#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-২১ ও ২২
ঝিলমিল জানতো ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত ওর চরিত্র নিয়ে কথা উঠবে। যদিও এই ধরনের মানুষের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। মিঠাপুকুর লেনে ওর বিয়ে নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। কিছু মানুষ বিয়েতে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে গিয়েও ওর নামে নিন্দে করে গেছে। তাতে কখনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি, খারাপ লেগেছে। নিজের জন্য খারাপ লাগে নি, ওদের কলেজের বাংলা ম্যাম একবার একটা কথা বলেছিল। তুমি যখন রাস্তা দিয়ে যাবে তখন দশ জন মানুষ যদি তোমাকে দেখে, দশজনের ভাবনা হবে দশরকম। কেউ দেখবে তুমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে কলেজ থেকে ফিরছ, কেউ দেখবে তোমার জুতোটা ময়লা, কেউ দেখবে চুলগুলো চকচকে কী না, পোশাক টা কেমন। এগুলো আসলে তাদের মানসিক ভাবনা। তোমাকে দশজন, দশরকম করে দেখবে তাদের অর্ন্ত:চক্ষু দিয়ে। এখানে তুমি যেমনই হও তাদের চিন্তা ভাবনা বদলাতে পারবে না।
তবুও ঝিলমিলের খারাপ লেগেছে বাবা আর ভাইয়ের জন্য। আজ ও তৈরী হয়েই এসেছে। ঠিক যখনই ও’কে এই বিষয় টা নিয়ে আক্রমণ করবে ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করবে। ক্লাবে ঢুকে ও একবারও তাকায় নি আকাশের দিকে। না মানুষটার দিকে তাকানোর রুচি ওর ছিলো না। ঝিলমিল ভেবেছিল ও আকাশের সব ট্রমা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু না, ভালো ছেলে, ভদ্র ছেলে শব্দগুলো শুনলে ওর চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভেসে ওঠে অনিন্দিতার বাসার সেই দৃশ্যটি।
ঝিলমিল আজ সবাইকে খেয়াল করেছে। চৈতী, আকাশ, ইশিকা, রাহেলা সবাইকে পর্যবেক্ষণ করেছে। আকাশ টু শব্দটি পর্যন্ত করে নি, বোধহয় তার মনে ভয় আছে। পরিস্থিতি যেন ঘুরে অন্যদিকে না যায়। কাল আসমা একবার ঝিলমিল কে বলেছিলেন,
“তুই ধাক্কা দিতে গেলি কেন? ওটা বাড়াবাড়ি হইছে না? কড়া গলায় বলে দিলেই তো হইতো। তাও ধাক্কাটা জোরে হয়ে গেছে ঝিলমিল। রাস্তায় পড়ে গেছে। ”
ঝিলমিল মায়ের দিকে তাকিয়েছিলো। মা ভাবলেন মেয়ে বুঝি রেগে গেছে। কিন্তু ঝিলমিলের মাথায় অন্য একটা ব্যাপার ঘুরছিল। ওর এই বাড়াবাড়ি ব্যাপারটাকে রঙচঙ মাখিয়ে যদি অপমান করতে আসে তবে ও আকাশের ব্যাপারে মুখ খুলবে। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে না। ওনারা ঠিক তাই করেছেন, এবং এবার ঝিলমিল সফলভাবে কাজটা করতে পেরেছে৷
***
ক্লাবঘর যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ঝিলমিলের ওই কথা বলার পর। তালুকদার সাহেব তার মেজাজ হারিয়ে ঝিলমিলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“একেবারে তোর জিব টেনে ছিড়ে ফেলব? কার নামে কী বলিস তুই?”
