অদিতির যবনিকা পর্ব-২৯

0
15

#অদিতির_যবনিকা -২৯
#তিশা

– সোফিয়া কিসের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে তোমার উপর?
অদিতির প্রশ্নে রঙ্গন একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো তারপর বলল,
– প্রথম নিউইয়র্ক যাওয়ার পরে আমি একটা মিউজিক একাডেমিতে ভর্তি হই।সেখানেই আমার পরিচয় হয় সোফিয়া আর জোসেফের সাথে।ধীরে ধীরে ভালো বন্ধুত্ব হয় ওদের দুজনের সাথে আমার।জোসেফ বেশ ভালো গান গাইতো কিন্তু ওর নাম যশ খ্যাতির প্রতি বেশ ঝোক ছিল। আমার আবার ওসবের প্রতি এত আগ্রহ ছিল না আমি তো আপনাকে ভুলে থাকার জন্য গান নিয়ে মেতে থাকতে চাইতাম।ধীরে ধীরে আমাদের তিনজনেরই বেশ নামডাক হতে লাগলো। কিন্তু জোসেফের থেকে আমার জনপ্রিয়তা আগে আসতে শুরু করলো। বেশ কয়েকটা মুভি থেকেও অফার আসতে লাগলো। জোসেফ আমাকে সামনাসামনি বেশ এপ্রিসিয়েট করতো কিন্তু তখনও বুঝিনি যে সে ভিতরে ভিতরে হিংসার অনলে জ্বলছিলো।বেশ কিছুদিন পরে আমার নামে রিউমার ছড়ালো আমি নাকি ড্রাগ এডিক্টেড এবং আমার চরিত্র নিয়ে বেশ কিছু নিউজ ছড়িয়েছিল।যার জন্য বেশ কিছু বড় বড় প্রজেক্ট আমার হাতছাড়া হয়ে গেছিলো। আমার আবার এসব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। কে কি বলল কে কি ছড়ালো এসবে আমার কিছু যায় আসতো না। কিন্তু বাবা যেনো তার ছেলের নামের এত মিথ্যা অপবাদ মেনে নিলেন না। তিনি খুজে বের করলেন এসব কিছুর পিছনে জোসেফের হাত আছে। সেই সাথে জোসেফ যে মিডিয়াকে টাকা খায়িয়ে এগুলো ছড়িয়েছে তার ভিডিও বের করে সবার সামনে নিয়ে এলেন। এরপর বেশ অনেকগুলো বড় বড় মিউজিক কোম্পানি জোসেফকে ব্যান করে দেয়।বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে ওর বেশ নাম খারাপ হয়। এসব জোসেফ সহ্য করতে না পেরে সু’ইসাইড করে। সোফিয়া আবার জোসেফকে ভালোবাসতো সে মনে করতো জোসেফের ম’ত্যুর জন্য আমি দায়ী তাই সে আর জোসেফের বোন র‍্যাচেল মিলে আমার ক্ষতি করতে চেয়েছে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রঙ্গন থামলো।তারপর অদিতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– এজন্যই আমার প্রতি প্রতিশোধ নিতে আপনাকে আর বেবীকে কষ্ট দিতে চেয়েছে। কারণ আপনাদের কিছু হলে আমি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবো।
অদিতি রঙ্গনে উন্মুক্ত বক্ষে অধর ডুবিয়ে বলল,
– এত ভালোবাসো?
রঙ্গন অদিতির চুলে মুখ ডুবিয়ে বলল,
– আপনারা আমার কাছে কতটা মূল্যবান আপনি ভাবতেও পারবেন না।
– বাবাইইই মাম্মাম!
আহিনার উচ্ছ্বসিত ডাকে রঙ্গন অদিতির সম্বিত ফিরলো। অদিতি হেসে বলল,
– এসে গেছে বাবা ভক্ত কন্যা।
রঙ্গন হেসে বলল,
– জেলাস।
অদিতি মুখ ঘুরিয়ে বলল ,
– আমারো পুচকু আসতেছে।
রঙ্গন হেসে বলল,
– আর পুচকুর মা যে আমার।
রঙ্গন অদিতির খুনসুটিময় আলাপের মধ্যেই আহিনাকে দৌড়ে আসতে দেখা গেলো। রঙ্গন হাত বাড়াতেই আহিনা ঝাপিয়ে পড়লো। মুঠোভর্তি ক্যাণ্ডি বাড়িয়ে ধরলো বাবাই মাম্মামের দিকে।
– দেখো বেবী তোমাদের জন্য কি এনেছি?
উৎফুল্ল ভাবে বলল আহিনা।রঙ্গন ক্যাণ্ডিগুলো নিয়ে আহিনার গালে আদর দিয়ে বলল,
– থ্যাংকিউ বাবাইয়ের বেবী।
অদিতি দুচোখ ভরে দেখলো দুজন মানুষ যাদের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই তারপরও একে অন্যের আত্মার আপন।
রঙ্গন আহিনাকে কোলের উপর বসিয়ে বলল,
– বেবী তোমার যদি একটা ছোট্ট ভাই অথবা বোন আসে কেমন হবে?
আহিনা বড় বড় চোখ করে বলল,
– আনার মতো আমিও বিগ সিস্টার হবো? ছোট্ট পুতুলের মত বেবী আসবে?
রঙ্গন মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালো। আহিনা খুশি হয়ে বলল,
– সত্যি?
বলেই রঙ্গনের গলা জড়িয়ে ধরলো।তারপর আবদারের সহিত বলল,
– কখন আসবে ছোট্ট বাবু?
– কিছুদিন পরেই আসবে বেবী।বাবু যেনো দ্রুত আসে এজন্য এখন থেকে তোমাকে মাম্মামের অনেক বেশি টেক কেয়ার করতে হবে বুঝেছো?
আহিনা চিন্তিতভাবে বলল,
– কেন?
– কারণ বাবু তো মাম্মামের কাছ থেকে আসবে তাই।
আহিনা অদিতির দিকে তাকিয়ে দেখলো অদিতি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহিনা তার মাম্মামের কাছে যেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– আমি তোমার টেক কেয়ার করবো মাম্মাম। এখন থেকে আমি তোমাকে খায়িয়ে দেবো তুমি দ্রুত বাবুকে নিয়ে আসো।
অদিতির নেত্র বেয়ে খুশির অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মেয়েকে পরম স্নেহে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো।রঙ্গন কাল বিলম্ব না করে দুইহাতে জড়িয়ে নিলো স্ত্রী সন্তানকে।নেত্র বুজে ভাবলো হয়তো এত সুখের প্রাপ্তি ললাটে লেখা ছিল বলেই সৃষ্টিকর্তা এতগুলো বছর তাকে বিষাদে রেখেছিলেন।

ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে আছে অদিতি আর ফ্লোরা। অদিতিই ফোন করে ফ্লোরাকে দেখা করতে বলেছে।ফ্লোরা বুঝতে পারছে না অদিতি কেন তাকে ডেকেছে।অদিতি ফ্লোরার মনোভাব বুঝে আলতো হাসলো।
– তোমাকে ধন্যবাদ জানাতেই ডেকেছি। সেদিন তো ঠিকভাবে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করতে পারিনি। তাই ভাবলাম ফেরার আগে একবার দেখা করে যাই।
ফ্লোরা মৃদু হেসে বলল,
– ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই ম্যাম।প্রিয় মানুষের প্রয়োজনে আমি তাকে একটু হলেও সাহায্য করতে পেরেছি এটাই অনেক বড় পাওয়া আমার কাছে।
অদিতি ফ্লোরার হাত ধরে বলল,
– আমার আহিনাকে ওরা রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছিলো। বাবার ওর কাছে পৌছাতে দশ মিনিটের মত সময় লেগেছিলো সেই দশ মিনিটে অনেক কিছু হয়ে যেতো পারতো। তারপর আমাকে খুজতেও অনেক সময় লেগে যেতো হয়তো ততোক্ষণে আমার অনাগত সন্তানেরও কিছু হয়ে যেতো পারতো। তাই মা হিসেবে আমার সন্তানদের জীবন বাচানোর জন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
ফ্লোরা অদিতির হাত ধরে বলল,
– এভাবে বলবেন না ম্যাম সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা আমি তো উপলক্ষ্য মাত্র।
অদিতি মৃদু হেসে বলল,
– যদি কখনো প্রয়োজন হয় আমাদের অবশ্যই জানাবে।
ফ্লোরা মাথা নাড়ালো। অদিতি বিদায় নিয়ে চলে গেলো।রেস্টুরেন্টের স্বচ্ছ কাচের জানালা দিয়ে ফ্লোরা দেখলো অদিতি বের হতেই রঙ্গন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। অদিতির কপালে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো পরম যত্নে কানের পিঠে গুজে দিলো তারপর গাড়ির দরজা খুলে বসিয়ে দিলো। ফ্লোরা অধর প্রসারিত করে হাসলো। তারপর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবলো ‘ভালোবাসা তার ভালোবাসার সাথে সুখে থাকুক।’

