#অদিতির_যবনিকা -১৯
#তিশা
“আমরা আজকেই বিয়ে করবো আহিনার মাম্মাম।”
রঙ্গনের কথায় অদিতি যেনো থমকে গেলো। যা ভয় পাচ্ছিলো তাই হলো। তার পাগল প্রেমিক খেপেছে। এখন একে অদিতি শান্ত করবে কিভাবে। অদিতি একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে রঙ্গনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাকলো।
– আমার দিকে তাকাও রঙ্গন।
রঙ্গন যেনো আরো বেশি করে মাথাটা অদিতির পেটে গুজে দিতে চাইলো। হাতের বাধন আরো শক্ত করতে চাইলো।
– আহিনার বাবাই।
নরম সুরে ডাকলো অদিতি। রঙ্গন এবার মাথা তুলে অদিতির দিকে চাইলো কিন্তু হাতের বাধন আলগা করলো না।অদিতি দুইহাতের আজলায় রঙ্গনের মুখটা নিয়ে শান্তভাবে বলল,
– বিয়ে তো আমরা করবো। সব তো ঠিক হয়েই আছে কয়েকটা তো দিন।এরকম মাথা গরম করে না।
রঙ্গন নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ অদিতির দিকে তারপর আচমকাই অদিতিকে উরুতে বসিয়ে দিয়ে ওর ঘাড়ে মুখ গুজে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অদিতি জমে গেলো যেনো। অদিতি অনুভব করলো রঙ্গনের শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। দ্রুত হাত দিতে চাইলো রঙ্গনের চিবুকে কিন্তু রঙ্গন যেনো ওকে অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরেছে।
– আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি আজকে এক্ষুনি বিয়ে করবো।নাহলে আবার কেউ এসে আপনাকে বোঝাতে চাইবে রঙ্গন ভালো না রঙ্গন সুপারস্টার ভালোবাসার কি বোঝে। এসব বলে বলে আপনাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যাবে। আর কোন রিস্ক নিতে চাই না আমি।
অদিতি হতাশ হলো তবুও বোঝানোর চেষ্টা করলো।
– আরে বাবা আমি কি বাচ্চা যে কেউ এসে আমাকে বোঝাবে আর আমি বুঝে যাবো?
– তাহলে ওই সাদা হুলোটাকে কিছু বললেন না কেন?
অদিতির হাসি পেলো কিন্তু এখন হাসলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে হাসি আটকে বলল,
– আরে আমি কিছু বলার আগেই তো তুমি লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিলে।
– এত কিছু জানতে চাই না আমরা আজই বিয়ে করবো এটাই ফাইনাল। বাংলাদেশ যেয়ে সবাইকে নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করতে হবে তো বেশ আবার করবো বিয়ে বাংলাদেশ যেয়ে। দরকার হলে প্রত্যেক বছর একবার করে বাংলাদেশ যেয়ে ধুমধাম করে আমরা বিয়ে করবো কিন্তু আজ আমরা বিয়ে করবোই।
এই পর্যায়ে রঙ্গন অদিতিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাতর স্বরে বলল,
– আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আপনাকে পুনরায় হারানোর ভয়ে আমি সব সময় ভীত হয়ে থাকি।একটু শান্তি দিন না প্লিজ আর এই আতঙ্ক নিয়ে থাকতে পারছি না আমি।
অদিতি হাল ছেড়ে দিলো।ধীর স্বরে বলল,
– আচ্ছা রিল্যাক্স। শান্ত হও এবার। করবো আমরা বিয়ে আজকে।
কথাটা বলে অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে বুঝতে পারছে রঙ্গনকে আজ থামানো যাবে না।অপরদিকে রঙ্গন শান্ত হলো।অদিতির ঘাড়ে মুখ গুজেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো অদিতির অগোচরে।তারপর মাতাল করা কন্ঠে বিড়বিড় করলো “আমি আপনাকে নিরন্তর ভালোবাসি রঙ্গনের রঙ্গবতী।”
