#অদিতির_যবনিকা -৩০
#তিশা
বাংলাদেশে আসার পরে রফিকুল ইসলামের সাথে রঙ্গনের এক দফা বাকবিতণ্ডা হয়েছে।রফিক সাহেব ভাগ্নীকে বিয়ের এই কয়টা দিন নিজের কাছে রাখতে চান কিন্তু রঙ্গন কিছুতেই বউ এবং মেয়েকে ছাড়া থাকবে না। এক পর্যায়ে রফিক সাহেবকে বলল ‘আমার বউয়ের মাঝরাতে খিদা লাগে তখন সে আমার হাতের পাস্তা খেতে চায় তখন আপনি আমার হাতের পাস্তা তাকে কিভাবে খাওয়াবেন? তারপর আমার বুকের মধ্যে না ঘুমালে আমার বউ বাচ্চা কেউ ঘুমাতে পারে না তখন কি অনলাইনে আমার বুক খুলে পাঠাবো আপনাকে?’ রঙ্গনের এই সমস্ত নির্লজ্জ কথায় অদিতির মনে হলো কান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে।রফিক সাহেব যেন ভাগ্নীজামাইয়ের এমন কথায় থতমত হয়ে গেলেন। রঙ্গন ফোস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শান্তভাবে বলল,
– মামা শুনুন আমার বউকে আপনার কাছে রাখতে চাচ্ছেন ভালো কথা কিন্তু প্রতিদিন রাতে আমাকেও আপনার বাড়িতে থাকতে দিতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি চলে আসবো। আপনার ভাগ্নী সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না উনাকে আলাদা রেখে রাতে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না।
রফিক সাহেব অপলক চেয়ে রইলেন রঙ্গনের দিকে।ভাগ্নীর সুখ দেখে চোখজোড়া বুঝি সিক্ত হলো একটু। খুব সংগোপনে সেটা আড়াল করলেন। তারপর শীতল গলায় বললেন ,
– ঠিক আছে তাই হবে।
অদিতি আর আহিনাকে নিয়ে রফিক সাহেব নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।আহিনা তো রঙ্গনকে ছেড়ে যাবে না কিছুতেই। রঙ্গন তাকে বুঝিয়েছে রাতেই বাবাই আসছে। গাড়িতে রফিক সাহেবের পাশে অদিতি বসে আছে।রফিক সাহেব অদিতির মাথায় হাত রেখে বললেন,
– রঙ্গনের সাথে আসলেই তুই অনেক সুখী হবি অদি।রঙ্গনের প্রফেশনের কারণে আমার একটু অমত ছিল কিন্তু ওকে দেখার পরে মনে হচ্ছে ওর থেকে ভালো তোকে কেউ রাখতে পারবে না।
অদিতি প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না তবে ওষ্ঠে ফুটে উঠলো স্নিগ্ধ এক হাসি। যার মানে আমি বলেছিলাম না আমার রঙ্গন বেস্ট।
অদিতি চলে যাওয়ার পরে রওনক সাহেব রঙ্গনকে নিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আলোচনায় বসেছেন।এক পর্যায়ে অতিথি কারা কারা আসবেন সেটা নিয়ে প্রসঙ্গ আসলে রঙ্গন ঠোট বাকিয়ে হাসলো।
– বাবা অতিথি কারা আসবেন সেটা তুমি ঠিক করো আমি তো শুধু একজনকেই নিমন্ত্রণ করবো।
রওনক সাহেব ভ্রু কুচকে ছেলের দিকে চাইলেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
– কাকে?
– আরাফ মাহমুদ।
রওনক সাহেব সন্ধানী দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখলেন।
– কি করতে চাইছো তুমি?
– অদিতির সুখ দেখাতে চাইছি তাকে।তাকে বোঝাতে চাইছি অদিতি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালোটা ডিজার্ভ করে।
– যা করবে অদিতিকে জানিয়ে করো অদিতি ব্যাপারটাতে কমফোর্ট ফিল করবে কি না সেটাও তো দেখতে হবে।
রঙ্গন মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
বেশ অনেকখানি রাত হলো কিন্তু রঙ্গনকে আসতে না দেখে অদিতির যেনো অস্বস্তি হচ্ছে।আহিনাকে অদিতির মামাতো বোন আনিশা তার কাছে নিয়ে রেখেছে রাতে।রফিক সাহেবের দুই ছেলে মেয়ে অনিক আর আনিশা।তারা অদিতির থেকে বয়সে অনেকখানি ছোট। আনিশা ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ছে আর অনিক এইস এস সি দিবে এবার।
রঙ্গনের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অদিতির এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয় সে।ইদানীং মেজাজ তার অল্পতেই খারাপ হয় এরকম শর্ট টেম্পার সে কখনোই ছিলো না। তারপর নিজের স্বল্প স্ফীত উদরে হাত রেখে হেসে ভাবে রঙ্গনের অংশ শরীরে ধারণ করছে তো রঙ্গনের মত মেজাজ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
রঙ্গন যখন এলো তখন রাত বারোটা। ঘরে ঢুকে অদিতিকে খাটের উপরে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে দেখে হাসলো সে।
– ঘুমাননি কেন এখনো?
