#অদিতির_যবনিকা -১৩
#তিশা
অনেক বুঝিয়ে অদিতি আহিনাকে তার কেবিনে নিয়ে এসেছে।ঘন্টাখানেক পরে রঙ্গন শ্যুট শেষ করে অদিতির কেবিনে ঢুকে দেখে অদিতি সেখানে নেই আহিনা সোফায় বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে।রঙ্গনকে দেখে আহিনা উৎফুল্ল ভাবে হাত নাড়িয়ে ডাকলো। রঙ্গন আহিনার পাশে বসে টেবিলের উপর থেকে একটা টিস্যু নিয়ে আহিনার ঠোটের আশেপাশে লেগে থাকা সস মুছিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো ,
– বেবী মাম্মাম কোথায়?
– মাম্মাম একটা আংকেলের সাথে বাইরে গেছে।
এমন সময় অদিতি ঢুকলো সাথে বছর ত্রিশের এক সুপুরুষ। রঙ্গন ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।
অদিতির সাথের ভদ্রলোক তার নতুন প্রজেক্টের পার্টনার জেমস।জেমস সোফায় বসা রঙ্গন আর আহিনাকে দেখে অদিতির দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে অদিতি ছোট করে জবাব দেয় ‘ফ্যামিলি।’ এরপর মিনিট বিশেক জেমস আর অদিতি প্রজেক্ট বিষয়ক কথাবার্তা বলার পরে জেমস বেরিয়ে যায়। রঙ্গন এতক্ষণ আহিনার সাথে ব্যস্ত থাকলেও তার পুরো মনোযোগ ছিল অদিতি আর জেমসের দিকে।জেমস চলে যেতেই রঙ্গন অদিতির সামনের চেয়ারে বসলো।
– আহিনার মাম্মাম এই লোক আপনার উপরে লাইন মারতেছে।
অদিতি ভ্রু কুচকে রঙ্গনের দিকে তাকালো।রঙ্গন একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
– নেক্সট টাইম আমার বেবীর মাম্মামের সাথে ফ্লার্ট করলে আমি কিন্তু ওই লোকের ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরায় দিবো।
অদিতি বিরক্ত হয়ে বলল,
– আশ্চর্য রঙ্গন এখন তো অনেক বড় হয়ছো এখনো আগের মতো পজেসিভনেস আর মা’রামারি করা স্বভাব যায়নি তোমার?
রঙ্গন বাকা হেসে বলল,
– পৃথিবীতে সবকিছু বদলে যাবে কিন্তু রঙ্গনের আপনার প্রতি ভালোবাসার ধরন কখনো বদলাবে না।
অদিতির বুঝি রঙ্গনের এমন গভীর কথায় টালমাটাল লাগলো নিজেকে। নির্নিমেষ চাইলো রঙ্গনের কৃষ্ণ কালো সেই গভীর নেত্রে।
– তোমরা প্রমিস ভুলে গেছো?
আহিনার কথায় বুঝি দুজনের ভাবনার সুতো কেটে গেলো। তাকিয়ে দেখলো আহিনা কোমরে হাত দিয়ে রাগী মুখে তাকিয়ে আছে।
– কি প্রমিস ভুলে গেছি বেবী?
রঙ্গন কনফিউজড হয়ে জানতে চাইলো। আহিনা গাল ফুলিয়ে বলল,
– বাবাই যাওয়ার আগে প্রমিস করেছিলে আমাকে তোমরা দুজন একসাথে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।
– যাবো তো বেবী।এই রবিবারেই আমরা ঘুরতে যাবো।
অদিতির দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে রঙ্গন বলল।অদিতি চোখ পাকিয়ে তাকালো রঙ্গনের দিকে।রঙ্গন অদিতির দিকে ঝুকে হাস্কি স্বরে বলল,
– It will be our first date Ahinar Mummum!
