#অদিতির_যবনিকা -১০
#তিশা
রঙ্গন আর আহিনা পার্কে খেলছে।রিফাত আর জেনিফার বেঞ্চে বসে আছে। জেনিফার ফোনে ব্যস্ত আর রিফাত রঙ্গন আর আহিনাকে দেখছে।
– কোনদিন বুঝিই নি রঙ্গন ভাই এরকম ফ্যামিলি পার্সন?
রিফাতের কথায় জেনিফার ফোন থেকে মনোযোগ সরিয়ে সামনে তাকালো। হাসিখুশি আহিনা তখন রঙ্গনের সাথে খেলায় মত্ত।জেনিফার একটা প্রশান্তির হাসি দিলো।
– আহি মামনী অবশেষে কাঙ্খিত বাবাই পেলো।
– কিন্তু অদিতি ম্যাম কি চাইছে বুঝতে পারছি না তো?
রিফাতের কথায় জেনিফার একটা মুচকি হাসি দিলো।
– আহিনার বাবাই যেহেতু রঙ্গন স্যার হতে পেরেছে ভবিষ্যতে ভালো কিছুই হবে আমার বিশ্বাস। আমার মনে হচ্ছে আপু মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে যাচ্ছে।অতীতে রঙ্গন স্যারকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর সংসার জীবনে বিপর্যয় এবং এতগুলো বছর পরে আবার রঙ্গন স্যারের মুখোমুখি।এই সব কিছু নিয়ে ভাবতে যেয়ে হয়তো তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। আপাতত সবকিছু প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেয়া যাক।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে জেনিফার একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে রিফাতের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল,
– হয়তো আহিনায় পারবে তার বাবাই মাম্মামকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে!
আজ রঙ্গন এসেছে অদিতির অফিসে শুটের জন্য। অদিতির অফিসের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের এরিনা ভেবে রেখেছে যে করেই হোক সে এই সুযোগে রঙ্গনের কাছাকাছি যাবে।রঙ্গন তার বহুদিনের ক্রাশ কিছুতেই এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না সে। রঙ্গন তখন বিজ্ঞাপন নির্দেশকের সাথে কথা বলে ড্রেসিং রুমে বসে ছিল। এমন সময় এরিনা নক করলো রঙ্গন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একজন সুন্দরী তনয়া দাড়িয়ে। গম্ভীরমুখে রঙ্গন বলল,
– পরে আসুন আমি এখন একা আছি।
এরিনা একটু অস্বস্তি বোধ করলো তারপরও হাসিমুখে বলল,
– আমি আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছি।
– আমার সাথে কথা বলতে আসলেও পরেই আসুন।
এরিনা মন খারাপ করে চলে যেতে নিলে সেসময়ে রিফাত ঢুকলো সাথে একজন স্টাইলিশ।
– এই যে মিস আপনি এবার আসতে পারেন ভিতরে।
রঙ্গনের কথায় এরিনা ঢুকে বলল,
– আমি আপনার সাথে শুধু কথা বলতেই এসেছিলাম। আমি আপনার অনেক পুরনো ফ্যান।
– এখানে আমি কাজের জন্য এসেছি আর সেলিব্রিটি হওয়ার সুবাদে সামান্য কিছুতে চরিত্রে দাগ লাগতে পারে অথবা রিউমারস ছড়িয়ে তুলকালাম হয়ে যেতে পারে। তাই নিরিবিলি কক্ষে কোন ভক্তের সাথে আলাপ করাটাও আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
রঙ্গনের গম্ভীর কণ্ঠে এরিনা মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে যেতে ভাবলো রাফিয়ান রঙ্গন আসলেই একটা আইসবার্গ। এতোদিন লোকমুখে ঠিকই শুনে এসেছে সে।
অদিতি তখন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছিল এমন সময়ে দরজার করাঘাতে সেদিকে তাকিয়ে দেখলো হাসিমুখে রঙ্গন দাড়ানো। অদিতির ভ্রু কুচকে এলো। রঙ্গন ভিতরে ঢুকে অদিতির সামনের চেয়ারে বসে পড়লো।
– আমার বেবীর মাম্মামের সাথে দেখা করতে এলাম।
রঙ্গনের ত্যাড়া কথায় অদিতির বিরক্তি যেনো বেড়ে গেলো।
– কি সমস্যা? তোমার কাজ তো এখানে নয়?
