#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১৬
অসুখ ঝিলমিল কে খুব নাজেহাল করে ছাড়লো । একটানা দুই সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে অসুস্থ ছিলো। জ্বর কখনো কমে যায়, কখনো বেড়ে এমন অবস্থা হয় যে একেবারে অচেতন হয়ে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি না করে বাসায় থেকেই চিকিৎসা হলো। হৃদয় পুরো সময়টা পাশে থেকে যত্ন করেছে। পনেরো ষোলো দিনে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত যায় নি। অসুস্থ ছিলো ঝিলমিল অথচ ওর নাওয়া, খাওয়া সব বন্ধ ছিলো। আসমা প্রতিদিন মেয়েকে দেখতে আসতেন। একটু পিঠা, খিচুড়ি করে নিয়ে আসতেন যদি ঝিলমিল খেতে পারে। জাহানারা আসমাকে ছেলের কথা বলেন। ঠিকঠাক খায় না, ঘুমায় না। আসমার খুব মায়া হলো। তিনি নিজেও খেয়াল করেছেন। মনে মনে খুশিও হলেন। মেয়েকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই, জামাইকে নিয়েও আক্ষেপ কম ছিলো না। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তিনি হৃদয়ের অন্য আরেক রুপ দেখলেন। একদিন বললেন,
“তুমি এভাবে নিজের অযত্ন করছো বাবা, এরপর তো অসুস্থ হয়ে যাবে। অন্তত খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করো। ”
“জোর করে খাওয়া যায় না, মন মেজাজ ভালো না থাকলে কিছুতেই শান্তি আসে না।”
আসমা তারপর আর কিছু বলেন নি। মেয়ের জন্য তিনি প্রতি নামাজের পড়ে প্রার্থনা করেন যেন ওর সবসময় ভালো হয়, কষ্ট যেন না পায়। এখন তার প্রার্থনায় বলা শব্দগুলো পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এখন বলেন, মেয়েটা সারাজীবন শ্বশুর বাড়িতে এমনই আদর, যত্নে ভালোবাসায় থাকুক।
***
আজ অনেক দিন বাদে ঝিলমিলের সকাল দেখা হলো। শরীর টা আজ একটু ভালো লাগছে। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসলো একটু। সামনে ছোট্ট টেবিলে বই খাতা রাখা। জাহানারা এক কাপ চা এনে রাখলেন। ঝিলমিল এই অসুখের মধ্যে চা খাওয়া প্রায় ভুলেই গেছে। আয়োজন করে শেষ কবে চা খেয়েছিল স্মৃতিতে নেই।
সামনে পরীক্ষা আছে। প্রচুর পড়াশোনা বাকী আছে। তাই বইপত্র খুলে দুই একটা লাইন পড়ার চেষ্টা করছে। জীবনে পর পর এমন ঝড়, তুফান চলে গেল যে পড়াশোনা নামেও একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিল। কাল ও’কে বই নিয়ে বসতে দেখে হৃদয় বলেছিল,
“তোমার এতো চাপ নেয়ার দরকার নেই। দরকার হলে এবার পরীক্ষা দিতে হবে না। আগে সুস্থতা জরুরী। ”
হৃদয়ের কথা মনে পড়ায় হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। হৃদয়ের অনেক পাগলামী আছে। দেখে বোঝা যায় না, শক্ত গলায় কথা বলে, কঠিন চোখে তাকায়। এমন ছেলের সঙ্গে কেউ কখনো প্রেম করার কথা ভাবে না। অথচ ও বিয়েও করে ফেলেছে।
হৃদয় খুব কেয়ারিং হাজবেন্ড। আড্ডা দেয়া, বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে বউয়ের জন্য রাত জেগে বসে থাকতে পারে, স্যুপ, রামেন বানাতে পারে। আবার সারপ্রাইজিংলি সেগুলো খেতেও সুস্বাদু হয়। কাপড় ভাজ করে গুছিয়ে রাখা, চায়ের কাপে চিনি গুলে এক সিপ নিজে নিয়ে চেক করে দেখায় বাড়তি যত্নের আভাস পেয়ে যায়। ঝিলমিল সব খেয়াল করেছে। এমন কিছু হৃদয়ের কাছ থেকে আশা করে নি, সত্যি বলতে ঝিলমিল সম্মান ছাড়া বাড়তি কোনো কিছুই আশা করে নি। সম্পর্ক, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও বাড়তি কিছু ভাবে নি। পরে যা কিছু ঘটবে সেটা তখন দেখা যাবে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছে।
