#দ্বিতীয়জন [১]
#Tahmina_Akther
আদনান ভাইয়ের সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হলো, তখন আমার বয়স মাত্র তেরো।
প্রেম, ভালোবাসা, সংসার; এসব শব্দ তখনও আমার জীবনে কোনো মানে তৈরি করেনি। স্বামী নামক একজন মানুষ সম্পর্কে জানার আগেই হুট করে বিয়েটা হয়ে গেলো।
রাতে বিয়ে, সকালে আদনান ভাই উড়াল দিলেন বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়তে।
তাঁর চলে যাওয়াটা আমাকে আশ্চর্যরকম স্বস্তি দিয়েছিল। কারণটা খুব ছোট, কিন্তু আমার কাছে অনেক বড় একটা ব্যাপার। বিয়ের পরের কয়েক ঘণ্টায় তাঁর আচরণে আমি দমবন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলাম প্রায়।
সকালে বিদায় নেবার সময় বড়ো আম্মু, বড়ো আব্বু, আমার মা-বাবার সামনে আমাকে শক্ত করে বুকে টেনে নিলেন আদনান ভাই। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন
— শুধু মিতাকে পাওয়ার জন্যই আমি বিদেশ যাচ্ছি। নয়তো ওই লেখাপড়া আমার দরকার নেই।
আমার আমানত রেখে যাচ্ছি। যেমন করে রেখে যাচ্ছি, তেমনি যেন ফিরে পাই।
কি রে মিতা, রাখবি তো আমার আমানত হেফাজতে?
ছোট্ট আমি কি বলব বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে ছিলাম। লজ্জা আর অস্বস্তিতে হু করে মাথা নেড়ে ছিলাম।
তাতেই তিনি দারুণ খুশি হয়ে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন
— ভুলে যাস না কিন্তু।
তারপর তিনি চলে গেলেন।
আমি যেন একটু হালকা নিশ্বাস নিতে পারলাম।
আদনান ভাই চলে যাওয়ার পর থেকে সবাই আমাকে চোখে চোখে রাখতে লাগলো।
বুঝিয়ে না বললেও বোঝা যেত, উঠতি বয়সের মেয়ে, কখন যেন প্রেম-ট্রেমে জড়িয়ে পড়ে! তাই তাদের এত নিরাপত্তা আমাকে ঘিরে।
স্কুল গেটের সামনে প্রায়ই ঘুরঘুর করতেন তাঁর বন্ধু তোফাজ্জল ভাই। শুরুতে বিরক্তিকর লাগলেও পরে আমি ওসব ভাবাই ছেড়ে দিলাম।
প্রতিদিন রাত দশটার দিকে ফোন করতেন আদনান ভাই।
— কেমন আছো? পড়াশোনা কেমন চলছে? আমাকে মিস করো?
প্রতিদিনই এই একঘেয়ে প্রশ্ন।
আমি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতাম। হ্যাঁ, না।
কারণ, এসব প্রশ্ন আমার কাছে বিরক্তিকর লাগতো। আমি তখনো বুঝে উঠতে পারিনি, কেউ একজন আমাকে নিজের করে নিয়েছে । আমার মন্দ লাগা, ভালো লাগা সবটাই তার কাছে অনেক একটা ব্যাপার।
এভাবেই সাত বছর কেটে গেলো। আমি এখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।
ইদানীং পারুল চাচীর কথায় হেসে ফেলি।
তিনি বলেন
— তোকে পাওয়ার জন্য আদনান যা করেছে, তা শুধু আমরাই জানি রে মিতা! তোকে তো সারাক্ষণ ধমকের ওপর রাখত, আর ভেতরে ভেতরে তোকে বউ বানানোর আশায় পাগল ছিল। তুই কিছুই বুঝিসনি। এখনকার মেয়েরা তো কত কিছু করে, তোর বয়সে!