হৃদয় তো আগেই ঝিলমিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। শক্ত করে হাতটা ধরলো। ওর চোখে যেন আগুন জ্বলছে। ঝিলমিলের বাবা তেড়ে এলেন। সেই সঙ্গে হৃদয়ের বাবাও। একটা ধুন্ধুমার ঝগড়ায় রুপ নিতে গিয়েও সেটা থামলো। সভাপতি সাহেব চিৎকার করে উঠলেন।
“থামেন সব। আপনারা মারামারি করবেন? আগে দেখতে দেন বিষয় টা। ”
রাহেলা কথা বলতে পারছেন না রাগে। আজ তার আসল রুপ বেরিয়ে এসেছে যেন। ইশিকা মায়ের কাঁধ ধরে সামলাচ্ছে। কিন্তু ওর দৃষ্টি ঝিলমিলের দিকে। সেই দৃষ্টিতে প্রচন্ড রাগ, পারলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ঝিলমিল কে আসমা আর হৃদয় আগলে রেখেছে।
এই মুহুর্তে ঘটে চলা নাটকের মূল চরিত্র আকাশ সে আগের মতোই মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাটু কাঁপছে ঠকঠক করে। যে কজন মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তারা দ্বিধা দ্বন্দে আছে। তবে এখানে কেউ কেউ আছে যারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। হৃদয়ের দুই সাগরেদ রাজু আর শাকিল। সাগর নামে একটা ছেলে আছে। সে নিজ চোখে দেখেছে আকাশ কে একতা হাউজিং এর ওই বিল্ডিং এ ঢুকতে। কিন্তু তখন অন্যকিছু ভাববার সুযোগ পায় নি।
রাজু আর শাকিল কে ঘটনাটা জানিয়েছে হৃদয়। ওদের মাধ্যমে সেটা আরও পাঁচ কান হয়েছে। আনাস ভাইয়ের দোকানের সামনে থেকে আকাশ কে যেতে দেখলেই ওরা হাসাহাসি করতো। আকার ইঙ্গিতে বলতো, ভাই এনার্জি নিতে যাইতেছে। ঘরে এনার্জি পায় না ঠিকঠাক।
কিন্তু আকাশ হঠাৎ করে একতা হাউজিং এ যাওয়া কমিয়ে দিলো। নাহলে কিছু লোক তক্কে তক্কে ছিলো ও’কে হাতেনাতে ধরার। চৈতীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ শুরু হবার পর থেকে আকাশের বাড়তি সতর্কতা ওদের পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল।
চায়ের কাপে চিনি গুলতে থাকা আনাস ভাইয়ের কান সবসময় সজাগ থাকে। তিনি এই পাড়ারই মানুষ। যখন বিষয়টা কানে এসেছে তখন থেকে তার মাথা গরম ছিলো। ছি: ছি: এমন একটা ঘটনা। তার দোকানে আকাশ চা খেতে আসে না সচরাচর। ভদ্র মানুষ ভদ্র দোকানে চা না খেলে বাসায় গিয়ে চা খায়, কিন্তু এই দোকানে আসে না। সেদিন চায়ের দোকানে যখন ঢুকলো তখন আকাশ অন্যমনস্ক ছিলো। যদি আনাস ভাইয়ের মুখ দেখতো তাহলে বুঝতে পারতো যে উনি অনিচ্ছায় চা বানাচ্ছিল ওর জন্য। আনাস ভাই সেদিন চা দেবার সময় আকাশের মুখের অভিব্যক্তি দেখতে চাচ্ছিলেন তাই ওই প্রশ্নটা করেছিলেন।
আকাশ গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না। যারা সবসময় মিথ্যে বলে অভ্যস্ত, তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে কনফিডেন্টলি সামলে নিতে পারে। ঝিলমিলের এতো বড় অভিযোগে আকাশ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এরকম একটা ভয় ও যে পাচ্ছিল না তেমন নয়, কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হওয়া ব্যাপার টাও সামলাতে পারে নি। সভাপতি সাহেব আকাশ কে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার নামে এতো বড় অভিযোগ আসছে। এর কারণ কী?”
রাহেলা চিৎকার করে বলেন,
“আপনি আর কতো দলকানা হইবেন? আমার ছেলের সাথে এইসব যায়? ”
একজন হঠাৎ বলল,
“চাচা ঘটনা সত্য, মিথ্যা যাই হোক, উনি প্রায় ই ওইদিকে যায়। কী কারণে যায় সেটা বলুক। ”
আকাশ সমানে ঘামছে। এতোগুলো চোখ ওর দিকে। সেই সঙ্গে আরও একটি দৃষ্টি ওর দিকে আছে। সেটা চৈতীর। চৈতী বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।
****
ঝিলমিল কে সরিয়ে নিয়ে হৃদয় বাসায় আসলো। সঙ্গে জাহানারা, আসমাও আছেন। সন্ধ্যায় আবারও ক্লাবঘরে মিটিং আছে। আজ একই দিনে দুইবার মিটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাহানারা বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি আসমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঘটনা কী সত্য?”
আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“মেয়ে বলছে আপা। ও কী মিথ্যা বলার কথা। ”
“হৃদয়ও তো মনে হয় জানে। আমরা তো কিছু জানিনা। কেমনে সম্ভব, এতো ভালো ছেলে। পড়ালেখায় এতো ভালো। ভালো বংশের ছেলে হয়ে কেমনে সম্ভব। ”
হৃদয় ঘরে এসে ঝিলমিল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, কোন কথা বলল না। সভাপতি সাহেব ঝিলমিল কে প্রশ্ন করেছিলেন,
“তুমি যা বলছ তার প্রমাণ আছে। ”
ঝিলমিল জবাবে বলেছিল,
“প্রমাণ যা আছে সেটা যদি সবার সামনে আনি তবে আপনাদের ইমান নষ্ট হবে। ”
এক মুরব্বি গোছের চাচা বলেছিলেন,
“হয় হোক, তবুও সবটা সামনে আসুক। ”
ঝিলমিলের হার্টবিট দ্রুত গতিতে চলছে। হৃদয় ওর মাথায় সমানে হাত বুলিয়ে বলছে,
“ভয় পেয়ো না, আমি আছি, আমি আছি তো। ”
****
“ওই হারা*মজাদিরে আমি পাড়া ছাড়া করব?”
রাহেলা উত্তেজিত হয়ে আছে। তালুকদার সাহেবও খুব উত্তেজিত। পাড়ায় এখন দুটো দল। একদল তালুকদার সাহেবের পক্ষে, অন্যদল কারোর পক্ষে না। তারা বিষয় টার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চায়। আকাশ এখনো নীরব। রাহেলা ভাবছেন অপমানে ছেলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। চৈতী এই প্রথম নিশ্চুপ হয়ে আছে। বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দোলাচলে ভাসমান। ইশিকা ভয় পাচ্ছে। কেন ভয় পাচ্ছে জানেনা। ওর মনে হচ্ছে ভাইয়ের চুপ থাকাই ওদের বিপদের কারণ হবে।
দুপুরের দিকে পুলিশ অফিসার আশরাফুল এলেন। সভাপতি সাহেব তাকে ডেকেছেন। এতো বড় একটা ঝামেলায় মারামারি হবার সম্ভাবনা প্রবল। আশরাফুল এসে তালুকদার সাহেবের সাথে কথা বললেন। তালুকদার সাহেব জানালেন সন্ধ্যের মধ্যে যদি কিছু প্রমাণ করতে না পারে তবে তিনি মানহানির মামলা করবে হৃদয় ও ঝিলমিলের পরিবারের নামে। সবাইকে জেলের ভাত খাওয়াবে। আশরাফুল জানালেন যে তিনি বিষয় টা দেখবেন। তিনি নিজে একতা হাউজিং এ গিয়ে খোঁজ নিবেন।
***
আকাশ এখন বসে আছে গেস্ট রুমে, দরজা বন্ধ করে। অনিন্দিতাকে আনব্লক করে সমানে কল করে যাচ্ছে। অনিন্দিতা কল রিসিভ করছে না। চৈতী আকাশ কে গেস্ট রুমে থাকতে দেখে রাহেলাকে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আপনার ছেলে দরজা বন্ধ করে কী করছে? আম্মু বিষয় টা ভালো লাগতেছে না। ”
রাহেলা অন্যকিছু ভাবলেন। ছেলে অপমানে লজ্জিত হয়ে ভুল কিছু করে বসবে না তো। তিনি অস্থির হয়ে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। বাসায় তারা ছাড়াও অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা এসে জড়ো হয়েছে, সকলের নাওয়া, খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। পর পর দরজায় ধাক্কা পেয়ে আকাশ দরজা খুলে চিৎকার করে বলল,
