দ্বিতীয়জন পর্ব-৫+৬

0
13

#দ্বিতীয়জন [৫]
#Tahmina_Akhter

মিতা কল করতেই স্তব্ধ হয়ে যায়! কারণ ওপর পাশ থেকে ভেসে আসে এক নারী কন্ঠ। নিজেকে সামলে ফেলল মিতা। গলার কাছে একদলা দুঃখ এসে জমা হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

–আপনি কে বলছেন?

মিতা প্রশ্ন করল। মিতার কথা শুনে মোবাইলের ওপর পাশে থাকা নারী স্তম্ভিত হয়ে যায়। নিজেকে খানিকটা তটস্থ করে বলল,

— এটা কি আদনানের নাম্বার না?

— জি। এটা আদনানের নাম্বার।

— আপনি কি হোন আদনানের?

অচেনা সেই নারীর প্রশ্ন শুনে মিতা বলল,,

— আমি আদনানের স্ত্রী।

ব্যস, ফোনটা কেটে যায়। সন্দেহ জাগে মিতার মনে। আদনানকে সেই নারীই বা কেন খুঁজছে? আর মিতা সে নিজেকে আদনানের স্ত্রী পরিচয় দেবার পর কেন কলটা কেটে দিলো? সদূর রাশিয়া থেকে কেউ কল করছে আদনানকে কিন্তু কেন? হয়ত কাছের কেউ?

মিতা কিছুক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইল। পর্দায় ভেসে থাকা “কল এন্ডেড” লেখা যেন হঠাৎ করেই পুরো পৃথিবী থামিয়ে দিল। বুকের ভেতর কেমন অস্থির লাগে তার। কে ছিল ওই নারী? আদনানকে কেন খুঁজছে? আর এমন গম্ভীর হয়ে ফোন কেটে দিল কেন?

মিতা ধীরে ধীরে বিছানায় বসে পড়ে। ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে, যেন আদনানের স্পর্শ পেতে চায়। চোখ বেয়ে নেমে আসে কয়েকফোঁটা কান্না।

“আল্লাহ, ও যদি কিছু লুকিয়ে থাকে? না না, আদনান তো এমন না। আমার আদনান এমন না”

তবুও অজানা সেই ভয়, সন্দেহ মিতাকে গ্রাস করে। কিন্তু তার ভেতরের আরেকটা কণ্ঠ বলে ওঠে,

“তুই ওর স্ত্রী। ওর পাশে দাঁড়ানোর জন্য তোদের বিয়ে নামক সম্পর্কের নামই যথেষ্ট । ভয় পেয়ে পিছু হটলে চলবে?”

********

বিকেল নাগাদ হসপিটালে পৌঁছে যায় মিতা। কেবিনের ভেতর প্রবেশ করতেই আদনানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেলো। ধীরে ধীরে আদনানের বেডের সামনে এগিয়ে যায়। বেডের পাশে রাখা টুলে বসল মিতা। আদনানের বামহাতের ওপর হাত রাখতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় মিতা। অভিমান, অনুযোগ মিতার মনে জেগে উঠল।

আদনানের হাত ছুঁতে গিয়েও থমকে যায় মিতা। চোখের কোলে কান্না জমে ওঠে, কিন্তু সে কাঁদে না। শুধু নীরবে বসে থাকে। কেবিনে তখন নিঃশব্দ রাজত্ব করছে। দূর থেকে কেবল ইসিজির টিক টিক শব্দ।

মিতা নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে,

— আপনার কাছে কি আমার চেয়ে কেউ বেশি কাছের মানুষ আছে? যার কথা আপনি কখনো প্রকাশ্যে আনেননি? আপনি ঘুমাচ্ছেন, জানি। কিন্তু আমার এসব প্রশ্ন ঘুমায় না আদনান ভাই। বুকের ভেতর তোলপাড় করে যায়।

সে একটানা তাকিয়ে থাকে আদনানের মুখের দিকে। ক্লান্ত মুখটা, কপালের নীচে হালকা ব্যান্ডেজ, ঠোঁটে কষ্টে চেপে রাখা একটা রেখা। মিতার অভিমান একটু নরম হয়। সে ধীরে ধীরে আদনানের হাতের পিঠে আঙুল ছোঁয়ায়, এবার আর সরিয়ে নেয় না।

— জেগে উঠলেই বলবেন, আপনি কিছু লুকিয়ে রেখেছেন কিনা।

তারপর মাথাটা ধীরে ধীরে আদনানের হাতের পাশে নামিয়ে রাখে। চোখ বুজে ফেলে। আজ যেন সে ঘুমিয়ে থাকতে চায় আদনানের পাশে, অভিমান নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে।

আঙুল মিতার চুলে ধীরে ধীরে বিলি কেটে দিচ্ছে। তার স্পর্শে মিতার চোখ ভরে ওঠে জলেযা, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখে। ধীরে ধীরে মাথা তোলে, চোখ মেলে তাকায় আদনানের চোখে। আদনান একটুকরো হাসি দিয়ে বলে,

— তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি তাই না মিতা? ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?

