#অদিতির_যবনিকা -০৫
#তিশা
রাতে আহিনার মারাত্মক জ্বর এলো। মূলত অতিরিক্ত কান্না করার জন্য জ্বর এসেছে তার। পরদিন অদিতি আহিনাকে স্কুলে পাঠালো না এদিকে রঙ্গন আহিনার জন্য স্কুলের সামনে অপেক্ষা করে যখন কোন দেখা পেলো না তখন জেনিফারকে ফোন দিলো। জেনিফারের কাছে আহিনার শরীর খারাপ জানতে পেরে রঙ্গন অদিতির বাসায় চলে আসে।রঙ্গন যখন এলো অদিতি তখন অফিসে ছিলো জেনিফার দরজা খুলে রঙ্গনকে দেখে ভিতরে আসতে দিলো। রঙ্গন আহিনার রুমে যেয়ে দেখলো আহিনা ঘুমাচ্ছে। সে আহিনার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো ,
– বেবী?
আহিনা রঙ্গনের আদুরে ডাকে পিটপিট করে তাকালো রঙ্গনকে দেখে একটা দুর্বল হাসি দিয়ে রঙ্গনের কোলে মাথা তুলে দিয়ে জ্বরের ঘোরে আওড়ালো,
– বাবাই!!
মুহূর্তেই রঙ্গনের শরীরের লোম বুঝি দাড়িয়ে গেলো। এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়নি তার। পরম আবেগে আহিনার মাথায় হাত বুলিয়ে সেখানে আদর চিহ্ন এঁকে দিলো সে।
দরজায় দাড়িয়ে পুরো ঘটনাটায় দেখলো জেনিফার। চোখ দুটো ভরে এলো তার। সেই পাঁচ মাস বয়স থেকে আহিনার দেখাশোনা করছে সে। অসহায় অনাথ জেনিফারকে অদিতি একরকম রাস্তা থেকে তুলে এনে নিজের ছোট বোনের জায়গা দিয়েছে। আহিনাকে সে নিজের সন্তানের মত আগলে রাখে। জেনিফার দেখেছে অন্যরা যখন তাদের বাবার হাত ধরে স্কুলে আসে আহিনা তখন চাতক পাখির মত সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বাবার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আহিনার ছোট্ট মনটা যে মরুভূমির তৃষ্ণার্থ যাযাবরের ন্যায় ছটফট করে সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে সে।রঙ্গনের কাছে পিতৃ সুলভ অনুভূতি পায় এজন্যই যে আহিনা রঙ্গনের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে সেটাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে।গতকাল অদিতি আর আহিনার কথোপকথন শুনেছে জেনিফার। অদিতির অতীত সম্পর্কে পূর্ব হতেই অবগত জেনিফার। এরকম ফুলের মত মা মেয়ের জীবনে উপরওয়ালা কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে কেন বুঝে পায় না সে।
রঙ্গন আহিনার সাথে দেখা করে চলে যাওয়ার সময় জেনিফারকে আহিনার হঠাৎ জ্বরের কারণ জিজ্ঞেস করলে জেনিফার তাকে গতকালের ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলে। সব শুনে রঙ্গন কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। জেনিফার এই কয়দিনে যতটুকু বুঝেছে রঙ্গন আর অদিতি পূর্ব পরিচিত এবং রঙ্গনের অদিতির প্রতি একটা অন্যরকম অনুভূতি অবশ্যই আছে। রঙ্গন চলে যেতেই জেনিফার দরজা বন্ধ করে আহিনার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে ভাবলো ‘মামনি আজ অজান্তে যাকে বাবা ডেকেছো আমি প্রার্থনা করি সৃষ্টিকর্তা যেনো খুব শীঘ্রই তাকে তোমার বাবা হওয়ার অধিকার দেন।’
রাতে ছাদে বসে গীটারে টুংটাং আওয়াজে সুর তোলার চেষ্টা করছে রঙ্গন।মস্তিষ্কে তার অজস্র ভাবনা জট পাকিয়ে আছে।দীর্ঘসময় চেষ্টা করেও যখন সুরে মনোনিবেশ করতে অক্ষম হলো তখন বিরক্ত হয়ে গীটার নামিয়ে রাখলো। ছাদের রেলিংয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে আওড়ালো,
