাব প্রতিপত্তি এসব আসলে আপেক্ষিক।
চলবে….
#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১৬
অসুখ ঝিলমিল কে খুব নাজেহাল করে ছাড়লো । একটানা দুই সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে অসুস্থ ছিলো। জ্বর কখনো কমে যায়, কখনো বেড়ে এমন অবস্থা হয় যে একেবারে অচেতন হয়ে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি না করে বাসায় থেকেই চিকিৎসা হলো। হৃদয় পুরো সময়টা পাশে থেকে যত্ন করেছে। পনেরো ষোলো দিনে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত যায় নি। অসুস্থ ছিলো ঝিলমিল অথচ ওর নাওয়া, খাওয়া সব বন্ধ ছিলো। আসমা প্রতিদিন মেয়েকে দেখতে আসতেন। একটু পিঠা, খিচুড়ি করে নিয়ে আসতেন যদি ঝিলমিল খেতে পারে। জাহানারা আসমাকে ছেলের কথা বলেন। ঠিকঠাক খায় না, ঘুমায় না। আসমার খুব মায়া হলো। তিনি নিজেও খেয়াল করেছেন। মনে মনে খুশিও হলেন। মেয়েকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই, জামাইকে নিয়েও আক্ষেপ কম ছিলো না। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তিনি হৃদয়ের অন্য আরেক রুপ দেখলেন। একদিন বললেন,
“তুমি এভাবে নিজের অযত্ন করছো বাবা, এরপর তো অসুস্থ হয়ে যাবে। অন্তত খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করো। ”
“জোর করে খাওয়া যায় না, মন মেজাজ ভালো না থাকলে কিছুতেই শান্তি আসে না।”
আসমা তারপর আর কিছু বলেন নি। মেয়ের জন্য তিনি প্রতি নামাজের পড়ে প্রার্থনা করেন যেন ওর সবসময় ভালো হয়, কষ্ট যেন না পায়। এখন তার প্রার্থনায় বলা শব্দগুলো পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এখন বলেন, মেয়েটা সারাজীবন শ্বশুর বাড়িতে এমনই আদর, যত্নে ভালোবাসায় থাকুক।
***
আজ অনেক দিন বাদে ঝিলমিলের সকাল দেখা হলো। শরীর টা আজ একটু ভালো লাগছে। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসলো একটু। সামনে ছোট্ট টেবিলে বই খাতা রাখা। জাহানারা এক কাপ চা এনে রাখলেন। ঝিলমিল এই অসুখের মধ্যে চা খাওয়া প্রায় ভুলেই গেছে। আয়োজন করে শেষ কবে চা খেয়েছিল স্মৃতিতে নেই।
সামনে পরীক্ষা আছে। প্রচুর পড়াশোনা বাকী আছে। তাই বইপত্র খুলে দুই একটা লাইন পড়ার চেষ্টা করছে। জীবনে পর পর এমন ঝড়, তুফান চলে গেল যে পড়াশোনা নামেও একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিল। কাল ও’কে বই নিয়ে বসতে দেখে হৃদয় বলেছিল,
“তোমার এতো চাপ নেয়ার দরকার নেই। দরকার হলে এবার পরীক্ষা দিতে হবে না। আগে সুস্থতা জরুরী। ”
হৃদয়ের কথা মনে পড়ায় হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। হৃদয়ের অনেক পাগলামী আছে। দেখে বোঝা যায় না, শক্ত গলায় কথা বলে, কঠিন চোখে তাকায়। এমন ছেলের সঙ্গে কেউ কখনো প্রেম করার কথা ভাবে না। অথচ ও বিয়েও করে ফেলেছে।
হৃদয় খুব কেয়ারিং হাজবেন্ড। আড্ডা দেয়া, বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে বউয়ের জন্য রাত জেগে বসে থাকতে পারে, স্যুপ, রামেন বানাতে পারে। আবার সারপ্রাইজিংলি সেগুলো খেতেও সুস্বাদু হয়। কাপড় ভাজ করে গুছিয়ে রাখা, চায়ের কাপে চিনি গুলে এক সিপ নিজে নিয়ে চেক করে দেখায় বাড়তি যত্নের আভাস পেয়ে যায়। ঝিলমিল সব খেয়াল করেছে। এমন কিছু হৃদয়ের কাছ থেকে আশা করে নি, সত্যি বলতে ঝিলমিল সম্মান ছাড়া বাড়তি কোনো কিছুই আশা করে নি। সম্পর্ক, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও বাড়তি কিছু ভাবে নি। পরে যা কিছু ঘটবে সেটা তখন দেখা যাবে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছে।
