দ্বিতীয়জন পর্ব-৩+৪

0
13

#দ্বিতীয়জন [৩]
#Tahmina_Akhter

— আমি কি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মিতা? আমার চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?

আদনান গলা নরমস্বর , তার চোখে অস্থিরতা স্পষ্ট।

আমি চুপ করে আছি। মাথা নিচু করে বসে আছি শিশুর মতো। কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না।

আদনান আস্তে করে আমার হাতটা নিজের দুই হাতের ভেতর নিয়ে বললেন,

— তুই তো জানিস, আমি তোর জন্য কতটা পাগল! কিন্তু আজ আমি শুধু জানাতে এসেছি, তুই চাইলে আমি থাকব, না চাইলে ফিরে যাব।

আমার চোখের কোনা ভিজে যাচ্ছে।
চোখের পানি গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে এল।

আদনান বিস্মিত হয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন।
তারপর নরম হাতে আমার গাল ছুঁয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললেন

— পাগলি! কান্না করিস কেন? আমি তো তোকে কাঁদাতে আসিনি। তোর চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না। আর তুই কিনা

তার গলা ভেঙে আসে।আমি কিছু বলি না। বলবার ভাষা নেই।

— দেখ, বাড়ির সবার কোনো আপত্তি নেই।

আদনান আবার বললেন,

— তোর মা, আমার মা-বাবা সবাই তোর পাশে আছে। এখন শুধু তুই আমাকে বল, তোর সিদ্ধান্ত কী? আমি তোকে কখনো ফোর্স করব না, মিতা। হ্যাঁ কিংবা না। তুই যেটা চাইবি, আমি সেটাই মাথা পেতে মেনে নেব।

তার চোখে কোনো রাগ নেই, দাবি নেই, আছে শুধু অনুরোধ।
আমার জন্য তার অপেক্ষার ভরসা।

আদনান আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

আমি মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম।
তার চোখে ভর করে কি যেন একটা ভরসা এসে ধরা দিল আমার চোখে। এই মানুষটা তো আমায় ভাঙতে নয়, গড়তে চায়।

আমি কিছু বলার আগেই আদনান আস্তে করে বললেন

— তোর হ্যাঁ না যাই হোক, আমি তোকে ভালোবাসি, মিতা। এটা কোনোদিনও বদলাবে না।

__________

মিতা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, সে আদনানের সঙ্গে রাশিয়ায় চলে যাবে। তার মা, বড়ো মা-বড়ো আব্বু সবাই রাজি। তাদের সমর্থন আর আদনানের ভালোবাসা মিতাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সাহস জুগিয়েছে । সে জানে, আদনানই এখন তার জীবন। তার স্বামী, তার সঙ্গী, তার সহযাত্রী সবকিছুই। মিতার চোখে আর কোনো দ্বিধা নেই।

যতই মনে হোক, সে জানে, তার জীবনের পথ এখন একটাই আদনানের পাশে থাকা। তাকে ছাড়া কিছু ভাবা সম্ভব নয়। আর তাই, সে হাসিমুখে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গে রাশিয়ায় যাব।

আদনান তার প্রিয় মিতার মুখে ‘হ্যাঁ’ শুনে এক চমৎকার আনন্দে বেঁধে ফেলল নিজেকে।
তার চোখের কোণে গর্ব, সুখ আর ভালোবাসার এক অজানা মিশেল। সে আরও বেশি আবেগে ডুবে যায়।
মিতার কপালে এক নিঃশব্দে চুমু দেয়, যেন সেই চুমুতে তার সমস্ত অনুভূতি, তার ভালোবাসা প্রকাশ পায়।
চুমুটা এত কোমল, এত মিষ্টি, যেন কোনো প্রকার শব্দ ছাড়াই সে মিতার সব কষ্ট, সব আবেগ বুঝে নিচ্ছে।

মিতা তৎক্ষণাৎ লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। তার চোখে নতুন এক ধরণের অনুভূতি আসে, সেই পুরানো শৈশবের মতো। এক ধরনের অস্থিরতা, এক ধরনের অদৃশ্য আনন্দ, যে আনন্দটা কখনো কখনো মনের গভীরে লুকানো থাকে।
মিতা চমকে যায়, আর কাঁদতে ভুলে যাওয়া মিতার চোখ থেকে ঝরে পরে আনন্দের অশ্রু।

আদনান তার চুমুর পর মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, আর বললেন,

— তুই জানিস? তোর এই একটা ‘হ্যাঁ’ এর জন্য আমি কত দিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম?