গম্ভীরমুখে বসে আছে রওনক সাহেব। একটু আগে রঙ্গন ফোন করে তাকে জানিয়েছে আজ এক্ষুনি বিয়ে করবে সে। অদিতিকে নিয়ে আসছে। সামাজিক এবং ধর্মীয় দুইভাবেই বিয়ে করবে সব ব্যবস্থা যেনো করে রাখে। রওনক সাহেব যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে তাকে থামিয়ে রঙ্গন রীতিমতো হুমকিস্বরূপ জানায় ‘বাবা তুমি যদি এক্ষুনি বিয়ের ব্যবস্থা না করো তাহলে কিন্তু আমি এবার নিউইয়র্ক গেলে আর ফিরবো না।’ অগত্যা বরাবরের মতো ছেলের জেদের কাছে হার মেনেছেন তিনি।নয়নকে জানিয়েছে বিয়ের ব্যবস্থা করতে। টেবিলের উপরে রাখা সহধর্মিণীর ছবির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– তোমার ছেলে তোমার মতই একরোখা আর জেদী হয়েছে মধুমিতা। তুমি সাত বছরের ছোট রওনককে ভালোবেসে দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলেছিলে আর তোমার ছেলে দুই বছরের বড় অদিতিকে ভালোবেসে তার বাবাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগে অদিতি আর রঙ্গনের বিয়ে হয়ে গেছে। অদিতির মাথায় রঙ্গনের মায়ের বিয়ের লাল ওড়না। আহিনা রঙ্গনের কোলে বসে ডাগর ডাগর চোখে সব বুঝার চেষ্টা করছে। একপাশে রিফাত আর জেনিফার চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। রিফাত জেনিফারের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– হুদাই এই কয়দিন ভাইয়ের বিয়ের জাকজমক দেখার জন্য এক্সসাইটেড হচ্ছিলাম। ভুলেই গেছিলা রাফিয়ান রঙ্গনের জীবনে স্বাভাবিকভাবে কিছু হয় না। বিয়েটাও করলো হাফপ্যান্ট আর হুডি পরে।
জেনিফার মুচকি হেসে বলল,
– সে যায় হোক আপু আর স্যারের বিয়েটা যে শেষমেশ হলো তাতেই শান্তি।
রওনক সাহেব এবার গম্ভীরমুখে জানতে চাইলেন।
– বিয়ে তো দিচ্ছিলামই এতো পাগলামি করার কি ছিলো?
– চারিদিকে যেভাবে চিল শকুন তাক করে আছে তাতে বউ দূরে রাখতে সাহস পাচ্ছিলাম না।আর তুমি যা ধুমধাম করার আয়োজন করেছো তা করতে থাকো সমস্যা নেই তো।
নির্বিকার জবাব রঙ্গনের। অদিতি একটু অপ্রস্তুত হলো সেই সাথে মেজাজ খারাপও হচ্ছে তার। উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,
– আংকেল আমি আসছি।
– আংকেল নয় এখন থেকে বাবা ডাকবে আর কোথায় যাচ্ছো এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ি।
রওনক সাহেব বললেন।অদিতি একটু নিরব থেকে বিনয়ের সাথে বলল,
– বাবা আপনার ছেলে পাগলামি করে হুট করে বিয়ে করেছে। আমি এসবের জন্য মানসিকভাবে একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।আশা করি আপনি আমার মানসিক অবস্থাটা বুঝবেন।আমার যেরকম সবকিছু রীতিনীতি মেনে আসার কথা ছিল সেভাবেই নাহয় আসবো।
রওনক সাহেব বুঝলেন অদিতির অবস্থাটা তাই আর জোর করলেন না। অদিতির মাথায় হাত রেখে বললেন ,
– ঠিক আছে আমি আর জোর করবো না তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই হবে।
পুরোটা সময়ে রঙ্গন ছিলো নির্লিপ্ত। চুপচাপ বসে ঘটনা দেখছে। সে জানতো এরকম কিছুই হবে। এখনো পর্যন্ত অদিতি শান্ত আছে এটাই বেশি। এখন যদি সে আবার এবাড়িতে থাকার জন্য জোর করে তাহলে দেখা গেলো তার বউ রণমুর্তি ধারণ করেছে। বিয়ে তো হয়ে গেছে এখন কয়দিন চুপচাপ থাকুক তারপর নাহয় আবার কোন মেলোড্রামা করে বউ বাড়িতে নিয়ে আসবে।আর তাছাড়া বউ তার বাড়িতে না থাকলে কি হয়ছে সে তো বউর বাড়িতে যেয়ে থাকতেই পারে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রঙ্গন মনে মনে হাসলো।