– আহিনার বাবার অভাব পূরণের জন্য হলেও এবার আপনাকে ধরা দিতেই হবে মিস চড়ুই।আরো একবার রাফিয়ান রঙ্গনের বেপরোয়া ভালোবাসার মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে এবার আপনার ওইসব অর্থহীন যুক্তির আর পরোয়া করিনা আমি। এবার ভালোবাসার বিপরীতে নাহয় নিজেকেই বাজি রাখলাম।
নিজের ব্যক্তিগত অফিস রুমে রওনক সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে ডুবে আছে।এমন সময় দরজায় নক করার শব্দে মনোযোগ সেদিকে নিলেন তিনি।রঙ্গনকে এই অসময়ে তার কাছে আসতে দেখে মৃদু হাসলেন তিনি।
– কি ব্যাপার রাস্তা ভুল হলো নাকি?
রঙ্গন একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বাবার সামনে বসলো তারপর নির্লিপ্ত ভাবে বলল,
– জীবনে প্রথমবার তোমার ক্ষমতা ব্যবহার করতে চাইছি।এই ব্যাপারে কোন আপত্তি আছে?
রওনক সাহেব ঠোট এলিয়ে হাসলেন তারপর বললেন,
– আমার টাকা পয়সা প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছুরই একমাত্র উত্তরাধিকার তুমি এখানে কোন সংশয় নেই। সবকিছুই তোমার। তবে সেই প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা কোন নিরাপরাধ মানুষের ক্ষতি হবে না এই প্রত্যাশা রাখি।
রঙ্গন মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। তারপর উঠে চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এলো।
– বাবা তোমার জন্য যদি বউমার সাথে সাথে নাতনীও নিয়ে আসি তুমি বিষয়টা কিভাবে নেবে?
– আহিনা নাতনী হিসেবে বেশ হবে বুড়ো বয়সে আমার খেলার সঙ্গী হবে।
রওনক সাহেবের কথায় রঙ্গন হতচকিতে তাকালো তার দিকে।রওনক সাহেব বাকা হেসে বলল,
– আমার গীটার নিয়ে পথে পথে ঘোরা ছেলে হঠাৎ বাবার আস্তানায় থাকতে চাইলো তো ব্যাপারটা খুজে বের করা বাবা হিসেবে আমার দায়িত্ব না?
রঙ্গনও শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
– ছেলের প্রেমের পিছনে গোয়েন্দাগিরি না করে নিজে একটা প্রেম করলেও তো পারো শুনলাম মিস রেবেকা বেস ইন্টারেস্টেড। আমার কিন্তু আধুনিক স্টেপ মমে কোন সমস্যা নাই।
কথাগুলো বলে রঙ্গন আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না। রওনক সাহেব রঙ্গনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বিড়বিড় করলো ‘মধুমিতাকে বার বার বলেছিলাম প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এত ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর এনিম্যাল প্লানেট দেখো না এখন দেখলে তো ছেলে একটা আস্ত বাদর হয়ছে।’
ছোট্ট একটা মেয়ে বাবু পার্কে সাইকেল চালোনো শিখছে মেয়েটির বাবা পিছন থেকে সাইকেলটা ধরে রেখেছে যেনো পড়ে না যায়। বিষাদ ভরা নয়নে পার্কের বেঞ্চে বসে সেই দৃশ্য অবলোকন করছে আহিনা। তার বাবাই থাকলে সেও এভাবে সাইকেল চালানো শিখতে পারতো। জেনিফার বিষয়টা বুঝতে পেরে আহিনার মনোযোগ অন্য দিকে নেওয়ার চেষ্টা করলো।
– বেবী চলো আমরা স্লিপারে উঠি!