মিতা যেন নিজের অনুভূতিগুলো শব্দের মধ্যে বাঁধতে পারছিল না, কিন্তু সে জানে, এই মুহূর্তে তার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন।

রাতের আকাশে গ্রামের বাড়ি যেন এক অন্য রকম শান্তি । দূরে কোথাও একটি কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। দোতলা বাড়ির উঠোনের পাশ দিয়ে একেকটা বায়ু প্রবাহে ভেসে আসে গরম বাতাস। বৈশাখ মাসের ঘন গরম হাওয়া, সারা শরীরের তীব্র গরমের ছোঁয়া । রাতের প্রকৃতির মধ্যে গভীর এক নিস্তব্ধতা। কেবল রাতের শব্দগুলো ঝিঁঝিঁ পোকার টুংটাং, দূরে শেয়ালের ডাক, আর পেছনের বিল থেকে মৃদু বাতাসের শো শো আওয়াজ।

দোতলা বাড়ির প্রাচীরের এক কোণে দোলনা লাগানো। উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো সেগুন কাঠের দোলনায় একসাথে বসে আছে আদনান এবং মিতা। বাতাসের ঝাপটায় মিতার চুল হালকা হিল্লোলিত হয়ে উঠছে। সেই স্নিগ্ধ বাতাসে মিতার মুখে এক ধরনের প্রশান্তি, যেন বছরের পর বছর জমে থাকা উত্তেজনা সরে যাচ্ছে।

আদনান তার হাতে ধীরে ধীরে দোলনাটি দোলাচ্ছেন, মাঝে মাঝে মিতার দিকে তাকিয়ে, তার নরম হাসি চোখে ফুটে উঠছে। মিতা শান্ত হয়ে, কিছুটা চোখ বন্ধ করে, বাতাসে ভেসে যাওয়া নিস্তব্ধ রাতের শব্দ শুনছে। দোলনাটির আস্তে আস্তে একটানা দোলানো যেন তাদের মধ্যে অজানা একটি সুর তৈরি করছে। এমন এক সুর যা শুধুমাত্র তারা দুইজনই শুনতে পাচ্ছে, অন্য কেউ নয়।

চাঁদের আলো তাদের মুখের ওপর পড়ে, মিতার মুখে এক রকম উজ্জ্বলতা এনে দেয়। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আসে যেন তাদের মধ্যে, সবকিছু থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কথা বলে না, তবে তাদের মধ্যে কিছু অপরিসীম কথা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে যায়। আকাশে মেঘেদের কিছু ছায়া এখনও অল্প অল্প ভেসে যাচ্ছে।

এক সময় মিতা আদনানের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, যেন পুরো দুনিয়া তার চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আদনান তার দোলনা ঠেলে আবার একটুখানি হাসেন, যেন মিতাকে আরও বেশি কাছে টানার চেষ্টায়। কিন্তু, এই এক মুহূর্তেরও গভীরতা ছড়িয়ে গেছে পুরো প্রকৃতিতে, যেখানে সময় থেমে গেছে এবং সব কিছু তাদের চারপাশে একটা সুস্বাদু নীরবতায় গাঢ় হয়ে গেছে।

বেশ রাত হয়ে গেছে। মিতা আর আদনান নিজেদের নিজ নিজ কক্ষে ফিরে গেছে, যেন কিছুটা সময় নিজস্বতার জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছিল, যেন সারা পৃথিবী একসাথে থেমে গেছে, অপেক্ষা করছে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। আগামীকাল তাদের ওয়ালিমার আয়োজন। একটি অনুষ্ঠান যা তাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়কে অফিসিয়ালি স্বীকৃতি দেবে। আর আদনান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই আয়োজনের পর মিতা তার স্ত্রী হিসেবে তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করবে।