ঝিলমিল জানে হৃদয় ও’কে ভালোবাসে। অনেক দিন আগে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেছিল। সাথে বলেও দিয়েছিল ও জবাবের অপেক্ষায় থাকবে। তারপর ওদের জীবনে কতকিছু ঘটে গেল যা নাটক কেও হার মানিয়ে দেয়। হৃদয় বিয়ের পর একবারও ভালোবাসার কথা বলে নি, তবে ওর আচরণে সেটা প্রকাশও পেয়েছে কয়েকবার। কেয়ারিং, লাভিং, পজেসিভ সবকিছুই দেখা গেছে। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো আলাদা করে হৃদয় ঝিলমিলের প্রতি কোনো এক্সপেক্টেশন রাখে নি। যা কিছু হয়েছে সবই ন্যাচারাল ভাবে হয়েছে। আরোপিত কিছু সেখানে ছিলো না।
হৃদয় আজ সকালে বেরিয়েছে। খুব দরকার বলে যেতে হলো। যাবার আগে ঝিলমিল কে কঠিন উপদেশ দিয়ে গেল, খাওয়া দাওয়া নিয়ে যেন ফাঁকিবাজি না করে। তাড়াতাড়ি ফিরবে কথাও দিয়ে গেল।
ঝিলমিল খানিকক্ষণ বারান্দায় থেকে জাহানারার খোঁজে গেল রান্নাঘরে। শাশুড়ী মানুষ টা ভালোই ওর সঙ্গে। প্রচুর গল্প করতে পারেন। মিঠাপুকুর লেনের সব খবর তার কাছে আছে। কার বাড়ি কী হয়, কার সংসারে কী ঝামেলা সব সে জানে। শাশুড়ীর থেকে ঝিলমিল জানতে পারলো আকাশদের সংসারে শান্তি নাই। বউটা খুব খারাপ। মাথা গরম হলে এটা, ওটা ভাঙে। স্বামীর সাথে রাগারাগি করে একটা দামী ডিনারসেট ভাঙছে। এদিকে বউয়ের বাপের বাড়ির লোকজনের নাকি খুব অহংকার। জামাই বউ ঝগড়া করছে তাতে আরও আগুন দিয়ে কী কী যেন করে গেছে। যাবার সময় তাদের দেয়া গাড়িটা নিয়ে গেছে। জামাই, বউ আসছে গাড়ি ছাড়া। মনে হয় গাড়ি রেখে দিছে। গাড়ির কাহিনী বলতে গিয়ে জাহানারা খুব হাসছিলেন। না চাইতেও ঝিলমিল আকাশের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে শুনলো। কিন্তু শাশুড়ীকে কিছু বলল না। আকাশের ভালো, খারাপ সব কিছুতেই ওর অনুভূতি শূন্য। একসময়ের পছন্দের পুরুষ এখন শুধু ঘৃনার পাত্র। নাম শুনলেও ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে একতা হাউজিং এর সেই দৃশ্যটি। কী বীভৎস কুৎসিত দৃশ্য। আজকাল ভালো মানুষ শব্দটা শুনতেও কেমন যেন লাগে। তারচেয়ে মনে হয় খারাপ মানুষেরাই ভালো।
ঝিলমিল রান্নাঘর থেকে শুনলো জাহানারা একতলায় ঝগড়া করছেন। তার গলার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে আরও তিনটা গলার আওয়াজে। একতলার ভাড়াটিয়াদের ও চিনে। সাথীদের বাসা, সাথী বিথী দুই বোন ওদের বিল্ডিংএ সীমা আপুর কাছে পড়তে যেত। সেই সুবাদে আলাপ আছে। ঝিলমিল নিচে নেমে এলো। ঝগড়ার কারণ খুব সামান্য। হাটার রাস্তায় পানি ফেলে রেখেছে। জাহানারা সেটা নিয়ে কিছু একটা বলেছিলেন। তিন মা, মেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ঝগড়া শুরু করেছে। ঝিলমিল শাশুড়ীর হাত ধরে দুই তিন বার বলল,
“আম্মা চলেন ঘরে। ”
জাহানারা গেলেন না। ঝগড়া বাড়তে লাগলো আরও। একপর্যায়ে সাথী জাহানারাকে তুই তোকারি শুরু করলো। ঝিলমিল স্তব্ধ হলো, এতো ছোট একটা মেয়ে মায়ের বয়সী একজন কে তুই সম্বোধনে কথা বলছে! ঝগড়ার ভাষা অসুন্দর হয় সেটা স্বাভাবিক তাই বলে এমন বয়োজ্যেষ্ঠ কে অপমান! ঝিলমিল হঠাৎ কঠিন গলায় বলল,
“এই সাথী তুমি অসভ্যের মতো কথা বলছ কেন? উনি তোমার মুরব্বি না?”