এখন আমি বুঝি, আদনান ভাই আমাকে নিজের মতো করে ভালোবাসেন।
তিনি রাগী মানুষ। তাঁর ছবি কখনো চাইলে বলতেন
— আমি বাড়ি এলে তখন দেখিস।
তাঁকে কখনো জোর করতে পারিনি। ভয় পেতাম। তাঁর গলা, চোখ, রাগ সবকিছু আমাকে ভয় আর সম্মানের জালে বেঁধে রেখেছিল।
তবু তাঁকে ভালোবাসতে শিখে ফেলেছিলাম। তাঁর জন্যই অপেক্ষা ছিল প্রতিটি দিনে, প্রতিটি রাত। সাত বছর ধরে।
একদিন দুপুরে কলেজে ক্লাসের সময় হঠাৎ মা’র কান্নাভেজা ফোন
— মিতা, তোর… বাবা আর নেই, মা।
পুরো পৃথিবীটা যেন থেমে গেলো।
শব্দটা গলার ভেতর আটকে গেলো। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না।ব্যাগ ফেলে, ছুটলাম হাসপাতালে।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখি, আমার বাবা নিথর হয়ে শুয়ে আছেন।
মা চোখে পানি, বড়ো আপু মাথা নিচু করে বসে আছে। ডাক্তার বললেন
— হার্ট অ্যাটাক। পৌঁছাতে পৌঁছাতে শেষ।
আমি বসে পড়ি মেঝেতে। বাবার হাত ধরে রাখি। কান্না আসছিল না। শুধু ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
বাবা ছিলেন আমার ভরসার জায়গা। আমার বাবার কাছেই ছিলাম সবচেয়ে নিরাপদ। তাঁর ছায়া ছিল আমার আশ্রয়। সেই ছায়া এক নিমিষেই হারিয়ে গেলো।
সেই দিনটার পর আমি আর আগের মতো নেই।
মা একদিন রাতের বেলা বললেন
— তোর বাবা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলরে তোর জন্য। বলতো, আমার মিতা একদিন ডাক্তার হবে। আদনান ভালো ছেলে। বিদেশে পড়ে এসে যদি চাকরির ভালো ব্যবস্থা করে, তাহলে তুই পড়াশোনা চালিয়ে যাবি।
মায়ের কথায় চোখ ভিজে যায়। বাবার স্বপ্ন… আমার ঘাড়ে রেখে যাওয়া দায়ভার।
আমি চুপ করে রই।
কিছু বলার মতো ভাষা তখন আমার ছিল না।
আদনান ভাই ফোন করেছিলেন সেদিন রাতে।
— খবরটা পেয়েছি। ছোট আব্বুর জন্য খুব খারাপ লাগছে মিতা। আমি আসার চেষ্টা করছি। তুই শক্ত থাকিস, প্লিজ। তোর কান্না সহ্য করতে পারি না রে মিতা!
আমি কেবল বলেছিলাম,
— বাবা ছিল আমার ভরসার স্থল। এখন আমি ভীষণ একা আদনান ভাই।
ফোনের ওপাশে নীরবতা । তারপর শুনলাম তাঁর দীর্ঘশ্বাস।
আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
আমার পৃথিবী থেকে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা চলে গেছে।
আর কেউ আমাকে “মা” বলে ডাকবে না। আর কেউ আমার মাথায় হাত রাখবে না।আর কেউ না। এই পৃথিবীতে আমি আর বাবার সেই ছোট্ট মিতা নই। আমি এখন একা, দায়িত্বের ভারে নুয়ে পড়া মেয়ে।
বাবার মৃত্যুর পর একমুঠো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আমার পৃথিবী।
সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবী, জীবন এসব শব্দের কোনো মানে আর নেই। যখন মানুষটাকে হারিয়েছিলাম, আমার সমস্ত পৃথিবী যেন তার সঙ্গেই চলে গিয়েছিল। তবে বাবার স্বপ্নটা আমার সাথে ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, আমি ডাক্তার হবো। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য শুরু হলো নতুন সংগ্রাম।
মা ভেঙে পরেছেন , কিন্তু তিনি চুপ করে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিচ্ছিলেন। বড়ো আপু, ছোটো ভাই।সবাই যেন নিজেদের মতো করে সয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি জানতাম, আমি আর সেই মিতা নইই, যে হাসতে জানতো। এখন আমি পরিণত হয়ে যাচ্ছি যে।
কলেজে নিয়মিত যাচ্ছি। পড়াশোনা, পরীক্ষা, সব কিছুই যেন এক ধরনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মাঝে মাঝে মনে হতো, কিছুই যেন আর ভালো লাগছে না। তবে যখন বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে ডুবে যেতাম, সেসময় মনে হতো, বাবার স্বপ্নটা পূরণ করেই ছাড়বো। বাবার জন্য, মা’র জন্য, আর নিজের জন্য।
আর প্রতিদিন রাতে আদনান ভাইয়ের ফোন আসত।
একদিনও বাদ পড়েনি। ফোনে কথা বলতে বলতে, আমার মনটা কিছুটা শান্ত হতো। তিনি বলতেন,
— কেমন আছিস মিতা? পড়াশোনা কেমন চলছে?