অদিতি আহিনাকে নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে রঙ্গনের সাথে কোন কথায় বলেনি সে। গাড়িতে আসার সময়েও অদিতি অনেকভাবে রঙ্গনকে বুঝিয়েছে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে না করতে কিন্তু রঙ্গন তার সিদ্ধান্তে ছিল অটল। এক পর্যায়ে বেশ উচ্চস্বরে রঙ্গন বলে উঠেছিল ‘দেখুন এই মুহূর্তে যদি বিয়ে না করেন আমি কিন্তু এই চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দেব।’ ব্যাস তারপর থেকে অদিতি আর একটা কথাও বলেনি থমথমে মুখে বসেছিলো।
অদিতি চলে যেতেই রওনক সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে হতবাক হলেন। কিছুক্ষণ আগে ঝড় উঠিয়ে বিয়ে করা ছেলে এখন নির্বিকার ভাবে সোফায় শুয়ে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করতে ব্যস্ত। অথচ তার সদ্য বিয়ে করা বউ তাকে ফেলে নিজের বাড়ি চলে গেছে তার মধ্যে কোন হেলদোল নেয়। বিরক্ত হয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
– মাথার মধ্যে কি পাকাচ্ছো? অদিতি যে রাগ করে ফিরে গেছে বুঝতে পারছো?
– বউ আমার বাড়ি থেকে চলে গেছে তো কি হয়ছে আমি তো তার বাড়ি যেতেই পারি। চিন্তা করো না রাত হলে ঠিক বউর কাছে চলে যাবো।
রঙ্গনের ঠোটকাটা জবাবে একটু ভড়কে গেলেন তিনি। তবে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন তারপর কটমট করে বলেন,
– অসভ্য বেয়াদব ছেলে।
রঙ্গন ইনোসেন্ট ভাবে বলল,
– আশ্চর্য বিয়ের প্রথম রাতে বউয়ের কাছে যাবো না? তুমি কি প্রথম রাতে বউছাড়া আলাদা ছিলে?
রওনক সাহেব উঠে গটগট করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বুঝতে পারলেন এই বাদর ছেলের সাথে যত বেশি কথা বলবেন ততো নিজেই বিব্রত হবেন।মনে মনে অদিতির জন্য মায়া হলো তার ওরকম লক্ষ্মী শান্ত একটা মেয়ের কপালে তার এই বাদরটাই জুটতে হলো।
আহিনাকে তখন এপ্রকার জোর করে ওই বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে অদিতি। সে বাবাইকে ছেড়ে আসবে না কিছুতেই। রঙ্গন বুঝিয়েছে একটু পরেই সে আসবে। বাড়িতে আসার পরে তাই আহিনা রাগ করে মাম্মামের সাথে কথা বলছে না নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে। অদিতিও বেশি মাথা ঘামায়নি জেনিফারকে আহিনার কাছে থাকতে বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেছে।সারাদিনের এই দৌড়ঝাপে তার আর ভালো লাগছে না এখন একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে পারলেই যেনো শান্তি।
রিফাত মুখ অন্ধকার করে দাড়িয়ে আছে।রঙ্গনের কথায় ওই টমাসোকে তুলে নিয়ে এসেছিলো। অথচ একটু আগে তাকে থ্যাংকিউ বলে জড়িয়ে ধরে আদর আপ্যায়ন করে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিছে।রঙ্গনের মাথায় যে কি চলে মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারেনা সে। রিফাতকে ওভাবে গোমড়া মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রঙ্গন জিজ্ঞেস করলো,
– কি সমস্যা?
– ভাই কিছু করবেন না যেহেতু তাহলে এত কষ্ট করে ওই সাদা হনুমানকে তুলে আনতে বললেন কেন?