আদনান জানিয়ে দিয়েছে,

— আমার শখ ছিল, মিতা। তোমায় বৌ সাজে দেখার। মানুষ এক জীবনে একবারই বর-কনে সাজে। সে সুযোগ আগে হয়নি, কারণ তুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলে। কিন্তু আজকের পর থেকে তুমি আমার সঙ্গে সেই সব পূর্ণতা পাবে যেগুলো অপূর্ণ ছিল।

মিতা তার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে যায়, চোখের কোণে অস্থিরতা দেখা দেয়। কিন্তু তারপর সে বুঝতে পারে, আদনান যা বলছে তা সত্যিই হৃদয়গ্রাহী।
আজ, সেই সময় এসেছে। যেখানে তাদের সম্পর্ক কেবল ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সামাজিকভাবে মিতাকে আদনানের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। সবকিছু যেন এক নতুন মাত্রা পেতে চলেছে।

পরদিন সকালে, সূর্যের প্রথম আলো মিতার ঘরটিতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে, আর দিন শুরু হচ্ছে। আদনান তার কক্ষে এসে মিতাকে জানাল,

— ওয়ালিমার জন্য রেডি হও, আমি চাই এই দিনটা তোমার জন্য বিশেষ হয়ে উঠুক। তোমাকে বৌ সাজিয়ে, তোমার পাশে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চাই।

মিতা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠে, কিন্তু মনে শান্তি অনুভব করে। আদনান নামমক এক প্রেমিকের স্বপ্ন পূরণ হবে আজ।

এই সিদ্ধান্ত যেন তাদের সম্পর্কের জন্য নতুন সূচনা। তারা একে অপরের জীবনজীবিকার অংশ হতে চলেছে, তাদের সম্পর্কটি আরও দৃঢ়, আরও গভীর হতে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের দোতলা বাড়িটা যেন আজ আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। উঠোন জুড়ে রঙিন লাইট, ফুলের তোড়ায় সাজানো গেট, আর প্যান্ডেল ভর্তি হাস্যোজ্জ্বল মুখ। বড়ো পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে ওয়ালিমার। এমন আয়োজনে শুধু আত্মীয়স্বজনই নয়, আশপাশের এলাকার সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। আদনানের ইচ্ছেতেই সব এত সাজানো–গোছানো।

সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়িতে গমগমে পরিবেশ। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে বিরিয়ানি আর কাবাবের গন্ধ। বাবুর্চির দল ব্যস্ত, বাড়ির মেয়েরা ব্যস্ত মিতাকে সাজাতে।

মিতা যেন সত্যিই আজ একটা রাজকন্যা। লাল–সোনালি জরির লেহেঙ্গায়, মাথায় টিকলি, হাতে মেহেদি। সাজটা এত নিখুঁত যে সবাই তাকিয়ে থাকছে। মিতার চোখে এক ধরনের অনুচ্চারিত আনন্দ আর লাজুক কোমলতা। আদনান, সাদা শেরওয়ানি আর পাগড়িতে যেন হুবহু নবযুবক বর। তার চোখে মিতার জন্য প্রশংসা আর ভালোবাসা ফুটে উঠছে।

এরপর কাজি সাহেব এলেন। আবার নতুন করে, সবাইকে সাক্ষী রেখে পড়ানো হলো বিয়ের কাবিননামা।
এইবার আর নয় কোনো ছেলেবেলার চাপে পড়ে যাওয়া বিয়ে। এবার এই বিয়ে সম্পূর্ণ ভালোবাসা আর সম্মতিতে হয়েছে।

আদনান আর মিতা একে অপরকে চেয়ে থাকল, যেন চোখেই কথা বলছে

—এবার সত্যি করে শুরু হল আমাদের পথচলা।

বিয়ের পর অতিথিরা একে একে এসে নববধূ আর বরকে দোয়া দিয়ে যাচ্ছে

— আল্লাহ্‌ তোমাদের সুখী করুক।
— জীবনের সব কষ্ট যেন এই হাসিমুখে গলে যায়।

একটা অপূর্ণ অধ্যায় যেন পূর্ণতা পেল এই সন্ধ্যায়।

রাত যত বাড়ে, হাসির রোল, বাজনার শব্দ আর অতিথিদের পদচারণায় বাড়ি যেন উৎসবস্থল হয়ে ওঠে।
মিতা আর আদনান ; আজ তারা শুধুই স্বামী-স্ত্রী নয়, দুইটা হৃদয়ের মিলন, যা সময়, দূরত্ব আর সমাজের চোখ উপেক্ষা করেও স্থায়ী হলো।

