#অদিতির_যবনিকা -০১
#তিশা
ডিভোর্স পেপারে সাইন করে আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না অদিতি কোর্ট রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো।
– অদিতি?
আরাফের ডাকে গতি শিথিল করলো অদিতি।এই লোকটা কিছুক্ষণ আগেও তার স্বামী ছিলো।
– আহিনার জন্য যদি কখনো আমার প্রয়োজন পড়ে অবশ্যই জানাবে।
আরাফের কথায় তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো অদিতি।তারপর বলল,
– আহিনার মা এতটাও দূর্বল নয় যে তার সন্তানের জন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন হবে।
অদিতি আর কোন কিছু বলার সুযোগ দিলো না আরাফকে তার আগেই প্রস্থান করলো সে।
জানালার পাশে বসে আছে আদিতি তিন মাসের আহিনা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে।প্রকৃতিতে এখন চৈত্রের খরা সেই খরা ধরা দিয়েছে অদিতির জীবনেও।তপ্ত দুপুরের উদাস প্রকৃতিতে নজর থাকলেও চিত্তটা তার বছর দুয়েক আগের অতীতে।
সবে এম বি এ শেষ করে বাড়িতে অলস সময় কাটাচ্ছিলো সে।একদিন বাবা জানালো তিনি অদিতির বিয়ে দিতে চান। মতিউর সাহেব বিপত্নীক সিঙ্গেল ফাদার ছিলেন। ছোট বয়সেই অদিতি তার মাকে হারায়।পত্নী বিয়োগের পরে মেয়ে অদিতিকে নিয়েই ছিল তার জীবন।কিছুদিন পূর্বে একবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন তিনি ,তাই চাইছেন বেচে থাকতে থাকতে মেয়েকে সুপাত্রস্থ করবেন তিনি।অদিতির নিজের কোন পছন্দ ছিল না তাই বাবার কথা একবাক্যে মেনে নিয়েছিলো সে। কিন্তু আসলেই কি অদিতির কোন পছন্দ ছিলো না! হৃদয়ের অনুভূতিতে কেউ একজন কড়া নাড়ার পরেও তাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলো বহু বছর আগে শুধুমাত্র সামাজিকতার অজুহাতে।
– আপা মামাজান আইছে।
ফাতেমার কথায় অতীত থেকে ফিরে আসে অদিতি। ফাতেমাকে বলল,
– তুই আহিনার পাশে বস একটু।
ফাতেমা মাথা নাড়ালো। অদিতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ফাতেমা অদিতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলো তার আপার মত এরকম সুন্দরী বউ থাকতে কেউ আবার বাইরে প্রেম করে বেড়ায় কিভাবে!
অদিতি নিচে নেমে দেখলো তার মামা রফিকুল ইসলাম বসে আছেন।ভাগ্নীকে দেখে রফিকুল সাহেব কাছে যেয়ে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।ফুলের মত ভাগ্নী তার কোনদিন ভাবেনি তার ভবিতব্যে এত এত পীড়া লেখা আছে।
– আর একবার ভেবে দেখলে হতো না অদি?
– ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মামা। বাবার এখানকার ব্যবসা আপাতত তুমি সামলাবে আমি জাপানের অফিসটা দেখবো সেই সাথে পি এইচ ডি টাও কমপ্লিট করতে চাই ওখানে।
– আহিনাকে নিয়ে একা পারবি সামলাতে?
অদিতি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল,
– আমার বাবা একজন পুরুষ মানুষ হয়ে একা হাতে ব্যবসা এবং আমাকে সামলেছেন তাহলে তার মেয়ে হয়ে আমি কেন পারবো না?