– উহু আমার কাজ তো এখানেই। শুনুন মেয়ে যেহেতু বাবাই মাম্মাম দুজনকেই পেয়ে গেছে তাহলে বাবাই মাম্মামেরও উচিত এক হয়ে যাওয়া তাই নয় কি।
কথাগুলো বলে ফিচেল হাসলো রঙ্গন তারপর উঠে দাড়ালো টেবিলে দুই হাত ভর দিয়ে নিচু হয়ে অদিতির বিরক্ত হওয়া মুখে ফু দিলো তারপর চলে গেলো। রঙ্গন চলে যেতেই অদিতি দুইপাশে মাথা নাড়িয়ে ভাবলো ‘এইজন্যই তো এই পাগলকে রিজেক্ট করতে চাইছিলাম। এখন আর কি বাড়ি অফিস দুই জায়গাতেই পাগলামি দেখা লাগবে।’
কেটে গেছে বেশ কিছুদিন রঙ্গন এখন অদিতি আর আহিনার জীবনের অলিখিত সদস্য। আহিনার দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে রঙ্গনের সাথে কিন্তু অদিতি লির্লিপ্ত। প্রয়োজনীয় টুকটাক কথাবার্তা রঙ্গনের সাথে তার হয়। আর রঙ্গনও অদিতির সাথে ফ্লার্ট করার একটা সুযোগও হাতছাড়া করে না। অদিতির মধ্যে কি চলছে সেটা রঙ্গন এখনো বুঝে উঠতে পারছে না।
ডিনার টেবিলে খেতে বসেছে রুহি আর আরাফ।রুহি সেদিন রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে মাহমুদ সাহেবের সব কথায় শুনেছে তারপর থেকে থমথমে হয়ে আছে সে।আরাফের সাথেও ঠিকভাবে কথা বলছে না।আজ নীরাবতা ভেঙে আরাফ জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়ছে তোমার? কথাবার্তা কম বলছো?
– কিছু না।
আরাফের দিকে না তাকিয়েই ছোট করে জবাব দিলো রুহি।
– কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি কথা বলছো না।কেমন চুপচাপ হয়ে আছো?
এবার রুহি খাবারের প্লেট সরিয়ে আরাফের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকালো।
– তোমার আর অদিতির সংসার ভাঙার জন্য আমি দোষী।তোমার বাবা মা সব সময় কেন আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে?
– দোষ তোমার না তো দোষ সব আমার।আর আমার বাবা মা মনে হচ্ছে তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করে আর আমাকে মাথায় তুলে নিয়ে রাখে? আমাকেও তো তারা একপ্রকার তাজ্য করার মত করেই ট্রিট করে।
কথাগুলো বলে আরাফ খাবারের প্লেট ঠেলে সরিয়ে উঠে চলে যায়। যেতে যেতে থেমে যায় আরাফ তারপর পিছন ফিরে বলে,
– ইদানীং কি মনে হয় জানো একদিন নিজের সন্তানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম তাই বোধহয় সৃষ্টিকর্তা আমাকে আর সন্তান দিলেন না।
আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না আরাফ বেরিয়ো গেলো ঘর থেকে। রুহি তখন মানসিক বিপর্যয়ের এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌছালো যে উন্মাদের মত টেবিলের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে লাগলো।
রঙ্গন রাতে বাড়িতে ফিরে রওনক সাহেবকে ড্রয়িংরুমে বসা দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলো।
– এখনো ঘুমাও নি বাবা?
– তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
রঙ্গন রওনক সাহেবের সামনে বসলো।
– আগামী সপ্তাহে আরাফ মাহমুদের সাথে মিটিং ফিক্সড করা হয়েছে।
– ওকে।
রওনক সাহেব চিন্তিত সুরে বললেন,
– পারবে তো সামলাতে?
