#অদিতির_যবনিকা -০৮
#তিশা
রঙ্গন চলে যাওয়ার পরে আহিনা প্রচুর কান্নাকাটি করেছে অদিতি আর জেনিফার অনেক কষ্টে তাকে খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।ব্যালকনির চেয়ারে উদাস অদিতি ফেলে আসা অতীত ঘাটতে ব্যস্ত। এমন সময় জেনিফার কফি নিয়ে এসে অদিতির সামনের চেয়ারে বসলো। জেনিফারকে দেখে অদিতি একটু হাসার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব। অদিতি বুঝলো জেনিফার কিছু বলতে চাই।
– কি বলতে চাও জেনি?
– আপু রঙ্গন স্যার……
এটুকু বলে জেনিফার চুপ হয়ে গেলো। অদিতি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল,
– রঙ্গনকে নিয়ে তোমার মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বুঝতে পেরেছি। ঠিকই ভেবেছো রঙ্গন আমার পূর্বপরিচিত।
নেভী ব্লু চেক শার্ট, রিপ ডেনিম ,সাদা স্নিকার্স , এলোমেলো কোকড়া চুল আর কাধে গীটার নিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের মত করে উনিশ বছরের রঙ্গন এসেছিলো সাদামাটা অদিতির জীবনে।
অতীত,
অদিতি তখন ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারে। একদিন ক্লাসে দেরি হওয়ার জন্য এক রকম ভার্সিটির করিডোর দিয়ে ছুটছিলো সে কাঙ্ক্ষিত ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে তখনই শক্তপোক্ত কোন শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে সামনে দাড়ানো ব্যক্তির শার্ট মুঠোয় আকড়ে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে চাইলো অদিতি। কিন্তু বিধিবাম দুজনেই একসাথে আছড়ে পড়লো শক্ত মেঝেতে।কোমরে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হতেই অদিতি বেদনাদায়ক আহাজারি করে উঠলো।সামনে তাকিয়ে দেখলো গভীর দুটি কালো চোখ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
– এই যে ভদ্রলোক হাবার মত না তাকিয়ে নিজে উঠুন আর আমাকেও উঠতে সাহায্য করুন।
ঘোর কাটলো রঙ্গনের। উঠে দাড়িয়ে অদিতিকে হাত ধরে তুললো সে। রঙ্গন সরি বললে অদিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
– আসলে দোষ আমার। আমিই কোন দিকে না তাকিয়ে ক্লাসে দেরি হচ্ছে দেখে দৌড়াচ্ছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই কোমরের ব্যথা নিয়ে আর ক্লাসে যেতেই পারবো না।
কথাগুলো বলে অদিতি একটু খুড়িয়ে সামনে রাখা বেঞ্চে বসে পড়লো। রঙ্গনও অদিতির পাশে ধুপ করে বসে পড়লো। অদিতি রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
– ফার্স্ট ইয়ার?
রঙ্গন মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো। রঙ্গন এবার জানতে চাইলো ,
– আপনাকে দেখেও ফার্স্ট ইয়ার মনে হচ্ছে?
– এক্সকিউজ মি মিস্টার গীটারওয়ালা!
– উহু গীটারওয়ালা না রঙ্গন।
– যাই হোক আমি তোমার সিনিয়র থার্ড ইয়ার।
রঙ্গন বুকে হাত দিয়ে নাটকীয়ভাবে বলল,
– ইসস! মন ভেঙ্গে গেলো।
অদিতি রঙ্গনের ড্রামা দেখে মুচকি হাসলো তারপর বলল,
– সিনিয়রের সাথে ফ্লার্ট করছো? ডাকবো নাকি তোমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইদের?
রঙ্গন বাঁকা হেসে বলল,
– উহু ফ্লার্ট করার জন্য আবার সিনিয়র জুনিয়র মানতে হয় নাকি। আর রাফিয়ান রঙ্গন অনুভূতি প্রকাশের জন্য কোন কিছুর পরোয়া করে না।
অদিতি হতাশ ভাবে মাথা নাড়ালো। তারপর রঙ্গনকে বলল,
– তো মিস্টার রাফিয়ান রঙ্গন আমাকে কি একটু ভার্সিটির গেট পর্যন্ত যেতে সাহায্য করবেন?
