#অদিতির_যবনিকা -০৪
#তিশা
রঙ্গনের প্রশ্নে আহিনা ঠোট ফুলিয়ে বলল,
– না তো। সব সময় মাম্মাম বলে বাবাই কাজের জন্য বাইরে গেছে কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে কিন্তু আসেই না।
রঙ্গন যেনো চিন্তিত হলো তার চিন্তার মধ্যেই আহিনা আবার বলল,
– জানো আংকেল আমার বন্ধুদের বাবারা কাজের জন্য বাইরে গেলে দুই তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসে আমার বাবাইটা যে কেন এতো দেরী করছে কি জানি!
রঙ্গন ওর কপালে আদর দিয়ে বলল,
– বাবাই খুব দ্রুত চলে আসবে মন খারাপ করে না বেবী।
স্কুলের দেরী হচ্ছে দেখে এবার জেনিফার এগিয়ে এলো।
– মামনি দেরী হচ্ছে স্কুলের আসো।
আহিনা টাটা বলে জেনিফারের হাত ধরে স্কুলের ভিতরে ঢুকে গেলো।রঙ্গন তার পরিহিত হাফ প্যাণ্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে গভীর কিছু চিন্তা করতে লাগলো।
কয়েকদিন অফিসে ব্যস্ত সময় পার করছে অদিতি। নতুন কিছু প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে চলেছে তার কোম্পানি সেইটা নিয়ে খুব ব্যস্ততায় দিন যাচ্ছে তার।সদ্য মার্কেটিং টিমের সাথে মিটিং করে বেরিয়ে গেছে সে।পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক ইন্টার্ন অদিতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
– ইস কি সুন্দর ম্যাম। এরকম অল্প বয়সে এত সুন্দর কাজের দক্ষতা আর নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব খুব কম মেয়েদের মধ্যে পাওয়া যায়।
পাশে বসা মেরি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার কি মনে হয় ম্যামের বয়স কত হতে পারে?
– চব্বিশ পঁচিশ মে বি।
মেরি একটা হাসি দিয়ে বলল,
– সী ইজ থার্টি।
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল,
– রিয়েলি? আমি ভেবেছি বাবার কোম্পানি তাই হয়তো অল্প বয়সেই বড় পোস্টের দায়িত্ব পেয়েছে।
তারপর হতাশ হয়ে বলল,
– যার উপরে ক্রাশ খায় সেই সিনিয়র বের হয় কেন!
মেরি ঠোট প্রসারিত করে হাসলো তারপর বলল,
– তাহলে আরো শুনে রাখো ম্যামের পাঁচ বছরের একটা বেবীও আছে।
– ভাই অদিতি ম্যামের সমস্ত ডিটেইলস।
কথাটা বলে রিফাত একটা ফাইল এগিয়ে দিলো রঙ্গনের দিকে। রঙ্গন ফাইলটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো।দেখতে দেখতে শিথিল ভ্রুদ্বয় কুচকে এলো তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকালো।
– পাঁচ বছর আগে অদিতি ম্যামের ডিভোর্স হয়ে গেছে ভাই।ওনার হাজব্যাণ্ডের প’রকীয়ায় মূলত ডিভোর্সের কারণ।
রিফাতের কথায় চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো রঙ্গনের।রঙ্গন মাথা নাড়াতেই রিফাত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ফাইলটা সামনে ছুড়ে দিয়ে কঠিন অভিব্যক্তি নিয়ে বলল ‘আরাফ মাহমুদ তোমার পাপের ফল তোমাকে খুব শীঘ্রই ভোগ করতে হবে।’ রঙ্গন এবার সোফায় আরাম করে বসে ঠোট এলিয়ে হাসলো তারপর মনে মন ভাবলো ‘মিস চড়ুই আর একবার পাগলামি করলে কি খুব বেশি মন্দ হয়ে যাবে!’
দোতলার একটা রুম থেকে আসবাবপত্র সব বের করে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।অফিস থেকে ফিরে এরকম হট্টগোল দেখে ললাটে ভাজ পড়লো রওনক সাহেবের। কৌতূহলী হয়ে উদাস হয়ে দাড়িয়ে থাকা রিফাতকে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি হচ্ছে এসব?
রিফাত দুঃখী মুখ করে বলল,
– ভাই এই রুমে স্টুডিও বানাবে।
রওনক সাহেব তারপরও যেনো বুঝলেন না ঠিক সেই মুহুর্তে রঙ্গনকে সামনে পেয়ে গেলেন তিনি।
– এসব কি শুরু করেছো?
– এখন থেকে এখানেই যেহেতু থাকতে হবে তো আমার একটা নিজস্ব স্টুডিও তো চাই?