অদিতি একটা বালিশ ছুড়ে মারলো রঙ্গনকে। রঙ্গন সেটা ক্যাচ করে হাসলো। অদিতির পাশে বসতে বসতে বলল,
– আপনার মামার মত চাইছেন বিয়ের আগে আপনার কাছে না আসি তাই মা’রছেন? চলে যাবো তাহলে।
কথাটা বলে রঙ্গন উঠে দাড়ালো। দরজার দিকে এগোতে নিলেই অদিতির কান্নার শব্দে তড়িৎ গতিতে ফিরে চাইলো। অদিতিকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে দেখে রঙ্গনের কেমন জানি পাগল পাগল লাগলো নিজেকে।তুরন্ত খাটে বসে অদিতিকে কোলের মধ্যে নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় অধর ছুয়ে দিতে দিতে বলল,
– আমি সরি। অনেক সরি।চলে যাচ্ছি না তো। চলে যাবো বলে কি এই মাঝরাতে ছুটে এসেছি। আমি তো মজা করছিলাম। আমার কি সাধ্য আছে আপনাকে ছেড়ে থাকার।কান্না থামান না প্লিজ। এই দেখুন কান ধরছি। আর বলবো না যাওয়ার কথা।
রঙ্গনের কথা অদিতির কর্ণগোচর হলো বলে মনে হলো না।সে তো মনের সুখে হাউমাউ করে কাদতে ব্যস্ত। সেই সাথে রঙ্গনের বুকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি দিতে থাকলো। রঙ্গন এবার শক্ত করে অদিতিকে জড়িয়ে ধরে অধরে অধর ডুবিয়ে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে অদিতি শান্ত হলে রঙ্গন ছেড়ে দিলো। কিন্তু দরজা খোলা থাকার কারণে অদিতির কান্নার শব্দে সবাই চলে এলো এমনকি আনিশার পিছনে আহিনাও বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে।
– বাবাই তুমি মাম্মামকে মে’রেছো? মাম্মাম কাদছে কেন?
রঙ্গনকে খুবই অসহায় দেখালো। রফিক সাহেব রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি বলেছো তুমি ওকে?
রঙ্গন নির্বিকারভাবে বলল,
– আমি আসতে দেরি করেছি তাই কাদছে।
রঙ্গনের জবাবে সবাই মিটিমিটি হাসছে।রফিক সাহেব নিজের অস্বস্তি ভাবটা লুকিয়ে রাগী স্বরে বললেন,
– জানোই যেহেতু তোমাকে ছাড়া রাতে থাকতে পারেনা তাহলে এত দেরি করলে কেন? খবরদার যদি আর কাদিয়েছো তাহলে কিন্তু আমি আমার ভাগ্নীর বিয়ে দেব না তোমার সাথে।
কথাটা বলে রফিক সাহেব আর দাড়ালেন না বেরিয়ে গেলেন। পিছু পিছু বাড়ির বাকি সবাই প্রস্থান করলো। আহিনার তার খালামনির সাথে খুব ভাব হয়েছে তাই সেও আনিশার হাত ধরে নাচতে নাচতে চলে গেলো। কিন্তু যার জন্য এত কাণ্ড ঘটে গেলো সেই অদিতি পুরোটা সময় রঙ্গনের বুকে মুখ গুজে মুখ ভার করে বসেছিলো।এমনকি রঙ্গনের শার্টটাও খামচি দিয়ে ধরে রেখেছে। রফিক সাহেবকে দেখে রঙ্গন সরে আসতে যেয়েও পারেনি।সবাই চলে যেতেই রঙ্গন চোখ নামিয়ে দেখলো অদিতি ঠোট ফুলিয়ে রেখেছে। রঙ্গন হেসে বলল,
– প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে আপনি এভাবে আমার মান সম্মান ডুবিয়ে দিলেন।এমনকি বেবীও ভাবলো আমি আপনাকে বকেছি।
অদিতি আবার ফুপিয়ে উঠলো।নাক টেনে টেনে বলল,
– তোমার পুচকু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারেনা।আমাকে ঘুমাতে দেয়না আমি কি করব!