রঙ্গন উঠে দাড়িয়ে কুর্নিশ করে হাত বাড়িয়ে বলল,
– জো হুকুম মিস চড়ুই।
অদিতি রঙ্গনের হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে বলল,
– মিস অদিতি।
রঙ্গন অদিতিকে ধরে হাটতে হাটতে বলল,
– সাইজ দেখেছেন নিজের চড়ুই পাখির মত।
– ভালো ব্যবহার করছি তো তাই বুঝতে পারছো না ভার্সিটির সিনিয়র কেমন হয়?
– তার জন্য থাংকিউ মিস সিনিয়র।
কথা কা’টাকাটি করতে করতে একজোড়া মানব মানবী ভার্সিটির লম্বা করিডোর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা কেউই সেদিন বুঝতে পারেনি এটা একটা অসমাপ্ত গল্পের সূচনা ছিল।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। অদিতির সাথে রঙ্গনের প্রায়শ ভার্সিটিতে দেখা হতে লাগলো। রঙ্গন বিভিন্নভাবে অদিতিকে তার অনুভূতির কথা বুঝাতো কিন্তু অদিতি রঙ্গনের দুষ্টুমি ভেবে উড়িয়ে দিতো। কিন্তু একদিন যখন ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় রঙ্গন অদিতিকে জানালো সে সত্যিই অদিতিকে ভালোবাসে অদিতি এক বাক্যে রঙ্গনকে সম্ভব নয় জানিয়েছিলো। কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলো অদিতি রঙ্গনের দুই বছরের বড়। সমাজের মানুষ কি বলবে? এমনিতেই ক্যাম্পাসের অনেকেই কানাঘুষা শুরু করেছে যে অদিতি জুনিয়র বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে। অদিতির না বলা এবং সমাজের মানুষের অজুহাত দেখানোতে রঙ্গন হেসে বলেছিলো ‘সমাজের মানুষ আপনাকে ভালোবাসবে না আর আপনিও তাদের সাথে সারাজীবন থাকতে যাবেন না। আপনি যাই করুন সমাজ আপনার দিকে কোন না কোন ভাবে আঙ্গুল তুলবে তাই সমাজের কথা না ভেবে নিজের ভালো থাকাটা নিয়ে ভাবুন। আমি তো হাল ছাড়ছি না মিস চড়ুই।’
এরপরের বেশ কিছুদিন কেটে গেলো অদিতি আর রঙ্গনের বাকবিতন্ডায়।তারপর একদিন ভার্সিটির এক সিনিয়র ভাই অদিতিকে প্রপোজ করে বসলো অদিতি প্রস্তাব নাকোচ করলেও সেই খবর গিয়ে পৌছালো রঙ্গনের কানে।
অদিতি তখন লাইব্রেরিতে এসাইমেন্টে ব্যস্ত ছিলো হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে অদিতির এক বান্ধবী এলো। হাপাতে হাপাতে জানালো রঙ্গন নাকি সেই সিনিয়র ভাইকে বেধড়ক মা’রধর করছে। অদিতি ছুটে গেলো ক্যাম্পাসের মাঠে। হাত ধরে টানতে টানতে ভার্সিটির মেডিকেলে নিয়ে এলো রঙ্গনকে। অদিতি বুঝলো দিন দিন রঙ্গন বেপিরোয়া হয়ে উঠছে তাকে থামানো উচিত।রঙ্গনের কপালের কে’টে যাওয়া অংশে ব্যাণ্ডএইড লাগাতে লাগাতে বলল,
– অযথা এরকম পাগলামি করে লাভ নেই রঙ্গন।
রঙ্গন খেয়াল করলো অদিতি তার সাথে রাগারাগি করছে না তবে খুব শীতলভাবে কথা বলছে।
– আমি তোমাকে বার বার বলেছি তোমার সাথে আমার কোন কিছু সম্ভব নয়। আজ শেষবার বলছি এসব পাগলামি বাদ দাও। তুমি এখন আবেগে আছো কিছুদিন পরে আবেগ কেটে যাবে।
