অদিতির যবনিকা পর্ব-২৮

0
14

#অদিতির_যবনিকা -২৮
#তিশা

বিকালে রঙ্গনের ফ্যান মিট আপ আছে। হোটেলের চারপাশে বেশ কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছেন রওনক সাহেব। আহিনা ঘুমের ওষুধের কারণে বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে।জেনিফারেরও একই অবস্থা। আহিনাকে কোলের মধ্যে নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে অদিতি।রঙ্গন তখন রেডি হচ্ছিলো বের হওয়ার জন্য।অদিতি আহিনার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে চিন্তিতভাবে বলল,
– বেবীকে কি আর একবার ডাক্তারের কাছে নিবো এত ঘুমাচ্ছে আমার টেনশন হচ্ছে।
রঙ্গন বিছানায় এসে বসে অদিতির হাত নিজের মুঠোবন্দী করে বলল,
– কাল বেবীর সব রকম টেস্ট করিয়েছি কোন সমস্যা নেই ওষুধের প্রভাব কেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
অদিতি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রঙ্গন আহিনা আর অদিতির কপালে আদর দিয়ে অদিতির পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– আসতে দেরি হতে পারে। সময়মতো বেবী আর পুচকুকে নিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন।
অদিতি বিনিময়ে আলতো হাসলো। রঙ্গন বেরিয়ে যেতেই অদিত ব্যালকনির চেয়ারে যেয়ে বসলো।চিত্তপটে কতশত ভাবনা এসে ভিড় জমালো। ভার্সিটির সেই পাগলাটে রঙ্গন। তার ভালোবাসার পাগলামি। অদিতির তার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করা। রঙ্গনের হারিয়ে যাওয়া। আরাফের প্রতারণা। আহিনাকে নিয়ে একা বেচে থাকার লড়াই তারপর ঝড়ো হাওয়ার মত রঙ্গনের আবির্ভাব। সব যেনো ছবির মতো ভেসে উঠলো অদিতির সামনে। কালের বিবর্তনে অদিতি আজ রঙ্গনের বউ।তারপর ধীরে ধীরে পেটের উপরে আলতো হাতে স্পর্শ করে মৃদু হেসে ভাবলো আজ সেই রঙ্গনের ভালোবাসার অংশকেও ধারণ করছে নিজের মধ্যে।অদিতি যখন ভাবনার সাগরে নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ করতে ব্যস্ত তখন আহিনার মিষ্টি ডাকে ঘোর কাটলো তার।ঘরে যেয়ে দেখলো আহিনা ঘুম থেকে উঠে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।মেয়েকে কোলের মধ্যে নিয়ে বলল,
– কি হয়েছে বেবী?
– বাবাই কোথায় মাম্মাম?
অদিতি হতাশ হলো পুনরায়।এটা তো বাপভক্ত যেটা আসছে সেটা যে কার ভক্ত হবে! উদাস মনে ভাবলো সে।