মিতা কিছু বলে না। চোখের পাতার ফাঁকে জমে থাকা জল গোপনে মুছে ফেলে। মনে মনে বলে,

— আপনার জন্য করা কোনো কাজেই আমার ক্লান্তি আসে না আদনান ভাই। কিন্তু, সেই নারীকন্ঠ শোনার পর থেকে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মানসিকভাবে। সেই ক্লান্তি আপনাকে দেখাতে চাই না, বোঝাতে চাই না।কিন্তু আপনি যদি না বোঝেন, তাহলে কি কে বুঝবে আদনান ভাই?

আদনান হয়ত কিছু আঁচ করতে পারে। সে মিতার কপালে একটা নরম চুমু দিয়ে বলে,

— তোমার চোখ এত কথা বলে মিতা! অথচ মুখটা দেখলে বোঝা যায় না । কি হয়েছে সব বলো আমাকে? কারণ আমি জানতে চাই, বুঝতে চাই, অনুভব করতে চাই তোমার হৃদয়ে চলা সকল কথা।

— কল এসেছিল আপনার মোবাইলে। একটা মেয়ে কল করেছিল।

মিতার গলা কেঁপে ওঠে কথাটা বলতে গিয়ে। সে চোখ নামিয়ে রাখে, কিন্তু তার কণ্ঠের ভার আদনানের কাছে লুকিয়ে থাকে না।

আদনান মৃদু হাসে। কিন্তু সেই হাসিতে শব্দ নেই, শুধুই একরাশ মায়া আর ভালোবাসার ছাপ। যেন নিজের বউয়ের ঈর্ষা আর কষ্টে তার অদ্ভুত ভালো লাগা হচ্ছে।

— এই যে পাগলি, আমি তোমার সামনে শুয়ে আছি, অথচ তুমি কান্না করছো একটা ফোনকলের জন্য?

মিতা কিছু বলে না। চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। সে চুপচাপ বসে থাকে।

আদনান তার কণ্ঠে একটুকরো কোমলতা এনে বলে,

— ওটা হয়ত রিমি ছিল? আমার কলিগ। কলকাতার মেয়ে। বিবাহিত। দুটো বাচ্চার মা।

মিতা ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায় আদনানের দিকে। বাকি কথা বলতে মন চাইল না। যদি আদনান ওকে হিংসুটে মেয়ে মনে করে। এবার মিতার চোখে শুধু অভিমান নয়, একরাশ অপরাধবোধও খেলে যায়।

— আমি না বুঝে ভুল করলাম, না?

— ভুল না। ভালোবাসলে ভয় পাওয়াটা ভুল না। তবে আমি চিরকাল তোমার ভয় দূর করার দায়িত্বটা নিয়ে ফেলেছি মিতা। তাই তুমি ভয় পেলে আমি আছি তোমার ভয় মন থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য।

মিতা লজ্জিত হয়। ভাবছে সে মানুষটাকে শুধু শুধু সন্দেহ করছিল। আদনান মিতাকে বলল,

— আমাকে হারানোর ভয় তোমার মনে তৈরি হয়ে গেছে মিতা। আমি যদি এখন মরেও যাই আমার মনে তোমাকে না পাওয়ার আক্ষেপ থাকবে না। কারণ, আমি জানি আমার মিতা এখন সম্পূর্ণভাবেই আমার। মিতার মন এবং মস্তিষ্কের নিউরনে আদনানের স্মৃতি কুট কুট করে ঘুরে বেড়াবে।

মিতা চুপ করে আদনানের কথাগুলো শুনছিল । মানুষটা এত চমৎকারভাবে কথা বলে যে কেবল শুনতে ইচ্ছে করে তার কথা।

একটি চমৎকার মূহুর্ত কাটাচ্ছিল দুজন এমনসময় আদনান হঠাৎ করে একটু অস্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে শুরু । প্রথমে মিতা ভেবেছিল হয়তো ক্লান্তির কারণেই এমন হচ্ছে। কিন্তু মুহূর্ত পেরোতে না পেরোতেই আদনান বুক চেপে ধরল। চোখ-মুখ কুঁচকে উঠল ব্যথায়।

— কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? আদনান , প্লিজ বলুন!