জাপান ফেরার পরে রঙ্গন আর অদিতি রওনক সাহেবের কাছেই উঠেছে।পুত্রবধূ নাতনী কাউকেই আর দূরে রাখতে চান না তিনি।জেনিফার আসার আগে একটু ইতস্তত বোধ করছিলো রঙ্গন তাকে ঝাড়ি দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। অদিতির প্রেগন্যান্সির চারমাস চলছে। রওনক সাহেব দ্রুত রঙ্গন আর অদিতির বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চাইলেও অদিতির প্রেগন্যান্সির ফার্স্ট পিরিয়ডে নানা জটিলতার কারণে রঙ্গন অদিতিকে নিয়ে বাংলাদেশ যাওয়ার ঝুকি নেয়নি।অবশেষে এবার বাংলাদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।রঙ্গন প্যাকিং করছে অদিতি আর আহিনা খাটের উপর বসে চিপস খাচ্ছে।প্যাকিং করতে করতে রঙ্গন মুখ গোমড়া করে বলল,
– কি দরকার অসুস্থ বউ নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করার। এর থেকে আর কয়েকমাস পরে বিয়ে করলে আমার দুই বাচ্চায় বাপ মায়ের বিয়ে খেতে পারতো।
অদিতি রঙ্গনের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো। আহিনা বুঝল না বাবাইয়ের কথা কিন্তু মাম্মামের হাসি দেখে সেও হাসতে লাগলো। রঙ্গন সেদিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। প্রেগন্যান্সি অদিতিকে যেনো প্রাণোবন্ত বানিয়ে দিয়েছে। চুপচাপ শান্ত শিষ্ট অদিতি এখন কথায় কথায় রঙ্গনের সাথে ঝগড়া করে।উল্টাপাল্টা আবদার করে।রঙ্গনকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে অদিতি ভ্রু উচিয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে।রঙ্গন অদিতির ঠোটের কোনের খাবার হাত দিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,
– প্রেগন্যান্সি শেষে কি আপনি আবার শান্ত শিষ্ট হয়ে যাবেন?
– মানে?
অদিতি কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করলো। রঙ্গন হেসে বলল,
– এরকম ছটফট করলে দেখতে ভালো লাগে।
অদিতি নিষ্পলক চাইলো রঙ্গনের দিকে। মনের গহীনে ভেসে উঠলো বহু বছর আগে এরকমই প্রেগন্যান্সির সময়ে আরেক জন পুরুষের ছবি।অদিতির প্রেগন্যান্সির মুড সুইং আর আবদারে বিরক্ত হয়ে সে বলেছিলো ‘প্রেগন্যান্ট হয়েছো বলে কি রাত বিরাতে উল্টাপাল্টা আবদার করবা।সারাদিন কাজের প্রেসার সামলে রাতে তোমার এসব নাটক দেখতে রোজ রোজ ভালো লাগে না।’ অতীত ভেবে নেত্র সিক্ত হলো অদিতির।ভাবলো একই পৃথিবীতে কত রকমের পুরুষ থাকে একজন পরের দিন মিটিং আছে বলে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কষ্ট উপেক্ষা করে গেস্ট রুমে ঘুমাতে যায় আর অন্যজন স্ত্রীর সামান্য মর্নিং সিকনেস দেখে একটার পর একটা কনসার্ট বাতিল করে দেয়।এই কয়দিনে অদিতি দেখেছে রঙ্গনকে এলবামের কাজ পিছাতে কনসার্ট বাতিল করে দিতে। রঙ্গনকে হাজারবার অদিতি বুঝিয়েছে এগুলো সাধারণ বিষয় কিন্তু রঙ্গন মানেনি।তার একটাই কথা এলবাম ,কনসার্ট সারাজীবন করতে পারবো কিন্তু এই সময়টা তো আর পাবো না। তারপর হেসে বলে বড় হয়ে পুচকু বলবে মাম্মাম আর আমি কষ্ট করে সারারাত জেগে বসেছিলাম আর তুমি কনসার্ট করে বেড়িয়েছো তখন কি আমার মান সম্মান থাকবে বলুন।ভাবতে ভাবতে অদিতির অধর প্রসারিত হয়। অন্যদিকে অদিতির ভেজা চোখ দেখে রঙ্গন বিচলিত হয়।
– কাদছেন কেন? অসুস্থ লাগছে? ডাক্তার কল করবো।
রঙ্গনের অস্থিরতা দেখে অদিতি রঙ্গনের হাত ধরে বলল,
– আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
রঙ্গনের অধর কোণে হাসি ফুটলো।কিন্তু আহিনার কথায় তাদের অনুভূতির বিচ্ছেদ হলো।
– আমি বাবাইকে ভালোবাসি।
গাল ফুলিয়ে বলল আহিনা। রঙ্গন হো হো করে হেসে আহিনাকে কোলের মধ্যে নিয়ে বলল,
– অবশ্যই। আমার বেবী আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

অবশেষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রঙ্গন অদিতি বাংলাদেশ পৌছেছে। দেশের মাটিতে পা দিয়ে যেনো অদিতির অনুভূতির লাগাম খুলে গেলো।অক্ষিকোটরে জল জমলো। কয়েক বছর আগে বিধ্বস্ত মন নিয়ে আহিনাকে বুকে জড়িয়ে রিক্ত হয়ে দেশ ছেড়েছিলো আর আজ যেনো পূর্ণতার পসরা নিয়ে ফিরছে সে।কাধের উপরে বিশ্বস্ত হাতের স্পর্শে ভাববাচ্যুত হলো সে। পাশে তাকিয়ে দেখলো রঙ্গন তার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। অদিতির সাথে নেত্র মিলিতেই চোখ দিয়েই যেনো রঙ্গন বুঝিয়ে দিলো এখন থেকে সব ভালো হবে।

নোট- জানি ছোট হয়েছে তাই ছোট বলে কষ্ট দিবেন না।ওভার থিংকিং করা মানুষ হবে।আপনাদের খারাপ মন্তব্য আমার মানসিক শান্তি নষ্ট করে।

……………….চলবে?

বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।