অন্ধকার কক্ষে চেয়ারে বেধে রাখা হয়েছে সোফিয়াকে।গু’লিবিদ্ধ হাত থেকে এখনো ক্ষণে ক্ষণে র’ক্ত ঝরছে। তার সামনের চেয়ারে বেশ দাপুটে ভঙ্গীতে বসে আছে রওনক চৌধুরী।
– রঙ্গনের সর্বনাশ কর‍তে নেমেছো অথচ রঙ্গনের বাবার ব্যাপারে খোজ নিলে না।
হাসিমুখে বললেন রওনক সাহেব। সোফিয়া ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রঙ্গনকে বোঝা গেলেও এই লোককে বুঝতে পারছে না সে। কেমন যেনো শান্ত কিন্তু তারপরও একটা ভয়ংকর আভা ছড়াচ্ছে যেনো। সোফিয়া মুখ খুলছে না দেখে রওনক সাহেব বললেন,
– সহজভাবে বলতে চাচ্ছো না তাই তো?
এমন সময় রঙ্গন প্রবেশ করলো কক্ষে। রঙ্গনের পিছনে দুজন নারী বডিগার্ডকে একজন নারীকে টেনে নিয়ে আসতে দেখা গেলো।আটককৃত নারীকে দেখে সোফিয়ার মুখটা র’ক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।বিড়বিড়িয়ে বলল,
– র‍্যাচেল!!
রঙ্গন বাকা হেসে বলল,
– এবার তো মুখ খুলবে নাকি? হাজার হোক তোমার ক্রাইম পার্টনার চলে এসেছে।
রওনক সাহেব মৃদু হেসে কক্ষ ত্যাগ করলেন।র‍্যাচেলকেও একটা চেয়ারের সাথে বেধে দেওয়া হলো।রঙ্গন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
– কি ভেবেছিলে তোমরা? রঙ্গনের জানের দিকে হাত বাড়াবে আর রঙ্গন সেটা বুঝতে পারবে না।এখন নির্বাক চলচ্চিত্রের মত বসে না থেকে বলে ফেলো তো কিসের প্রতিশোধ নিতে চাইছিলে আমার উপর।
– তোমার জন্যই আমি জোসেফকে হারিয়েছি রঙ্গন। আমি যেরকম সারাজীবন ভালোবাসা হারানোর বেদনায় ভুগেছি তোমাকেও সেই যন্ত্রণা দিতে চেয়েছি অদিতিকে মে’রে।
তেতে উঠলো সোফিয়া। রঙ্গন মৃদু হেসে র‍্যাচেলের দিকে তাকিয়ে বলল ,
– যখন দেখলে সোফিয়াও তোমার মতো জোসেফের মৃ’ত্যুর জন্য আমাকে দায়ী ভাবে অমনি তুমিও ওর ইমোশনকে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করলে ভাইয়ের মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে তাই তো?
– তা নয়তো কি? প্রথমে ভেবেছিলাম অদিতির সাথে তোমার বিচ্ছেদ করাবো শুধু এজন্য সোফিয়া জাপান গেছিলো কিন্তু তোমার অদিতি তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তাই ভাবলাম এত সন্দেহের বীজ বোনার পিছনে সময় নষ্ট না করে সরাসরি মে’রে ফেললেই তো হলো।হাজার হোক রাফিয়ান রঙ্গনের জান থাকে অদিতির মধ্যে। কিন্তু কিন্তু…..
হুংকার দিয়ে উঠলো র‍্যাচেল।
– কিন্তু তোমাদের সব পরিকল্পনা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।
রঙ্গনের কথায় ভ্রু কুচকে তাকালো র‍্যাচেল।রঙ্গন একটা বক্র হাসি দিয়ে বলল,
– জাপানে অদিতি আর আহিনার পিছনে গুপ্তচর লাগানো হঠাৎ করে সোফিয়ার আমার প্রতি দরদ এগুলো কিছুই কি আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছো? তবে তোমাদের লক্ষ্য কি সেটা বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেছিলো এই আর কি।
রঙ্গন একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পুনরায় বলল,
– জোসেফের শাস্তি হয়েছিলো তার নিজের দোষে। সেটা সহ্য না করতে পেরে সে সুই’সাইড করেছিলো এখানে আমার কোন দোষ ছিলো না। কিন্তু তোমাদের মতো সাইকোপ্যাথ সেসব বুঝবে না।
এরপর রঙ্গন গভীর দৃষ্টিতে সোফিয়া আর র‍্যাচেলের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
– কিন্তু যার পিছনে লাগতে এসেছো সে যে সাইকোপ্যাথের থেকে বেশি ভরংকর সেটা বুঝতে পারোনি।একসময়ে আণ্ডারওয়াল্ড কাপতো রওনক চৌধুরীর নামে তার ছেলে হিসেবে কিছু তো গুণ আমার মধ্যে থাকবে।
রঙ্গনের ঠাণ্ডা হুমকিতে সামনে বসা দুই রমণীর চেহারার রঙ উড়ে গেলো। রঙ্গন আয়েশ করে বসলো যেনো আর একটু।
– ভার্সিটিতে ভয়ংকর সুন্দরী যে মেয়েগুলো ছিলো অদিতি তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রায়শ কেউ না কেউ অদিতির সাথে সখ্যতা গড়তে চাইতো। কতশত ছেলেকে যে প্রকাশ্যে পিটিয়েছি আর কতশতকে যে আড়ালে পঙ্গু বানিয়েছি তার ইয়ত্তা নেয়।একবার এক ছেলে ভিড়ের মধ্যে অপ্রীতিকর স্পর্শে ছুয়ে দিলো অদিতিকে। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে অদিতি ঘন্টাখানেক কাদলো। ওয়াশরুমের দরজার বাইরে দাড়িয়ে আমি নিরবে শুনলাম সেই কান্না।পরদিন থেকে আজ অব্দি সেই ছেলের হদীস কেউ জানে না।
রঙ্গন এবার একটু ঝুকে একটা হাসি দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
– কি ভেবেছো অদিতির গালের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ ,ঠোটের কোণে লেগে থাকা রক্ত ,আমার এক সন্তানকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা আর এক অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলার প্রয়াস এসব কিছুর সহজ পরিণতি হবে তোমাদের? মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত ম’রণ ভিক্ষা করবে এতটা কষ্ট দেব তোমাদের আমি।
কথাগুলো বলে বেরিয়ে এলো রঙ্গন।
রঙ্গন বেশ অনেকখানি রাত করেই ফিরলো হোটেলে। ঘরে ঢুকেই আজ আবার চারিদিকে অন্ধকার দেখে বুকটা কেপে উঠলো তার। আবার কি বিপদ এলো কোনো! কিন্তু হঠাৎ এক ফালি আলোকরশ্মি এসে বিধলো অক্ষিকোটরে।মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোয় প্রেয়সীর সুতনু আনন যেনো হৃদয়পটে দোলা দিয়ে গেলো। ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। অদিতি আলতো হাসি দিয়ে বলল,
– জন্মদিন এখনো শেষ হয়নি।
রঙ্গন ঠোট কামড়ে হেসে অদিতির পাশে বসলো। অদিতি ছু’রিটা রঙ্গনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। রঙ্গন ছু’রিটা না নিয়ে ছু’রিসহ অদিতির হাতটা ধরে কেক কাটলো। অদিতি প্রথমে রঙ্গনকে কেক খাওয়ালো এরপর রঙ্গন অদিতিকে কেক খাওয়াতেই অদিতি রঙ্গনের নাকে ক্রিম লাগিয়ে দিয়ে ওর কানের কাছে ঠোট নিয়ে ফিসফিস করে বলল “ভালোবাসি বরমশাই।” রঙ্গন যেনো কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো।সত্যি কি অদিতি তাকে ভালোবাসি বললো। অদিতি তাকে ভালোবাসে এটা সে অনুভব করতে পারে কিন্তু তার মুখ থেকে শোনার পরে যেনো রঙ্গন বুঝতে পারছে না তার কি অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত।রঙ্গন অদিতির গাল ছুয়ে নিষ্পলক চাইলো তার দিকে তারপর গভীর স্বরে বলল,
– আরেকবার বলবেন প্লিজ।
অদিতি আলতো হেসে রঙ্গনের কপালে অধর ছুয়ে বলল,
– ভালোবাসি। তোমার মত করে হয়তো বাসতে পারিনা কিন্তু নিজের সবটুকু দিয়ে আমি বেপরোয়া রঙ্গনের প্রেমে পড়েছি।
রঙ্গন শক্ত করে অদিতিকে জড়িয়ে ধরলো। চুলের ভাজে অধর ডুবিয়ে বলল,
– আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্মদিন ছিলো আজ। আপনাকে নিয়ে আমি আজ কানায় কানায় পূর্ণ।

