অদিতির যবনিকা পর্ব-০৬

0
13

#অদিতির_যবনিকা -০৬
#তিশা

আহিনা একটা বেগুনি কালারের সাইকেল পছন্দ করেছে। নতুন সাইকেল নিয়ে ফেরার সময় অদিতি রঙ্গনকে বাসায় আমন্ত্রণ জানালো। রঙ্গন একটু অবাকই হলো কিন্তু আহিনা বেশ উৎফুল্ল।
অদিতির বাসায় ডিনারের পরে আহিনা জেনিফার আর রিফাতের সাথে তার নতুন সাইকেল নিয়ে গবেষণা করছে। অপরদিকে মুখোমুখি বসে আছে রঙ্গন আর অদিতি। রঙ্গন অনুভব করতে পারছে অদিতি নিশ্চয়ই সুখকর কিছু বলবে না। নীরাবতা ভেঙে অদিতিই প্রথম কথা বলল,
– আমার মনে হয় আহিনার সাথে তোমার দূরত্ব মেইনটেইন করা উচিত রঙ্গন।
রঙ্গন ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো কিছু বলল না।অদিতিই পুনরায় বলল,
– আহিনা তোমার প্রতি ধীরে ধীরে অনেক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে সব কিছুতেই তোমাকে চাই। পরবর্তীতে তুমি দূরে চলে গেলে ওর বাচ্চা মন সেটা নিতে পারবে না তাই এখন থেকেই ধীরে ধীরে আহির সাথে তোমার দূরত্ব মেইনটেইন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
রঙ্গন বোধহয় রহস্যময় হাসলো কিন্তু মুহূর্তেই সেটা লুকিয়ে নিলো তারপর গভীরভাবে অদিতির দিকে তাকালো।পুরনো অতি পরিচিত সেই চাহনিতে অদিতি কি একটু ঘাবড়ালো? ঠিক বোঝা গেলো না।
– আপনাকে কে বলল ভবিষ্যতে আমি আহিনার থেকে দূরে চলে যাবো?
রঙ্গনের গভীর কণ্ঠে অদিতি কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে রইলো। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
– তুমি নিশ্চয়ই সারাজীবন আহিনার কাছাকাছি থাকতে পারবে না তোমারও একটা নিজস্ব জীবন আছে?
রঙ্গন হেসে বলল,
– আমার দ্বারা আহিনা কোনদিন বিন্দু পরিমাণ কষ্ট পাবে না। আর আপনি খুব ভালো করেই জানেন রাফিয়ান রঙ্গন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় না।
কথাগুলো বলে রঙ্গন আহিনার কাছে চলে গেলো। অদিতি অদূরে বসে দেখলো রঙ্গনকে কাছে যেতে দেখে আহিনার চোখে মুখে খুশির জোয়ার।একদিকে রঙ্গন আর আহিনার মেলবন্ধনে একরকম চিন্তিত আবার আহিনার চোখেমুখের উচ্ছ্বাসও ভেঙে ফেলতে চাইছে না সে।রঙ্গনের কাছাকাছি আসার পর থেকে আহিনা আগের থেকে আরো বেশি প্রাণোচ্ছল আর চটপটে হয়েছে অনুভব করে সে।রঙ্গন ভালো মানুষ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই তার কিন্তু অতীত ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছে সে।

বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে রুহি। আরাফের সাথে সংসারের পাঁচ বছর হতে চলেছে তার। বিলাশবহুল জীবন হলেও সুখ শান্তি জিনিসটা তাদের সংসারে ধরা দিয়েও যেনো দিচ্ছে না। প্রথম প্রথম তারা ইচ্ছে করেই সন্তান নেয়নি কিন্তু বিয়ের দুবছর পর থেকে যখন সন্তানের জন্য চেষ্টা করা শুরু করেছে তখন থেকে প্রতিবারই বিফলে গেছে সেই চেষ্টা। অপরদিকে প্রথম থেকেই শ্বশুর শ্বাশুড়ির অপছন্দের তালিকায় সে। অদিতিকে তার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকেই ভীষণ ভালোবাসতেন সেই ভালোবাসা কোথাও না কোথাও এখনো সুপ্তভাবে রয়ে গেছে। এজন্যই তো বিয়ের এতগুলো বছর পরেও শ্বশুরবাড়ির মানুষজন তাকে পুরোপুরি মেনে নেয়নি। এখন তো সন্তান না হওয়াকে কেন্দ্র করে দুই একজন আত্মীয় কথা শোনাতেও পিছপা হয় না। এসমস্ত ভাবতে ভাবতে রুহির নেত্রদ্বয় হয়ে উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো।

