অদিতির যবনিকা পর্ব-৩২

0
15

#অদিতির_যবনিকা -৩২
#তিশা

বাবাইয়ের আদর পেয়ে আহিনা ভুলে গেলো আরাফ আর রুহির বলা কথাগুলো। রঙ্গনের কোলেই ঘুমিয়ে গেলো সে।আরাফ আর রুহি দেখলো অদিতির স্বপ্নের মতো সাজানো সুখের সংসার।
রওনক সাহেব বেশ ধুমধাম করে পুত্রবধূ বরণ করলেন। কিন্তু সারাদিনের ধকলে অদিতি যেনো কাহিল হয়ে পড়েছে।সারারাত বেশ কয়েকবার বমি করলো সেই সাথে ঘুমাতে পারলো না কোমর আর পায়ের যন্ত্রণায়।রঙ্গন একবার রওনক সাহেবকে ডেকে বেশ কথা শুনিয়ে আসলো যে তার এই ধুমধাম করে বিয়ের চক্করে রঙ্গনের বউ অসুস্থ হয়ে গেছে।রওনক সাহেব মুচকি হেসে ছেলের বকা শুনলেন। তারপর বললেন,
– ডাক্তার ডাকছি।
সেই রাতে ডাক্তার এলো। ডাক্তার বললেন তেমন কোন সমস্যা না একটু রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে। রঙ্গন যেনো বিশ্বাস করলো না। ঠিক করলো সকালে হাসপাতালে নিবে অদিতিকে।রওনক সাহেব হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। জানেন ছেলে কারো কথা শুনবে না।
সকালে অদিতি সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। রঙ্গন ফ্লোরে বসে অদিতির পেটে হাত দিয়ে বলল,
– মাম্মামকে একটু কম জ্বালাতন করো পুচকু।মাম্মাম এত কষ্ট নিতে পারে না জানো তো।
অদিতি রঙ্গনের কথা শুনে মুচকি হাসলো। এমন সময় আহিনা ঘরে এলো। বাবাইকে পুচকুর সাথে কথা বলতে দেখে তার গতকাল আরাফ আর রুহির বলা কথাটা মনে পড়লো। ঠোট ফুলিয়ে রঙ্গনের পাশে বসে পড়লো ফ্লোরে।
– মাম্মাম পুচকুকে আনার দরকার নেই।
রঙ্গন অদিতি হাসিমুখেই তাকালো আহিনার দিকে।অদিতি জিজ্ঞেস করলো,
– কেন?
আহিনা মুখ অন্ধকার করে বলল,
– পুচকু আসলে বাবাই আর আমাকে ভালোবাসবে না।
অদিতির পেটে বুলাতে থাকা রঙ্গনের হাত থেমে গেলো। অদিতির দিকে চমকে তাকালো সে।দ্বিতীয় বার বেবী নিলে প্রথম বেবী মাঝেমধ্যে ইনসিকিউরড ফিল করে এটা স্বাভাবিক কিন্তু সে কিংবা অদিতি কেউ তো আহিনার সাথে সেরকম কোন ব্যবহার করেনি তাহলে আহিনার মনে এরকম ধারণা কেন হলো। রঙ্গন আহিনাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর খাটের উপরে বসে বলল,
– তোমাকে এই কথা কে বলেছে বেবী?
– কাল ওই আংকেল আন্টি বলেছে।
রঙ্গন ভ্রু কুচকে বলল,
– কোন আংকেল আন্টি?
আহিনা সঠিক বলতে পারলো না কোন আংকেল আন্টি। অদিতি থমথমে মুখে রঙ্গনকে বলল ,
– ল্যাপটপ নিয়ে আসো রঙ্গন।কালকের সিসি টিভি ফুটেজ অন করো।
রঙ্গন দ্রুত ল্যাপটপ নিয়ে এলো।তারপর গতকালের সিসিটিভি ফুটেজ অন করলো।বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলো রুহি আর আরাফকে আহিনার সাথে কথা বলতে । রঙ্গনের মুখশ্রী কঠিন হয়ে এলো।অদিতি আহিনাকে বলল,
– বেবী এই আংকেল আন্টি বলেছে?
আহিনা মাথা নাড়ালো। অদিতি আহিনাকে নিজের কাছে টেনে নিলো তারপর বলল,
– বেবী আংকেল আন্টি কি কি বলেছে?
– বলেছে বাবাই আমার স্টেপ ড্যাড। পুচকু এলে বাবাই আমাকে আর আদর করবে না তুমিও করবে না।ওই আংকেলটা নাকি আসল বাবাই।আচ্ছা স্টেপ ড্যাড মানে কি?
রঙ্গনের চোখ মুখ রক্তিম হয়ে এলো। মনে হলো এই মুহূর্তে সব ধ্বংস করে দিবে। কিন্তু সামনে আহিনা আছে বলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অদিতি রঙ্গনের মনোভাব বুঝলো। রঙ্গনের হাত ধরে আশ্বস্ত করলো। তারপর আহিনেকে নিজের কোলের মধ্যে নিয়ে কপালে আদর দিয়ে বলল,
– বেবী মনে আছে তোমার বাবাই আসার আগে তুমি বাবাইয়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না করেছিলে আমি তোমাকে বলেছিল তোমার যে বাবাই সে মাম্মামের সাথে থাকতে চায় না অন্য একটা আন্টির সাথে থাকতে চাই।
আহিনা বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ালো। অদিতি আহিনাকে ল্যাপটপে থাকা আরাফ আর রুহির ছবি দেখিয়ে বলল,
– ওই আংকেলই সেই লোক যিনি তোমার বাবা ছিলেন কিন্তু উনি মাম্মামের সাথে থাকতে চায় না ওই আন্টিটার সাথে থাকতে চাই। এখন বলো তুমি কি বাবাই মাম্মামকে ছেড়ে তাদের কাছে যাবে?
আহিনা কাদো কাদো হয়ে অদিতির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– আমি তোমাকে আর বাবাইকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
তারপর আহিনা অদিতিকে ছেড়ে রঙ্গনের দিকে ঝাপিয়ে পড়লো। রঙ্গনের গলা জড়িয়ে বলল,
– আমার বাবাই বেস্ট। ওই আংকেল পচা।
রঙ্গনের নেত্র যেনো সিক্ত হলো। দুইহাতে জড়িয়ে নিলো আহিনাকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আহিনাকে বুকের উপরে নিয়ে শুয়ে রঙ্গন আহিনার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– বেবী তুমি না সেদিন আমাকে গল্প বললে তোমার বন্ধু রেননের একটা বোন বাবু হয়েছে?
আহিনা হ্যা বলল।রঙ্গন এবার বলল,
– রেনন কি একবারও বলেছে বোন বাবু হওয়ার পরে তার বাবাই তাকে আর আদর করে না?
আহিনা চিন্তিতভাবে না জানালো। রঙ্গন হেসে বলল,
– তাহলে পুচকু আসলে আমি কেনো তোমাকে আদর করবো না। আর পুচকুকে তো আমার থেকে তোমাকে বেশি আদর করতে হবে তুমি না পুচকুর বিগ সিস্টার।
আহিনা খুশি হয়ে হ্যা বলল।
– তাহলে তোমার উচিত পুচকুকে সরি বলা তুমি তো পুচকুকে আসতে মানা করলে এখন যদি রাগ করে পুচকু না আসে।
রঙ্গনের কথায় আহিনাকে বেশ চিন্তিত দেখালো তারপর সোফায় বসা অদিতির কাছে ছুটে গেলো। অদিতির পরিহিত শার্টটা পেটের উপর থেকে সরিয়ে উন্মুক্ত করলো। তারপর সেখানে আদর দিতে দিতে বলল,
– পুচকু রাগ করো না। তাড়াতাড়ি চলে আসো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো।
রঙ্গন অদিতি যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। অদিতি আহিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– বেবী জেনি আন্টি আর রিফাত আংকেলের সাথে খেলো।বাবাই আর আমি একটু বাইরে যাচ্ছি আসার সময় তোমার জন্য গামিস নিয়ে আসবো কেমন?
আহিনা খুশিতে ওকে বলে জেনিফারের কাছে চলে গেলো। রঙ্গন উঠে এসে অদিতির পাশে বসে তার শার্ট ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
– অসুস্থ শরীরে কোথায় যেতে চাচ্ছেন?
– গেলেই দেখতে পাবে।চলো।