আতঙ্কে কাঁপছিল মিতার কণ্ঠ। সে উঠে দাঁড়ায়, আদনানের পাশে গিয়ে তার বুকের হাত চেপে ধরে অনুভব করার চেষ্টা করে কিছু।

আদনান দম নিতে কষ্ট পাচ্ছে। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে। ঠোঁট কাঁপছে।

— মি…তা…

শুধু এইটুকু উচ্চারণ করে জ্ঞান হারায় আদনান।

— আদনান ! আদনান ! প্লিজ! চোখ খুলুন! কেউ আছে? নার্স! ডাক্তার!

মিতার আর্তচিৎকারে হসপিটালের করিডোর কেঁপে ওঠে। নার্সরা দৌড়ে আসে, চিকিৎসককে খবর দেয়া হয়।

হুট করেই আদনান ছটফট করতে শুরু করে। চোখে মুখে তীব্র যন্ত্রণা। বুকের মাঝখানটা চেপে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করে—কিন্তু পারছে না। ঘাম আর কষ্টে কুঁকড়ে যাচ্ছে ওর পুরো শরীর।

— মিতা… মি…তা…

শুধু এইটুকু উচ্চারণ করেই হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে আদনান।

— আদনান ! আদনান ! আপনার কি হয়েছে ! কেউ আছেন? ডাক্তার! কেউ আসুন!

মিতা আর্তনাদ করতে করতে কেবিন থেকে বের হয়ে ছুটে গেল করিডোরে। নার্স আর চিকিৎসকেরা দৌড়ে এল।

চেকআপ করেই একজন নার্স চিৎকার করে উঠল,

— কার্ডিয়াক এরেস্ট!

তৎক্ষণাৎ CPR শুরু করা হলো। একজন নার্স অস্থির হাতে ডিফিব্রিলেটর প্রস্তুত করে। ডাক্তার হানিফ এসে পৌঁছালেন দৌড়ে।

— স্ট্যান্ড ব্যাক! চার্জিং, ক্লিয়ার!

একবার, দুইবার; সময় থেমে গেছে যেন।

মিতা ভেতরে ভেঙে পড়ছে, বাইরে দাঁড়িয়ে ঠায় কাঁদছে। শুধু প্রার্থনা,

—আল্লাহ, আমার আদনানকে ফিরিয়ে দিন।

ডাক্তার হানিফ আদনানের বুকের মাঝখানে হাত রেখে চেপে ধরতে থাকে। বুকে চাপ, এক… দুই… তিন… চার… ধীরে ধীরে দ্রুততা বাড়ছে। আরেকজন নার্স অক্সিজেন মাস্ক ঠিক করে দিচ্ছে। অন্য কেউ ইনজেকশন প্রস্তুত করছে।

মিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে, ঠোঁট কাঁপছে, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, শুধু কেবিনের কাঁচের দরজার ওদিকে হাহাকার শুনতে পাচ্ছে।

— Come on! Don’t give up on men ! Push harder!

ডাক্তাররা যেন শেষ চেষ্টা করছে প্রিয় রোগীটাকে ফিরিয়ে আনার। একবার… দুইবার… তিনবার শক দেওয়া হলো। মনিটরে হৃদস্পন্দনের রেখা কেবল সোজা এক দাগে রূপ নেয়।

— Time of death: 4:37 PM.

সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালের সেই কেবিনে হঠাৎ এক নিস্তব্ধতা নামে। মৃত্যুর নিস্তব্ধতা।

মিতার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। তার বুকের ভেতর থেকে যেন একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে। হৃদয় ছিন্নভিন্ন করা কান্না।

তার স্বামী, তার ভালোবাসা, তার স্বপ্ন। সবকিছু যেন ওর সামনে নিথর হয়ে পড়ে আছে।

হাসপাতালের করিডোরজুড়ে এখন শুধু নিস্তব্ধতা। ডাক্তারের “টাইম অফ ডেথ” ঘোষণার পর থেকেই মিতা কিছু শুনতে পাচ্ছে না, বুঝতেও পারছে না। যেন শব্দহীন এক জগতে আটকে গেছে সে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।