কথাটা বলে রঙ্গন আর এক মুহূর্ত দাড়ালো না আহিনাকে কাধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অদিতি বিস্মিত নজরে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। আর বুঝি অনুভূতির লাগাম টানা সম্ভব হবে না ভেবে অদিতি টেবিলের উপরে রাখা দুইহাতের উপরে মাথা এলিয়ে দিলো।
অদিতি ঘন্টাখানেক পরে রঙ্গন আর আহিনাকে খুজতে বের হলো। ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে দেখলো রঙ্গন বিজ্ঞাপন নির্দেশক আর ক্রিয়েটিভ টিমের প্রধানের সাথে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে কাজ সম্পর্কিত কোন বিষয়। অদিতি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো অদূরেই সোফায় বসা আহিনা হাতে রঙ্গনের ফোন। অদিতি আহিনার কাছে যেতে নিলে দেখলো এরিনা এসে আহিনার পাশে বসেছে।অদিতি ঈগলের ন্যায় তিক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকালো তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো।
আহিনা তখন রঙ্গনের ফোনে টকিং অ্যাঞ্জেলা খেলতে ব্যস্ত।হঠাৎ এরিনাকে পাশে বসতে দেখে আহিনা রাগী মুখে তার দিকে তাকালো। আহিনা এখনো মনে রেখেছে এরিনা বলেছিলো রঙ্গন তার বাবাই নয়।এরিনা একটা হাসি দিয়ে বলল,
– বেবী তোমার বাবাইয়ের নাম কি?
– রাফিয়ান রঙ্গন।
এরিনার মুখটা থমথমে হয়ে এলো আহিনার সহজ সরল জবাবে তারপরও পুনরায় কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই অদিতি এসে আহিনার অপর পাশে বসে পড়লো। অদিতিকে হঠাৎ এসে বসতে দেখে এরিনা ভয় পেলো। অদিতি এরিনার দিকে তাকিয়ে একটা শান্ত হাসি দিয়ে বলল,
– মিস এরিনা এখন তো লাঞ্চ টাইম যান লাঞ্চ করে আসুন।
এরিনা অদিতির হঠাৎ শান্ত ব্যবহার ধরতে পারলো না তবে কোন বাক্যব্যয় না করে চলে গেলো সে। এমন সময় রঙ্গনও এলো। রঙ্গনের উপর অকারণেই অদিতির মেজাজ খারাপ হলো কেন জানি। রঙ্গন আসতেই অদিতি উঠে দাড়ালো ঝাঝালো কণ্ঠে আহিনাকে বলল,
– আহি তোমার বাবাইকে নিয়ে লাঞ্চ করতে আসো আমার কেবিনে। ফ্যানদের ভালোবাসায় তো আর পেট ভরবে না।
কথাটা বলে অদিতি হনহন করে চলে গেলো। রঙ্গন বেকুবের মত কিছুক্ষণ অদিতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে আহিনাকে জিজ্ঞেস করলো ,
– বেবী আমি কি কিছু ভুল করেছি?
আহিনা ইনোসেন্ট ভাবে বলল,
– মাম্মামের বোধহয় খিদে পেয়েছে বাবাই।
রঙ্গন আর আহিনা দরজা দিয়ে অল্প একটু মাথা ঢুকিয়ে দেখলো অদিতি খাবার সাজিয়ে থমথমে মুখে সোফায় বসে আছে। রঙ্গন আর আহিনা একে অন্যের মুখের দিকে দুঃখী ভাবে তাকালো। তারপর ফিক করে হাসলো। তারপর….
“আজ তুমি আমি ভাবছি ঘুরেফিরে
শঙ্খচিলের বাসা বড়ো দূরে
আজ তুমি আমি ভাবছি ঘুরেফিরে
শঙ্খচিলের বাসা বড়ো দূরে…
এতটুকু গেয়ে রঙ্গন আহিনাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। অদিতি ভ্রু কুচকে তাকালো সেদিকে। রঙ্গন আহিনার হাত ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে আবার গাইলো….
আমি সোনার কাঠির ঠিকানা কী জানি
আমি সোনার কাঠির ঠিকানা কী জানি
তোমার আঙুল ছুঁতেই হঠাৎ শিরশিরানি….
এতটুকু গেয়ে রঙ্গন আহিনাকে সোফায় উঠিয়ে দিয়ে হুট করে অদিতির হাত ধরে উঠিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে অদিতির ডান হাত নিজের বাম কাধে দিয়ে বাম হাত নিজের ডান হাতের মধ্যে মুঠোবন্দি করলো আর বাম হাত অদিতির কোমরে রেখে কাপল ডান্স করতে করতে গাইলো….