“আমাকে একটু একা থাকতে দাও। ”
চৈতী নরম গলায় বলল,
“আমি থাকি। ”
আকাশ কঠিন গলায় বলল,
“না। কেউ আমাকে জোর করবে না। ”
রাহেলা অস্থির হলেন। কোমল স্বরে বললেন,
“বাবু আমরা আছি তো। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে পাড় পেয়ে যাবে। ছাড়ব না কাউকে, দেখো তোমার আব্বু এবার কী করে। মারা, থ্রেট দেয়া অনেক হইছে। এবার পুলিশ দেখবে। ”
আকাশ হঠাৎই দরজা বন্ধ করে দিলো। ও কাঁপছে থরথর করে। দুহাতে আকড়ে ধরলো চুলগুলো। জোরেশোরে চিৎকার করতে লাগলো। পাগলের মতো কল করতে লাগলো অনিন্দিতাকে।
****
মিঠাপুকুর লেনে সকলের সব কাজ বন্ধ। কখন সন্ধ্যে হবে, কখন এই ঘটনার সবটা জানা যাবে এই নিয়ে অস্থিরতার শেষ নেই। কারোর ঘরে রান্না হচ্ছে, কেউ কেউ ভুলে গেছে খাবার কথা। জটলা বেঁধে আলোচনা করছে।
এখন দুই ধরনের গল্প হচ্ছে। একদল যারা ঘটনাটি বিশ্বাস করেছে তারা ভাবছে আকাশের কুৎসিত সম্পর্কের কথা ঝিলমিল জেনে যাওয়ায় বিয়ে টা ভেঙেছে। ঝিলমিল কে পাড়া ছাড়ার জন্য বোধহয় প্রেশারও দেয়া হয়েছে তাই ও হৃদয়ের বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। হতে পারে ও’কে চাপের উপর রেখেছিল বলে ও হৃদয়কে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। হৃদয়দের পাওয়ারও তো কম নয়, হৃদয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে তালুকদার রা কিছু করতে সাহস পাবে না।
দ্বিতীয় দল ভাবছে ঝিলমিল শান্ত স্বভাবের হলেও শয়তান। আকাশের উপর প্রতিশোধ নিতেই হৃদয়কে বিয়ে করেছে। তাও শান্তি পায় নি, এখন উল্টো হেনস্তা করতে মিথ্যে অভিযোগ দিচ্ছে।
এসব ভাবনা চিন্তার পরেও সবার অপেক্ষা সন্ধ্যের জন্য।
ঝিলমিল কে অনেকে অনেক প্রশ্ন করছে। ও কাউকেই জবাব দিচ্ছে না। জাহানারা ধমকের সুরে কয়েকজন কে বললেন, যা ফয়সালা হবার সন্ধ্যার পর হবে। এখন বউরে কিছু জিজ্ঞেস কইরো না।
আনাস ভাইয়ের চায়ের দোকান রমরমা। কাপের পর কাপ চা নিচ্ছে। আজকের আলোচনার বিষয়বস্ত আকাশ। আনাস ভাই বিজ্ঞের মতো একটা কথা বললেন। তিনি বললেন,
“আরেহ সভাপতি চাচা জিগাইলো না ক্যান যে সে ওইদিকে যে মাঝেমধ্যে যায় কোন কাজে যায়?”
সকলে একমত হলেন। একজন মাতব্বরি করে ছুটে গেলেন তালুকদার সাহেবের বাসায় তাকে গিয়ে কথাটা বললেন। তালুকদার সাহেব ছেলের বিপক্ষে কিছু শুনতে নারাজ। যৌক্তিক কিছু কেউ বললেও তিনি রেগে গালাগাল করছেন।
বিকেল চারটার দিকে পুলিশ অফিসার আশরাফুল কল করে তালুকদার সাহেব কে বললেন,
“আপনার ছেলে বাসায় আছে? ”
“হ্যাঁ। ক্যান কিছু জানার দরকার? ”
“আপনি ফোনটা স্পিকারে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন তো উনি একতা হাউজিং এ কার বাসায় যেতেন?”
তালুকদার সাহেব মেঘগর্জন স্বরে বললেন,
“মানে?”