রঙ্গন উঠে দাড়িয়ে মৃদু হাসলো তারপর বলল,
– আমি সামলাতে না পারলে তুমি আছো তো।
তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।রঙ্গনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলো ‘রঙ্গন কি বুঝে ফেলেছে আমি আরাফের সমস্ত খবরাখবর রাখছি?’
আজ শুটের মাঝে রঙ্গন কিছুক্ষণের জন্য বসেছিল। এমন সময় এরিনা এসে তার পাশে বসে পড়লো। রঙ্গন ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো।
– আজ কিন্তু সবার সামনেই আপনার পাশে বসেছি।আশা করি কোন সমস্যা হবে না।
রঙ্গন কোন কথা বলল না নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।এরিনা নিজেই আবার কথা বলল,
– আপনি কোন সম্পর্কে আছেন আই মিন গার্লফ্রেন্ড?
রঙ্গন শীতল চোখে চাইলো এরিনার দিকে। ওই দৃষ্টিতে এরিনা বুঝি ঘাবড়ালো তারপর আমতা আমতা করে বলল,
– না মানে আপনার অনেক বড় ভক্ত আমি এজন্য একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলেছি।
রঙ্গন কিছু বলতে নিবে তখন দেখল দূর থেকে অদিতি এদিকেই আসছে। অদিতির দিকে তাকিয়ে একটা বাকা হাসি দিয়ে এরিনাকে দুই আঙ্গুলের ইশারায় একটু কাছে আসতে বলল এরিনা কনফিউজড হয়ে মাথাটা রঙ্গনের দিকে আর একটু এগিয়ে নিলো। রঙ্গনও এরিনার দিকে সামান্য এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– সিক্রেট হচ্ছে আমার বউ বাচ্চা সবই আছে।
বলেই রঙ্গন সরে এলো এরিনা অবাক হয়ে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে আছে।কি বলছে এসব রঙ্গন! যাকে কখনো কোন নারীর সঙ্গে দেখা যায়নি যার নামে কোন প্রেম ঘটিত রিউমার নেয় তার নাকি বউ বাচ্চা আছে।
ওদিকে দূর থেকে তার অফিসের একজন মেয়ে কর্মচারীর সাথে রঙ্গনকে হাসিমুখে ফিসফিস করে গল্প করতে দেখে শীতল চোখে চাইলো অদিতি।রঙ্গন এক ভ্রু উচিয়ে ঠোট বাকিয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতি দাম্ভিক পদক্ষেপে এসে রঙ্গন আর এরিনার সামনে দাড়ালো। অদিতিকে দেখে এরিনা দাড়িয়ে গেলো।
– মিস এরিনা যতদূর মনে পড়ছে আপনার এই মুহূর্তে মার্কেটিং টিমের সাথে ফোর্থ ফ্লোরে থাকার কথা? আপনি এখন এখানে কি করছেন?
এরিনা মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
– সরি ম্যাম।
– গো ব্যাক টু ইয়োর ওয়ার্ক।
অদিতির সুক্ষ্ম ধমক খেয়ে এরিনা আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না। এরিনা যেতেই রঙ্গন উঠে দাড়ালো তারপর মাথা একটু নিচু করে অদিতির মুখোমুখি হয়ে বলল,
– আর ইউ জেলাস আহিনার মাম্মাম?
রঙ্গনের মুখে আহিনার মাম্মাম শুনে অদিতির হৃদয় বুঝি স্বাভাবিকের তুলনায় একটু জোরেসোরেই ধ্বক করে উঠলো। অদিতি ভাবলো রঙ্গনও কি তার হৃদপিণ্ডের এই অস্বাভাবিক গতির ছন্দ শুনতে পাচ্ছে! রঙ্গন অদিতির উত্তর না পেয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে দুই ভ্রু নাচালো। অদিতি এবার নিজেকে সামলে নিয়ে খ্যাক করে বলল,
– বয়েই গেছে আমার জেলাস হতে! এদিক ওদিক ফ্যান মিট আপ না করে কাজে মন দাও।
কোনরকমে কথাটা বলে অদিতি চলে গেলো।কিন্তু যেতে যেতে শুনলো রঙ্গনের উচ্ছ্বসিত আওয়াজ,
– আমি জানি আপনি জেলাস!