ন্যানো সেকেন্ডের জন্য নীরব হলো পরিবেশ। দোতলা, তিনতলায় যারা ছিলো তারা নেমে এসে মজা দেখছে। কেউ কিছু বলছে না৷ সাথীর মা হঠাৎ ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি থামো, তোমার কাহিনী সবাই জানে! আমার মেয়েরে অসভ্য বলতে আসছে!”
ঝিলমিলেরও রাগ উঠে গেল। বলল,
“আপনিও অসভ্য। বাড়িওয়ালার বাড়িতে থাকতে হলে রুলস ফলো করতে হয়। সেটা নিয়ে আবার আসছেন ঝগড়া করতে।”
জাহানারা সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন। সাথী মেয়েটা চুপ ছিলো। এখন সেও শুরু করেছে। ঝিলমিলকে একবার বলল,
“যেমন শাশুড়ী তেমন বউ। অসভ্য কে সেটা সবাই জানে পাড়ায়। ”
ঝিলমিল আবারও বলল,
“সাথী তুমি আর তোমার মা মুখ সামলে কথা বলো, নাহলে লিটনের কথা যা জানি সব বলে দেব। ”
লিটন মিঠাপুকুর লেনে রোমিও নামে পরিচিত। সে যখন বাইরে বের হয় তার কানে ফোন থাকে, বারান্দায় আসে তখনও কানে ফোন। শোনা যায় মিঠাপুকুর লেনের তিনটা মেয়েই নাকি তার গার্লফ্রেন্ড। লিটন কে সবাই কন্যারাশির জাতকও বলে মজা করে। তবে মা চাচীদের ভারী অপছন্দের। লিটন হাফ প্যান্ট পরে হাটে। এক টিশার্টেই তাকে দেখা যায়। ঝিলমিলের মায়ের ধারণা সেই টিশার্ট এক মাসেও ধোয় না।
জাহানারা লিটনের ব্যাপার শুনে আরও জোরে জোরে বললেন,
“আরেহ মোটকা বেডি, খাইয়া খাইয়া মোটা হও, আর এদিকে তোর মাইয়া হেলু হেলু করে লিটইন্যার সাথে। ”
সাথীর মায়ের চোখ দিয়ে আগুন বের হলেও মুখ বন্ধ হয়েছে। সঙ্গে তাদের মেয়েদেরও। সাথী এখন মাথানত করে আছে। দ্রুত ওর মা মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। জাহানারা একাই বকে যাচ্ছেন। সেই সময় হৃদয় এসে দেখলো তার মা, বউ দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
***
“সিরিয়াসলি? তুমিও আম্মার মতো ঝগড়া করতে নেমে গেছ?”