ওয়ালিমার এই রাতটা হয়ে রইল তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতির একটি, যেটা তারা হয়তো সারাজীবন মনে রাখবে।

বাসরঘরটা আজ অন্যরকম সাজানো। বিছানায় লাল-সাদা গোলাপ ছড়ানো, জানালায় পর্দার ফাঁকে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়েছে। মিতা বসে আছে চুপচাপ। ওর পরনে নতুন শাড়ি, হাতে মেহেদি। মুখে লাজুক হাসি থাকার কথা, কিন্তু এখন তার স্থানে জায়গা নিয়েছে অজানা অস্বস্তি। বারবার দরজার দিকে তাকিয়ে মনে মনে শুধু একটাই প্রশ্ন

—আদনান এলো না কেন?

সময়ের কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে। আধঘণ্টা… তারপর এক ঘণ্টা। কারও পায়ের শব্দ নেই, কারও ছায়া নেই। মিতার বুক ধীরে ধীরে ধকধক করে উঠছে।

হঠাৎ দরজায় টোকা।

“অদিতি” আদনানের ছোটবোন, ঘরে ঢুকে কিছুটা হেঁচকির মতো গলায় বলল,

— ভাবি, আদনান ভাই তো বাসায় নেই!

মিতা চমকে তাকায়, চোখ কুঁচকে আসে,

— মানে? কোথায় গেছে?

অদিতি মুখ নামিয়ে ফেলে।

— কেউ জানে না ভাবি। আমি খুঁজে খুঁজে সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। গেটের দারোয়ান বলল, বিকেলের পরেই নাকি উনি বের হয়েছেন। এখনও ফেরেননি।

মিতার মনে কেমন একটা কু ডাক দেয়। বুকের ভেতর কেমন একটা ঠান্ডা শীতলতা জমে উঠছে। সে কিছু বলতে পারছে না। শব্দ যেন গলার কাছে এসে আটকে গেছে।

বাড়িতে উপস্থিত আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে এবার কানা-ঘুষা শুরু হয়ে গেছে।

— আদনান কই গেলো রে?

— এই বাসর রাতে ছেলেটা বাড়ি ছাড়া? কিছু তো একটা হয়েছে!

কেউ মুখে না বললেও সবার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ। মিতা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখে জল জমে উঠেছে, কিন্তু সে তা শক্তভাবে চেপে ধরে। কাঁদবে না এটা তার দিন, তার রাত। সে ভেঙে পড়তে চায় না। কিন্তু আদনান কেন নেই? কোথায় গেলো সে?

একটা রাত, যে রাত তাদের নতুন জীবনের শুরু হওয়ার কথা ছিল,, সেই রাতটাই যেন ভেঙে পড়ছে অজানা কোনো ঝড়ে।

চলবে…

#দ্বিতীয়জন [৪]
#Tahmina_Akhter

জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করার রাতেই আদনান বড়ো ধরণের এক্সিডেন্ট করে ফেলল। আদনানকে খোঁজার জন্য যখন সবাই খোঁজখবর লাগানো শুরু করে ঠিক তখনি আননোন নাম্বার থেকে কল আসে আদনানের বাবা রহিম সাহেবের কাছে। কল রিসিভ করতেই ছেলের সর্বশেষ অবস্থা শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পরলেন। তারপর, আদনানের মা, এবং মিতাকে নিয়ে রওনা হলেন মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। উনারা যখন হসপিটালে পৌঁছালেন তখন আদনানের অপারেশন চলছিল। বেশ কয়েকঘন্টার অপারেশনের পরে আদনানকে পোস্টঅপারেটিভ রুম থেকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়। সারারাত অতিবাহিত হয়ে দুপুর যখন বারোটা ঠিক তখনি আদনানের৷ জ্ঞান ফিরে আসতে শুরু করে। জ্ঞান ফেরার পর আদনান সবার আগে মিতার মুখখানা দেখল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার আগে ধীরে ধীরে টের পেলো তার শরীর ভালো নেই। অসহনীয় যন্থনা তার পুরো শরীরজুড়ে। শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় ইনজুরি হয়েছে। ডানহাতটি প্রায় অকেজো। বাম পাজরের দুটো হাড় ভেঙে গেছে।