আহিনা দেয়ালের দিকে মাথা দিয়ে দাড়িয়ে আছে বুকে দুইহাত গুজে। রঙ্গন অনেকক্ষণ ধরে মানানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আহিনা মানতে নারাজ।সে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে কিন্তু রঙ্গন কয়েকদিনের জন্য বাংলাদেশ যাবে এটা শোনার পর থেকে আহিনা গাল ফুলিয়ে আছে।রঙ্গন আর আহিনার মান অভিমানের মধ্যেই অদিতি এলো অফিস থেকে।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জেনিফারের দিকে তাকাতেই সে বিষয়টা খুলে বললো।অদিতি ফোস করে নিঃশাস ছেড়ে সোফায় বসে রঙ্গন আর আহিনার কীর্তিকলাপ দেখছে। এক পর্যায়ে রঙ্গন হতাশ হয়ে অদিতির দিকে অনেক আশা নিয়ে বলল,
– মিস চড়ুই প্লিজ হেল্প!
অদিতি একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার বেবী তুমি সামলাও।
রঙ্গন খুবই অসহায় বোধ করলো বুঝি। রঙ্গনের অসহায়ত্ব দেখে অদিতির মন বুঝি গললো।মিষ্টি করে আহিনাকে ডাকলো।
– বেবী মাম্মামের কাছে আসো তো দেখি।
আহিনা ফুলো ফুলো গাল নিয়েই অদিতির সামনে দাড়ালো। অদিতি আহিনাকে কোলে তুলে নিলো। আদুরে স্বরে বলল,
– বাবাই তো বলছে ফিরে এসে তোমাকে তিনদিন ঘুরতে নিয়ে যাবে তাহলে এখনো রাগ কিসের?
– তাহলে প্রমিস করো তুমি আর বাবাই একসাথে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে?
আহিনার কথায় অদিতি রঙ্গনের দিকে তাকালো। রঙ্গন অসহায় ভাবে ইশারায় বোঝালো প্লিজ। অদিতি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আহিনাকে সম্মতি জানালো। আহিনা সোফার উপরে লাফিয়ে হাত তালি দিতে দিতে বলল,
– কি মজা আমিও বন্ধুদের মত বাবাই আর মাম্মামকে নিয়ে একসাথে ঘুরতে যাবো।
অদিতির চেহারায় হতাশা ফুটে উঠলো কিন্তু কিছু বলল না উঠে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। যেতে যেতে মনে মনে ভাবলো ‘যতো দূরে দূরে থাকতে চাই পরিস্থিতি ততো কাছাকাছি নিয়ে আসে।’
অদিতি চলে যেতেই আহিনা লাফিয়ে রঙ্গনের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো তারপর রঙ্গনকে শোনাতে লাগলো সে ফিরে এলে কি কি করবে।
রাতে রঙ্গন তার স্টুডিওতে নতুন গানের প্র্যাকটিস করছিলো তখন রওনক সাহেব এলেন।তাকে দেখে রঙ্গন গীটার নামিয়ে রাখলো। রওনক সাহেব বেশ কিছুক্ষণ তাকে ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য দিলেন এবং তাকে হেল্প করার জন্য কে কে থাকবে বাংলাদেশে সবিস্তরে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর যখন চলে যাবেন তখন ঘাড় ঘুরিয়ে রঙ্গনকে বললেন,
– আহিনার সাথে তার দাদুর পরিচয় করাবে না?
রঙ্গন মৃদু হেসে জবাব দিলো ফিরে এসে একদিন নিয়ে আসবো বাড়িতে। রওনক সাহেব মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন তিনি নিজে এবার অদিতির সাথে কথা বলবেন।
নোট: জ্বর ,সর্দি ,কাশি নিয়ে লিখেছি হয়তো কোথাও কোথাও বাক্যের ছন্দপতন অথবা শব্দ বিভ্রাট হতে পারে তার জন্য দুঃখিত।
…………..চলবে?
বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।