রফিকুল সাহেব আর কিছু বললেন না। তিনিও ভাবলেন সবকিছু থেকে দূরে থাকলে যদি অদিতি মানসিক শান্তি পায় তাহলে সেটাই হোক।
প্লেনের সীটে বসে আছে অদিতি। ছোট্ট আহিনা মায়ের বুকে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ছোট্ট মানবীটি বুঝতেও পারছে না মা তাকে নিয়ে বিষাদের সাগর পাড়ি দিয়ে শান্তির অন্বেষণে এক নতুন জীবনে নিয়ে যাচ্ছে।
প্লেনের জানালা দিয়ে অন্তরীক্ষের কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘমালার ভীড়ে অদিতি বুঝি আবার ফিরল অতীতে।আরাফের সাথে খুব ধুমধাম করেই বিয়ে হলো অদিতির।স্বামী শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে সুখের সংসার হলো তার।
স্বামী হিসেবে প্রথম দিকে আরাফ একেবারেই আদর্শ স্বামীর উদাহরণ ছিল। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সংসারের কিছুদিন পরেই জানা গেলো অদিতি সন্তানসম্ভবা। ভালোবাসায় যেনো খুশির জোয়ার এলো। অনাগত সন্তানকে নিয়ে আরাফের বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস দেখে অদিতিও হাসলো। কিন্তু প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস পর থেকেই ধীরে ধীরে আরাফের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিলো। প্রথমে অদিতি ভেবেছিলো হয়তো কাজের প্রেসারের জন্য এমনটা হচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে অদিতির প্রতি অনীহা অবহেলা আরাফের বেড়েই চললো তারপর একদিন সেই চরম সত্যটা সামনে এলো তার।গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলো রেস্টুরেন্টে আরাফ এক সুন্দরী মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বসা। সেদিন রাতেই আরাফের মুঠোফোন হাতে নিলো সে সত্যিটা জানার অভিপ্রায়ে।পায়ের নিচের জমিন কেপে উঠলো বুঝি তার। আদিতির কাছে এই কয়মাসে আরাফের উদাসীনতার সমস্ত কারণ কাচের ন্যায় স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিলো। পরদিন যখন অদিতি আরাফকে সরাসরি এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলো প্রথমে আরাফ চমকে উঠলেও পরবর্তীতে বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলেছিল আদিতির প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছে সে। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল সে রুহির ব্যাপারে জানানোর জন্য। সেদিনই বাবার কাছে ফিরে এসেছিলো অদিতি।মেয়ের পরিণতির জন্য মনে মনে মতিউর সাহেব নিজেকেই দোষারোপ করেছেন তিনি। সেই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক করলেন তিনি কিন্তু এবার আর সুস্থ হয়ে ফিরলেন না। অদিতি তখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মতিউর সাহেবের জানাজায় আরাফের বাবা মা এসেছিলেন খুব করে অদিতিকে বলেছিলো ডেলিভারির কয়টা দিন তাদের সাথে থাকতে বিনা বাক্য ব্যয়ে অদিতি সেই প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছিলো আর সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো ডেলিভারির পরেই সে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবে।ডিভোর্সের প্রসেসের সময় আহিনার কাস্টাডি নিয়ে অদিতি একটু চিন্তিতই ছিলো আরাফ যদি কোন ঝমেলা করে কিন্তু অদিতি পরে বুঝলো নতুন জীবনে আরাফ পূর্বের কোন কিছুই রাখতে চাই না। রুহি চাই না আরাফ আহিনাকে তার কাছে রাখুক। অদিতি যেন হাফ ছেড়ে বাচলো।
বেদনাবিধুর অতীতে অদিতি এতটাই নিমগ্ন ছিলো যে কখন গন্তব্যে পৌছে গেছে বুঝতেই পারেনি। আহিনাকে বুকে জড়িয়ে নতুন এক জীবনের উদ্দেশ্যে অদিতি পা বাড়ালো।
বছর পাঁচেক পরে….
আমেরিকার জনপ্রিয় এক স্টেডিয়াম মুখরোতি তরুণ তরুণীদের উচ্ছ্বসিত কলোরবে। আর আর নামে মুখোরিত চারপাশ। সবাই যেনো এক অন্যরকম উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে বহুল আকাঙ্খিত সেই মানুষটির। কিছুক্ষণ পরে স্টেজের কেন্দ্রবিন্দুর উজ্জল আলোয় দেখা মিলল সাতাশ বছরের এক যুবকের ,সাদামাটা জিন্স টিশার্ট পরিহিত এলোমেলো কোকড়া চুলগুলো পড়ে আছে ললাটে হাতে প্রিয় গীটার এতেই যেন অন্যরকম সৌন্দর্যের আভা ছড়ালো পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে। ‘রাফিয়ান রঙ্গন চৌধুরি’ বর্তমান সময়ের আলোচিত গায়ক।বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রঙ্গন এখন মিউজিক দুনিয়ার অন্যতম নাম।
কনসার্ট শেষে হোটেল রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে রঙ্গন এমন সময় তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট রিফাত এসে জানালো কিছু জার্নালিস্ট এসেছে তার সাক্ষাৎকার নিতে চাই।রঙ্গন বিরক্ত হয়ে বলল,
– তোকে না বলেছিলাম আমি কনসার্টের পরে কোন সাক্ষাৎকার দেব না।
– ভাই ওরা অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছে বার বার রিকুয়েষ্ট করে বলছে মাত্র দশ মিনিট সময় দিতে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রঙ্গন রাজি হলো।ওয়েটিং রুমে যেয়ে দেখলো দুইজন পুরুষ এবং একজন নারী অপেক্ষায় আছে তার। কোনরকম ভণিতা ছাড়াই রঙ্গন শুরু করতে বলে তাদের।একজন পুরুষ সাংবাদিক প্রথম প্রশ্নটা করলেন।
– আপনি কি ছোটবেলা থেকেই গায়ক হতে চেয়েছিলেন?
– না।
ছোট জবাব রঙ্গনের।অপর পুরুষটি দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়লো তার দিকে।
– বাংলাদেশী হয়েও কখনো বাংলাদেশে কখনো কনসার্ট না করার কারণ?