সাতসকালে কলিংবেলের আওয়াজে রুহির ঘুম ভেঙে গেলো। দরজা খুলে সামনে রঙ্গন আর অদিতিকে দেখে বেশ চমকালো সে।অদিতি হাসিমুখে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
– ঘুমাচ্ছিলে বুঝি? তা মানুষের সংসারে বিষ ঢেলে শান্তির ঘুম আসে তোমার?
রুহি কিছু বলল না। তবে মনে মনে বেশ ঘাবড়ালো। আহিনা কি কিছু বলেছে অদিতিকে। রুহির ভাবনার মাঝেই অদিতি সোফায় বসতে বসতে বলল,
– তোমার বলার জন্য অপেক্ষা করলাম না নিজেই বসলাম।আসলে এই অবস্থায় বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারিনা। অবশ্য তুমি এই সমস্যা বুঝবে কিভাবে?
রুহির মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। ততক্ষণে আরাফ এসে গেছে। সোফায় রঙ্গন আর অদিতিকে দেখে বেশ আশ্চর্য হলো। অদিতি ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বলল,
– আরে বাহ রুহি আমার সাজিয়ে রাখা সংসারে সংসার করছো এখনো। সবকিছু দেখি আগের মতই।
রুহি বসতে বসতে বলল,
– এখানে কেন এসেছো?
– প্রতারকরা কিভাবে থাকে দেখতে এসেছি।
রুহি আঙ্গুল উচিয়ে বলল,
– দেখো একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।
অদিতি অকস্মাৎ দুইটা থাপ্পড় মে’রে বসলো রুহির গালে। আরাফ কিছু বলরে উদ্যত হলে রঙ্গন পকেট থেকে একটা পি’স্তল বের করে টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে বলল,
– আরাফ সাহেব গৃহিণীদের কথায় আমাদের নাক গলানো উচিত হবে না।
আরাফ যেনো থমকে গেলো রঙ্গনের ঠান্ডা হুমকিতে। রঙ্গন যে একটু হলেও রওনক সাহেবের ল্যাগেসি ধারণ করে বলা বাহুল্য।
অদিতি দাতে দাত চেপে বলল,
– প্রতারকরা নির্লজ্জ হয় এতো তোমাদের না দেখলে বুঝতাম না। আমার নিষ্পাপ পবিত্র আহিনার হৃদয়ে তুমি স্টেপ ড্যাডের মত জিনিস ঢুকাতে চাইছো। নিজে তো মূল্যবোধ কি জিনিস বোঝ না আবার ওই নিষ্পাপ শিশুকেও নিজের মনের ময়লায় জড়াতে চাইছো। শুনে রাখো আরাফ মাহমুদকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অদিতি আগেও রাখতো এখনো রাখে। শুধুমাত্র নর্দমার নোংরায় হাত ময়লা করতে চাইনি এজন্য সবকিছু সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মেয়েকে এর মধ্যে টেনে ঠিক কাজ করোনি। শেষবার বলছি ভালো হয়ে যাও। কম শাস্তি তো পাওনি।শুনেছি পরিবারের কেউ তোমাদের সাথে যোগাযোগ করে না।
রুহি ছলছল চোখে এতক্ষণে কথা বলল,
– তুমি তো আবার মা হতে যাচ্ছো। হয়তো ভবিষ্যতে আবারো হতে পারো তাই বলছিলাম আহিনাকে আমায় দিয়ে দাও প্লিজ।
আকুতিভরা কণ্ঠে জানালো রুহি।অদিতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
– তুমিই না আরাফকে বলেছিলে নতুন জীবন শুরু করবা এখনই সন্তানের ঝামেলা চাও না।এইজন্যই বুঝি আল্লাহ তোমাকে সেই ঝামেলা থেকে চিরতরে মুক্তি দিয়েছে। আহিনাকে নিজেদের কাছে রাখার দিবাস্বপ্ন ছেড়ে দাও তাতে তোমাদেরই মঙ্গল।
অদিতি আর রঙ্গন উঠে দাড়ালো। রঙ্গন আরাফের মুখোমুখি দাড়িয়ে বলল,
– একটা কেন আমার যদি আরো চার পাঁচটা সন্তান হয় তবুও আহিনা আমার কাছেই থাকবে।আমার প্রথম সন্তান আহিনা। পিতৃত্ব শুধো দুফোঁটা স্পার্ম দান করলেই আসেনা। স্টেপ ড্যাড বলে কিছু হয় না। বাবা বাবায় হয়।
অপমানে লাল হয়ে গেলো আরাফ।রঙ্গন আর দাড়ালো না। অদিতির হাত ধরে বেরিয়ে এলো।
রঙ্গন আর অদিতি বেরিয়ে গেলে আরাফ রাগী চোখে রুহির দিকে তাকালো।
– কে বলেছিলো বাড়াবাড়ি করে আহিনাকে ওসব বলতে। এখন দেখলে তো তার পরিণতি। তোমার এই বাড়াবাড়ির জন্য যদি আমার ব্যবসায় কোন ক্ষতি হয় তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না।
কথাগুলো বলে আরাফ চলে গেলো বেডরুমে।সোফায় বসে রুহি নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাতে লাগলো।