আমার কাব্যে তবু মিশে পলাতকের সুর
আমি তোমার সাথে ছুটেছি অচিনপুর
আমার কাব্যে তবু মিশে পলাতকের সুর
আমি তোমার সাথে ছুটেছি অচিনপুর
ফেলে বাস্তবেরই অগোছালো ব্যথা
ফেলে বাস্তবেরই অগোছালো ব্যথা
জেনো, ভালোবাসা নিজেই রূপকথা
অদিতি তখন নির্বাক হয়ে রঙ্গনের পাগলামি দেখছে কি হচ্ছে মস্তিষ্ক ঠিক ধরতে পারছে না। অপরদিকে আহিনা সোফার উপরে লাফিয়ে হাততালি দিয়ে তার বাবাই মাম্মামকে চিয়ার করতে ব্যস্ত।রঙ্গন এবার বাধন আলগা করে অদিতির এক হাত ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে গেয়ে উঠলো…
আমি শীতের দুপুরে খুঁজেছি অলীক ডানা
তুমি টাঙিয়ে রেখো রোদের শামিয়ানা
আর পর্ণমোচী দুঃখগুলো ডালে ডালে
আজ কাঁপছে ঝরে পড়ার তালে তালে।।
তুমি নতুন জরির সুতোয় আমায় বাঁধো
জানি নদীর জলে আয়না ভেবে ভেবে কাঁদো
আমিও আগলে নেবোই চোখের জলের ভাগ
আমিও আগলে নেবোই চোখের জলের ভাগ
তোমার হাতের মুঠোয় স্পর্শকাতর দাগ
(তালপাতার সেপাই)
গান শেষে ঘুরতে ঘুরতে অদিতি রঙ্গনের বুকে এসে পড়লো। আখিতে আখি মিললো দুজনের। অদিতি বোধহয় প্রথমবার লাজুক হলো।চিবুক হালকা রক্তিম বর্ণধারণ করলো সেটা লুকাতেই হালকা করে রঙ্গনকে ধাক্কা দিয়ে সরে এলো। রঙ্গন বোধহয় সেই রক্তিম চিবুকের প্রত্যক্ষদর্শী হলো। ঠোটে দেখা দিলো প্রশান্তির হাসি। তবে কি জীবনে বসন্ত আসতে চলেছে!
লাঞ্চের পুরোটা সময় অদিতি ছিল নিশ্চুপ। লজ্জা বা অস্বস্তি যে কারণেই হোক না কেন অদিতি তেমন কথা বলেনি আর। আহিনা আর রঙ্গনই অবিরাম আলাপ জুড়ে গেছে পুরোটা সময়।রঙ্গনের সান্নিধ্যে আহিনা যেনো আরো বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছে।অদিতি অবাক হয় রঙ্গনের সহ্য ক্ষমতা দেখে এই যে আহিনাকে রঙ্গন খায়িয়ে দিচ্ছে আর আহিনা একবার রঙ্গনের কোলে বসছে আবার নামছে একবার গলা জড়িয়ে ধরছে আবার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছুই অদিতি সুক্ষ্ম নজরে দেখছে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও রঙ্গনের চেহারার বিন্দুমাত্র বিরক্তি ফুটে ওঠেনি। অদিতি বিস্মিত হয় এত ধৈর্য্য তো অদিতির নিজেরও নেয়।
লাঞ্চের পরে অদিতির মিটিং আছে রঙ্গনের আপাতত এখানে কোন কাজ নেয়।সে অদিতিকে জানালো,
– আমি আহিনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।
অদিতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
– বাবা আহিনার সাথে দেখা করতে চায়।
অদিতি কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– হঠাৎ আহিনার সাথে দেখা করতে চান?
রঙ্গন নির্বিকার ভাবে বলল,
– তার মনে হয় সবার সাথেই একান্তে সাক্ষাৎ করতে মন চেয়েছে তাইতো হবু পুত্রবধূর পরে এবার নাতনীর সাথে দেখা করতে চাইছে।
– একটু বেশিই কনফিডেন্সে দেখিয়ে ফেলছো না?
রঙ্গন একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
– উহু আমি তো জাস্ট আপনাকে সব হজম করার জন্য একটু সময় দিচ্ছি নাহলে এতদিন বিয়ে করে নিতাম।
– অসভ্য!!