– আহি পাখি আজ কোন রাইডে চড়বে না।
দুঃখী ভাবে জানালো আহিনা।জেনিফার এবার চকলেট অফার করলো কিন্তু তাতেও আহিনার উদাস ভাব কাটলো না।এমন সময় রঙ্গন এলো দৌড়াতে দৌড়াতে। আহিনাকে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে হাসি দিয়ে বলল,
– আমার বেবীর মন খারাপ কেন?
আহিনা রঙ্গনের হাতের ব্রেসলেট নিয়ে খেলতে খেলতে আভিমানী স্বরে জানালো,
– আমার বাবাই নেই তাই আমি সাইকেল চালানো শিখতে পারছি না।
কথাটা বলে সামনে সাইকেল চালানো বাবা মেয়ের দিকে ইশারা করলো সে।রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল ,
– তো কি হয়েছে আহিনার তো রঙ্গন আংকেল আছে সে শিখাবে।
মুহূর্তেই আহিনার মুখের অন্ধকার কেটে গেলো প্রফুল্ল নয়নে রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরে গালে আদর দিলে বলল,
– প্রমিস!
প্রমিস বলে নিজের পিংকি ফিঙ্গার এগিয়ে দিলো সে রঙ্গন হেসে তার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি দিয়ে আহিনার ছোট্ট আঙ্গুল আকড়ে ধরে প্রমিস জানালো।
– আমি আজই মাম্মামকে সাইকেল কিনে দিতে বলবো।
উচ্ছ্বসিত হয়ে আহিনা বলল।রঙ্গন একবার ভাবলো সে কিনে দেবে তারপর চিন্তা করলো অদিতি বিষয়টা পছন্দ করবে না তাই আর বিশেষ কিছু বললো না।
রঙ্গন আজ প্রথমবার রওনক সাহেবের অফিসে এসেছে।হাফপ্যান্ট ,হুডি আর মাক্স পরা রঙ্গনকে দেখে সবাই একটু বিস্মিত হয়েছে বটে কিন্তু রিফাতকে রওনক সাহেবের অফিসের লোকজন ভালোভাবেই চেনে এজন্য কেউ কিছু বলে নি।রঙ্গন যখন রওনক সাহেবের কেবিনে প্রবেশ করলো তিনি তখন জরুরি ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল।ছেলেকে হঠাৎ অফিসে দেখে ললাটে ভাজ দেখা দিলো তার। দ্রুত ওপাশের ব্যক্তির সাথে আলাপ শেষ করলেন।
– কি ব্যাপার হঠাৎ অফিসে?
– আমি চাইছি এবার বিডির কন্সট্রাকশনের প্রজেক্ট এ.এম বিল্ডার্সের সাথে করতে।
রঙ্গনের ভণিতাবিহীন প্রস্তাবে রওনক সাহেব একটু বিস্মিত হলেন বটে তারপর চিন্তিত হয়ে বললেন,
– এ.এম বিল্ডার্স মানে আরাফ মাহমুদ তো?
রঙ্গন মাথা নাড়ালো।
– কিন্তু তার থেকেও ভালো ভালো কন্সট্রাকশন ফার্ম তো বিডিতে আছে?