গাড়িতে বসে আছে রঙ্গন আর অদিতি।রঙ্গন চিন্তিতভাবে বলল,
– বেবী বড় হলে তো বুঝবে আমি তার নিজের বাবা নই তখন কি আমার থেকে দূরে চলে যাবে?
অদিতি হাসলো তারপর রঙ্গনের কাধে মাথা দিয়ে তার বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,
– বেবী যখন জানবে ততোদিনে সে এটাও বুঝে যাবে তার বাবাই পৃথিবীর বেস্ট বাবা।
রঙ্গনের ঠোটের কোণে হাসি ফুটলো। তারপর বলল,
– আপনি তো ভালোই রাগ দেখাতে পারেন?
– সবই রাফিয়ান রঙ্গনের জিনের কারসাজি।
নির্বিকারভাবে জবাব দিলো অদিতি।রঙ্গন উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। তারপর অদিতির পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
– যাক পুচকু তার মাম্মামকে একটু হলেও বদলাতে পেরেছে।
– দ্রুত জাপান ফেরার ব্যবস্থা করো। আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।
রঙ্গন অদিতির ললাটে অধর ছুয়ে সায় জানালো। তারপর ভাবলো যাওয়ার আগে আরাফ মাহমুদের ধ্বংস নিশ্চিত করে যাবো।রুহি আর আরাফ নিজেরাই গতকাল তাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে এবার দেখব কে বাচায় তাদের।

নোট- অন্তিম পর্ব সন্নিকটে। এরপর #ভীনদেশী_গোলাপ সিজন-০২ নিয়মিত দেয়া হবে।

…………………চলবে?

বিঃদ্রঃ অনুমতি ব্যতীত সকল প্রকার কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।