রঙ্গন হেসে অদিতির চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– পুচকুর বাবাই এজন্য অনেক সরি। আর এমন করবে না। আমি তো পুচকু আর তার মাম্মামের জন্য স্পেশাল জিনিস নিয়ে আসতে যেয়ে দেরি করে ফেলেছি।
অদিতি কৌতূহলী হয়ে তাকালো। রঙ্গন হেসে বলল,
– তখন সেটা আনতেই ঘরের বাইরে যেতে চেয়েছিলাম আর আপনি ভাবলেন চলে যাচ্ছি।
রঙ্গন কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। ফিরে এলো হাতে একটা ট্রে নিয়ে।ট্রেতে ফুচকা সাজানো দেখে অদিতির নেত্রদ্বয় চকচক করে উঠলো। রঙ্গন ট্রে টা অদিতির সামনে রেখে বলল,
– প্লেনে বসে বললেন না বাংলাদেশ এসে ফুচকা খেতে চান। তাই তো সন্ধ্যা থেকে ইউটিউব দেখে ফুচকা বানানো শিখতে যেয়ে দেরি হয়ে গেলো।
অদিতি টুপ করে রঙ্গনের গালে চুমু দিয়ে বলল,
– পুচকু বাবাইকে অনেক ভালোবাসে।
রঙ্গন হেসে দিলো। তারপর একটা ফুচকা নিয়ে অদিতির গালে দিয়ে বলল,
– দেখুন কেমন টেস্ট হয়েছে?
অদিতি উমমম করে শব্দ করে বলল,
– বেস্ট।
এক ট্রে ফুচকা সাবাড় করে অদিতি একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। রঙ্গন অদিতিকে পানি খায়িয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– একটা পারমিশন চাই আপনার থেকে?
অদিতি মাথা তুলে রঙ্গনের দিকে তাকালো।
– আমি আরাফ মাহমুদকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে চাইছি!
অদিতি রঙ্গনের বুকে মুখ গুজে দিয়ে বলল,
– তার আসা না আসায় আমার কিছু যায় আসে না। তোমার বিজনেস পার্টনার হিসেবে তুমি কাকে কি ইনভাইট করবে সেটা তোমার ব্যাপার।
– এইতো রঙ্গবতী তার পুরনো চরিত্রে ফিরে এসেছে।ফুচকা বোধহয় ভালোই কাজ করেছে।
বলে রঙ্গন হাসলো। অদিতি রঙ্গনের বাহুতে চড় মে’রে দিলো।
আরাফ অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিল।এমন সময় রিসিপশন থেকে ফোন এলো রাফিয়ান রঙ্গন এসেছে তার সাথে দেখা করতে।এই অসময়ে রঙ্গনের আসার সংবাদ শুনে ললাটে ভাজ পড়লো।দরজার করাঘাতে আরাফের সম্বিত ফিরলো। দেখলো দরজায় হাসিমুখে রঙ্গন দাড়ানো। আরাফও ভদ্রতার হাসি দিয়ে রঙ্গনকে অভ্যর্থনা জানালো।
– নিমন্ত্রণ করতে এলাম আরাফ সাহেব।
আরাফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রঙ্গনের দিকে তাকালো। রঙ্গন একটি কার্ড আরাফের দিকে এগিয়ে বলল,
– আগামী সতেরো তারিখ আমার বিয়ে আপনি সস্ত্রীক নিমন্ত্রিত।
আরাফের মস্তিষ্ক যেনো কয়েক মুহুর্তের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিলো।তারপর ধীর হাতে কার্ডটা তুলে জোর করে একটা হাসি দিলো। রঙ্গন মৃদু হেসে বলল,
– প্রাইভেসি মেইনটেইন করে অনুষ্ঠান হচ্ছে।জানেনই তো আমার প্রফেশন সম্পর্কে সব সময় মিডিয়া পিছনে লেগে থাকে।তাছাড়া অদিতিও অসুস্থ এজন্য খুব কাছের পরিচিত কিছু মানুষ নিয়েই আয়োজন করা।
– অদিতি অসুস্থ মানে? কি হয়ছে তার?
একটু ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলো আরাফ।রঙ্গন হাসিমুখেই বলল,
– প্রেগন্যান্ট। আমরা দ্বিতীয়বার প্যারেন্টস হতে যাচ্ছি।
রঙ্গনের কথাটা যেনো তীরের মত বিধলো আরাফের হৃদপিণ্ডে। রঙ্গন সেটা উপলব্ধি করে বাকা হাসি দিলো একটা তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,
– আজ তাহলে আসি। সতেরো তারিখ দেখা হচ্ছে।
আরাফ নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো শুধু।রঙ্গন বেরিয়ে যেতেই কাপা কাপা হাতে কার্ডটা খুললো। কার্ডের একপাশে রঙ্গন এবং অদিতির একটা ছবি দেয়া। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে।কি স্নিগ্ধ সে হাসি যেনো পৃথিবীর সব সুখ দুজনের মধ্যে জমা হয়ে আছে।দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কার্ডটা পড়া শুরু করলো সে কিন্তু পড়া শেষে দীর্ঘশ্বাস যেনো আরো দীর্ঘ হলো। নিমন্ত্রণ পত্র আহিনার পক্ষ থেকে লেখা হয়েছে সে তার বাবাই আর মাম্মামের বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে।আরাফের মনে পড়ে গেলো অদিতির বলা কথাটা ‘প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না।’
…………….চলবে?