– আমার ইচ্ছা।
পুনরায় ছোট জবাব রঙ্গনের। এরকম গা ছাড়া এক কথায় উত্তর দেয়ার জন্য সাংবাদিক তিনজন একটু মনে মনে বিরক্তই হচ্ছিলো তবে তারা পূর্ব থেকেই রঙ্গনের এরকম গা ছাড়া স্বভাব সম্পর্কে অবগত এবং তার কাছ থেকে যে সদুত্তর পাওয়া যাবে না সেটাও জানে তারপরও যদি ভাগ্যক্রমে কোন একটা তথ্য জানতে পারে তাহলেই কেল্লাফতে। রঙ্গন সম্পর্কিত যেকোন একটা অজানা তথ্য প্রকাশ করতে পারলেই তাদের চ্যানেলের টি আর পি আকাশ ছোঁয়া হতে সময় লাগবে না।নারী সাংবাদিকটি এই পর্যায়ে জিজ্ঞেস করল,
– আপনার ভক্তদের মনে আপনাকে নিয়ে অনেক কৌতুহল বিশেষ করে আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তো আপনি আপনার ভক্তদের কি আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু জানাতে চান?
– আপনার ব্যক্তিগত জীবন বাকি সাধারণ মানুষের মত সাদামাটা সেখানে আলাদা কোন রঙের ছোয়া নেই।
নারী সাংবাদিকটি পুনরায় প্রশ্ন করলো,
– আপনাকে কখনো কোন নারীর সাথে সেভাবে দেখা যায়নি অন্য গায়কদের মত আপনার সাথে কাউকে নিয়ে কোন গুজবও শোনা যায়নি আপনার জীবনে কি সেরকম বিশেষ কেউ আছে আর থাকলে কে সে সেটা বলতে চান আপনার ভক্তদেরকে?
রঙ্গন উঠে দাড়িয়ে বলল,
– আপনাদের দশ মিনিট শেষ।
কথাটা বলে গটগট করে চলে গেলো সে। সাংবাদিক তিনজন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
– মাম্মাম তুমি কি বাবাইয়ের সাথে অনেক বেশি ঝগড়া করেছিলে?
অদিতি মেয়ের কথা ঠিক বুঝলো না তাই জিজ্ঞেস করলো ,
– মানে?
– জেসিয়া আমাকে বলেছে মাম্মাম আর বাবাইয়ের মধ্যে অনেক বেশি ঝগড়া হলে নাকি বাবাই মাম্মাম আলাদা থাকে।
অদিতি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো।এমন নয় সে আরাফের কৃতকর্মের কথা আহিনাকে জানাতে চায় না তবে সেটা আহিনা আর একটু বুঝতে শিখলে জানাতে চাই।আহিনার নিষ্পাপ মস্তিষ্কে এখনই সে বাবা সম্পর্কে খারাপ কোন ধারণা দিতে চাই না।নিজের দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আদিতি হেসে মেয়েকে বলল,
– না মা তোমাকে বলেছি না বাবাই একটু কাজে ব্যস্ত কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে।কারো এরকম কথা শুনবে না বুঝেছ?
আহিনা লক্ষ্মী বাচ্চার মত মাথা নাড়ালো।
নিউইয়র্কের বিলাশবহুল এক এপার্টমেন্টের সুউচ্চ এক ব্যালকনি থেকে ভেসে আসছে গানের কিছু লাইন কিন্তু এ যেনো গান নয় জীবনের খেলাঘরে পরাজিত কোন এক মানবের হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি!
হাসতে দেখো, গাইতে দেখো
অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো
দেখো না কেউ হাসি শেষে নীরবতা
হাসতে দেখো, গাইতে দেখো
অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো
দেখো না কেউ হাসি শেষে নীরবতা
বোঝে না কেউ তো চিনলো না
খোঁজে না আমার কি ব্যথা
চেনার মতো কেউ চিনলো না
এই আমাকে
বোঝে না কেউ তো চিনলো না
খোঁজে না আমার কি ব্যথা
চেনার মতো কেউ চিনলো না
এই আমাকে…..!
গান শেষে গীটার পাশে রেখে ব্যালকনির রেলিং ঘেষে দাড়ালো রঙ্গন।নিকোটিনের ধোয়া উড়াতে উড়াতে ভাবলো মিস চড়ুই গল্প উপন্যাস অপছন্দ করা এই আমি এখন নিজেকে এই ভেবে শান্তনা দেয় আপনি আর আমি একই আকাশের নিচে বাস করি।কথাগুলো ভেবেই আকাশের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসলো রঙ্গন। আচ্ছা সব হাসিতেই কি সুখ থাকে? কি জানি! হয়তো আর্তনাদের হাসিগুলো একটু বেশিই সুন্দর।
………চলবে?