অদিতির মুখে অসভ্য শুনে রঙ্গন খিলখিলিয়ে হাসলো।
– বহুদিন পরে আপনার মুখে অসভ্য শুনলাম মনটা ভাল্লাগছে।
এরপর রঙ্গন অদিতির মাথা থেকে ক্লাচারটা এক টানে খুলে নিলো। সাথে সাথে অদিতির রেশম কোমল কেশগুচ্ছ ঝরঝর করে পিঠ ছাড়িয়ে কোমরে ছড়িয়ে পড়লো।অদিতি বিরক্ত হয়ে রঙ্গনকে কিছু বলবে তার আগেই রঙ্গন বেরিয়ে গেলো।
অদিতির কেবিন থেকে বেরিয়েই রঙ্গন বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আহিনাকে খুজতে লাগলো। দেখলো আহিনা জেনিফার আর রিফাতের সাথে খেলছে। রঙ্গন সেদিকে এগিয়ে গেলো।
– বেবী চলো আমরা আজ একটা স্পেশাল জায়গায় ঘুরতে যাবো।
আহিনা খুশি হয়ে রঙ্গনের হাত ধরে ঝুলে পড়লো।
গাড়িতে আহিনা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। রঙ্গনও উত্তর দিচ্ছে।
– আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবাই?
– তোমার দাদুর সাথে দেখা করতে।
আহিনা কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– দাদু?
– আমি যেমন তোমার বাবাই সেরকম দাদু হচ্ছে আমার বাবাই।
আহিনার চোখ এবার খুশিতে চকচক করে উঠলো।
– তোমার বাবাই?
রঙ্গন মাথা নাড়ালো।
– তুমি যেমন আমাকে আদর করো তোমার বাবাইও তোমাকে আদর করে?
রঙ্গন আহিনার নাক টেনে বলল,
– হ্যা অনেক আদর করে।
রঙ্গন আহিনাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। মিটিং শেষে কেবিনে ঢুকতেই মেরী এলো কিছু ফাইল নিয়ে। অদিতি ফাইলগুলো সাইন করে মেরীকে বলল,
– মিস এরিনাকে পাঠিয়ে দেবেন তো।
মেরী মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে ভাবলো এরিনাকে বার বার বললাম বেশি বাড়াবাড়ি করো না এখন মনে হচ্ছে মেয়েটার কপালে দুঃখ আছে।
…………..চলবে?
#অদিতির_যবনিকা -১৪
#তিশা
অদিতির সামনে ভীতু মুখে দাড়িয়ে আছে এরিনা। অদিতি একটা শান্ত হাসি দিয়ে ব্রাউন রঙের একটা খাম এগিয়ে দিলো। এরিনা কনফিউজড হয়ে খামটা হাতে নিলো।খুলে দেখলো একটা চেক। এরিনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকাতেই পুনরায় আর একটা খাম এগিয়ে দিলো। এরিনা এবারের খামটা খুলে চমকে অদিতির দিকে তাকালো। অদিতি শান্তস্বরে বলল,
– অফিসে আনঅফিশিয়াল ব্যবহারের জন্য এবং কাজের সময়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি করার জন্য আপনাকে ফায়ার করা হলো। এবং আপনাকে দুই মাসের স্যালারিও কোম্পানি দিয়ে দিয়েছে আশা করি আপনার আর কোন প্রশ্ন নেই?
এরিনা বুঝি খেপে গেলো একটু।
– ম্যাম অফিসে আপনিও তো আনঅফিশিয়াল ব্যবহার করেন আপনি অফিসে বাচ্চাকে নিয়ে আসেন তাকে সময় দেন এগুলো কি।
অদিতি এবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো একটা।
– আমার অফিসে যেসকল কর্মচারীর ছোট বাচ্চা আছে তারা যেনো বাচ্চা নিয়ে ভালোভাবে কাজ করতে পারে এজন্য আমি বাচ্চাদের জন্য আলাদা একটা কিডস সেকশনই রেখেছি এমনকি কাজের ফাকে ফাকে তারা যেনো বাচ্চাদের দেখে আসতে পারে সেই সুবিধাও দিয়েছি আর আপনি আমাকে রুলস শেখাচ্ছেন?