হাসপাতালের কড়িডের দাঁড়িয়ে আছেন রহিম সাহেব। মুখ থমথমে, চোখদুটো লাল, ভেতরটা যেন খালি হয়ে গেছে। তাঁর সামনে দাড়িঁয়ে আছেন ডাঃ হানিফ মাহমুদ।আদনানের চিকিৎসার মূল দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

ডাঃ হানিফ নরম গলায় বললেন,

— আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, রহিম সাহেব। আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু আদনানের মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে।

রহিম সাহেব নিঃশব্দে চেয়ারের হাতল চেপে ধরলেন। তাঁর ঠোঁট কাঁপছে। গলার স্বর ভারি হয়ে আসে।

— ডাক্তার সাহেব! একটা সুস্থ, হেসে খেলে বেড়ানো ছেলেকে আমি এই অবস্থায় দেখব, এটা কোনোদিন ভাবিনি। ওর তো সামনে অনেক কিছু ছিল।একটা নতুন জীবন শুরু করছিল।

ডাঃ হানিফ এক নিঃশ্বাসে বললেন,

— এক্সিডেন্টের সময় মাথায় যেটা চোট লেগেছিল, সেটা প্রথমে তেমন গুরুতর মনে হয়নি। কিন্তু আমরা পরে রিপোর্টে জানতে পারি, সেটি ব্রেইনে চাপ সৃষ্টি করছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে হার্টে প্রভাব ফেলে। সেই চাপ থেকেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।

রহিম সাহেব মাথা নাড়িয়ে বলেন,

— না! আমার আদনান এমন করে চলে যাবে না। আল্লাহর কাছে কত দোয়া করেছি আমি।ওর জন্য সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। ও আমার চোখের আলো ছিল, আমার সমস্ত গর্ব।

তিনি কাঁপা গলায় আরও বললেন,

— আপনি বলছেন একটা ‘হার্ট অ্যাটাক’। এই একটা শব্দেই আমার পুরো পৃথিবীটা ভেঙে গেল। আমি তো ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম, ডাক্তার হানিফ।

ডাক্তার হানিফ নিরুপায় হয়ে শুধু বলেন,

— ওর মৃত্যুর খবর আপনাদের মতো আমাদের জন্যও কষ্টকর। আদনান ছিল অসাধারণ একজন মানুষ। এমন হৃদয়বান, বিনয়ী, এবং আশাবাদী মানুষ খুব কম দেখি।

রহিম সাহেব এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেন না। কেঁদে ফেলেন। বুকচেরা সেই কান্না যেন চারপাশের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে দেয়। তিনি বলতেই থাকেন,

— আমি ভাবিনি বিধাতা আমার বুক খালি করে দেবেন। ওকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব? কীভাবে আমি মিতার চোখে চোখ রাখব? সে তো এখন বিধবা।আমার ছেলের নববধূ, কয়েকদিনেই নিঃসঙ্গ!

ডাক্তার হানিফ পাশে এসে হাত রাখেন তাঁর কাঁধে।

— আপনি শক্ত হোন, রহিম সাহেব। মিতার এখন আপনাদের দরকার সবচেয়ে বেশি। আদনান আমাদের ছেড়ে গেছে ঠিক, কিন্তু ওর ভালোবাসা, ওর স্বপ্ন।এগুলো এখনও বেঁচে আছে।

মিতা রহমান সাহেব এবং ডাক্তারের কথাগুলো শুনছে তারপর ধীরে ধীরে কেবিনে ঢোকে। সেখানে নিথর পড়ে আছে আদনান।মিতার জীবন, মিতার ভালোবাসা, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ সব। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফেলে সে, তবু কান্না থামে না।

সে আদনানের বুকের কাছে গিয়ে বসে। হাত ধরে থাকে অনেকক্ষণ, হয়তো ভেবেছিল আদনান উঠে বসে বলবে, “পাগলি কান্না করিস না তো।” কিন্তু আদনান আর কোনোদিনও কথা বলবে না, হাসবে না, দুষ্টুমি করবে না।

মিতা ফিসফিস করে বলে,

— আপনি তো বলেছিলেন, আমাকে ছেড়ে যাবেন না। বলেছিলেন, আর কোথাও যেতে হবে না আমাকে ছেড়ে। তাহলে এই চলে যাওয়া কেন আদনান ?