অভিযোগ জানালো রিফাত। রঙ্গন একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,
– মা’রবো বলেই তুলে আনতে বলেছিলাম। কিন্তু বিয়ে করার পরে মনে হলো ওই ব্যাটার জন্য এত দ্রুত বিয়েটা করতে পেরেছি তাই ওকে মাফ করে দিলাম।
তারপর রঙ্গন একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
– তিনমাস পরে বিয়ে করার পক্ষপাতী আমি নিজেও ছিলাম না। শুধু তোর ম্যামকে ওইসময় নারাজ করতে চাইনি বলে রাজি হয়েছিলাম।
এরপর রঙ্গন সামনের টেবিলের উপরে দুই পা তুলে দিয়ে সোফায় আধশোয়া হয়ে নির্বিকার ভাবে বলল,
– ওই টমাসো এই কাহিনী না ঘটালে হয়তো দুদিন পরে আমাকেই কোন কাহিনী ঘটাতে হতো বিয়ে করার জন্য। এজন্যই মাফ করে দিলাম বুঝলি।
রিফাত যেনো অবাক হতেও ভুলে গেলো। রঙ্গন রিফাতের মনের অবস্থা বুঝলো তাই মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
– তোর ম্যামকে দ্বিতীয়বার হারানোর মত সহ্যশক্তি আমার নেই রিফাত।
রিফাত বুঝলো রঙ্গন অদিতিকে নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় থাকে। এবার যদি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারে।
আহিনাকে ঘুম পাড়িয়ে অদিতি নিজের বিছানায় এসে ঘুমানোর চেষ্টা করছে দীর্ঘসময় হলো। কিন্তু এপাশ ওপাশ করেও কাঙ্খিত নিদ্রাদেবী ধরা দিচ্ছে না।এলোমেলো চিন্তারা জেকে বসেছে মস্তিষ্কে।ওই বাড়ি থেকে আসার পরে এতগুলো সময় পেরিয়ে গেলো রঙ্গন তো একবারো তাকে ফোন করলো না। এত কাণ্ড ঘটিয়ে বিয়ে করলো তারপর আর কোন খোজ নেয় বান্দার।অদিতির যেনো রঙ্গনের উপর একটু রাগই হলো। সে নাহয় রাগ করে চলে এসেছে তাই বলে একবার ফোনও করবে না।নিজের ভাবনায় অদিতি নিজেই অবাক হলো।রঙ্গনের প্রেমে পড়ে সেও কি তার মত পাগল হয়ে যাচ্ছে। এসমস্ত আকাশ কুসুম ভাবনায় অদিতির তখন কেবল তন্দ্রাভাব এসেছে এমন সময় বুকের উপরে উষ্ণ কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলো সে। ঘুম ভাবে থাকার জন্য প্রথমে বিষয়টা আমলে নিলো নো কিন্তু পরক্ষনেই গ্রীবাদেশে কারো উষ্ণ ওষ্ঠের স্পর্শ পেতেই ঘুম ছুটে গেলো তার।হাত দিয়ে সেই ওষ্ঠের মালিককে ধাক্কা দিতে উদ্যত হওয়ার পূর্বেই পরিচিত মিষ্টি একটা গন্ধ অনুভূত হতেই ভ্রু কুচকে এলো তার। অন্ধকারে কাপা কাপা হাতে মানবটির মাথায় হাত দিয়ে ধীরস্বরে বলল,
– রঙ্গন!!
মুহূর্তেই কর্ণগোচর হলো চির পরিচিত পুরুষালী গভীর সেই কণ্ঠস্বর “হ্যাপী ফার্স্ট নাইট রঙ্গনের রঙ্গবতী।”
………………চলবে?