আদনান বিমর্ষ চোখ তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমার দিকে। মনে হচ্ছে কতকাল তার সঙ্গে দেখা হয়নি! মিতার পরনে এখনও লাল শাড়ি। এলোমেলো হয়ে আছে সাজ। তবুও তার বউটাকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে। চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে তবুও চোখ খুলে রাখছে। কারণ, এখন ঘুমানোর সময় নয়। মিতার সঙ্গে অনেক কথা আছে তার। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা আদনান তখন জীবন-মরণের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে।

মিতার এক হাতে পাসপোর্ট এবং টিকিট রাশিয়ায় যাওয়ার সকল ডকুমেন্টস। এবং অন্যহাতে আদনানের হাতে। মিতা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে আদনানের হাতটা। যেন হাত আলগা হলেই আদনান হারিয়ে যাবে।

—তোমার স্বপ্নকে হারাতে দেই কী করে মিতা? আমি তো শুধু চেয়েছিলাম, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে। তুমি First Moscow State Medical University (Sechenov University) থেকে স্কলারশিপ পেয়েছো। এখন জিজ্ঞেস করো না কিভাবে পেয়েছো?অদিতির কাছ থেকে জেনে নিয়ো সব। কাগজপত্রগুলো আমাকেই কালেক্ট করতে হত।কাগজপত্রগুলো আজই গোছাতে হতো কারণ সময় খুবই কম। ঠিক এক মাস পর ভার্সিটিতে তোমার প্রথম সেশন শুরু হবে তাই…

— তাই আপনি কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে গেলেন? কাউকে অন্তত সঙ্গে নিতে পারতেন। আজ এই কাগজপত্রের জন্য যদি আপনার কিছু হয়ে যেত…?

মিতা কথাগুলো বলতে বলতে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে। বুকের সব কান্না যেন একসাথে বেরিয়ে আসতে চায়। আদনান বুকে জমানো কষ্ট আর ভালোবাসা একসাথে মিশিয়ে বলে,

— আমার কিছুই হয়নি পাগলি। কেঁদো না। শুধু একটা কথা মনে রাখবে তোমার স্বপ্ন এখন তোমার একার না, এ স্বপ্ন এখন তোমার স্বামীরও। যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে পৃথিবীর এক নামকরা ডাক্তার হিসেবে দেখতে চায়। পূরণ করবে তো আমার স্বপ্ন, মিতা?

মিতা নিজের কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে আদনানের কপালে হাত রাখল। চোখ ভিজে গেছে কান্নায়। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,

— আমি ডাক্তার হবো, আদনান । পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হবো। আপনার স্বপ্ন, আমার স্বপ্ন এখন আমাদের স্বপ্ন। আপনি আমাকে যেভাবে ভরসা করেছেন, ভালোবেসেছেন, আমি সেটা বৃথা যেতে দেব না।

মিতা ধীরে ধীরে আদনান ভাইয়ের হাত নিজের বুকের উপর টেনে রাখল।

— আপনি যেমন বলেন না, “পাগলি, কান্না করিস না,” আজ থেকে আমি আর কাঁদব না। আপনার জন্য, আমাদের জন্য, আমার পরিবারের জন্য আমি নিজেকে গড়ে তুলব। আপনি কেবল একটা কথা মনে রাখবেন।আপনার এই ছোট্ট বউটা আর ছোট নেই। এখন সে একজন দায়িত্বশীল পুরুষের স্ত্রী ।

আদনান চোখ বন্ধ করে একফোঁটা অশ্রু ফেলল। বুকভরা প্রশান্তি, গর্ব আর ভালোবাসায় সে যেন মিতার প্রতিটি শব্দকে হৃদয়ে গেঁথে রাখল।