তার গলা ভেঙে আসে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।

— আমি তো শুধু আপনার স্ত্রী ছিলাম না আদনান , আমি তো আপনার বন্ধু ছিলাম, আপনার জীবনসঙ্গী। আপনি একা চলে গেলেন? আমার কথা একবারও ভাবলেন না?

ওর কান্নার শব্দে কেবিন ভরে যায়, তবুও কারো কিছু বলার থাকে না। আজ মিতার ভাগ্যে লেখা হয়ে যাচ্ছে এক অপূর্ণ প্রেমের শেষ অধ্যায়।

চলবে….

#দ্বিতীয়জন [৬]
#Tahmina_Akhter

আদনানের দাফন শেষ হয়ে গেছে। গ্রামের ছোট কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয় আদনানের মৃত্যুর পরদিন দুপুরের পরপরই। বিকালে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সবাই নিশ্চুপ। কেবল কান্নার আওয়াজ আর ভেতরে জমে থাকা হাহাকার গুমরে গুমরে উঠে আসে।

আদনানের মা ছেলের কবরে মাটি পড়ার প্রতিটা শব্দ মনে করতেই তার মনে হচ্ছে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখের জল নয়, যেন হৃদয়ের রক্ত ঝরছে। মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিনি বলতে লাগলেন,,

–তুই বলেছিলি মা, মিতাকে ছাড়া দমবন্ধ লাগে মা। ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে আসব, বলেছিলি! এখন আমাকে রেখে কোথায় চলে গেলি রে আদনান?

অদিতি ভাইয়ের জানাজায় একফোঁটা চোখের জলও ঠিকভাবে ফেলতে পারছিল না, গলায় দলা বাঁধা কান্না জমে ছিল । সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ভাইয়ের কবরের দিকে, মুখ দিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ভাইয়ের শেষ কণ্ঠধ্বনি, শেষ হাসি, শেষ আদর সব এখন অতীত।

রহিম সাহেব একজন পিতা যখন সন্তানের জানাজায় ইমাম সাহেবের পেছনে দাঁড়ান, তখন তার বুকের ভিতর কতটা ফাঁকা হয়ে যায় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

–আমি তোকে বিয়ে দিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম তোর সংসার যেন ফুলের বাগানের ন্যায় চোখ জুড়ানো হয়। দেখতে পারলাম না তো বাবা!

রহিম সাহেব এই একটাই কথা অস্ফুট সুরে বলছিলেন বারবার।

মিতার মা মেয়ে জামাইকে হারিয়েছে। নিজের মেয়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারছেন না। হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটা এখন কবরের মাটিতে শুয়ে আছে। মিতা তার একমাত্র মেয়ে এত বড় শোক বুকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবে? এই ভেবে থম মেরে গেছেন তিনি।

আর মিতা?

সবাই শোক করলেও মিতার শোক ছিল নিঃশব্দ, ভয়াবহ রকমের নিঃসঙ্গ। এক জায়গায় বসে থাকতে পারছিল না সে। তার মাথার চুল খুলে গেছে, চোখের নিচে কালি, ঠোঁট ফাটতে বসেছে। কিছু খাচ্ছে না, কিছু বলছে না, কেবল মাঝে মাঝে বলে উঠছে,

—আমি আর আপনাকে কখনো সন্দেহ করব না বলেছিলাম, তাই না? দেখুন, আমি এখন প্রতিটা নিঃশ্বাসে আপনাকে খুঁজছি সন্দেহ করার জন্য নয়, আপনাকে ফিরে পাওয়ার জন্য আদনান। একবার ফিরে আসুন না আপনি!

মিতা কখনো গিয়ে বসছে আদনানের ব্যবহৃত চেয়ারটায়, কখনো তাকায় সেই পোশাকের দিকে যা আদনান তার জন্য কিনেছিল। প্রতিটা ঘর, প্রতিটা আসবাব যেন আদনানের কথা বলছে।

রাত হলেই ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে মিতা। মনে মনে বলে উঠে,

—আপনি বলেছিলেন, আর কয়েকটা দিন। তারপর এক ছাদের নিচে থাকব।

আজও মিতা ছাঁদের নিচেই আছে, কিন্তু আদনান নেই। নেই সেই ভালোবাসার চাদর।

*******

পনেরো দিন পর।

আদনানের ল্যাপটপে মেইল আসে। ইউনিভার্সিটি থেকে মিতার নামে মেইল এসেছে। অদিতি অনলাইনে চেক করে দেখতে পায় মিতা এবং আদনানের রাশিয়ায় যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। অদিতির চোখ ভিজে আসে ভাইয়ের নামটা স্ক্রীণে দেখে। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,