আমি কিছুটা শ্বাস ফেলে বলি,
— হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। বাবার কথা মনে পরছে অনেক। আমি চেষ্টা করছি তাকে ভুলতে৷ কিন্তু, চাইলেই কি আর বাবার স্মৃতি ভুলতে পারা যায়?
তিনি তখন সান্ত্বনা দেন,
— তোর বাবা চাইতেন, তুই বড় কিছু হো। তুই জানিস, তুই যা চাস তাই পাবি। তোর পাশে আমি আছি সবসময়।
এভাবেই তাঁর কথা আমাকে অদৃশ্য এক শক্তি দিতো।
যতই দিন যাচ্ছিল, ততই লেখাপড়া এবং পরীক্ষায় মনোযোগী হয়ে উঠছিলাম। আমি জানতাম, আদনান ভাই আমাকে স্বপ্ন দেখাতে চাইছেন। তাঁর কথাগুলো ছিল জীবনের প্রতি সাহস, আস্থা আর শক্তির জোগানের মত।
এতগুলো মাস, বছর মাঝে মাঝে মনে হতো, আদনান ভাই যদি আমাকে পাশে থাকতেন! কিন্তু যখনই এমন চিন্তা মাথায় আসতো, তাঁর ফোনে ভেসে আসত সেই শান্ত কণ্ঠ।
— মিতা, তুই জানিস না, আমি কতটা গর্বিত তোর জন্য।
শুধু একটাই আফসোস ছিল, তিনি ফিরে আসতে পারছিলেন না।এটা ছিল আমাদের দুইজনের মাঝের এক অব্যক্ত বেদনা। তিনি চাইতেন ফিরতে, কিন্তু তার অনেক বাধা ছিল।
আর আমি, নিজের স্বপ্নগুলো ঠিকমতো দেখতেই চাইছিলাম। বাবার অসম্পূর্ণ স্বপ্নটাকে শেষ করতে চাইছিলাম।
বিকেলে যখন আমি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতাম, রাতে বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, আকাশের মতো বিশাল কিছু আমার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে এই অপেক্ষা বেশ দীর্ঘ মনে হতো। মাঝে মাঝে ভাবতাম, যদি আদনান ভাই আমার পাশে থাকতেন, তাহলে কতই না শান্তি পেতাম।
তারপরও, আমি জানতাম, এখন আর কিছু করতে পারি না। আমি যা করতে পারি, তা হলো নিজের ভিতরের শক্তিকে খুঁজে বের করা। তাঁর ফোনের কথাগুলো আমার জীবনে আলো হয়ে ঝলকাতে থাকতো, যখনই আমি থেমে যেতে চাইতাম।
একদিন, শেষ পরীক্ষা দেওয়ার পর, আমি ফোন করে বললাম,
— আদনান ভাই, আমি যা চেয়েছিলাম, সেটি পেতে যাচ্ছি। আমার ইন্টার পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট এলেই মেডিকেল ভর্তিযুদ্ধে যে নামতে হবে।
তিনি হেসে বললেন,
— তুই খুব ভালো করেছিস, মিতা। কাকা যা চেয়েছিলেন, তুই তা করতে যাচ্ছিস এটাই তো গর্বের বিষয়।
আমি হাসলাম, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে কষ্ট ছিল।
আদানান ভাই ফিরে আসতে পারতেন না, জানতাম।
কিন্তু তাঁর বিশ্বাস আর ভালোবাসা আমার সঙ্গে ছিল, এই কথাটা ছিল আমার বড় আশ্রয়।
তবে এখন, সামনে অপেক্ষা করছিল জীবনের নতুন অধ্যায়। একটা নতুন শুরু।
চলবে…