টিফিন টাইমে আহিনা জেসিয়া আর আরো কিছু বন্ধুদের সাথে ক্যান্টিনে খেতে বসেছে।আহিনা দুই হাত গালে ঠেকিয়ে ভাবুক হয়ে বসে আছে।জেসিয়া কনুই দিয়ে আহিনাকে গুতা দিয়ে বলল,
– কি ভাবছিস আহি?
আহিনা গাল থেকে হাত নামিয়ে ঠোট ফুলিয়ে বলল,
– আগের বাবাই মাম্মামের সাথে থাকতে চাই না তাই আমিও সেই বাবাইকে চাই না কিন্তু আমার তো একটা বাবাই দরকার।
কথাটা বলেই আহিনা দুখী দুখী মুখ করে জেসিয়ার দিকে তাকালো। বেস্টফ্রেণ্ডের দুঃখে জেসিয়াকেও বেশ দুঃখী দেখালো।
– আসলেই বাবাই থাকা খুব দরকার। মাঝে মাঝে হোম ওয়ার্ক করে দেয় আমার বাবা আবার মাম্মির মা’রের হাত থেকে বাচিয়ে দেয়। মাম্মিকে চুরি করে চকলেট আইসক্রিম খাওয়ায় আমকে।
জেসিয়ার কথায় আহিনা আরো প্রবলভাবে বাবাইয়ের গুরুত্ব অনুভব করলো। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দুই বন্ধুর কথা শুনছিলো রেনন ,এবার সে কথা বলল,
– আহি আমি তোকে একটা বুদ্ধি দিতে পারি।
রেননের কথায় আহিনা এবং জেসিয়া দুজনেই উৎসাহী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।
– তোর মাম্মাম যদি বিয়ে করে নেয় তাহলে তুই নতুন বাবাই পেয়ে যাবি।
আহিনার রেননের কথাটা বেশ পছন্দ হলো তারপরও বিজ্ঞের মত প্রশ্ন করলো,
– তুই শিউর মাম্মামের বিয়ে হলে আমি নতুন বাবাই পাবো?
রেনন বেশ কনফিডেন্সের সাথে নিজের ছোট্ট বৃদ্ধা আঙ্গুল উচিয়ে বলল,
– হাড্রেট পার্সেন্ট শিউর। আরে আমিও তো এভাবেই বাবাই পেয়েছি আমার আগের বাবাই তো গড নিয়ে গেছে তারপর মাম্মাম আবার বিয়ে করেই তো এই বাবাই নিয়ে এলো।

আহিনা রেননের কথায় বেশ আশাবাদী হলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো মাম্মামকে বিয়ে দিবে সে। ছুটির পরে জেনিফার তাকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেলো।চিপস খেতে খেতে তার প্রিয় জেনি আন্টিকে প্রশ্ন করলো ,
– বিয়ে কিভাবে দিতে হয় আন্টি?
জেনিফার আহিনার এরকম প্রশ্নে বিস্মিত হলো।
– মামনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কার বিয়ে দিতে চাও তুমি?
– মাম্মামের।
সহজ সরল স্বীকারোক্তি আহিনার। জেনিফার যেন আকাশ থেকে পড়লো আবার মজাও পেলো। মৃদু হেসে জেনিফার আহিনাকে জিজ্ঞেস করলো ,
– হঠাৎ মাম্মামের বিয়ে দিতে মন চাইলো যে?
স্কুলে বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতার বিস্তারিত খুলে বললো সে জেনিফারকে। জেনিফারও ভাবলো এই সুযোগে যদি আহিনার মাধ্যমে রঙ্গনকে আদিতির জীবনে আনা যায় তাহলে মন্দ হয় না। তাছাড়া রঙ্গনের কাছে আহিনাও বাবার ভালোবাসা পাবে সে ব্যাপারে এই কয়দিনে সে নিশ্চিত হয়েছে।
– কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে মামনি।
জেনিফারের কথায় আহিনা চিন্তিত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো কি সমস্যা।
– মাম্মামের বিয়ে দিতে গেলে আগে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যে আহি বেবীকে বাবাইয়ের মত ভালোবাসবে তাই না? মাম্মামের সাথে যে কাউকে তো বিয়ে দেয়া যাবে না তাই না বেবী?
আহিনা মাথা দুলিয়ে হ্যা জানালো।ছোট্ট মস্তিষ্ক ভাবতে লাগলো তাই তো মাম্মামের বিয়ে দিতে হলে আগে তো ভালো বাবাই খুজতে হবে!

অদিতির মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্মচারীদের উপরে প্রচণ্ড রাগারাগি করে এসেছে সে।নতুন প্রডাক্ট লঞ্চের জন্য একটা মানসম্মত মডেল কেউ জোগাড় করতে পারছে না।হঠাৎ দরজায় নক শুনে সেদিকে তাকালো সে। মার্কেটিং টিমের হেড রজারকে দেখে ভিতরে আসার অনুমতি দিলো সে।রজার ভয়ে ভয়ে বলল,
– ম্যাম আমরা কি এবার মডেল বাদ দিয়ে কোন সেলিব্রিটি আই মিন হিরো অথবা সিঙ্গার হায়ার করে দেখতে পারি?
অদিতি রাগত স্বরে বলল,
– যাকে ইচ্ছা হায়ার করুন কিন্তু এবার ভুল হলে সবাই তার ফল ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
রজার মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। যে করেই হোক এবার বেস্ট কিছুই করতে হবে। অদিতি ম্যাম এমনিতেই ভালো মানুষ কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এক শতাংশও গাফিলতি পছন্দ করেন না এই ব্যাপারে রজার খুব ভালোভাবেই অবগত।