— প্রকৃতির কি নিয়ম বুঝতেই পারি না! ভাই আর ভাবি যখন দূরে ছিল তখন তাদের কত স্বপ্ন ছিল একদিন না একদিন তারা কাছে আসবে। আর যখন সত্যিই একদিন দূরত্ব মিটিয়ে তারা এক হতে চাইল তখন প্রকৃতি তাদের আলাদা করে ফেলল। প্রকৃতির রক্ষক মহান রব কি চায় সে তো কেবল মহান রবই জানেন!

অদিতির কণ্ঠে ছিল ভাই হারানো বোনের নিঃসঙ্গতা, হাহাকার। ল্যাপটপের স্ক্রিনে আদনানের জিমেইল আইডির ছবি এবং নামটা তখনো জ্বলজ্বল করছে। অদিতির চোখের পানি ল্যাপটপের কি-বোর্ডে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। মেইলের নিচে যুক্ত ছিল মিতার ভিসা, ফ্লাইটের সময়সূচি, এবং ক্লাসের প্রথম দিনের বিস্তারিত তথ্য।

অদিতি জানে, ভাইয়ের চলে যাওয়ার এই শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হবে না। কিন্তু ভাবির কি থেমে থাকা উচিত ? আদনান তো চাইত মিতা ডাক্তার হোক। একটা বড় পরিচয় হোক । রাশিয়ায় যাক। নিজের স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখুক।

অদিতি ল্যাপটপটা বন্ধ করল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল জানালার সামনে। বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,

—ভাইয়া, তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমার স্বপ্ন যেন পূর্ণ হয়। ভাবি যেন হাসতে শেখে আবার। তোমার স্বপ্নকে বুকে বেঁধে সে যেন আবার বাঁচে।

বাড়ির উঠোনে সন্ধ্যার হালকা আলো ছড়িয়ে আছে। বাতাসে বৈশাখের মিষ্টি ঘ্রাণ। মিতার মা চুপচাপ এক কোণে বসে আছেন, রহিম সাহেব নামাজ শেষে তসবিহ পড়ছেন। চারপাশে যেন একটা বোবা নিরবতা নেমে এসেছে, যে নিরবতা আদনানের শূন্যতায় আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে।

এমন সময় অদিতি ধীরে ধীরে এসে উঠোনে দাঁড়ায়। সবার দৃষ্টি তার দিকে ফিরতেই সে কাঁপা কণ্ঠে জানায়,

— ভাবির ফ্লাইট পরশুদিন।

চারপাশে যেন মুহূর্তেই শোকের বাতাস আরও ভারী হয়ে যায়। মিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার পাশে। এই ঘোষণায় তার হৃদয়ের মধ্যে একরাশ হাহাকার আবারো গর্জে ওঠে।

এই বাড়ি, এই উঠোন, এই মানুষগুলো সব কিছুর সঙ্গে মিশে আছে আদনানের অস্তিত্ব। এখন এখান থেকে চলে যাওয়ার মানে যেন নিজেকে আবারও শূন্য করে ফেলা।

মিতার মা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। অদিতি এসে মিতার পাশে দাঁড়ায়, ধরা গলায় বলে,

— ভাইয়ার স্বপ্ন কি তুমি পূরণ করবে না ভাবি? ।

মিতা অদিতির দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না। তার চোখের কোণে চিকচিক করছে না বলা অনেক কথা, আর আদনানের স্মৃতি।

কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে। বাতাস থমকে গেছে যেন। উঠোনে বসে থাকা সবাই নিঃশব্দ। এমন সময় আদনানের মা হঠাৎই ধসে পড়ার মতো করে বললেন,

— এই অলক্ষুণে মেয়েকে জলদি বের কর বাড়ি থেকে। নিজের বাবাকে খেয়েছে, আমার ছেলেটাকে খেয়েছে ! আর কাকে খাবে এই বাড়িতে থেকে।

মিতার দিকে আঙুল তুলে কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠলেন তিনি,

— তুই কালনাগিনী! তোর কপালেই অমঙ্গল! আমার ছেলেকে তুইই কেড়ে নিয়েছিস। তোর জন্যই আজ আমার বুক খালি!