#অদিতির_যবনিকা -২০
#তিশা
রঙ্গনের ঘোরলাগা সেই গভীর কণ্ঠ যেনো অদিতির হৃদপিণ্ডের গতি উলোটপালোট করে দিলো।কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্ক নিশ্চল হলো। ক্ষণকাল পরে সম্বতি ফিরে পেতেই রঙ্গনকে নিজের উপর থেকে সরাতে চাইলো। নাছোরবান্দা প্রেমিক পুরুষ কি আর সরাতে চাইলেই মেনে নেবে! মোটেই নয়। রঙ্গন যেনো আরো গভীর ভাবে অদিতির গলায় মুখ গুজে দিলো। তারপর আকুতিভরা কণ্ঠে বলল,
– এমন করছেন কেন।স্বামীর অধিকার নিতে আসিনি একটু শান্তিতে ঘুমাতে এসেছি। জানেন কতগুলো বছর শান্তিতে ঘুমায় না।
অদিতির যেনো রঙ্গনের এই বিষাদমাখা কথা শুনে মায়া হলো।আসলেই তো রঙ্গন তাকে ভালোবেসে কম কষ্ট তো পায়নি।অদিতি কিছু বলছে না দেখে রঙ্গন মাথা তুলে অদিতির কপালে ওষ্ঠো ডুবিয়ে বলল,
– জানি তো আমার উপর রাগ করে আছেন। কিন্তু কালকের জন্য রাগটা প্লিজ তুলে রাখুন না।একদম জ্বালাবো না প্রমিস শুধু আপনার আলিঙ্গনে একটু ঘুমাবো।
কথাগুলো বলে রঙ্গন পুনরায় অদিতির ঘাড়ে মাথা গুজে দিলো।অদিতির রাগ অভিমান বুঝি রঙ্গনের সেই বিষাদমাখা আলাপনের মধ্যেই হারিয়ে গেলো।একটু সময় নিয়ে শান্তভাবে রঙ্গনের চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো।না চাইতেও এই বেপরোয়া প্রেমিকের প্রেমে ডুবে গেছে সে। কিভাবে সামলাবে শান্ত শিষ্ট অদিতি এই রগচটা পাগল প্রেমিককে।ভাবনার অকুল পাথারে ডুবে যেতে যেতে অদিতি অবচেতন মনে অধর ছুয়ে দিলো রঙ্গনের কোকড়া কেশগুচ্ছে।অদিতির কোমল স্পর্শ অনুভব করে রঙ্গন আলগোছে হাসলো তারপর অদিতির কটিদেশে হাতের বাধন আরো দৃঢ় করতে করতে বিড় বিড় করে বলল “জানেন আহিনার মাম্মাম ভালোবাসা ভয়ংকর সুন্দর।”
সকাল সকাল আহিনা ঘুম থেকে উঠে রোজকার মতো তার মাম্মামের ঘরে ঢুকলো গুটিগুটি পায়ে। কিছু বিছানায় মাম্মামের বদলে বাবাইকে ঘুমাতে দেখে চেহারায় খুশির ঝিলিক দেখা দিলো।দ্রুত বেডের উপরে উঠে রঙ্গনের বুকের উপরে শুয়ে পড়লো।
চোখে মুখে নরম স্পর্শ পেয়ে ঘুমের মধ্যে ভ্রু কুচকে ফেললো রঙ্গন। ধীরে ধীরে তন্দ্রা কেটে যেতেই দেখলো নিষ্পাপ দুটো আখি উচ্ছলভাবে তার দিকে চেয়ে আছে। রঙ্গনের মুখেও প্রশান্তির একটা হাসি দেখা দিলো। দুইহাতে আগলে নিলো ছোট্ট সেই তনু।কপালে ঠোট ছুইয়ে আদর দিলো রঙ্গন।চিত্তপটে ভেসে উঠলো কিছুদিন আগের সেই স্মৃতি। এরকমই এক সকালে আহিনা প্রথম তাকে বাবাই ডেকেছিলো। অজান্তেই এই ছোট্ট প্রাণটা খুলে দিয়েছিলো ভালোবাসার এক নতুন দ্বার।সেই স্মৃতি ভেবে আরো একটু পরম আবেশে আহিনাকে আগলে নিলো রঙ্গন।
– তুমি কখন এসেছো বাবাই?
– আমিতো রাতে এসেছি তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাকিনি।
– এখন থেকে তুমি এখানে থাকবে তো বাবাই সবার বাবাই তাদের সাথে থাকে তুমি কেন থাকো না?