“তালুকদার সাহেব আস্তে কথা বলেন। হাউজিং এর সিসিটিভি ফুটেজ, সিকিউরিটি ম্যান কনফার্ম করছে যে সে এখানে অনেক দিন যাবত আসা যাওয়া করে। সকাল, বিকাল, দুপুর সন্ধ্যা বিভিন্ন সময়ে। কোন বিল্ডিংয়ে, কোন ফ্লোরে যাইতো সেগুলো জানতেও আমার বেশী সময় লাগবে না। আপনি আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন। ”
তালুকদার সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। রাহেলা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, তিনি শুনছেন না। শ্রবণশক্তি দূর্বল হবার কারণে তিনি কলে কথা বলার সময় স্পিকার ম্যুডে কথা বলেন। আজও ব্যতিক্রম ছিলো না, ড্রইং রুমে বসা সকলে কথাটা শুনে স্তব্ধ হলো।
****
“আপনি অনিন্দিতা সাহা? ”
“জি?”
“আকাশ আপনার ছেলের টিচার ছিলো? ”
অনিন্দিতা একবার পিছনে দাঁড়ানো অপূর্বর দিকে তাকালো। অপূর্বর হাতে ব্যান্ডেজ। সেই যে রেগে শিরা কেটেছিল সেখানে ইনফেকশন হয়ে হাতের অবস্থা খারাপ হয়েছে। অনিন্দিতাকে কেউ কখনো কন্ট্রোল করতে পারে নি। নিজের জীবনে যা ওর ভালো মনে হয়েছে তাই করেছে। ভালোবেসে, মিষ্টি কথা বলে অনেক কিছু হাসিল করলেও ছেলেকে পারছে না। অপূর্ব স্কুলের প্রি টেস্ট পরীক্ষা দেয় নি, ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ গুলো ফেলে দিয়ে হাতের রোগ টা এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে ডাক্তার ও’কে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে বলেছে। বেশী দেরি হলে হাতও কাটা লাগতে পারে এই খবর টা শুনে অনিন্দিতার চারপাশ টা দুলে উঠেছিল। সেই সঙ্গে স্বামীর হঠাৎ অন্যরুপ। ছেলের কিছু হলে ও’কে গলাটিপে মেরে ফেলবে এমন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনিন্দিতা সপ্তাহ খানেক আগে ইন্ডিয়া থেকে ফিরলো। আত্মীয় স্বজনের কথাবার্তা গায়ে না লাগালেও এখন তাদের অভিযোগে জর্জরিত হয়ে রীতিমতো ক্লান্ত।
“একটা প্রশ্নের জবাবে এতোক্ষন কী ভাবছেন? ”
“জি ছিলো? ”
“কত বছর ধরে পড়িয়েছে?”
“ঠিক মনে নেই। ”
অপূর্ব জবাব দিলো,
“দুই বছর। ”
আশরাফুল অপূর্বকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার হাতে কী হয়েছে?”
অপূর্ব স্পষ্ট গলায় বলল,
“কাঁচ দিয়ে কেটেছি।”
অনিন্দিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আশরাফুল মা’কে এক নজর দেখে ছেলেকে প্রশ্ন করলো,
“কেন বাবা?”
“সেটা মা বলতে পারবে? আমি অনেক রিকোয়েস্ট করেছি, উনি আমার মাথা ছুঁয়েও কথা রাখেন নি। ”
“বাবা আকাশ তালুকদার তোমার টিচার ছিলেন? ”
“ওই শু*য়ারের বাচ্চার জন্যই সব হয়েছে। ”
অনিন্দিতা চাপা গলায় বলল,
“অপূর্ব চুপ করো। ”
“আমি চুপ করব না। আজও শুয়ার টা তোমাকে কল করেছে। পঞ্চাশের উপরে মিসড কল। তুমি নাকি ব্লক করেছ! আমি মরে গেলে তোমার শান্তি হবে? আমি স্কুলে, একাডেমিতে কারোর সাথে মিশতে পারি না। সবাই বলে তুমি একটা…..
অপূর্ব থেমে গেল। আশরাফুল অপূর্বকে বললেন,
“বাবা তুমি বসো। ”
অপূর্ব বসলো না। অনিন্দিতা চোখের পানি মুছে বলল,
“আপনি কী জানতে চান?”