মিতা যেন এক নিমিষে পাথর হয়ে গেল। চোখে পানি নেই, কিন্তু ভেতরটা ভেঙে পড়ছে। মা শব্দটা মুখে আসতে গিয়েও আটকে যায়। এই মুহূর্তে তার নিজের কানও বিশ্বাস করতে চায় না এই কথা আদনানের মা’র মুখে।

রহিম সাহেব কাঁপা কণ্ঠে বললেন,

— আদনানের মা! তুমি কি ভুলে গেছো হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে?

— না ভুলি নাই আদনানের আব্বা। কিন্তু মনটার কি কইয়া বুঝ দেই। আমার আদনান কই গেলো? কই গেলি রে আমার বাবা?

আদনানের মা যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। উনার কান্নায় উঠোনে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষের চোখ ভিজে উঠে।

মিতা চোখের পানি মুছল তারপর মাথা নিচু করে চলে যেতে পা বাড়ায় । পায়ের শব্দ যেন একেকটা কান্নার ঢেউ। বুকের ভিতর জমে থাকা শত অভিমান, বেদনা আর অপমানে সে নিঃশব্দে উচ্চারণ করল,

— বড়ো আব্বু গাড়ির ব্যবস্থা করুন। সময় খুবই কম। আদনানের স্বপ্ন অপূর্ণ রাখা যাবে না।

রহিম সাহেব উঠোনের এক কোণে বসে আছেন । মিতার চোখে জলের রেখা, মুখে জমে থাকা শব্দহীন হাহাকার আর মাথা নিচু করে চলে যাওয়ার দৃশ্য। এই সবকিছু তার বুকের ভিতরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

তিনি ধীরে ধীরে উঠে এসে তাকালেন মিতার চলে যাওয়া পথের দিকে। খুব নিচু গলায় যেন নিজেকেই বললেন,

— এই মেয়েটা ভেঙে পড়েনি, মাটি হয়ে যায়নি। ওর চোখে আমি আগুন দেখেছি, না পোড়ানোর আগুন নয় বরং জ্বলে ওঠার আগুন।

তিনি ফিসফিসিয়ে বললেন, যেন আদনান শুনছে,,

— তোর বউটা খুব সাহসী রে বাবা। তুই নেই, কিন্তু ও আছে। ও-ই তোর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখবে। ও-ই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

রাশিয়া স্থানীয় সময় দুপুর দুটো…

মস্কোর আকাশ যেন আজ হিমশীতল নয়, বরং এক অদ্ভুত ভার নিয়ে নেমে এসেছে মিতার মাথার ওপর। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই কনকনে ঠান্ডার হাওয়া মিতার গালে এসে ছুঁয়ে গেল;যেন আদনানের শেষ ছোঁয়া, শেষ বিদায়।

সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। পরনে হালকা রঙের কোট, হাতে এক গুচ্ছ টিউলিপ ফুল। মিতাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল, মুখে একরাশ মৃদু হাসি।

— আপনি নিশ্চয়ই মিতা আপু? আমি সায়মা। আদনান ভাই অনেকবার আপনার কথা বলেছিলেন।

মিতা কিছু বলতে পারল না। শুধু চোখে জল এসে গেল। কিন্তু চোখ মুছে ফেলল সঙ্গে সঙ্গেই। অপরিচিত কারো সামনে ভেঙে পড়লে নিজেকে ছোট মনে হয়। এটাই হয়ত বহুদিনের অভ্যাস।

সায়মা ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল,

— স্বাগতম। আমি জানি আপনার এখন কেমন লাগছে। আমরা এক ফ্ল্যাটেই থাকব, আপু। যদিও আদনান ভাইয়ের প্ল্যান ছিল একদম আলাদা।

এই কথার পরেই মিতার বুকের গভীরে যেন কাঁটার মতো বিঁধে গেল কিছু। কিছু বলল না সে, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর চুপচাপ সায়মার পেছনে হাঁটা দিল।

নতুন ঠিকানার পথে, নতুন এক জীবনের দিকে। যেখানে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোণা জুড়ে এখনও আদনানের ছোঁয়া লেগে আছে।
বাসার দরজায় পৌঁছেই মিতার বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। সায়মা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলো। ভেতরে পা দিতেই মিতা থমকে দাঁড়ায়। মনে হলো কেউ যেন ওর শ্বাসচাপা দিয়ে ধরেছে। চারদিকটা চেনা চেনা লাগছে। অথচ ও কখনও এখানে আসেনি।