– আচ্ছা বাবাই এখন থেকে সবসময় তার বেবীর সাথে থাকবে।
ওয়াশরুমের দরজায় দাড়িয়ে বাবা মেয়ের সেই ভালোবাসাময় দৃশ্য অবলোকন করলো অদিতি।রঙ্গনের দৃষ্টি অদিতির দিকে পড়তেই সে চোখ ঘুরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভাবলো বাকবিতন্ডার জন্য প্রস্তুত হও রঙ্গন।
ড্রয়িংরুমে এসে অদিতি যেনো আকাশ থেকে পড়লো।রঙ্গনের ল্যাগেজ গীটার আর অন্যসব জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘর জুড়ে আর এককোণে রিফাত মুখ ভার করে বসে আছে। অদিতি যখন ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে তখন আহিনাকে নিয়ে রঙ্গন বেরিয়ে এলো।
– এসব কি?
রঙ্গন একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল,
– আমার জিনিসপত্র। বউ শ্বশুরবাড়ি থাকবে না বলে আমাকে ফেলে চলে এসেছে তাই ভাবলাম আমিই নাহয় বউয়ের কাছে চলে যায়।হাজার হোক নারী পুরুষ সমান অধিকার।
অদিতি থমথমে মুখ করে বলল,
– জিনিসপত্র নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যাও।
রঙ্গন অদিতির মুখোমুখি দাড়িয়ে ফিচেল হেসে বলল,
– বেশ তো চলুন। আপনিও তো আমার।
অদিতির মেজাজ চরম খারাপ হলো।রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,
– রাতেই তোমাকে বের করে দেয়া উচিত ছিল।
রঙ্গন বাকা হাসি দিয়ে জোরেশোরে বলল,
– আই লাভ ইউ ঠু আহিনার মাম্মাম।
অদিতি রান্নাঘরে যেতে নিয়ে পুনরায় পিছন ফিরে রঙ্গনকে চোখ রাঙালো।
– ফ্লোরা আগামী মাসে তো রঙ্গনের কনসার্ট ক্যালিফোর্নিয়ায়?
– হুম জানি তো।
ছোট করে জবাব দেয় ফ্লোরা।
– যাবি না?
– অবশ্যই যাবো।
ফ্লোরা ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পুনরায় বলল,
– তোর কি মনে হয় রঙ্গনের লাভ লাইফ জানার পরে আমি ওর গান শোনা কনসার্টে যাওয়া বন্ধ করে দেব? কাম অন ন্যান্সি এতটাও চাইল্ডিশ ভাবিস না আমাকে। রঙ্গন আগেও আমার ক্রাশ ছিল এখনো আছে। হ্যা আগে ও সিঙ্গেল ছিল বলে একটু রঙ্গিন স্বপ্ন দেখতাম এখন সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে এই আর কি!
ন্যান্সি একটা হাসি দিলো ফ্লোরার কথায়। তারপর বলল,
– আসলে কম পাগলামি করিস নি তো রঙ্গনের জন্য এজন্যই চিন্তা হয় তোর জন্য আর কি?
ফ্লোরা ন্যান্সির কাধ জড়িয়ে ধরে বলল,
– চিল ব্রো লাইফে সেলিব্রিটি ক্রাশ থাকলে এরকম দু একটা হার্ট ব্রেক হবেই।
তারপরে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই বসে আছে।রিফাত নিজেকে নিয়ে খুবই কনফিউজড। রঙ্গন নিজের জিনিসপত্রের সাথে তাকেও নিয়ে এসেছে অদিতির বাড়িতে।মনে মনে ভাবলো সে কি জিনিসপত্র যে তাকেও বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে রঙ্গন। আচ্ছা অদিতি যদি তাকে না রাখে যদি বের করে দেয় তাহলে ব্যাপারটা খুবই অসম্মানের হবে। তারপর পুনরায় ভাবলো না না অদিতি ম্যাডাম কত ভালো মানুষ সব সময় কেমন শান্ত ব্যবহার করে বরং এই জায়গায় রঙ্গন হলে বের করে দেয়ার একটা চান্স ছিলো। রিফাত ভাবনাচ্যুত হলো রঙ্গনের কথায়।
– আপনার পশ্চিমদিকের রুম দুইটাতে যেহেতু কেউ থাকে ওই দুইটা আমি নিচ্ছি। একটা স্টুডিও বানাবো আর একটাতে রিফাত থাকবে।
অদিতিকে উদ্দেশ্য করে বলল রঙ্গন।অদিতি শান্ত চোখে রঙ্গনের দিকে চাইলো।
– মানা করলে শুনবে?