কথাটা বলে হনহন করে নিজের রুমের মধ্যে ঢুকে গেলো রঙ্গন। রওনক সাহেব প্রফুল্লিত কণ্ঠে রিফাতকে বলল,
– ও এখন থেকে আমার কাছে থাকবে?
রিফাত দুইপাশে কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।রওনক সাহেব যেনো আনন্দে আত্মহারা হলেন।
গত দুদিন ধরে আহিনা জেসিয়ার সাথে রঙ্গনের গল্প করছে কিন্তু জেসিয়া বিশ্বাস করছে না বলে সে খুব হতাশ হচ্ছে।আজ রঙ্গনের দেয়া কার্ড দেখিয়ে বলল,
– এই দেখ আংকেলের কার্ড দেখিস আমি তোকে একদিন ঠিক আংকেলের কনসার্টে নিয়ে যাবো।
জেসিয়াও উদাস হয়ে বলল,
– যেদিন নিয়ে যাবি সেদিন বিশ্বাস করবো আমার আপু বলেছে আর আর এর গল্প শুনে তোর মধ্যে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।
আহিনার এবার রাগ হলো টুপ করে নিজের ব্যাগ নিয়ে পিছনে চলে গেলো। প্রিয় বন্ধুর অভিমান জেসিয়ার সহ্য হলো না সে আহিনার কাছে যেয়ে বলল,
– আচ্ছা সরি আর বলবো না এরকম এখন চল।
জেসিয়া একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলো আহিনাকে নিজের পাশে।
আজ ছুটির দিন আহিনাকে নিয়ে গ্রোসারি শপিংয়ে এসেছে অদিতি। আহিনা একটা করে স্ন্যাকস ট্রলিতে ওঠাচ্ছে আর অদিতি সেগুলো পুনরায় সেলফে রেখে দিচ্ছে এক পর্যায়ে আহিনা ঠোট ফুলিয়ে কোমরে দুই হাত দিয়ে দাড়ালো তারপর আহিনা হঠাৎ খেয়াল করলো আদিতির ঠিক পিছনে কিছুটা দূরত্বে ব্যাগী ডেনিম আর মেরুন হুডি পরা রঙ্গন দাড়িয়ে। মুহূর্তেই আহিনার রাগ উবে গেলো যেনো।
– রঙ্গন আংকেল!!!!!
উচ্ছ্বসিত আওয়াজে ডাক দিলো আহিনা তারপর ছুটে গেলো রঙ্গনের দিকে। রঙ্গনও দুই হাত মেলে আগলে নিলো আহিনাকে।অদিতি রঙ্গনকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হলো বটে কিন্তু সেটা লুকিয়ে নিলো সে।জেনিফারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে রঙ্গন আর আহিনার বন্ডিংয়ের ব্যাপারে অবগত সে। অদিতি ভেবেছিলো রঙ্গন তো কনসার্ট অব্দি জাপানে আছে এই দুই একদিন আহিনার সাথে দেখা হলে আর এমন কি কিন্তু গতকাল তো কনসার্ট হয়ে গিয়েছে তাহলে রঙ্গন এখনো জাপানে কি করছে।এসমস্ত ভাবতে ভাবতে অদিতি রঙ্গনের সামনে দাড়ালো। রঙ্গন আর আহিনা তখন নিজেদের কথোপকথনের মধ্যে ব্যস্ত আশেপাশে কি হচ্ছে কারা আছে তাতে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না।
– গতকাল তোমার কনসার্ট হয়ে গেছে না?
অদিতির প্রশ্নে রঙ্গন তার দিকে চাইলো তারপর মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।অদিতি এবার একটু ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলো ,
– আমেরিকা ফিরবে কবে?
– আর ফিরবো না।
সোজাসাপটা জবাব রঙ্গনের। অদিতি মাথা নাড়ালো তারপর আহিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– মা চলো বাসায় ফিরতে হবে।
আহিনা রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা হেলিয়ে বলল,
– মাম্মাম আমি কিছুক্ষণ আংকেলের সাথে থাকি প্লিজ!
অদিতি একটু রাগত স্বরে বলল,
– তোমাকে বলেছি না অহেতুক জেদ করবে না!