ঝিলমিল জানে হৃদয় ও’কে ভালোবাসে। অনেক দিন আগে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেছিল। সাথে বলেও দিয়েছিল ও জবাবের অপেক্ষায় থাকবে। তারপর ওদের জীবনে কতকিছু ঘটে গেল যা নাটক কেও হার মানিয়ে দেয়। হৃদয় বিয়ের পর একবারও ভালোবাসার কথা বলে নি, তবে ওর আচরণে সেটা প্রকাশও পেয়েছে কয়েকবার। কেয়ারিং, লাভিং, পজেসিভ সবকিছুই দেখা গেছে। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো আলাদা করে হৃদয় ঝিলমিলের প্রতি কোনো এক্সপেক্টেশন রাখে নি। যা কিছু হয়েছে সবই ন্যাচারাল ভাবে হয়েছে। আরোপিত কিছু সেখানে ছিলো না।
হৃদয় আজ সকালে বেরিয়েছে। খুব দরকার বলে যেতে হলো। যাবার আগে ঝিলমিল কে কঠিন উপদেশ দিয়ে গেল, খাওয়া দাওয়া নিয়ে যেন ফাঁকিবাজি না করে। তাড়াতাড়ি ফিরবে কথাও দিয়ে গেল।
ঝিলমিল খানিকক্ষণ বারান্দায় থেকে জাহানারার খোঁজে গেল রান্নাঘরে। শাশুড়ী মানুষ টা ভালোই ওর সঙ্গে। প্রচুর গল্প করতে পারেন। মিঠাপুকুর লেনের সব খবর তার কাছে আছে। কার বাড়ি কী হয়, কার সংসারে কী ঝামেলা সব সে জানে। শাশুড়ীর থেকে ঝিলমিল জানতে পারলো আকাশদের সংসারে শান্তি নাই। বউটা খুব খারাপ। মাথা গরম হলে এটা, ওটা ভাঙে। স্বামীর সাথে রাগারাগি করে একটা দামী ডিনারসেট ভাঙছে। এদিকে বউয়ের বাপের বাড়ির লোকজনের নাকি খুব অহংকার। জামাই বউ ঝগড়া করছে তাতে আরও আগুন দিয়ে কী কী যেন করে গেছে। যাবার সময় তাদের দেয়া গাড়িটা নিয়ে গেছে। জামাই, বউ আসছে গাড়ি ছাড়া। মনে হয় গাড়ি রেখে দিছে। গাড়ির কাহিনী বলতে গিয়ে জাহানারা খুব হাসছিলেন। না চাইতেও ঝিলমিল আকাশের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে শুনলো। কিন্তু শাশুড়ীকে কিছু বলল না। আকাশের ভালো, খারাপ সব কিছুতেই ওর অনুভূতি শূন্য। একসময়ের পছন্দের পুরুষ এখন শুধু ঘৃনার পাত্র। নাম শুনলেও ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে একতা হাউজিং এর সেই দৃশ্যটি। কী বীভৎস কুৎসিত দৃশ্য। আজকাল ভালো মানুষ শব্দটা শুনতেও কেমন যেন লাগে। তারচেয়ে মনে হয় খারাপ মানুষেরাই ভালো।
ঝিলমিল রান্নাঘর থেকে শুনলো জাহানারা একতলায় ঝগড়া করছেন। তার গলার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে আরও তিনটা গলার আওয়াজে। একতলার ভাড়াটিয়াদের ও চিনে। সাথীদের বাসা, সাথী বিথী দুই বোন ওদের বিল্ডিংএ সীমা আপুর কাছে পড়তে যেত। সেই সুবাদে আলাপ আছে। ঝিলমিল নিচে নেমে এলো। ঝগড়ার কারণ খুব সামান্য। হাটার রাস্তায় পানি ফেলে রেখেছে। জাহানারা সেটা নিয়ে কিছু একটা বলেছিলেন। তিন মা, মেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ঝগড়া শুরু করেছে। ঝিলমিল শাশুড়ীর হাত ধরে দুই তিন বার বলল,
“আম্মা চলেন ঘরে। ”
জাহানারা গেলেন না। ঝগড়া বাড়তে লাগলো আরও। একপর্যায়ে সাথী জাহানারাকে তুই তোকারি শুরু করলো। ঝিলমিল স্তব্ধ হলো, এতো ছোট একটা মেয়ে মায়ের বয়সী একজন কে তুই সম্বোধনে কথা বলছে! ঝগড়ার ভাষা অসুন্দর হয় সেটা স্বাভাবিক তাই বলে এমন বয়োজ্যেষ্ঠ কে অপমান! ঝিলমিল হঠাৎ কঠিন গলায় বলল,
“এই সাথী তুমি অসভ্যের মতো কথা বলছ কেন? উনি তোমার মুরব্বি না?”