এরিনা একটু দমে গেলো তারপরও রূঢ়ভাবে বলল ,
– তারপরও আপনি আমাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে ফায়ার করছেন। আমি আপনার বিরুদ্ধে লিগ্যাল একশন নিবো।
অদিতি হেসে ফেললো।
– প্লিজ প্রসিড।তবে দেইখেন অন্য কোম্পানিতে আর ঢুকতে পারেন কি না। আমি আপনাকে ব্যান করলে আপনি অন্য কোন কোম্পানিতে জয়েন করতে পারবেন তো। এতদিন এই অফিসে আছেন এতটুকু ক্ষমতা যে আমি রাখি সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়।
এরিনা এবার সত্যিই দমে গেলো।ব্যবসায়িক অঙ্গনে অদিতি বেশ ক্ষমতাশালী সেটা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই তাই চুপচাপ বেরিয়ে এলো। এরিনা বেরিয়ে যেতেই অদিতি চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে হতাশ হয়ে বলল,
– রাফিয়ান রঙ্গন তোমার জন্য ভবিষ্যতে আরো কত কত এরকম মানুষের সাথে যে ডিল করতে হবে!
রওনক সাহেব তখন ড্রয়িংরুমে বসে বই পড়ছিলেন।দরজার দিকে নজর দিতেই দেখলেন রঙ্গন আহিনার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। মুহুর্তেই উনার চেহারায় চমক দেখা দিলো। উঠে দাড়িয়ে বললেন,
– আরে আমার বাড়িতে আজ চাঁদ এসেছে।
আহিনা তখন ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে। রঙ্গন আহিনাকে বলল,
– বেবী উনিই তোমার দাদু।
রওনক সাহেব এগিয়ে এসে আহিনাকে কোলে তুলে নিলেন। আহিনা উনার গালে হাত দিয়ে বলল,
– তোমাকে আমি চিনি। মাম্মামের অফিসে দেখেছি।
রওনক সাহেব আড় চোখে রঙ্গনের দিকে তাকালেন। ছেলে বুঝি জানতে পেরে গেলো তিনি অদিতির সাথে দেখা করেছেন! কিন্তু রঙ্গনের সেরকম কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।
সেদিন সন্ধ্যায় আহিনা আর রওনক সাহেবের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন হলো বুঝি।আহিনার সাথে তার বাবার প্রথম দেখাতেই এরকম সখ্যতা হবে রঙ্গন বুঝতেও পারেনি। দোতলার বারান্দায় দাড়িয়ে বাগানে ছুটোছুটি করা আহিনা আর রওনক সাহেবকে দেখতে দেখতে রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
– এখন শুধু আপনি রাজি হয়ে যান মিস চড়ুই তাহলেই সম্পর্কগুলো পূর্ণতা পাবে।
সেদিন রাতে রওনক সাহেবের সাথে দেখা করে আসার পর আহিনা অদিতির সাথে উচ্ছ্বসিত হয়ে তার দাদুর গল্প করলো পুরোটা সময়।দাদুর সাথে কি গল্প করেছে কি কি খেলা খেললো এসব খুব উৎসাহ নিয়ে আহিনা তার মাম্মামকে শোনালো।অদিতিও মনোযোগ দিয়ে আহিনার গল্প শুনলো।
রাতে আহিনাকে ঘুম পাড়িয়ে অদিতি তখন কেবলই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। এই সময়ে কে ফোন করতে পারে ভাবতে ভাবতে অদিতি বেড সাইড টেবিল থেকে ফোন নিয়ে রঙ্গনের নাম্বার দেখে ললাটে ভাজ পড়লো তার।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রঙ্গনের হতাশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
– আহিনার মাম্মাম!
রঙ্গন যতবার এই নামে অদিতিকে ডাকে ততোবার যেনো তার হৃদপিণ্ডের গতি উল্টে পাল্টে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে অদিতি বলল,
– এত রাতে ফোন দিলে কেন?কোন সমস্যা?
– অনেক সমস্যা। আমার ঘুম আসছে না চলুন না হাটতে বের হই!
– তুমি কি উল্টাপাল্টা কিছু খাইছো রঙ্গন?