অদিতির প্রশ্নে রঙ্গন দাত বের করে হেসে ইশারায় না বোঝালো। অদিতি হতাশভাবে খাবারে মনোযোগ দিলো। তারপর কিছু মনে পড়তেই আবার রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো।
– এক মিনিট তুমি থাকবে কোথায়?
– আহিনার মাম্মামের কাছে।
খেতে খেতে নির্বিকার জবাব রঙ্গনের।অদিতি কটমট চোখে চাইলো রঙ্গনের দিকে। ওই দৃষ্টি দেখে রঙ্গন বুঝলো অদিতি বুঝাতে চাইছে এসো আজ রাতে তারপর মজা দেখাচ্ছি।
আজ অদিতির অফিসে বেশ কাজের প্রেসার ছিল ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো তার। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই নজরে এলো রঙ্গন আর আহিনা ড্রয়িং করতে ব্যস্ত। অদিতি মনে মনে শান্তি পেলো যাক অন্তত দক্ষযজ্ঞ বাধাচ্ছে না। কিন্তু বেডরুমে ঢুকেই তার চক্ষু চড়ক গাছ। মনে হচ্ছে না এটা অদিতির ঘর। সব সময় পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা ঘরের বেহাল দশা। খুব সম্ভবত কিছু আগে বাপ মেয়ে বিছানায় যুদ্ধ করেছে। রঙ্গনের সকালের হুডিটা টি টেবিল থেকে ঝুলছে। সোফায় একটা গীটার রাখা ঘরের এক কোণায় আর একটা গীটার দেখা যাচ্ছে।খুব সম্ভবত শাওয়ার নিয়ে তোয়ালেটাও অদিতির স্টাডি টেবিলের উপরে ফেলে রেখেছে। আর সবথেকে বড় ব্যাপার ঘর জুড়ে একটা পুরুষালি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অদিতি ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তারপর ঘর গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
সেদিনের পরে রুহির সাথে খুবই কম কথা হয়েছে আরাফের।আগামী সপ্তাহে রঙ্গনের সাথে আরাফের আরো একটা মিটিং হওয়ার কথা আছে।রঙ্গন যদি বাংলাদেশ আসে তাহলে খুব ভালো হবে।সরাসরি কথা বললে একটু হলেও রঙ্গনের হাবভাব বোঝা যাবে।রুহির সাথেও ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলা দরকার চারিদিকে এত ঝামেলা আর ভালো লাগছে না তার।বারান্দায় বসে এসমস্ত ভাবনায় এতক্ষণ মশগুল ছিল আরাফ। বেডরুমে তাকিয়ে দেখলো রুহি চুপটি করে শুয়ে আছে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো সে।
বেশ কয়েকদিন হচ্ছে অদিতির জীবনে আমূল-পরিবর্তন এসেছে। তার শান্ত শিষ্ট বাড়িটা আর শান্ত নেই।আগে টুকটাক আহিনার চঞ্চলতার শব্দ আসতো আর এখন যেনো ঘরের প্রতি কোণায় কেমন একটা উচ্ছলতার ভাব।অগোছালো ঘরবাড়ি ,রঙ্গন আহিনার কোলাহল ,জেনিফার আর রিফাতের ঝগড়া ,আহিনার কিচিরমিচির আর সময় অসময়ে রঙ্গনের গীটারের টুংটাং। সবমিলিয়ে অদিতির কেমন জানি একটা সুখ সুখ অনুভূতি আসে।যদিও মুখে মুখে বোঝায় সে রঙ্গনের উপর এখনো রেগে কিন্তু মনের গহীনে অনুভব করে আহিনার পরে রঙ্গনই তার জীবনের সব থেকে সুন্দর অধ্যায়।অদিতি একটু রাগারাগি করলেও রঙ্গন ঠিকিই প্রতিদিন রাতে অদিতির সান্নিধ্যেই ঘুমিয়েছে।