রহিম সাহেব দু’হাতের আঙুল একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে কেবিনের ছোট্ট কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। চোখে গম্ভীর দৃষ্টি, মুখে চাপা চিন্তার ছাপ। পাশের টেবিলে রাখা আদনানের একগুচ্ছ রিপোর্ট। সেই রিপোর্টের প্রতিটা পৃষ্ঠা যেন একেকটা দুঃসংবাদ তার মনে চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ডক্টর হানিফ মাহমুদ কেবিনে ঢুকে সোজা এসে বসলেন টেবিলের ওপারে। মাথায় হালকা টাক, গাঢ় ফ্রেমের চশমা আর গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো। রিপোর্টগুলো হাতে তুলে এক নজর দেখে বললেন,

— রহিম সাহেব, কিছু রিপোর্ট এসেছে। বলবো, কিছুটা ভরসার জায়গাও আছে, আবার কিছু দুশ্চিন্তার বিষয়ও আছে।

রহিম সাহেব কাঁধ সোজা করে বসলেন, গলায় উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে।

— বলুন হানিফ সাহেব। সত্যটা বলুন। আমাকে গোপন না করে জানান।

ডক্টর হানিফ এক পৃষ্ঠা সামনে এনে বললেন,

— আপনার ছেলের পাজরের হাড় দু’টি ভেঙে গেছে, এবং হাতের স্নায়ুতে একটা জটিল আঘাত লেগেছে। বিশেষ করে ডান হাতটা নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত। আগামী কয়েক সপ্তাহ বেশ জটিল চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে তাকে।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ডক্টর হানিফ যোগ করলেন,

— তবে আশার কথা হচ্ছে, সে এখন ভালো আছে, মানসিকভাবে অনেকটাই স্থিত। এই মানসিক স্থিতি থাকলে শারীরিক সেরে উঠার হার অনেকটাই বাড়ে।

রহিম সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। চোখেমুখে সাহস ফিরে এল। বললেন,

— আমার ছেলেটা মানসিকভাবে সবসময় শক্ত। ওর পাশে আমরা সবাই আছি, কিন্তু আপনি ডাক্তার হিসেবে বলুন, আমার ছেলের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা?

ডক্টর হানিফ একটু থেমে বললেন,

— সময় লাগবে, কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। ওর বয়স কম, ইচ্ছাশক্তি প্রবল, এবং যদি পাশে মিতার মতো একজন থাকে, তাহলে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়।

রহিম সাহেব চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা দোয়া করে ফেললেন মনে মনে। তারপর ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— আমার ছেলেকে সুস্থ করে দিন, হানিফ সাহেব। ওর সামনে অনেক দায়িত্ব,অনেক স্বপ্ন অপেক্ষা করছে।

ড. হানিফ খানিকটা নীরব হয়ে গেলেন। হাতে থাকা শেষ রিপোর্টটা টেবিলে রেখে কাগজের উপর আঙুল ছুঁইয়ে বললেন,

— আর একটা জিনিস, যেটা আপনাকে জানানো জরুরি, কিন্তু আমি খুব সাবধানে বলছি।

রহিম সাহেবের মুখ কড়কড়ে হয়ে গেল। বুকটা ধক করে উঠলো, বললেন,

— বলেন, ডাক্তার সাহেব। দয়া করে কিছু লুকাবেন না।

ড. হানিফ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

— এক্সিডেন্টের সময় আদনান সাহেবের মাথায় যে চোটটা লেগেছিল, সেটা শুরুতে তেমন গুরুতর মনে হয়নি। কিন্তু সিটি স্ক্যান রিপোর্ট বলছে,একটা ছোট্ট হেমাটোমা (রক্ত জমাট) তার ফ্রন্টাল লোবের এক কোণে জমেছে। এখনই সেটা ভয়াবহ না হলেও..

— মানে? এখনই না হলেও?