ঘরের দেয়ালে ঝুলছে ওর প্রিয় রঙের পর্দা। সোফার পাশে রাখা ছোট্ট একটা বইয়ের তাক।সেখানে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা আছে বাংলা সাহিত্যের কিছু জনপ্রিয় উপন্যাস। ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা আছে নীল-সাদা ফুলের টেবিলম্যাট। যা একবার কথার ফাঁকে আদনানকে বলেছিল পছন্দ তার।

ঘরের এক কোণায় ছোট্ট একটা শেলফে রাখা ফটোফ্রেমে রয়েছে মিতার একটা একক ছবি, ঠিক সেই ছবিটা যা সে একদিন আদনানকে পাঠিয়েছিল, মজার ছলে। আর পাশেই, হাতে পেন ধরা আদনানের ছবি। যেন ওদের দুজনের গল্পটা এখানেও লেখা হচ্ছিল,নীরবে, নিভৃতে।

মিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখে জল জমে, ঠোঁটের কোণে হালকা এক কাঁপন। কণ্ঠে ফিসফিসে স্বরে বলে ওঠে,

— তুমি আমার জন্য এত কিছু ভেবে রেখেছিলে আদনান? সত্যিই যদি তোমার হাত ধরে এখানে আসতে পারতাম?

সায়মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল পেছনে। সে জানে এখন এই মেয়েটির পাশে কেউ থাকতে পারবে না, আদনানের স্মৃতি ছাড়া।

মিতা ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করে। যেন আদনানের হাত ধরে হাঁটছে, সেই প্রতীক্ষিত ‘নীড়ে’, যেখানে স্বপ্ন আর ভালোবাসা মিশে ছিল পরিপূর্ণতায়। কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষটাই আজ নেই।

তবুও, মিতা জানে এই ঘর, এই সাজানো কোণাগুলো, সবখানে আদনানের অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। আদনানের শেষ চাওয়া ছিল মিতা যেন স্বপ্নকে আঁকড়ে বাঁচে। মিতা চোখ মুছে চুপচাপ জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালা দিয়ে বাইরের বরফ ঢাকা শহরটা যেন বলছে

—নতুন করে শুরু করো মিতা। তুমি একা নও।

———————

ঘুমের ঘোরে মিতার মনে হলো ঘরে চোর এসেছে। হুট করে মিতা ঘুম থেকে জেগে উঠল। অন্ধকার হাতরে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে। মিতা সাহস করে একটা ফুলদানি হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। তারপর, ঠাসস করে মেরে বসল চোরের কপালে। চোর বেচারা আহ্‌ করে উঠল। সায়মা দৌড়ে আসল। এসেই আগে রান্নাঘর লাইট অন করল। এবং যা দেখল তাতেই ওর চক্ষু চড়াকগাছ।

আব্রাহামের কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। মিতার হাতে ফুলদানি। যা বোঝার বুঝে ফেলল সায়মা।

সায়মা দৌড়ে গিয়ে আব্রাহামের মাথায় হাত রাখল,

— আল্লাহ! রক্ত বের হচ্ছে! কী করেছো মিতা!

মিতা তখনো ধমকে বলল,

— এই লোকটা কে? রাতে রান্নাঘরে কী করছিলো?

আব্রাহাম ব্যথায় কপাল চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

— চা বানাচ্ছিলাম। ঘুম আসছিল না।

সায়মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

— ও আমাদের সাবলেটের অন্য রুমমেট। আমাদের মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট। হোস্টেলে জায়গা না পাওয়ায় এখানে থাকছে কিছুদিন।

মিতার মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। মুখে হাত চাপা দিয়ে পেছনে সরে গেল দু’পা।

— আমি তো ; আমি ভেবেছিলাম?

আব্রাহাম ঠোঁটে হালকা হাসি এনে বলল,

— আপনি মনে হয় খুব সাহসী মানুষ। ফুলদানি দিয়ে মাথায় মারা সহজ কাজ না।

মিতা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।

সায়মা এবার একটু হাসতে চেষ্টা করল,

— ভালোই হলো, পরিচয়টা বেশ রোমাঞ্চকরভাবে হয়ে গেল।

আব্রাহাম ব্যথা ভুলে মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

— কেউ গজ, তুলা আর ব্যান্ডেজ এনে দেবে?

মিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আব্রাহামের দিকে। পরিস্থিতির অবস্থা বুঝতে পেরে অগত্যা সায়মা চলে যায় ফার্স্ট এইডের বক্স আনতে।

চলবে…