ন্যানো সেকেন্ডের জন্য নীরব হলো পরিবেশ। দোতলা, তিনতলায় যারা ছিলো তারা নেমে এসে মজা দেখছে। কেউ কিছু বলছে না৷ সাথীর মা হঠাৎ ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি থামো, তোমার কাহিনী সবাই জানে! আমার মেয়েরে অসভ্য বলতে আসছে!”
ঝিলমিলেরও রাগ উঠে গেল। বলল,
“আপনিও অসভ্য। বাড়িওয়ালার বাড়িতে থাকতে হলে রুলস ফলো করতে হয়। সেটা নিয়ে আবার আসছেন ঝগড়া করতে।”
জাহানারা সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন। সাথী মেয়েটা চুপ ছিলো। এখন সেও শুরু করেছে। ঝিলমিলকে একবার বলল,
“যেমন শাশুড়ী তেমন বউ। অসভ্য কে সেটা সবাই জানে পাড়ায়। ”
ঝিলমিল আবারও বলল,
“সাথী তুমি আর তোমার মা মুখ সামলে কথা বলো, নাহলে লিটনের কথা যা জানি সব বলে দেব। ”
লিটন মিঠাপুকুর লেনে রোমিও নামে পরিচিত। সে যখন বাইরে বের হয় তার কানে ফোন থাকে, বারান্দায় আসে তখনও কানে ফোন। শোনা যায় মিঠাপুকুর লেনের তিনটা মেয়েই নাকি তার গার্লফ্রেন্ড। লিটন কে সবাই কন্যারাশির জাতকও বলে মজা করে। তবে মা চাচীদের ভারী অপছন্দের। লিটন হাফ প্যান্ট পরে হাটে। এক টিশার্টেই তাকে দেখা যায়। ঝিলমিলের মায়ের ধারণা সেই টিশার্ট এক মাসেও ধোয় না।
জাহানারা লিটনের ব্যাপার শুনে আরও জোরে জোরে বললেন,
“আরেহ মোটকা বেডি, খাইয়া খাইয়া মোটা হও, আর এদিকে তোর মাইয়া হেলু হেলু করে লিটইন্যার সাথে। ”
সাথীর মায়ের চোখ দিয়ে আগুন বের হলেও মুখ বন্ধ হয়েছে। সঙ্গে তাদের মেয়েদেরও। সাথী এখন মাথানত করে আছে। দ্রুত ওর মা মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। জাহানারা একাই বকে যাচ্ছেন। সেই সময় হৃদয় এসে দেখলো তার মা, বউ দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
***
“সিরিয়াসলি? তুমিও আম্মার মতো ঝগড়া করতে নেমে গেছ?”