আজ অফিস থেকে ফিরতে একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে অদিতি।বাড়ি ফিরে দেখে রঙ্গন আহিনাকে বুকে নিয়ে হাটাহাটি করছে আর ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। মনে মনে হাসে অদিতি।সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে বারান্দার বেতের সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে সামনের টি টেবিলে পা উঠিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। আজ দুপুরে রওনক সাহেব এসেছিলেন তার সাথে দেখা করতে। তিনি চাইছেন অদিতি তার ব্যবসা ধীরে ধীরে বুঝে নিক। অদিতি মানা করলেও তিনি কিছুতেই শুনতে রাজি নন। তার ভাষ্যমতে রঙ্গন তার গানবাজনা রেখে কোনদিন ব্যবসায় মন দিবে না তারও বয়স হচ্ছে এখন অদিতিই তার একমাত্র ভরসা।অদিতি বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলে রওনক সাহেব তাকে বলেছেন ‘বাবা হয়ে মেয়ের কাছে এতটুকু কি আমি আশা করতে পারি না মা।’ এই কথার পরে অদিতি আর কিছু বলতে পারেনি।মানুষটা তাকে এতটা আপন করে নেবে অদিতি ভাবতেও পারেনি।হঠাৎ পায়ে কারো স্পর্শ অনুভব করে চমকে সেদিকে তাকিয়ে দেখে রঙ্গন তার কোলের উপর অদিতির পা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে।
– কি করছো কি? পা ছাড়ো।
রঙ্গনের মধ্যে ছাড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না বরং শান্তভাবে বলল,
– এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেয়। বাবা আপনাকে ভরসা করেন। তার ধারণা আমার থেকে আপনার মধ্যে রেসপন্সিবিলিটি পালনের ক্ষমতা বেশি।
অদিতি ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তারপর বলল,
– সেটাই ভাবা কি উচিত নয়?
– অবশ্যই উচিত।রঙ্গনের বউ বেস্ট।
অদিতির চিবুক রক্তিম হলো বুঝি এবার। অন্যদিকে তাকিয়ে সেটা লুকানোর চেষ্টা করলো। এমন সময় বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। রঙ্গন চট করে উঠে দাড়িয়ে অদিতিকেও হাত ধরে তুলে রেলিংয়ের কিনারায় নিয়ে গেলো।
– আরে আরে কি করছো?ভিজে যাবো তো।
রঙ্গন যেন সেকথা কানেই তুললো না। অদিতিকে দাড় করিয়ে নিজে তার পিছনে দাড়িয়ে গেলো। অদিতির কোমর জড়িয়ে ধরলো একহাত দিয়ে আরেক হাত দিয়ে অদিতির একটা হাত ধরে বৃষ্টিতে মেলে ধরলো।রঙ্গনের এমন গভীর স্পর্শে অদিতি কথা হারিয়ে ফেললো। রঙ্গনের ভালোবাসার পাগলামির কাছে সে বরাবরই পরাজিত। অদিতি বেসামাল হয়ে কটিদেশ জড়িয়ে রাখা রঙ্গনের হাতের উপর নিজের হাত চেপে ধরলো।বেপরোয়া বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে দুজনকে।রঙ্গন অদিতির কানে অধর ছুয়ে মাতালস্বরে গাইলো,
“পেছনে ফিরে দেখো তুমি
অপ্রত্যাশিত কোনো অতিথি
চোখ ফেরালে বল কেন?
ভয় পেয়েছ, নাকি আরতি
জানি প্রতিটা স্বপ্নে তুমি দেখেছো আমায়
নিরন্তর ছিলে আমার-ই ছায়ায়
তবে, চোখ মেলাতে কি বিরোধ?
ভুল করে একটা বার প্রাচীরটা ভেঙ্গে দেখো
জমে আছে কত কথা ভুল করে বলে দিয়ো
জন্মান্তর যদি মিথ্যে হয়, এই হবে শেষ দেখা
ভালবাসি কেনো যে তোমায় হবে না কখনো বোঝা।”
…………চলবে?
বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।