“যা জানতে চেয়েছিলাম জানা হয়ে গেছে ম্যাডাম। এখন শুধু একটা ব্যাপার কনফার্ম করুন। আপনাদের সম্পর্ক কী এখনো চলছে? ”
অনিন্দিতা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না। কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে। ”
অপূর্ব সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“মিথ্যে কথা। ”
আশরাফুল আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“ম্যাডাম আপনি কী জানেন যে উনি বিয়ে করেছে?”
“হ্যাঁ। ”
“উনি বিয়ে করেছে, আপনিও ফুটফুটে দুটো বাচ্চার মা। তবুও…. আপনারা দুজনেই অসুস্থ। ”
অনিন্দিতা মাথানিচু করে ফেলল। আশরাফুল আবারও বললেন,
“উনি আজ আপনাকে কল করেছে কেন জানেন? ”
অনিন্দিতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। ওর ফোন টা অপূর্বর কাছে। অনিন্দিতা চাইলেও কল টা রিসিভ করতে পারে নি। তবে পুলিশ দেখে বুঝলো আকাশ বিপদে পড়ে ও’কে মনে করেছে। কী স্বার্থপর! এতোদিন অনিন্দিতার খোঁজ নেবার প্রয়োজন মনে করে নি, এখন নিজে বিপদে পড়ে কল করেছে৷ অথচ এই ক’মাসে অনিন্দিতার ও’কে কতো দরকার ছিলো।
অনিন্দিতা নিজেকে সামলে দৃঢ় গলায় বলল,
“এখন কী করতে হবে? ”
আশরাফুল অপূর্বকে ইশারায় ডেকে ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে বলল,
“কল করুন, কথা বলেন। আর হ্যাঁ স্পিকারে দিয়েন। ”
***
চৈতী হাপুস নয়নে কাঁদছে। ফোনের ওপাশে ওর মা ব্যকুল হয়ে জানতে চাইছে।
“মা মাগো, ওমা কী হইছে? ”
চৈতী কিছু বলতে পারছে না। তালুকদার সাহেব নিজেও সোফায় এমন ভাবে এলিয়ে শুয়ে আছেন যেন উঠে চলাফেরার শক্তি নেই। আকাশ কিছুক্ষন আগে মা’কে ঘরে ডেকে সব স্বীকার করেছে। মায়ের হাত ধরে অনুরোধ করেছে যেন ও’কে বাঁচায়। যেকোনো উপায়ে যেন দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। আজ আর আকাশ চৈতীকে ভয় পায় নি। ভয় পেয়েছে দূর্বল স্বভাবের ঝিলমিল কে। যে কখনো ওর কিছু করতে পারবে না ভেবে আনন্দে বুক ফুলিয়ে মিঠাপুকুর লেনে ঘুরে বেড়িয়েছে। আকাশের অবচেতন মনে ঝিলমিলের জন্য ছিলো অবজ্ঞা। ও ভেবেছিল ঝিলমিল কখনো ওর ক্ষতি করবে না। আর হৃদয় যেহেতু এতোদিনেও কিছু করে নি এখন আর কিছু করে ঝিলমিলের সম্মানও খোয়াবে না। কী বোকা ভাবনা চিন্তা। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ওর তো আগেই সবকিছু ম্যানেজ করা দরকার ছিলো যেন আজকের এই পরিস্থিতিতে ফাঁক ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
আকাশের চরম ভুল ছিলো অনিন্দিতার উপর অন্ধ বিশ্বাস করা৷ অনিন্দিতা সবসময় বলেছে আর সব কিছু এমন ভাবে ব্যবস্থা করা যে কেউ কিছু প্রমাণ করতে পারবে না। এখানেই আকাশ অন্ধ থেকে ভুল করে নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছে। অবশ্য অন্ধ থাকলে এমনিতেও কিছু চোখে পড়ার কথা নয়।
পুলিশ অফিসার আশরাফুল সভাপতি সাহেব কে কল করে জানালেন। তিনি বললেন,
“ঘটনা সত্যি খান সাহেব। এমন বিশ্রী জিনিস আল্লাহ। মহিলার বড় ছেলেটা সামনে ও লেভেল এক্সাম দিবে। ভাবতে পারেন। ”