আরাফ মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে রুহিকে বেডরুমে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় পা বাড়ালো। উদাসভাবে রুহিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সুখী হতে যেয়েও যেনো সুখী হতে পারছে না সে।বাবা মা ঠিকভাবে কথা বলে না বিগত বছরগুলোতে। অদিতির সাথে ডিভোর্সের পরে তারা আরাফের বোনের কাছেই বেশীরভাগ সময় থাকে। প্রথম প্রথম ভেবেছিলো কিছু দিন গেলে হয়তো বাবা মা স্বাভাবিক হবেন কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করে এতগুলো বছরেও তারা না আরাফের সাথে ভালোভাবে কথা বলেছে আর না রুহিকে মেনে নিয়েছে। এখন তো একটা সন্তানের জন্যও কত হাহাকার করতে হচ্ছে।এইসমস্ত ভাবতে ভাবতে আরাফ রুহির দিকে পা বাড়ালো।
– এত কি ভাবো বলো তো?
রুহি আরাফের কথায় পিছন ফিরে চাইলো। তারপর উদাস হাসি দিয়ে বলল,
– ভাবার তো কত কিছুই আছে!
– চিন্তা করো না বিজনেসের ঝামেলা মিটলে আমরা দেশের বাইরে যাবো উন্নত চিকিৎসার জন্য।
স্বামীর সান্ত্বনা বাণীতে রুহি হতাশ হয়ে বলল,
– তাতেও যদি লাভ না হয় তখন?
– তাহলে আমরা বাচ্চা এডপ্ট করবো।
হাসিমুখেই বলল আরাফ। রুহি আরাফের হাত ধরে বলল,
– আহিনাকে কোনভাবে আমাদের কাছে রাখার ব্যবস্থা করা যায় না?
স্ত্রীর অনুনয়ের কথা শুনে আরাফ তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো তারপর বলল,
– তুমি চাওনি বলে আমি আহিনার উপর থেকে আমার সকল অধিকারবোধ তুলে নিয়েছিলাম এখন চাইলেই সেটা সম্ভব নয়।
– কেন সম্ভব নয় আহিনা তো তোমারও মেয়ে চাইলেই তুমি আইনী পদ্ধতিতে পুনরায় আহিনার জন্য লড়তে পারো!
বেশ উত্তেজিত হয়ে রুহি কথাগুলো বললো। আরাফ কঠিন কণ্ঠে বলল,
– অদিতি সাদাসিধা মানুষ ছিল কিন্তু বোকা ছিল না। যখন আমি আহিনার দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম তখনই সে সকল প্রকার আইনী পদ্ধতিতেই আহিনার সকল কিছুর অধিকার তার আওতাধীন করে নিয়েছে চাইলেও আমি কিছু এখন করতে পারবো না।
কথাগুলো বলে আরাফ ঘরের উদ্দেশ্য যেতে যেতে পিছু ফিরে পুনরায় বলল,
– যে সন্তানের দায়িত্ব নিতে একদিন ভরা মজলিসে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম আজ তার অধিকার চাইতে যেতে পারবো না। এতটাও নির্লজ্জ আমি নই।
রুহি বিষাদভরা নয়নের আরাফের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।

– ভাই?
– রিফাত এখন আমি কোন কিছু শোনার মুডে নেই।
গীটারে মনোযোগ দিতে দিতে রিফাতকে প্রত্যুত্তর করলো রঙ্গন। রিফাত মনে মনে ক্রুর হাসি হাসলো তারপর ভোলাভালা মুখ করে বলল,
– আচ্ছা তাহলে অদিতি ম্যামের অফিস থেকে আসা প্রোপোজাল ক্যান্সেল করে দিই কি আর করার।
কথাটা বলেই রিফাত বেরিয়ে যেতে নিলে রঙ্গনের গম্ভীর কণ্ঠের ডাকে থেমে যায় সে।
– স্টপ!!
রিফাত আগের থেকও গুরুতর ইনোসেন্ট মুখ করে তাকালো রঙ্গনের দিকে।
– কিসের প্রোপোজাল?
– ম্যামের কোম্পানির নতুন প্রোডাক্টের ব্র‍্যাণ্ড এম্বাসাডরের জন্য আপনাকে অফার করা হয়েছে। ম্যামের বিজ্ঞাপন ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি যোগাযোগ করেছে।
রঙ্গনের চোখেমুখে খেলে গেলো প্রফুল্লতার এক ঝলক। ঠোট এলিয়ে আওড়ালো ‘ভবিতব্যও চাইছে আপনি আর আমি কাছাকাছি থাকি মিস চড়ুই।’

………….চলবে?

বিঃদ্রঃ সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।