– এটা আমার আবেগ নয় মিস চড়ুই এটা আমার অনুভূতি।
অদিতি তখন রঙ্গনের আঙ্গুলের র’ক্ত পরিষ্কার করছিলো। রঙ্গনের কথা শুনে অদিতি ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
– তাহলে বলবো ভালোবাসা জোর করে হয়না।যদি ভালোবেসে থাকো তাহলে সেই ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়ে হলেও এরকম পাগলামি বন্ধ করো। আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসিনি আর বাসবোও না।
কথাগুলো বলে অদিতি চলে যেতে নিলে রঙ্গন তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়।
– ভালোবাসেন কি না জানি না তবে আমার প্রতি কোন না কোন অনুভূতি তো আপনার আছেই। সমাজের মানুষের কথার ভয়ে আর বাকা চোখে তাকানোর ভয়ে সেই অনুভূতি আপনি চেপে রেখেছেন। কিন্তু আমি আর আপনাকে জোর করবো না আপনার সামনেও আসবো না। দিলাম ভালোবাসার সম্মান।কিন্তু “আজ আমি আপনার কথা মেনে চলে যাচ্ছি মিস চড়ুই। আপনার ত্রিসীমায় আর আমাকে দেখতে পাবেন না কিন্তু যদি নিয়তি দ্বিতীয়বার আমাকে আপনার সামনে দাড় করায় সেদিন আমি আর কোন কিছুর পরোয়া করবো না। হয় সবকিছু জ্বালিয়ে দেব নয়তো নিজে জ্বলবো।”
রঙ্গনের কথার বিপরীতে অদিতি আর কিছুই বলেনি নিঃশব্দে চলে এসেছিলো। সেটাই ছিল অদিতির সাথে রঙ্গনের শেষবার দেখা। এরপর আর কখনো রঙ্গনকে ভার্সিটিতে দেখেনি অদিতি।
পরদিন থেকে অদিতির অবচেতন মন ভার্সিটির আনাচে কানাচে রঙ্গনকে খুজতো কিন্তু তাকে আর দেখতে পায়নি সে। পড়ন্ত দুপুরে লাইব্রেরির কোনার বেঞ্চে বসে অদূরে দাড়িয়ে থাকা শিমুল গাছের নিচের ওই বসার জায়গায় অদিতির চোখ চলে যেতো কিন্তু গীটারে সুর তুলতে থাকা রঙ্গনকে দেখতে পেতো না সে। কিংবা ক্যান্টিনে খেতে বসে হঠাৎ করে এলোমেলো কোকড়া চুলের কোন পাগল প্রেমিক এসে আর তার পাশে বসতো না। কোথায় যেনো একটা শূণ্যতা অনুভব করতে লাগলো অদিতি। তারপর একদিন নিজেকেই শাসালো অদিতি যা হয়েছে ভালো হয়েছে মরীচিকার পিছে না ঘুরে রঙ্গন ভালো থাকুক। এরপর কেটে গেলো অনেকগুলো গ্রীষ্মের উদাস দুপুর ,বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা আর বিবর্ণ শীত। ক্যালেণ্ডারের পাতা বদলে গেলো। অদিতির জীবনের নতুন মোড় এলো ভুলে গেলো বুঝি রঙ্গনকে নাকি ভবিতব্য মেনে নিয়ে খুব যত্নে চাপা দিয়ে রাখলো অব্যক্ত অনুভূতি। এরপর জীবনের উত্থান পতনে অদিতি বুঝি সত্যিই ভুলে গেছিলো রঙ্গনকে। বহুবছর পরে অদিতি দেখলো সেই রঙ্গন এখন মিউজিক দুনিয়ার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অদিতি তখন জীবনের খেলাঘরে প্রতারণার ঘা শুকিয়ে নতুন করে ঘুরে দাড়াতে ব্যস্ত।দূরদর্শনের ঝলমলে আলোয় হাসোজ্জল রঙ্গনকে দেখে অদিতি ভাবলো যাক ছেলেটা তাহলে সুখী মানুষের কাতারেই আছে।