— মানে এটা বাড়তেও পারে, আবার শরীর যদি নিজে থেকে ঠিকমতো রক্ত শোষণ করে নিতে পারে, তাহলে কোনো জটিলতা হবে না। কিন্তু যদি সেটা না হয়, তাহলে সার্জারি করতে হতে পারে। এবং সেক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থেকেই যায়, যেমন স্মৃতিভ্রষ্টতা, আচরণগত সমস্যা, বা দৃষ্টিশক্তির ওপর প্রভাব।

রহিম সাহেব থমকে গেলেন। এক মুহূর্তে মনে হলো যেন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মুখে কোনো শব্দ নেই, কেবল নিঃশ্বাসের ভারি চাপ। তিনি বললেন,

— মিতা জানে?

ড. হানিফ মাথা নাড়লেন,

— না, এখনও না। আপাতত আমরা ওকে বলিনি। আদনান নিজেও জানেন না পুরো ব্যাপারটা। ও এখনো স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে, স্মৃতি ঠিক আছে। তবে পর্যবেক্ষণে রাখছি। আজ রাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

রহিম সাহেব চুপচাপ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার বাইরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

— আমি ওকে হারাতে পারবো না, ডাক্তার সাহেব। আমার বিশ্বাস আপনি সব করবেন যা যা করণীয়।

ড. হানিফ কেবল বললেন,

— আমরা চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ। দোয়া করবেন।

***★****

আদনানের অনুরোধে মিতা বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হলো। দু’দিন ধরে হসপিটালে ছিল মিতা। গোসল, খাওয়াদাওয়া, ঘুম ঠিকমত কিছুই হয়নি। আদনানের ভীষণ মায়া হচ্ছিল তাই জোর করেই মিতাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তবে যাবার আগে মিতা আদনানের কপালে হাত রেখে বলে এসেছে, আপনি অপেক্ষায় থাকুন আমি বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব। কেন যেন আপনাকে এক পলকের জন্য কোথাও রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। আদনান দুষ্টুমির সুরে বলল,

— আর মাত্র কয়েকটা দিন মিতা। তারপর আর কোথাও যেতে হবে না আমাকে ছেড়ে। একসাথে একই বাসার ছাঁদের তলে আমরা ভালোবাসার চাদরে মুড়ে থাকব।

মিতা ভীষণ লজ্জা পায়। লজ্জা থেকে বাঁচতে কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য ছুটে যাচ্ছিল। এময়সময় আদনান ডাকল,

— মিতা? এই বউ?

মিতা থমকে দাঁড়ায়। চোখদুটোর দৃষ্টি মেঝেতে তবুও আদনানের বেডের দিকে এগিয়ে যায়। আদনান তার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বউটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।

— আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে যাও তো।

— হ্যা?

— হ্যা নয়। যেটা বলেছি সেটা করো।

— কোনো কিন্তু নয়।

মিতা লজ্জা পেয়ে এদিকসেদিক তাকায়। তারপর টুপ করে আদনানের কপালে চুমু খেয়ে দৌঁড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

মিতা কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়, কিন্তু করিডোরে এসে আর এক পা ফেলতে পারে না। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার ঠোঁটে তখনো আদনানের কপালের স্পর্শ। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

—আল্লাহ, ওকে সুস্থ করে দাও। আমি শুধু ওর বউ হয়ে থাকতে চাইওর ছায়া হয়ে বাঁচতে চাই।

অন্যদিকে আদনান বিছানায় শুয়ে মুচকি হাসে। নিজের বুকের উপর রাখা কাঁপা কাঁপা ডানহাতটা মিতার চুমুর জায়গায় নিয়ে যায়।

— বউটা আমার, শুধু আমার।

ফিসফিস করে বলে সে। তারপর চোখ বুজে ফেলে যেন সেই স্পর্শ নিয়ে স্বপ্নে হারিয়ে যেতে চায়।

হসপিটালের কথা মনে পড়তেই ফের লজ্জায় লাল হয়ে যায় মিতার মুখখানা। গোসল করে কেবল ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছিল ঠিক সেসময় আদনানের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। মিতা ওয়ারড্রবের ওপর থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল রাশিয়া থেকে কেউ কল করেছে।

মিতা কল রিসিভ করতেই স্তব্ধ হয়ে গেছে….

চলবে….