অদিতির এমন কথায় রঙ্গন উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
– আহিনার মাম্মামের বিরহে নিকোটিনের নেশা হয়েছিলো আহিনার সান্নিধ্যে এসে এখন সেটাও বিলুপ্তির পথে।
অদিতি জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– তাহলে মাঝরাতে এরকম পাগলামি করছো কেন?
– আমার সাথে একটু হাটতে বের হলে কি হবে?আপনি তো এখনো ঘুমাননি।
অসহায় ভাবে বলল রঙ্গন। অদিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আমি ঘুমায়নি তুমি কিভাবে জানো?
– ব্যালকনিতে এসেই দেখুন।
অদিতি কৌতুহলী হয়ে ব্যালকনিতে যেয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল রঙ্গন গাড়ির বনেটের উপরে বসে আছে। পরনে তার মেরুন হাফপ্যান্ট আর গ্রে টিশার্ট।অদিতিকে দেখে রঙ্গন একটা সুন্দর হাসি দিয়ে হাত নাড়ালো।
– এত রাতে উদ্বাস্তুর মত রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন?
– আপনার জন্য।
সহজ সরল স্বীকারোক্তি রঙ্গনের। ক্ষণিকের জন্য অদিতি বুঝি ভাষাহীন হয়ে পড়লো। তারপর কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কঠিন করে বলল,
– এসবের মানে কি রঙ্গন?
– যখন এভাবে প্রেম করার বয়স ছিল তখন তো করলেন না তাই বাধ্য হয়ে এখন করতে হচ্ছে।
অদিতির অধর কোণে বুঝি এক হাসির ঝলক দেখা দিলো রঙ্গনের কথায়। কিন্তু দ্রুত সেটা লুকিয়ে নিলো সে।
– এসব না করে বাসায় যাও আহিনার ঘুম ভেঙে গেলে ভাববে তার বাবাই পাগল হয়ে গেছে।
রঙ্গন বনেটের উপর থেকে নেমে এলো তারপর রাস্তায় হাটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো।রঙ্গনের এমন কাণ্ডে অদিতি ভড়কে গেলো।
– রঙ্গন কি করছো এসব ওঠো বলছি।
– আপনাকে নিয়ে আধাঘন্টা হাটবো তারপর ফিরে যাবো। আহিনার পিংকি প্রমিস।প্লিজ!
অসহায় ভাবে বলল রঙ্গন। অদিতি দোনামোনা করে শক্ত কণ্ঠেই বলল,
– ওকে আসছি।
রঙ্গন সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে একটা হাসি দিয়ে ইশারায় ওকে বোঝালো।
শান্ত সুনশান রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে রঙ্গন আর অদিতি। কারো মুখে কোন কথা নেই।শুধু শান্ত পদক্ষেপের আওয়াজ। নীরাবতা ভেঙ্গে রঙ্গন জিজ্ঞেস করলো,
– আমার কি নিজের মধ্যে গুরুগম্ভীর ভাব আনা উচিত মিস চড়ুই?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– আজ বেবীকে রেখে বাড়ি যাওয়ার পরে বাবা বলল আমি এখন বাচ্চার বাবা তাই নাকি আমার মধ্যে সিরিয়াস ভাব আনা দরকার।
অদিতি রঙ্গনের কথা শুনে ঠোট এলিয়ে হাসলো তারপর রাস্তার পাশের এক বেঞ্চে বসে বলল,
– তাহলে এরকম হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন ফর্মাল ভাবে আসতে।
– রাতেও ফর্মাল পরে ঘুরতে হবে তাহলে?
কনফিউজড হয়ে জানতে চাইলো রঙ্গন। রঙ্গনের এক্সপ্রেশন আর কথা শুনে অদিতি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় সেই হাসি যেনো ঝংকার তুললো রঙ্গনের বুকের বা পাশে। হাত দিয়ে বুকের বা পাশে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। অদিতি হাসি থামিয়ে রঙ্গনকে ইশারায় তার পাশে বসতে বলল।রঙ্গন পাশে বসতেই অদিতি বলল,
– তুমি জানো আহিনা তার মাম্মামের থেকে বাবাইকে বেশি পছন্দ করে।
– সত্যিইইই!!!
উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো রঙ্গন। অদিতি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো রঙ্গনের দিকে।
– আর বাবাইকে কেন বেশি পছন্দ করে জানো?