এতক্ষণ জেনিফারকে অতীতের গল্প শোনাতে শোনাতে অদিতি নিজেও যেনো ডুবে গেছিলো অতীতে।জেনিফার একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অদিতির দিকে ফিরে চাইলো দেখলো অদিতি তখন উদাস হয়ে বারান্দার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের শূণ্যতায় দৃষ্টি মেলে আছে। জেনিফার একটু সাহস নিয়েই বলল,
– আপু রঙ্গন স্যার কিন্তু অতীতেও আপনাকে ভালোবাসতো এখনো বাসে। মাঝখানের এই বিশাল সময়টাতে সেই ভালোবাসায় কিন্তু বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা দেয়নি।
অদিতি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল,
– আমি আহিনাকে নিয়ে ভালো আছি জীবনে দ্বিতীয় বার আর কারো বন্ধনে নিজেকে বাধতে চাই না।
– আহিনা যে কতটা বাবার ভালোবাসার কাঙ্গাল সেটা আপনি খুব ভালো জানেন আর এই পৃথিবীতে রঙ্গন স্যারের মত কেউ আহিনাকে পিতৃস্নেহ দিতে পারবে না আমি হলফ করে বলতে পারি। আর একসময়ে আপনি যে কারণ দেখিয়ে রঙ্গন স্যারকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেটা নিছকই ছেলেমানুষি মনে হচ্ছে আমার। সামাজিক বাধ্য বাধকতার উর্ধ্বে হচ্ছে নিজের অনুভূতি নিজের ভালোথাকা। দিনশেষে শুধুমাত্র আপনার ভালোবাসার মানুষগুলোই আপনাকে আগলে রাখবে আপনার চারপাশে বাকা চোখে তাকানো মানুষগুলো নয়। রিফাত সাহেবের কাছে শুনেছিলাম কোন এক নারীর জন্য রঙ্গন স্যার নাকি রাতের পর রাত গীটারে সুর তুলে আহাজারি করেছে এতগুলো বছর তখন বুঝিনি আপনিই সেই নারী। যে মানুষটা আপনাকে পাবে না জেনেও নিঃশ্বার্থ ভালোবেসে গেছে নিজের মধ্যে দিনের পর দিন গুমড়ে মরেছে এমনকি অন্য কোন নারীকে নিজের জীবনে স্থান দেয়নি সে কি ভালোবাসার এই রঙ্গমঞ্চে একটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নয়।
কথাগুলো বলে জেনিফার একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে আহিনার ঘরের দিকে চলে গেলো।অদিতি আবার উদাস হলো। কেন জীবন সমান্তরালে চলে না।
সেইরাতে আহিনার তুখোড় জ্বর এলো।পারতপক্ষে আহিনা খুবই নাজুক প্রকৃতির একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে আর এবারে তার দুঃখ তো বিশাল। রঙ্গন আংকেল তাকে না বলে তখন চলে গেলো তার আবদার রাখলো না তাহলে কি সে বাবাই পাবে না। এসব নিয়ে কান্নাকাটির ফল এই মা’রাত্মক জ্বর।ডাক্তার এসে জানিয়েছে কোন সমস্যা নাই ইমোশনাল ব্রেকডাউনের জন্য এরকমটা হয়েছে। মেডিসিন দেয়ার পরেও যখন জ্বরে কাতর আহিনা ঘোরের মধ্যেও রঙ্গনকে তার বাবাই হতে আবদার করছে তখন জেনিফারের কথায় অদিতি বাধ্য হলো রঙ্গনকে ফোন করতে।
……………চলবে?
বিঃদ্রঃ সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।