হৃদয়ের বিস্ময় কাটছে না। ঝিলমিল লজ্জা পেল। জাহানারা খুব খুশি। সাথীর মায়ের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে ঝিলমিল। তিনি বারবার ঘুরেফিরে প্রশংসা করছে।
হৃদয় ঝিলমিল কে বলল,
“কাছে আসো তো, দেখি জ্বর আছে কী না। ”
ঝিলমিল কাছে আসলো। হৃদয় কপালে, গালে হাত দিয়ে বলল,
“না জ্বর নেই। শক্তিও তো আছে ভালোই। নাহলে ঝগড়া করতে কিভাবে গেলে? ”
ঝিলমিল স্মিত হেসে বলল,
“ওরা তিনজন আর আম্মা একা ছিলেন। আশ্চর্য বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়াটিয়ার এমন ঝগড়া প্রথম দেখলাম। আমাদের বাড়িওয়ালা কিছু বললেও তো আমরা চুপচাপ মেনে নিতাম। ”
হৃদয় শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
“ঝগড়ার টপিক জানতে চাইছি না। আমি জানতে চাই তুমি ঝগড়া করার এনার্জি কী করে পেলে! দুদিন আগেও ঠিক করে দাঁড়াতে পারতে না। ”
ঝিলমিল তাকিয়ে দেখছিল হৃদয়কে। ওর হাসিটা অকৃত্রিম ও সুন্দর। প্রানখোলা হাসি। ও’কে তাকিয়ে থাকতে দেখে হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,
“কী হলো? ”
ঝিলমিল আচমকা মুখ ফসকে বলে ফেলল,
“হাসলে তোমাকে ভালোই লাগে। ”
হৃদয় হাসি থামিয়ে গভীর চোখে তাকালো। বলল,
“আচ্ছা।”
ঝিলমিলের হঠাৎ খেয়াল হলো যে ও মুখ ফসকে হৃদয়কে যা বলেছে সেটা বলা উচিত হয় নি, এখন সেটা নিয়েও ক্ষ্যাপানো শুরু করবে। হৃদয় ও’কে লজ্জা পেতে দেখে বলল,
“এখন আমারও তোমাকে এই টাইপ কমপ্লিমেন্ট দিতে হবে? মানে বলতে হবে যে তোমার হাসিও অনেক সুন্দর, তুমি যখন ঝগড়া করছিলে তখন দেখতে অপূর্ব লাগছিল আমি মুগ্ধ, অপলক নয়নে দেখছিলাম। এই টাইপ কিছু বলতে হবে। ”
ঝিলমিল হতবাক হয়ে গেল। এখন ওর হৃদয়কেও অসভ্য বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে৷ ঝিলমিল এক পলকও না দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হৃদয় আবারও শব্দ করে হাসলো।
***
চৈতী বাড়ি থেকে ফিরে বেশ শান্ত আচরণ করছে। একটু বেশী ভালো হচ্ছে শাশুড়ী ননদের সঙ্গে। কিন্তু তারা আগের মতো দেখানো আন্তরিকতা টুকুও আনতে পারছেন না। রাহেলা সারাক্ষণ মুখভার করে থাকেন। ছেলে জীবনে প্রথম তার সঙ্গে বড় গলায় কথা বলেছেন। তার মানুষ চেনায় ভুল আছে এবং নিজের জীবন নষ্টের জন্য সরাসরি মা’কে দায়ী করে। আকাশ সরাসরি বলেছে, তোমার কথা আমার শোনা উচিত ই হয় নাই। ফর্সা গায়ের রঙ আর ফ্যামিলির টাকা ছাড়া আর তো কিছু দেখোও নি। ঝিলমিল এটলিস্ট ম্যানার জানতো, এডুকেটেড আর মুখের ভাষাও সুন্দর ছিলো। এই কথা শুনে রাহেলা খুব মুষড়ে পড়েছেন। বছর ঘুরলো না, অথচ ছেলে তার পছন্দ করা বউয়ের এতো দোষ খুঁজে পেল! এটা তার জন্যও কম অপমানের না। আকাশ মায়ের সঙ্গে কথা বলে শক্ত গলায়। কিন্তু বউয়ের সঙ্গে তার ভালো ভাব আছে। একসঙ্গে ঘুরতে যায়, সময় কাটায়। চৈতীও বেশ হাসিখুশি আছে। তবুও যা কিছু ঘটেছে সেটাও সহজে ভোলার মতো কিছু না। এতো অপমানজনক ব্যাপার তাদের সাথে আগে ঘটে নি।
চলবে….