হৃদয়ের বিস্ময় কাটছে না। ঝিলমিল লজ্জা পেল। জাহানারা খুব খুশি। সাথীর মায়ের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে ঝিলমিল। তিনি বারবার ঘুরেফিরে প্রশংসা করছে।
হৃদয় ঝিলমিল কে বলল,
“কাছে আসো তো, দেখি জ্বর আছে কী না। ”
ঝিলমিল কাছে আসলো। হৃদয় কপালে, গালে হাত দিয়ে বলল,
“না জ্বর নেই। শক্তিও তো আছে ভালোই। নাহলে ঝগড়া করতে কিভাবে গেলে? ”
ঝিলমিল স্মিত হেসে বলল,
“ওরা তিনজন আর আম্মা একা ছিলেন। আশ্চর্য বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়াটিয়ার এমন ঝগড়া প্রথম দেখলাম। আমাদের বাড়িওয়ালা কিছু বললেও তো আমরা চুপচাপ মেনে নিতাম। ”
হৃদয় শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
“ঝগড়ার টপিক জানতে চাইছি না। আমি জানতে চাই তুমি ঝগড়া করার এনার্জি কী করে পেলে! দুদিন আগেও ঠিক করে দাঁড়াতে পারতে না। ”
ঝিলমিল তাকিয়ে দেখছিল হৃদয়কে। ওর হাসিটা অকৃত্রিম ও সুন্দর। প্রানখোলা হাসি। ও’কে তাকিয়ে থাকতে দেখে হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,
“কী হলো? ”
ঝিলমিল আচমকা মুখ ফসকে বলে ফেলল,
“হাসলে তোমাকে ভালোই লাগে। ”
হৃদয় হাসি থামিয়ে গভীর চোখে তাকালো। বলল,
“আচ্ছা।”
ঝিলমিলের হঠাৎ খেয়াল হলো যে ও মুখ ফসকে হৃদয়কে যা বলেছে সেটা বলা উচিত হয় নি, এখন সেটা নিয়েও ক্ষ্যাপানো শুরু করবে। হৃদয় ও’কে লজ্জা পেতে দেখে বলল,
“এখন আমারও তোমাকে এই টাইপ কমপ্লিমেন্ট দিতে হবে? মানে বলতে হবে যে তোমার হাসিও অনেক সুন্দর, তুমি যখন ঝগড়া করছিলে তখন দেখতে অপূর্ব লাগছিল আমি মুগ্ধ, অপলক নয়নে দেখছিলাম। এই টাইপ কিছু বলতে হবে। ”
ঝিলমিল হতবাক হয়ে গেল। এখন ওর হৃদয়কেও অসভ্য বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে৷ ঝিলমিল এক পলকও না দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হৃদয় আবারও শব্দ করে হাসলো।
***
চৈতী বাড়ি থেকে ফিরে বেশ শান্ত আচরণ করছে। একটু বেশী ভালো হচ্ছে শাশুড়ী ননদের সঙ্গে। কিন্তু তারা আগের মতো দেখানো আন্তরিকতা টুকুও আনতে পারছেন না। রাহেলা সারাক্ষণ মুখভার করে থাকেন। ছেলে জীবনে প্রথম তার সঙ্গে বড় গলায় কথা বলেছেন। তার মানুষ চেনায় ভুল আছে এবং নিজের জীবন নষ্টের জন্য সরাসরি মা’কে দায়ী করে। আকাশ সরাসরি বলেছে, তোমার কথা আমার শোনা উচিত ই হয় নাই। ফর্সা গায়ের রঙ আর ফ্যামিলির টাকা ছাড়া আর তো কিছু দেখোও নি। ঝিলমিল এটলিস্ট ম্যানার জানতো, এডুকেটেড আর মুখের ভাষাও সুন্দর ছিলো। এই কথা শুনে রাহেলা খুব মুষড়ে পড়েছেন। বছর ঘুরলো না, অথচ ছেলে তার পছন্দ করা বউয়ের এতো দোষ খুঁজে পেল! এটা তার জন্যও কম অপমানের না। আকাশ মায়ের সঙ্গে কথা বলে শক্ত গলায়। কিন্তু বউয়ের সঙ্গে তার ভালো ভাব আছে। একসঙ্গে ঘুরতে যায়, সময় কাটায়। চৈতীও বেশ হাসিখুশি আছে। তবুও যা কিছু ঘটেছে সেটাও সহজে ভোলার মতো কিছু না। এতো অপমানজনক ব্যাপার তাদের সাথে আগে ঘটে নি।
চলবে….
(রিচেক দিতে পারিনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ।)