রঙ্গনের ব্যাপারে সমস্ত সংশয় কেটে যাওয়ার পরে আরাফ পুরো দস্তুর প্রজেক্টে মন দিয়েছে।আপাতত ব্যবসাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য।রুহির সাথে এখন মোটামুটি সম্পর্কটা ঠিক আছে তবে দুজনের মধ্যে একটা নীরব সম্পর্ক বিরাজ করছে।আরাফ চিন্তা করছে প্রজেক্টটা শেষ হলেই রুহি আর সে দেশের বাইরে যাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য। দরকার হলে আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করবে।জীবনটা একটু সহজ করা দরকার এত জটিলতা আর ভালো লাগছে না।আজকাল অদিতিকে নিয়েও মনের মধ্যে মাঝে মাঝে হতাশা উকি দেয় বুঝি কিন্তু আফসোস এখন আর কিছুই আরাফের হাতে নেই।

ব্যালকনিতে একই চাদরের নিচে পরস্পরকে জড়িয়ে আছে রঙ্গন আর অদিতি।অদিতির অনাবৃত উদরে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– বেবীকে পুচকুর কথা জানিয়েছেন?
অদিতি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। তারপর বলল,
– জানানোর জন্য তো তার বাবাই আছে।
– আপনি কবে জেনেছেন?
– জাপান থাকতেই।
– এই যে থেকে থেকে মাথা ঘুরে যাওয়া কোন কিছু খেতে ইচ্ছে না করা শুধু শুধু টমেটো সস খাওয়া এগুলো তাহলে পুচকুর জন্য।
অদিতি কিছু না বলে রঙ্গনের উন্মুক্ত বুকে মুখ গুজে মৃদু হাসলো।
– আমাকে আগে বলেন নি কেন?
– তোমার বার্থডে তে সারপ্রাইজ দিবো তাই।
রঙ্গন অদিতিকে আর একটু নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে তারপর ফিসফিস করে বলল,
– আপনাকে কখন সব থেকে বেশি সুন্দর লাগে জানেন?
অদিতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
– যখন আমার শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন।
অদিতি রঙ্গনের বাহুতে চড় মে’রে বলল অসভ্য।রঙ্গন খিলখিলিয়ে হেসে অদিতির গ্রীবাদেশে ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলো।

পরদিন সকালে অদিতির শরীরটা বেশ খারাপ হওয়ায় রঙ্গন আর ঘুরতে বের হলো না। রিফাত আর জেনিফারের সাথে আহিনাকে ঘুরতে পাঠিয়েছে। রওনক সাহেব গতকাল রাতেই জাপান ফিরে গেছেন। আর বলে গেছেন খুব দ্রুত তিনি অদিতি আর রঙ্গনের ধুমধাম করে বিয়ে দিবেন।

সকাল থেকে বেশ কয়েকবার বমি করেছে অদিতি। রঙ্গন বেশ চিন্তিত এই অবস্থায় অদিতিকে নিয়ে জাপান ফিরবে কিভাবে। অদিতিকে কোলের মধ্যে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রঙ্গন।
– রঙ্গন?
অদিতির ডাকে রঙ্গন ভাবনা থেকে বেরিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
– শরীর খারাপ লাগছে? আবার বমি করবেন?
অদিতি মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো তারপর রঙ্গনের আঙ্গুলের ভাজে নিজের আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলল,
– সোফিয়া কিসের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে তোমার উপর?

…………….চলবে?

বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।