“কী শুনাইলেন এসব! আসতাগফিরুল্লাহ! হিন্দু মহিলার সাথে! নাউজুবিল্লাহ। ”
“হিন্দু মহিলা তাও বয়সে বড়। চিন্তা করতে পারেন। আপনি মিটিং ক্যান্সেল করেন। হারামজাদা আর ওর বাপ তো মানুষের হাতে মার খেয়েই মরবে। ”
সভাপতি কল ছেড়ে হৃদয়কে জানালেন যে ঝিলমিলের আসার দরকার নেই। তুমি আসো। ওর কাছে কাউরে রেখে আসো। আর চিন্তা নাই, আজকে যারা ওরে অপমান করছে তারা ওর পা ধরে মাফ চাইবে। সেই ব্যবস্থা হবে। এই পাড়ায় সবার জন্য নিয়ম এক। বিরাট বাড়ির মালিক হইয়া তারা মাথা কিনে নেন নাই।
সভাপতি আকাশদের বাসায় গেল। তার সঙ্গে কয়েকজন মুরব্বি গোছের মানুষজন। হৃদয়ের বাবাও আছেন সঙ্গে। সভাপতি আগে চৈতীর খোঁজ করলেন। তিনি চৈতীকে নরম গলায় বললেন,
“তুমি আমার ঘরে চলো মা। এখানে নিরাপদ না তুমি। তোমার আব্বা, মায়েরে কল দিছিলা?”
চৈতী জবাব দিলো না। প্রফেসর সাহেবের বউ এসে ওর হাত ধরে বললেন,
“কিসের জন্য কাঁদতেছ? এমন স্বামীর জন্য? নাকি পোড়া কপালের জন্য? আসো তুমি। ”
সভাপতি সাহেব এবার রাহেলাকে বললেন,
“আমাকে তো দলকানা, টানা কতো কিছু বললেন। আর এখন! আপনি ঝিলমিলের কাছে আগে মাফ চাইবেন। ফাজিল মহিলা আরেক মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলেন! নিজের ছেলের চরিত্র কে কী বলবেন! ”
রাহেলা স্থির হয়ে আছেন। পাশেই ইশিকা কাঁদছে। আকাশ অবনত মুখে বসে আছে সেই একইভাবে। বাইরে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। পাড়ার ছেলেপেলেরা আকাশ কে মারতে মুখিয়ে আছে। সভাপতি সাহেব গেট লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই গেটে একের পর এক ধাক্কা দিয়ে চলছে লোকজন। একজন মুরব্বি জানালেন যে তালুকদার সাহেব যেন মসজিদে না যান। দুই বছর আগে রহমানের ছেলে এক বিবাহিত মহিলাকে বাচ্চাসমেত বিয়ে করার কারণে রহমানকে মসজিদে অপমান করেছিলেন। রহমানের সঙ্গে একই জামাতে নামাজ পড়বেন না বলে কাহিনী করেছিল। আজ তার সঙ্গেও এমন হওয়া চাই।
****
ঝিলমিল দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। সুন্দর মিঠা বাতাস ছুঁয়ে দিলো ওর শরীরে। পাড়ার হইচই কানে আসছে। ঝিলমিল আজ কিছু ভাবছে না, কিছু নিয়ে টেনশন করছে না। একদম নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। ভবিষ্যতে কখনো আজকের দিন টা নিয়ে ভাবতে চায় না। আজ ও ঠিক করেছে নাকি ভুল করেছে সেসব নিয়েও ভাববে না। আসমা এসে দাঁড়ালেন। তার চোখ ভেজা। তিনি বললেন,
“তুই নিশ্চিন্ত থাক মা। তোর আর কিছু প্রমাণের দরকার নেই। ”
ঝিলমিল মৃদু হেসে বলল,
“আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেইও মা। ”
আসমা অবাক চোখে শক্ত, দৃঢ় চরিত্রের মেয়েকে দেখলেন। এক বছর আগেও তার মেয়েটা তুলতুলে নরম ছিলো। ঝিলমিল মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“আমার তো হৃদয় আছে মা। তাই এতো সাহস পেলাম। ”
চলবে….
(আজকে বানান ভুল ক্ষমার চোখে দেখবেন প্লিজ)