রঙ্গন একটা বক্র হাসি দিয়ে বলল ,
– গতকালই না তোমাকে বললাম প্রথমবারের মত তোমার ক্ষমতা ব্যবহার করতে চাই।
রওনক চৌধুরী আর কথা বাড়ালেন না। ছেলের প্রস্তাব মেনে নিলেন। রঙ্গন পুনরায় বলল,
– এবং এই প্রজেক্টের সবটাই আমি নিজ হাতে হ্যাণ্ডেল করতে চাই।
রওনক সাহেব জহুরি নজরে ছেলের দিকে তাকালেন।ছেলে যে তার স্বভাবের বিপরীতে কাজ কর্ম করছে ভালোই বুঝতে পারছেন তিনি। এর পিছনেও যে অদিতি সংক্রান্ত কোন কারণ সেটাও আন্দাজ করতে পারছেন তিনি। কিন্তু পরিশেষে তিনি ছেলের সুখটাই চান। অদিতির মধ্যেই যদি তার ছেলের সুখ থাকে তাহলে সেটাই হোক। বিরহের যন্ত্রণায় দিনের পর দিন ছেলেকে ছটফট করতে দেখেছেন তিনি। এতগুলো বছর পরে আবার তিনি রঙ্গনের চোখে মুখে পুরনো উন্মাদনা দেখছেন । ছেলের এই উচ্ছলতা ধরে রাখার জন্য নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে রাজি আছেন রওনক চৌধুরী ।
সন্ধ্যাবেলা রঙ্গনের ফোনে অদিতির নাম্বার থেকে ফোন এলো। রঙ্গন একটু অবাকই হলো অদিতির সাথে এখনো অব্দি ফোনে তার কখনো কথা হয়নি যেটুকু কথা হয়েছে তাও কুশল বিনিময় আর টুকিটাকি আলাপচারিতায় সীমাবদ্ধ থেকেছে। বেশি চিন্তা না করে রিসিভ করলো সে।
– রঙ্গন আংকেল আমি তোমার আহি বেবী।
আহিনার কথায় রঙ্গনের ঠোট প্রসারিত হলো।
– হ্যা বেবী বলো।
– মাম্মাম সাইকেল কেনার পারমিশন দিয়েছে আমি সাইকেল কিনতে যাবো তুমিও চলে আসো।
– আমি…
বাকিটুকু বলার আগেই আহি তার আদুরে কণ্ঠে তরতর করে বলে চললো ,
– তোমাকে না নিয়ে আমি সাইকেল কিনবো না মাম্মামের সাথে কথা বলো।
আহি ফোনটা অদিতির দিকে এগিয়ে দিলো। অদিতি ফোনটা কানে নিয়ে দোকানের ঠিকানা দিয়ে সরাসরি রঙ্গনকে সেখানে আসতে বলে ফোন কেটে দিলো।
ঘুরে ঘুরে রঙ্গন আর আহিনা সাইকেল পছন্দ করছে। অদিতি সোফায় বসে দুজনকে দেখছে সেই সাথে গভীর কিছু ভাবছে।
দূরে দাড়িয়ে জেনিফার অদিতিকে পর্যবেক্ষণ করছে। পাশে দাড়ানো রিফাতকে খোচা দিলো সে।রিফাত চেতে উঠলো।
– এই আরব্যরজনীর জ্বীনি কি সমস্যা?
– সব সময় খেঁকশিয়ালের মত খ্যাক খ্যাক না করে একটা কথা শুনুন।
রিফাত ভ্রু কুচকে তাকালো।
– আপনার বস কি অদিতি আপুকে পছন্দ করে?
রিফাতকে এবার ভাবুক দেখা গেলো।
– শুধু পছন্দ না আমার মনে হয় ভাই অদিতি ম্যামকে ভয়ংকর ভালোবাসে।আমার ধারণা ম্যামই হয়তো ভাইয়ের এতদিনের লুকিয়ে রাখা সেই ভালোবাসা।
জেনিফার এবার চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
– আপু যেভাবে রঙ্গন স্যারকে পর্যবেক্ষণ করছে আমার কাছে ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না।
রিফাত জেনিফারের কথায় অদিতির দিকে তাকিয়ে দেখলো অদিতি রঙ্গন আর আহিনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
– মিস জ্বীনি অদিতি ম্যামকে না পেলে এবার ভাই বোধহয় সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যাবে!
…………..চলবে?
বিঃদ্রঃ সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।