রঙ্গন মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।
– কারণ তার বাবাই মাম্মামের মত সিরিয়াস না সব সময় চিল মুডে থাকে।
রঙ্গন ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। অদিতি এবার ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি সিরিয়াস হওয়ার টিপস লাগবে?
– একদমই না আমার বেবী যেমন চাইবে তার বাবাই তেমনি চলবে।
অদিতি রঙ্গনের দিকে গভীরভাবে ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি আহিনাকে এত ভালোবাসো কেন?
– সত্যি বলতে আপনাকে ভালোবাসি বলেই আহিনাকে আপন করে নিয়েছিলাম কিন্তু ধীরে ধীরে কখন যে সত্যি আহিনার বাবাই হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।আগে আপনাকে ছেড়ে কোনভাবে বেচে ছিলাম কিন্তু এখন আপনাদের ছেড়ে হয়তো দ্বিতীয়বার বাচতে পারবো না।আপনার সাথে একটু কথা বলতে না পারলে আর সারাদিনে একবার আহিনাকে জড়িয়ে ধরতে না পারলে আমি শান্তি পাই না।
অকপটে কথাগুলো বলে গেলো রঙ্গন। অদিতি নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো রঙ্গনের দিকে। ভাবলো ‘এতটাও কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে!’
বেশ কিছুদিন ধরে আহিনা আবদার করেছে তার গীটার চাই।রঙ্গন তাই আহিনার জন্য কাস্টমাইজড ছোট্ট একটা গীটার অর্ডার দিয়েছিল সেটা আজ ডেলিভারি এসেছে। রঙ্গন যখন গীটারটা আহিনার সামনে রাখলো সে তো খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তারপর বলল,
– বাবাই চলো আমরা কনসার্ট করি।
– ওকে বেবী।
Don’t you want me like I want you, baby?Don’t you want me like I want you, baby?Don’t you want me like I want you, baby?Don’t you need me like I need you now?Don’t you need me like I need you now?Don’t you need me like I need you now?Sleep tomorrow, but tonight, go crazySleep tomorrow, but tonight, go crazySleep tomorrow, but tonight, go crazyAll you gotta do is just meet me at theAll you gotta do is just meet me at theAll you gotta do is just meet me at the
Apartment, apartment
apateu, apateu
অদিতি বাসায় ঢুকতে ঢুকতে জোড়ালো মিউজিক আর সেই সাথে রঙ্গন আর আহিনার গানের গলা শুনে হতাশ ভাবে মাথা নাড়ালো।মনে মনে ভাবলো ‘না জানি আজ আবার কোন লঙ্কাকাণ্ড হচ্ছে বাড়ির মধ্যে।’
ড্রয়িংরুমে ঢুকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি দেখে চোখ বড় বড় হলো। উলোট পালোট ড্রয়িংরুমের সোফার উপরে আহিনা আর রঙ্গন ডান্স করতে করতে গীটার বাজাচ্ছে আর গান গাচ্ছে। সামনে অসহায় মুখে রিফাত আর জেনিফার দর্শক হিসেবে বসে আছে অবশ্য চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না তারা কনসার্ট এনজয় করছে। অদিতি সোজা যেয়ে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করে দিলো। কনসার্টে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রঙ্গন আর আহিনা থেমে গেলো। অদিতির থেকে চোখ ফিরিয়ে আহিনা রঙ্গনের দিকে তাকালো গাল ফুলিয়ে।রঙ্গন অসহায়ভাবে বলল,
– থাক বেবী আমরা পরে আবার কনসার্ট করবো।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসের অভিজাত এলাকার কোন এক আলো আধারি কক্ষে একজন সুন্দরী তনয়ার সামনে বেশ কিছু ছবি রাখা। ছবি গুলোতে দেখা যাচ্ছে রঙ্গন আর অদিতি রাস্তার পাশের বেঞ্চে বসে আছে।মেয়েটি একটা ছবি হাতে নিলো ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে অদিতি কিছু একটা বলছে আর রঙ্গন বিমুগ্ধ নেত্রে অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি ছবিটা হঠাৎ সামনে রাখা মোমবাতির জলন্ত শিখায় ধরলো সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে গেলো চিত্রখানা।
……………চলবে?
বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।