আহিনা ছলছল চোখে রঙ্গনের দিকে তাকালো। রঙ্গন একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে অদিতিকে বলল,
– মিস চড়ুই বেবী কিছুক্ষণ থাকুক আমি ওকে বাসায় দিয়ে আসবো।
– কিন্তু…
কিছু বলতে নিয়েও মেয়ের প্রায় কান্নারত মুখটার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলল না সে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো তারপর দ্রুত বাসায় ফেরার কথা বলে প্রস্থান করলো অদিতি।অদিতি চলে যেতেই রঙ্গন আর আহিনা উচ্ছ্বসিত হয়ে হাই ফাইভ দিলো দুজন দুজনকে।
ঘন্টা দুয়েক পরে রঙ্গন আহিনাকে নিয়ে ফিরে এলো।রঙ্গন আহিনাকে কোল থেকে নামিয়ে চলে যেতে নিলো অদিতি ভদ্রতা সুলভ ভিতরে আমন্ত্রণ জানালো তাকে আহিনাও মায়ের কথায় সায় দিয়ে রঙ্গনের হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো।
আহিনা রঙ্গনকে সোফায় বসিয়ে নিজেও ওর পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলো আবার।রঙ্গন কিছু সময় পরে চলে যেতে চাইলে অদিতি তাকে ব্রেকফাস্ট করে যেতে বলে।ডাইনিং টেবিলে আহিনা টুকটাক কথা বলছে অদিতি আর রঙ্গনের মধ্যে চলছে অস্বস্তিকর নীরাবতা।অদিতিই প্রথম কথা বলল,
– সিঙ্গার হওয়ার ডিসিশন কবে নিলে?
– ওইভাবে চিন্তাভাবনা করে কোন ডিসিশন নেইনি গানের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে কিভাবে যেনো গানের জগতে ঢুকে গেলাম।
রঙ্গনের সহজ সাবলীল উত্তরে অদিতিও যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। মনে মনে ভাবলো যাক তাহলে রঙ্গনের আবেগ কেটে গেছে।তারপর টুকটাক কথা হলো দুজনের।
এরপর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন রঙ্গনের সাথে আহিনার প্রায়শ দেখা হয় দুজনে এখন বেস্ট বাডি।অদিতি আর রঙ্গনের খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তবে যদি কখনো মুখোমুখি হয় দুজনের তবে দুজনই সহজ সাবলীলভাবেই কথা বলে। অদিতি ভেবে নিয়েছে বহু বছর আগের রঙ্গন এখন অনেকটাই পরিণত আগের সেই আবেগ অনুভূতি হয়তো তার মধ্যে আর নেই। কিন্তু আসলেই কি তাই!
আজ স্কুল থেকে ফিরে আহিনা সোজা নিজের রুমে যেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।জেনিফার দীর্ঘসময় চেষ্টা করেও যখন আহিনার মন ভালো করতে পারলো না তখন বাধ্য হয়ে অদিতিকে ফোন করলো সে।অদিতি জানালো তার একটা মিটিং আছে সেটা শেষ করেই আসছে।
অদিতি বেশ দেরি করেই ফিরলো বাসায়।মেয়েকে মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে দেখে সে আহিনার পাশে যেয়ে বসে কোলে উঠিয়ে নিলো তাকে।
– আমার আহি পাখির মন খারাপ কেন?
আহিনা ছলছল চোখে অদিতির বুকে মাথা রেখে বলল,
– মাম্মাম আমাকে মিথ্যে বলেছো তুমি!
অদিতি মেয়ের কথা না বুঝে জিজ্ঞেস করলো ,
– কি মিথ্যে বলেছি মা?
– তুমি বলেছিলে বাবাই কাজ শেষ হলে ফিরে আসবে কিন্তু তোমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে আর ডিভোর্স হলে তো বাবাই মাম্মাম আলাদা হয়ে যায়। আর একসাথে থাকে না।
বলেই আহিনা কান্না করে দিলো। অদিতি কি বলবে বুঝতে পারলো না। মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– তোমাকে এসব কে বলেছে মা?
– দুইজন মিস বলতেছিলো আমার বাবা মার ডিভোর্স হয়ে গেছে তারপর আমি জেসিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু জেসিয়াও বলতে পারেনি ছুটির পরে জেসিয়ার আপুর কাছে জিজ্ঞেস করেছি তখন সে বলেছে।
অদিতি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো তারপর ভাবলো ধীরে ধীরে আহিনাকে সত্যিটা বুঝিয়ে বলা উচিত।
– পাখি তুমি মাম্মামকে অনেক ভালোবাসো না?
আহিনা চোখ মুছতে মুছতে সায় জানালো।অদিতি পুনরায় বলল,
– তোমার যিনি বাবাই তিনি তোমার মাম্মামকে আর ভালোবাসে না। তিনি তোমার মাম্মামের সাথে আর থাকতে চায় না অন্য এক আন্টির সাথে থাকতে চায় এজন্য মাম্মাম তোমাকে নিয়ে চলে এসেছে। এখন তুমি কি বাবাইয়ের কাছে যেতে চাও তাহলে কিন্তু মাম্মামকে ছাড়া থাকতে হবে।
আহিনা তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে অদিতির গলা জড়িয়ে ধরলো তারপর বলল,
– আহি পাখি তার মাম্মামকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমার বাবাই লাগবে না আমার শুধু মাম্মামকে চাই।
অদিতি মেয়েকে পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে চুলের ভাজে আদর দিলো চোখেমুখে তার প্রাপ্তির হাসি।
…………চলবে?
বিঃদ্রঃ সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।